ও, আচ্ছা। তাহলে এই ব্যাপার। বীরিভড়-টার্নড় টুরিস্ট ভাইপোর সঙ্গে দুদিন দুরাত্রি লুডোর খোলে ছক্কার মতো ঝাঁকুনি খেতে খেতে আমি উড়ে এসেছি। আমি জানতাম, মার্সেদে গিয়ে আমাকে পড়তেই হবে। সে ছয়-পাঁচ, তিন-দুই, পাঞ্জা বা পোয়া, যা হয়েই পড়ি। ছেলেটা আর মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাদের জেঠকে আর বাবাকে। তারপর ভাই হিসেবে, ভাসুর হিসেবে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ওদের শেষকৃত্য করা— এর বেশি কিছু কৃত্য আমার ধারণায় ছিল না। কিন্তু, এখন দেখছি, আরও একটা লাশ পড়েছে। এবং, তা হল ওদের বিষয়সম্পত্তি, টাকাকড়ির লাশ—–ডানা মেলে শকুনের পাল উড়ে আসছে সেদিকেই—এরা কি সেই লাশের ওপর বসে?
আচ্ছা, এদের বিষয়-সম্পত্তি কত হবে?
সম্পত্তির কথা পরে। অমিয় বলল, দুদিন ধরে বডি সিটি করোনারের অফিসে পড়ে আছে। আসুন, আগে ওদের সৎকারের ব্যবস্থা করি।
অবশ্য, সকার আর কীসের হবে। বডি বলতে তো কিছু নেই। মুখ চোখ বিকৃত করে ছন্দা বলল, শুধু তাল-তাল মাংস। ডেন্টিস বডি আইডেনটিফাই করেছে। সুমি-র তিনটে দাঁত বাঁধানো ছিল। সেটা ছিটকে পড়েছিল। আর আপনার মেয়ের বডি কার্ড।
বডি কার্ড?
হ্যাঁ। ওতে ছবি থাকে। নাম-ধাম থাকে। ড্যাশ বোর্ডে ছিল। ওই গাড়িতেই নন্দিন ড্রাইভিং শিখছিল কিনা। ওগুলো পোড়ে না। ওই জন্যেই তো ভাইস-কনসাল আপনাদের প্রথমে জানিয়েছিলেন নন্দিনও…. কাগজেও প্রথম দিন তাই বেরিয়েছিল। আমরা তো তাই জেনেই এসেছিলাম। যে শুধু অঞ্জন বেঁচে আছে।
ডিং-ডং, ডিংডং, ডিংডং। ডোর-বেল।
প্রথম মোর্নার। থ্রি-পিস ডাভ-গ্রে স্যুট। গ্যাবার্ডিন। হাতে প্রচুর খাবার। সেই প্রথম আর শেষ রোগা আমেরিকান। নাম বলল, হ্যারি। গভীরভাবে মর্মাহত। আবার আসব বলে চলে গেল।
আমরা ওদের মৃতদেহ দেখিনি। প্যাডে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে মাথা নিচু করে ছন্দা বলে গেল, দেহ বলতে কিছু ছিল না। এবং ওদের শরীরের সবটাই যে করোনারের কাছে আছে, তাও না বলতে বলতে হাল্কা মেহেদি-রঙা ববড় চুল তার মুখ ঢেকে দেয়, গয়নার বাক্স যেটা গাড়িতে ছিল, তার চারদিকে জমে ছিল তাল-তাল মাংস, যেন সূর্যের তাপে পুড়ে অমন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমাদের তো…. আমাদের তো ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে মাংস ছাড়াতে হয়েছিল। গয়নাগুলোর, আশ্চর্য, কিছুই হয়নি।
ছন্দার ধারণা, গয়নার বাক্সের চারদিকে জমে থাকা যে তাল-তাল মাংসপিণ্ড, তা ছিল সুমিতার। তার মতে, নিজের মাংস ঢেলে সে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে সেগুলোকে রক্ষা করে গেছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি দীঘা যাওয়ার সময় বাসস্ট্যান্ডেমাথা থেকে একটা হেয়ার-পিন পড়ে গেল সুমিতার। খোঁজ, খোঁজ। সুমিতা একটা এঁটো শালপাতার নিচে থেকে সেটা কুড়িয়ে পেল, তবে পরের বাসে উঠল। আবার টিকিট কাটতে হল।
আর একটা জিনিস মিরাকিলাসলি সেভড় হয়েছে ছন্দা জানাল, কী বলুন তো?
