কী সুযোগ?
যে কারণে সিং-এর কাছে যাচ্ছি। খবর এসেছে রামগড়ের রাস্তায় আজ বিকেলেই নাকি বাঘাটা দেখা গেছে। এদিকে একটি ট্রেনার তো হাসপাতালে, অন্যটি মালিকের সঙ্গে ঝগড়াটিগড়া করে নিখোঁজ। আমি সিংকে বলেছি যে বাঘটাকে যদি মারতেই হয়, তো আমাকে মারতে দাও। অলরেডি তো তার দিকে গুলি চলেছে; যদি জখম হয়ে থাকে। তা হলে তো হি ইজ এ ডেঞ্জারাস বীস্ট।
আমার বলার ইচ্ছে ছিল বাঘটাকে দেখে তো জখম বলে মনে হয়নি, কিন্তু ফেলুদার ইশারাতে সেটা আর বললাম না।
আমি তো সঙ্গে থ্রি ওয়ান ফাইভটা নিচ্ছি, বললেন অরুণবাবু, কারণ এমনিতেই চারিদিকে প্যানিক। গোরু, ছাগলও গেছে এক আধটা। সকাসের খাঁচায় বন্দি অবস্থায় বুড়ো হয়ে মরার চেয়ে জঙ্গলে গুলি খেয়ে মারাটা খারাপ কীসে?…যাই হোক, আপনার ইন্টারেস্ট থাকলে আপনিও আসতে পারেন। কাল সকলে বেরোধ আমরা।
দেখি… বলল ফেলুদা।আমার এই কাজটা কতদূর এগোয় তার উপর নির্ভর করছে। ভাল কথা–
অরুণবাবু যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন, ফেলুদার কথায় খামলেন। ফেলুদা বলল, সেদিন পিকনিকে আপনিই তো বন্দুক ছুঁড়েছিলেন, তাই না?
ভদ্রলোক হেসে উঠলেন। আপনি বোধহয় ভাবছিলেন—বন্দুক চলল, অথচ শিকার নেই কেন? গোয়েন্দার মন তো! ওয়েল, আই মিসূড ইট। একটা বটের। সেরা শিকারিরও লক্ষ্য কি সব সময় অব্যৰ্থ হয়, মিঃ মিত্তির?
০৯. মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলের চিঠি
বিলেত থেকে লেখা মহেশবাবুর দ্বিতীয় ছেলের চিঠিগুলো থেকে সত্যিই বিশেষ কিছু জানা গেল না। চিঠি বলতে সবই পোস্টকার্ড, তার একদিকে ছবি, অন্যদিকে ঠিকানা। যেখানে ঠিকানা ছাড়াও কিছু লেখা আছে, সেখানে বীরেন তার বাবার দেওয়া নাম ব্যবহার করেছে—দুরি।
নটায় বুলার্কিপ্ৰিসাদ ডিনার রেডি করে আমাদের ডাক দিল। ফেলুদা ডায়রি আর খাতা নিয়ে খেতে বসল। যে-সংকেতগুলো তৎক্ষণাৎ সমাধান হচ্ছে না, সেগুলো সে নিজের খাতায় লিখে রাখছে। বাঁ হাতে লিখছে, এবং দিব্যি লিখছে। লালমোহনবাবু একবার বললেন, লেখা বন্ধ না করলে আজকের মাংসের কারিটার ঠিক জাসটিস করতে পারবেন। না। দুর্ধর্ষ হয়েছে।
ফেলুদা বলল, বাঁদর সমস্যা নিয়ে পড়েছি, এখন মাংস-টাংস বলে ডিসটর্বে করবেন না।
আমি লক্ষ করছিলাম ফেলুদার ভুরুটা সাংঘাতিক কুঁচকে রয়েছে, যদিও ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাসও রয়েছে। জিজ্ঞেস করতেই হল ব্যাপারটা কী। ফেলুদা ডায়রি থেকে পড়ে শোনাল-অগ্নির উপাসকের অসীম বদ্যান্যতা। নবরত্ন বাঁদরের হিসাবে দু হাজার পা।
লালমোহনবাবু বললেন, রাঁচিতে পাগলাগারদ আছে বলে ওখানকার বাসিন্দারাও নাকি একটু ইয়ে হয় বলে শুনিচি। সেটাও একটু মনে রাখবেন।
ফেলুদা এ কথায় কোনও মন্তব্য না করে বলল, অগ্নির উপাসক পার্সিদের বলে জানি, কিন্তু বাকিটা সম্পূর্ণ ধোঁয়া।
তাতে লালমোহনবাবু বললেন যে, প্রথমত নবরত্ন বাঁদর বলে কোনওরকম বাঁদর হয় কি না সে বিষয়ে ওঁর সন্দেহ আছে; আর দ্বিতীয়ত, নটা রত্নের কী করে দু হাজার পা হয়, আর বাঁদর কী করে সে হিসেবটা করে সেটা কোনওমতেই বোধগম্য হচ্ছে না–এইবার আপনি খাতা বন্ধ করে একটু বিশ্রাম করুন।
