উন্মত্ত জাজের সঙ্গে ভাঙা-নৃত্যের রতিপটিয়সীদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে শেষের অক্ষরটি উল্টে দেয়। বিপুল হর্ষধৃনি। দেখা গেল সেখানে একটি N ছিল। বহুবর্ণ আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে তা থেকে।
আর-একজন সহাস্যে বলল: আই নিড আ T. দেখা গেল T-ও রয়েছে। চিৎকার। নাচ সমানে চলেছে।
ইলেকট্রনিক ঘড়িতে টিক-টক, টিক-টক… সময় ৩০ সেকেন্ড। কারও মোট তিনবার না মিললে সে মঞ্চ থেকে নেমে আসবে। অর্থাৎ, পয়সা হজম।
আই নিড আ F.
নোও?
এ-ভাবে আধঘণ্টার মধ্যে, বাঁ-দিকে ON E শেষের দিকে ROB–R এবং একেবারে শেষে TAN পর্যন্ত তৈরি হতে না হতেই, অসমাপ্ত শব্দের বাকি অক্ষরগুলো মনে মনে বসিয়ে এবং ৪২টি অক্ষর আঙুলে গুনে, উঠে দাঁড়িয়ে একজন গড়গড় করে বলে গেল
ONCE UPON A TIME THERE LIVED A ROBBER NAMED AL CAPITAN.এ-ভাবে, বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে, আল কাপিতান মুহূর্ত মধ্যে একজনকে রাজা ও নজনকে ফকির করে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে মিলিয়ে গেল।
পলকের জন্য দেখা গেল তার পাখি-পালকের উষ্ণীষ এবং উদ্যত বর্শা। তাকে এরা কেউ কখনও দেখতে পায়নি। পেল না।
১৩. হ্যারি, জেফ, মারিয়া ও লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল
৮ মে।
মারিয়া পৃথুলা, ছোটখাটো, দুধ-সাদা, ঘাডের বদলে গর্দান, মাথায় গোলাপিরুমাল, গায়ে সাদা অ্যাপ্রন। লাল পাতলা ঠোঁট। তাকে জিপসি-জিপসি দেখতে। মারিয়া নাকি ছাগল পোষে। ছোটবেলায় জীয়ন-অঞ্জন দুজনেই ওর ছাগলের দুধ খেয়েছে। রোজ সকালে একটা ফোর্ড গাড়িতে চেপে ছাগল আসত। সামনে দুয়ে দিত। এখন মারিয়া আসে ফিয়াটে। অঞ্জন ওকে এখনও গোট উওম্যান বলে।
আমি মারিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, এখন বুঝি বরফ পড়ে না।
এ-রকম আবহাওয়ায় না। মারিয়া বলল, তবে পরপর কয়েকদিন ধরে আকাশ খুব পরিষ্কার আর নীল থাকলে পড়তে পারে। আবহাওয়াও ড্রাই থাকা দরকার।
কিচেনের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি। বেলা ১০টা হবে। এখনও কুয়াশা কাটেনি। তবে শুকনো হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে। মাঠের উত্তর দিকের গমক্ষেতে একটা ট্রাক্টর কুয়াশার মধ্যে ফুটে রয়েছে। বহুদূরে, শুনেছি ৭০/৮০ মাইল দূরে, কুয়াশা ছাড়িয়ে কাপিনের চূড়া দেখা যায়। একটা হলুদ আলোর রশ্মি কোথা থেকে উঠে এসে পর্বতচূড়ায় লাগল। কিছুক্ষণ থাকল। তারপর রঙ বদল করতে করতে শেষ পর্যন্ত কালো হয়ে ভারি রহস্যময়ভাবে কুয়াশার মধ্যে ঢুকে গেল।
৮ মে।
শ্রাদ্ধ ১১ মে। কার্ড এসে গেছে। ওপরে আমি নিজের হাতে বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম। ছাপা হয়েছে। পোস্ট করার জন্য সমস্ত কার্ড জেফের অফিসে দিয়ে এলাম।
