আপনি বাঘটাকে খুঁজতে গেলেন না যে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ওরাই খুঁজুক না, গভীর অভিমানের সঙ্গে বললেন কারান্ডিকার।
লালমোহনবাবু বিড়বিড় করে ফেলুদাকে বাংলায় বললেন, একটু জিজ্ঞেস করুন তো তেমন তেমন দরকার পড়লে উনি যাবেন কি না। খবরটা পেলে বাঘ ধরা দেখা যেত। অবিশ্যি একা নয়, ইন ইওর কম্পানি। খুব খ্রিলিং ব্যাপার হবে নিশ্চয়ই।
ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে কারান্ডিকার বললেন যে বাঘকে গুলি করে মারার প্রস্তাব উঠলে তাঁকে যেতেই হবে বাধা দিতে, কারণ সুলতান ওঁর আত্মীয়ের বাড়া!
আমিও একটা জিনিস জিজ্ঞেস করার কথা ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত ফেলুদাই করল।
আপনার মুখে কি বাঘ কোনওদিন আঁচড় মেরেছিল?
নট সুলতান, বললেন কারান্ডিকার। গোল্ডেন সার্কাসের বাঘ। গাল আর নাকের খানিকটা মাংস তুলে নিয়েছিল।
কথাটা বলে কারান্ডিকার তাঁর শর্ট খুলে ফেললেন। দেখলাম বুকে পিঠে কাঁধে কত যে আঁচড়ের দাগ রয়েছে তার হিসেব নেই।
আমরা ভদ্রলোককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লাম। তাঁবু থেকে বেরোবার সময় ফেলুদা বলল, আপনি এখন এখানেই থাকবেন?
কারান্ডিকার গভীর হয়ে বললেন আজি সতেরো বছর আমি সকাসের তাঁবুকেই ঘর বলে জেনেছি। এবার বোধহয় নতুন ডেরা দেখতে হবে।
লালমোহনবাবু মিঃ কুট্টিকে বলে রেখেছিলেন যে তিনি ম্যাজেস্টিকের পশুশালাটা একবার দেখতে চান। মুরুগশের সঙ্গে গিয়ে আমরা সাকসের অবশিষ্ট দুটি বাঘ, একটা বেশ বড় ভাল্লুক, একটা জলহস্তী, তিনটে হাতি, গোটা ছয়েক ঘোড়া আর সুলতানের গা ছমছম করা খালি খাঁচটা দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল পাঁচটা। বুলাকিপ্ৰসাদকে চা দেবার জন্য ডেকে পাঠাতে সে বলল, চৌধুরী সাহেবের বাড়ি থেকে একজন বাবু এসেছিলেন, বলে গেছেন আবার আসবেন।
সাড়ে ছটায় এলেন প্রীতীন্দ্ৰ চৌধুরী। ইতিমধ্যে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ঝাপ্ করে ঠাণ্ডা পড়েছে, আমরা সবাই কোিট পুলোভার চাপিয়ে নিয়েছি, লালমোহনবাবুর মাঙ্কিক্যাপটা পরার মতো ঠাণ্ডা এখনও পড়েনি, কিন্তু ওঁর টাক বলে উনি রিক্স না নিয়ে এর মধ্যেই ওটা চাপিয়ে বসে আছেন।
আপনি যে ডিটেকটিভ সেটা তো বলেননি! আমাদের তিনজনকেই অবাক করে দিয়ে বললেন প্রীতীন্দ্ৰ চৌধুরী। -বাবা তো আপনার মক্কেল মিঃ সহায়কে খুব ভাল করে। চেনেন। সহায় ওঁকে জানিয়েছেন যে আপনারা এখানে আসছেন। বুঝাবা বিশেষ করে বলে। দিয়েছেন। আপনারা তিনজনেই যেন কাল আমাদের সঙ্গে পিকনিকে আসেন।
পিকনিক? লালমোহনবাবু ভুরু কপালে তুলে প্রশ্ন করলেন।
বলেছিলাম না-কাল বাবার জন্মদিন। আমরা সবাই যাচ্ছি। রাজরা প্লা পিকনিক করতে। দুপুরে ওখানেই খাওয়া। আপনাদের তো গাড়ি রয়েছে, নটা নাগাত আমাদের ওখানে চলে আসুন। বাড়ির নাম কৈলাস। আপনাদের ডিরেকশন দিয়ে দিচ্ছি, খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হবে না।
