০১. পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতে

পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতেই হাফ-খরচা হয়ে গেল নিতাই। কৌপিন ধরল, জটা রাখল। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ। লোকে নাম দিল খ্যাপা নিতাই।

খ্যাপা নিতাই এখন ওই বসে আছে শিমুল গাছের তলায়। রক্তাম্বরের কোঁচড়ে পো-দেড়েক মুড়ি। সকাল থেকেই আজ রোদ আর বাতাসের বড় বাড়াবাড়ি। উত্তরে হাউড় বাতাস এসে কলকল করে কথা বলছে গাছের পাতার সঙ্গে, মাঝে মাঝে টানা দীর্ঘশ্বাস তুলে যাচ্ছে ডালপালায়। খসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শালের শুকনো পাতা। নিতাইয়ের চারদিকে থিরিক থিরিক নেচে নেচে কয়েকটা শালিখ আর কাক অনেকক্ষণ ধরে মুড়ির ভাগা চাইছে। এক মুঠ মুড়ি মুখে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভাবনা এল মাথায়। সামনেই শালার হ্যাট মাথায় সাইকেলে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে মদন ঠিকাদার নতুন রাস্তা তৈরির কাজ তদারক করছে। দুরমুশ করা মাটির ওপর ইট সাজানো শেষ হয়েছে। এখন ঝুড়ি ঝুড়ি পাথরকুচি ঢালছে কামিনরা।

নিতাই ভাবল, শালারা করছেটা কী? তার হাঁ করা মুখের দরজায় কোষভরা মুড়ি থেমে ছিল অসাবধানে, অন্যমনস্কতায়। পাজি বাতাস এসে এক থাবায় বারো আনা মুড়ি উড়িয়ে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলল চারদিকে। নিতাই বেকুবের মতো চেয়ে কাণ্ডটা দেখল, তারপর মুঠোভর যেটুকু মুড়ি ছিল তাও উড়িয়ে দিয়ে বলল, খা শালারা পঞ্চভূত!

বাকি মুড়ি কোমরে বেঁধে উঠে গেল নিতাই। সামনের গড়ানে জমি ধরে নেমে গিয়ে মদনের দু-তিন হাত পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোমরে হাত রেখে মাতব্বরের মতো উত্তর-দক্ষিণে টানা নতুন রাস্তাটার ঘেয়ো চেহারা দেখল। অবশ্য কাজ শেষ হলে এতটা ঘেয়ো দেখাবে না। তখন গাড়ি যাবে, মানুষ, গোরু, কুকুর হাঁটবে। গলা খাঁকারি দিয়ে সে খুব নরম গলায় বলল, মদনবাবু, এই এত এত রাস্তা তৈরি করা কি ভাল হচ্ছে?

মদন ঠিকাদার আলকাতরার মতো কালো, লম্বা। মস্ত গোঁফ আছে তার। ভীষণ রাগী চেহারা। একবার ফিরে তাকাল মাত্র। চোখে আগুন।

নিতাই তাতে ভয় খায় না। সেও সাধক, তান্ত্রিক। বলল, দুনিয়াময় যদি রাস্তাই বানায় মানুষ, কেবল বাড়িঘর বানিয়ে বানিয়েই যদি জায়গা ভরাট করে, তবে চাষবাসইবা হবে কোথায়, মানুষ খাবেই বা কী? কথাটা ভেবে দেখবেন একটু? আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি, একেবারে মুখ নই।

মদন একটি কথাও বাজে খরচ করে না। ভারী গম্ভীর মানুষ। যারা কম কথা বলে, যারা প্রয়োজনের চেয়েও কম কথা বলে তাদের লোকে কী জানি কেন একটু ভয় পায়। মদন কখনও কাউকে মারেনি ধরেনি, গালাগালও করেনি বড় একটা, তবু কুলি কামিন থেকে বন্ধুলোক পর্যন্ত তাকে একটু খাতির দেখিয়ে চলে। খ্যাপা নিতাইয়ের কথারও কোনও জবাব দেয় না মদন। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার কাজ দেখতে থাকে।

মদন জবাব না দিল তো বয়েই গেল নিতাইয়ের। কিন্তু সাহস করে একটা মস্ত তত্ত্বকথা যে মদন ঠিকাদারকে বলতে পেরেছে সে তাতেই ভারী খুশি হল। ফের ঢিবির ওপর উঠে শিমুলের ছায়ায় জমিয়ে বসল সে। একটা কাকের দিকে চেয়ে বলল, নিতাই কাউকে উচিত কথা বলতে ছাড়ে না, হ্যাঁ।

 

আজ সকালে খুব ঘন কুয়াশা ছিল। শেষ রাত থেকে বাঁদুরে টুপি আর তুষের চাদরে জাম্বুবান সেজে দক্ষিণের টানা বারান্দায় কাঠের ভারী চেয়ারখানায় বসে আছে শ্রীনাথ। তার চোখের সামনেই কুয়াশার আড়ালে রোগা-ভোগা ন্যাড়া মাথা কমজোরি সূর্যেব উদয় হল। তারপর অবশ্য কুয়াশা কেটে ঝা ঝা রোদ ফুটেছে। শ্রীনাথ টুপি আর চাদর খুলে ফেলেছে অনেকক্ষণ। বাগানে উবু হয়ে বসে বসে এ গাছ সে গাছের পায়ে ধরে, গায়ে হাত বুলিয়ে বাবা-বাছা বলে সেবা দিচ্ছে। রোদের তাপে আর পরিশ্রমে গেঞ্জি ভিজে ঘাম ফুটে উঠল। ফর্সা রং এখন টমেটোর মতো টুকটুকে। কনুই পর্যন্ত মাটি মাখা, সারা মুখে ধুলোবালি। শেষ শীতে পালঙের শিষ হঠাৎ লাফিয়ে ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে হাত দেড়েক। তারই আড়াল থেকে দেখতে পেল, বারান্দার সামনের দিকে কোণে একটা সাদা কাপ ডিশ দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে কে যেন। দু হাতে তালি বাজিয়ে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসে শ্রীনাথ। বারান্দার নীচে চায়ের কাপটার তলাতেই একটা মস্ত গো-হাড় কামড়াচ্ছে খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুর ইস্পাত। ব্যাটা চায়ের কাপটা শুঁকেটুকে দেখেনি তো! চা রেখে গেছে, কিন্তু তাকে ডেকে দিয়ে যায়নি। শ্রীনাথ চায়ের কাঁপে জ্বর দেখার মতো হাত ছুঁইয়ে দেখল, নিমঠান্ডা। এর চেয়ে বেশি এ বাড়ির লোকের কাছে সে আশাও করে না। আস্তে আস্তে ঠান্ডা চা-ই খেয়ে নেয় শ্রীনাথ। অভিমান বা রাগ করে লাভ নেই। বউ, মেয়ে, ছেলে, এরা সবাই তার আপনজনই তো। আদরযত্ন করার ইচ্ছে থাকলে এমনিতেই করত। এখন এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সে কিছুই আর নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারবে না।

নিতাইয়ের কুকুরটা কুঁই কুঁই করে এখন তার পায়ের ফাঁকে মুখ গুঁজে আদর কাড়বার চেষ্টা করছে। গো-হাড় চিবোচ্ছিল, ঘেন্নায় পা তুলে বসে শ্রীনাথ। কিন্তু নেই-আঁকড়া কুকুরটা কি তাতে ছাড়ে? শ্ৰীনাথ বলল, হাড়টা তো এনে ফেলেছ বাপ, কিন্তু আবার যে সেটা বাইরে গিয়ে রেখে আসবে সে বুদ্ধি নেই। সাধে কি কুকুর বলেছে!

ফটক ঠেলে বদ্রী ঢুকল। গায়ে জহর কোট, পাজামা, হাতে ফোলিও ব্যাগ, চতুর গোঁফ। সোজা এসে রোদে-তাতা বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসল। ব্যাগ খুলে কাগজপত্র বের করতে করতে বলল, প্রমথবাবুর জমিতে বর্গা রেজিস্ট্রি হয়ে আছে। ওঠানো যাবে না। তবে বর্গার দরুন দাম কিছু ছাড়তে রাজি আছেন।

শ্রীনাথ বলে, আমি নিজে চাষ করাব। বর্গাদার দিয়ে হবে না।

সে আপনি করুন না! বর্গার আইন তো তাতে পালটে যাচ্ছে না। চাষ আপনি করালেও সেই তে-ভাগাই হবে। বর্গা পাকা খুঁটি।

শ্রীনাথ সবই জানে। গভীর শ্বাস ফেলে বলল, এ তো ধান চাষ নয়। আমি করব ভেষজের চাষ।

উকিলবাবুকে সব বলেছি। উনি বললেন, হওয়ার নয়।

বর্গাদার কে? দেখা করেছিলি তার সঙ্গে?

সে এক তেরিয়া ধরনের ছেলে। তবে বলছিল, প্রমথবাবুর কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পেলে আদালতে গিয়ে বলবে যে, চাষ সে করত না। কিন্তু উকিলবাবু সেই ফঁদে পা দিতে নিষেধ করেছেন। ওরা যখন-তখন কথা পালটায়। টাকা খাওয়ার পর আদালতে দাঁড়িয়ে উলটো কথা বললে কিছু করার থাকবে না।

শ্রীনাথ খানিক ভেবে বলে, তুই বরং কোনও চাষির জমি দ্যাখ, যে নিজে চাষ করে। বর্গার গন্ধ যেন না থাকে।

বদ্রী মাথা নেড়ে বলে, সে দেখব। কিন্তু কাছে-পিঠে হবে না।

দুরেই যাব।

অনেক দূর হলেও যাবেন? সেখানে নিজে গিয়ে চাষ করানো মানেই স্থায়ীভাবে থাকা।

থাকতে তো হবেই।

চাষ করাবেন বলছেন, তার মানে তো আবার সেই বর্গার খপ্পরে পড়ে গেলেন।

চাষ করাব না। ভাবছি নিজেই করব।

হাল গোরু সব কিনবেন? তার ওপর বলদের দেখাশোনা, লাঙলের মেরামতি, আরও কত কী সব করতে হবে। চাকরি করে কি পারবেন অত সব?

পারব। চাকরি করার ইচ্ছে থাকলে আর জমি করতে যেতাম নাকি? ভেষজের চাষে লাভও যেমন, তেমনি লোকের উপকারও হবে।

বদ্রী চারদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় সাবধানে বলে, বউঠান সঙ্গে যাবেন বলে তো বিশ্বাস হয়। সেখানে একা থেকে অসুখে পড়লে?

শ্রীনাথ চায়ের খালি কাপটা প্লেটের ওপর উপুড় করে ঘোরাতে ঘোরাতে হেসে বলে, এখানে অসুখ করলেই বা দেখছেটা কে? এখানেও একা, সেখানেও একা। তুই দ্যাখ।

 

দুধের মধ্যে সর ভাসলে ভারী ঘেন্না পায় সজল। রোজ তার দুধ ছাঁকনিতে ভাল করে ছেঁকে দেওয়া হয়। আজও তাই দিয়েছিল মেজদি মঞ্জুলেখা। তবু এক কুচি সর কীভাবে রয়ে গিয়েছিল তাতে। ওয়াক তুলে খুব চেঁচামেচি করেছে সজল। তাইতেই মায়ের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছে মেজদি।

শোওয়ার ঘরের মস্ত বিছানাটা বলটান দিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়-প্রমাণ উঁচু সেই বিছানা আর খাটের বাজুর মধ্যে যে খাজটুকু, সেইখানে উপুড় হয়ে পড়ে কাদছে মঞ্জুলেখা। মায়ের চিমটিতে তার ডান গাল ফুলে লাল হয়ে লঙ্কাবাটার মতো জ্বলছে। এই গাল নিয়ে সে লোকের সামনে বেরোয়। কী করে এখন? তাই এক পুকুর দুঃখের মধ্যে ড়ুবে কাদছে মঞ্জুলেখা। এ সময়ে খিচ করে চুলে একটা টান পড়ল। একবার। দু’বার। দূর থেকে সজল ছিপ ঘুরিয়ে বঁড়শি মারছে, চুলে। মুখটা তুলে মঞ্জুলেখা বলল, মরিস না কেন তুই?

সজল ছিপটা সামলে নিয়ে হি হি করে হেসে বলল, মাকে গিয়ে বলে দেব?

বল গে যা। কচু করবে।

যাচ্ছি তা হলে। বলব, মেজদি আমাকে বলেছে তুই মর।

সজল ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বিছানার খাঁজ থেকে উঠে পড়ল মঞ্জুলেখা। তাড়াতাড়ি এলো চুলে খোঁপা বেঁধে নিল। চুপিসারে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর মস্ত বাগানের গাছপালার মধ্যে পালিয়ে গেল।

সজল মায়ের কাছে নালিশ করবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল উঠোনে। উঠোন পেরিয়ে বান্নাঘরে যেতে যেতে আকাশের ঘন নীলের দিকে চাইল। দেখল শীতের অফুরান রোদে ঘর ছেড়ে বেরোনোর ডাক। আস্তে আস্তে শ্লথ হয়ে গেল তার পা।

বাগানের চারধারে শক্ত বেড়া আছে। উঠোনের চারধারে আছে নিচু ঘের-পাঁচিল। ফটক ঠেলে খ্যাপা-নিতাই ঢুকে এল। বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা একটা মস্ত রাঙা মুলো তার হাতে। সঙ্গে ইত। চেঁচাতে চেঁচাতে বলছে, গরম রুটি ডাল আর কাঁচা মুলো… ডাল রুটি কাঁচা মুলো, এর

ওপর কথা হয় না।

নিতাইয়ের ওপর এ বাড়ির কেউ খুশি নয়। একটা বাড়তি লোক খামোখা ঘাড়ের ওপর বসে খায়, থাকে। মন করলে কিছু কাজে আসে, পাগলামি চাড়ান দিলে কেবল বসে বক বক করে। রোজ রাতে পুতুলরাণীর একটা ছবি আঁকে কাগজে। তারপর মন্ত্র পড়ে বাণ মারে।

নিতাইকে ভারী ভাল লাগে সজলের। এই একটা লোক যার কোনও সময়েই কোনও কাজ থাকে, যাকে যখন খুশি ডাকলেই পাওয়া যায়, যার কাছে মনের কথা যা খুশি বলা যায়। সংসারে আর সবাই ভারী ব্যস্ত, সকলেরই ভারী তাড়া, নিজের গম্ভীর বাবার কাছে কখনওই প্রায় ঘেঁষতে পারে না সে। সবচেয়ে ভালবাসে যে মা, সেও চৌপর দিন সংসারের হাজারও কাজে ব্যস্ত থাকে বলে তেমন পাত্তা দিতে চায় না। সে শুনেছে যখন তারা খুব গরিব ছিল তখন বড়দি চিত্রলেখাকে পুষ্যি নিয়েছিল মেজমাসি। বড়দি সেই মাসির কাছে এলাহাবাদে থাকে। তাকে ভাল করে দেখেইনি সজল। আর দুই দিদির সঙ্গে ভাল বনিবনা নেই সজলের। মেজদি আর ছোড়দি দুজনেই হিংসুটির হদ্দ। মা সজলকে কিছু বেশি ভালবাসে বলে ওরা তাকে সহ্য করতে পারে না। তবে ভয় পায়।

খ্যাপা নিতাইয়ের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরের দিকে হন্যে হয়ে যেতে যেতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সজলকে দেখে বলল, আজ মদন ঠিকাদারকে খুব বকে দিয়ে এসেছি। পালপাড়ার জমি গায়েব করে রাস্তা বানাচ্ছিল।

সজল সঙ্গ ধরে বলল, আজ কোথাও নিয়ে যাবে নিতাইদা?

