ফেলুদা প্রথমেই বলে নিল যে ও পুলিশের লোক নয়, সার্কাস ওর খুব প্রিয় জিনিস, গ্রেট ম্যাজেস্টিকের খ্যাতির কথা ও জানে, হাজারিবাগে এসে সাকৰ্গস দেখার ইচ্ছে ছিল, আপশোঁস এই যে একটা দুর্ঘটনার জন্য আসল খেলাটাই দেখা হবে না। সেই সঙ্গে লালমোহনবাবুরও পরিচয় করিয়ে দিল। একজন বিশিষ্ট লেখক বলে। —সার্কাস নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভাবছেন মিঃ গাঙ্গুলী।
মিঃ কুট্টি বললেন, সাকসে আসার আগে ছবছর উনি কলকাতায় একটা জাহাজ কোম্পানিতে ছিলেন, বাঙালিদের ভালবাসেন, কারণ বাঙালিরাই নাকি সাকসের সত্যিকার কদর করে। আমরা সার্কাস দেখায় নিরুৎসাহ বোধ করছি জেনে বললেন যে বাঘের খেলা ছাড়াও অনেক কিছু দেখার আছে গ্রেট ম্যাজেস্টিকে। –কাল আমাদের স্পেশাল, শো ছিল, হাজারিবাগের অনেক নামকরা লোককে আমরা ইনভাইট করেছিলাম। আপনাদেরও ইনভাইট করছি।
ব্যাপারটা হল কী ভাবে? লালমোহনবাবু হিন্দি আর ইংরিজি মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। (আসলে জিজ্ঞেস করেছিলেন–শের তো ভাগা, বাট হাউ?)
ভেরি আনফরচুনেট, মিঃ গাঙ্গুলী, বললেন মিঃ কুট্টি। বাঘের খাঁচার দরজাটা ঠিক ভাবে বন্ধ করা হয়নি। বাঘ নিজেই সেটাকে মাথা দিয়ে ঠেলে তুলে পালিয়েছে। তার উপর আর একটা গলতি হয়েছে। এই যে টিনের বেড়ার একটা অংশ কে জানি ফাঁক করে বাইরে যাবে। বলে শর্টকাট করেছিল তারপর আর বন্ধ করেনি। কে দাষী সেটা আমরা বার করেছি, আর তার জন্য প্রপার স্টেপস নিচ্ছি।
ফেলুদা বলল, বম্বেতে একবার ঠিক এইভাবে বাঘ পালিয়েছিল না?
হ্যাঁ, ন্যাশনাল সার্কাস। শহরের রাস্তায় বেরিয়ে গিয়েছিল বাঘ। কিন্তু বেশি দূর যাবার আগেই রিং-মাস্টার তাকে ধরে নিয়েছিল।
এখানকার বাঘ পালানোর ব্যাপারে আরও খবর জানলাম কুট্টির কাছে। কম করে জনা পঞ্চাশেক লোক নাকি বাঘটাকে তাঁবুর বাইরে দেখেছে। এক পেট্রোল স্টেশনের মালিকের বাড়ির উঠোনে নাকি বাঘটা ঢুকেছিল। ভদ্রলোকের স্ত্রী সেটাকে দেখতে পেয়ে ভিরমি যান। এক নেপালি ভদ্রলোক স্কুটারে যাচ্ছিলেন, তিনি বাঘটাকে রাস্তা পেরোতে দেখে সোজা ল্যািম্পপেস্টে ধাক্কা মেরে পাঁজরার তিনটে হাড় ভেঙে এখন হাসপাতালে আছেন।
আচ্ছা, আপনাদের তো রিং-মাস্টার আছে নিশ্চয়ই?
