চন্দ্ৰন যদিও এক পা এক পা করে এগোচ্ছে বাঘটার দিকে, তাকে দেখে মনে হয় না যে তার নিজের উপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সে যে একবার জখম হয়েছে এই বাঘেরই হাতে সেটা সে নিশ্চয়ই ভুলতে পারছে না।
আমি আড়চাখে মাঝে মাঝে দেখছি অরুণবাবুর দিকে। তিনি যেভাবে বন্দুক উচিয়ে স্থির লক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, বেশ বুঝতে পারছি। সুলতান বেসামাল কিছু করলেই বন্দুক গৰ্জিয়ে উঠে তাকে ধরাশায়ী করে দেবে। আমার বাঁ পাশে দু পা সামনে ফেলুদা পাথরের মতো দাঁড়ানো, ডাইনে লালমোহনবাবু, তাঁর মুখ এমনভাবে হাঁ হয়ে রয়েছে যে মনে হয় না। চোয়াল আর কোনওদিনও উঠবে। (ভদ্রলোক পরে বলেছিলেন যে, তাঁর ছেলেবিয়সে তিনি যত সাকাসে যত বাঘের খেলা দেখেছিলেন, তার সমস্ত স্মৃতি নাকি মুছে গেছে আজকের হাজারিবাগের বনের মধ্যে দেখা এই সাকাসে।)
চন্দ্ৰন যখন পাঁচ হাতের মধ্যে, তখন সুলতান হঠাৎ তার সমস্ত মাংসপেশি টান করে শরীরটা একটু নিচু করল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ফেলুদা একটা নিঃশব্দ লাফে অরুণবাবুর ধারে পৌঁছে গিয়ে তাঁর বন্দুকের নলের উপর হাত রেখে মৃদু চাপে সেটাকে নামিয়ে দিল।
সুলতান!
গুরুগম্ভীর ডাকটা এসেছে আমাদের ডান দিক থেকে। যিনি ডাকটা দিয়েছেন, তাঁকে আগে থেকে দেখতে পেয়েই যে ফেলুদা এই কাজটা করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সুলতান! সুলতান!
গম্ভীর স্বরটা নরম হয়ে এল। অবাক হয়ে দেখলাম রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন রিং-মাস্টার কারান্ডিকার; এরও হাতে চাবুক, পরনে সাধারণ প্যান্ট আর শার্ট। গলা অনেকখানি নামিয়ে নিয়ে পোষা কুকুর বা বেড়ালকে যেমন ভাবে ডাকে, সেই ভাবে ডাকতে ডাকতে কারান্ডিকার এগিয়ে গেলেন সুলতানের দিকে।
চন্দ্রন হতভম্ব হয়ে পিছিয়ে গেল। অরুণবাবুর বন্দুক ধীরে নেমে গেল। বনবিভাগের কর্তার মুখ লালমোহনবাবুর মুখের মতোই হাঁ হয়ে গেল। বনের মধ্যে এগারো জন হতবাক দর্শক দেখল গ্রেট ম্যাজেস্টিক সাকর্মসের ব্রিং-মাস্টার কী আশ্চর্য কৌশলে পালানো বাঘকে বশ করে তার গলায় চেন পরিয়ে দিল, আর তার পর সেই চেন ধরে সুলতানকে জঙ্গলের মধ্যে থেকে বার করে নিয়ে এল একেবারে সার্কাসের খাঁচার কাছে। তারপর খাঁচার দরজা খুলে তার বাইরে টুল রেখে দিল সাকর্মসের লোক, আর কারান্ডিকার চাবুকের এক আছাড়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘আপ্!’ বলতেই সেই বাঘ তীরবেগে ছুটে গিয়ে টুলে পা দিয়ে আবার সাকসের খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল।
আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিলাম; বাঘ খাঁচায় বন্দি হওয়া মাত্র কারান্ডিকার আমাদের দিকে ফিরে একটা সেলাম ঠুকলি। তারপর সে একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এটা একটা প্ৰাইভেট ট্যাক্সি, আগে ছিল না।
গাড়িটা চলে যাবার পর অরুণবাবুকে বলতে শুনলাম, ব্রিলিয়ান্ট। তার পর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, থ্যাঙ্কস।
১১. কৈলাসে ফিরে এসে
কৈলাসে ফিরে এসে ফেলুদা প্রথমে অরুণবাবুর অনুমতি নিয়ে একটা টেলিফোন করল, কাকে জানি না। তারপর বৈঠকখানায় এল, যেখানে আমরা সবাই বসেছি। নীলিমা দেবী চা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওঁরা তিনজনে কালই কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন; মহেশবাবুর শ্ৰাদ্ধ কলকাতাতেই হবে। অখিলবাবুকে বাঘের খবরটা দেওয়াতে তিনি ঘটনাটা দেখতে পেলেন। না বলে খুব আপশোস করলেন।
আমিও ভাবছি। কালই বেরিয়ে পড়ব, বললেন অরুণবাবু, অবিশ্যি যদি আপনার তদন্ত শেষ হয়ে থাকে।
ফেলুদা জানাল সব শেষ। -আপনার পিতৃদেবের শেষ ইচ্ছা পালনেও কোনও বাধা নেই। সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।
অরুণবাবু চায়ের কাপ থেকে দৃষ্টি তুললেন।
সে কী, বীরেনের খোঁজ পেয়ে গেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার বাবা ঠিকই অনুমান করেছিলেন।
মানে?