নিতাই আড়চোখে চেয়ে বলে, যাবে কোথায়? চারদিকে ট্যাম-গোপাল বসে আছে। ধরবে।

হি হি করে হাসে সজল। ট্যাম-গোপালের গলায় মত্ত ঘ্যাঘ। তাই দেখে সজল ভয় পেত বরাবর। ওই ঘ্যাঘের জনাই গোপালের নাম হয়েছিল ট্যাম-গোপাল। তার নাম করে সজলকে এতকাল ভয় দেখিয়ে যা করার নয় তাই করিয়ে নিয়েছে বাড়ির লোক। কিন্তু সজল যে আর অত ছোট নেই তা সবাই এখনও তেমন বুঝতে পারে না। সে বলল, টাম-গোপালের সঙ্গে আমার কবে ভাব হয়ে গেছে। চালাকি কোরো না নিতাইদা, আজ নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজতে যাব।

হবে হবে।

বলে নিতাই রান্নাঘরমুখো হাঁটা দেয়। সঙ্গে ইস্পাত, হাতে মুলো।

বাগানে একটা ছোট্ট পুকুর আছে। গাছে জল দেওয়ার জন্য বাবা কাটিয়েছিল। এখন তাতে কিলবিল করে আমেরিকান কই মাছ। এ বাড়ির কেউ এই মাছ খায় না। সজলের কাজ না থাকলে এসে চুপচাপ ছিপ ফেলে মাছ ধরে। পরে লুকিয়ে সেগুলো বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কাজ নেই বলে সজল ছিপ হাতে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। আটার টোপ ফেলে মাছের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

 

বদ্রী চলে গেলে শ্রীনাথ উঠল। অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে। বেশ একটু দেরিতেই যায়, রাত করে ফেরে।

বাইরের দিকে নিজের এই আলাদা ছোট্ট ঘরখানা শ্রীনাথের একার। এ ঘরে কদাচিৎ কেউ আসে। দাদা মল্লিনাথ এ বাড়ি বানিয়েছিল নিজের পছন্দমতো। এই ঘরটা ছিল ভাবন-ঘর। চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যে বাড়িতে একটা আলাদা ঘর থাকা দরকার এটা একমাত্র তার মাথাতেই আসতে পারে যার মাথার স্কু কিছু ঢিলে। বলতে নেই মল্লিনাথের মাথার কলকবজা কিছু ঢিলেই ছিল। বেশি বয়স পর্যন্ত ব্যাচেলর থাকলে যা হয়। অবরুদ্ধ কাম গিয়ে মাথায় চাড়া দেয়, নারীসঙ্গহীনতায় মনটা হয় ভারসাম্যহীন। পৃথিবীতে মেয়ে এবং ছেলে এই দুই জাতের সৃষ্টি যখন হয়েছে তখন তার পিছনে একটা কারণও থাকার কথা। এককে ছেড়ে আর একের কি পুরোপুরি চলে? শেষ দিকটায় মল্লিনাথের খুব সেবা করেছিল শ্রীনাথের বউ তৃষা। সেই কৃতজ্ঞতাতেই মলিনাথ তার গোটা বাড়ি সম্পত্তি সব তাকে উইল করে দিয়ে গেল। আর সেই থেকেই এ বাড়িতে পর হয়েছে শ্রীনাথ।

মল্লিনাথের এই ছোট্ট ভাবন-ঘরে সে থাকে। তার জাগতিক যা কিছু আছে সব এই ঘরটুকুর মধ্যে। তাও সব কিছু তার নিজের নয়। ওই ইজিচেয়ারটা মল্লিনাথের। লেখার ডেসকটাও তারই। দিশি মিস্ত্রি দিয়ে বানানো মজবুত চৌকিটার মালিক অবশ্য শ্রীনাথ। কিন্তু বইয়ের আলমারিটা মল্লিনাথের। এই ঘরে এই বাড়িতে বাস করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তেই শ্রীনাথের মনে হয়, সে পরের ঘরে বাস করছে। প্রতি মুহূর্তেই সে বোধ করে, এ বাড়ির দখল নিয়ে তারা ঠকাচ্ছে কাউকে।

মল্লিনাথের বিষয়-সম্পত্তির দাবিদার আরও দু’জন আছে। শ্রীনাথের ছোট দুই ভাই দীপনাথ আর সোমনাথ। দীপ অন্য ধরনের মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটন ও অঘটনের দিকেই তার ঝোক, কে কোথায় কবিঘে জমি নিয়ে বসে আছে তা তার মাথাব্যথার বিষয় নয়। দীপ অতিশয় জটিল চরিত্রের মানুষ, তাকে একদম বুঝতে পারে না শ্রীনাথ। কিন্তু ছোট সোমনাথ জটিলতার ধার ধারে না। মানুষের সহজ সরল লোভ হিংসা প্রবৃত্তির বশে সে চলে। অর্থাৎ সোমনাথ খুবই স্বাভাবিক। উপরন্তু তার ভাবের বিয়ের বউ আর শাশুড়ি তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়। সুতরাং, সে প্রথম-প্রথম এসে বড়দার সম্পত্তির ভাগ নিয়ে শ্রীনাথ আর তৃষার সঙ্গে একটা রফা করার কথা বলত। শ্রীনাথ এ সম্পত্তি চায় না, তার আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। সে থাকত চুপচাপ। সোমনাথের সঙ্গে লড়ত তৃষা একা। কিন্তু একাই সে একশো। প্রথম-প্রথম সোমনাথ নরম গরম কথাবার্তায় তুতিয়ে পাতিয়ে সম্পত্তি ভাগ করাতে চাইত, পরে সে নরম ছেড়ে গরম হল। রবিবার বা ছুটির দিনে এসে সে তুমুল ঝগড়া বাঁধাত তৃষার সঙ্গে। প্রায় সময়েই সঙ্গে করে আনত তার অল্পবয়সি প্রায় বালিকা বউকে। সে বউটিও গলার জোরে কিছু কম যায় না। কোনও পক্ষকেই কোনওদিন হার মানতে বা ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেনি শ্রীনাথ। ছুটির দিন এলে পারতপক্ষে সে নিজে আর এ বাড়িতে থাকত না। দূরে কোনও গ্রামগঞ্জে চাষ-আবাদ দেখার নাম করে চলে যেত।

খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই একদিন সোমনাথের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গত বছর শীতকালে এক রবিবারে এসে সারা দিন সোমনাথ আর শমিতা থেকেছিল এ বাড়িতে। দফায় দফায় প্রবল ঝগড়াঝাটি হল দু’পক্ষে। সন্ধেবেলা যখন স্বামী-স্ত্রী কলকাতার ট্রেন ধরতে স্টেশনে যাচ্ছে তখন বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে দু’ শো গজ যেতে না যেতেই নির্জন রাস্তায় দুটো লোক এসে ধরল তাদের। একজন শমিতাকে রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে গয়নাগাটি কেড়ে বদ মতলবে মাটিতে পেড়ে ফেলেছিল। অন্যজন লোহার রড দিয়ে চ্যাঙা-ব্যাঙা করে পিটিয়েছিল সোমনাথকে। হাতব্যাগ, ঘড়ি, মানিব্যাগ হাপিস করেছিল। শমিতা অবশ্য চরম লজ্জাকর ঘটনাটা ঘটতে দেয়নি। তার প্রবল প্রতিরোধ আর আঁচড় কামড়ে ধর্ষণকারী লুঠেরাটি নিবৃত্ত হয়। কিন্তু সোমনাথকে দিনতিনেক হেলথ সেন্টারে পড়ে থাকতে হয়েছিল। পুলিশ সেই ঘটনায় কাউকে আজও ধরতে পারেনি। সোমনাথকে যে লোকটা পিটিয়েছিল সে লোকটা নাকি ছিল বেশ লম্বা আর দশাসই চেহারার। আর শমিতাকে যে ধরেছিল সে নাকি ছিল নরম-সরম শরীরের ছোটখাটো মানুষ। দু’জনেরই মুখে ভুষো কালি মাখা ছিল বলে ওদের ভাল বর্ণনা দিতে পারেনি শমিতা আর সোমনাথ। তবে শমিতা বলেছে, তাকে যে ধরেছিল তার মুখে পচা মাছের মতো প্রবল এক দুর্গন্ধ পেয়েছে সে। কিন্তু এই অস্পষ্ট বিবরণ থেকে কাউকে চেনা মুশকিল। শ্রীনাথ অনেক ভেবেছে, কিন্তু এ অঞ্চলের কোনও মানুষকেই ওই দুই বদমাশ বলে মনে হয়নি। তবে সোমনাথ স্পষ্টই তাকে বলেছে, এ কাজ করিয়েছে তৃষা।

শ্রীনাথের কোনও পক্ষপাত নেই। তৃষা এ কাজ করালেও করাতে পারে। তৃষার হাতে লোকের অভাব নেই। ঘরামি, মাটিকাটা মজুর, রাজমিস্ত্রি, দালাল, পলিটিকসওয়ালা, পুলিশ দারোগা সকলের সঙ্গেই তৃষা সদ্ভাব রেখে চলে। শুধু ছিনতাই করার জন্যই যদি সোমনাথ আর শমিতাকে ধরেছিল ওরা তবে খামোখা সোমনাথকে অত মারল কেন? সোম্নাথ মার খাওয়ার পর অবশ্য শ্রীনাথ তৃষাকে ভাল করে লক্ষ করে দেখেছে। কোনও ভাবান্তর চোখে পড়েনি। কিন্তু শ্রীনাথ এও জানে, মুখের ভাবে ধরা পড়ার মতো কাঁচা মেয়ে তৃষা নয়। এই পুরো জমিজমা, সম্পত্তি একা হাতে সামলাচ্ছে তৃষা। সোমনাথ মার খেয়ে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দাদার সম্পত্তির ভাগ দাবি করে মামলা ঠুকেছে। সেই মামলাও একা চালাচ্ছে তৃষা। আদালতে গিয়ে উইলের প্রোবেট বের করেছে। উকিলের বাড়ি যাতায়াত করছে। দরকারমতো উকিলকে পরামর্শ দিচ্ছে। এরকম বউ থাকলে মেনিমুখো মানুষের গৌরব হওয়ার কথা।

ঘরে এসে গা থেকে ঘামে-ভেজা গেঞ্জিটা খুলে সেটা দিয়েই গা মুছে নিল শ্রীনাথ। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে রইল একটু। মাথায় অজস্র চিন্তার ভিড়। কোনওটাই কাজের চিন্তা নয়। মল্লিনাথের এই ভাবন-ঘরের চারদিকেই অজস্র জানালা। আলোয় হাওয়ায় ঘরে ভাসাসি কাণ্ড। ভারী সুন্দর। কিন্তু সারাক্ষণ একটা অস্বস্তির কাটা বিধে থাকে শ্রীনাথের মনে। এ বাড়ি দাদা বানিয়েছিল, এখন এর মালিক তার বউ তৃষা। এসব তার নয়, সে এ বাড়ির কেউ নয়।

গোলপা একটা মুখ উঁকি দিল দরজায়। আবছা একটা ফেঁপানির শব্দ। আধবোজা চোখেই মুখখানা নজবে এল শ্রীনাথের। তার মেজো মেয়ে মঞ্জ।

শ্রীনাথ সোজা হয়ে বসে বলল, কী রে? কাঁদছিস নাকি?

কোনও জবাব নেই। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে অবশেষে মঞ্জু আড়াল থেকে বেরিয়ে কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু। খোলা চুল নেমে এসে খানিকটা আড়াল করেছে মুখখানা।

আগে ছেলেমেয়ের ওপর বড় মায়া ছিল শ্রীনাথের। বাড়ি ছেড়ে দূরে যেতে পারত না। এখন কে যেন আর বুকের মধ্যে তেমন ব্যাকুলতা নেই, টান নেই। ছেলেমেয়েদের দেখলে, হঠাৎ যেন মনে হয়, অন্য কারও ছেলেমেয়ে। আগে খুব মিশত ওদের সঙ্গে শ্রীনাথ, আজকাল গা বাঁচিয়ে থাকে। পারতপক্ষে ওরাও আজকাল তার কাছে ঘেঁষে না। মেয়ে দুটো তবু মাঝে মাঝে একটু-আধটু ডাক-খোঁজ করে, কিন্তু ছেলের সঙ্গে প্রায় পরিচয়ই নেই শ্রীনাথের। ছেলে সজল পুরোপুরি তার মায়ের সম্পত্তি। এইভাবে বন্ধনমুক্তি শ্রীনাথের খুব খারাপও লাগছে না।

শ্রীনাথ আর কিছু বলছে না দেখে মঞ্জু এলোচুল খোঁপায় বাঁধল, চোখ মুছল, তারপর খুব সংকোচে সাবধানি পায়ে ঘরে এসে চৌকির বিছানায় বসে বলল, তোমার এ ঘরের চাবিটা আজ আমাকে দিয়ে যাবে বাবা?

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কেন?

আমি এখানে দুপুরটা থাকব।

তাই বা থাকবি কেন? ঝগড়া করেছিস নাকি কারও সঙ্গে?

ভাই ভীষণ পাজি। সারাদিন মাকে নালিশ করে মার খাওয়ায়। আজও মা কীরকম মেরেছে দেখো। গাল এখনও ফুলে আছে দেখেছ?

দেখল শ্রীনাথ। তৃষা এরকমই মারে! শ্রীনাথ উঠে দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে বলল, এ ঘরে তোকে খুঁজে পাবে না নাকি?

মঞ্জু সংকোচের গলায় বলে, ভাই তো তোমাকে ভয় পায়। এ ঘরে আসতে সাহস পাবে না।

এ কথায় একটু থমকাল শ্রীনাথ। এ বাড়ির কেউ তাকে ভয় পায় এটা নতুন কথা। সজল কে তাকে ভয় পায় তা বুঝতে চেষ্টা করেও পারল না। মাথাও ঘামাল না বিশেষ। বালতি মগ আর সর্ষের তেলের শিশি নিয়ে ঘবের পিছন দিকে টিউবওয়েলে যেতে যেতে বলল, চাবি রেখে দিস, কিন্তু জিনিসপত্র ঘাঁটিস না।

বিশাল উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় নিকোনো শানের মেঝেয় পরিপাটি গালচের আসনের সামনে বাড়া ভাত আর ঢাকা-দেওয়া জলের গেলাসটি সাজিয়ে রাখার দৃশ্যটি দেখলে তখনও তার সেই একটি কথাই মনে আসে। এ বাড়িতে সে বড় বেশি অতিথির মতো। তৃষার কাজ নয়, এ হচ্ছে রাঁধুনি বামনির যত্ন-আত্তি। পিছনে অবশ্য তৃষার হুকুম আছে। কিন্তু এক কালে গরিব অবস্থার সময়ে কলকাতার শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের ভাড়াটে বাসায় তৃষা নিজের হাতে বেঁধে তাকে খেতে দিত, তখনও কোনওদিন এত যত্নে ভাত বেড়ে দেয়নি।

তবে তৃষা ভাত বেড়ে না দিলেও আজ কাছেপিঠেই ছিল। শ্রীনাথ খেতে বসার পরই সামনে এসে বসে বলল, কতদিন হয়ে গেল বিলুর চিঠি এসেছে। প্রীতমবাবুর অত অসুখ, তোমার একবার দেখতে যাওয়া উচিত ছিল না? রোজই তো কলকাতা যাচ্ছ। একদিন অফিসের পর গিয়ে ঘুৱে আসতে কী হয়?

ভগ্নিপতির অসুখের খবর একটা কানে এসেছিল বটে শ্রীনাথের। অতটা গুরুত্ব দেয়নি। এখন বলল, কী অসুখ? খুব খারাপ কিছু নাকি?

তৃষা বলল, অত ভেঙে তো লেখেনি। শুধু লিখেছে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না পর্যন্ত।

শ্রীনাথ ভ্রু কোঁচকাল। কতকাল হল সে বিলুর খবর রাখে না? বছরখানেক হবে? তা হবে বোধহয়। গতবার বিলু ভাইফেঁাটায় ডেকেছিল। সেবারই শেষ দেখা। এবার ভাইফোটায় বিলুও ডাকেনি, শ্রীনাথেরও ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এতকাল মায়ের পেটের বোনকে একেবারে ভুলে সে ছিল কী করে? শ্রীনাথ পাতের দিকে চোখ রেখেই বলল, চিকিৎসার ব্যবস্থা কী করেছে?

কী আবার করবে? স্বামীর অসুখ হলে স্ত্রীরা যেমন করে তেমনই ব্যবস্থা করেছে। নিজে গিয়ে দেখে এলেই তো হয়।

উদাস উদার গলায় শ্রীনাথ বলল, যাব।

আজই যেয়ো পারলে। দেরি করা ঠিক নয়।

আজই?–বলে ভাবল একটু শ্ৰীনাথ। কী হয়েছে তার আজকাল, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে এক পা হাঁটতে হলেও কেন যে জড়তা আসে।

কেন, আজ কি কোনও কাজ আছে?

