১৯৭৫-এর পাতায় পাওয়া গেল এ তিনের বশ। কাম ক্ৰোধ লোভ মাহ মদ মাৎসর্য। তিন হল লোভ।এ হচ্ছে A-অরুণবাবু!
শেষ লেখা মহেশবাবুর জন্মদিনের আগের দিন। –ফিরে আসা; ফিরে আশা-ব্যস—তার পর আর কিছু নেই।
ডায়ারি যখন শেষ হল তখন রাত একটা। ফেলুদার তখনও ঘুম আসেনি, কারণ আমি যখন লেপটা গায়ের উপর টানছি, তখন দেখলাম ও লালমোহনবাবুর দেওয়া সার্কাসের বইটা খুলল। উনি কথাই দিয়েছিলেন ওঁর পড়া হলে ফেলুদাকে পড়তে দেবেন, আর ফেলুদার পড়া হলে আমি পড়ব।
যখন তন্দ্রার ভাব আসছে, তখন শুনলাম ফেলুদা কথা বলছে, আর সেটা আমাকেই বলছে। —
কোথাও খুন হলে পুলিশে গিয়ে খুনের জায়গার একটা নকশা করে লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে একটা চিহ্ন দিয়ে দেয়। সে চিহ্নটা কী জিনিস?
এক্স মার্কস দ্য স্পট। আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ঠিক বলেছিস। এক্স মার্কস দ্য সম্পট।
এই এক্সটাই স্বপ্নে হয়ে গেল দু হাত তোলা পা ফাঁক করা কালী মূর্তি, যেটা অরুণবাবুর দিকে চোখ রাঙিয়ে বলছে, তুই দুইয়ের বশ, তুই দুইয়ের বশ, তুই দুইয়ের বশ, আর অরুণবাবু চিৎকার করে বলছেন, আমি দেখছিলাম! আমি দেখছিলাম। তারপরই কালীর মুখটা হয়ে গেল। লালমোহনবাবুর মুখ, আর যেই সেই মুখটা বলছে, এক মাসে তিন হাজার বিক্রি-ই ই-কালমোহন বেঙ্গলি!!-আমনি স্বপ্নটা ভেঙে গেল একটা শব্দে।
দরজায় ধাক্কা লাগার শব্দ। আর তার সঙ্গে একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এটাও বুঝতে পারলাম।
আমার হাতটা আপনা থেকেই টেবিল ল্যাম্পের সুইচটার দিকে চলে গেল। আলো জ্বলল না। বিহারেও যে লোডশেডিং হয় এটা খেয়াল ছিল না।
মেঝেতে ধূপ করে কী একটা পড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদার গলা—
টৰ্চ জ্বাল, তোপ্সে—আমারটা পড়ে গেছে!
টেবিলের উপর হাতড়ে জলের গেলাসটাকে মাটিতে ফেলে ভেঙে তবে টৰ্চটা পেলাম। ফেলুদা ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। টর্চের আলোতে তার নিষ্ফল ক্রোধটা চোখে মুখে ফুটে বেরোচ্ছে।
কে ছিল ফেলুদা?
দেখিনি, তবে অনুমান করতে পারি। লোকটা ষণ্ডা।
কী মতলবে এসেছিল, বল তো?
চুরি।
কিছু নেয়নি তো?
নেয়নি, তবে নিঘাঁত নিত—যদি আমার ঘুমটা এত পাতলা না হত।
কী নিত?
ফেলুদা এ প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে কেবল বিড়বিড় করে বলল, এখন দেখছি ফেলু মিত্তিরই একমাত্র লোক নয় যে মহেশ চৌধুরীর সংকেতের মানে বুঝতে পারে। যদিও এটা একটু লেটে বুঝেছে।…
১০. চোর ডাকাতের উপদ্রব
পরদিন সকালে লালমোহনবাবু সব শুনে-টুনে বললেন, আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম দরজা বন্ধ করে শোবেন। এ সব জায়গায় চোর ডাকাতের উপদ্রব তো হবেই।
আপনি তো বাঘের ভয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন।
আর আপনি চোরের জন্য খোলা রেখেছিলেন! বন্ধ রাখলে দুটোর হাত থেকেই সেফ। ওহে বুলাকিপ্রসাদ, চটপট ব্রেকফাস্টটা দাও ভাই!