মাইনাস আট-দশ পাওয়ারের সোনালি সেল-ফ্রেমের চশমার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে চোখের কোণ মুছল সে। ঠিক পরমুহূর্তে, মুখে এনে জীবনের উদ্ভাস, বলল, যাবতীয় ফোন-নম্বর আর ঠিকানা লেখা রঞ্জনদার ডায়েরিটা। ওটাও গাড়িতে ছিল। সত্যি, কী করে যে ওটা বাঁচল। পুরো একটা দিন আমরা হাত গুটিয়ে বসে। কিছু করতে পারছি না। একটা ঠিকানা নেই, কিছু নেই। পুলিস ভাগ্যিস দিয়ে গেল। নইলে তো কাউকে কনট্যাক্টই করতে পারতাম না। ছন্দা গর্বের সঙ্গে বলে যায়, দেখবেন, কত লোক আসবে ফিউনারালে। কত ভালবাসত সবাই রঞ্জনদাকে। অ্যাজ আ সার্জন, হি ওয়াজ অ্যাট দা টপ। বলতে বলতে চশমা খুলে সে রুমাল বের করে।
৫ থেকে ১০ মিনিট অন্তর মোর্নাররা আসতে থাকে। হাতে রাংতা দিয়ে মোড়া কাগজের থালায় খাবার, বা, ঝুড়িতে ফল। ফুলের দোকান থেকে খেপে খেপে ফ্লাওয়ার-স্ট্যান্ড বা ফ্লাওয়ারবাস্কেট আসছে। সঙ্গে কার্ড। একজন স্নিগ্ধ, আত্মকর্মক্ষম, দুচার ডায়ালগের অভিনেতাকে বদলিহিসেবে সহসা ট্র্যাজেডির হিরো-চরিত্রে নামালে সে যতটা পারে, ততটা আপ্রাণভাবে করমর্দন করতে করতে আমি সমানে আই অ্যাপ্রিসিয়েট বলে যাচ্ছি। গ্রেগ লুইস নামে এক কালো দৈত্য এসে, কী যেন করে, সমানে ডাঃ চ্যাটার্জির প্রশংসা করে যাচ্ছে, তারপর সে যখন ইট উইল টেক আ লঙ লঙ তাইম তু…তু…ফরগেত আ পার্সন লাইক হিম বলছে, দেখি তার সাদা চোখে জল আমি অভিভূত হয়ে তার দুহাত জড়িয়ে আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ যেই না বলেছি, মনে হল, দারুণ রেগেই যেন সে চিৎকার করে উঠল, নো নিড! আমি তার হাত চমকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুপা পিছিয়ে আসি। তা নয়, ছন্দা আমাকে পরে বোঝাল, আসলে ও বলতে চেয়েছে, ইংরেজরা যেমন বলে, নিড নট মেনশন। তবে, ওর গলাটা ওইরকম রাগী। মেঘের হুঙ্কারের মতন। আমি ভেবেছিলাম, ও বলছে, তোমার কৃতজ্ঞতার আমি পুটকি মারি। ছন্দা বলল, শুধু ডায়ালেক্ট নয়,
এদের ভাষা একদম আলাদা।
সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় শোক প্রকাশ করে গেলেন পাশের বাড়ির মিসেস স্টেইনসন। ভদ্রমহিলা রোগা, একা বিধবা, ৫০, ছেলে থাকে লাস ভেগাসে। ছাই রঙের গোড়ালি পর্যন্ত স্কার্ট পরে শুধু তিনি হেঁটে এসেছিলেন। দুঃখ জানাতে এসে, শুধু তাঁরই দেখলাম, ওই নামের শব্দটির আদৌ দরকার হয় না। মাই পার্স ইজ ইওর্স তিনি মাথা নিচু করে শুধু এইমাত্র আমাকে জানালেন।
দুটোর সময় নন্দিন ফিরে এল। ততক্ষণে ডাইনিং রুম ফল আর খাবারে বোঝাই। লিভিং রুমে রঞ্জন, সুমিতা আর জীয়নের ছবি রেখেছে ছন্দা। সমস্ত ফুল সেখানে রাখা হচ্ছে।