শ্রীনাথ বলে, অফিস ছুটির পর বাসে ট্রামে বড্ড ভিড়। তার চেয়ে কোনও ছুটির দিনে–

তৃষা মাথা নেড়ে বলে, তা তুমি কি যাবে? ছুটির দিনে মানুষকে আলিস্যির ভূতে পায়। ব্যাপারটা ফেলে রাখলে আবার বছর গড়িয়ে যাবে। যেতে হলে আজই যাও। বিলুকে বোলো আমি মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। নইলে আমিও যেতাম।

০২. দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে

দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে আঁচাতে আঁচাতে খুব সাবধানে চোখের মণি বাঁয়ে সরিয়ে শ্রীনাথ তার বউ তুষাকে দেখল। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশ লম্বা, প্রায় শ্রীনাথের সমান। গায়ে মেদ নেই, কিন্তু তেজালো একটা শক্তি-সামর্থ্যের ভাব আছে। গায়ের রং শ্যামলা। মুখখানাকে সুন্দর বলা যায়, কিন্তু একটু বন্যভাব আর লোভ আর হিংস্রতা মেশানো আছে। এ বাড়ির ঝি চাকর মুনিশ খামোখা ওকে ভয় খায় না। ভয় পাওয়ার মতো একটা থমথমে ব্যক্তিত্ব আছে তৃষার। এ মেয়ের বর হওয়া খুব স্বস্তির ব্যাপার নয়। শ্রীনাথ কোনওদিন স্বস্তি পায়নি। কী করে তবে এর কাছে স্বস্তি পেয়েছিল মল্লিনাথ? তুষার মুখে যে মধুর আত্মবিশ্বাস আর নিজের ধ্যানধারণার ওপর অগাধ আস্থার ভাব রয়েছে সেটা লক্ষ করলেই বোঝা যায়, সোমনাথ মামলায় হেরে যাবে। তৃষার সঙ্গে কেউ কখনও জেতেনি।

ভাবতে ভাবতে রোদে-ভরা উঠোন পেরোতে থাকে শ্রীনাথ। সোমনাথের দুরবস্থার কথা চিন্তা করতে করতে আপনমনে হাসে। চাকরির জমানো টাকা খরচ করে দেওয়ানি মামলা লড়তে গিয়ে ফতুর হয়ে যাচ্ছে বেচারা। তৃষার ধান-বেচা অগাধ টাকা তো ওর নেই। যখন মামলায় হারবে তখন মাথায় হাত দিয়ে বসবে। বেচারা! সোমনাথ মরিয়া হয়ে এমন কথাও বলে বেড়াচ্ছে মল্লিনাথকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সম্পত্তি বাগাবার জন্য তৃষা তার ভাসুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। পাতিয়েছিল।

এ কথাও কি উড়িয়ে দিতে পারে শ্রীনাথ? রোদ থেকে বাগানের ছায়ায় পা দিয়েই সে থমকে দাঁড়ায়। অবৈধ সম্পর্কের কথাটা মনে হতেই তার শরীর গরম হচ্ছে। রক্তে উথাল পাথাল। সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কামভাব। আশ্চর্য এই, তৃষাকে সে সন্দেহ তো করেই, তার ওপর সেই সন্দেহ থেকে একটা তীব্র আনন্দও পায়।

পুকুরপাড়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে না? সজল কি? কয়েক পা এগিয়ে গেল শ্রীনাথ। চোখের দৃষ্টি এখন আগের মতো তীক্ষ্ণ নেই। তবু মনে হল সজল। মাছ ধরছে।

নিঃসাড়ে এগিয়ে যায় শ্রীনাথ।

জলের খুব ধারে দাঁড়িয়ে আছে সজল। সাঁতার জানে না। পাশে ঘাসের ওপর কম করেও পাঁচ-ছ’টা মাছ পড়ে আছে। কেউ খায় না। ধরছে কেন তবে?

খুবই রেগে গেল শ্রীনাথ। এমনিতেও তুষার আশকারা আর আদরে বেহেড এই ছেলেটাকে তেমন পছন্দ করে না শ্রীনাথ। একটু আগেই মঞ্জু বলছিল, মাকে বলে দিদিদের মার খাওয়ায়। ছেলেটা।

শ্রীনাথ আচমকা পিছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, কী করছ?

একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। চমকে কেঁপে উবু হয়ে পড়ে যেতে যেতে কষ্টে সামলে নিল সজল। ভয়ে সাদা মুখ ফিরিয়ে তাকাল! তার সামনে খাড়াই পাড় ছিল। অন্তত সাত-আট ফুট নীচে জল। পড়লে খুব সহজে ওঠানো যেত না। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে শ্রীনাথ একটু লজ্জিত হয়। ঠান্ডা গলায় বলে, মাছ ধরতে কে বলেছে?

সজল আস্তে করে বলে, কেউ বলেনি।

ছেলের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাসের দরুন কী বলবে তার ভাষা ঠিক করতে পারে না শ্রীনাথ। গম্ভীর মুখে বলে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তুমি কি সাঁতার জানো?

না।

তা হলে পুকুরের ধারে আর কখনও এসো না।

ঘাড় কাত করে ভাল মানুষের মতো সজল বলল, আচ্ছা।

তারপর ছিপ গোটাতে লাগল।

শ্রীনাথ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি মায়ের কাছে দিদিদের নামে নালিশ করো?

সজল সেই রকমই ভয়ার্ত মুখে বাবার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, না তো!

আজই করেছ।

সজল মৃদু স্বরে বলে, দুধে সর ছিল। তাই বলেছিলাম।

তুমি দুধের সর খাও না?

সজল মাথা নাড়ে। না।

শ্রীনাথ একটু হেসে বলে, সর তত ভাল। পুষ্টি হয়।

ঘেন্না লাগে।

শ্রীনাথ একটু চেয়ে থেকে কী বলবে ভাবে। তারপর খাস ছেড়ে বলে, যারা রোজ দুধ খায় তারা বুঝবে না একটুখানি ঘেন্নার সর কত ছেলের কাছে অমৃতের মতো।

সজল কথাটা হয়তো বুঝল না, কিন্তু টের পেল যে, বাবা তার ওপর খুশি নয়। তার মুখে-চোখে ডাইনি বুড়ি দেখার মতো অগাধ অসহায় ভয়। শ্রীনাথের মনে পড়ল, এক সময়ে ট্যাম-গোপালের নাম করলে সজল ভয় পেত খুব! আজ তার বাবাই তার কাছে সেই ট্যাম-গোপাল।

শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, আমার সম্পর্কে তোমাকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?

না-তো!–তেমনি ভয়ে ভয়েই বলে সজল।

তবে ভয় পাচ্ছ কেন?

সজল হাতের ছিপটার দিকে চেয়ে থাকে মাথা নিচু করে।

শ্রীনাথ একটু মজা করার জন্য বলে, আমার তো শিং নেই, বড় বড় দাঁত নেই, থাবা নেই। তবে?

সজল এ কথায় একটুও মজা পেল না। তার মুখ রক্তশূন্য, চোখে কোনও ভাষা নেই। এই অসহায় অবস্থা থেকে ওকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই শ্রীনাথ বলে, যাও। তোমাকে কিন্তু আমি বকিনি। সাবধান করে দিয়েছি মাত্র। ওই মাছগুলো এখন কী করবে?

কিছু করব না।

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, কিছু করবে না তো কি ফেলে দেবে? বরং খ্যাপা নিতাইকে দিয়ে। সে বেঁধে খাবেন। নইলে গরিব-দুঃখী কাউকে দিয়ে দিয়ে যাও।

সজল চলে গেলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে ইস্পাতের আনা সেই গো-হাড়টা নজরে পড়ে শ্রীনাথের। কাঁচা হাড়। এখনও মাংস লেগে আছে। ঘেন্নায় গা বিরিয়ে ওঠে। আর সেই সঙ্গেই আবার গুপ্ত কাম-ভাবটা মাথা চাড়া দেয়।

ঘরটা হাট করে খোলা। মঞ্জু নেই। শ্রীনাথ তার ইজিচেয়ারে বসে খানিক বিশ্রাম করে। তারপর উঠে জামাকাপড় পরতে থাকে।

শ্রীনাথের চাকরিটা খুবই সামান্য। এত ছোট চাকরি যে, নিজেকে নিয়ে একটু অহংকার থাকে না। একটা মস্ত বড় নামী প্রেসে সে প্রুফ দেখে। বেতন যে খুব খারাপ পায় তা নয়। কিন্তু এ চাকরিতে কোনও কর্তৃত্ব নেই, উন্নতির সম্ভাবনা নেই, উপরন্তু সারা বছরই প্রচণ্ড খাটুনি।

তারা সব ক’জন ভাই-ই ছিল ভাল ছাত্র। শ্রীনাথ একান্ন সালে ফাস্ট ডিভিশনে অঙ্ক আর সংস্কৃতে লেটার পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করে। আই এস-সিতে লেটার না পেলেও ডিভিশনটা ছিল। বি এস-সিতে পাসকোর্সে ডিস্টিংশন পায়। কিছু লোক আছে যাদের পাথরচাপা কপাল। বি এস-সি পাশ করে কিছুদিন মাস্টারি করেছিল শ্রীনাথ। তখন মনে হত, একদিন নিশ্চয়ই সে এসব ছোটখাটো পরিমণ্ডল ছেড়ে মস্ত কোনও কাজ করবে। মফসসল ছেড়ে কলকাতাবাসী হওয়ার জন্য একদা মাস্টারি ছেড়ে প্রেসের চাকরিটা নিয়েছিল সে। তখনও ভাবত, এ চাকরিটা নিতান্তই সাময়িক। বড় চাকরি পেলে এটা ছেড়ে দেবে। সেই ছাড়াটা আর হয়ে উঠল না। একটা জীবন বড় কষ্টে কেটেছে। দাদা মল্লিনাথ ছিল মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু একটু খ্যাপাটে স্বভাবের দরুন এক চাকরি বেশিদিন করত না। তারপর একদিন খেয়ালের বশে মারকিনি কায়দায় র্যনিচ বা খামারবাড়ি বানিয়ে চাষবাস করে একটা বিপ্লব ঘটানোর জন্য এইখানে চলে এল। উন্মার্গগামী ও অসম্ভব সুপুরুষ মল্লিনাথকে ভালবাসত সবাই। সে বিবাহে বিশ্বাসী ছিল না, কিন্তু একটু হয়তো মেয়েমানুষের দোষ ছিল। প্রচণ্ড মদও খেত। খুব খাটত, অনিয়ম করত, শরীরের যত্ন নিত না। ছুটির দিনে শ্রীনাথ সপরিবারে বেড়াতে এলে মলিনাথ তাদের ছাড়তে চাইত না। তৃষাকে এটা ওটা রান্নার ফরমাশ করত। তৃষা সেই পাগল লোকটার মনস্তত্ত্ব বুঝতে পেরেছিল জলের মতো। স্বামীর চেয়েও বেশি যত্ন করত তাকে। এমনও হয়েছে ছেলেমেয়ে সহ তৃষাকে এখানে চার-পাঁচ দিনের জন্য রেখে কলকাতায় ফিরে গেছে শ্রীনাথ। সেই সব দিনের কথা ভাবতে চায় না সে এখন আর। ওই সব দিনগুলি তার বুকে বিশাল বিশাল গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। কালো রহস্যে ঢাকা গহ্বর সব। আজও সে একা বসে বসে সেই সব কথা ভাবে আর শিউরে ওঠে গা। তখন ব্যাপারটা অসংগত মনে হত না কেন যে! এখন মনে হয়, কী সাংঘাতিক ভুলটাই সে করেছিল। তখন গরিব ছিল সে। বড়ই গরিব। মলিনাথ দেদার সাহায্য করত। ছেলেমেয়েরা এখানে এলে ভাল খাওয়া পেত, পরিষ্কার জলবায়ু পেত। অন্য দিকটা তখন কিছুতেই চোখে পড়ত না শ্রীনাথের।

কাজে আজ মন লাগছিল না শ্রীনাথের। মাঝে মাঝে এক রকম হাঁফ ধরা একঘেয়েমির মতো লাগে। মাইনের টাকাটা এখন আর দিতে হয় না তৃষাকে, তার নিজের খাই-খরচও নেই। সুতরাং টাকাটা জমে বেশ মোটা অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। বদ্রী যদি খোঁজ দিতে পারে তবে সে নিজস্ব আলাদা জমি কিনে ভেষজের চাষ করবে। চাকরি করবে না, সারাক্ষণ দাদা মল্লিনাথের বাসায় বাস করার অপরাধবোধ থেকেও মুক্ত হবে।

প্রুফ রিডার হলেও প্রেসে তার কিছু খাতির আছে। খাতিরটা ঠিক তার নয়, পয়সার। সবাই জানে শ্রীনাথবাবুর পয়সা হয়েছে। সেই খাতিরটুকু মাঝে মাঝে ভাঙায় শ্রীনাথ। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টেনে-মেনে কাজ করে সুপারভাইজারকে গিয়ে বলল, আমার ভগ্নিপতির বড্ড অসুখ। একটু যেতে হবে।

সুপারভাইজার বোসবাবুর সঙ্গে খুবই খাতির তার। বোসবাবু হেসে-টেসে বলেন, গেলেই হয়। ভগ্নিপতির অসুখের কথাটা বোধহয় বিশ্বাস হল না বোসবাবুর। শ্রীনাথের মনে খিচ থেকে গেল একটু। বিশ্বাস না করলেও বোসবাবুকে দোষ দেওয়া যায় না। মাঝেমধ্যেই আলতু-ফালতু অজুহাত দেখিয়ে সে অফিস থেকে কেটে পড়ে।

বাইরে শীতের ক্ষণস্থায়ী বেলা ফুরিয়ে সন্ধে নেমে এসেছে। বেশ শীত। শরীরের মধ্যে সকাল থেকে জিয়োল মাছের মতো ছটফট করে দাপাচ্ছে অদম্য সেই কামের তাড়না। তৃষার সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতার দরুন শরীরের ব্যাপারটা বড় একটা হয়ে ওঠে না। তুষার প্রতি তার যেমন নিস্পৃহতা, তার প্রতি তুষারও তাই। কিন্তু তা হলে চল্লিশ-বিয়াল্লিশে তার পুরুষত্ব তো আর মরে যায়নি?

প্রীতমকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত, এটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনকে বোঝাল সে। এই মধ্য কলকাতা থেকে ভবানীপুর যে খুব একটা দূর তাও নয়। কিন্তু গণ-বিস্ফোরণে কলকাতার রাস্তাঘাট এত গিজগিজে, ট্রাম-বাসের এমনই আসন্নপ্রসবার চেহারা এবং এত ধীর তাদের গতি যে কোথাও যেতে ইচ্ছেটাই জাগে না।

ইচ্ছে-অনিচ্ছের মধ্যে খানিক হেঁটে সে গিরিশ পার্কের পিছনের এলাকায় চলে এল। এখানে সে যে নিয়মিত আসে তা নয়, তবে মাঝে মধ্যে কাম তাড়া করলে চলে আসে। মেয়েমানুষের দরদাম ঠিক করতে পারে না সে। যা চায় প্রায় দিয়ে দেয় এবং বোধহয় খুব ঠকে যায়। এ পর্যন্ত যে তিন-চারজন বেশ্যার কাছে সে গেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বিপজ্জনক মনে হয়েছে দানা নামে। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের একটি মেয়েকে। একটু বেশি কথা বলে, একটু বোকাও, কিন্তু কেমন একটু ধর্মভাব আছে তার।

সাড়ে পাঁচটাও বাজেনি ভাল করে। এটা ঠিক সময় নয়। তবু এ সময়টাই ভাল। অব্যবহৃত মেয়েদের পেতে হলে একটু আগে আসা ভাল।

এ পাড়াতেও গিজগিজ করছে লোকজন। বেশির ভাগই মতলববাজ লোক। মেয়ের দালাল, গুন্ডা, মাতাল, কামুক। সে এদেরই একজন, এ কথা ভাবতে তার অহংবোধে লাগে। কিন্তু বাস্তববোধ তার কিছু কম নয়। মুখটা রুমালে সামান্য আড়াল করে সে গলি থেকে আরও গহিন গলির অন্ধকারে ঢুকে যেতে লাগল।

দোতলা বাড়িটার ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাঁফ ছাডে সে। কিছু ক্লান্তি আর উদ্বেগে শরীরটা অস্থির। বুকে হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দীনা তার ঘরের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখচোখের অবস্থা ভাল নয়। বোধহয় মন খারাপ। ওর একটা বছর দশ-বারোর মেয়ে আছে। তার কিছু হয়নি তো? হলে আজ জমবে না।

দীনা তাকে চিনতে পারল। ডাকতেই মুখ ফিবিয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখল তাকে। তারপর ক্রু সহজ হয়ে গেল। বলল, অনেক দিন পর না?