রাজরাপ্পা হাজারিবাগ থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূর, জলপ্রপাত আছে, চমৎকার দৃশ্য, আর একটা পুরনো কালীমন্দির আছে—~নাম ছিন্নমস্তার মন্দির। এসব আমরা আসবার আগেই জেনে এসেছি, আর পিকনিকের নেমস্তন্ন না হলো নিজেরাই যেতাম।
প্রীতীনবাবু আরও বললেন যে আমরা যদি একটু আগে আগে যাই, তা হলে মহেশবাবুর প্রজাপতি আর পাথরের কালেকশনটাও দেখা হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু পিকনিকে যে যাচ্ছেন আপনারা, বাঘ পালানোর খবরটা জানেন কি? ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন জটায়ু।
জানি বইকী। হেসে বললেন প্রীতীনবাবু, কিন্তু তার জন্য ভয় কী? সঙ্গে বন্দুক থাকবে। আমার বড়দা ক্র্যাক শাট। তা ছাড়া বাঘ তো শুনেছি উত্তরে হানা দিচ্ছে, রাজরাপ্লা তো দক্ষিণে, রামগড়ের দিকে। কোনও ভয় নেই।
ঠিক হল আমরা সাড়ে আটটা নাগাত মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে পৌঁছে যাৰ। লালমোহনবাবু, কৈলাস নাম দিল কেন, মশাই-এর উত্তরে ফেলুদা বলল, শিবের বাসস্থান কৈলাস, আর মহেশ শিবের নাম, তাই কৈলাস।
প্রীতীনবাবু চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার হয়ে এল। আমরা বারান্দায় বেতের চেয়ারে এসে বাতিটা জ্বাললাম না, যাতে চাঁদের আলো উপভোগ করা যায়। ছিন্নমস্তার মন্দিরের কথাটা লালমোহনবাবু জানতেন না, তাই বোধহয় মাঝে মাঝে নামটা বিড়বিড় করছিলেন। সাতবারের বার ছিন বলেই থেমে যেতে হল, কারণ ফেলুদা হাত তুলেছে।
আমরা তিনজনেই চুপ, ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই, এমন সময় শোনা গেল।–বেশ দূর থেকে, তাও গায়ের রক্ত জল করা-বাঘের গর্জন। একবার, দুবার, তিনবার।
সুলতান ডাকছে।
কোনদিক থেকে, কতদূর থেকে, সেটা বুঝতে হলে শিকারির কান চাই।
০৩. সার্কাসের বাঘ পালানো
আমি ভেবেছিলাম যে সার্কাসের বাঘ পালানোটাই বুঝি হাজারিবাগের আসল ঘটনা হবে; কিন্তু তা ছাড়াও যে আরও কিছু ঘটবে, আর ফেলুদা যে সেই ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়বে, সেটা কে জানত? ২৩শে নভেম্বর মহেশ চৌধুরীর বার্থডে পিকনিকের কথাটা অনেক’দিন মনে থাকবে, আর সেই সঙ্গে মনে থাকবে রাজরাল্পীর আশ্চর্য সুন্দর রুক্ষ পরিবেশে ছিন্নমস্তার মন্দির।
কাল রাত্ৰে বাঘের ডাক শোনার পথ থেকেই লালমোহনবাবুর মুখটা জানি কেমন হয়ে গিয়েছিল, ভাবছিলাম বলি উনি আমাদের ঘরে আমার সঙ্গে শোন, আর ফেলুদা পশ্চিমের ঘরটা নিক, কিন্তু সেদিকে আবার ভদ্রলোকের গোঁ আছে। চৌকিদারের কাছে টাঙি আছে। জেনে, আর লোকটা বেঁটে হলেও সাহসী জেনে ভদ্রলোক খানিকটা আশ্বাস পেয়ে নিজের তিন সেলের টর্চের বদলে আমাদের পাঁচ সেলটা নিয়ে দশটা নাগাত নিজের ঘরে চলে গেলেন। বড় টর্চ নেওয়ার কারণ এই যে, ফেলুদা বলেছে। তীব্র আলো চোখে ফেললে বাঘ নাকি অনেক সময় আপনা থেকেই সয়ে পড়ে। –অবিশ্যি জানালার বাইরে যদি গর্জন শোনেন, তখন টর্চ জ্বালানোর কথা, আর সেই টর্চ জানালার বাইরে বাঘের চোখে ফেলার কথা, মনে থাকবে কি না সেটা জানি না।