আপনি ওটা সম্বন্ধে জানেন কিছু? ফেলুদা অরুণবাবুকে প্রশ্ন করল।
অরুণবাবু মাথা নাড়লেন।ও জিনিসটা যে বাবার কাছে ছিল সেটাই জানতাম না। বাবার শেবার ঘরে আমিও কালই প্রথম গোলাম।
আমিও জানতাম না।–প্রীতীনবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বলে উঠলেন।
ফেলুদা বলল, দুটো জিনিস পেলে আমার কাজের একটু সুবিধা হতে পারে।
কী জিনিস? অরুণবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
প্রথমটা হল—মহেশবাবুকে লেখা তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের চিঠি।
বীরেনের চিঠি? অরুণবাবু অবাক। ‘বীরেনের চিঠি দিয়ে কী হবে?
আমার বিশ্বাস ওই ছবিটা মহেশবাবু বীরেনকে দেবার জন্য দিয়েছিলেন আমাকে।
হাউ ষ্ট্রেঞ্জ। এ ধারণা কী করে হল আপনার?
ফেলুদা বলল, ছবিটা আমাকে দিয়ে মহেশবাবু দুটো আঙুল দেখিয়েছিলেন সেটা আপনারাও দেখেছিলেন ; একটা সম্ভাবনা আছে যে দুই আঙুল মানে দুরি। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আপাতত এই বিশ্বাসেই আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু বীরেনকে আপনি পাচ্ছেন কোথায়?
ধরুন মহেশবাবু যদি ঠিকই দেখে থাকেন ; যদি সে এখানে এসে থাকে।
অরুণবাবু তাঁর বাপের মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন।
বাবা গত পাঁচ বছরে কতবার বীরেনকে দেখেছেন তা আপনি জানেন? বিশ বছর যে ছেলে বিদেশে, বাবা তাঁর দুর্বল দৃষ্টি দিয়ে তাকে এক ঝলক দেখেই চিনে ফেলবেন এটা আপনি ভাবছেন কী করে?
আপনি ভুল করছেন অরুণবাবু, আমি নিজে একবারও ভাবছি না যে বীরেনবাবু ফিরে এসেছেন। কিন্তু তিনি যদি দেশের বাইরেও কোথাও থেকে থাকেন, তা হলেও আমার দায়িত্ব দায়িত্বই থেকে যায়। তিনি কোথায় আছেন জেনে জিনিসটা তাঁর হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে।
অরুণবাবু একটু নরম হয়ে বললেন, বেশ। আপনি দেখবেন বীরেনের চিঠি। বাবা সব চিঠি এক জায়গায় রাখতেন। বীরেনের চিঠিগুলো আলাদা করে বেছে রাখব।
ধন্যবাদ, বলল ফেলুদা, ‘আর দ্বিতীয় জিনিস হচ্ছে—মহেশবাবুর ডায়রি। সম্ভব হলে সেগুলোও একবার দেখব।
আমি ভেবেছিলাম অরুণবাবু এতে আপত্তি করবেন, কিন্তু করলেন না। বললেন, দেখতে চান দেখতে পাবেন। বাবা তাঁর ডায়রির ব্যাপারে কোনও গোপনতা অবলম্বন করতেন না। তবে আপনি হতাশ হবেন, মিঃ মিত্তির।
কেন?
বাবার মতো ও রকম নীরস ডায়রি আর কেউ লিখেছে কি না জানি না। অত্যন্ত মামুলি তথ্য ছাড়া আর কিছু নেই।
হতাশ হবার ঝুঁকি নিতে আমার আপত্তি নেই।
চিঠির ব্যাপারে ঠিক হল অরুণবাবু আর গ্ৰীতীনবাবু ভাইয়েরগুলো বেছে আলাদা করে রাখবেন, সেগুলো কাল সকালে ফেলুদাকে দেওয়া হবে। ডায়রিগুলো আজই নিয়ে যাব আমরা, আর কালই ফেরত দিয়ে দেব। বুঝলাম ফেলুদাকে আজ রাত জগতে হবে, কারণ ডায়রির সংখ্যা চল্লিশ।
তিনজনে ভাগাভাগি করে খবরের কাগজে মোড়া মহেশ চৌধুরীর ডায়রির সাতটা প্যাকেট নিয়ে কৈলাসের কাঁকর-বিছানো পথ দিয়ে যখন ফটকের দিকে যাচ্ছি, তখন দেখলাম জোড়া-মৌমাছি তার বিলিতি ডিল হাতে নিয়ে বাগানে ঘোরাফেরা করছে। পায়ের শব্দে সে হাঁটা থামিয়ে আমাদের দিকে ঘুরে দেখল। তারপর বলল, দাদু আমাকে বলেনি।
হঠাৎ এমন একটা কথায় আমরা তিনজনেই থেমে গোলাম।
কী বলেনি দাদু? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
কী খুঁজছিল বলেনি।
কবে?