তুমি ভাল আছ?–জিজ্ঞেস করে শ্রীনাথ।

ভাল আর কী? আসুন।

ভিতরে ঢুকে দীনা কপাট ভেজিয়ে দিয়ে বলে, কী কাণ্ড শুনবেন?

কী?

সে এক কাণ্ডই।

বলে দীনা হেসে ফেলে। দেখতে ভাল কিছু নয় মেয়েটা। সাদামাটা পেঁয়ো চেহারা। রং কালো। মাঝারি লম্বা, মাঝারি গড়ন। কিছু বৈশিষ্ট্য নেই। তাই খদ্দেরেরও বাঁধাবাঁধি নেই। হেসে ফের গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, খুব রাগ হচ্ছে আমার, হাসিও পাচ্ছে। দুটো স্কুলে-পড়া ছেলে এসেছিল আজ জানেন?

বটে?–শ্রীনাথ তেমন আগ্রহ দেখায় না। স্কুল কলেজের ছেলেরা আজকাল হরবখত বেশ্যাপাড়ায় যায়। কিছু অস্বাভাবিক নয়।

দীনা চৌকির বিছানায় বসে খুব চিন্তিত মুখে বলে, চৌদ্দ-পনেরোর বেশি বয়স নয়, গায়ে স্কুলের পোশাক পর্যন্ত রয়েছে। ঠিক দুপুরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেখি দুই মূর্তি। প্রথমে ভেবেছিলাম পথ ভুল করে এসেছে বা জলতেষ্টা পেয়েছে বলে ঢুকে পড়েছে। তারপর দেখি তোতলাচ্ছে, আগড়ুম বাগড়ুম বলছে। বলতে গেলে ছেলের বয়সি। যখন বুঝতে পারলুম মতলব অন্যরকম, তখন এমন রাগ হল! বেঁটে ছাতাটা হাতের কাছে পেয়ে সেইটে দিয়ে পয়লা ছেলেটাকে দিলুম কষে ঘা কতক। দুটোয় মিলে এমন পড়িমরি করে পালাল না!

দীনা হেসে খুন হতে লাগল বলতে বলতে। তারপর ফের গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু অন্য একটা কথা ভেবে ভারী ভয় হয়, জানেন! ভাবি, আজ না হয় তাড়ালুম। কিন্তু রোজ যদি ওরকম সব ছেলেরা আসে? একদিন হয়তো আর তাড়াব না।

শ্রীনাথ কিছু বিরক্ত হয়ে বলে, আজই বা তাড়ালে কেন? ওরা তো কারও না কারও কাছে যাবেই। মাঝখানে তোমার রোজগারটা গেল।

দীনা ঠোঁট উলটে বলে, ঝাঁটা মারি রোজগারের মুখে! বেশ্যা বলে কি ঘেন্নাপিত্তি নেই?

শ্রীনাথ দার্শনিকের মতো একটু হাসে। বেশ্যা বলে নয়, আজকাল এই দুনিয়ায় কোনও মানুষেরই ঘেন্নাপিত্তি খুব বেশিদিন থাকে না।

প্রীতমকে দেখতে যাওয়া হল না। বাড়ি ফিরতে বেশ একটু রাত হয়ে গেল শ্রীনাথের। স্টেশনে নেমে শীতে অন্ধকারে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, এই রাতে গিয়ে কোন অজুহাতে স্নানের জন্য গরম জল চাইবে। স্নান না করলেই নয়। যতবার বেশ্যাপাড়ায় গেছে ততবার ফিরে এসে স্নান করতেই হয়েছে তাকে। নইলে ভারী খিতখিত করে।

বাড়িটা ভারী নিঃঝুম। অন্ধকারে নিবিড় গাছপালার ছায়ায় আর কুয়াশায় যেন মিশে গেছে চারপাশের সঙ্গে। শুধু বাগানের মধ্যে এক জায়গায় শুকনো কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে বসে আছে খ্যাপা নিতাই। প্রতিদিন এই নিশুত রাতে মাটিতে একটা শলা দিয়ে পুতুলরাণীকে আঁকে সে। তারপর মন্ত্র পড়ে বাণ মারে। এতদিনে বাণের চোটে পুতুলরাণীর মুখে রক্ত উঠে মরার কথা। কিন্তু শ্রীনাথ যতদূর জানে পুতুলরাণী গুসকরায় রসবড়া ভাজছে। মাঝখান থেকে এ ব্যাটাই তান্ত্রিক-মান্ত্রিক সেজে খ্যাপাটে হয়ে গেল।

নিতাই নাকি রে?–ডাকল শ্রীনাথ।

ডাক শুনে নিতাই উঠে আসে, কিছু বলছেন?

তোর আগুনটায় আমায় এক ডেকচি জল গরম করে দে তো!

গু মাড়িয়েছেন বুঝি? স্নান করবেন?

ঠিক ধরেছিস। আমার ঘর থেকে ডেকচি নিয়ে যায়। আর শোন, তোর কুকুরটা একটা গো-হাড় এনে ফেলেছিল এইখানে। ওটা তুলে ফেলে দিস।

বলে টর্চ জ্বেলে বারান্দার তলায় দেখাল শ্রীনাথ। হাড়টা পড়ে আছে এখনও।

নিতাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বাঁ হাতে হাড়টা তুলে নিয়ে বলল, দিচ্ছি ফেলে।

ব্যাটা চামার।–গাল দেয় শ্রীনাথ, এত রাতে হাড়টা ছুঁতে গেল?

নিতাই অন্ধকারে জটাজুট নিয়ে মিলিয়ে যায়। একটু বাদে ডেকচি নিয়ে ফিরে আসে।

এই শীতে খোলা জায়গায় টিউবওয়েলের ধারে গরম জলে স্নান করতে গিয়েও শীতে থরথরিয়ে কাপছিল শ্রীনাথ। স্নানের পর যখন গা মুছছে তখন হ্যারিকেনের সামনে একটা মস্ত ছায়া এসে পড়ল।

চোখ তুলে দেখল, তৃষা। আর একবার আপনা থেকেই কেঁপে উঠল শ্রীনাথ।

তৃষা গম্ভীর মুখে বলে, তুমি কি আজ সজলকে বকেছ?

আমি?–বলে ভাববার চেষ্টা করে শ্রীনাথ। ভেবে-টেবে বলে, বকিনি। তবে পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিল। সাঁতার জানে না। বিপদ হতে পারে সাবধান করে দিয়েছিলাম।

তৃষা কোনও তর্ক করতে আসেনি। বিমর্ষ মুখে বলল, ছেলেটার বিকেল থেকে খুব জ্বর। ভুল বকছে। জ্বরের ঘোরে বার বার বলছে, বাবা বকেছে। বলেছে মারবে। ভীষণ মারবে।

বেকুবের মতো চেয়ে থেকে শ্রীনাথ বলে, মারব বলিনি তো! মারব কেন?

তৃষা একটু অবাক গলায় বলল, তুমি কি রোজ রাতে স্নান করো? সাধুটাধু হলে নাকি?

না। ওই নিতাইয়ের কুকুরটা একটা গোরুর হাড় এনে ফেলেছিল। সেটা পায়ে লেগেছে।

ও।–বলে তৃষা চলে গেল।

সজলকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত কি না তা বুঝল না শ্রীনাথ। বাবা হিসেবে হয়তো উচিত। কিন্তু সে তো ঠিক স্বাভাবিক বাবা নয়।

স্নান করে ঘরে ফিরে এসে বালতি রেখে দড়িতে গামছা টাঙাচ্ছে, এমন সময় মঞ্জু এল চুপিসারে।

বাবা!

আবার কী চাই?

ভাইয়ের জ্বর হয়েছে কেন জানো?

না তো। কেন?

ভাই বলেছে, তুমি নাকি ওকে আজ খুব মেরেছ। মারতে মারতে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলে। তাই!

শ্রীনাথ রাগে স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, সজল এ কথা বলেছে?

নিজের কানে শুনেছি বাবা। আমার সামনেই মাকে বলল।

আমি মেরেছি?

বলে দিশেহারা শ্রীনাথ নিজের দুটো হাতের দিকে যেন সন্দেহবশে চেয়ে দেখল একটু। তারপর রাগে গরগর করে বলল, আচ্ছা মিথ্যেবাদী ছেলে তো! ওকে চাবকানো দরকার।

শুনে খুশি হল মঞ্জু। বলল, আমাদের নামেও বলে।

থমথমে মুখে শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, ওর জ্বর এখন কত?

একশো চার। ওকে কিছু বলব বাবা?

না, এখন থাক। যা বলার আমিই বলব।

সেই রাগ নিয়েই গিয়ে রান্নাঘরে খেতে বসল শ্রীনাথ। সেই রাগ নিয়েই শুল রাত্রে। ঘুম আসতে চাইল না। পৃথিবীটা বড় পচে যাচ্ছে যে! সেই পচনের দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট। নিজের ছেলে জলজ্যান্ত এমন মিথ্যে কথাটা বলল কেমন করে?

শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রীনাথ। স্বপ্ন দেখল, সজল একটা মস্ত সুন্দর দিঘির ধারে মাছ ধরছে। আসলে মাছ নয়, পুকুর থেকে ছিপের টানে উঠে আসছে নানা রঙের ঘুড়ি। পিছন থেকে চুপিচুপি গিয়ে শ্রীনাথ ওর পিছনে দাঁড়াল। দেখল দিঘির জল খুব গভীর। সজল তার পিছনে বাবার উপস্থিতি টের পায়নি। শ্রীনাথ হাত বাড়িয়ে আচমকা সজলকে ঠেলে ফেলে দিল জলে।

০৩. শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার

শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার থেকে দুপুরের রোদে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছিল। দূর প্রসারিত নীলবর্ণ পাহাড়ের আড়াল থেকে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে হঠাৎ তাকালে মনে হবে যেন শূন্যে ভেসে আছে। যেন-বা রুপোলি মেঘ। বহুবার দেখেছে দীপনাথ। আবারও দেখছে।

রওনা হতে আর বেশি দেরি নেই। হোটেলের লাগোয়া ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিসের লাউঞ্জে একটু আগেই সে দেখে এসেছে এ কে বোসের নামের লেবেল মারা একটা বেডিং আর দুটো ঢাউস বিদেশি ফাইবার গ্লাসের সুটকেস নামানো হয়েছে। সে বুঝতে পারছে না মালপত্রগুলো নিয়ে তাকেই এয়ারলাইনসের গাড়িতে যেতে হবে কি না। এয়ারলাইনসের লাউঞ্জে মালপত্র রাখার অর্থটা তাই দাঁড়ায়। বোস আর তার স্ত্রীর জন্য রাঙ্গাপানি টি এস্টেটের অ্যামবাসাড়ার গাড়ি এসে গেছে। দীপনাথ বুঝতে পারছে না বাগডোগরায় সে নিজে যাবে কীসে। অ্যামবাসাডারে, না এয়ারলাইনসের। গাড়িতে? বস্তুত আজকাল এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই। সিদ্ধান্ত নেয় বোস। বোসের ইচ্ছাই তার সিদ্ধান্ত। তবে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আর ভাবে না দীপনাথ। মেনে নিতে নিতে মন ভোতা হয়ে গেছে।

পরশু গ্যাংটকে কার্পেট কেনা নিয়ে বোস ও তার স্ত্রীর মধ্যে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলার খরচের হাত সাংঘাতিক। সেই ঝগড়ার জের এখনও চলছে কি না কে জানে! যদি চলে তবে বোস স্বভাবতই চাইবে দীপনাথ তাদের সঙ্গে অ্যামবাসাডারেই এয়ারপোর্টে যাক। সেক্ষেত্রে বোস বসবে সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে, দীপনাথকে বসতে হবে শ্রীমতী বোসের পাশে একটু জড়সড় হয়ে পিছনের সিটে এবং পুরো রাস্তাটাই কোনও কথাবার্তা হবে না। বড় জোর শ্রীমতী বোস বলবে, যা-ই বলুন গ্যাংটক ভীষণ নোংরা, তার চেয়ে কালিম্পং অনেক ভাল। কিংবা, আপনি কিন্তু এবারও শিলিগুড়ির হংকং মার্কেট দেখালেন না।

হোটেলেব লাউঞ্জে বসে না থেকে দীপনাথ দুপুরের রোদে বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষণেক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে নিচ্ছে। ছেলেবেলায় বহুবার দেখেছে সে। তার বড়ভাই শ্রীনাথ আর ছোট সোমনাথ যখন মা বাবার কাছে মানুষ হচ্ছে তখন বড়পিসি তাকে এনে রেখেছিল শিলিগুড়িতে। তখন সারাদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা জেগে থাকত ঠিক এইভাবে। তার যৌবন নেই, জরা নেই। কিংবা হয়তো আছে। কিন্তু পাহাড়ের যৌবন বা জরা এতটাই দীর্ঘস্থায়ী যে মানুষের আয়ুতে বেড় পায় না। কিন্তু আজও সে বাল্যকালের সেই যৌবনোদ্ধত পাহাড়টিকে দেখে খুব আনন্দিত হয়। সবকিছুর চেয়ে আজও তার বেশি প্রিয় পাহাড়। উঁচু, একা, মহৎ।

দীপনাথ নিজে পাহাড়ের ঠিক বিপরীত মানুষ। কোনও উচ্চতা নেই, মহত্ত্ব নেই। কলকাতার এক কৌটো তৈরির ছোট্ট কারখানায় সে প্রায় বছর আষ্টেক ম্যানেজারি করেছে। বাঙালির সেই প্রতিষ্ঠানটি প্রথম থেকেই ধুকছিল। মালিক তেমন গা করত না। শ্রমিকরা ছিল ভয়ংকর তেড়িয়া। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিল দীপনাথের চিরশত্রু এবং মালিকের স্পাই। দীপনাথের খবরদারির মধ্যেই কারখানায় নিয়মিত চুরি হত। এ সবই সহ্য করে মুখ বুজে পড়ে ছিল সে। এমনকী অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের উসকানিতে সে একবার যোবলা ঘণ্টা ঘেরাও হয়ে থাকে, আর একবার তিন-চারজন ওয়ার্কারের হাতে তাকে মারধর খেতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেকা গেল না। কারখানার বুড়ো মালিক ডেকে বললেন, তোমার হাতে দিয়ে এতদিন তো দেখলাম, এবার ছেড়ে দাও, নতুন কারও হাতে দিয়ে দেখি যদি চালাতে পারে। দীপ জানে কারখানায় নতুন করে টাকা না ঢাললে, আপাদমস্তক ঢেলে না সাজালে কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়।

বছরখানেক আগে চাকরি খুইয়ে সে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াল খানিক। তারপর জুটল বোসের সঙ্গে। মস্ত এক গুজরাটি ফার্মের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বোস অতি ধূর্ত ও অভিজ্ঞ। দীপনাথ যে কাজের লোক নয় সেটা বোধহয় সে এক নজরেই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট করে বলেনি আজও। তবে দীপনাথকে যে সে সঙ্গী এবং সাহায্যকারী হিসেবে খুবই পছন্দ করে তাতে সন্দেহ নেই। কোম্পানি থেকে দীপনাথ ভাউচারে মাসিক ছয় থেকে সাতশো টাকা পায়। তাকে খাতায় সই করতে হয় না, অফিসে বসতে হয় না, ডিউটি আওয়ার্স বা ছুটির দিন বলেও কিছু নেই। অর্থাৎ তাকে কোম্পানির চাকরিতে বহাল করা হয়নি। কেবল ফুরনের লোক হিসেবে পোষা হচ্ছে। বোসকে বিস্তর টুর করতে হয়, সঙ্গে থাকে দীপনাথ। এসব খরচ অবশ্য কোম্পানিই দেয়। বোস কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় দীপনাথের যে পদের উল্লেখ করে সেটাও গোলমেলে। বোস তাকে নিজের সেক্রেটারি বলে চালায়। ধৈর্যশীল এবং উপায়ান্তরহীন দীপনাথ তবু বোসের সঙ্গে লেগে আছে। সবদিন তো সমান যায় না। কৌটোর কারখানার ম্যানেজার হিসেবেও সে ছয়-সাতশো টাকার বেশি পেত না। কোনওদিন চুরি করেনি এক পয়সাও। করলে মাসিক আয় বেড়ে হাজার দুয়েকে দাঁড়াতে পারত। চুরি দীপনাথ এখনও করে না। আর সেটা জানে বলেই বোধহয় বোস তাকে এখনও খাতির করে। আপনি-আজ্ঞে করে কথা বলে।

