গত এপ্রিলে হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে নন্দিন আমেরিকা বেড়াতে যায়। আমার আর নন্দিনের টিকিট এসেছিল। চিনুর আসেনি বলে আমি যাইনি। ওখানে ৮ মাসে টেথ গ্রেড পাস করে, মাস দুই হল সে নিউট্রিশন মেজর নিয়ে মার্সে কাউন্টি কলেজে ঢুকেছে। রঞ্জনের ইচ্ছে ছিল নন্দিন ডায়াটিসিয়ান হয়ে ওর অলিভ মেডিকেল সেন্টারে ঢোকে।
অঞ্জন পাবলিক স্কুলে পড়ে। স্কুল যায় সকাল ৭টায়। সে পড়ছে টেন্থ গ্রেডে। যাওয়ার আগে দরজায় টোকা মেরে বাংলায়, নন্দিন তোমার সাতটার সোময় হয়েছে বলে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ, তার কলেজ যাওয়ার সময়।
আজই প্রথম ও স্কুলে আর আমি কলেজে যাচ্ছি বাবা। গত সপ্তাহেও কাকিমা ডেকে তুলেছিল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার আগে দাঁত মাজতে মাজতে নন্দিন আমাকে জানাল।
সত্যি, মস্ত ঘরখানা নন্দিনের। উঁচুতে, তিন দেওয়াল জুড়ে ক্লোজেট। একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। বহুদিন ব্যবহার হয়নি বোঝা যায়। বেকার দাঁড়িয়ে থেকে থেকেই বুঝি পা চারটি অমন বেঁকে গেছে। বিশাল ডালার ওপর নন্দিনের বইপত্র থেকে কালার এবং হোয়াট নট। এমনকি, একটি হেয়ার-কন্ডিশনার। ড্রায়ার ও ওয়াশিং মেশিনও এ-ঘরেই। এত বড় ঘরে জানালার ধারে মাত্র একটা ছোট্ট সিঙ্গল বেড দেখে লেদু আমরা শোব কোথায় জানতে চাওয়া মাত্র কেন, এইখানে বলে ছুটে গিয়ে চার-পাঁচজনে বসার সোফাটার নিচে একটা রড ধরে টানতে টানতে, সোফা গদিটদি সাজিয়ে, মায় চাদর-ব্ল্যাঙ্কেট-বালিশ সব পেতে মিনিট দুয়েকের মধ্যে নন্দিন একা-একাই সেটাকে পরিণত করেছিল একটি আকর্ষণীয় ডাবল বেডে। লেদু এখনও সেখানেই ঘুমুচ্ছে।
মেয়ের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় কাল থেকে অনবরতই পাচ্ছি। বুঝছি যে, সেনন্দিন আর নেই যার এক-একটি হাই তুলতে লাগত ৩০ সেকেন্ড। ঘড়ি দেখে তবু বললাম, কীরে, পারবি তো? এখন ৭টা ২৫।
পারতেই হবে বাবা। কালো জিনসের স্কার্ট আর কালো সিফনের ফ্রিল-দেওয়া জামা পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নন্দিন বলল, সাড়ে সাতটা মানে এখানে সাতটা ঊনত্রিশ, সাতটা একত্রিশ কখনওই নয়। সাত ঊনত্রিশে ওই চায়না বেরি গাছটার নিচে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
এর মধ্যে পারবি?