রিং-মাস্টার কথাটা নতুন শিখে সেটা ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারলেন না জটায়ু।
কে, কারান্ডিকার? তার শরীর কিছুদিন থেকে এমনিতেই খারাপ যাচ্ছে। বয়স হয়েছে নিয়ারলি ফর্টি। ঘাড়ে একটা ব্যথা হয় মাঝে মাঝে, তাই নিয়েই খেলা দেখায়। আমার কথা শুনবে না, ডাক্তার দেখাবে না। মাস খানেক হল তাই আমি আর একজন লোক রেখেছি। নাম চন্দ্রন। কেরলের লোক! ভেরি গুড। সেও বাঘ ট্রেন করে, কারান্ডিকার অসুস্থ হলে সে-ই খেলা দেখায়।
কাল স্পেশাল শো-তে দেখিয়েছিল? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কাল কারান্ডিকারই দেখিয়েছিল। একটা খেলা ও ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারে না। খেলার ক্লাইম্যাক্সে দুহাতে বাঘের মুখ ফাঁক করে তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। দুঃখের বিষয়, কাল একটা বিশ্ৰী গণ্ডগোল হয়ে যায়। দুবার চেষ্টা করেও যখন বাঘ মুখ খুলল না, তখন কারান্ডিকার হঠাৎ চেষ্টা থামিয়ে দিয়ে খেলা শেষ করে দেয়। ফলে হাততালির সঙ্গে তাকে কিছু টিটকিরিও শুনতে হয়েছিল।
আপনি তাতে কোনও স্টেপ নেননি?
নিয়েছি বইকী। পুরনো লোক, কিন্তু তাও কথা শোনাতে হল। ও সতেরো বছর কাজ করছে সাকাসে। প্ৰথম তিন বছর গোলেন্ডনে ছিল, বাকি সময়টা এখানে। ওর যা নাম তা আমার সাকাসে খেলা দেখিয়েই! এখন বলছে কাজ ছেড়ে দেবে। খুবই দুঃখের কথা, কারণ অন্তত আরও বছর তিনেক ও কাজ করতে পারত বলে আমার বিশ্বাস।
বাঘ খুঁজতে সার্কাসের লোক যায়নি?
কারান্ডিকারেরই যাবার কথা ছিল, কিন্তু ও রাজি হয়নি। তাই চন্দ্রনকে যেতে হয়েছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকের সঙ্গে!
লালমোহনবাবুর সাহস বেড়ে গেছে। বললেন, কারান্ডিকারের সঙ্গে দেখা করা যায়? কোনও গ্যারান্টি দিতে পারি না, বললেন মিঃ কুট্টি, খুব মুডি লোক। মুরুগোশের সঙ্গে যান আপনারা গিয়ে দেখুন। সে দেখা করে কি না।
মুরুগোশ হল মিঃ কুট্টির পাসোনাল বেয়ারা। সে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল, মন্নিবের হুকুমে আমাদের তিনজনকে নিয়ে গেল রিং-মাস্টারের তাঁবুতে।
তাঁবুর ভিতরে দুটো ভাগ; একটা বসার জায়গা, আর একটা শোবার। আশ্চর্য এই যে খবর দিতেই বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন রিং-মাস্টার। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে বলে দিতে হয় না যে উনি একজন অত্যন্ত শক্তিশালী পুরুষ, বাঘের খেলা দেখানোর পক্ষে এর চেয়ে উপযুক্ত চেহারা আর হয় না। লম্বায় ফেলুদার সমান, চওড়ায় ওর দেড়া। ফরসা রঙে কুচকুচে কালো চাড়া-দেওয়া গোঁফটা আশ্চর্য খুলেছে, চোখের দৃষ্টি এখন উদাস হলেও হঠাৎ হঠাৎ এক একটা কথা বলতে জ্বলে ওঠে। ভদ্রলোক জানিয়ে দিলেন যে তিনি মারাঠি মালয়ালম তামিল আর ভাঙা ভাঙা ইংরিজি আর হিন্দি জানেন। শেষের দুটো ভাষাতেই কথা হল।
কারান্ডিকার প্রথমেই জানতে চাইলেন আমরা কোনও খবরের কাগজ থেকে আসছি কি না। বুঝলাম ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর হাতে খাতা পেনসিল দেখেই প্রশ্নটা করেছেন। ফেলুদা প্রশ্নের জবাবটা যেন বেশ হিসেব করে দিল।
যদি তাই হয়, তা হলে আপনার কোনও আপত্তি আছে?
আপত্তি তো নেইই, বরং সেটা হলে খুশিই হব। এটা পাবলিকের জানা দরকার যে বাঘ পালানোর জন্য ট্রেনার কারান্ডিকার দায়ী নয়, দায়ী সার্কাসের মালিক। বাঘ দুজন ট্রেনারকে মানে না, একজনকেই মানে। অন্য ট্রেনার আঁসার পর থেকেই সুলতানের মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিল। আমি সেটা মিঃ কুট্টিকে বলেছিলাম, উনি গা করেননি। এখন তার ফল ভোগ করছেন।