বসুন। চা করি আপনার জন্যে। এক কাপ জল কুকিং রেঞ্জের একটা বাক্সের মধ্যে রেখে সে কাচের ডালাটা তুলে দেয়। দূটো-তিনটে বোতাম টিপে। ভেতরে আলো জ্বলে ওঠে। ফুটন্ত জলসুদ্ধ কাপ বের করে এনে তাতে টি-ব্যাগ, সুগার আর শুকনো দুধ-কিউব মিশিয়ে চা পরিবেশন করতে তার এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।
এগুলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এক কাপ জল ২০ সেকেন্ড। বলতে বলতে ছায়া ঘনিয়ে এল ছন্দার মুখে, সুমি আগুনকে ভয় করত খুব। রান্নাবান্না সব মাইক্রোওয়েভেই করত।
অমিয় ওয়েস্ট কোস্ট স্টার নামে একটি কাগজ আমার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে দেয়। প্রথম পাতার ডান দিকের সেকেন্ড লিডটা কালো সাইন পেনে চৌকো করে বর্ডার দেওয়া।
তিন কলমের হেডিং: টারলক বয় প্লিডস ইন্নোসেন্স। ছেলেটির নাম জন পার্ল। বয়স ১৯। তার এক কলম ছবি।
টারলক? চেনা-চেনা লাগছে। অ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়ল, এইটারলকশহর ছিল জন আপডাইকের কাপল উপন্যাসের চরিত্রদের লীলাক্ষেত্র। সেটা তাহলে ধারেকাছেই? টারলকের সেই জোড়ায়জোড়ায় ইদুর-দম্পতি, এর গোড়ালি ওর পায়ে বাঁধা— তাদের খাড়া-ল্যাজ ইঁদুর-দৌড়। ইঁদুর বৌ-দের অনবরত বিছানা-বদল। সব নাম ভুলে গেছি, তবু বেশ কিছু লোক, যাদের সঙ্গে দেখা হলেই চিনতে পারব, এমন কিছু মানুষের কাছাকাছি কোথাও আমি, এই বিভুই-এ, এমনটা ভেবে একটু স্বস্তি বোধ করছি দেখি।
জন পার্ল বিধবার একমাত্র ছেলে। বাড়ি টারলকে। ড্রপ-আউট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে। সে বেকার ভাতা পায়। সান্টা মারিয়া থেকে সে একটা খালি পিক-আপ ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিল স্টকটনের দিকে, ফ্রি-ওয়ে হান্ড্রেড থার্টির ৩নং লেন ধরে না, গাড়িটা তার নয়। তার বন্ধু স্যাম পিয়ার্সনের। হ্যাঁ, সে কিছুটা মদ খেয়েছিল। কিন্তু সে তো দুপুরবেলায়। অনেক আগে। হা, স্পিডলিমিট ছাড়িয়ে সে গাড়ি চালিয়েছিল কিছুক্ষণ। একসময় ছিল ৯০ মাইলে, ৬০-এর লেনে। বোধহয় রাডারে ধরা পড়ে যায়। ট্রাফিক-পেট্রল তাকে তাড়া করে। পুলিস বলেছে, না? তাড়া করেনি! পিছনে জোর আলো ফেলে অনেকক্ষণ ধরে তবে কারা আসছিল? তার তাই মনে হয়েছিল, এনিওয়ে। যে, পুলিস! তখন রাত? ১০টা হবে। মডেরা শহর থেকে বেরোবার মুখে শোল্ডার থেকে নেমে এল একটা নীল রঙের লিঙ্কন। সে তখন পুলিসের ভয়ে প্রাণপণে চালাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনি যে গাড়িটা ওভাবে নামবে। গাড়িটার পেছনে সে সোজা ধাক্কা মারে। উইথ মাই আইজ ক্লোজড। তাকে অবাক করে গাড়িটা মুহূর্তে দপ্ করে জ্বলে ওঠে। তারপর…