জেফ কোনিগ অনেক খবর দিল। ডক্টর চ্যাটার্জির অলিভ অ্যাভিনিউ-এর মেডিক্যাল সেন্টার সে বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি মেয়ে কাজ করত, ছাড়িয়ে দিয়েছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলোর কাছে ক্লেম-পিটিশন দেওয়া হয়েছে। চারজন উকিল চারটি কমপেনশেসন কেস করেছে। জন পার্লের নামে পুলিস সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের মামলা এনেছে। কাল কেস উঠবে।
এদিকে শ্রাদ্ধের আয়োজন সম্পূর্ণ, সে বলল। সানফ্রান্সিসকোয় দা হিমালয়া রেস্তোরাঁকে ১৫০টি ভারতীয় এবং ওলিয়েন্ডারকে ৫০টি বিদেশি লাঞ্চ লিভারমোর টেম্পলে পাঠাতে বলা হয়েছে।
৮ মে।
দুপুরবেলাটা বড় একা লাগে। গান-টান শুনি। টিভি দেখি। মাঠে গিয়ে বসে থাকি। মাঠের মাঝখানে গিয়ে বসলে সবচেয়ে নিরাপদ লাগে। মনে হয়, আর যাই হোক, আকাশ তো ভেঙে পড়বে না! ওদিককার ঘরগুলোয় যাইনা। লিভিং রুমেও যাই না। ওখানে একটা ছৌ-মুখোশ আছে। দুর্গার মুখ! তার গর্জন তেল মেশানো হলুদ পালিশ অন্ধকারে দেখা যায়। চোখ দুটো, আলো পড়লে ঠিকরায়। আমি নন্দিনের ঘর ছেড়ে কোথাও যাই না। টেলিফোন এ-ঘরে এনে রেখেছি।
আজ দুপুরবেলা নন্দিনের ঘরের পর্দা সরাতে প্রথমেই লেটার বক্সটি চোখে পড়ল। লন পেরিয়ে সাইডওয়াকের ধারে লোহার খুঁটির ওপর পোঁতা একটা কাঠের বাক্স। পোস্টম্যান এসে তার পাশে গাড়ি রাখছে। দেখলাম, ড্রাইভারের সিট থেকে না নেমে সে শুধু দরজা খুলেই বাক্সে চিঠি দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। আমি আজ দুটি চিঠি ওখানে রেখেছি। বাক্সর দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাল হাতলটা সে তুলে দিয়ে গেল। মানে, অন্তত একটি চিঠি এসেছে।
প্রথম দু-চারদিন কত চিঠি, বইপত্র আসত। কত দ্রুত কমে এল! গত দুদিনে তো কিছুই আসেনি। সবাই জেনে যাচ্ছে। আমি রোজ ছোটকাকার ডাকবাক্স থেকে চিঠি আনি। এটা আমার কাজ। ছোটকাকার অনেক চিঠি আসে। বইপত্র আসে। বেশ ভারি হয়। কিন্তু, তোমাদের একটি চিঠি থাকলে একটুও ভারি লাগে না। প্রথম দিকে নন্দিন লিখেছিল।
বাক্স খুলে দেখি, কল্যাণ লিখেছে। তার বক্তব্য: ফোনে আমি যা বলেছি, শুনে তার মনে হয়েছে, একজন বিশ্বাসযোগ্য লোকাল গার্জেন ঠিক করেনন্দিনকে এবং সম্ভব হলে, মাসখানেকের জন্যে হলেও, অঞ্জনকে নিয়ে আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসা উচিত। অঞ্জন আমেরিকাতেই পড়াশোনা করবে। তার শেকড় ওপড়াননা মোটেই উচিত হবে না। কোনও প্রলোভনেই তুমি যেন ওখানে থেকে যেও না বাক্যটির নিচে লাল কালি বুলিয়ে কল্যাণ আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। চিনু নন্দিনকে লিখেছে কান্না দিয়ে। ওরে, তোকে আর কিছু হতে হবে না। কিছু করতে হবে না। তুই আমার বুকে ফিরে আয়। ইত্যাদি।
দুপুরবেলা। শহরতলির এই দামি আবাসন-এলাকায় কেউ কোথাও নেই। কুকুর নেই এমন রাস্তা ভাবা যায়! কিন্তু, পথিক নেই, তবু পথ? এখানে শত শত মাইল ড্রাইভ করে গেলেও একজন পথিক চোখে পড়ে না। পথ এখানে পথে পড়ে থাকে।