যাই হাক, রাত্রে বাঘ এসে থাকলেও সে গর্জন করেনি, তাই টর্চ ফেলারও কোনও দরকার হয়নি।
আমরা প্রীতীনবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক সাড়ে আটটার সময় কৈলাসের লাল ফটকের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। বাইরে থেকে বাড়িটা দেখে লালমোহনবাবু মন্তব্য করলেন যে বোঝাই যাচ্ছে। এ শিব হল সাহেব শিব। সত্যিই, বছর দশেক আগে তৈরি হলেও বাড়ির চেহারাটা সেই পঞ্চাশ বছর আগের ব্রিটিশ আমলের বাড়ির মতো।
দারোয়ান গেট খুলে দিতে আমরা গাড়িটা বাইরে রেখে কাঁকর বিছানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। আরও তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কম্পাউন্ডের এক পাশে একটা কালকের দেখা প্রীতীনবাবুর কালো অ্যামবাসাডর, একটা সাদা ফিয়াট, আর একটা পুরনো হলদে পানটিয়াক।
একটা কু পাওয়া গেছে মশাই।
লালমোহনবাবু বাগান আর রাস্তার মাঝখানে সাদা রং করা ইটের বেড়ার পাশ থেকে একটা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে ফেলুদাকে দিলেন। ফেলুদা বলল, আপনি রহস্যের অবর্তমানেই কু-য়ের সন্ধান পাচ্ছেন?
জিনিসটা কীরকম মিস্টিরিয়াস মনে হচ্ছে না?
একটা রুলটানা খাতার পাতা, তাতে সবুজ কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কিছু, অর্থহীন ইংরিজি কথা। মিস্ট্রির কিছুই নেই; বাঝাই যাচ্ছে সেটা বাচ্চার হাতের লেখা, আর সেই কারণেই কথাগুলোর কোনও মানে নেই। যেমন–OKAHA, RKAHA, LOKC
ওকাহা যে জাপানি নাম সে তো বোঝাই যাচ্ছে বললেন লালমোহনবাবু।
বাংলা নামটা না চিনে জাপানি নামটা চিনে ফেললেন?—বলে ফেলুদা কাগজটা পকেটে পুরে নিল।
একজন ভীষণ বুড়ো মুসলমান বেয়ারা দাঁড়িয়েছিল গাড়িবারান্দার নীচে, সে আমাদের সেলাম করে আইয়ে বলে ভিতরে নিয়ে গেল। একটা চেনা গলা আগে থেকেই পাচ্ছিলাম, বৈঠকখানার চৌকাঠ পেরোতেই প্রীতীনবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।
আসুন, আসুন—সো কাইন্ড অফ ইউ টু কাম।
ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখ চলে যায় দেয়ালের দিকে। তিন দেয়াল জুড়ে ছবির বদলে টাঙানো রয়েছে ফ্রেমে বাঁধানো মহেশ চৌধুরীর সংগ্ৰহ করা পিনে আটা সার সার ডানা মেলা প্রজাপতি। প্রতি ফ্রেমে আটটা, সব মিলিয়ে চৌষট্টি, আর তাদের রঙের বাহারে পুরো ঘরটা যেন হাসছে।
যাঁর সংগ্ৰহ, তিনি সোফায় বসে ছিলেন, আমাদের দেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম এককালে ভদ্রলোক বেশ শক্ত সুপুরুষ ছিলেন। টকটকে রং, দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কামানো, চোখে রিমালেস চশমা, পরনে ফিনফিনে ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি আর ঘন কাজ করা কাশ্মীরি শাল। বুঝলাম এটা মহেশ চৌধুরীর সত্তর বছরের জন্মদিন উপলক্ষে স্পেশাল পোশাক।
প্রীতীনবাবু শুধু ফেলুদার নামটাই জানেন, তাই বাকি দুজনের পরিচয় ফেলুদাকেই দিতে হল। ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই লালমোহনবাবু আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ স্যার!
ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। —থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ! বুড়োমানুষের আবার জন্মদিন। এসব আমার বৌমার কাণ্ড। —যাক আপনারা এসে গিয়ে খুব ভালই হল। হায়ার ইজ দ্য ডেড বডি খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি তো?
প্রশ্নটা শুনে আমার আর লালমোহনবাবুর মুখ একসঙ্গে হাঁ হয়ে গেছে। ফেলুদা কিন্তু ভুরুটা একটু তুলেই নামিয়ে নিল।আজ্ঞে না, অসুবিধা হয়নি।
ভেরি গুড। আমি বুঝেছিলাম। আপনি যখন গোয়েন্দা তখন হয়তো আমার সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারবেন। তবে আপনার দুই বন্ধু মনে হচ্ছে বোঝেননি।
ফেলুদা বুঝিয়ে দিল। কৈলাস হচ্ছে কই লাশ?
এবারে লক্ষ করলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা চিতাবাঘের ছালের উপর বসে একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে ডান হাতে একটা চিমটের মতো জিনিস নিয়ে বাঁ হাতে ধরা একটি বিলিতি ডলের ভুরুর জায়গায় এক মনে চিমটি কাটছে। বোধহয় পুতুলের ভুরু প্লক করা হচ্ছে। আমি ওর দিকে চেয়ে আছি বলেই বোধহয় মহেশবাবু বললেন, ওটি আমার নাতনি; ওর নাম জোড়া মৌমাছি।
আর তুমি জোড়া কাটারি, বলল মেয়েটি।
বুঝলেন তো, মিঃ মিত্তির?
ফেলুদা বলল, বুঝলাম, আপনার নাতনি হলেন বিবি, আর আপনি তার দাদু। লালমোহনবাবু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন দেখে বুঝিয়ে দিলাম। বিবি হচ্ছে Bee-Bee, আর দাদুর দা হল কাটারি। আর দু হল দুই। ফেলুদা আর আমি অনেক সময়ই বাড়িতে বসে কথার খেলা তৈরি করে খেলি, তাই এগুলো বুঝতে অসুবিধা হল না।
প্রীতীনবাবু দাদাকে ডাকি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন; আমরা তিনজনে সোফায় বসিলাম। মহেশবাবুর ঠোঁটের কোণে হাসি, তিনি এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন ফেলুদার দিকে। ফেলুদার তাতে কোনও উসখুসে ভাব নেই, সেও দিব্যি উলটে চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে।
ওয়েল, ওয়েল, ওয়েল, অবশেষে বললেন মহেশ চৌধুরী, সহায় আপনার খুব সুখ্যাতি করছিল, তাই আপনি এসেছেন শুনে তিরিকে বললুম, ভদ্রলোককে ডাক, তাকে একবার দেখি। আমার জীবনেও তো অনেক রহস্য, দেখুন। যদি তার দু-একটাও সমাধান করে দিতে পারেন।
তিরি মানে আপনার তৃতীয় পুত্র কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
রাইট এগেন, বললেন ভদ্রলোক। আমি যে কথা নিয়ে খেলতে ভালবাসি সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
ও বাতিকটা আমারও আছে।
সে তো খুব ভাল কথা। আমার নিজের ছেলেদের মধ্যে টেক্কা তবু একটু আধটু বোঝে, তিরির মাথা এদিকে একেবারেই খেলে না। তা যাক গে–আপনি গোয়েন্দাগিরি করছেন কদ্দিন?
বছর আষ্টেক।
আর উনি কী করেন? মিঃ গাঙ্গুলী?