সবুজ ডাকবাক্স। গায়ে লেখা ২৮৫৬। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট ড্রাইভ। পথের ধারে অচেনা বৃক্ষরাজির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আকাশপাতাল ভাবতে থাকি। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, ক্যা–৯৫৩৪০, যেখানে চিঠিতে-কার্ডে সপ্তাহে দুটো করে ধরলেও গত এক বছরে শুধু নন্দিনের জন্যে শতাধিক চিঠি এসে পড়েছে এই বাক্সে। আর, এইভাবে তরুণ সুদর্শন সাহেব পোস্টম্যান গাড়ি চেপে এসে ড্রাইভারের সিটে বসে সযত্নে চিঠিগুলি একে একে রেখে হাতল তুলে দিয়ে গেছে। বাড়ি থাকলে, নন্দিন এসেছে ছুটতে ছুটতে। ওই সেই বাড়ি, হাজার হাজার মাইল দূরে যার অস্তিত্বের কথা আমি মুহূর্তের জন্যও কখনও অস্বীকার করতে পারিনি, যদিও তা ছিল কালপুরুষের পায়ের কাছে বশংবদ লুব্ধকের চেয়েও ঢের অবাস্তব, কেননা, লুব্ধককে তো চোখে দেখা যায়।
বিদেশ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখেছি কত-না। আশ্চর্য যে, প্রত্যেকটির পটভূমি ছিল আমেরিকা। রঞ্জন তো ইংল্যান্ডেও ছিল, কানাডার সাসকাচুয়ান আর এডমন্টনে ছিল ছমাস করে— কই, এদের কখনও দেখিনি তো স্বপ্নে! তা ছাড়া, ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ…এরাও রয়েছে। পৃথিবীর কোথায় যে রয়েছে, থেকে গেছে রিও-ডি-জেনেরো! হয়ত ব্রাজিলে। যেন মৃত্যুর মতো এরা সব। মানো বা না মাননা, মনে রাখো বা ভুলে যাও, যা তোমার খুশি। সে তুমি যেখানে থাক, যে চুলোয়, এরা আছে। দূরে… কিন্তু আছে। অপেক্ষা করছে। একদিন তুমি সেখানে যাবে বলে।
বস্তুত, বিদেশ শব্দটির মধ্যে একটা কাছে আয় ডাক আছেই। বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের অদম্য আকর্ষণের কথাই ভাবা যাক না কেন। সেই যে একবার রঞ্জন আমার জন্যে এনেছিল একটা পালকের মতো হালকা গ্যাস লাইটার— তখন এখানে লাইটার বলতে লম্ফ, কেরোসিনে জ্বলে যার বোতাম টিপলেই জ্বলে উঠত দপ করে আগুন এবং আগুন না নেভা পর্যন্ত বিখ্যাত সব সোনাটা থেকে রেকর্ড করা সাতটি সুরের একটা-না-একটা বেজে যেত। বেজেই চলত! একটির সুর নাকি ছিল মোৎসার্টের দ্য ম্যারেজ অফ ফিগারো থেকে?