কাল গ্যাংটক থেকে ফিরে দীপনাথ বোস এবং তার বউকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে নিজে ফিরে গিয়েছিল হাকিমপাড়ায়, পিসির বাসায়। বছরখানেক আগে পিসি মারা গেছে। অতিবৃদ্ধ পিসেমশাই আর পিসতুতো ভাইরা আছে। দীপনাথ গেলে বাড়ির সবাই আন্তরিক খুশি হয় এখনও। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। সব ব্যর্থতার গ্লানি ফুকারে উড়ে গিয়েছিল গানে, গল্পে, ঠাট্টায় আর পুরনো দিনের কথায়। ছেলেবেলার কয়েকজন বন্ধুও এসে জুটেছিল। এসেছিল প্রীতমের মেজো ভাই শতম। কয়েকটা ঘণ্টা বড় আনন্দে কেটেছে। আজ দুপুর থেকে আবার সে বোসের রহস্যময় সেক্রেটারি। অর্থাৎ ফাইফরমাশ খাটার লোক, ফুরনের ভবিষ্যৎহীন খাটনদার।

শতম তার জিপগাড়িতে সিনক্লেয়ার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল দীপনাথকে। চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ বলল, মেজদা, আমার দাদার জন্য কিন্তু বউদিই দায়ী। দাদা বোধহয় বাঁচবে না, এই শেষ সময়টায় যদি আমাদের কাছে তাকে আসতে দিত বউদি, তবে দাদা বোধহয় একটু আনন্দে মরতে পারত। তুমি বউদিকে একটু বুঝিয়ে বোলো।

পিসতুতো ভাইরা দীপনাথকে মেজদা বলে ডাকত। সেই থেকে সে প্রায় সকলেরই মেজদা। এই ডাকের ভিতরে পুরনো দিনের গন্ধ আছে, জড়িয়ে আছে আত্মীয়তা। মেজদা ডাকের মধ্যে আজও গভীর ভালবাসা খুঁজে পায় দীপনাথ।

মনটা খারাপ হয়ে আছে সেই থেকে। বিলুর সঙ্গে প্রীতমের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল পিসিমাই। কিন্তু প্রীতমের মতো সাদা সরল ভাল মানুষের সঙ্গে বিলুর মতো বারমুখো মেয়ের যে মিল হয় না সেটা প্রথম থেকেই বুঝেছিল দীপ। কিছু বলেনি তুব। গরমিল কতটা হয়েছিল তা হিসেব করার অবশ্য অবসর হল না। তার আগেই, জীবনের শুরুতেই আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে প্রীতম। এখনও একবার শিলিগুড়িতে আসার জন্য সে ছটফট করে। কিন্তু বিলু আসতে দেয় না। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রীতমের এখন আকুপাংচার চলছে। একটু উন্নতি হয়তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটুকুর ওপর ভরসা রাখতে ভয় পায় সবাই।

দীপ আর-একবার লাউঞ্জে ঢুকে খোঁজ নিল বোস সাহেবদের কতদূর। যদি এয়ারলাইনসের গাড়ি ছেড়ে যায় তবে তাকে বোসের সঙ্গে আমরাসাডারেই যেতে হবে। কিন্তু এখন কিছুটা সময় সে বোসের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়। সঙ্গে গেলেই হাজারও কথার জবাব দিতে হবে। একা থাকলে মুখ বুজে কিছুক্ষণ চিন্তা করার অবকাশ পাবে সে।

রিসেপশনিস্ট বোসের ঘরে ফোন করল। তারপর দীপনাথকে বলল, আপনি মালপত্র নিয়ে এয়ারলাইনসের গাড়িতেই চলে যান।

দীপনাথ একটা শ্বাস ছাড়ল। তা হলে বোধহয় দাম্পত্য ঝগড়া মিটেছে। সে কিছুক্ষণ একা হতে পারবে।

বস্তুত হোটেলের রিসেপশনিস্ট থেকে এয়ারলাইনসের কর্মচারী পর্যন্ত সবাই দীপনাথের চেনা। কারণ বোসের টিকিট কাটা, হোটেল বুক করা, গাড়ি ভাড়া করা থেকে যাবতীয় অনভিপ্রেত কাজ তাকেই করতে হয়।

দীপনাথ এয়ারলাইনসের অফিসের দিকে আসতে আসতেই দেখল এয়ারলাইনসের গাড়ি ছেড়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। দীপনাথ ‘দত্ত!’ বলে দু হাত তুলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়োতে লাগল। যেন তার সর্বস্ব চলে যাচ্ছে।

দত্ত বোধহয় গাড়ির আয়নায় দেখতে পেয়েছিল তাকে। চেনা লোক। জানালা দিয়ে মুখ বার করে পিছু ফিরে হাসল। তারপর গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করিয়ে আনল।

দত্তর চোখে গগলস, মুখখানা দারুণ সুন্দর। দুর্দান্ত স্মার্ট ছেলে। বলল, আমি তো আপনাকে এতক্ষণ খুঁজছিলাম। উঠে পড়ুন।

দীপনাথ লাউঞ্জে ঢুকে প্রকাণ্ড ভারী সুটকেসগুলো প্রায় ঘেঁচড়ে নিয়ে এল নিজেই। এটুকু পরিশ্রমেই হাঁফাচ্ছিল। দত্ত বিরক্ত গলায় পোর্টারদের হাঁক দিয়ে বলল, ক্যা দেখ রহে হো? সাবকা মাল উঠা দো।

দীপনাথের কাছে একস্ট্রা খরচের পয়সা নেই। অন্য দিন থাকে। আজ নেই। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হওয়ার পর থেকেই বোস গোমড়ামুখো হয়ে আছে, অনেক কিছু করণীয় কাজও করছে না। কাজেই পোর্টারদের মাল তোলার ব্যাপারে একটু ভয় খেল দীপ। টিপস দিতে হবে নিজের গাঁট থেকে।

গতকাল পিসির বাড়ি যাওয়ার সময় দশ টাকার মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিল। দীপের কাছে আজকাল দশ টাকা মানে অনেক টাকা। সে যে ফুরনের কাজ করে তা তো কেউ জানে না। পিসতুতো ভাইরা বা পিসেমশাই জানে, সে একটা বড় ফার্মের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সেক্রেটারি। গালভরা কথা।

পোর্টারদের অবশ্য ঠেকাতে পারল না দীপ। তারা হাতাহাতি করে মালগুলো বাসের পিছনে তুলে দিল ফটাফট। চোখ বুজে তিনটে টাকা দিয়ে দিতে হল। এয়ারলাইনসের কুলিভাড়া সাংঘাতিক। এক পিস মালে এক টাকা।

বাসে কুল্লে দশ-পনেরোজন যাত্রী। তার মধ্যেও তিন-চারজন এয়ারলাইনসের লোক। বাস ছাডবার আগে কেতাদুরস্ত দত্ত হাসিমুখে এগিয়ে এসে বাসের টিকিট দেয়। চারটে টাকা। দীপনাথ চোখ বুজে টাকাটা দিল। এসব খরচের হিসেব দিয়ে বিল করলে টাকাটা সে পেয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু এসব ছোটখাটো হিসেব বিল করতে তার লজ্জা করে।

জানালার ধারে বসে বাইরে চেয়ে থাকে দীপ। সামান্য একটা কুয়াশার ভাপ উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবছা হয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে এসে এফেঁড় ওফেঁড় করছিল তাকে! তবু জানালাটা বন্ধ করল না দীপ। এই জায়গার বাতাসটা তার প্রিয়। এই জায়গা প্রিয় প্রীতমেরও। প্রীতম কি শেষ হয়ে যাওয়ার আগে কোনওদিন ফিরে আসতে পারবে এখানে?

বহুকাল আগে হাকিমপাড়ার কাঁচা নর্দমার ধারে তার হাতে ঘুসি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রীতম। বয়সে কয়েক বছরের ছোট ছিল প্রীতম। রোগা এবং দুর্বল। কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল তাদের তা আজ মনে নেই। শুধু মনে আছে মাটিতে পড়ে প্রীতমের প্রাণান্তকর চেঁচানি। অসহায় আক্রোশে প্রীতম কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলছিল, তুই আমার বাঁ হাতটা খা, আমার বাঁ পাটা খা। প্রীতম খারাপ গালাগাল জানত না। কোনওদিন সে শালা’ কথাটাও বলেনি। তাদের পারিবারিক শিক্ষাই তার জিভকে শুদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু সেদিন প্রীতমের সেই গালাগাল শুনে হেসে বাঁচেনি দীপ। ও কি একটা গালাগাল হল? বাঁ হাত খা! বাঁ পা খা!

আজ বহুকাল পরে সেই কথা মনে পড়ায় চোখে জল আসছিল দীপের। না কি ঠান্ডা বাতাস লেগে চোখ জলে ভরে আসছে! একজন দয়ালু যাত্রী পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা টেনে বন্ধ করে দিল। দীপ আর কাচটা খুলল না। দত্ত প্রায় এরোপ্লেনের মতোই জোর গতিতে গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এত বাতাস সইবে না।

এয়ারপোর্টে নামতেই আবার ব্যস্ততা। দার্জিলিঙে বরফ পড়ছে এবার। প্রচণ্ড শীতে মুহ্যমান উত্তরবঙ্গ। এয়ারপোর্টে ভিড় তাই তেমন নয়। সে মালপত্র ওজন করাল, কেবিন টিকিট নিল। প্লেনে মাত্র একটি সারিতেই রয়েছে দুটো সিট। সাধারণত বোস সস্ত্রীক সেই দুটো সিটেই জায়গা নেয়। কিন্তু মালপত্র ওজন করানোর সময় দীপের হঠাৎ মনে পড়েছে গ্যাংটকে দেড় হাজার টাকায় কেনা কার্পেটটা মালপত্রের সঙ্গে নেই। এয়ারলাইনসের অফিসে ফোন করে জানল যে, সেটা লাউঞ্জেও পড়ে নেই। মহার্ঘ কার্পেটটার গতি কী হল তা বুঝতে পারছিল না দীপ। ঝগড়ার মূলেও সেটাই। কার্পেটটা ভাজ করে সুটকেস বা বেডিং-এও ঢুকবে না। ঢুকলেও তা টের পেত দীপ। কারণ এই বেডিং বা সুটকেস তাকে বহুবার গোছাতে হয়েছে। তাই সে আন্দাজ করল কার্পেটটা ওরা সঙ্গে নিচ্ছে না। রাগ করে হয়তো ফেলে রেখেই যাচ্ছে। তার মানে, ওদের ঝগড়া মেটেনি। তাই যদি হয় তবে দুই আসনের সারিতে ওরা কিছুতেই পাশাপাশি বসবে না। দীপকে হয় বোস বা শ্ৰীমতী বোসের সঙ্গে বসতে হবে।

বোসরা এখনও আসেনি। লাউডস্পিকারে জানান দিচ্ছে, প্লেন আসতে দেরি হবে। কলকাতা থেকেই ছাড়বে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরিতে। একটু বিরক্ত হয় দীপ। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট বেড়ে বেড়ে শেষ পর্যন্ত দু’ঘণ্টায় দাঁড়াতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তার আছে। তার খুব ইচ্ছে আজ, কলকাতায় ফিরেই প্রীতমকে দেখতে যায়। অবশ্য বোস যদি সময়মতো তাকে অব্যাহতি দেয়।

দীপ এক কাপ কফি খাবে বলে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। বেশ কয়েকজন সাহেব-মেম বসে বিয়ার খাচ্ছে। সামনের দিকে কয়েকজন সাহেব-মেমের খুব জটলা আর উঁচু গলার কথা শোনা যাচ্ছিল। তাদের মাঝখানে একজন প্রৌঢ় নেপালি দাঁড়িয়ে। তার গায়ে বিদেশি জার্কিন, পরনে কর্ডের প্যান্ট, চোখে গগলস। প্রথমটায় চিনতে পারেনি দীপ। একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কফি এলে গভীর তৃপ্তিতে চুমুক দিল সে। কিন্তু মনটা খচখচ করছে। আবার তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত স্মৃতি মথিত করে উঠে এল পরিচয়। তেনজিং নোরকে!

তেনজিং যখন এভারেস্টে উঠেছিল তখন দীপ বোধহয় স্কুলের বেশ নিচু ক্লাসে পড়ে। শিলিগুড়িতে সে বহুবার তেনজিংকে দেখেছে। দুটি কিশোরী মেয়েকে নিয়ে তেনজিংকে তখন চারদিকে সংবর্ধনা নিতে ছুটতে হচ্ছে। জন্মগত বিনয় ও অহংকারহীনতা তেনজিংকে ভারী জনপ্রিয় করেছিল। আজও তাকিয়ে সে তেনজিং-এর মুখে সেই সবল হাসি দেখতে পায়। এই লোকটা এক মস্ত পাহাড়ে উঠেছিল। দীপ কোনওদিন সেইসব দুরারোহ পাহাড়ে উঠবে না। তার গতি নীচের দিকে। নীচের দিকে।

সমস্ত কৈশোরকাল তার সমস্ত রং আর গন্ধ নিয়ে ঘিরে ধরে দীপকে। সে উঠে কোটের পকেট থেকে ছোট নোটবই আর ডটপেন বের করে এগিয়ে যায়। সাহেব-মেমরা রাস্তা দিল। সোজা গিয়ে তেনজিং-এর সামনে, খুব কাছাকাছি দাঁড়ায় দীপ। হাত বাড়াতেই তেনজিং শক্ত পাঞ্জায় চেপে ধরে তার হাত। এ লোকটা পাহাড়ে উঠেছিল। খুব উঁচু, একা মহৎ এক শুভ্র পাহাড়ে। বাঁ হাতের নোটবইটা বাড়িয়ে যখন দীপ বলল, অটোগ্রাফ প্লিজ’ তখনই বুঝতে পারল রুদ্ধ আবেগে তার গলা বসে গেছে।

তেনজিং খুব বিনয়ের সঙ্গে সই দিয়ে দেয়। কিছু বলার ছিল না দীপের। সে ফের এসে টেবিলে বসে। কফি ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সে এক চুমুকে সেটা খায়। নোটবইটা খুলে একবার সইটা দেখে। এইভাবে সই নেওয়ার অভ্যাস তার কোনওকালে নেই। তেনজিং বিখ্যাত মানুষ বলেও নয়। কেবল সেই শৈশবের দারুণ সুন্দর স্মৃতি আর পাহাড়ে ওঠার এক অসম্ভব স্বপ্নই তাকে এই কাজে প্ররোচিত করেছে। পাহাড়ের মতো সুন্দর আর কী আছে পৃথিবীতে? কে আছে তার মতো সুখী যে পাহাড়ে ওঠে?

একদিন দীপ তার সব কাজকর্ম ফেলে রেখে একা বেরিয়ে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে কোনও মস্ত দুরারোহ পাহাড়ের পাদদেশে। তারপর শুরু করবে তার ধীর ও কষ্টকর আরোহণ। কোনওদিনই শীর্ষে পৌঁছাবে না সে। অনাহারে, শীতে, পথশ্রমে একদিন ঢলে পড়বে পাহাড়েরই কোলে। বড় একা, নিঃসঙ্গ মৃত্যু ঘটবে তার। কিন্তু বড় সুখী হবে সে।

আচমকাই বোস কাচের দরজা ঠেলে হনহন করে তার টেবিলে চলে এল। একা। বসেই বলল, বিয়ার চলবে?

না।–দীপ স্বপ্নভঙ্গের পর কিছুটা নরম স্বরে বলে। তারপর ভদ্রতাবশে জিজ্ঞেস করে, মিসেস বোস কোথায়?

