উনি লেখেন। রহস্য উপন্যাস। জটায়ু ছদ্মনামে।
বাঃ! আপনাদের কম্বিনেশনটি বেশ ভাল। একজন রহস্য-প্লট পাকান, আরেকজন রহস্যের জট ছাড়ান। ভেরি গুড।
ফেলুদা বলল, আপনার প্রজাপতি আর পাথরের সংগ্ৰহ তো দেখতেই পাচ্ছি; এ ছাড়া আরও কিছু জমিয়েছেন কি কোনওদিন?
পাথরগুলো রাখা ছিল ঘরের একপাশে একটা বড় কাচের আলমারির ভিতর। এত রকম রঙের পাথর যে হয় আমার ধারণাই ছিল না। কিন্তু ফেলুদা হঠাৎ এ প্রশ্ন করল কেন? ভদ্রলোকও বেশ অবাক হয়ে বললেন, অন্য সংগ্রহের কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন কেন?
আপনার নাতনির হাতের চিমটেটাকে পুরনো টুইজারস বলে মনে হচ্ছে তাই—
ব্রিলিয়ান্ট! ব্রিলিয়ান্ট!–ভদ্রলোক ফেলুদার কথার উপর তারিফ চাপিয়ে দিলেন। —আপনার অদ্ভুত চোখ। আপনি ঠিক ধরেছেন, ওটা স্ট্যাম্প কালেকটরের চিমটেই বটে। ডাকটিকিট এককালে জমিয়েছি বইকী, আর বেশ যত্ন নিয়ে সিরিয়াসলি জমিয়েছি। এখনও মাঝে মাঝে গিবনসের ক্যাটালগের পাতা উলটাই। ওটাই আমার প্রথম হবি। যখন ওকালতি করি তখন আমার এক মক্কেল, নাম দোরাবজী, আমার উপর কৃতজ্ঞতাবশে তার একটি আস্ত পুরনো অ্যালবাম আমাকে দিয়ে দেয়। তার নিজের অবিশি। শেখ মিটে গিয়েছিল, কিন্তু এ জিনিস সহজে কেউ দেয় না। বেশ কিছু দুষ্পাপ্য টিকিট ছিল সেই অ্যালবামে।
আমি নিজে স্ট্যাম্প জমাই, আর ফেলুদারও এক সময় ডাকটিকিটের নেশা হয়েছিল। ও বলল, সে অ্যালবাম দেখা যায়?
আজ্ঞে?–ভদ্রলোক যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন—অ্যালবাম? অ্যালবাম তো নেই ভাই। সেটা খোয়া গেছে।
খোয়া গেছে?
বলছি না–আমার জীবনে অনেক রহস্য। রহস্যও বলতে পারেন, ট্র্যাজিডিও বলতে পারেন। তবে আজকের দিনটায় সেসব আলোচনা থাক। –এসে টেক্কা, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
টেক্কা মানে বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোকের বড় ছেলে। প্রীতীনবাবুর সঙ্গে এসে ঘরে ঢুকলেন। বয়সে প্রীতীনবাবুর চেয়ে বেশ কিছুটা বড়। ইনিও সুপুরুষ, যদিও মোটার দিকে, আর প্রীতীনবাবুর মতো ছট্ফটে নন; বেশ একটা ভারভার্তিক ভাব।
তিরিকে মাইক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে আপনি ভাল জবাব পাবেন, বললেন মহেশ চৌধুরী, আর ইনি মাইকার কারবারি। অরুণেন্দ্র। কলকাতায় অফিস, হাজারিবাগ যাতায়াত আছে কর্মসূত্রে।
আর দুরি বুঝি উনি? ফেলুদা রুপোর ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির দিকে দেখাল। ফ্যামিলি গ্রুপ। মহেশবাবু, তাঁর স্ত্রী, আর তিন ছেলে। অন্তত বছর পচিশ আগে তোলা, কারণ বাপের দুপাশে দাঁড়ানো দুজন ছেলেই। হাফ প্যান্ট পরা, আর তৃতীয়টি মায়ের কোলে। দাঁড়ানো ছেলে দুটির মধ্যে যে ছোট সেই নিশ্চয়ই মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলে।
ঠিকই বলেছেন আপনি বললেন মহেশবাবু, তবে দুরির সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য আপনার হবে কি না জানি না, কারণ সে ভাগলওয়া।
অরুণবাবু ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। বীরেন বিলেত চলে যায়। উনিশ বছর বয়সে; তারপর আর ফেরেনি।
ফেরেনি কি?—মহেশবাবুর প্রশ্নে কোথায় যেন একটা খটকার সুর।
ফিরলে কি আর তুমি জানতে না, বাবা?
