হরিশঙ্কর বললেন, তোকে কিছু করতে হবে না। সব আমরা করছি। শুধু সেই রাসকেলটা এখনও আসছে না কেন? লোহা গরম থাকতে থাকতেই ঘা মারতে হয়।
ছোটদাদু বললেন, মুখ হাত পা তো ধুতেই হবে হরিশঙ্কর, আর একটা অবশ্য করণীয় কাজ তুমি ভুলে গেছ। দাঁত মাজা। গাবভ্যারেন্ডার বেড়া দেখতে পাচ্ছি। দাঁতনের অভাব হবে না।
হরিশঙ্কর বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। দাঁত মাজাটা বাকি আছে।
দাওয়ার এক পাশে একটা বালতি ছিল। পিসিমা সেই দিকে এগোলেন। ছোটদাদু বললেন, আশা, তোর মেয়েকে বল না। জল আনবে কোথা থেকে? টিউবওয়েল?
ও পারবে না ছোটমামা। পাতকোটা খুব বড় আর অনেক নীচে জল।
তা হলে আমরাই কেন যাই না!
পিসিমা বললেন, তুমি তো জানো আশা কীরকম খাটতে পারে! মাথার চোট আমাকে কাবু করতে পারবে না।
পিসিমা বালতি হাতে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলেন। হরিশঙ্করের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা ছুরি বেরোল। বিদেশি জিনিস। শেফিল্ডে তৈরি। চকোলেট রঙের বাঁট। পেতলের কাজ করা। খুবই লোভনীয়। জিনিসটা হরিশঙ্করের বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো। পকেটে পকেটে ঘোরে। ফলকাটা, গাছের ডাল কাটা, সবেতেই লাগে। এইসব কাজে হরিশঙ্করের নিপুণতা তুলনাহীন। সব কাজেই হরিশঙ্কর অসাধারণ দক্ষ। তিনি বলেন, কাজের চেয়ে কাজের ফিনিশই বড় কথা। যেমন শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতি।
হরিশঙ্কর দাঁতনের জন্যে ডাল কাটতে গেলেন। ভেঙে নিলেই হয়। কিন্তু না, তা হবে না, নিখুঁত করে কাটতে হবে। চুলতে হবে। একটা ডাল কেটেছেন। দাঁড়িয়ে আছি পাশে। ডাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরছে। হঠাৎ পিসিমা প্রায় ছুটতে ছুটতে এলেন। মুখে চোখে ভয়ংকর এক আতঙ্ক। যেন ভূত দেখেছেন।
আমাদের কাছে এসে প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলেন।
হরিশঙ্কর বললেন, কী হল আশা? ওরকম করছিস কেন?
পিসিমা ধরাধরা গলায় বললেন, পাতকোর মধ্যে।
পাতকোর মধ্যে কী?
কী একটা রয়েছে।
কী একটা রয়েছে মানে? জল ছাড়া আর কী থাকবে?
একটা মানুষ।
মানুষ। কী করছে মানুষ? চান করছে!
মরা মানুষ।
সেকী?