লালমোহনবাবু বলার জন্য নিশ্চয়ই নয়, হয়তো চোখ আর মাথাটাকে একটু রেস্ট দেবার জন্য ফেলুদা খাবার পরে হাঁটতে বেরোল। অবিশ্যি এক নয়, আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে।
পূর্ণিমার চাঁদ এই কিছুক্ষণ হল উঠেছে, তার গায়ের রং থেকে এখনও হলুদের ছাপটা যায়নি। আকাশে মেঘ জিমেছে, তাই দেখে জটায়ু বললেন, চন্দ্ৰলোক ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হচ্ছে! পশ্চিম দিক থেকে মাঝে মাঝে একটা দমকা বাতাস দিচ্ছে, আর তার সঙ্গে একটা শব্দ ভেসে আসছে। যেটা ভাল করে শুনলে বোঝা যায় সাকসের ব্যান্ড।
ডাইনে মোড় নিয়ে দুটো বাড়ি পরেই কৈলাস। এক সারি ইউক্যালিপটাসের ফাঁক দিয়ে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। দোতলায় একটা ঘরের জানালা খোলা, ঘরে আলো জ্বলছে। সেই আলোর সামনে দিয়ে কে যেন দ্রুত পায়চারি করছে। ফেলুদারও চোখ সেইদিকে। আমরা হাঁটা থামিয়েছি। ওটা করে ঘর? প্রীতীনবাবুর। পায়চারি করছেন নীলিমা দেবী। একবার জানালায় এসে থামলেন, আবার সরে গিয়ে পায়চারি। অস্থির ভাব।
আমরা আবার চলা শুরু করলাম। জানালাটা ক্রমে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল।
পরপর আরও বাড়ি। প্রত্যেকটাতেই বেশ বড় কম্পাউন্ড। রেডিয়োতে খবর বলছে; কোন বাড়িতে চলছে রেডিয়ো জানি না। লালমোহনবাবু আরেকটা বেমানান রবীন্দ্ৰ সংগীত ধরতে যাচ্ছিলেন-গুনগুনানি শুনে মনে হল ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়—এমন সময় দেখলাম দূরে একজন লোক রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদেরই দিকে। গায়ে নীল রঙের পুলোভার।
আরেকটু কাছে এলেই চিনতে পারলাম।
আপনাদের ওখানেই যাচ্ছিলাম, নমস্কার করে বললেন শঙ্করলাল মিশ্র। চেহারা দেখে মনে হল অনেকটা সামলে নিয়েছেন, যদিও সেই হাসিখুশি ছেলেমানুষি ভাবটা এখনও ফিরে আসেনি।
কী ব্যাপার? বলল ফেলুদা।
আপনাকে একটা অনুরোধ করব।
কী অনুরোধ?
আপনি তদন্ত ছেড়ে দিন।
হঠাৎ এমন একটা অনুরোধে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ফেলুদা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, কোন বলুন তো?
এতে কারুর উপকার হবে না, মিঃ মিত্তির।
ফেলুদা একটুক্ষণ চুপ থেকে একটা হালকা হাসি হেসে বলল, যদি বলি আমার নিজের উপকার হবে? মনে খট্কা থাকলে আমি বড় উদ্বেগ বাধ করি মিঃ মিশ্র; সেটাকে দূর না। করা অবধি শাস্তি পাই না। তা ছাড়া মৃত্যুশয্যায়। একজন একটা কাজের ভার আমাদের দিয়ে গেছেন, সেটা না করেও আমার শান্তি নেই। এইসব কারণে আমাকে তদন্তু চালাতেই হবে। উপকার-অপকারের প্রশ্নটা এখানে খুব বড় নয়। ভেরি সরি, আপনার অনুরোধ আমি রাখতে পারলাম না। শুধু তাই নয়—এই তদন্তের ব্যাপারে। আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে আমাকে একটু সাহায্য করুন। মহেশবাবু সম্বন্ধে আর কেউ যাই ভাবুন না কেন, আপনি তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন এটা তো ঠিক?