পরদিনই বেল-বোর্ডটি তুলে নেওয়া হয়। এ-সব অবশ্য হিরণরা আসার আগের কথা। এখন নিচে থেকে ডাকাডাকি করতে হয়, রাতবিরেতে কেউ এলে। নিচে নেমে গিয়ে গেট খুলে দিতে হয়। চিনু তাই নিচে নেমে গিয়েছিল।
ওরা ওপরে উঠে আসছে। প্রথমে লেদু, পরে চিনু। পাখিও নয়, কেননা পাখি তো তবু ডানা থেকে জল ঝাড়ে–বোঝা যায়, গাছের ফল কি একটা শস্যের দানা যে-ভাবে ভেজে, ভিজে যায়, সেইরকম অচেতন, নিপ, আত্মরক্ষাহীনভাবে লেদু কে জানে কঘণ্টা ধরে এমন একটানা ভিজেছে যে, এখন তাকে দেখে তার ফ্যাকাশে-নীল কোঁচকানো মনুষ্য-চামড়াটা হ্যাঙারে টাঙিয়ে দেওয়ার কথাই প্রথমত মনে পড়ে। শেষ কটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে সে দু-দুবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মানুষ নয়, তাকে দেখে হিরণের মনে হল, তাড়া খাওয়া জন্তুই এমন বোধবুদ্ধিহীনভাবে এগিয়ে আসে। যখন, সে এগচ্ছে না পিছচ্ছে, নাকি, সেই সর্বনাশাকেন্দ্রের দিকেই চলে যাচ্ছে যেখান থেকে তার পলায়ন, সে ব্যাপারে তার কোনও হুঁশ থাকে না। যখন শুধু ছোটা। আর হুমড়ি খেয়ে পড়া। নাজানি রাস্তায় আরও কতবার এ-ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে বেচারা! পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়িয়েছে।
এসো এসো, তোমরা ঘরে এসো, বলে তাদের আগেই ঢুকে পড়ে বসার ঘরের মেঝেয় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল লেদু। তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে একটি জলাসন তৈরি হতে থাকে।
হ্যাঁ, যে-কোনও সর্বনাশের কথাই সে এখন বলবে। এবং সে যা বলবে শোনামাত্র তা সত্য হয়ে যাবে ও তা মেনেও নিতে হবে। কারণ, ঠিক যা ঘটেছে, সে দাঁড় করাবে সেই অনস্বীকার্যের সামনে। তবে যাই ঘটে থাকুক, যাই বলুক সে, আসল কথা হল, সে-সর্বনাশের সঙ্গে সে বা চিনু সরাসরি কতখানি জড়িত। আর, তাদের দুজনের যে কিছু হয়নি এতো দেখাই যাচ্ছে। লেদুর পক্ষে এমন কথা জানাবার আর সম্ভাবনা নেই যে, ওগো কাকা, ওগো কাকিমা, তোমাদের দুজনের বা দুজনের একজনের এই সর্বনাশ হয়েছে। হ্যাঁ, সুযোগ সে পেয়েছিল বটে একবার। যখন হিরণের কাঁধের মস্ত টিউমারটির ব্যাপারে সে গিয়েছিল পার্ক সার্কাসে বায়োপসি-রিপোর্ট আনতে আর সে ফেরার আগেই হিরণ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল বাঁশদ্ৰোনিতে, ভাগ্নীর ওখানে। লেদু মোটরবাইক চালিয়ে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করে শেষমেশ চেতলা থেকে সেই যার নাম বাঁশদ্ৰোনিতে তাকে খুঁজে বের করে ও হাসতে-হাসতে এন-এ-এফ বা নাথিং অ্যাবনর্মাল ফাউন্ড রিপোর্টটি তার হাতে তুলে দেয়। ভগ্নদূত সেই একবারই চান্স পেয়েছিল যখন সে বলতে পারত, ওগো কাকা, তোমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। অমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। আর সে সুযোগ সে হারিয়েছে। চিরতরে।