বোস তার বিয়ারের অর্ডার দিয়ে বলে, স্টলে বোধহয় কিছু কিনছে। শি ইজ অলওয়েজ বায়িং অ্যান্ড বায়িং হেল।

বোস ছ’ ফুটের ওপর লম্বা। কিন্তু চেহারাটা শক্তিমানের নয়। বরং খানিকটা ভুড়ি এবং যথেষ্ট চবিওলা দশাসই চেহারাটা দেখলে একটু মায়াই হয়। মনে হয় এত বড়সড় চেহারাটা টানছে কী করে লোকটা? বোসের বয়স দীপের মতোই ত্রিশ পেরোনো। অর্থাৎ যথেষ্ট যুবক। তবু আরাম আমোদ এবং উচ্ছঙ্খলতার দরুন তার চুলে পাক ধরেছে, চোখের দৃষ্টিতে একটা ঘোলাটে ভাব এসেছে। লোকটা প্রচণ্ড অহংকারী। হালকা পেপারব্যাক ছাড়া আর কিছু পড়ে না বলে ওর মানসিকতাও এক জায়গায় থেমে আছে।

চোঁ করে বিয়ারের গ্লাস শেষ করে বোস। তারপর বলে, প্লেন লেট শুনছি!

হ্যাঁ। পঁয়তাল্লিশ মিনিট বলছে। তবে বেশিও হতে পারে।

বোস অন্য দিকে চেয়ে থাকে ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি দমদমে নেমে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবেন। আমি অফিস হয়ে যাব।

দীপ স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। মিসেস বোসকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েও সে প্রীতমের কাছে যাওয়ার যথেষ্ট সময় পাবে।

রেস্টুরেন্ট থেকে লাউঞ্জে ঢুকবার আগে পকেট থেকে এম্বাকেশন কার্ডগুলো বের করে ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ দেখে দীপ। সমস্যা একটা থেকেই যাচ্ছে। দুটো সিট পাশাপাশি, একটা আলাদা। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে বোস এবং তার বউ কিছুতেই পাশাপাশি বসবে না। সেক্ষেত্রে তাকে হয় বোস বা তার বউয়ের সঙ্গে বসতে হবে। একা চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ আপনমনে থাকার কোনও আশাই নেই।

লাউঞ্জে খুব একটা ভিড় নেই। সব মিলিয়ে ষাট-সত্তরজন লোক হবে। বড়সড় বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি আজ ফাঁকাই যাবে। তবু একা আলাদা বসার কোনও সুযোেগই পাবে না দীপ। ভেবে তার মনটা ভার লাগছিল। কিছুই নয়, মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়, তবু ওই সময়টুকু নিজের জন্য চুরি করার যেন বড় প্রয়োজন ছিল। প্লেনটা যখন উঠবে তখন কয়েক পলক এক অসম্ভব অবিশ্বাস্য অ্যাঙ্গেল থেকে সে আর-একবার প্রাণমন ভরে দেখে নেবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। দেখবে বিপুল কালো শরীরে মহিষাসুর পাহাড়গুলিকে। তারপর চোখ বুজে পাহাড়ের কথা ভাববে বাকিটা সময়।

ওপাশের স্টলে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। পিছন থেকেও নির্ভুলভাবে মিসেস বোসকে চিনতে পারে দীপ। ইদানীং ভদ্রমহিলা কিছু উগ্র হয়েছেন। পরনে ঢোলা প্যান্ট এবং গায়ে খুব আঁটসাঁট একটা লাল পুলওভার। গলায় জড়ানো কালো নকশাদার একটা স্কার্ফ। বব চুলের ওপর একটা মস্ত বেতের টুপি। কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই একটা অসম্ভব সুন্দর সুগন্ধ পায় দীপ। গন্ধটা মোহাচ্ছন্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে।

মিসেস বোস চকোলেট থেকে পেপারব্যাক পর্যন্ত বিস্তর জিনিস ইতিমধ্যেই কিনে ফেলেছেন। হাতের মস্ত হাতব্যাগটা খুলে অত্যন্ত অসাবধানে এবং অগোছালো হাতে অন্তত গোটা কুড়ি-পঁচিশ একশো টাকার নোট এক খামচায় বের করে এনে দাম দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু টাকাগুলো গোছানো অবস্থায় ছিল না বলে দু-একটা নোট পড়ে গেল মেঝেয়। মিসেস বোস নিচু হয়ে কুড়োতে যাচ্ছিলেন, দীপ তা করতে দিল না। অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে নিজেই কুড়িয়ে দিল। নিচু অবস্থায় খুবই কাছাকাছি হল দু’জনের মুখ। মিসেস বোস বললেন, থ্যাংক ইউ।

দীপ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খুব দয়ালু হাতে মিসেস বোসের নোটগুলো সাজিয়ে ভাঁজ করে দেয় এবং বলে, প্লেন লেট। কফি খাওয়ার সময় আছে।

আমি এখন খাব না। ওই গরিলাটা আগে বেরোক, তারপর দেখা যাবে।

মিসেস বোস লম্বায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। অর্থাৎ দীপের চেয়ে মাত্র ইঞ্চি তিনেক খাটো, রংটা তেমন পরিষ্কার নয়, কিন্তু ভারী ঢলঢলে আহ্লাদী এবং সুশ্রী চেহারা। বয়স নিতান্তই কম বলে একটা সতেজ আভা শরীর থেকে বিকীর্ণ হয়। দীপ জানে মিসেস বোসের অনেকগুলো মারাত্মক দোষ আছে, কিন্তু গুণের মধ্যে এই সতেজ ভাবটুকু অবশ্যই ধরতে হবে। যতবারই সে এই মেয়েটির কাছাকাছি হয় ততবারই তার অনুভূতি হতে থাকে, হাতের নাগালে একটা সাংঘাতিক হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার দুলছে। ছুঁলেই ঘঁাত করে মেরে দেবে। দীপ তার নিজের স্বাসের পরিবর্তন টের পায়। খাস কিছু গাঢ় ও ঘন এখন। সে বলল, উনি এখনই বেরোবেন বলে মনে হয় না, বিয়ার নিয়ে বসেছেন। কিন্তু রেস্টুরেন্টে একজন খুব ইন্টারেস্টিং লোক রয়েছেন। তেনজিং নোরকে। দেখবেন তাকে?

দ্যাট এভারেস্ট হিরো? ওঃ, ওকে আমি দেখেছি।

বলে মিসেস বোস তাঁর মস্ত হাতব্যাগটা খুলে কেনা জিনিসগুলো ভরবার চেষ্টা করতে থাকেন। স্বভাবতই দীপকে হাত লাগাতে হয়। মিসেস বোসের হাতব্যাগে জিনিস ভরে দিতে দিতে সে আনমনে তেনজিং-এর কথা ভাবছিল। বহু বছর আগে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতে উঠেছিল লোকটা। আজ পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তেনজিং-এর পর এভারেস্টে আরও অনেকে উঠেছে। কে তেনজিং-এর কথা অত করে মনে রাখবে? এভারেস্টের সেই মহিমাও তো আর নেই।

মিসেস বোস লাউঞ্জের একটা চেয়ারে বসে বলেন, এর আগের বার যখন এসেছিলাম, মনে আছে? আমাদের সঙ্গে প্লেনে বম্বের তিন-চার জন ফিলমস্টার ছিল? শিলিগুড়ির কোন ফাংশনে আসছিল যেন!

দীপ পাশের চেয়ারটা ফাঁক রেখে পরের চেয়ারটায় বসেছে। বলল, শিলিগুড়িতে ওরা প্রায়ই আসে। এখানে বছরে দশ-বারোটা ফাংশন হয়। কলকাতার চেয়েও বম্বের ফিলমস্টাররা শিলিগুড়িতে বেশি আসে।

ও। তা হলে এবার তারা নেই কেন?

এবারও আছে। তিলক ময়দানে বিরাট ফাংশন হচ্ছে।

ইস, তা হলে আর-একদিন থেকে গেলে হত।

মিস্টার বোসকে বলুন না!

ঠোঁটটা খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উলটে মিসেস বোস বলে, ওকে বলতে বয়ে গেছে। অদ্ভুত আনসোশ্যাল লোক একটা। আপনিই দেখলাম ওর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন, আমার তো অ্যাডজাস্ট করতে ভীষণ অসুবিধে হয়।

দীপ খুব উদার গলায় বলে, কেন? মিস্টার বোস তো বেশ লোক।

মিসেস বোস চকোলেট বারের রাংতা খুলতে খুলতে বলেন, পুরুষদের কাছে পুরুষরা তো ভাল হবেই। খারাপ যত মেয়েরা।

ঠিক তা বলিনি।–দীপ একটু দ্বিধার ভাব দেখায়।

মিসেস বোস টুকুস করে এক টুকরো চকোলেট দাঁতে কেটে বলেন, পুরুষদের আসল চেহারা বোঝা যায় বেডরুমে। বাইরে সে যত বড় একজিকিউটিভই হোক না কেন, বেডরুমে তার মুখোশ খুলে যায়। বাইরের লোক তো সেটা দেখতে পায় না।

কথাটা হয়তো ঠিকই। দীপ তাই এই বিপজ্জনক প্রসঙ্গ আর ঘাটে না। চুপ করে থাকে। বোসের অল্পবয়সি সুন্দরী স্ত্রটি চকাস-টকাস শব্দ করে চকোলেট খান বটে, কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা যায় চকোলেটের স্বাদ উনি একটুও উপভোগ করছেন না। ভদ্রমহিলার আসল ভ্রু বলতে কিছু নেই। লোমগুলো খুবই নিপুণভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে। কপালের দিকে উঁচু করে কৃত্রিম ভ্রু আঁকা। ফলে চোখের ওপরে অনেকটা মাংসের ডেলা বেরিয়ে আছে। কাছ থেকে দেখলে দৃশ্যটা তেমন সুন্দর নয়। যা হোক, মিসেস বোস এখন তার আঁকা ভ্রু কুঁচকে খুব বিরক্তির সঙ্গে সামনের দিকে চেয়ে কিছু ভাবছেন। বোধহয় মিস্টার বোস সম্পর্কে খুবই খারাপ ধরনের কিছু কথা। দীপ একবার কার্পেটটার খোঁজ নেবে কি না ভাবল। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ঠিক সাহস পেল না।

লাউডস্পিকারে ফ্লাইট টু টুয়েন্টি টু-র যাত্রীদের সিকিউরিটি এনক্লোজারে যেতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। অর্থাৎ প্লেন আর খুব বেশি দেরি করবে না। ঘোষণাটি খুব নিরুত্তাপ মুখে শুনলেন মিসেস বোস, কিন্তু নড়লেন না। অবশ্য তাড়াহুড়ো নেই, হাতে এখনও অঢেল সময় আছে।

দীপ নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। ওপাশের রানওয়ে দিয়ে পর পর এয়ারফোর্সের চারটে ন্যাট গোঁ গোঁ করে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে উড়ে গেল। তারপর ফাঁকা রোদে মাখা মস্ত মাঠটা পড়ে রইল উদোম হয়ে। উত্তরে নীলবর্ণ বিশাল পাহাড়ের সারি। কাঞ্চনজঙ্ঘার রং ধূসর সাদাটে হয়ে আকাশের পিঙ্গলতায় প্রায় মিশে গেছে। তবু তার ভাঙাচোরা শীর্ষদেশের একপাশে একটা সমতল ধারে সোনালি রোদ ঝলকাচ্ছে আয়নার মতো। মুহূর্তে সব ভুলে গেল দীপ। তার ভিতর থেকে আর-একজন দীপ বেরিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড়ের দিকে দীর্ঘ চলা শুরু করল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে দীপ। পিঙ্গল আকাশে হঠাৎ রুপোলি প্লেনটা দেখা যায়। লাউডস্পিকারে শেষবারের মতো সিকিউরিটি চেক-এর জন্য যাত্রীদের ডাকা হচ্ছে। দীপ লাউঞ্জে এসে দেখে তার কিটব্যাগটা অনাদরে পড়ে আছে চেয়ারের পাশে। মিসেস বা মিস্টার বোসকে দেখা যায় না। সে একবার রেস্টুরেন্টে উঁকি দিল। নেই। সিকিউরিটির বেড়া ডিঙিয়ে ওরা সামনের লাউঞ্জে চলে গেছে নিশ্চয়ই। নিশ্চিত হয়ে সে সিকিউরিটির কাঠের খাঁচায় গিয়ে ঢোকে।

প্লেনে উঠে বোস আর তার বউ একটু ইতস্তত করছিল। তারপর যা হওয়ার তাই হল। বোস গিয়ে আলাদা সিটে বসল। দীপকে বসতে হল মিসেসের পাশে। স্বভাবতই মিসেস বোস জানালা দখল করেছেন।

যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। প্লেনের অর্ধেক সিটও ভরতি হয়নি। প্লেনের ভিতরে মৃদু সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। লাউডস্পিকারে একঘেয়ে ঘোষণার শেষে নিয়মমাফিক মিউজিক বাজতে থাকে এবং খাবারের ট্রে হাতে আসে হোস্টেস। ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় প্লেন নিয়মমাফিক নামবে দমদমে। এই একঘেয়েমির হাত থেকে কচি মুক্তি পায় মানুষ। এই যে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে আকাশের হৃদয়ে ঢুকে পড়া তা মানুষ টেরই পায় না এইসব আধুনিক বিমানে। মিউজিক, এয়ার হোসটেস, খাবার, চা বা কফি, নরম কুশন ইত্যাদি দিয়ে কেবলই অন্যমনস্ক করে রাখা হয় যাত্রীদের। এক-আধবার নিয়ম ভেঙে প্লেনে আগুন লাগে, ইঞ্জিন বিগড়োয়, আর তখন মৃত্যুভয়ে হিম হয়ে যায় মানুষ। কিংবা কখনও-সখনও বেপরোয়া কোনও হাইজ্যাকার বন্দুক বার করে প্লেনকে নিয়ে যায় কোনও অচেনা দুর-দুরান্তে। সেসব বিরল ঘটনা। নইলে দুনিয়াভর অধিকাংশ বিমানই নিয়ম মাফিক ওড়ে এবং নামে। নিয়ম ভেঙে আজ অন্তত একজন হাইজ্যাকার উঠে দাঁড়াক বন্দুক হাতে। বলুক, এ প্লেনকে সোজা নিয়ে চলো কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে।

এক কাপ কফি ছাড়া দীপ আর কিছুই খেল না। কফি ভাল করে শেষ হওয়ার আগেই পায়ের নীচে চলে এল কলকাতা। দিগন্তে আর কোনও পাহাড়ের চিহ্নও রইল না।

এয়ারপোর্টে বোসের বশংবদ ড্রাইভার সহ গাড়ি অপেক্ষা করছিল। কিন্তু গাড়িতেও ওরা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ঝগড়াকে জানান দিতে আলাদা বসে। সামনে বোস, পিছনে তার বউ আর দীপ। দীপের মাথা থেকে পাহাড় খসে গেছে, এমনকী বোসের বউয়ের গা থেকে আসা সুবাসটিও সে টের পাচ্ছে না। ট্রলি থেকে লাগেজ বুটে মাল তোলার সময় সে লক্ষ করেছে মস্ত ফাইবার গ্লাসের বিদেশি সুটকেসটার একটা কবজা ভাঙা। আজকাল প্লেনে মাল নেওয়াটাই আহাম্মকি। এয়ারপোর্টের পোর্টাররা দুমদাম করে সেগুলো আছড়ে ফেলে বা তোলে। কোনও মায়াদয়া দায়িত্ববোধ নেই। কবজা ভাঙার জন্য সে দায়ী নয় বটে কিন্তু সুটকেসটা সারানোর দায়িত্ব তার ওপর পড়তে পারে ভেবে একটু তটস্থ বোধ করছিল দীপ। এসব ছোটখাটো জিনিস লক্ষ করাই আসলে তার কাজ। দীপ আজকাল ধরেই নিয়েছে, সে হল বোসের মোসাহেব, হেড চাকর, বাজার সরকার। এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সংযোগ-রক্ষাকারী দালাল। তবু নিজের ওপর তেমন কোনও গভীর ঘেন্না হয় দীপের। কারণ সে জানে, একদিন এইসব তুচ্ছতা থেকে সে মুক্তি পাবে। যেদিন পাহাড় ডাকবে।

বোস গণেশ অ্যাভেনিউ অফিসের সামনে নেমে গেল।

দীপ একবার ভাবল, সামনের সিটে গিয়ে বসবে। কিন্তু সেটা কেমন দেখাবে তা বুঝতে না পেরে তার নড়তে চড়তে সাহস হচ্ছিল না। বোস নেমে যেতেই মিসেস বোস চাপা স্বরে বলেন, হামবাগ। কাজ না আরও কিছু! জাস্ট অ্যাভয়েড করার জন্য অফিসের নাম করে কেটে পড়ল।

দীপ কথা বলে না। বলার নেই। মাঝে মাঝে তাকে কেবল শুনে যেতে হয়। কলকাতায় পা দিয়েই বোসের বউ একটা মস্ত রোদ-চশমা চোখে দিয়েছেন। বাইরের দিকে চেয়ে থেকেই দীপকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনার কি অন্য কোনও কাজ জোটে না, দীপনাথবাবু? ওই গরিলাটার সঙ্গে লেগে থেকে নিজের ফিউচারটা নষ্ট করছেন কেন? হি উইল ড়ু নাথিং ফর ইউ।

দীপ চালাক হয়েছে। সে জানে এসব দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে মিস্টার বোস সম্পর্কে একটিও নিন্দের কথা তার বলা ঠিক হবে না। একদিন বোস আর তার বউ আমে-দুধে মিশে যাবে, আর সেদিন এই নিন্দের কথা বাঁশ হয়ে ফিরে আসবে। তাই সে খুব উদাসভাবে বলে, বোস সাহেবের ওপর আপনি খুব চটেছেন। রেগে গিয়ে কাউকে ঠিক বিচার করা চলে না।

একটু অধৈর্যের গলায় মিসেস বলেন, প্লিজ! আমার লাইফটা নষ্ট হয়েছে, আপনারটাও নষ্ট করবেন না।

দীপ কঁচুমাচু হয়ে বলে, আসলে দেশে চাকরির খুব একটা স্কোপও তো নেই দেখছেন।

ওসব বাজে কথা। ভাববেন না যে, আমি একজন হামবাগ মানিসেন্ট্রিক একজিকিউটিভের স্ত্রী বলে কোনও খবর রাখি না! ইন ফ্যাক্ট আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। সোসাইটিতে কী হচ্ছে।

হচ্ছে সব খবর রাখি। মাত্র কয়েক বছর আগেও আমি লেফটিস্ট ছিলাম, অ্যাকটিভ পলিটিকস করতাম।

দীপ একটু অবাক হয়ে নতুন করে মিসেস বোসের দিকে তাকায় এবং কথাটা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মিসেস বোসের রোদচশমাটার জন্য তেমন কিছু বুঝতে পারছিল না দীপ। খুব কৌতুকের সঙ্গে সে প্রশ্ন করে, এসব কথা কি মিস্টার বোস জানেন?

