সুটকেস থেকে জিনিস বার করে বাইরে রাখছি, এমন সময় বুলকিপ্রসাদ আমার ঘরে চা নিয়ে এসে ট্ৰেটা টেবিলের উপর রেখে যে কথাটা বলল, তাতে আমাদের দুজনেরই কাজ বন্ধ করে ওর দিকে চাইতে হল। লালমোহনবাবু সবে ঘরে ঢুকেছেন, তিনিও দরজার মুখটাতেই দাঁড়িয়ে গেলেন।
আপলোগ যব বাহার যাঁয়ে, বলল বুলাকিপ্রসাদ পয়দল যানেসে যারা সমহালকে যান।
চোর ডাকাতের কথা বলছে নাকি মশাই? বললেন লালমোহনবাবু।
নেহি, বাবু; বাঘ ভাগ গিয়া মজিস্টি সর্কস সে।
সর্বনাশ! লোকটা বলে কী!
জিজ্ঞেস করতে জানা গেল। আজই সকলে নাকি একটা তাগড়াই বাঘ সার্কাসের খাঁচা থেকে পালিয়েছে। কী করে পালিয়েছে সেটা বুলকিপ্রসাদ জানে না, কিন্তু সেই বাঘের ভয়ে সারা হাজারিবাগ শহর তটস্থ। বাঘের খেলাই নাকি এক সার্কাসের ষাকে বলে স্টার অ্যাট্রাকশন। সার্কাসের বিজ্ঞাপনাও যা দেখেছি, তাতে বাঘের ছবিটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। ফেলুদার অবিশ্যি চোখই আলাদা, তাই সে আমাদের চেয়ে বেশি দেখেছে। বলল, বাঘের খেলা যিনি দেখান। তিনি নাকি মারাঠি, নাম কারান্ডিকার, আর নামটা নাকি বিজ্ঞাপনে দেওয়া ছিল।
লালমোহনবাবু খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন তার গল্পে বাঘ পালানোর ঘটনা একটা রাখা যায় কি না সেটা তিনি ভাবছিলেন, কাজেই এটাকে টেলিপ্যাথি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। —তবে আপনি মশাই একেবারে ইন্কঙ্গিটো হয়ে থাকুন, গোয়েন্দা জানলে আপনাকে নিঘাত ওই বাঘ সন্ধানের কাজে লাগিয়ে দেবে।
ইনকাঙ্গিটা অবিশ্যি ইনকগনিটের জটায়ু সংস্করণ। লালমোহনবাবু মাঝে মাঝে ইংরিজি কথায় এরকম ওলট পালট করে ফেলেন। খবরটা শুনে এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে তাঁকে আর শুধরে দেওয়া হল না। ফেলুদা অবিশ্যি অকারণে কখনও ওর পেশািটা প্রকাশ করে না। আর গোয়েন্দা বলেই যে ওকে যে কেউ যে কোনও তদন্তে ফাঁসিয়ে দেবে। সেটারও কোনও সম্ভাবনা নেই।
বুলাকিপ্রসাদ আরও বলল যে সাকাসটা নাকি আগে শহরের মাঝখানে কার্জন মাঠে বসন্ত, এইবারই নাকি প্রথম সেটা শহরের এক ধারে একটা নতুন জায়গায় বসেছে; এই মাঠটাির উত্তরে নাকি বিশেষ বসতি নেই। বাঘ যদি সেদিক দিয়ে বেরোয় তা হলে রাস্তা পেরিয়ে কিছুদূর গিয়েই জঙ্গল পাবে। কাছাকাছি আদিবাসীদের গ্রাম আছে, খিদে পেলে সেখান থেকে গোরু বাছুর টেনে নিয়ে যাওয়া কিছুই আশ্চর্য নয়।
মোটকথা, ঘটনাটা চাঞ্চল্যকর। আপশোস এই যে হাজারিবাগের মতো জায়গায় এসে বাঘের ভয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়ানো যাবে না।
চা খাওয়ার পর লালমোহনবাবু প্ৰস্তাব করলেন যে দুপুরে একবার গ্রেট ম্যাজেস্টিকে ঢুঁ মারা হাক। ঘটনাটা ঠিক কী ভাবে ঘটেছে সেটা জানতে পারলে নাকি ওঁর খুব কাজে দেবে। ঢুঁ মারা মানে কি টিকিট কেটে সার্কাস দেখার কথা ভাবছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ঠিক তা নয়, বললেন লালমোহনবাবু, আমি ভাবছিলাম। যদি খোদ মালিকের সঙ্গে দেখা করা যায়। অনেক ডিটেলস জানা যেত ওঁর কাছে।
সেটা ফেলুমিত্তিরের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।
