৭২ কিলোমিটারের পোস্টটা পেরিয়ে কিছুদূর গিয়েই আর একটা অ্যাম্বাসাডর দেখা গেল! সেটা রাস্তার এক ধারে বনেট খোলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক হাত তুলে যে ভঙ্গিটা করছেন সেটা রেলের স্টেশনে খুব দেখা যায়। সেখানে সেটা গুড-বাই, আর এখানে হয়ে গেছে থামতে বলার সংকেত। হরিপদবাবু ব্রেক কষলেন।
ইয়ে, আপনার হাজারিবাগ যাচ্ছেন কি?
ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। গায়ের রঙ ফরসা, চোখে চশমা, পরনে খয়েরি প্যান্টের উপর সাদা শার্ট আর সবুজ হাত-কটা পুলোভার। সঙ্গে ড্রাইভার আছে, যার শরীরের উপরের অর্ধেকটা এখন বনেটের নীচে।
প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা আজ্ঞে হ্যাঁ বলায় ভদ্রলোক বললেন, আমাদের গাড়িটা গণ্ডগোল করছে, বুঝেছেন। বোধহয় সিরিয়াস। তাই ভাবছিলাম…
আপনি আমাদের সঙ্গে আসতে চাইলে আসতে পারেন।
সো কাইন্ড অফ ইউ!–ভদ্রলোক বোধহয় ভাবতে পারেননি যে না চাইতেই ফেলুদা অফারটা করবে।–আমি ওখান থেকে একটা মেকানিক নিয়ে ট্যাক্সি করে চলে আসব। তা ছাড়া আর কোনও ইয়ে দেখছি না।
আপনার সঙ্গে লাগেজ কী?
একটা সুটকেস, তবে সেটা অবিশ্যি পরে নিয়ে যেতে পারি। এখান থেকে যেতে আসতে তিন কোয়ার্টারের বেশি লাগবে না।
চলে আসুন।
ভদ্রলোক ড্রাইভারকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠে আরও দু বার বললেন সে কাইন্ড অফ ইউ। তারপর বাকি পথটা আমরা কিছু না জিজ্ঞেস করতেই নিজের বিষয়ে একগাদা বলে গেলেন। ওঁর নাম প্রীতীন্দ্ৰ চৌধুরী। বাপ বছর দশেক হল রিটায়ার করে হাজারিবাগে বাড়ি করে আছেন, আগে রাঁচিতে অ্যাডভোকেট ছিলেন, নাম মহেশ চৌধুরী। এ অঞ্চলের নামকরা লোক।
আপনি কলকাতাতেই থাকেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
হ্যাঁ। আমি ইলেকট্রনিকসে। ইন্ডোভিশনের নাম শুনেছেন?
ইন্ডোভিশন নামে একটা নতুন টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন কিছুদিন থেকে কাগজে দেখছি, সেটা নাকি এঁদেরই তৈরি।
আমার বাবার সত্তর পূর্ণ হচ্ছে কাল, বললেন ভদ্রলোক, বড়দা আমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে দিন তিনেক হল পৌঁছে গেছেন। আমার আবার দিল্লিতে একটা কাজ পড়ে গোসল, আসা মুশকিল হচ্ছিল, কিন্তু বাবা টেলিগ্রাম করলেন মাস্ট কাম বলে। —একটু থামাবেন গাড়িটা কাইন্ডলি?