পরশু, তরাশু নরশু।
তিনদিন?
একদিন।
কী হয়েছিল বলে তো।
বিবি দূরে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে কথা বলছে, যদিও তার মন পুতুলের দিকে। সে পুতুলের মাথায় গোঁজার জন্য বাগান থেকে ফুল নিতে এসেছে। ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে বলল, দাদুর যে ঘর আছে দোতলায়, যেখানে টেবিল আছে, বই আছে আর সব জিনিস-টিনিস আছে, সেইখানে খুঁজছিল দাদু!
কী খুঁজছিলেন?
আমি তো জিজ্ঞেস করলাম। দাদু বলল কী পাচ্ছি না, কী খুঁজছি।
আবোল তাবোল বকছে, মশাই চাপা গলায় বললেন লালমোহনবাবু।
আর কিছু বলেননি দাদু? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
দাদু বলল এটা হেঁয়ালি, পরে মানে বলে দেব, এখন খুঁজতে দাও। তার পর আর বলল না দাদু। দাদু মরে গেল।
ইতিমধ্যে ডালের মাথায় ফুল গোঁজা হয়ে গেছে, বিবি বাড়ির দিকে চলে গেল, আর আমরাও হলাম বাড়িমুখো।।
০৭. ফেলুদা এখন মহেশ চৌধুরীর ডায়রি নিয়ে বসবে
ফেলুদা এখন মহেশ চৌধুরীর ডায়রি নিয়ে বসবে, তাকে ডিসটার্বন করাই ভাল, তাই আমরা দু জনে চারটি নাগাদ চা খেয়ে একটু ঘুরুব বলে গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম। লালমোহনবাবুর ধারণা শহরের দিকে গেলে হয়তো সুলতানের লেটেস্ট খবর পাওয়া যেতে পারে। —মহেশ চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে তোমার দাদা যতই রহস্যের গন্ধ পেয়ে থাকুন না কেন, আমার কাছে বাঘ পালানোর ঘটনাটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।
বাঘের খবর পেতে বেশি দূর যেতে হল না। পেট্রোল নেবার দরকার ছিল, মেন রোডে ব্রিজভূষণ তেওয়ারির পেট্রোল পাম্পের সামনে ভিড় দেখেই বুঝলাম বাঘের আলোচনা হচ্ছে, কারণ একজন ভদ্রলোক থাবা মারার ভঙ্গি করলেন কথা বলতে বলতে।
লালমোহনবাবু গাড়ি থেকে নেমে সটান এগিয়ে গেলেন জটলার দিকে। ভদ্রলোক এককালে রাজস্থানে যাবেন বলে বই পড়ে কিছুটা হিন্দি, শিখেছিলেন, কিন্তু এখন সেটা ফেলুদার ভাষায় আবার শেয়ালের স্ট্যান্ডার্ডে নেমে গেছে। তার মানে কেয়া হুয়া-র বেশি এগোনো মুশকিল হয়। তবু ভাল, ভিড়ের মধ্যে একজন বাঙালি বেরিয়ে গেল। তার কাছেই জানলাম যে হাজারিবাগের পুবে বিষ্ণুগড়ের দিকে একটা বনের মধ্যে নাকি সুলতানকে পাওয়া গিয়েছিল। ট্রেনীর চন্দ্রনের সঙ্গে বনবিভাগের শিকারি নাকি বাঘটার দিকে এগিয়ে যায়। একটা সময় মনে হয়েছিল যে বাঘটা ধরা দেবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা চন্দ্রনকে একটা থাকা মেরে পালিয়ে যায়। গুলিও চলেছিল, কিন্তু বাঘাটা জখম হয়েছে কি না জানা যায়নি। চন্দ্ৰন অবিশ্যি জখম হয়েছে, তবে তেমন গুরুতরভাবে নয়। সে এখন হাসপাতালে।