মহেশবাবু উঠে পড়েছিলেন। বললেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায় সেটা বলে দিতে কি জ্যোতিষীর দরকার হয়?
কথাটা বলে মহেশবাবু উত্তরদিকে চলে গেলেন, বোধহয় পাথরের সন্ধানে। অখিলবাবু বসলেন তাঁর জায়গায়। গল্প বলার মুড়ে ছিলেন ভদ্রলোক। বললেন, আশ্চর্য লোক এই মহেশ! আমি ওঁর পড়শি ছিলাম। যদিও অন্য দিক দিয়ে ব্যবধান বিস্তুর। আমি শিক্ষক, আর ও উদীয়মান অ্যাডভোকেট। ওর ছেলেদের টিউশনি করেছি। কিছুদিন, সেই থেকে আলাপ। অ্যালোপ্যাথিতে আস্থা ছিল না, তাই অসুখ-টসুখ করলে মাঝে মাঝে শিকড় বাকল চেয়ে নিত আমার কাছে। সামাজিক ব্যবধানটা কোনওদিন বুঝতে দিত না। আমার ছেলেকেও নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করত। কোনও স্নবরি ছিল না।
আপনার ছেলে কী করে?
কে, অধীর? অধীর ইঞ্জিনিয়ার। বোকারোয় আছে। খড়গপুরে পাশ করে ডুসেলডর্ফে চাকরি নিয়ে চলে গোসল। বিদেশেই ছিল বছর দশেক, তারপর–
একটা বিস্ফোরণের শব্দ অখিলবাবুর কথা থামিয়ে দিল। বন্দুক!–চেঁচিয়ে উঠল বিবি–জেঠু পাখি মেরেছে! আমরা রাত্তিরে তিতিরের মাংস খাব!
দেখি মহেশ আবার কোথায় গেল। অখিলবাবু যেন কিছুটা চিন্তিত ভাবেই উঠে পড়লেন।পাথর খুঁজতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে-টড়ে গেলে জন্মদিনটাই…
পিকনিক বলে মনে হচ্ছে না। প্রীতীনবাবুর স্ত্রী হাতের বইটা বন্ধ করে শতরঞ্চির উপর রেখে উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। সবাই এমন ছড়িয়ে আছে কেন বলুন তো?
খিদে পেলেই সুড়সুড়ি করে এসে হাজির হবে, বলল ফেলুদা।
কিছু খেললে হত না?
তাস? বললেন লালমোহনবাবু, আমি কিন্তু স্কু ছাড়া আর কিছু জানি না।
তাও আবার টিলে, বলল ফেলুদা।
তাস তো আনিনি সঙ্গে, বললেন নীলিমা দেবী। এমনি মুখে মুখে কিছু খেলা যেতে পারে।
জল-মাটি-আকাশ হলে লালমোহনবাবু যোগ দিতে পারেন, বলল ফেলুদা।
সেটা আবার কী মশাই?
খুব সহজ, বললেন নীলিমা দেবী, ধরুন, আপনার দিকে তাকিয়ে আমি জল, মাটি, আকাশ এই তিনটের কোনও একটা বলে দশ গুনতে শুরু করব। জল বললে জলের, মাটি বললে মাটির, আর আকাশ বললে আকাশের একটা প্রাণীর নাম করতে হবে আপনাকে ওই দশ গোনার মধ্যে।
এটা খুব কঠিন খেলা বুঝি?
