পাগলের প্রলাপ! পাগলের প্রলাপ বকছেন আপনি!
সাক্ষী আছে, অরুণবাবু-একজন নয়, তিনজন—যদিও তাঁরা কেউই সাহস করে সেটা প্রকাশ করেননি। আপনার ভাই সাক্ষী–অখিলবাবু সাক্ষী–শঙ্করলাল সাক্ষী।
সাক্ষী যেখানে নির্বাক, সেখানে আপনার অভিষোগ প্রমাণ করছেন কী করে, মিঃ মিত্তির?
উপায় আছে, অরুণবাবু। তিনজন ছাড়াও আরেকজন আছে যে নির্দ্বিধায় সমস্ত সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করবে।
কৈলাসের বৈঠকখানায় পাখির ডাক কেন? জলপ্রপাতের শব্দ কেন?
অবাক হয়ে দেখলাম ফেলুদা তার কোটের পকেট থেকে প্রীতীনবাবুর ক্যাসেট রেকর্ডার বার করেছে।
সেদিন একটি ঘটনা দেখে এবং কয়েকটি কথা শুনে বিহ্বল হয়ে প্রীতীনবাবু হাত থেকে এই যন্ত্রটা ফেলে দেন। নীলিমা দেবী এটা কুড়িয়ে নেন। এই যন্ত্রতে পাখির ডাক ছাড়াও আরও অনেক কিছু রেকর্ড হয়ে গেছে, অরুণবাবু।
এইবারে দেখলাম অরুণবাবুর মুখ ক্ৰমে লাল থেকে ফ্যাকাসের দিকে চলেছে। ফেলুদার ডান হাতে রিভলবার, বা হাতে টেপ রেকর্ডার।
পাখির শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে। ক্রমে এগিয়ে আসছে গলার স্বর, স্পষ্ট হয়ে আসছে। অরুণবাবুর গলা–
বাবা, বীরু ফিরে এসেছে। এ ধারণা তোমার হল কী করে?
তারপর মহেশবাবুর উত্তর—
বুড়ো বাপের যদি তেমন ধারণা হয়েই থাকে, তাতে তোমার কী?
তোমার এ বিশ্বাস মন থেকে দূর করতে হবে। আমি জানি সে আসেনি, আসতে পারে না। অসম্ভব।
আমার বিশ্বাসেও তুমি হস্তক্ষেপ করবে?
হ্যাঁ, করব। কারণ বিশ্বাসের বশে একটা অন্যায় কিছু ঘটে যায় সেটা আমি চাই না।
কী অন্যায়?
আমার যা পাওনা তা থেকে বঞ্চিত করতে দেব না তোমাকে আমি।
কী বলছি তুমি!
ঠিকই বলছি। একবার উইল বদল করেছ, তুমি বীরু আসবে না ভেবে। তার পর আবার–
উইল আমি এমনিও চেঞ্জ করতাম।—মহেশবাবুর গলার স্বর চড়ে গেছে; তাঁর পুরনো রাগ যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি বলে চলেছেন–
তুমি আমার সম্পত্তির ভাগ পাবার আশা করা কী করে? তুমি অসৎ, তুমি জুয়াড়ি, তুমি চোর –লজ্জা করে না? আমার আলমারি থেকে দোরাবাজীর দেওয়া স্ট্যাম্প অ্যালবাম–
মহেশবাবুর বাকি কথা অরুণবাবুর কথায় ঢাকা পড়ে গেল। তিনি উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠেছেন–
আর তুমি? আমি যদি চোর হই। তবে তুমি কী? তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না? দীনদয়ালের কী হয়েছিল। আমি জানি না? তোমার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সব দেখেছিলাম আমি পদার ফাঁক দিয়ে। পঁয়ত্রিশ বছর আমি মুখ বন্ধ রেখেছি। তুমি দীনদয়ালের মাথায় বাড়ি মেরেছিলে পিতলের বুদ্ধমূর্তি দিয়ে। দীনদয়াল মরে যায়। তারপর নূর মহম্মদ আর ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়িতে করে তার লাশ–
