কৌশিক কিছু বলল না।
ওরা ভেবেছিল, হয়ত পুরোটা মরেনি। সত্যবান আমাকে জানালেন, আগে খুন করেনি তো। আগে দ্যাখেনি। তাই, টু বি সিওর, কৌশিক সঞ্জয়কে গলাটা কেটে দিতে বলে। ওই আপনার কেনা ছুরিটা দিয়েই। খোলে কাঠি নেই দেখে বাক্সটা টুক করে লিটার ক্যানে ফেলে দিয়ে সত্যবান হেঁকে বললেন, দারওয়াজা, এক ম্যাচিস ল্যাও! গলা নামিয়ে, ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে ছিল।
কৌশিকের পরনে জিন্স। গায়ে ব্যাগি জামা। চুলে ক্রু ছাঁট। সানগ্লাস টেবিলের ওপর পড়ে আছে। পাপপূণ্যের বাইরে কী শুদ্ধ, শান্ত, শূন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে এই মুক্ত বন্দী!
তুই কাকিমাকে খুন করলি কেন রে কৌশিক, দীপ্তির মৃতদেহ দেখেও যা হয়নি, কৌশিককে দু-চোখ ভরে দেখতে দেখতে আমার তাই হল। চোখ জলে ভরে এল। টপ করে একফোটা, আমার হাতের ওপর পড়ল যেন আকাশ থেকে, কেন রে।
সে জবাব দিল না।
ওই যে আপনার মেয়ে চৈতি। তার কাছেই কৌশিক প্রথম শোনে আপনারা কেদার বদ্রী যাচ্ছেন। চৈতি ওদের ভ্রমণ সাথী বইটাও পড়তে দেয়। তাতেই হেমকুণ্ড আর ব্রহ্মকমলের কথা ছিল। কৌশিক বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে। যে, ওরা যাবে। ব্রহ্মকমল আনবে। উইদাউট রিজার্ভেশন ওরা ফার্স্ট ক্লাসে উঠে পড়ে। ওদের সঙ্গে ছিল, আমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে, এক লক্ষ টাকা। আপনার বুক র্যাকের পিছন থেকে ওরা হঠাৎই টাকাটা পেয়ে যায়। দা গ্রিনিং গোরিলা বইটা দেখতে গিয়ে রাকেশই প্যাকেটটা দ্যাখে। আলমারি টালমারি খুলতেই হয়নি। তবে ওরা হাজার দশের বেশি নেয়নি।
এই যে ব্ৰহ্মকমল, প্রথম ড্রয়ার খুলে উঁটিসুদ্ধ একটা প্রকাণ্ড পদ্মকুঁড়ি বের করলেন সত্যবান, ড্রয়ারে আপহোলস্টারের মধ্যে রিভলভার, বললেন, পাঁচ-ছদিন পরেও দেখুন কত ফ্রেশ রয়েছে। অ্যান অলমোস্টএক্সটিঙুট স্পিসিজ অ্যামংস্টদা ইন্ডিয়ান ফ্লোরা। টাটকা অবস্থায় একটা লাল আভা বেরোয় এর গা থেকে। যদিও দেখুন, কোনও গন্ধ নেই। বলে উনি নিজে এঁকে দেখলেন।
বরফের মধ্যে দিয়ে সাঁতরে কৌশিক এটা নিজে তুলে এনেছে।
আমি চুপ করে আছি দেখে সত্যবান বলে চললেন, এরা সবাই সাউথ স্টার আর বীরেন্দ্রপুরের ছেলে। শুধু রাকেশ কনভেন্ট স্কুলের। স্কুল ফাইনালে প্রত্যেকে হাই ফাস্ট ডিভিশনে পাস করেছিল। কৌশিক তো লেটারই পেয়েছিল চিারটে। আপনার মেয়ের বন্ধু। জানেন নিশ্চয়ই।
ম্যাচেস এসে গেছে। হুস-হুস করে বার তিনেক ধোঁয়া ছেড়ে সত্যবান বললেন, আপনি এর বাবাকেও চেনেন। কী নাম তোমার বাবার, কৌশিক।
কৌশিক উত্তর দিল না।
আর একবার বলবে না? ঠিক আছে। ঠিক আছে। এর বাবার নাম বন্ধুবিহারী মুখার্জি। আলিপুর বয়েজ-এর হেড মাস্টার। খবর দেওয়া হয়েছে।এসে পড়বেন। নাচিয়ে সত্যবান জানালেন, বাকি তিনটে লকআপে। এক-এক করে ডাকছি আর কী। সোমবার কোর্টে প্রোডিউস করব।