গাড়ি থামল; কেন তা বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোক তাঁর হাতের ব্যাগটা থেকে একটা ছোট্ট ক্যাসেট রেকড়ার বার করে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশেই একটা শালবনে ঢুকে মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরে এসে বললেন, একটা ফ্লাইক্যাচার ডাকছিল; লাকিলি পেয়ে গেলাম। পাখির ডাক রেকর্ড করাটা আমার একটা নেশা। সে কাইন্ড অফ ইউ।
ধন্যবাদটা অবিশ্যি তাঁর অনুরোধে গাড়ি থামানোর জন্য।
আশ্চৰ্য্য, ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে এত বলে গেলেও, আমাদের কোনও পরিচয় জানতে চাইলেন না। ফেলুদা অবিশ্যি বলে যে একেকজন লোক থাকে যারা অন্যের পরিচয় নেওয়ার চেয়ে নিজের পরিচয় দিতে অনেক বেশি ব্যগ্ৰ।
হাজারিবাগ টাউনে পৌঁছে ইউরেকা অটামোবিলস্-এ প্রীতীন্দ্রবাবুকে নামিয়ে দেবার পর আর একবার সো কাইন্ড অফ ইউ বলে ভদ্রলোক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ভাল কথা, আপনারা উঠিছেন কোথায়?
জবাবটা দিতে ফেলুদার গলা তুলতে হল, কারণ গাড়ির কাছেই কেন জানি লোকের ভিড় জমেছে, আর সবাই বেশ উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে। কী বিষয়ে কথা হচ্ছে সেটা অবিশ্যি পরে জেনেছিলাম।
ফেলুদা বলল, সঠিক নির্দেশ দিতে পারব না, কারণ এই প্রথম আসছি এখানে। এটা বলতে পারি। যে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড রেস্ট হাউস আর কর্নেল মোহান্তির বাড়ির খুব কাছে।
ও, তার মানে আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট সাতেকের হাঁটা পথ। —টেলিফোন আছে?
সেভেন ফোর টু।
বেশ, বেশ।
আর আমার নাম মিত্র। পি সি মিত্ৰ।
দেখেছেন, নামটাই জানা হয়নি!
ভদ্রলোককে ছেড়ে দিয়ে রওনা হবার পর ফেলুদা বলল, নতুন মাল বাজারে ছাড়ছে বলে বোধহয় টেনিস হয়ে আছে।
বাতিকগ্রস্ত, বললেন লালমোহনবাবু।
ডিস্ট্রিক্ট বার্ড রেস্ট হাউসের কথা জিজ্ঞেস করে আমাদের বাড়ির রাস্তা খুঁজে বার করতে কোনও অসুবিধা হল না। কর্নেল জি সি মোহান্তির নাম লেখা মার্বেল ফলক-ওয়ালা গেট ছাড়িয়ে তিনটে বাড়ি পরেই এস সহায় লেখা বুগেনভিলিয়ায় ঢাকা গেটের বাইরে এসে হর্ন দিতেই একজন বেঁটে মাঝবয়সী লোক এসে গেটটা খুলে দিয়ে সেলাম ঠুকলি। মোরাম ঢাকা পথে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একতলা বাংলো টাইপের বাড়ির সামনে আমাদের গাড়ি থামল। মাঝবয়সী লোকটাও দৌড়ে এসেছে। পিছন পিছন, জিজ্ঞেস করে জানলাম সে-ই চৌকিদার, নাম বুলাকিপ্রসাদ।
গাড়ি থেকে নেমে বুঝলাম কী নির্জন। বাংলোটা ঘিরে বেশ বড় কম্পাউন্ড (লালমোহনবাবু বললেন অ্যািট লিস্ট তিন বিঘে), একদিকে বাগানে তিন চার রকম ফুল ফুটে আছে, অন্য দিকে অনেকগুলো বড় বড় গাছ, তার মধ্যে তেঁতুল, আমি আর অর্জন চিনতে পারলাম। কম্পাউন্ডের পাঁচিলের উপর দিয়ে উত্তর দিকে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, সেটাই নাকি কানারি হিল, এখানে থেকে মাইল দুয়েক।
বাড়িটা তিনজনের পক্ষে একেবারে ফরমাশ দিয়ে তৈরি। সামনে তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে চওড়া ধারান্দার পর পাশাপাশি তিনটে ঘর। মাঝেরটা বৈঠকখানা, আর দুদিকে দুটো শোবার ঘর। পিছন দিকে আছে খাবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি। সানসেট দেখা যাবে বলে লালমোহনবাবু পশ্চিমের বেডরুমটা নিলেন।