সারা বাড়ি নীল ভেলভেট কার্পেটে মোড়া। মায় বাথরুমও। গতকাল দুপুরে কমোড থেকে উঠতে গিয়ে দুফোঁটা পেচ্ছাপ বাইরে পড়ে গেল। যদিও কমোডের চারদিকে আর এক প্রস্থ তোয়ালে পাতা আছে এমনতর দুর্ঘটনার কথা ভেবেই— তবু সেই মৃত্যুমুখর জনহীন বাড়ির টয়লেটে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল রঞ্জন টের পেয়েছে। আর সে যেন বলছে, ছিঃ, নদা! জানি, ব্যাপারটা পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। তবু ভয় পাবার দায় তো মনেরই, শরীরের নয়। আমি টয়লেট থেকে দ্রুত ছুটন্ত, উলঙ্গ বেরিয়ে এলাম। মন বলল, সেদিন তো বাথটাবের পর্দা টানতে ভুলে গিয়েছিলে বলে কার্পেট-টার্পেট ভিজে একসা, কই, সেদিন তো এমনটা শোনোনি। হা মনে পড়ে অনেক কথাই। কামপারাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে শেষের দিকে ফোন করলে কীরে, নদা, কবে আসছিস?ভাবখানা, নন্দিনের সঙ্গে টিকিট পাঠালাম, এলি না। কিন্তু, বাপু হে, এখন তো কান এখানে, মাথা আর কতদিন দূরে থাকবে? কবে টিকিট পাঠাব বল, কখন আসতে পারবি, আর হ্যাঁ, শোন ড্রাইভিংটা শিখে আয়। তোকে কামপারাটা দিয়ে দেব। —মনে পড়ে।
কিন্তু, আজ দুপুরে যা ঘটল, তাকে যেন শুনলাম কিছুতেই বলতে পারি না।
শ্রদ্ধ-ব্যাপারে সাক্ৰামেন্টোর অনাথানন্দজির সঙ্গে কথা বলছি।
হঠাৎ কোথা থেকে সেই ইন্টারন্যাশনাল কলের পি-পি-পি-পি-পি, পৃথিবীর তিনভাগ জলের ওপর দিয়ে উড়ে আসা সোঁ-সোঁ হাওয়া।
নারীকণ্ঠ: কেমন আছেন?
আমি: তুমি কে?
অনাথানন্দ: আমি স্বামী অনাথানন্দ।
আমি: আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
অনাথানন্দ: আমি খুব ভাল শুনতে পাচ্ছি। যদি তিল-কাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন, তাহলে—
নারীকণ্ঠ: আপনি ভাল আছেন আঁ? আর ইউ ও-কে?
আমি:আপনি কোনও মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছেন?
অনাথানন্দ : না তো।
আমি: তাহলে ক্রশ কানেকশান—
অনাথানন্দ: এখানে ক্রশ হয় না। হ্যাঁ, যদি তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন—
নারীকণ্ঠ: হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–
টেলিফোন হুকে টাঙিয়ে আমি ছুটে বেরিয়ে পড়লাম মাঠে। কেউ কোথাও নেই। সাইলেন্ট ফিল্মে যেমন, কী স্তব্ধ বৃষ্টিপাত হচ্ছে সারা মাঠ জুড়ে! মাঠের মধ্যে সাদা-ছোট বাদামি ঘোড়াটা ঢুকে পড়ল কী করে?
মুখ ঘাসে ডোবানো, মাঝে মাঝে ভিজে পরিতৃপ্ত ল্যাজ তুলে সে নিজের পেট, কোমর ও পিঠ আদর করছে। চিরস্তব্ধ, শব্দসুরহীন বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে তাকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে।
সব জল তুলে ফেলে আমোস সুইমিং পুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
ডীড ইউ সি সামথিং? সে সোজাসুজি জানতে চাইল।
শান্ত ঘাড় নেড়ে আমি জানালাম, না।
ডীড ইউ হিয়ার সামথিং?
আমি কী স্বীকার করব, আমি এইমাত্র ফোনে অবিকল সুমিতার গলা শুনেছি, যদিও তা ছিল ঈষৎ মৃত? না। না! আমাকে উইক ভাববে। পাছে লোকে উইক ভাবে, সে-জন্যে ঐটুকু ছেলে কী না করছে। মা পুড়িয়ে, বাবা পুড়িয়ে, ভাই পুড়িয়ে ছাই-মাখা মুখে সে যাচ্ছে নাইট-শোতে পর্নো দেখতে।
হেসে বললাম, ও নো। নাথিং। অ্যাবসোলিউটলি নাথিং।
ওকে। বলে সে পুলের গা ধুতে শুরু করল। নিচে, নীলাভ জল-তলানির মধ্যে স্বচ্ছ দেখা যায়। একটা মস্ত ইন্টারভেনাস ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ জলতলে পড়ে আছে। আমাদের কালবোস টাইপের একটা নিশ্চল মাছ সেটা শুঁকছে।
রবারের নয় তো, মাছটা?