আমার সঙ্গে সুদীর্ঘ বারো দিনের সেমিনারে সত্যবান মণ্ডলের একদিনের বিষয় ছিল খুন। উনি সেদিন বলেছিলেন—
পৃথিবীর যে-কোনও খুনকে আমি জীবনবিরোধী বলে মনে করি। টু মার্ডার ইজ ইনহিউম্যান। অ্যান্ড স্টুপিড।
অথচ দেখুন, পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে কোথাও না কোথাও একটা করে খুন হয়ে যাচ্ছে। এটা পরিসংখ্যান। বছরে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ৬০০। কেন এত খুন! কারণ একটাই। আমি চুরি করব না, আমি বলাৎকার করব না, এগুলো বলা যায়। কিন্তু আমি পাগল হব না, আমি খুন করব না–এগুলো বলা যায় না। এ দুটো ব্যাপারে মানুষ বড় অসহায়, জানেন।
পৃথিবীর শতকরা ৯৮টা খুন হয় চূড়ান্ত উত্তেজনার মাথায়। যে কোনও আমি বাবা-ওসবে নেই মানুষই তো ওগুলো করে ফেলে? পাগল হয় সুস্থ মানুষেই, তাই নয় কি? ছেড়ে দিলে এরা কেউ আর-একবার খুন করবে না।
এগুলোকে আধুনিক অপরাধ-বিজ্ঞানে বলা হয় নিরপরাধীর অপরাধ।৩৪ উপধারা-সহ পঠিতব্য ৩০২ ধারায় এদের যারা ফঁসি দেয় সেই সব বেতনভূক বিচারককে আমি ফাঁসুড়ে ছাড়া কিছু মনে করি না। ইন্ডিয়ান পিনাল কোর্টের বকলস বাঁধা পুলিসের কুকুর-মরালিটিকে আমি ঘৃণা করি।
তাহলে তো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, জুলিয়স সিজর—এরা সবাই খুনি।বা, রাসকলনিকভ! তাই নয় কি?
সেদিন মাত্র একবার ওঁকে বাধা দিয়ে আমি বাকিটু পার্সেন্টের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম।
হ্যাঁ। শূ-শূ করে সিগারেটে টান মেরে সত্যবান বলেছিলেন, বাস্তবের সেই টু পার্সেন্ট খুনি–যারা প্রিমেডিটেটেড মার্ডার করে। যেখানে মোটিভ থাকে। যেমন, খোকা গুন্ডা। তার প্রেমিকা রামবাগানের মলিনা ভালবাসত তার তবলচি রোগা, তিংখাডু পাগলাকে। থোকা পাগলাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে গেল। বলল, পাগলা, যা স্নান করে আয়। শীতকাল। তখন শেষ রাত। পাগলা জানতে চাইল, দাদা, তুমি কি আমাকে সত্যিই খুন করবে? খোকা বলল, পাগলা, যা, স্নান করে আয়।
ইউরোপের মর্ডান ক্লাসিকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। জ্যাক দ্য রিপার, মনস্টার অফ ডুসেলডর্ফ, পিটার কার্টেন ব্লু বিয়ার্ড ল্যানডু পৃথিবীর সবচেয়ে অমানুষিক মার্ডার যেগুলো—এদেরও তো মানুষ হিসেবে একটা সহানুভূতি প্রাপ্য ছিল। যে, খুন না করে এরা পারেনি। পাগল না হয়ে পারেনি। পাগলের যদি বেঁচে থাকার অধিকার থাকে, খুনির থাকবে না কেন? আমার প্রতি চূড়ান্ত অবিচার করলে, হে ঈশ্বর, এই ধারণায় বিশ্বাস রেখেই কি এরা প্রত্যেকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়নি? এরা কি অভিসম্পাত দিয়ে যায়নি খুনিদের খুনি প্রতিটি বিচারপতিকে। বিশ্বাসঘাতক ঈশ্বরকে!