আছেন, তবে দূরে, বলল ফেলুদা
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম মন্দির ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা দক্ষিণে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে শঙ্করলাল কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই গেরুয়াধারীটির সঙ্গে কথা বলছেন।একটু যে সাসপিশাস্ বলে মনে হচ্ছে, মন্তব্য করলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদারও স্যাসপিশাস মনে হচ্ছে কি না সেটা জানিবার আগেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন অরুণবাবু, তাঁর হাতে বন্দুক। ওটা দিয়ে কি বাঘ মারা যায়? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
সার্কাসের বাঘ এতদূর আসবে না, হেসে বললেন অরুণবাবু। সাম্বার মেরেছি এটা দিয়ে, তবে সাধারণত পাখিটখিই মারি। এটা টোয়েন্টি-টু।
তাই তো দেখছি।
আপনি শিকার করেন?
শুধু মানুষ!
আপনার কি কোনও এজেন্সি নাকি? না প্রাইভেট?
ফেলুদা তার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর লেখা একটা কার্ড অরুণবাবুকে দিয়ে দিল ভদ্রলোক বললেন, থ্যাঙ্কস। কখন কাজে লেগে যায় বলা তো যায় না।
ভদ্রলোক যেদিক দিয়ে এসেছিলেন সেইদিকেই চলে গেলেন; ফেলুদা এই ফাঁকে কখন যে সেই সকলের কাগজটা পর্কেট থেকে বের করেছে সেটা দেখতেই পাইনি। লালমোহনবাবু কাগজটার দিকে ঝুকে পড়ে বললেন, বাংলা নামের কথা কী বলছিলেন মশাই?
এই দেখুন।
ফেলুদা পাশাপাশি লেখা চারটে ইংরেজি অক্ষরের দিকে দেখাল। লালমোহনবাবু ডুরু কুঁচকে বললেন, ওটা তো মনে হচ্ছে লক্ লিখতে গিয়ে বানান ভুল করে LOKC লিখেছে।
এলোকেশী। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এরকম ভাবে ইংরিজি অক্ষরে বাংলা কথা আমিও লিখেছি ছেলেবেলায়।
বাঃ বললেন লালমোহনবাবু, সত্যিই তো। আর এই জাপানি নামটা?
ওকাহা? এটা একটা বাংলা সেনটেন্স। OKAHA।
ও, কে, এ, এইচ, এ? এটা একটা বাংলা সেনটেনস্! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি?
ও, কে, এ, এইচ, এ–এটা তাড়াতাড়ি বলুন তো, না থেমে! দেখুন তো কী রকম শোনায়।
এবার লালমোহনবাবুর মুখে একটা বিস্ময় আর খুশি মেশানো ভাব দেখা দিল। ও কে এয়েচে! ওয়ান্ডারফুল!…বাঃ, বাঃ, এই তো, জলের মতো সোজা। –SO—এসো; DO–দিও; NADO—এনে দিও; NHE—এনেচি। –ও বাব্বা! এটা যে বিরাট সেনটেন্স; এর তো শেষ নেই মশাই!–AKLO ATBB BBSO ADK SO RO ADK SO AT KLO PC LO ROT OT DD OK OJT RO OG এ আমার সাধ্য নেই।
ধৈর্য নেই বলুন। তোপ্সে পড়। পাংচুয়েট করে নিলে জলের মতো সোজা।
খুব বেশি না ঠেকেই পড়ে গেলাম আমি। —
এ কে এল? এটি বিবি। বিবি এসে। এদিকে এসে। আরো এদিকে এসো। এটি কে এল? পিসি এল। আর ওটি? ওটি দিদি। ও কে? ও জেঠি। আর ও? ও ঝি।
ওটা কোথায় পেলেন। আপনারা? মহেশবাবু হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন।
আপনার বাগানের ধারে পড়ে ছিল, বলল ফেলুদা।
বিবিদিদিমণির সঙ্গে একটু খেলা করছিলাম আর কী।
সেটা আন্দাজ করেছি, বলল ফেলুদা। আমরা তিনজনেই উঠতে যাচ্ছিলাম, ভদ্রলোক বাধা দিয়ে আমাদের পাশেই পাথরের উপর বসে পড়লেন।
আরেকটি কাগজ দেখাব আপনাদের।
মহেশবাবুর মুখে আর হাসি নেই। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে তার ভিতর থেকে একটা পুরনো ভাঁজ করা পোস্টকার্ড বার করলেন। —আমার দ্বিতীয় পুত্রের শেষ পোস্টকার্ড।
ফেলুদা পোস্টকার্ডটা নিয়ে ভাঁজ খুলল। একদিকে রঙিন ছবি। লেক সমেত জুরিখ শহরের দৃশ্য। উলটাদিকে শুধুই নাম ঠিকানা দেখে আমরা সকলেই বেশ অবাক।
মহেশবাবু বললেন, শেষের দিকে ও তাই করত। শুধু জানান দিয়ে দিত কোথায় আছে। আগেও দু-এক লাইনের বেশি লেখেনি কখনও।
ভদ্রলোক ফেলুদার হাত থেকে পোস্টকার্ডটা নিয়ে আবার ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিলেন।
ফেলুদা বলল, বীরেনবাবু বিলেতে কী করতেন সেটা জানতে পেরেছিলেন?