তো, সেই কবে ১৯৭২ সালে রঞ্জন আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে স্বপ্নে আমি বহুবার আমেরিকা গেছি। কিন্তু সে তো এই মার্সেদ নয়, এই বাড়ি নয়, এই রাস্তা নয়। বরাবরই আমি এ-দেশে এসেছি বিনা পাসপোর্টে ও বিনা ভিসায়। আর, পালতোলা জেলে-ডিঙিতে। আর, সে অভিযাত্রায় প্রধান আকর্ষণ ছিল কী? না, ভয় পৌঁছনো কোনওমতে। কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়া। আর, পুলিসকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা। আর, রঞ্জনকে খোঁজা। যেজন্যে ডক এরিয়া থেকে খুব বেশি দূরে কখনও যেতে পারিনি। ধরা পড়ার ভয়ে।
ডাকবাক্সর ধারে দাঁড়িয়ে আমার স্পষ্ট মনে পড়ল, অন্তত একবার আমি রঞ্জনকে খুঁজে পাই। পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণতম বিন্দুর কোনও এক শহরে সেদিন ভোরবেলা সাইক্লোনের আবহাওয়া। ঝোড়ো হাওয়া আর উড়ন্ত বৃষ্টিকণার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি অবশেষে রঞ্জনকে খুঁজে পাই একটা হতদরিদ্র অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের ঝুলন্ত চারতলায়, মাটি থেকে যার তিনটি তলা গেছে। ভেঙে, এবং, রঞ্জনের তখনও তা জানা নেই! কী ভয়ঙ্কর! রঞ্জনের ঘরে ঢুকে দেখি, মেঝেয় পাতা অনেকগুলো বিছানা। কেউ নেই। রঞ্জন একা শতরঞ্চি-সহ নিজের বিছানা গোটাচ্ছে। আমাকে দেখে সে দারুণ রেগে গেল। আমার দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলে বলল, এই সাইক্লোন আসছে কাঁথির সাইক্লোন-আই থেকে! আমি লক্ষ্য করলাম, স্বপ্নের সেই দরিদ্র আমেরিকা, সেই বাস্তুহারা রঞ্জন, সেই ভিজে মৃত্যু-আবহাওয়া, আজকের ঝকঝকে দুপুরের তুলনায় আমার কাছে
অনেক বেশি সত্য হয়ে আছে।
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় দেখি একটি বিশাল পিক আপ ভ্যান হোয়াইট গেট থেকে এদিকে ৬০/৭০ মাইল বেগে ছুটে আসছে। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি সাইডওয়াকের ওপর উঠে দাঁড়াই। তারপর কী ভেবে আরও পিছিয়ে লনের ঘাসের ওপর গিয়ে দাঁড়াই।
গাড়ি না বলে দোতলা বাড়িই বলা উচিত। কলকাতার এল নাইনের মতন। হাব-ভাবে মনে হয়েছিল বেরিয়ে যাবে, তা না, গাড়িটা হঠাৎ আমার উল্টোদিকে সশব্দে দাঁড়াল। দেখলাম, সিঁড়ি নামিয়ে ড্রাইভারের কেবিন থেকে একজন লাল আমেরিকান নামছে। রাস্তার ওপার থেকে হাত তুলে সে যখন বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড আমি সত্যিই আঁতকে উঠেছিলাম।
এখানে ভয় পেতে পেতে আমি এতটুকু হয়ে গেছি। ভয় একটাই: রঞ্জন-সুমিতা আমাকে এভাবে উড়িয়ে এনেছে, সে কি আমাকে ধৃংস করবে বলে? কী ওদের ইচ্ছে? অপঘাতে মৃত প্রেতাত্মা, যার নাকি মাটির মায়া সহজে যায় না, আর এখনও তো শ্রাদ্ধও হয়নি…
আকাশ ভেঙে পড়ে না। তাই মাঝে মাঝে মাঠে গিয়ে বসি। তখন সাহস পাই। তখন ওদের শুনিয়ে মনে মনে বলি, আমি সব বাজি রেখে ২০ হাজার টাকা ধার রেখে এভাবে ছুটে এলাম, সবটাই কি আমার মেয়ের জন্যে? তোমাদের ছেলের জন্য নয়? তোমাদের ফিউনারালে থাকব বলে নয়? তোমাদের মৃত আত্মার সম্মানের জন্য নয়?
একটি প্রশ্নেরও আমি উত্তর পাই না।
লোকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে লাল শর্টস, গায়ের সাদা গেঞ্জির ওপর লেখা: ডু নট কাম ইন মাই ওয়ে!
সে আবার বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। মাই নেমে ইজ হ্যারি কেলার।
আমি কিলারই শুনলাম। এবং শুনে সাদা হয়ে গেল আমার মুখ। লোকটা তাও দেখল। বলল, কে ই এল এল ই আর। নট কিলার।
আমার বৌ কারা ডক্টর চ্যাটার্জির মেডিকেল সেন্টারে নার্স ছিল। হি ওয়জ আ ব্রেভ ম্যান। আ গ্রেট ডক্টর।