ঠোঁট উলটে মেয়েটা বলে, আমি ওকে কিছু বলিনি। জানলে জানে। আমি পরোয়া করি না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনি এভাবে ওর সঙ্গে লেগে আছেন কেন? আফটার অল আপনার তো কাজের কিছু এক্সপেরিয়েন্স আছে বলে শুনেছি।

দীপ মৃদু স্বরে বলে, আমি একটা কৌটো তৈরির কারখানায় কাজ করতাম। টেকনিক্যাল কাজ নয়, অ্যাডমিনস্ট্রেশনের। খুবই ছোেট লুজিং কনসার্ন। সেই অভিজ্ঞতার তেমন কোনও দাম নেই।

মিসেস বোস খুব দৃঢ় স্বরে বলেন, টেকনিক্যাল নো হাউ ই আসল জিনিস। যদি আপনি সেটা শিখে নিতেন তা হলে আজ এই গরিলাটাকে তোয়াজ করে চলতে হত না। আজকাল একটা সামান্য ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা থার্ডগ্রেড ছুতোরও বসে থাকে না। যে সামান্য তালাচাবি সারাতে পারে, ঝালা দেওয়ার কাজ জানে, ছুরি কঁচি শান দেয় বা লেদ চালায় তাবও কাজের অন্ত্র নেই। একটুখানি টেকনিক্যাল কাজের জ্ঞান আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকলেই হল। আপাব কি কোনওটাই নেই?

দীপ একটু হাসে। মাথা নেড়ে বলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা তো জৈব জিনিস। সেটা ছাড়তে পারিনি বলেই এখনও মিস্টার বোসর সঙ্গে লেগে আছি।

কিন্তু তাতে বাঁচবেন না। ও নিজেই আমাকে অনেকবার বলেছে, দীপনাথ ইজ গুড ফর নাথিং। ওর উন্নতি করার ইচ্ছেটাই নেই। তার মানে ও আপনাকে অলরেডি ক্যানসেল করে বেখেছে। আর আপনি যতটা মনে করেন ওর ততটা ক্ষমতাও নেই। গুজরাটিরা অত্যন্ত কাশিং বিজনেসম্যান। তাই ওর হাতে রিক্রুটিং পাওয়ার তেমন কিছু দিয়ে রাখেনি। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার কথাটা খুব গালভরা, কিন্তু পাওয়ার বলতে কিছু নেই, চিসিশন বা পলিসি মেকিং নেই, অ্যাডভাইস দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আপনি অনর্থক এখানে চাকরির আশা করছেন।

দীপ বোসের বউকে আর-একটু ভাল করে দেখল। কম বয়স, বামপন্থী চিন্তাধারার অবশিষ্ট কিছু রেশ, কিছু আবেগ, স্বামীর ওপর রাগ এবং তার ওপর করুণা এইসব মিলিয়ে এ মেয়েটা এখন যা বলছে তা নিজেও বিশ্বাস করে না। দীপ এই সমাজকে খুব ভাল না চিনলেও খানিকটা বুকে নিয়েছে। সে জানে মিস্টার বোস চাকরি দেওয়ার মালিক না হলেও তার কথার দাম আছে। গুজরাটি ভাল ব্যবসায়ী বলেই বোসকে কখনও!টাবে না। বোস ইটান জোন-এ কোম্পানির কোমরের জোর অনেকখানি এনে দিয়েছে। বোসর বউ সেটা স্বীকার করুক বা না করুক। সে তাই মৃদু স্বরে বলে, বোস সাহেবের ক্ষমতা নেই এমন কথা আপনাকে কে বলল? কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তা ছাড়া নতুন করে টেকনিক্যাল না হাউ শেখার বয়সও আমার নেই!

আপনার বয়স কত?

ত্রিশের কিছু ওপরে। সঠিক হিসেব নেই, উইদিন থার্টিথ্রি।

ওটা কোনও বয়স নয়। আপনি তো খুব ফিট দেখতে।

তবু বয়সটা ফ্যাক্টর। শেখার পক্ষে ফ্যাক্টর।

বাড়িতে কে কে আছে?

অলমোস্ট কেউ না।

স্ত্রী?

বিয়ে করিনি।

তাই বলুন! একটা বয়স পর্যন্ত বিয়ে না করে থাকলে পুরুষরা একটু খ্যাপাটে হয়ে যায়।

আমি কি খ্যাপাটে?

নয়তো কী? প্লেন থেকে নামাবার সময় আমি লক্ষ করেছি আপনি মিস্টার বোসের অ্যাটাচি কেসটা হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিলেন। আপনার আত্মমর্যাদাবোধ নেই কেন? ওর অ্যাটাচি আপনি কেন বইবেন?

দীপ খুব হাসে। হাসতে হাসতে বলে, আপনি মিস্টার বোসের ওপর খুব চটেছেন আজ?

মিসেস বোস একটু চুপ করে থাকেন। কমনীয় মুখশ্রী এখন আর ততটা কমনীয় দেখাচ্ছে না। চোয়ালে যথেষ্ট দৃঢ়তা। খুব আস্তে করে বলেন, আই অ্যাম স্টিল ডেডিকেটেড টু মাই আইডিয়ালস। আমি কোনও বড়লোককেই সহ্য করতে পারি না। বিশেষ করে ওর মতো হামবাগ স্লেভ একজিকিউটিভদের। আমি ওকে জাংকারপট করে ছাড়ব। তার কিছু না পারি ওর সমস্ত সেভিংসকে উড়িয়ে দেওয়ার পথ আমার ভোলা আছে। আমি ওকে ভিখিরি করে ছেড়ে দেব।

দীপ টের পায় মিসেস বোসের কোমল অঙ্গ থেকে একটা অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ আসছে। ভারী অস্বস্তি বোধ করে সে। এবং খুবই ঠান্ডাভাবে বসে থাকে।

 ০৪. এই শীতে অন্ধকার বারান্দায়

এই শীতে অন্ধকার বারান্দায় মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিলু। গলি থেকে চোখ তুলে দৃশ্যটা দেখে দীপ। নিঃঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিলু, যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না, কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ঘর থেকে আবছা আলোর আভাস এসে পড়েছে ওর গায়ে। আবছা দেখাচ্ছে মূর্তিটা। দোতলার ওই বারান্দায় উত্তরের বাতাস হুঁ হু করে বয়ে আসে। বিলুর শীতবোধও কমে গেছে বুঝি।

বিলু গলির আবছা আলোতেও দীপকে দেখতে পেয়েছিল ঠিকই। দীপ দোতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতেই দরজা খুলে পরদা সরিয়ে দেয় বিলু।

আজকাল বিলুর কথা কমে এসেছে খুব। দরজা খুলে একবার ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চলে যাচ্ছিল ভিতরের দিকে। দীপ বাইরের ঘরের সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে খুব সাবধানে মৃদু স্বরে বলল, এখন খুব হিম পড়ে। বাচ্চাটাকে নিয়ে বারান্দায় যাস কেন?

বিলুর সঙ্গে সবাই আজকাল সতর্কভাবে কথা বলে। কখন বোমা ফাটবে তার কিছু ঠিক নেই। সামান্য কথাতেই কখনও খুব রেগে যায়, কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

বিলুর চুল রুক্ষ, ম্যাড়ম্যাড়ে হলুদ রঙের শাড়িটা রং-চটা ময়লা। গায়ের চামড়ায় খড়ি উড়ছে, ঠোঁট দুটো ভীষণ শুকিয়ে মামড়ি দেখা যাচ্ছে। দীপের কথার জবাব না দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেল।

দীপ একটা ঠোঙায় মহার্ঘ কাঠ-বাদাম, কিছু মুসুম্বি আর আপেল এনেছে। কাঠবাদাম খুব ভালবাসে প্রীতম।

জুতো খুলে মেঝেয় দাঁড়াতেই মোজার ভিতর দিয়ে ডিসেম্বরের ঠান্ডা উঠে এল শরীরে। এই কয়েকটা দিনই যা একটু শীত কলকাতায়। শীতের শিহরনটুকু শরীরে স্রোতের মতো বয়ে যেতেই মনের মধ্যে একটি দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। মনে পড়ল, হাকিমপাড়ার মস্ত কাঁচা ড্রেনের পাশে দীপের হাতে অকারণে মার খেয়ে মাটিতে গড়াচ্ছে আর প্রাণপণে চেঁচিয়ে কাঁদছে। দীপের সমান গায়েব জোর ছিল না প্রীতমের, বয়সেও অনেকটা ছোট। রাগে দুঃখে অপমানে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ ভরা জল আর শরীর-ফেটে-পড়া রাগ নিয়ে প্রীতম চিৎকার করে দীপকে বলেছিল, আমার বাঁ হাতটা খা। আমার বাঁ পাটা খা। তখন খুব হেসেছিল দীপ। আজকাল যতবার মনে পড়ে ততবার হাসির বদলে চোখে জল আসতে চায়।

দীপ ভিতরের ঘরের পরদা সরাতেই দেখল, প্রীতম প্রাণপণ চেষ্টায় একা একাই উঠে লেপটা সরিয়ে পাজামা পরা পা দুটো খাট থেকে নামানোর চেষ্টা করছে। কাঠির মতো শুকিয়ে এসেছে পা, হাত দুটোও কমজোরি হয়ে আসছে ক্রমে। শরীরটা এখন ভারী বে-টপ দেখায়। আচমকা দেখলে লোকে ভাববে, মানুষটা বেঁচে আছে কী করে?

শুধু মুখটাতে এখনও অসুস্থতা স্পর্শ করেনি প্রীতমকে। চোখের দৃষ্টি এখনও সজীব। পা ঝুলিয়ে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতো বসবার চেষ্টা করতে করতে প্রীতম তার ব্যথা-ভরা সুন্দর মুখ-টেপা হাসিটা হাসে।

টিনের চেয়ার বিছানার ধারটিতে টেনে নিয়ে বসে দীপ জিজ্ঞেস করে, আকুপাংচারের তারিখ কবে ছিল?

আজই। এই তো ঘণ্টা দুয়েক আগেই ফিরেছি আমরা।

ডাক্তার কী বলল?

ভাল। অনেক ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। আজ ছ’টা কি সাতটা ছুঁচ দিয়েছিল। তাই না বিলু? বলে বিলুর দিকে একবার ফিরে তাকানোর চেষ্টা করল প্রীতম। বিলু পিছন দিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত তার রুক্ষ চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল। কিন্তু জটধরা চুলে চিরুনি চলতে চাইছে না। বিলুর রাগের হাত জটসুদ্ধ চুল ছিড়ে আনছে মাথা থেকে। প্রীতমের কথার জবাব দিল না বিলু।

প্রীতমের বালিশের পাশে ফলের ঠোঙাটা রেখে দিয়েছিল দীপ। প্রীতম তার সরু একখানা হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা ছুঁল, তৃপ্তির চোখে চেয়ে দেখল একটু। তারপর লাজুক গলায় বলে, এসব এনেছ কেন? আমি কি এখন আর আগের মতো খেতে পারি, বলো? আজ অরুণবাবুও ডাক্তারের কাছ থেকে আসার সময় একগাদা ফল কিনে আনলেন। কত বারণ করলাম।

বিলু ঘর থেকে চলে গেল রান্নাঘর আর ডাইনিং স্পেসের দিকে। খুব সতর্ক নিচু গলায় দীপ জিজ্ঞেস করল, আজ কি তুই অরুণের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি? বিলু সঙ্গে যায়নি?

প্রীতম মাথা নাড়ে। যায়নি। মুখে সেই অসম্ভব ভালমানুষের হাসি। দুটো হাতের পাতা কোলের ওপর জড়ো করা। হাড়ের ওপর চামড়া বসে যাচ্ছে খাঁজে খাঁজে। আঙুলের গিঁট জেগে উঠেছে, কংকালসার হয়ে যাচ্ছে হাতের পাতা। সেদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে প্রীতম। নিজের কররেখা দেখে। তারপর মুখ তুলে বলে, অরুণ বড় ভাল ছেলে। ও এলে বাড়িটা জমজম করে। বিলুরও মনটা ভাল থাকে।

এ কথায় দীপ খুব কুট চোখে প্রীতমের মুখখানা দেখে! না, প্রীতমের মুখে কোনও ছায়া নেই। দরজার ওপরে সাঁইবাবার একটা ছবি টাঙানো, সেই দিকে চেয়ে আছে।

অরুণ হয়তো ভালই। তবে একটু আবেগহীন, বাস্তববাদী। প্রীতমের এই অসুখটা আজ পর্যন্ত কোনও ডাক্তার ধরতে পারেনি ঠিকমতো। প্রথমদিকে একজন বড় ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করে রোগটাকে আরও গাঢ়িয়ে তোলে। পরে অন্যান্য ডাক্তার বিস্তর কসরত করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছে, এক ধরনের ইন্টারন্যাল ইনফেকশন। এ রোগের পরিণতি কী হতে পারে তা তারা কেউ স্পষ্ট করে বলেনি। তবে বুঝে নেওয়া যায় সবার আগে সেটা বুঝেছিল অরুণ। সে উপযাচকের মতোই প্রীতমকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কোম্পানি থেকে ভলান্টারি রিটায়ার করাল। তাতে এক কাঁড়ি টাকা পেয়ে গেল প্রীতম। এল আই সি-র একজন চেনা এজেন্টকে ধরে করে অরুণ প্রীতমের একটা সত্তর হাজার টাকার পলিসি করিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকে প্রীতমের অ্যাকাউন্টকে বিলুর সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করিয়েছে। আত্মীয়-স্বজন যখন রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তখন ঠান্ডা মাথায় এই জরুরি কাজগুলি সেরে রেখেছে অরুণ। সে তোক ভাল হতে পারে, তবে তার মনে কোনও ভাবাবেগ নেই। পরোক্ষে সে কি প্রীতমকে তার পরিণতিটা জানিয়ে দিতে সাহায্য করেনি?