অতএব, এ প্রলয়-পয়োধি রাতে এমন আর কী ঘটে থাকতে পারে যা তাকে আর চিনুকে জানাতে সে এ-ভাবে ছুটে এসেছে তা ভাবতে গিয়ে হিরণ কোথাও থই পেল না। তাই সে ধরে নিল, তাহলে এমন কিছু ঘটেছে যাতে লেদুই প্রত্যক্ষভাবে ইনভলভড়। সর্বনাশ হয়ে গেছে তারই।
বৌদি কেমন আছে? সে জানতে চাইল।
অর্থাৎ লেদুর মা।
ততক্ষণে একটা বড়সড় গামছা এনে লেদুর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে চিনু। গামছার ভেতর থেকে লেদু জানাল (তার মুণ্ডু দেখা যায় না) ন-কাকা, একটা টে-টেলিফোন এসেছে মার্সেদ থেকে। ওখানে একটা কিছু হয়েছে। মার্সেদ? সে তো ম্যাপে-নেই-তবু-আছে, ক্যালিফোর্নিয়ার এমন এক স্মল-টাউন— হাজার হাজার… প্রায় চার হাজার মাইল দূরে প্রশান্ত মহালমুদ্রের ধারে বোধ ও বুদ্ধির বাইরে শ্বেত জনবসতি এক—তার কাছে যা শুধু স্প্যানিশ শব্দ একটি, যা এসেছে মার্সি বা ক্ষমা থেকে, যা রঞ্জনের বৌ সুমিতা তাকে জানাল এই তো সেদিন, কমাস আগে, দীঘার ফরেস্ট বাংলোয় দোতলার বিমুগ্ধ বারান্দায় বসে।
চার মাসও পুরো হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে মার্সেদ থেকে এবার সুমিতা এসেছিল একাই, তার ছোটভাই রবির বিয়েতে। তারপর কদিনের জন্যে ওরা দীঘা গিয়েছিল। চিনু ছিল, লেদু আর তার বৌ শর্মি ছিল। সঙ্গে ছিল ওদের চার বছরের বিছুটা যে সুমিত্তার রিস্টওয়াচটা ওখানে বাংলোর ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল, নইলে পচে যাবে বলে। দুটো দিন, আহা কী মাতিয়েই রেখেছিল ছেলেটা। একতলার বাগান থেকে ছেলেটাকে দোতলায় সুমিতার কাছে পাঠানো হয়েছিল “সোনাদিদার কাছ থেকে, যাও, লাপিয়ের-এর সিটি অফ জয় বইটা চেয়ে আনো” এই বলে। ব্যাটা ঠিক ঠিক বলেছিল। এবং দুহাতে বুকে ধরে সিঁড়ি ভেঙে বইটা নিয়েও এসেছিল।
নন্দিন, বেশ ভাল আছেনদা, খুব অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। পড়াশোনা খুব ভাল করছে। বারবার জানাত সুমিতা। দশ-পনের মিনিট অন্তর নিজের থেকেই বলত বারবার। কেউ জানতে চাক বা না চাক।
একটা কিছু?
হিরণ এই প্রথম টের পেল দিকচিহ্নহীন জলরাশির ওপর সবে মাথা তুলেছে একটি চঞ্চল টেলিস্কোপ-চক্ষু, সমুদ্রের গভীরে একটি স্থির সাবমেরিন দাঁড়িয়ে আছে।
রঞ্জন, সুমিতা, তাদের দুই ছেলে জীয়ন আর অঞ্জন এবং…এবং…হ্যাঁ, তাদের একমাত্র সন্তান নন্দিন এদের কারও একজনের ভীষণ একটা কিছু হয়েছে। তবু, হয়ত, না নিশ্চয়ই এদের কারও মৃত্যু-সংবাদ লেদুর কাছে নেই। না, নন্দিনের তো নয়ই। ভাইনয়, ভ্রাতৃবধু নয়, ভ্রাতুস্পুত্র নয়, শুধু তাদের আত্মজার কথা ভেবে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম সে চিন্ময়ীকে খোঁজে ও তার মুখের ভাষা পড়তে তার মুখের দিকে তাকায়।
সে দেখল, লেদুর মাথা-মোছা থামিয়ে, গামছাটা বুকের কাছেদুহাতে দুমড়ে ধরে চিনু দাঁড়িয়ে। তার পিঠ দেওয়ালে।