ছন্দা বলল, চা খান নদী। এগুলো পেস্তোশিয়া। সল্টেড পেস্তা। আর এগুলোকে এরা বলে ককি। আমেরিকান বিস্কুট। অনেকটা আমাদের লেড়ো বিস্কুটের মতো, তাই না? বলে কী মনে করে সে একটু হেসেই বলে, আমি দর্জিপাড়ার মেয়ে। আপনারা তো বেনেটোলার?সুমিতা ছিল আমার… চোখের জল লুকোতে সে মুখ লুকোয়, লোকে বলত, অনসূয়া-প্রিয়ংবদা।
টেবিলে ইন্ডিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিয়া অ্যাব্রড, নেভাদা পোস্ট আর মর্নিং স্টার। সবই আশপাশের কাগজ। সবাই ফলো-আপ ছেপেছে কিছু না-কিছু।
টি ভি-র টেনথ-চ্যানেলে থার্টি মিনিটস-এ পুরোটা দেখিয়েছে। ছন্দা জানাল, অঞ্জনের ইন্টারভিউ নিয়েছে। আপনার মেয়েকেও দেখিয়েছে।
গত তিনদিনের খবরের কাটিং ওই বোর্ডটায় ছন্দা টেলিফোনের পাশে বোর্ডটা দেখায়। বোর্ড পিন দিয়ে আটকানো খবরগুলির মধ্যে একটি চার কলমব্যাপী গাড়ির ভস্মীভূত কঙ্কাল! আমি শিউরে উঠি।
অবিচুয়ারি বোর্ডের পাশ থেকে শুরু কিচেনের। কিচেনের গোটা পূর্ব দিক জুড়ে লম্বা গ্লাসপ্যানেল। সুমিতা এখানে দাঁড়িয়ে পূর্বাস্য হয়ে রান্না করত।
…বাবা, আজ কি ওখানে রথ?
…না, রথ তো কাল রে।
…কাকিমা বলল আজ!
…ও-হ্যাঁ, তোদের হিসেবে তাই তো হবে।
.. আমরা এখন রাইস-ক্রিসপি, মানে ঠিক মুড়ি নয়, ধরো চালভাজা— চালভাজা দিয়ে বেগুনি আর পাঁপড় খাব। কাকিমা ভাজছে। ছোটকাকা বলল, তোর বাপকে ডাক। ডেকে বল।
তাই ফোন করলাম।
কুকিং রেঞ্জের গ্লাস-প্যানেল দিয়ে বাড়ির পিছনে বিঘে চারেকের মাঠ পেরিয়ে সিয়েরা নেভেদা পর্বতমালা পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় আল কাপিতান। রেড ইন্ডিয়ানরা থাকত মূলত ওখানে, ওই ইওসেমিটি উপত্যকায়। ওখানেই সেই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু, ৪০০০ ফুটের সাদা-ধূসর ওয়ান-পিস গ্রানাইটের খাড়া পাহাড়: আল কাপিতান। কাপিতান ছিল বিখ্যাত রেড-ইন্ডিয়ান ডাকাত। জানো বাবা? সে যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যেত, ঘোড়ার ওপর তাকে দেখা যেত না। শুধু দেখা যেত তার মাথার পালকের মুকুট আর হাতের বর্শা। জানো বাবা, ওই কাপিতান আসছে বলে এখানে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ায়।
শরতের ছেঁড়া মেঘ ছাড়া কিছু মানায় না এমন নীল আকাশের দিকে মাঠের বেড়া ডিঙিয়ে বন পেরিয়ে, আল কাপিতান পর্যন্ত সুমিতার চোখের ভেতর দিয়ে আমি দেখবার চেষ্টা করি। সুমিতা নিশ্চয় দেখত। রান্না করতে করতে। মাঝে মাঝে। মুখ তুললেই: আল কাপিতান!
কাপল-এর নায়কের নাম মনে পড়ে গেছে। পিয়েতনাম মনে না পড়ে যাবে কোথায়, চেনা মানুষ! পিয়েতের প্রেমিকার নাম ছিল জর্জি। তাই কী?
টারলক এখান থেকে কতদূর?
টারলক? সে তো খুব কাছে। ৩০ মাইল। কেন, চেনেন বুঝি কাউকে?
অমিয় উঠে গিয়েছিল ডোরবেল শুনে। হাউসক্লিনিং লেডি এসেছে। হাই মারিয়া: অমিয়। শুনলাম, পোটুরিকান। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বের করে সে লিভিং রুমের ভেলভেট কার্পেট ঝাঁট দিতে শুরু করেছে দেখতে পাই।