তিনি এখানেই আছেন।
হাজারিবাগে?
হাজারিবাগে।
খুবই আশ্চর্য লাগছে আপনার কথাটা শুনে।
আশ্চর্য লাগার সঙ্গে যে একটা অবিশ্বাসের ভাবও মিশে আছে সেটা অরুণবাবুর কথার সুরেই বোঝা গেল। ফেলুদা বলল, আশ্চর্য তো হবারই কথা, কিন্তু আপনারও এরকম একটা সন্দেহ হয়েছিল, তাই নয় কি?
অরুণবাবু চায়ের কাপটা নামিয়ে সোজা ফেলুদার দিকে চাইলেন।
শুধু তাই নয়, ফেলুদা বলে চলল, আপনার মনে এমনও ভয় ঢুকেছিল যে মহেশবাবু হয়তো আবার নতুন উইল করে আপনাকে বাদ দিয়ে বীরেনকে তাঁর সম্পত্তির ভাগ দেবেন।
ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব। লালমোহনবাবু আমার পাশে বসে সোফার একটা কুশান খামচে ধরেছেন। প্রীতীনবাবুর মাথায় হাত। অরুণবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন—তাঁর চোখ লাল, তাঁর কপালের রগ ফুলে উঠেছে।
শুনুন মিঃ মিত্তির, গৰ্জিয়ে উঠলেন অরুণবাবু, আপনি নিজেকে যত বড়ই গোয়েন্দা ভাবুন না কেন, আপনার কাছ থেকে এমন মিথ্যে, অমূলক, ভিত্তিহীন অভিযোগ আমি বরদাস্ত করব না। –জগৎ সিং!
পিছনের দরজা দিয়ে বেয়ারা এসে দাঁড়াল।
আর একটি পা এগোবে না। তুমি!-ফেলুদার হাতে রিভলবার, সেটার লক্ষ্য অরুণবাবুর পিছনে জগৎ সিং-এর দিকে। —ওর মাথার একগাছা চুল কাল রাত্রে আমার হাতে উঠে এসেছিল। আমি জানি ও আপনারই আজ্ঞা পালন করতে এসেছিল আমার ঘরে। ওর মাথার খুলি উড়ে যাবে। যদি ও এক পা এগোয় আমার দিকে!
জগৎ সিং পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
অরুণবাবু কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন সোফাতে।
আ-আপনি কী বলতে চাইছেন?
শুনুন সেটা মন দিয়ে, বলল ফেলুদা, আপনি উইল চেঞ্জ করার রাস্তা বন্ধ করার জন্য আপনার বাবার চাবি লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিবি দেখেছিল মহেশবাবুকে চাবি খুঁজতে। মহেশবাবু হেঁয়ালি করে তাঁর নাতনিকে বলেছিলেন তিনি কী হারিয়েছেন, কী খুঁজছেন। এই কী হল Key–অর্থাৎ চাবি। কিন্তু চাবি সরিয়েও আপনি নিশ্চিন্ত হননি। তাই আপনি সেদিন রাজরাপ্লায় সুযোগ পেয়ে আপনার মোক্ষম অস্ত্রটি প্রয়োগ করেন। আপনার বাবার উপর। আপনি জানতেন সেই অস্ত্ৰে মৃত্যু হতে পারে–এবং সেটা হলেই আপনার কার্যসিদ্ধি হবে।–