যাওয়ার সময় ঝি মারিয়া অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কী ব্যাপার। অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি, এমন সময় সে বলল, আমার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে, স্ট্রেঞ্জ! ব্যাপার কী!
ইউ লুক একজ্যাক্তলি লাইক ইওর নেফিউ। ওনলি দিফারেন্স, হি ইজ মাচ মোর স্ত্রং। সে বলে গেল।
অর্থাৎ, অঞ্জন। আমি তা জানি। ছোটটাকে দেখতে হয়েছিল ওর বাপের মতো।
সকালে সেই যে বেরিয়েছে অঞ্জন, আর দেখা নেই। একটা ফোনও করেনি। ওর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
৩০ এপ্রিল।
৩টের সময় জেফ কোনিগ ফোন করল। ৩টে বলতে দুপুর নয়, কারণ, এরা বলেছে সন্ধ্যা হবে রাত ৮টায়।
জেফ রঞ্জনের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বিস্তর শোকপ্রকাশ করে সে জানতে চাইল, আমরা খরচাপত্র চালাচ্ছি কী করে। আমি বললাম, আমাদের সঙ্গে হাজারখানেক ডলার আছে। আর বাড়িতে তো প্রচুর খাবার-দাবার। জেফ বলল, ফিউনারালের বিষয়ে আমি কী ভেবেছি। শুধু ফিউনারালেই ১০ হাজার ডলারের মতো খরচ হতে পারে। একটু ইতস্তত করে সে বলল, আমি যদি তাকে টেম্পােরারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করি, তাহলে ডাঃ চ্যাটার্জির এস্টেট থেকে সে আপাতত সব বিল মেটাতে পারবে। এটা অবশ্য একটা খুবই টেম্পােরারি অ্যারেঞ্জমেন্ট, ও বলল, আগামী তিন বছরের জন্য এস্টেটের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং ছেলের গার্জেন কোর্ট থেকে যতদিন না হচ্ছে শুধু সেই কদিনের জন্য। দিস ইজ নো বাইন্ডিং, ও বলল। ওকে, এ বিষয়ে একটু পরে জানাচ্ছি বলে ফোন রেখে, আমি ছন্দা আর অমিয়র পরামর্শ চাইলাম। এখন আমার মুশকিল একটাই, কে বিশ্বাসযোগ্য, বা কারা? আসার আগে জানতাম, আমার কাজ একটাই এবং তা হল—এখানে এসে-পড়া। তারপর চিৎপাত ভেসে-থাকা, শোক-সাগরে। ভেসে-যাওয়া। কিন্তু, ওই চিত্রকল্পের সূত্র ধরে বলা যায়, তীরে এত ঢেউ, ঢেউয়ের পরমুহূর্তে ঢেউ যে, কাল থেকে আমি হাঁটু জলেও নামতে পারিনি।
ওরা রাজি হল। মনে হল, বেশ খুশি, ওদের কাছে আমার এই প্রথম আত্মসমর্পণে।
ওদের দুজনের মধ্যে কথা বলে ছন্দা, অমিয় স্ত্রীর ইঙ্গিত না-পাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকে।
ছন্দা অমিয়কে বলল, তাহলে ফিউনারাল পরশুই হয়ে যাক। তুমি জেফকে ডাক।
অমিয় জেফকে ফোনে ধরলে আমি বললাম, তাহলে কাগজপত্র আনো, আমি সই করে দিচ্ছি।
জেফ যা বলল, তা শুনে এ-দেশে এসে এই প্রথম আমি অবাক হলাম। বা, আমেরিকা জিনিসটা কী, তার প্রথম স্বাদ পেলাম, এভাবেও বলা যায়। জেফ বলল, আজ রবিবার। কাল সকাল থেকেই আমি যেন সমস্ত বিল তার অফিসে পাঠাই। সে কাল সকালে কোর্ট বসলেই, জাজকে একটা স্টেটমেন্ট দেবে যে ডাঃ চ্যাটার্জির নিয়ারেস্ট রিলেশান তার দাদা তাকে টেম্পােরারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করেছেন।
আমার মুখের কথাতেই হবে?