মহেশবাবু মাথা নাড়লেন!মামুলি চাকরি করার ছেলে ছিল না বীরেন। সে ছিল যাকে বলে রেবেল। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। গতানুগতিকের একেবারে বাইরে। তার আবার একটি হিরো ছিল। বাঙালি হিরো। একশো বছর আগে তিনিও নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজের খালাসি হয়ে বিলেত যান। তারপর শেষ পর্যন্ত ব্ৰেজিল না মেক্সিকো কোথায় গিয়ে আর্মিতে ঢুকে কর্নেল হয়ে সেখানকার যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব দেখান।
সুরেশ বিশ্বাস কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। লালমোহনবাবুরও চোখ চকচক করে উঠেছে। বললেন, ইয়েস ইয়েস, সুরেশ বিশ্বাস। ব্ৰেজিলে মারা যান ভদ্রলোক। কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস।
মহেশবাবু বললেন, ঠিক বলেছেন। ওই নাম। কোথেকে তার একটা জীবনী জোগাড় করেছিল, আর সেটা পড়েই ওর অ্যাডভেঞ্চারের শখ হয়। আমি বাধা দিইনি। জানতাম দিলে কোনও ফল হবে না। উধাও হয়ে গেল। তারপর মাস দুয়েক পরে এল ইউরোপ থেকে এক চিঠি। হল্যান্ড, সুইডেন, জামানি, অস্ট্রিয়া.কী করছে কিছু বলে না, শুধু জানিয়ে দেয় সে আছে। চলে গেছে বলে যেমন দুঃখ হত, তেমনি নিজের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে বলে গর্কও হত। তারপর সিক্সটি সেভানের পর আর চিঠি নেই।
মহেশবাবু কিছুক্ষণ উদাস চোখে দূরের গাছপালার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সে আর আমার কাছে আসবে না। এত সুখ আমার কপালে নেই। আমার উপরে যে অভিশাপ লেগেছে!
সে কী হে, তুমি আবার অভিশাপ-টভিশাপে বিশ্বাস কর কবে থেকে?—অখিলবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। মহেশবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার কোষ্ঠীই বিচার করেছি। অখিল, মানুষটাকে বিচার করনি।
ওইখানেই তো ভুল, বললেন অখিলবাবু, মানুষের কুষ্ঠি, মানুষের রাশি গ্ৰহ লগ্ন-এ সবের থেকে তো আলাদা নয় মানুষ। তোমায় বলেছিলুম। সেই ফটিটুতে, যে তোমার জীবনে একটা বড় চেঞ্জ আসছে—মনে আছে তোমার?-শুনুন মশাই— ফেলুদার দিকে ফিরলেন অখিলবাবু।–এই যে দেখছেন এঁকে এখন দেখলে বুঝতে পারছেন কি যে ইনি এককালে রাঁচি টু নেতারহাট যাবার পথে এঁর একটি পুরনো ফোর্ড গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়ায় তার উপর রাগ করে সেটাকে পাহাড় থেকে হাজার ফুট নীচে ফেলে দিয়েছিলেন?