এর পরেই একটা ঝুপ শব্দ, আর কথা বন্ধ। তার পর শুধু পাখির ডাক আর জলের শব্দ।
টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে সেটা প্রীতীনবাবুকে ফেরত দিয়ে দিল ফেলুদা।
মিনিটখানেক সকলেই চুপ, আর সকলেই কাঠ, এক ফেলুদা ছাড়া।
ফেলুদা রিভলবার চালান দিল পকেটে। তার পর বলল, আপনার বাবা গৰ্হিত কাজ করেছিলেন, সাংঘাতিক অন্যায় করেছিলেন, সেটা ঠিক, কিন্তু তার জন্য তিনি পঁয়ত্ৰিশ বছর যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, যত রকমে পেরেছেন প্ৰায়শ্চিত্ত করেছেন; তবুও তিনি শান্তি পাননি। যেদিন সেই ঘটনা ঘটে, সেইদিন থেকেই তাঁর ধারণা হয়েছে যে, তাঁর জীবনটা অভিশপ্ত, তাঁর অন্যায়ের শাস্তি তাঁকে একদিন না এক’দিন পেতেই হবে। অবিশ্যি সেই শাস্তি এভাবে তাঁর নিজের ছেলের হাত থেকে আসবে, সেটা তিনি ভেবেছিলেন কি না জানি না। অরুণবাবু, পাথরের মতো বসে আছেন মেঝের বাঘছালটার দিকে একদৃষ্টি চেয়ে। যখন কথা বললেন, তখন মনে হল তাঁর গলার স্বরটা আসছে অনেক দূর থেকে।
একটা কুকুর ছিল; আইরিশ টেরিয়ার। বাবার খুব প্রিয়। দীনদয়ালকে দেখতে পারত। না কুকুরটা। এক’দিন কামড়াতে যায়। দীনদয়াল লাঠির বাড়ি মারে। কুকুরটা জখম হয়। বাবা ফেরেন রাত্তিরে-পার্টি থেকে। কুকুরটা ওঁর ঘরেই অপেক্ষা করত। সেদিন ছিল না। নূর মহম্মদ ঘটনাটা বলে। বাবা দীনদয়ালকে ডেকে পাঠান। রাগলে বাবা আর মানুষ থাকতেন না…
ফেলুদার সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। অখিলবাবুও উঠছেন দেখে ফেলুদা বলল, আপনি একটু আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। কি? কাজ ছিল।
চলুন, বললেন ভদ্রলোক, মহেশ চলে গিয়ে আমার তো এখন অখণ্ড অবসর।
১২. গাড়িতে অখিলবাবু বললেন
গাড়িতে অখিলবাবু বললেন—আমার নাম লেখা পাথরটার পাশে দাঁড়িয়েই আমি ওদের কথা শুনতে পাই। তাকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছি। সে হঠাৎ হঠাৎ এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে কেন। সে ঠাট্টা করে বলত—তুমি গুনে বার করো, আমি বলব না। আশ্চৰ্য্য-তার জীবনের এত বড় একটা ঘটনা—সেটা কুষ্ঠিতে ধরা পড়ল না কেন বুঝতে পারছি না! হয়তো আমারই অক্ষমতা।
বাড়ির কাছাকাছি। যখন পৌঁছেছি তখন বুঝতে পারলাম ফেলুদা কাকে ফোন করেছিল।
ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শঙ্করলাল মিশ্র।
আপনার মিশন সাকসেসফুল? গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
হ্যাঁ, বললেন শঙ্করলাল, বীরেন এসেছে।
আমরা বৈঠকখানায় ঢুকতে সেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করলেন। লম্বা চুল, রুক্ষ লম্বা দাড়ি, লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা।
বাপের শেষ ইচ্ছার কথা শুনে বীরেন। আসতে রাজি হল, বললেন শঙ্করলাল, মহেশবাবুর উপর কোনও আক্রোশ নেই ওর।