তাদের কাজ শুধু স্বামীর বেঁচে থাকাটুকু নিয়ে বলতে বলতে কোমর জড়িয়ে ধরে আমি তাকে বুকে টেনে নিই।
দার্শনিকতা পুরুষদের ব্যাপার। কৃষ্ণ থেকে শঙ্করাচার্য, ডায়োজেনিস থেকে দেকার্ত–সবাই পুরুষ মানুষ। নইলে তো এক-আধটা মেয়ে থাকত। দীপ্তি কখনও কোনওপ্রকার দার্শনিকতার ফাঁদে পা দেয় না। সে মেয়েমানুষ।
তবু, এত তাড়াতাড়ি সে উত্তর দেবে, ভাবতে পারিনি।
তার রূঢ় স্তনবৃন্ত আমার বুকে খরখর শব্দ তুলে নিচু স্বরে জানায়, লাল্লু ঠিকই তো বলেছে।
০২. আঠারো বছর পরে
গত বছরের মতো এবারেও গরমের ছুটির কিছুদিন আগে থেকে দীপ্তি শুরু করেছে, এবার গরমের ছুটিতে আমরা কেদার-বদ্রী যাব।
বলছে মেয়েকে; কিন্তু আমাকে শুনিয়ে।
এবার এপ্রিলে আমাদের বিয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ১৮ বছর ধরে তার যাবতীয় কামনা ও বাসনার খবর আমি প্রথম দিকে দেওয়াল ও পরবর্তীকালে চৈতি মারফত পেয়ে থাকি। সে বলে আমাকে; মেয়েকে শুনিয়ে।
কিন্তু, নতুন বছর থেকে সে সুর বদলেছে। এবার সে যে রাগে গাইছে, তারই নাম বোধহয় আশাবরী। এর মিড-গমক-মূৰ্ছনা সবটাই আলাদা। ভাবখানা, যেন কেদার-বদ্রী সেরে এসে সে জনে জনে সুতোর তাগা আর চিনি-রোলার প্রসাদ বিতরণ করছে।
এর মধ্যে একদিন, দীপ্তি বেরিয়ে যাওয়ার পর, চৈতি তিন-তিনখানা রেনকোট আমার সামনে এনে রাখল।
কেন রে?
মা সেল-এ খুব সস্তায় পেয়েছে। কেদারের পথে যেতে লাগবে।
আমাকে দেখাবার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন সে বোধ করেনি। এবার তার আত্মপ্রত্যয় এত বেশি।
ওর কলেজের বীণাদি মনোরমাদিরা গত গ্রীষ্মে পাল স্পেশালে কেদারনাথ বদ্রীনাথ গিয়েছিল। সেই থেকে বলছে। ওদের সঙ্গে তখন যেতে পারত। তা নয়।
আমরা যাব। সামনের বছর পুজোয় আমরা ফ্ল্যাটের সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট দেব। শান্তিনিকেতনে, কোপাই নদীর একদম ধারেই, মাস্তৃপিসি ৫ কাঠা জমি ছেড়ে দিচ্ছে। এখন হাজার দুই দিয়ে বায়না করলেই হবে। আমরা কিনব।
এ ধরনের সঙ্কল্প সে করে মেয়ের কাছেই, তবে তখন, যখন আমি ধারেকাছে থাকি। অবশ্য, এইটুকু তিন-ঘরা ফ্ল্যাটে কত দূরেই বা যাব।
একটু জোরে ফিসফিস করেও যখন কিছু মেয়েকে বলে, এ ঘরে শোনা যায়। জানা যায় যে, সে যাবে। সে দেবে। সে কিনবে।
ভুল বললাম।
আমরা দেব। আমরা কিনব। আমরা যাব।
আমার সঙ্গে আদৌ কোনও পরামর্শ না করে, আমার সুবিধে-অসুবিধের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে, সে এই সব সিদ্ধান্ত নেয় ও সেই সব অভিযানের তোড়জোড় করতে জমির দালাল বা পাল স্পেশালের ভূমিকায়, যখন যা, আমাকে অবতীর্ণ হতে বলে।
এখনও পর্যন্ত আমি তাকে একটি ব্যাপারেও না বলতে পারিনি।
দেব। যাব। খাব। করব। করাব। কিনব।