খেলে দেখুন একবার। আমি আপনাকেই প্রশ্ন করছি।
বেশ। রেডি। লালমোহনবাবু দম নিয়ে সোজা হয়ে যোগাসনে বসলেন। নীলিমা দেবী ভদ্রলোকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন–
আকাশ! এক দুই তিন চার পাঁচ—
এঁ—এঁ—এঁ–
ছয় সাত আট নয়–
বেঙুর।
ফেলুদা অবিশ্যি জানতে চাইল বেঙুরটা কোন গ্রহের আকাশে চরে বেড়ায়। তাতে লালমোহনবাবু বললেন যে ক্যাঙ, হাঙর। আর বেলুন-এই তিনটে তিনি ভেবে রেখেছিলেন, বলার সময় তালগোল পাকিয়ে গেছে। তাতে ফেলুদা বলল যে বেলুনকে প্রাণী বলা যায় কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু লালমোহনবাবু কথাটা মানতে চাইলেন না। বললেন, বেলুনে অক্সিজেন লাগে, প্রাণীরও অক্সিজেন ছাড়া চলে না, সুতরাং প্রাণী বলব না কেন মশাই? ফেলুদা বলল যে সে হাওয়া, হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের বেলুনের কথা শুনেছে, এমন কী কয়লার গ্যাসের বেলুনের কথাও শুনেছে, কিন্তু অক্সিজেন বেলুনের কথা এই প্রথম শুনল।
নীলিমা দেবী তর্ক থামানোর জন্য হাত তুলেছিলেন, ঠিক সেই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তর্ক আপনিই থেমে গেল।
প্রীতীন্দ্ৰবাবু।
মানুষে একসঙ্গে দুঃখ আর আতঙ্ক অনুভব করলে তার কীরকম ভাবভঙ্গি হতে পারে, লিওনাদোঁ দা ভিঞ্চির করা তার একটা ড্রইং ফেলুদা একবার আমাকে দেখিয়েছিল। প্রীতীনবাবুর চেহারা অবিকল সেই ছবির মতো।
ভদ্রলোক একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লেন।
নীলিমা দেবী ছুটে গেলেন স্বামীর দিকে, যদিও ফেলুদা তার আগেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে কথা বেরোতে বেশ সময় লাগল।
বা…বা…বাবা! বললেন প্রীতীনবাবু, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতটা পিছন দিকে নির্দেশ করল।
০৫. মহেশবাবুকে যখন বাড়িতে আনা হয়
মহেশবাবুকে যখন বাড়িতে আনা হয় তখন প্রায় আড়াইট। তখনও জ্ঞান হয়নি ভদ্রলোকের। মাথায় চোট লেগেছে, দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সটান পড়েছিলেন মাটিতে। ডাক্তার বলছেন হার্ট অ্যাটাক। ভদ্রলোকের হার্ট এমনিতেই দুর্বল ছিল, তার উপর এই বয়সে হঠাৎ কোনও কারণে শক্ পেলে এরকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মোটকথা, তাঁর অবস্থা ভাল নয়, সেরে ওঠার সম্ভাবনা আছে কি না সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না।
রাজরাপ্লার আমরা যেখানে বসেছিলাম, তার উত্তরে খানিকটা দূরে একটা বেশ বড় পাথরের পিছনে একটা খোলা জায়গায় মহেশবাবুকে পাওয়া যায়। এটা কোনওদিন ভুলব না। যে আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন তাঁর কাছেই দুটো হলদে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছিল। প্রীতীনিবাবু পাহাড় বেয়ে উপর দিকের জঙ্গলে গিয়েছিলেন, ফেরার পথে কিছুদূর নেমে এসে একটা ঝোপ পেরিয়ে নীচের দিকে চেয়ে দেখেন মহেশবাবু পড়ে আছেন মাটিতে। তিনি ভেবেছিলেন ভদ্রলোক মারাই গেছেন, তাই ওরকম চেহারা করে এসেছিলেন খবর দিতে। ফেলুদা গিয়েই মহেশবাবুর নাড়ি ধরে বলল তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর মাথাটা পড়েছিল একটা থান ইটের সাইজের পাথরের উপর, তার ফলে খানিকটা রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল পাথর আর বালির উপর।
আমরা মহেশবাবুর কাছে পৌঁছনোর মিনিটখানেক পরে প্রথম এলেন অরুণবাবু, তাঁর হাতে বন্দুক। তারপর এলেন অখিলবাবু। সব শেষে এলেন শঙ্করলাল মিশ্র। শেষের ভদ্রলোকটিকে যেরকম ভেঙে পড়তে দেখলাম, তাতে বুঝলাম মহেশবাবুর প্রতি তাঁর টান কত গভীর।