সুলতান যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের দেখল, সেটার আন্দাজ দেওয়া মুশকিল। মনে হচ্ছিল সময়টা অফুরন্ত। লালমোহনবাবু পরে বললেন কম করে আট-দশ মিনিট; আমার মতে আট-দশ সেকেন্ড, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট বেশি।
দেখা শেষ হলে পর মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে আরও চার পা ফেলে বাঘ রাস্তা পেরিয়ে গেল। সাহস একটু বাড়াতে ধীরে ধীরে ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম শাল সেগুন সরল শিশু শিমুল আর আরও অনেক সব শুকনা গাছের জঙ্গলে সুলতান অদৃশ্য হয়ে গেল।
আশ্চর্য এই যে, এর পরেও আমরা অন্তত মিনিটখানেক (লালমোহনবাবুর বর্ণনায় পনেরো মিনিট) প্রায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার পর তিন জনে কেবল তিনটে কথা বলে গাড়িতে উঠলাম-হরিপদবাবু চলুন, আমি আসুন আর লালমোহনবাবু ছঃ। খুব বেশি ভয় নিয়ে কথা বলতে গেলে লালমোহনবাবুর এ রকম হয় এটা আমি আগেই দেখেছি। ডুয়ার্সে মহীতোষ সিংহরায়ের বাড়িতে আমরা তিনজনে একঘরে শুয়েছিলাম। এক’দিন রাত্রে ঘরের বন্ধ দরজাটা হাওয়াতে খট্ খট্ করায় উনি কে না বলে খে বলেছিলেন।
হরিপদবাবুর নির্ভটা দেখলাম মোটামুটি ভাল। ফেরার পথে স্টিয়ারিং হুইলে হাত-টাত কাঁপোনি। উনি নাকি এর আগেও রাস্তায় বাঘ দেখেছেন, জামসেদপুরে ড্রাইভারি করার সময়।
বাড়ি ফিরে দেখি ফেলুদা তখনও মহেশবাবুর ডায়রিতে ডুবে আছে। আমার মনে হচ্ছিল সুলতানের খবরটা লালমোহনবাবু দিতে পারলে খুশি হবেন, তাই আমি আর কিছু বললাম না। ভদ্রলোক লেখেন-টেখেন বলেই বোধহয় সরাসরি খবরটা না দিয়ে একটু পাঁয়তারা কষে নিলেন। বার দু-তিন ভূঁই হুঁ ই করে কী একটা গানের সুর ভেঁজে নিয়ে বললেন, আচ্ছা, তপেশ, বাঘের পায়ের তলায় বোধহয় প্যাডিং থাকে, তাই না?
আমি মজা দেখছি; বললাম, তাই তো শুনেছি।
নিশ্চয়ই তাই; নইলে এত কাছ দিয়ে গেল আর কোনও শব্দ হল না?
লালমোহনবাবুর পাঁয়তারা কিন্তু মাঠে মারা গেল। ফেলুদা আমাদের দিকে চাইলও না, কেবল একটা ডায়ারি সরিয়ে রেখে আর-একটা হাতে নিয়ে বলল, আপনারা যদি বাঘটাকে দেখৈ থাকেন, তা হলে কটার সময় কোনখানে দেখেছেন সেটা বনবিভাগে ফোন করে। জানিয়ে দেওয়া উচিত ইমিডিয়েটলি।
লালমোহনবাবু বললেন, টাইম পাঁচটা তেত্রিশ, লোকেশন রামগড়ের রাস্তায় এগারো কিলোমিটার পোস্টের পরের কালভার্টের কাছে।
বেশ তো, পাশের ঘরে ডিরেকটরি রয়েছে, আপিসে এখন কেউ নেই, আপনি একেবারে ডি-এফ-এর বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিন। ওদের উপকার হবে।
আচ্ছা, হুঁ, তা হলে. লালমোহনবাবু দেখলাম মাস্লগুলোকে টান করে নিচ্ছেন। –কী ভাবে পুট করা যায় ব্যাপারটা? ইংরেজিতেই বলব তো?