আন্টি ড্রাইভওয়ের ওই দিক দিয়ে ঢুকবে আর এই দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মাঝখানে একবার শুধু আমার জন্যে দরজা খুলবে। পারতেই হবে বাবা।
রাস্তার দিকে বিশাল গ্লাস প্যানেল। দুদিকে নস্যি-রঙের প্রগাঢ় পর্দা টানা। পর্দা দুদিকে সরে যাওয়ার পর গ্লোব সিনেমার প্যানোরামিক স্ক্রিনে যেমন, জানালার কাচে এখন ফুটে রয়েছে একটি মূলত সবুজ, রোদ ঝলমলে চলচ্ছবি। দূরে, বেয়ারক্রিক খালের (নন্দিন বলেছে নদী) ওপর সেতুর এপারে সাদা রঙের কাঠের গেট পর্যন্ত দেখা যায়। সেখান থেকে শুরু হোয়াইট গেট ড্রাইভের। দু লেনের লম্বা রাস্তা জুড়ে সাদা ফুলে ভরা এখনও নাম-না-জানা বিদেশি গাছের সারি দুধারে। মাঝে মাঝে একটা গাড়ি বাঁক নিচ্ছে, ব্রিজ থেকে নেমে এই দিকে ছুটে নিঃশব্দে আসছে। বাড়ি সাউন্ড প্রুফ। ড্রাইভারের সিটে নারী-পুরুষ যেই বসে থাক, তখন থেকে দেখছি সকলেই এই বাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। লাল কস্টিউম পরে স্বর্ণকেশী শ্বেতাঙ্গিনী এক জগ করতে করতে বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে গেল, শুধু সে কেন, তার সঙ্গী পোলকা-ডট গ্রেট-ডেনটাও, ছোটা অব্যাহত রেখে, এদিকে কয়েকবার ভীতভাবে তাকায়। যেন সেও জানে মাত্র ৪ দিন আগে কী ভীষণ ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে এই বাড়িটা, যদিও আপাতদৃষ্টিতে অটুট দাঁড়িয়েও রয়েছে।
এই সেই হোয়াইট গ্রেট ড্রাইভ, ২৮৫৬ নং। ক্যালিফোর্নিয়া-৯৫৩৪০। গত ১২ বছরে এই ঠিকানায় কত চিঠি, কত কার্ড যে পাঠিয়েছি তার হিসেব নেই। এক বছরে সপ্তাহে দুটো করে নন্দিনের কাছেই শখানেক চিঠি এসেছে। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, যে ঠিকানায় সুমিতাকে পাঠানো হারমোনিয়ামটা, হায়, শেষ পর্যন্ত পৌঁছল না।
পোল থেকে একটা গাড়ি নামতে দেখেই ওই আসছে বলে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে, আপেলহাতে নন্দিন ছুটতে শুরু করল, আমি ফোন করব তোমাকে। কলেজ থেকে।
হাই আন্টি, হাই আঙ্কল বলতে বলতে সে ছুটে কিচেন পেরোচ্ছে, আমি শুনতে পেলাম। ছন্দা-অমিয় তাহলে উঠে পড়েছে। আমার এবার বাইরে বেরনো উচিত। কাল রাতে ওদের সঙ্গে আলাপ ছাড়া বিশেষ কোনও কথা হয়নি। ওরাই তাড়াতাড়ি শুতে বলেছিল।
গাড়ির কাচ খুলে নন্দিন হাত নাড়ল। হাত নাড়ল ইয়াসও। ওই যে ওদের ছেলেমেয়েরাও হাত নাড়ছে। গাড়িটা হোয়াইট গেটের মুখে বাঁক নেওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধহয় ক্যাডিল্যাক।
০৭. আল কাপিতান
৩০ এপ্রিল
প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না।
যা ভেবেছিল, ভুল। এখানে জীবন এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু তাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। অনভিপ্রেত অতিথি মাত্র চারদিন যেতে না-যেতেই বলছে, তবে উঠি রে।
কিচেন-সংলগ্ন টেবিলে অমিয় আর ছন্দা বসে আছে। সামনে একটা প্যাড। হোল্ডারে গুচ্ছের ডট পেন। আর, আজকের খবরের কাগজ অনেকগুলো। ছন্দা চা খাচ্ছিল। আন্ডারলাইন করার বদলে, বেঢপ মোটা মার্কার কলম দিয়ে একটা সম্পূর্ণ প্যারাগ্রাফের লাইনগুলোর ওপর স্বচ্ছ হলুদ কালি বোলাচ্ছিল অমিয়। ওরা আমার দরজা খোলার শব্দের দিকে মুখ তুলে তাকায়।
মর্নিংনদা, ছন্দার গলার সুরে আত্মীয়তা, ঘুম হয়েছিল?
ঠিক আছে। আমি বলি।