অনুষ্ঠান ১০ মিনিটের। কিন্তু রীতিমাফিক করমর্দন চলল প্রায় একঘণ্টা ধরে। শোকার্থীদের অধিকাংশই সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে পাশাপাশি আমাদের দুজনের হাত পরপর ধরে প্রায় ফিসফিসিয়ে কিছু না-কিছু সন্তপ্ত মোনোসিলেবিল উচ্চারণ করে গেলেন। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম: শোক বলতে এরা বোঝে স্তব্ধতা। পিয়ানোর সুরে কিন্ডারগার্টেনের স্বর্গচ্যুতা পরীশিশুরা যে শোকগান গেয়ে চলেছে তাও যেন রাগিণী নীরবতায়।
লক্ষ্য করলাম শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অনেকেই যখন হাত-নাড়া দিয়ে অঞ্জনকে বললেন, হাউ একজ্যাক্টলি ইউ লুক লাইক ইওর আঙ্কল..অঞ্জন রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছে। বস্তুত, তার জুতো ঘষার শব্দ আমি দুএকবার শুনতে পেলাম।
মডেস্টো ক্রিমেশান হোমে পাশাপাশি তিনটি বিদ্যুৎ-চিতার মধ্যে তিনখণ্ড বিশাল পাঊরুটি, সেঁকা হবে বলে, কত ব্যঞ্জনাবিহীনভাবে ঢুকে গেল।
বাবা-মা-ভাই পুড়িয়ে, গায়ে মেখে চিতার ছাই, অঞ্জন সে-রাতে মুভি দেখতে গেল।
নইলে নাকি, বন্ধুরা ওকে উইক ভাববে!
হতভাগা!
আর, এই যদি হয় আমেরিকার নব-প্রজন্মের সবল ছেলেরা, তবে তারা গোল্লায় যাক।
১০. প্রসঙ্গ কমলালেবু
৫ মে।
সকালে উঠে দেখলাম এক বাক্স কমলালেবু থেকে একসঙ্গে ৪টি বা ৫টি লেবু নিয়ে অঞ্জন মাঠে লোফালুফি খেলা খেলছে। মাটিতে পড়ে একটু ঘেঁতো হয়ে যাচ্ছে যেগুলো, সেগুলো কখনও হাই-কিক, কখনও ব্যাক-ভলি করে দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে।
হেই, হোয়াট আর ডুয়িং? খেলা না থামিয়ে মুখ ঊর্ধ্বপানে রেখে সে ঠিক আমাকে নয়, উদাসীন চাপা গলায় ছোট্ট করে যেন নিজেকেই জবাব দিল, জাগলিং! আমাকে উত্তর দিলে তো আরও চেঁচিয়ে বলত।
উন্মাদ নয় তো ছেলেটা!
আমার মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগের কথা। তখনওর চার বছর বয়স হবে। ওরা দিনদুই আগে এসেছে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রেডিওটারনব ঘোরাতে যেতেই সেটা আলমারির পাল্লার মতো দুদিকে দুখণ্ডে খুলে গেল। খোঁজ! ছোট্ট ফ্ল্যাট আমাদের। এর মধ্যে কোথায় লুকোল ছেলেটা।
অঞ্জনকে পাওয়া গেল খাটের নিচে, এককোণে। লেজ গুটিয়ে যেন অপরাধী কুকুর ছানাটা!
আমি উবু হয়ে বসে জানতে চেয়েছিলাম, হেই, হোয়ায় ডিড ইউ ডু দ্যাট।
খাটের নিচের কোনায় আরও গুটিয়ে-সুটিয়ে বসে সে চিল্কার করেদুবার প্রত্যুত্তর দিয়েছিল।
বিকজ আই কুড ডু ইট!
বিকজ আই কুড ডু ইট!
তারপর বছরের পর বছর ধরে ঘটনাটা অফিসে, আড্ডায় যাকে পেয়েছি তাকে বলেছি।
প্রশ্ন: ভাঙলে কে?
উত্তর: কারণ, আমি বাংতে পারি।
ভাবা যায়!
চার বছরের আমেরিকা-বর্ন বাচ্চার মুখে এ-হেন ভ্যালু-জাজমেন্ট অফিসে, আড্ডায় যে যখন শুনেছে, সে-ই হা-হা, হো-হো, হিহি বা ঠোঁট মুচড়ে না হেসে পারেনি— যার যা। বিশেষত কবছর আগেই নকশালবাড়ি আন্দোলন হয়ে গেছে।
মাঠে পূর্ব-সীমানায় কাঠের সাদা বেড়ার ওপর কটি রঙিন চড়ুই বসে। বোধহয় লাভ বার্ড। এরা নাকি শবযাত্রার কফিনের ওপর বসতে ভালবাসে। এদের পছন্দ স্তব্ধতা। বা শোক। বেড়ার ওপারে ঈশ্বরের অ্যামন্ড ওয়ালনাট অরণ্য পেরিয়ে দূরে, বহুদূরে চতুর্ভুজ পিরামিডের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একখণ্ডের গ্রানাইট—– আল কাপিতান। এখন কাপিতানের মাথায় ঘন কালো মেঘ। নিশ্চয়ই খুব বৃষ্টি হচ্ছে ওখানে। এত সাদা, এমন ঝকঝকে তো কোনওদিন দেখিনি। সবুজ ছাঁটা ঘাসের মাঠ জুড়ে, ঘুরে ঘুরে এখন সাত-আটটা কমলা নিয়ে জাগলিং করছে অঞ্জন। খুলে-যাওয়া স্পিঙ্কলার থেকে সবেগে উঠে এসে তোড় জল-ফোয়ারা ওর আউট-সাইড, বিস্তৃত, উন্মুক্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়ছে। সে কথা ওর মনে নেই।
ওর মুখ আকাশের দিকে।
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু
আনমনে,
নিরজনে, প্রভু নিরজনে…