এত তাড়া কীসের, বলল ফেলুদা।
বাঘ ধরা দেখতে যাবেন না?
ধরবে কে? কারান্ডিকার তো নিখোঁজ।
নিখোঁজ হলে কী হবে? বাঘ মারার তাল হচ্ছে সে খবর কি তার কাছে পৌঁছয়নি?–ওঃ, কী থ্রিলিং ব্যাপার মশাই। এ চান্স ছাড়া যায় না। আপনি ব্যাপারটা কী করে এত কামলি নিচ্ছেন জানি না।
আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে ডায়রি আর চিঠির প্যাকেট নিয়ে কৈলাসে যাবার জন্য তৈরি হয়েছি, এমন সময় অখিলবাবু এলেন। বললেন তাঁর এক হোমিওপ্যাথ বন্ধু কাছেই থাকেন, তাঁর কাছেই যাচ্ছিলেন, আমাদের বাড়ি পথে পড়ে বলে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন।
ঘৃতকুমারীতে মহেশবাবুর মাথা ঠাণ্ডা হয়েছিল? ফেলুদা প্রশ্ন করল হালকাভাবে।
ও বাবা! এত কথাও লিখেছে নাকি মহেশ ডায়রিতে?
আরও অনেক কথাই লিখেছেন।
অখিলবাবু বললেন, আমার ওষুধের চেয়েও অনেক বেশি কাজ দিয়েছিল ওর মনের জোর। যাকে বলে উইল পাওয়ার। সে যে কী ভাবে মদ ছাড়ল সে তো আমি নিজের চোখে দেখেছি। সে তো আর ঘৃতকুমারীতে হয়নি।
উইলের কথাই যখন তুললেন,’ বলল ফেলুদা, তখন বলুন তো মহেশবাবুর উইল সম্বন্ধে কিছু জানেন কি না। আমি অবিশ্যি দলিলের কথা বলছি, মনের জোরের কথা বলছি না।
ডিটেল জানি না, তবে এটুকু জানি যে মহেশ একবার উইল করে পরে সেটা বাতিল করে আরেকটা উইল করে।
আমার ধারণা এই দ্বিতীয় উইলে বীরেনের কোনও অংশ ছিল না।
অখিলবাবু অবাক হয়ে বললেন, এটা কি ডায়রিতে পেলেন নাকি?
না। এটা উনি মৃত্যুশয্যায় বলে গেছেন। সংকেতটা আপনার মনে আছে কি না জানি না। প্রথমে দুটো আঙুল দেখালেন, তারপর উই উই বললেন, আর তারপর বুড়ো আঙুলটা নাড়ালেন। দুই আঙুল। যদি দুরি হয়, তা হলে ও ছাড়া আর কোনও মনে হয় না। ’
আশ্চর্য সমাধান করেছেন। আপনি বললেন অখিলবাবু। প্রথমে উইলে বীরেনের অংশ ছিল। তার কাছ থেকে চিঠি আসা বন্ধ হবার পর পাঁচ বছর অপেক্ষা করে ছেলে আর আসবে না ধরে নিয়ে গভীর অভিমানে বীরেনকে বাদ দিয়ে মহেশ নতুন উইল করে।
বীরেন ফিরে এসেছে জানলে কি আবার নতুন উইল করতেন?
আমার তো তাই বিশ্বাস।
এবার ফেলুদা একটু ভেবে প্রশ্ন করল—
বীরেন সন্ন্যাসী হয়ে যেতে পারে, এমন কোনও সম্ভাবনা তার মধ্যে কখনও লক্ষ করেছিলেন কি?
দেখুন বীরেনের কুষ্ঠি আমিই করি। সে যে গৃহত্যাগী হবে সেটা আমি জানতাম। তাই যদি হয় তা হলে সন্ন্যাসী হবার সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?
আরেকটা শেষ প্রশ্ন। —সেদিন আপনি বললেন মহেশবাবুকে খুঁজতে যাচ্ছেন। অথচ আপনি এলেন আমাদের পরে। আপনি কি পথ হারিয়েছিলেন? জায়গাটা তো তেমন গোলকধাঁধা নয় কিছু।