৬ মে।
নন্দিন রোজ কলেজ যাচ্ছে। অঞ্জন যায় না। ও, একবারও কাঁদেনি। জেফ ফোনে বলছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। শ্রাদ্ধের পর দেখানো হবে ঠিক হয়েছে।
নন্দিনের কাছে জানতে চাইলাম, কীরে, তোর কী ইচ্ছে? সে খুব আগ্রহভরে বলল, আমি থাকব বাবা। পড়াশোনা শেষ করব। জেফ বলল, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ওর সোস্যাল সিকিউরিটি ইনসিওরেন্স করা আছে। সোস্যাল সিকিউরিটির কাজ হল, যদি কারও জীবনে ছন্দপতন হয়, সেই ছন্দে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া নন্দিনের নিউট্রিশনে মেজর হওয়া পর্যন্ত কাভার করা আছে। ও ততদিন কলেজ ক্যাম্পাসে থেকে পড়তে পারবে।
কলকাতা থেকে এসেছিলাম একটা নর্থ স্টার পরে। দেড় বছরে একবারও ব্রাশ করিনি। আমেরিকায় এসে কদিনেই জুতোটা ঝকঝকে হয়ে গেছে। এমন কি, সোলেও ময়লা নেই একটুও।
১২. দ্য গোল্ড রাশ
৭ মে।
এখানে সবই পার্সেন্টেজ। বা দালালি।
সারাদিনে চার-পাঁচটা টেলিফোন আসে শুধু উকিলদের কাছ থেকে। সকলে পরিচয় দিয়ে প্রথমেই বলে, নমস্কার। আপনার একটাও পয়সা লাগবে না। আমি লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল কোম্পানির বিরুদ্ধে ১০ মিলিয়ন ডলারের কেস করব। আমার কাছে খবর আছে, ওই ব্যাচের গাড়িগুলো ছিল ডিফেক্টিভ। এর গ্যাসোলিন ট্যাঙ্ক ছিল পিছন দিকে। টোকিওর এক অ্যাকসিডেন্টে ১০ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দেবার পর ওরা মডেল বদলায়। ট্যাঙ্ক সামনে আনে। কিন্তু আপনার ভাইকে কি ওরা সতর্ক করেছিল? ৫ মিলিয়ন আপনাদের। ৫ আমার। নমস্কার। আমি ক্যাম্ফ অ্যান্ড ক্লিভারের বিরুদ্ধে কেস করব। যারা জন পার্ল ফ্রি-ওয়ে ধরে গাড়ি ড্রাইভ করছে জেনেও তাকে অতটা মদ সার্ভ করেছিল। নমস্কার। আমি স্যাম পিয়ার্সনের বিরুদ্ধে কেস করব, যে ওর মতো হেবোকে তার গাড়ি দিয়েছিল। টু মিলিয়ন ডলার্স। ভেসে-ওঠা এইসব ইয়াঙ্কি ডুডলদের আমি জেফ-এর নাম্বার জানিয়ে দিই।
ডলার! ডলার! ডলার! টিভির সমস্ত অনুষ্ঠানে সুসজ্জিত লালমুখো বাঁদরের এই একটাই চিৎকার, আর ল্যাজ-আস্ফালন। এক কুৎসিত লোলচৰ্মা বুড়িকে নিয়ে বিখ্যাত ৩০ মিনিট-এ সারাক্ষণ দেখাল। কী? না, সে ১০ মিলিয়ন ডলার লটারিতে পেয়েছে! ১৬ নং চ্যানেলে একটি হিট প্রোগ্রামের নাম হল, হিয়ার কামস দা চাম্প! ফেক রেসলিং দেখায়। মনে হয় যেন সত্যি কুস্তি হচ্ছে, তা নয়। এরা রেফারির বাঁশি কেড়ে নেয়। পরস্পরকে শেষ পর্যন্ত চেয়ার, বেঞ্চি, খুঁটি যা পায় তাই তুলে মারে। ঘাড় মটকে ঘুরিয়ে দেয়। কটাং করে শব্দ হয়। বলা বাহুল্য, ঘাড়গুলো তখন রবারের,তবে বোঝা যায় না। কাল সন্ধেবেলা হল কী, একজন চারমণি রেসলার বাঁ-দিক থেকে ঢুকল। তার পরনে কাস্তে-হাতুড়ি-তারাসহ লাল পতাকা দিয়ে তৈরি ল্যাঙট। অর্থাৎ, সে রাশিয়া! ভাবলাম, ছিঃ, এরা এত ইতর। ওমা, পরমূহুর্তে ছিপছিপে আমেরিকান কুস্তিগীর স্টার্স অ্যান্ড স্টিপস্-সহ আমেরিকান পতাকার ল্যাঙট পরে মঞ্চে হাজির। বুঝলাম:আজকের বিষয় রাশিয়া ভার্সাস আমেরিকা। এই বর্বর ভাঁড়ামো কেন? উত্তর একটাহ: ফান! বস্তুত, পর্দায় সমবেত দর্শকরা হেসে হাঃ হাঃ। আজকের বিজেতা পুরস্কার পাবেন—-টিংটং–পর্দায় ভেসে ওঠে গাড়ি, উড়ন্ত এরোপ্লেন (ট্রিপ টু হনলুলু) ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যান্ড–এইট্টি থাউজান্ড ডালার!