সেটাই যথেষ্ট। এখানে কেউ মিথ্যে কথা বলে না।
শুনে ছন্দা বলল, তা ঠিক। কিন্তু এখানে কেউ কারুকে বিশ্বাসও করে না।
কাদের দেশে এসেছি, জানবার ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। আমি বললাম, আর-একটু বলুন।
না, আমি খারাপভাবে কথাটা বললাম না। তবে, খুব একটা ভালও নয় হয়ত ব্যাপারটা। ছন্দা হাই তুলে বলল, আসলে, এদের কারুকে বিশ্বাস করার দরকারই হয় না। কারণ এদের আত্মবিশ্বাস আছে।
জেফ বলছিল, এখানে কেউ মিথ্যে কথা বলে না।
বলবে কোত্থেকে, মিথ্যে কথা তো বলে মানুষ। কারণ, মিথ্যে বলতে বুদ্ধি লাগে। এখন, একটা বাঘ এসে যদি বলে আমি মিথ্যে বলি না, আমি বলি, হালুম, আপনি কি খুব ইমপ্রেসড় হবেন? সেটাকে তার সততা বলবেন? অনেস্টলি, দে হ্যাভ হার্ডলি এনি চয়েজ ইন দা ম্যাটার। সে হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, চলুন বাড়িটা দেখবেন। আগে বাইরেটা দেখি চলুন। তারপর ভেতরটা দেখবেন। তুমি থাক।
ফিউনারাল কবে হবে?
পরশু। ও হ্যাঁ, তুমি জেফকে বল, সে অমিয়র দিকে ঘাড় বাঁকায়, সমস্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে।
বেশ একটা রানী রানী ভাব ছন্দার আত্মপ্রত্যয়ে। চোখ ছাইরঙা। চুলের রঙ বাদামি। হংসিনী গ্রীবা।
সামনে দিয়ে বেরুলে দীর্ঘ ড্রাইভওয়ের দুপাশে সবুজ ছাঁটা ঘাসের লন। অনেকগুলো অজানা গাছ। এটা মেহগিনি যেতে যেতে ছন্দা একটার গায়ে হাত রাখে। আমরা বাড়ির পিছনের বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম পথের ধারে তিনটে নুড়ির মতো অনুল্লেখযোগ্যভাবে তিনখানা গাড়ি পড়ে আছে। এটা ক্যাডিলাক, ওটা মার্সেডিজ, এটা কামপারা, যেতে যেতে ছন্দা হাত রাখে গাড়িগুলোর গায়ে। লিঙ্কন কন্টিনেন্টালটা তো গেছে। বিশাল গাড়ি ছিল, নীল রঙের। সুমি ওটাই বেশি চালাত। দামি বলে, শুধু টার্বো পোর্সাটা আছে গ্যারেজে।
আহা, রঞ্জনদা বারদুয়েকও চাপেনি।
এখন ৭টা। খাঁটি বিকেলবেলা। হাওয়ার জোর বাড়ছে। বসন্তের আবহাওয়া। যেতে যেতে ঙ্কিলারগুলো নিজের থেকে খুলে গিয়ে, মাঠময় বৃত্তাকারে জল ছড়াতে লেগেছে।
আমরা মাঠের ধারে সাদা রঙ করা কাঠের বেড়া পর্যন্ত গেলাম। ছন্দা বলল, ওই যে বনটা দেখছেন ওটাও চ্যাটার্জির্দার। অ্যামন্ড আর ওয়ালনাটের পর পর দুটো অৰ্চাৰ্ড। মাইল তিনেক লম্বা হবে।
আমরা সুইমিং পুলে গেলাম। ৭২ ফিট লম্বা। মার্সেদে এত বড় সুইমিং পুল আর কারও নেই। একে বলে জাকুসি। মাঝখানের দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা ছোট অংশটায় গরম জল। ধোঁয়া ওড়ে। হট স্প্রিং আর কী। বাকিটা কনকনে ঠাণ্ডা। পরপর দুটোয় স্নান করে উঠলে ক্লান্তি বলে কিছু আর থাকে না। মার্সেদে জাকুসি আর কারও নেই। গার্ডেনারের নাম আমোস। সে পুলের জুল তুলে ফেলেছে। আমি দেখলাম পুলের ধারে কাঁটা চামচ আর একটা শুকনো কোয়ার্টার প্লেট পড়ে আছে। একটা প্রকাণ্ড সোনা ব্যাঙ পাশেই সোফায় বসে আছে এখনও না লাফ দিয়ে।