০২. বেরিয়ে পড়লাম আমরা
বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বুঝতে পারলাম ফেলুদারও যথেষ্ট কৌতুহল আছে। এই বাঘ পালানোর ব্যাপারে। বেক্লোবার আগে থানায় একটা ফোন করল। কোডাময়ি ওকে বিহার পুলিশের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল, সৰ্বেশ্বর সহায়কেও এখানে সবাই চেনে, তাই নাম করতেই ইনস্পেক্টর রাউত ফেলুদাকে চিনে ফেললেন। আসলে পুলিশের সাহায্য ছাড়া হয়তো এই জরুরি অবস্থায় সার্কাসের মালিকের সঙ্গে দেখা করা মুশকিল হত। রাউত বললেন, সার্কাসের সামনে পুলিশের লোক থাকবে, ফেলুদার কোনও অসুবিধা হবে না। ফেলুদা এটাও বলে দিল যে সে কোনওরকম তদন্ত করতে যাচ্ছে না, কেবল কৌতুহল মেটাতে যাচ্ছে।
সমস্ত শহরে যে সাড়া পড়ে গেছে সেটা গাড়িতে যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারছিলাম। শুধু যে রাস্তার মোড়ে জটিল তা নয়, একটা চৌমাথায় দেখলাম ঢািড়া পিটিয়ে লোকদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। ফেলুদা একটা পানের দোকানো চারমিনার। কিনতে নেমেছিল, সেখানে দোকানদার বলল যে বাঘটাকে নাকি উত্তরে ডাহিরি বলে একটা আদিবাসী গ্রামের কাছাকাছি দেখা গেছে, তবে কোনও উৎপাতের কথা এখনও শোনা যায়নি।
সাকসের তাঁবু দেখলেই বুকের ভিতরটা কেমন জানি করে ওঠে, ছেলেবেলা ফেলুদার সঙ্গে কত সার্কাস দেখেছি সে কথা মনে পড়ে যায়। গ্রেট ম্যাজেস্টিকের সাদা আর নীল ডোরাকাটা ছিমছাম। তাঁবুটা দেখলেই বোঝা যায় এটা জাত সাকাস। তাঁবুর চূড়োয় ফরফর করে হলদে ফ্ল্যাগ উড়ছে, চুড়ো থেকে বেড়া অবধি টেনে আনা দড়িতে আরও অজস্র রঙিন ফ্ল্যাগ। তাঁবুর গেটের বাইরে কমপক্ষে হাজার লোক, তারা অনেকেই টিকিট কিনতে এসেছে। বাঘ পালানোয় সার্কাস বন্ধ হয়নি, শুধু আপাতত বাঘের খেলাটাই স্থগিত। আরও কতরকম খেলা যে সে সাকাসে দেখানো হয় সেটা হাতে আঁকা প্রকাণ্ড বড় বড় বিজ্ঞাপনে বোঝানো হয়েছে। শিল্পী খুব পাকা নন, তবে লোকের মনে চনমনে ভাব আনতে এই যথেষ্ট।
পুলিশের লোক গেটের বাইরেই ছিল। ফেলুদা কার্ডটা দিতেই খুব খাতির করে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। বলল, মালিক মিঃ কুট্টিকেও বলা আছে, তিনি তাঁর ঘরে অপেক্ষা করছেন।
তাঁবুঢ়াকে ঘিরে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে তারপর টিনের বেড়া। এই বেড়ার মধ্যেই একধারে দাঁড়িয়ে আছে দ্য গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসের মালিক মিঃ কুট্টির ক্যারাভ্যান। বলা যায় একটা সুদৃশ্য চলন্ত বাড়ি। দুপাশের সার বাঁধা কাচের জানালায় নকশা করা পদার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ ঢুকেছে। ভিতরে আবছা অন্ধকারে। মিঃ কুট্টি চেয়ার ছেড়ে উঠে আমাদের তিনজনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বসবার জন্য মিনি-সোফা দেখিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের গায়ের রং মাজা, বয়স পঞ্চাশের বেশি না হলেও মাথার চুল ধপধাপে সাদা, হাসলে বোঝা যায় দাঁতও চুলের সঙ্গে মানানসই, যদিও ফলস টিথ নয়।