আমরা সবাই ছুটলুম কুয়োতলার দিকে। শ্যাওলা শ্যাওলা একটা জায়গা। কয়েকটা ইট এলোমেলো পাতা। একপাশে বিশাল একটা ছাইগাদা। বড় বড় মান গাছ। বিশাল একটা কাঁঠাল গাছ। খা খা করে কাক ডাকছে। হঠাৎ একটা কাক ক্রাঙ্ক ক্রাঙ্ক করে ডাকতে লাগল। কাক সাধারণত এইভাবে ডাকে না। ছোটদাদু আমাকে বললেন, শুনছ? ভীষণ অমঙ্গলের ডাক। কাক সব জানিয়ে দেয়। অদ্ভুত এক পাখি। কাকের ডাক নিয়ে আমাদের শাস্ত্রে অভ্রান্ত গবেষণা আছে, কাকতত্ত্ব।
তিন পাশ থেকে আমরা পাতকো দেখতে লাগলুম ঝুঁকে। পাতকোর বেড় বিশাল। ইদারার মতো। তেমনই গভীর। বাঁকুড়া খুব শুকনো জায়গা। জলের খুব কষ্ট। অনেক নীচে জল। সেই জলে ভাসছে সাদা কাপড়। একটা চুলঅলা মাথা। তালের ফোঁপলের মতো। সব তালগোল পাকিয়ে আছে। বেশ বোঝা যায়, ওঠার জন্যে হাঁচোড়পাঁচোড় করে এলিয়ে পড়েছে একসময়। মাথার ওপর সূর্য। ফলার মতো কিরণ পড়েছে। ভেতরটা বেশ স্পষ্ট। দশাসই একজন মানুষের সলিল-সমাধি। জলের ভেতরে একটা লালের আভা।
মানকচুর ঝোপে একটা কিছু ভয়ংকর চকচক করছে। দেখা গেল, সেটা একটা টিনের খাঁড়া। একজোড়া খড়ম পড়ে আছে একপাশে। আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সেই কাক তারস্বরে চিৎকার করছে, ক্রাঙ্ক ক্রাঙ্ক। হরিশঙ্কর যার পালক ছাড়াতে চেয়েছিলেন, সে ওই কূপে মৃত।
প্রথমে কথা বললেন ছোেটদাদু, এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! হয় নিজেই ঝপ মেরে আত্মহত্যা করেছে, না হয় কেউ মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। পুলিশ কেসের ব্যাপার।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের এখন কী করা উচিত?
ছোটদাদু পিসিমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা তো সারাটা রাতই ওই দাওয়ায় ছিলিস, এত বড় একটা জিনিস কুয়োয় পড়ল, তোরা কোনও শব্দ পেলি না।
পিসিমা ভয়ে ভয়ে বললেন, আমরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। আর এটা তো বাড়ির পেছন দিক।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের এখন থানায় যাওয়া উচিত।
ছোটদাদুর চেহারা, গলা সবই হঠাৎ পালটে গেল। একেবারে অন্য মানুষ। চাপা গলায় বললেন, কোনও চিৎকার চেঁচামেচি না করে সব ওদিকে চলল। মনে করো, তোমরা এটা দেখোনি। তোমরা কিছুই জানো না।
আমরা এইবার চোরের মতো অপরাধীর মতো দাওয়ায় এসে বসলুম। ঝলমলে দিন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে গভীর রাত। গভীর এক ষড়যন্ত্রে বসেছি আমরা। আমরাই যেন খুনি। বেশ বোঝ। যাচ্ছে, হরিশঙ্কর কোনওরকমে নিজের ভয়ংকর উত্তেজনা চেপে রেখেছেন। আমি জানি তিনি কী চাইছেন! এখনই ওই মৃতদেহ তোলার ব্যবস্থা করতে চাইছেন। মানুষটির প্রতি রাগ-দ্বেষ যা ছিল আর নেই। এখন আছে মৃতের প্রতি কর্তব্য, শেষ সংস্কার। মৃতের কোনও জাত নেই। পাপ-পুণ্য নেই।
হরিশঙ্কর বললেন, থানায় খবর দিলে ক্ষতিটা কী? যতই হোক আমাদের একজন আত্মীয়!
ছোটদাদু বললেন, একটু আগেই তো তুমি কীচকবধ করতে চেয়েছিলে।
মৃতের কোনও শত্রু থাকে না।
তুমি যা ভেবেছিলে, এখন কাজে তাই হয়ে গেছে। এখন আমাদের সম্পর্ক–হত আর হত্যাকারী।
হরিশঙ্করের বিস্মিত প্রশ্ন, আমরা হত্যাকারী?
সন্দেহটা প্রথমে আমাদের দিকেই আসবে। পুলিশ আমাকে ধরে টানাটানি করবে। আমাদেরও জড়াবে। এই দাওয়া, ওই ইদারা। অত বড় একটা শরীর পড়ল, শব্দ হল, কেউ শুনতে পেল না। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? আদালত মানবে!