নিশ্চয়ই ঠিক। ফেলুদার কথাটা মনে ধরতে কিছুটা সময় নিল বলেই বোধহয় জবাবটা এল একটু পরে। কিন্তু যখন এল তখন বেশ জোরের সঙ্গেই এল। নিশ্চয়ই ঠিক, আবার বললেন শঙ্করলাল। তার পর তার গলার সুরাটা কেমন যেন বদলে গেল। বললেন, যে শ্রদ্ধাটা বহুদিন ধরে ক্ৰমে ক্রমে গড়ে ওঠে, সেটাকে কি এক ধাক্কায় ভাঙতে দেওয়া উচিত?
আপনি কি সেটাই করছিলেন?
হ্যাঁ, সেটাই করছিলাম। কিন্তু সেটা ভুল। এখন বুঝেছি সেটা মস্ত ভুল, আর বুঝতে পেরে মনে শান্তি পাচ্ছি।
তা হলে আপনার কাছে সাহায্য আশা করতে পারি?
কী সাহায্য চাইছেন বলুন, ফেলুদার দিকে সোজাসুজি চেয়ে বেশ সহজ ভাবে কথাটা বললেন শঙ্করলাল।
তাঁর দুই ছেলের প্রতি মহেশবাবুর মনোভাব কেমন ছিল সেটা জানতে চাই। চৌধুরী পরিবার সম্বন্ধে আপনি যতটা নিরপেক্ষভাবে বলতে পারবেন, তেমন অনেকেই পারবেন।
শঙ্করলাল বললেন, আমি যেটুকু বুঝেছি তা বলছি। আমার বিশ্বাস শেষ বয়সে বীরেন। ছাড়া আর কারুর উপর টান ছিল না মহেশবাবুর। অরুণদা আর প্রীতীন দুজনেই ওঁকে হতাশ করেছিল।
সেটার কারণ বলতে পারেন?
সেটা পারব না, জানেন, কারণ ওই দু ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। অনেক’দিন থেকেই। তবে অরুণদাকে যে জুয়ার নেশায় পেয়েছে সে কথা আমাকে এক’দিন মহেশবাবু বলেছিলেন। সোজা করে বলেননি, ওঁর নিজস্ব ভাষায় বলেছিলেন? আমি বুঝতে পারিনি; শেষে ওঁকেই বুঝিয়ে দিতে হল। বললেন, অরুণ গুড হলে আমি খুশি হতুম, বেটার হয়েই আমায় চিন্তায় ফেলেছে! শুনছি। নাকি আজকাল মহাজাতি ময়দানে যাতায়াত করছে নিয়মিত।-বেটার তো বুঝতেই পারছেন, আর জাতি হল রেস; মহাজাতি ময়দান হল মহেশবাবুর ভাষায় রেসের মাঠ।
ফেলুদা বলল, কিন্তু প্রীতীনবাবু তাঁকে হতাশ করবেন কেন? উনি তো ইলেক্ট্ৰনিকসে বেশ–
ইলেকট্রনিকস! -শঙ্করলাল যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ও কি আপনাকে তাই বলেছে নাকি?
ইন্ডেভিশনের সঙ্গে ওঁরা কোনও সম্পর্ক নেই?।
শঙ্করলাল সশব্দে হেসে উঠলেন। হুরি, হরি; ইন্ডোভিশন! প্রীতীন একটা সদাগরি আপিসে সাধারণ চাকরি করে। সেটাও ওর শ্বশুরের সুপারিশে পাওয়া! প্রীতীন ছেলে খারাপ নয়, কিন্তু অত্যন্ত ইমপ্র্যাকটিক্যাল আর খামখেয়ালি। এককালে সাহিত্য-টাহিত্য করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেও খুব মামুলি। ওর স্ত্রী বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে। ও যে গাড়িটাতে এসেছে সেটাও ওর শ্বশুরের। আপিস থেকে ছুটি পাচ্ছিল না, তাই আসতে দেরি হয়েছে।
এবার আমাদের আকাশ থেকে পড়ার পালা।
তবে ওর পাখির নেশাটা খাঁটি, বললেন শঙ্করলাল, ওতে কোনও ফাঁকি নেই।
ফেলুদা বলল, আরেকটা প্রশ্ন আছে।
বলুন।
সেদিন রাজরাপ্পায় যে গেরুয়াধারীটির সঙ্গে আপনি কথা বলছিলেন, তিনিই কি বীরেন্দ্ৰ?
হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্ন শুনে শঙ্করলাল থতমত খেলেও, মনে হল চট করে সামলে নিলেন। কিন্তু উত্তর যেটা দিলেন সেটা সোজা নয়।
আপনার যা বুদ্ধি, আমার মনে হয় ক্ৰমে আপনি সব কিছুই জানতে পারবেন।
এটা জিজ্ঞেস করার একটা কারণ আছে, বলল ফেলুদা। যদি তিনি বীরেন হন, তা হলে মহেশবাবুর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে আমার একটা জিনিস দিতে হবে। আপনি প্রয়োজনে বীরেনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন কি?
শঙ্করলাল বললেন, মহেশবাবুর শেষ ইচ্ছা যাতে পূরণ হয়, তার চেষ্টা আমি করব। এটা আমি কথা দিচ্ছি। এর বেশি আর কিছু বলতে পারব না। আমায় মাপ করবেন।
কথাটা বলে শঙ্করলাল যে পথে এসেছিলেন, আবার সেই পথে ফিরে গেলেন।
আমরা যে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকখানি পথ চলে এসেছিলাম সেটা বুঝতেই পারিনি। ফেলুদা টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখে বলল সাড়ে দশটা। আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। কৈলাসে সব বাতি নিভে গেছে, চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘে, সাকসের বাজনাও আর শোনা যাচ্ছে না। এই থমথমে পরিবেশে ফেলুদার বাঁদর বলে চেঁচিয়ে ওঠাটা এত অপ্রত্যাশিত যে লালমোহনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে কোথায় বলতে কিছুই আশ্চর্য হলাম না। আমি অবিশ্যি বুঝেছিলাম যে ফেলুদা মহেশবাবুর ডায়রির বাঁদরের কথা বলছে। কী অদ্ভুত মাথা ভদ্রলোকের! বলল ফেলুদা।বাঁদরেও যে বই লিখেছে সেটা তো খেয়ালই ছিল না।
আপনি সিমপিল ফ্র্যাকচারটাকে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচারে পরিণত করছেন কেন বলুন তো মশাই? শুধু বাঁদরে শানাচ্ছে না, তার উপর আবার বই-লিখিয়ে বাঁদর?
গিবন! গিবন! গিবন। বলে উঠল। ফেলুদা।
আরেব্বাস। সত্যিই তো। গিবন তো একরকম বাঁদর তো বটেই।
কিন্তু ফেলুদা হঠাৎ কেন জানি মুষড়ে পড়ল। বাড়ির ফটকের কাছাকাছি। যখন পৌঁছেছি তখন চাপা গলায় বলতে শুনলাম, সাংঘাতিক দাঁও মেরেছে। লোকটা, সাংঘাতিক।
কে মশাই? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
রাত বারোটা পর্যন্ত আমাদের ঘরে থেকে লালমোহনবাবু ফেলুদার হেঁয়ালির সমাধান দেখলেন। একটা হেঁয়ালির উত্তরের জন্য এগায়োটার সময় কৈলাসে ফোন করতে হল। ১৯১৫-র ১৮ই অক্টোবর মহেশবাবু লিখেছেন He Passes away; কার মৃত্যু সংবাদ ডায়রিতে লেখা রয়েছে জানিবার জন্য অরুণবাবুকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল ওই দিনে অরুণবাবুর মা মারা গিয়েছিলেন। মা-র নাম জিজ্ঞেস করাতে বললেন হিরন্ময়ী। তার ফলে বেরিয়ে গেল He হল হি।
১৯৫৮-তে কিছু লেখা পাওয়া গেল যেগুলো পড়লে মনে হয় ইংরিজি মটো। যেমন, Be foolish, Be stubborn, Be determined । তার পর যখন এল Be leaves for England তখন বোঝা গেল। Be হচ্ছে বী অর্থাৎ বীরেন।