কাজি বেশি সময় নেয় না, তার দক্ষতা অসীম, দুটি মন্ত্রণালয় দেখছে সে;–সাত দিনের মধ্যে কাজি তার পীরের শহরে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে একটি প্রায়-আন্তর্জাতিক সেমিনার, একটি অ্যাকাডেমির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও একটি কুচকাওয়াজের আয়োজন করে ফেলে। কাজির দক্ষতা দেখে আমি বিস্মিত হই না, সে যে দক্ষ সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান, যা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তা আমার মনে পড়ে। কাজি ঠিক করে ফেলেছে আমাকেও যেতে হবে, আমার পক্ষে না করাও সম্ভব নয়, আর আমি না করতেও চাই না। বেশ উৎসব আর আনন্দ হবে; আইনশৃঙ্খলা জানা যাবে, ভিত্তিপ্রস্তর, কুচকায়াজ, আর মাজার দেখা যাবে; কোনো অলৌকিক উপকারও হয়ে যেতে পারে।
কাজি আমাকে ফোন করে, তোমাকে যেতে হবে, পীরবাবার মাজারটা জিয়ারত করে আসতে পারবে, আর হালিমা বেগম তোমার কথা শুনবেন মনে হয়, তাকে তুমি যাওয়ার জন্যে একটু রাজি করাবে।
আমি বলি, ভাবীকে দিয়ে একটা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করালে কেমন হয়?
কাজি বলে, তা করতে পারতাম যদি হালিমা বেগম ঠিকমতো বাঙলা বা ইংরেজি বলতে পারতেন।
আমি বলি, এখন তা কে-ইবা পারে, তুমি ভাবীকে দিয়ে একটা পাথরটাথর বসানোর ব্যবস্থা করো, আমি তাকে রাজি করাবো।
কাজি বলে, জেনারেল হালিমা বেগমকে দেখুক আমি চাই না, আমার ভয় হয়, হালিমা বেগম সেক্রেটারির থেকে জেনারেল বেশি পছন্দ করে।
পীরবাবার পুণ্যনগরে গিয়েই কাজি মাজার জিয়ারতের ব্যবস্থা করে, সেটাই প্রথম কাজ, চারদিকে সাড়া পড়ে যায়; জেনারেল মাজারটাজার পেলেই পাগল হয়ে ওঠে, না পেলে রাতারাতি একটা তৈরি করে ফেলতে চায়; তাকে বোঝাতে কোনো কষ্ট হয় না কাজির, বরং সে-ই কাজিকে বোঝাতে থাকে; আমিও অর্ধেক রাজি হই, আমলা হওয়ার পর কোনো বিশ্বাস রাখা বা কিছু অবিশ্বাস করা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়; বিশ্বাস আমার কাছে যা, অবিশ্বাসও আমার কাছে তা-ই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে হালিমা বেগম সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান নন, মনে হয় তিনি কিছু কিছু বিশ্বাস করেন আর অবিশ্বাসও করেন অনেক কিছু; সে-অধিকার তাঁর আছে; তাকে আমাদের সাথে যেতে রাজি করাতে আমার বেশ কষ্ট হয়, রাজি করাতে পেরে আমি কাজিকে একই সাথে স্বস্তি আর অস্বস্তিতে ফেলে দিই, নিজে একটু সুখ বোধ করি; কিন্তু হালিমা বেগমকে মাজার জিয়ারত করতে রাজি করাতে পারি না।
হালিমা বেগম বলেন, উই গুলিন পুরুষপোলাগো কাম, মাজারে আমার কাম নাই; ড্রাইবর একবার আমারে লইয়া আইছিল, আমারে উপরে উটতেও দেয় নাই, আমি আর উইগুলিনে নাই।
হালিমা বেগম হাসতে থাকেন, বলেন, ড্রাইবর ত আমারে মাজারে লইয়া আইছিল, তার কী লাব হইল? পীর আমারে ত তার লিগা ধইর্যা রাকতে পারল না? সেকরেটারি ত আমারে ভাগাইয়া নিজের বিছনায় উঠাইল।
আমি বলি, ভাবী, তবে আপনি মাজারের নিচে না গেলে কাজির একটু বিপদ হতে পারে, জেনারেল অসন্তুষ্ট হতে পারে, জেনারেল সেকরেটারিদের স্ত্রীদের দেখতে পছন্দ করেন।
হালিমা বেগম বলেন, জেনারেল যুদি আবার আমারে পছন্দ কইর্যা ফ্যালে।
আমি কোনো কথা বলি না; আমি জানি জেনারেল হালিমা বেগমকে পছন্দ করবে।
হালিমা বেগম হাসেন, মনে হয় বছরখানেক ধরে হাসেন, এবং বলেন, আনিছ ভাই, আপনেরা হইলেন পুরুষপোলা, বড় বড় চাকরি করেন আপনেরা, এই দ্যাশটা চালান। আপনেরা, আপনাগো ডরে দ্যাশটা কাঁপতে থাকে, কিন্তু আমি ভাইব্যা পাই না আপনেরা যে ক্যান পীর আর মাজার লইয়া পাগল হন। পীর আর মাজারে আমার কাম নাই।
আমি তাঁকে রাজি করাতে পারি না; আমরা যখন মাজার নিয়ে মেতে উঠি তিনি তখন রেস্টহাউজে বসে ভিসিআর দেখতে থাকেন; আমি যখন মাজারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকি, তখন আমি হালিমা বেগমকে দেখতে থাকি; তার হাসি শুনতে থাকি।
অ্যাকাডেমির মর্মরভিত্তিপ্রস্তর যখন স্থাপন করছিলো জেনারেল হালিমা বেগমের পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। আমার সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোর একগুচ্ছ আমি তখন যাপন করি।
হালিমা বেগম বলেন, আনিছ ভাই, কন ত এই পাথর বসাইয়া কী লাভ?