কী জানি!–সেই একই সুরে বললেন মহেশ চৌধুরী। গত দশ বছর তো সে আমাকে চিঠিও লেখেনি।
ঘরে কেমন একটা থমথমে ভাব এসে গেছিল বলেই বোধহয় সেটা দূর করার জন্য মহেশবাবু হঠাৎ চাঙা হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। —চলুন, আপনাদের আমার বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। অখিল আর ইয়ে যখন এখনও এল না, তখন হাতে কিছুটা সময় আছে।
তুমি উঠছ কেন বাবা, বললেন অরুণবাবু, আমিই দেখিয়ে আনছি।
নো স্যার, আমার প্ল্যান করা আমার বাড়ি, আমিই দেখাব | আসুন, মিঃ মিত্তির।
দোতলায় উত্তরে রাস্তার দিকে একটা চমৎকার চওড়া বারান্দা, সেখান থেকে কানারি হিল দেখা যায়। বেডরুম তিনটে, তিনটোতেই এখন লোক রয়েছে। মাঝেরটায় থাকেন। মহেশবাবু নিজে, এক পাশে বড় ছেলে, অন্য পাশে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে প্রীতীনবাবু। নীচে একটা গোস্টরুম আছে, তাতে এখন রয়েছেন মহেশবাবুর বন্ধু অখিল চক্রবর্তী। অরুণবাবুর দুই সন্তানের মধ্যে বড়টি ছেলে, সে এখন বিলেতে, আর মেয়েটির সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় রয়ে গেছে।
মহেশবাবুর বেডরুমেও দেখলাম কিছু পাথর আর প্রজাপতি রয়েছে। একটা বুকসেলফে পাশাপাশি রাখা অনেকগুলো একরকম দেখতে বইয়ের দিকে ফেলুদার দৃষ্টি গিয়েছিল, ভদ্রলোক বললেন। ওগুলো ওঁর ডায়ারি। চল্লিশ বছর একটানা ডায়রি লিখেছেন। উনি। খাটের পাশে টেবিলে ছোট্ট বাঁধানো ছবি দেখে লালমোহনবাবু বলে উঠলেন, আরে, এ যে দেখছি মুক্তানন্দের ছবি।
মহেশবাবু হেসে বললেন, আমার বন্ধু অখিল দিয়েছে। ওটা। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, তিনটে মহাদেশের শক্তি এঁর পিছনে।
কারেক্ট। বললেন লালমোহনবাবু, বিরাট তান্ত্রিক সাধু। ইন্ডিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা-সর্বত্র এঁর শিষ্য।
আপনি তো অনেক খবর রাখেন দেখছি, বললেন মহেশ চৌধুরী, আপনিও এঁর শিষ্য নাকি?
আজ্ঞে না, তবে আমার পাড়ায় আছেন একজন।
দোতলায় থাকতেই একটা গাড়ির শব্দ পেয়েছিলাম, নীচে এসে দেখি, যে-দুজনের কথা মহেশবাবু বলছিলেন, তাঁরা এসে গেছেন। একজন মহেশবাবুরই বয়সী, সাধারণ ধূতি পাঞ্জাবি আর গাঢ় খয়েরি রঙের আলোয়ান গায়ে। ইনি যে উকিল-টুকিল ছিলেন না কোনওদিন সেটা বলে দিতে হয় না, আর সাহেবিয়াও কোনও গন্ধ নেই। এর মধ্যে; অন্য ভদ্রলোককে মনে হল চল্লিশের নীচে বয়স, বেশ হাসিখুশি সপ্রতিভা ভাব, মহেশবাবু আসতেই তাঁকে টিপ করে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির হাতে মিষ্টির হাঁড়ি ছিল, সেটা তিনি প্রীতীনবাবুর হাতে চালান দিয়ে মহেশবাবুর দিকে ফিরে বললেনগআমার কথা যদি শোনো তো পিকনিকের পরিকল্পনাটা বাদ দাও। একে যাত্রা অশুভ, তার উপর বাঘ পালিয়েছে। শার্দুলবাবাজী যদি মুক্তানন্দের শিষ্যটিষ্য হন তা হলে একবার ছিন্নমস্তায় হাজিরা দেওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়।