হিন্দি ইংব্রিজি যেটায় বেশি দখল তাতেই বলবেন।
দি টাইগার হুইচ এসকেপূর্ড ফ্রম দি.এসকেপূর্ডই বলব তো?
সহজ করে নিয়ে র্যান অ্যাওয়ে বলতে পারেন।
এসকেপটা বোধহয় ম্যানেজ করতে পারব।
তা হলে তাই বলুন।
নম্বর বার করে দিলাম। আমি। ফোনটাও বোধহয় আমি করলেই ভাল হত, কারণ লালমোহনবাবু দি সার্কাস হুইচ এসকেপণ্ড ফ্রম দি গ্রেট ম্যাজেস্টিক টাইগার—থুড়ি, বলে থেমে গেলেন। ভাগ্যিস ভদ্রলোক কথাটা খুব চেঁচিয়ে বলেছিলেন। ফেলুদা পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে টেলিফোনটা ওঁর হাত থেকে ছিনিয়ে খবরটা নিজেই দিয়ে দিল।
০৮. ফেলুদার ঘরেই চা এনে দিল
ফেলুদার ঘরেই চা এনে দিল বুলাকিপ্ৰসাদ। আমরা আসার আগেই বাঘের হাতে চন্দ্রনের জখম হবার খবরটা ফেলুদা বুলকিপ্রসাদের কাছে পেয়ে গিয়েছিল; ফেলুদার ধারণা কারান্ডিকার ছাড়া এই বাঘ জ্যান্ত ধরার সাধ্যি কারুর নেই।
লালমোহনবাবু। গরম চায়ে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন, কিছু পেলেন ও ডায়রিতে? নাকি অরুণবাবুর কথাই ঠিক?
আপনিই বলুন না।
ফেলুদা একটা ডায়ারি খুলে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
লালমোহনবাবু পড়লেন ‘Self elected President of club–meeting on 8.4.46—তারপর আরেকটা পাতা খুলে পড়লেন–Tea Party at Brig. Sudarshan’s আর তার পরের পাতায়–Trial for new suit at Shakurs-4 P.M…কী মশাই, এসব খুব তাৎপর্যপূর্ণ বুঝি?
তোপ্সে, তোর কী মনে হয়?
আমি লালমোহনবাবুর পিছন দিয়ে বুকে পড়ে দেখছিলাম, এবার ডায়রিটা হাতে নিয়ে নিলাম। আলোর কাছে আন, বলল ফেলুদা।
টেবিল ল্যাম্পের নীচে ডায়রিটা ধরে চোখটা কাছে নিতেই একটা শিহরন খেলে গেল। আমার শিরদাঁড়ায়।
বেশ বড় সাইজের ডায়রি, তার পাতার মাঝখানে ফাউনটেন পেনে ইংরেজিতে লেখা ছাড়াও অন্য লেখা রয়েছে। যেটা প্ৰায় চোখে দেখা যায় না। পাতার একেবারে উপর দিকে ছাপা তারিখেরও উপরে, খুব সরু করে কাটা হার্ড পেনসিল দিয়ে খুদে খুদে অক্ষরে হালকা লেখা।
কী দেখলি?
বাংলা লেখা।
কী লেখা?
এই পাতাটায় লেখা–পাঁচের বশে বাহন ধ্বংস।
সর্বনাশ, বললেন লালমোহনবাবু, এ যে আবার হেঁয়ালি দেখছি মশাই।
তা তো বটেই, বলল ফেলুদা, এবার এটা দেখুন। এটা ১৯৩৮ অর্থাৎ প্রথম বছরের ডায়রি, আর এটাই পেনসিালে প্রথম সাংকেতিক লেখা।
১৯৩৮-এর ডায়রির প্রথম পাতাতেই লিখেছেন ভদ্রলোক শাস্তু দুই-পাঁচের বশ।
শঙ্কুটি কে? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।
ফেলুদা বলল, ভদ্রলোক নিজের বিষয় বলতে গেলে সব সময়ই শিবের কোনও না কোনও নাম ব্যবহার করেছেন।
শিবের নাম তো হল, কিন্তু দুই-পাঁচের বশ তো বোঝা গেল না।
রিপু বোঝেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।