আমি বলি, এখানে একটি বড় দালান উঠবে, অ্যাকাডেমি হবে।
হালিমা বেগম বলেন, তাইলে দালানটা বানাইয়া ফ্যালাইলেই ত পারত, পাথর বসানের কী দরকার?
আমি বলি, দালান বানাতে সময় লাগে, পাথর বসাতে সময় লাগে না; আর দালান নাও উঠতে পারে।
হালিমা বেগম বলেন, আপনেরা তাইলে সব জায়গায়ই ফাঁকি দ্যান, আনিছ ভাই? বিছনায়ও ফাঁকি দ্যান, পাত্থর বসাইয়াও ফাঁকি দ্যান?
অ্যাকাডেমির মঙ্গল কামনা করে মঙ্গলময়ের কাছে মোনাজাত হচ্ছে, এটা আমরা নিষ্ঠার সাথে করে আসছি, মোনাজাত ছাড়া কিছু আমরা করি না, কিন্তু তিনি শুনছেন না বলেই সন্দেহ হচ্ছে, চারদিকে তার শোনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; আমি (এবং আরো অনেকে) ঠিক মোনাজাত করতেও জানি না, অনেক আগে শিখেছিলাম, দরকার নেই দেখে ভুলে গেছি; তবে সিনেমাহল, হোটেল, পানশালা, প্রমোদশালা, সেতু, কারখানা, মাদ্রাসা উদ্বোধন করতে গিয়ে কয়েক শো বার আমি দু-হাত উঠিয়ে ঠোঁট নেড়েছি; আজো আমি হাত উঠোই, হাত দুটি অভ্যাসবশত ওপরের দিকে বাঁকা হয়ে উঠে যায়, ঠোঁটও নড়ে অভ্যাসবশত; কিন্তু হালিমা বেগম হাত তুলছেন না, ঠোঁট দুটি নাড়ছেন না। তিনি কি এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ছাড়া ওই দুটি ব্যবহার করেন না? হালিমা বেগম হাত তুলছেন না দেখে আমি ভয় পাই; ভিক্ষা করতে কেউ অস্বীকার করতে পারে এ-দৃশ্য আমাকে ভীত করে তোলে; যদি কোনো বজ্র আকাশ ফেড়ে এখনই তাঁর মাথায় নেমে আসে, নেমে আসারই কথা, অবশ্যই নেমে আসবে, তা আমার মাথায়ও পড়বে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি; আমার ইচ্ছে করে দৌড়ে কোনো পাহাড়ের দিকে ছুটে যাই, আমি যেতে পারি না। বজ্রটা কোন দিক থেকে আসতে পারে? আকাশের দিকে একবার অন্যমনস্কভাবে তাকাই; আমি সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান, আমাকে সাবধান থাকতেই হবে, আমার মাথায় কোনো বজ্রপাত হতে দেয়া হবে না। অন্যদের মাথায় হতে পারে, সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তানের মাথায় নয়। বজ্রপাত হচ্ছে না দেখে আমি কম্পন বোধ করি, কাঁপতে থাকি, হতাশ বোধ করি। আমি একটি বজ্র চাই, ভীষণ বজ্রপাত চাই, যাতে আমি নিজেও ছাই হয়ে যেতে পারি; কোনো বজ্রপাত হয় না দেখে আমি কাঁপতে থাকি। হালিমা বেগম কেনো হাত তুলবেন না? তিনি কি বজ্রপাতের ভয় করেন না? তিনি কি বজ্রপাতের সংবাদ রাখেন না? বজ্রের কাল কি শেষ হয়ে গেছে? মনে হয় আমারই ভুল হয়েছে; তিনি এখনই আমাদের শাস্তি দেবেন না; একদিন দেবেন। সেদিন বুঝতে পারবেন হালিমা বেগম। তার পাশে দাঁড়িয়ে কি আমারও বুঝতে হবে?