এ নয় যে ভবিষ্যবাচক এই সব ক্রিয়াকর্মের প্রতিটি ব্যাপারেই সে আমার মুখাপেক্ষী। বা, উচ্চারণ করে তার সকল কামনাই সে এভাবে ব্যক্ত করে। তা নয়। সে এতটা খেলো নয়। তার ব্যক্তিত্ব আছে। যেমন, ওই জামদানিটা কিনব। ফান মাঞ্চ খাব। এগুলো বলে না। আলমারি বা ফ্রিজে কমলা রঙ করাব। বলে না। বা, বাথরুম মোজায়েক, কী ডাইনিং টেবিলে সানমাইকা! রঙ, কাঠ ও রাজমিস্ত্রির ব্যাপারে সে আমার বদলি হিসেবে পাড়ার কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সংস্পর্শে এসে গেছে। দীর্ঘ ১৮ বছরের দাম্পত্য-জীবনে গুণরাশিনাশি দারিদ্রদোষ থেকে আমরা যত মুক্তি পেয়েছি যতই দুধ-আনা, রেশন-আনা থেকে অব্যাহতি মিলেছে, ততই আমরা কবে থেকে যে ক্রমাগত আমি হয়ে গেছি, সরে এসেছি দুজনেই দুজনের কাছ থেকে, কত যে। কোনওদিন কাছাকাছি ছিলাম হয়ত। না পড়ুক মনে, সুখ অথবা দুঃখের কোনও কোনও ঘটনা আমাদেরও জীবনে নিশ্চয়ই ঘটেছিল। অন্তত, সিনেমা তো গেছি। দুজনে বেড়াতে গেছি অন্তত মিহিজামে। যাইনি? এক বিছানায় শুয়েছি কত না বার। কিন্তু, ওর ওই পরস্ত্রীমুখের দিকে তাকালে আজ আমার মনেও হয় না, যে, আমরা কোনওদিন পরস্পরকে হয়ত চুম্বনও করেছি। বড় ভুলো মন আমার, নিঃসন্দেহে।
তাই, সে যখন আমরা বলে, আমি দেখতে পাই লতা-পাতা-ঘাসফুলে ঢাকা এক নিখুঁত ফাঁদ। একটা গহ্বর। ফাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তার নির্মিতির কৃৎ-কুশলতা তারিফ না করে পারি না।
এমনকি, মাঝে মাঝে আমি যদি তাকে এখনও কাছে ডাকি, আর ঘুমন্ত মেয়েকে পাশের ঘরে রেখে সে আমার সিঙ্গল বেডে আসেও আমাদের সেই শোয়া ব্যাপারটিও কখনও যুগ্মতায় পর্যবসিত হয় না। (হয়েছিল নাকি কোনওদিন?) এই কাজটিও মূলত একা-একা সে নিম্পন্ন করে নেয়, (নিয়েছে ও বরাবর নিয়েছিল) কত অনায়াসে, কী পেশাদারি শারীর পটুতায়! সে এসে সেক্স করে যায়, তার মান-মর্যাদা, এমনকি, বলা যেতে পারে, তার কৌমার্যটুকুও অক্ষুন্ন রেখে। কী নিপুণভাবে পারে যে! শিশুপাল বধ যেন দর্পহারী শ্রীমধুসূদনের। কুচুৎ করে গলাটা কেটেই, ওই, আবার তর্জনীতে সুদর্শন। বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে।
নাকি, কন্ট্রাক্টর দত্তবাবুর সূত্র ধরে ভাবব, ওর কাছে গোটা দাম্পত্য ব্যাপারটাই স্রেফ হিসেবের কড়ি। যে, রঙ করেছ, পারিশ্রমিক পেয়েছে। এবার এই ফ্রিজ আমার। আলমারি আমার।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি বাঁজা নয়, এ ছাড়া আর কিছু জানবার জন্যে সে একদিন মাথায় সিঁদুর ও গায়ে লাল বেনারসি ও মুখময় চন্দন পরেছিল বলে আমার মনে হয় না।
এই যেমন আজ এপ্রিল ১৭, ১৯৮৮। সোমবার। এখন বেলা সাড়ে ৯টা। দীপ্তি ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে। লেখক নই, তবু আমি এ ঘরে এই সব ছাইপাঁশ ভেবে যাচ্ছি। হঠাৎ, ডাইনিং স্পেশ থেকে, সি-শার্পে—ধূর! ইচ্ছে করে সব টান মেরে ফেলে দিই। হুশ-হুশ!