দীপ অন্য একটা কথাও মাঝে মাঝে ভাবে, অরুণ কি এসব প্রীতমের জন্যই করেছে? না কি বিলুর জন্য? এখনও বিলু অরুণকে ডাকনামে বুধু বলে ডাকে। বিলুর পোশাকি নাম অনন্যা। অরুণ ওকে ডাকে অন্যা বলে। এই বুধু ও অন্যার রহস্য লুির দাদা হয়ে ভেদ করতে চায় না দীপ।

দীপ ভাবে, প্রীতমের মনে যখন পাপ নেই তখন তার মনেই বা থাকবে কেন?

পাশের ডাইনিং স্পেসে অনেকক্ষণ ধরে সরু গলায় লাবু ঝিয়ের কাছে কী একটা বায়না করছিল। মেয়েটা এমনিতে মিষ্টি, ভিতু, ঠান্ডা, কিন্তু কখনও-সখনও খুব ঘ্যানায়। আর যখনই ঘ্যানায় তখনই ধৈর্যহীন বিলু নির্মম হাতে মেরে মেয়েটাকে পাট পাট করে দেয়। বিলুর ভয়ে মেয়েটা সবসময়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে থাকে। লাবুর সবচেয়ে বড় আশ্ৰয়টা সরে গেছে। শরীরের কারণেই বাবার কাছে আসা তার বারণ।

প্রীতম খুব উৎকর্ণ হয়ে মেয়ের গলার স্বর শোনে আর কীসের জন্য যেন অপেক্ষা করে। আচমকাই পরবার ওপাশে বিলুর চাপা গর্জন শোনা যায়, চুপ করলি অলক্ষ্মী মেয়ে? গর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই চটাস পটাস চড়-চাপড়ের শব্দ হতে থাকে। বিলুর শ্রান্ত গলা শোনা যায়, আমাকে শেষ না। করে ছাড়বি না তোরা! প্রীতম কেমন কুঁজো হয়ে চোখ বুজে সিঁটিয়ে থাকে। যেন মারটা তার পিঠেই পড়ছে।

আরও মারের ভয়ে লাবু কাঁদতে পারে না। কাঁদা বারণ, বারণ না মানলে বিলু আরও মারবে। তাহ প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টায় ক্রমান্বয়ে হেঁচকি উঠছে লাবুর। পরদার ওপাশ থেকে সেই হেঁচকির শব্দ এসে এ ঘরে হাতুড়ির ঘা মারে। প্রীতম বিবর্ণ মুখে চেয়ে থাকে দীপের দিকে। খুব চেষ্টা করে একটু হাসে। মাথা নেড়ে বলে, বিলুর দোষ নেই। ও পেরে উঠছে না। সারাদিন ঘরে আটকে থাকে, ওর মেজাজ খারাপ তো হতেই পারে।

অজুহাতের দরকার ছিল না। দীপ সবই জানে। এও জানে লাবু হচ্ছে প্রীতমের প্রাণের প্রাণ। সেই লাবু পাশের ঘরে মার খেয়ে কাদছে এটা শরীর বা মন দিয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না প্রীতম। কিন্তু এই একটা জায়গা ছাড়া প্রীতমেব আশ্চর্য সহনশীলতার কোনও তুলনা নেই। নিজের বোন হলেও বিলুকে কোনওদিন তেমন পছন্দ করে না দীপ। ওর ধৈর্য বলতে কিছু নেই, অল্প কারণেই ভয়ংকর রেগে যায়, তাছাড়া অলস, অগোছালো এবং বেশ কিছুটা স্বার্থপর। অরুণের সঙ্গে ও বহুকাল ধরে একটা ব্যাখ্যাহীন রহস্যময় সম্পর্ক রেখে চলেছে। এসব মিলিয়ে প্রীতমের বিবাহিত জীবনটা খুব সুখের নয় নিশ্চয়ই। তবু প্রীতমকে কদাচিৎ দুঃখিত বা বিষণ্ণ দেখেছে দাপ।

বিলু ঘরে নেই, তাই ফাঁক বুঝে দীপ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, শিলিগুড়িতে যাবি প্রীতম?

প্রীতম উদাস চোখে তাকিয়ে বলে, গিয়ে কী হবে?

তোর ইচ্ছে করে না যেতে?

আগে করত। এখন হচ্ছে-টিচ্ছে কিছু নেই।

বিলু বলে, কলকাতা ছাড়া চিকিৎসা ভাল হবে না।

আমি আসার আগে শতমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

ও।

বলে চুপ করে থাকে প্রীতম। দীপের কথায় ওর মন নেই। পরদার ওপাশ থেকে এখনও লাবুর হেঁচকি তোলার শব্দ আসছে। কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনছে প্রীতম। যেন কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে প্রীতম আস্তে করে বলা, আমি যে ভাল হয়ে উঠব এটা ওরা বিশ্বাস করে না।

কারা?-দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

আমার বাড়ির সবাই। ওদের ধারণা আমি শিগগিরই মরে যাব। তাই আমাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বিলুকে এরকম ধরনের চিঠিও লিখেছিল বাবা। আবার তুমিও শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা বলছ!

দীপ একটু মুশকিলে সড়ে গিয়ে বলে, দুব বোকা! তোর অসুখ সাববে না বলে শিলিগুড়ি য, ওয়ার কথা বলেছি নাকি? আসলে ওখানকার জলহাওয়া তো ভাল, আত্মীয়স্বজনদের কাছে মনটা ভাল থাকে।

খুব যে অভিমনিভরে মাছ না শ্রী তম বলে, ওসব কথার কথা। আসলে তোমরা বিশ্বাসই করে না যে, আমি আর বেশিদিন বাঁচব।

প্রীতমকে এ ধরনের কথা কোনওদিন বলতে শোনেনি দীপ। তাই অবাক হয়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে। বিলু নিঃশব্দে ঘরে এসে দীপের হাতে এক কাপ চা দিয়ে চলে যায়।

ধীরে ধীরে প্রীতম শুয়ে চোখ বুজল।

দীপ চায়ে চুমুক দিয়েই হরিণঘাটার স্ট্যান্ডার্ড দুধের বোটকা গন্ধ পায় এবং মুখ বিকৃত করে। সে প্রাণপণে প্রীতমের অসহায়তা, তার রোগভোগের যন্ত্রণা, মৃত্যুচিন্তা এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছের অহর্নিশ লড়াই, লাবুর প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা ইত্যাদি বুঝবার চেষ্টা করতে থাকে। ভাবতে গেলে প্রীতমের সমস্যার শেষ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, মরবার আগে প্রীতম কিছুতেই নিশ্চিন্তে জেনে যেতে পারবে না যে, বিলু শেষ পর্যন্ত বিধবা থাকবে, না কি অরুণকে বিয়ে করে বসবে। যদি তাই হয় তবে লাবুর দশা কী হবে! ভেবেচিন্তে প্রীতমের জন্য এক বুক দুঃখ উথলে উঠছিল দীপের। তাই সে চায়ে দুধের বোঁটকা গন্ধটা আর তেমন টের পেল না।

পরদা সরিয়ে মেয়ে কোলে বেরিয়ে এসে বিলু বলল, তুমি একটু বোসো মেজদা। আমি পাশের ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসছি।

বিলু চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ বাদে প্রীতম চোখ খুলে বলে, মেজদা, আমি খুব বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।

দীপ আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, তুই বাঁচবি নাই বা কেন?

খুব কষ্টে প্রীতম উঠে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে। বলে, এগুলো খুব বাজে ব্যাপার। এই অসুখ-টসুখ মোটেই ভাল জিনিস নয়। মন দুর্বল হয়ে যায়, মাথার ঠিক থাকে না। এই সময়ে তোমরা আমার কাছে এসে এমন কোনও কথা বোলো না যাতে মরবার কথা মনে হয়। আমি দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকার চিন্তা করি। কাজটা সোজা নয়, তবু করি।

দীপ একটা ঢোক গিলে বলে, আমি তোর অনেক ইমপ্রুভমেন্ট দেখছি প্রীতম।

প্রীতম বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, ইচ্ছাশক্তিকে খুব কম জিনিস বলে মনে কোরো না। উইল পাওয়ার অনেক অঘটন ঘটাতে পারে।

নিশ্চয়ই।—দীপ তেমনি আস্থাহীন গলায় বলে।

আমি কখনও কাউকে বলিনি যে, আমি মরে গেলে লাবু আর বিলুকে দেখো। কেন বলব? ওসব তো হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা! আমার তো মনে হয় না কখনও যে, আমি মরে যাব!

সে কথা কেউই ভাবছে না। তুই অকারণে সবাইকে সন্দেহ করিস।

তবে বাড়ির লোক আমাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যেতে চায় কেন? ওরা কি জানে না, সেখানে কলকাতার মতো চিকিৎসা হবে না?

এ কথাটা প্রীতম খুব আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলল। কোনও রাগ বা অভিমান নিয়ে নয়। নিষ্পলক কয়েক সেকেন্ড দীপের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ কয়েক পরদা নিচু স্বরে বলে, শোনো মেজদা, আমি শিলিগুড়ি গেলেও বিলু কিছুতেই যাবে না। শ্বশুরবাড়ির কাউকেই ও দু’চোখে দেখতে পারে না। জানো তো?

জানি।

কিন্তু আমি বিলুকে কলকাতায় একা রেখে যেতে ভয় পাই।

দীপু জুয়াড়ির মতো মুখের ভাব ঢেকে রাখার চেষ্টা করে বলে, কেন?

কেন তা আর বলল না প্রীতম। সামান্য একটু বিচিত্র সুন্দর হাসি হাসল মাত্র। দীপ জানে, মরে গেলেও কথাটা আর প্রীতমের মুখ দিয়ে বেরোবে না। ও কেবল সুন্দর করে হাসবে।

দীপ তাই চাপাচাপি না করে বলল, ইচ্ছে না হলে যাবি না। কেউ তো জোর করছে না!

তা ঠিক। তবে জোর করছে আমার ভিতরের একটা ইচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি ডানপাশের ওই জানালাটা দিয়ে শিলিগুড়ির পাহাড় দেখতে পাই। প্রায় ডাকঘরের অমলের অবস্থা। কিন্তু জানি শিলিগুড়িতে গেলে আমি আর বাঁচব না। চিকিৎসার অভাবে নয়, শিলিগুড়িতে গেলেই আমার মন নরম হয়ে গলে যাবে, ইচ্ছার শক্তি যাবে কমে।

দূর পাগল!

প্রীতম হাসছেই। এতটুকু সিরিয়াস ভাব নেই মুখে, বিষণ্ণতাও নেই। যেন ঠাট্টা-ইয়ারকি করছে এমনিভাবে বলে, ওখানে গেলেই সেই ছেলেবেলায় সব কথা এসে ঘিরে ধরবে। সে ভারী সুখের ব্যাপার, কিন্তু ওগুলো মনকে দুর্বল করে দেয়। তার ওপর সকলে বুক বুক করে যত্ন-আত্তি শুরু করবে, সিমপ্যাথি দেখাবে। ব্যস অমনি আমার লড়াইয়ের মনটাই যাবে নষ্ট হয়ে। এখানে তো তা নয়। এখানে প্রতি মুহূর্তেই রুক্ষ বাস্তবতার সঙ্গে লড়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এটাই আমার পক্ষে ভাল কেন জানো? আমাকে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখছে, সাবধান রাখছে, হাল ছাড়তে দিচ্ছে না, জেদ ধরিয়ে দিচ্ছে। যদি আমাকে বাঁচাতে চাও, মেজদা, কখনও শিলিগুড়ির কথা বোলো না।

দীপের স্বভাব হল যখনই কেউ কোনও কথা আন্তরিকভাবে বলে তখনই সে তা গভীরভাবে বিশ্বাস করে ফেলে। শিলিগুড়িতে গেলে প্রীতম কেন মরে যাবে তার যুক্তিসিদ্ধ কারণ থাক বা না-থাক দীপ তা বিশ্বাস করল এবং শিউরে উঠে বলল, না না, ওসব আর বলব না প্রীতম। তোর যাওয়ার দরকার নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে দু’জন। প্রীতম তার দুর্বল হাত চোখের সামনে ধরে চেয়ে থাকে, যেন আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, তুমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ না মেজদা?

দীপ একটু অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ। অনেকদিন।

বেশিদিন নয়। মাত্র দু’-তিন মাস বোধহয়।

তাই হবে। দীপ বলে, কেন বল তো!

আগে তুমি অনেক সিগারেট খেতে। দিনে অন্তত চল্লিশটা।

হুঁ।–দীপ বুঝতে পারে না প্রীতম কী বলতে চায়।

অত সাংঘাতিক নেশা ছাড়লে কী করে?

দীপ উদাস হয়ে বলে, ছেড়ে দিলাম।

কষ্ট হয়নি?

খুব। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। পাগলের মতো লাগত।

প্রীতম তার সুন্দর হাসিটা মুখে মেখে বলে, তোমার ভীষণ রোখ আছে মেজদা। সাংঘাতিক রোখ।

দীপ ম্লান একটু হাসে। ছিল, কোনওদিন তার মধ্যে একটু ইস্পাতের মিশেল ছিল। একটু ছিল হয়তো বিলুর মধ্যেও। ছিল বড়দা মল্লিনাথেরও। কিন্তু দীপের ভিতরকার সেই ইস্পাত জীর্ণ হয়ে গেছে আজকাল। বিকেলেই মিসেস বোস তাকে বলেছিলেন, আপনার আত্মমর্যাদাবোধ নেই কেন?

প্রশ্নটা এখনও পাথরের মতো বুকের ভিতরে ঝুলে আছে।

দীপ ছটফট করে উঠে বলে, বিলু কোথায় গেল বল তো!

পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটার আজ জন্মদিন। এক্ষুনি এসে পড়বে। বোসো।

দীপ ঘড়ি দেখে। সাতটা। তার কোথাও যাওয়ার নেই। এখান থেকে সে সোজা মেসবাড়িতে ফিরে যাবে। কারও সঙ্গেই কোনও কথা বলবে না। চুপচাপ খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়বে সিঙ্গল বেডের বিছানায়। জীবনে অনেককাল কিছু ঘটেনি।

সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, না রে, অনেক রাত হয়ে গেল।

প্রীতম করুণ মুখ করে চেয়ে বলে, চলে যাবে? রাতে খেয়ে যাও না! মেসে তো বিচ্ছিরি খাবার খাও রোজ।

দীপ মাথা নেড়ে বলে, আজ নয়।

তুমি মাঝে মাঝে এসে আমাকে একটু জোর দিয়ে যেয়ো। তোমার মনের জোরটা আমাকে দিতে পারো না?

দীপ খুব গম্ভীর মুখে বলে, তোর মনের জোর আমার চেয়ে কিছু কম নয় রে প্রীতম।

প্রীতম মুখ তুলে বলে, শোনো, শতম কলকাতায় এলে যেন আমার সঙ্গে দেখা না করে। ওকে দেখলেই সেইসব পুরনো কথা, মায়াটায়া এসে পড়ে। আমার পক্ষে ওগুলো ভাল নয়। ও যেন ভুল না বোঝে। ওকে বারণ করে দিয়ে।

দীপ মাথা নেড়ে বলল, আচ্ছা।

প্রীতম এমন কাঙালের মতো চেয়ে আছে যে, দীপ চট করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে পারছিল না। তার বড় মায়া, তার বড় ভালবাসা এই ছেলেটির প্রতি।

দীপ তাই নিঃশব্দে আবার বসে, মেজদা বা সোমনাথ তোকে দেখতে আসে?

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, না। সোমনাথ একবার এসেছিল বহুদিন আগে। শ্রীনাথদা আসেনি।

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, আসা উচিত ছিল।

প্রীতম ক্লান্ত স্বরে বলে, তুমি মাঝে মাঝে এসো, তা হলেই হবে। আর কেউ না এলেও ক্ষতি নেই। বরং আত্মীয়দের আহা-উহু শুনলে আমার খারাপ রি-অ্যাকশন হয়। সিমপ্যাথি দেখানোর লোক আমি চাই না।

দীপ একটু হেসে বলে, তবে কী চাস? সেই পুরু রাজার মতো বীরের প্রতি বীরের ব্যবহার?

প্রীতম ক্ষীণ হাসে। বলে, ঠিক তাই।

দীপ শ্বাস ছেড়ে বলে, আমার রোখের কথা বলছিলি প্রীতম, কিন্তু তুই রোখা কিছু কম নোস। তুই পারবি মনের জোরে এসব কাটিয়ে উঠতে।

প্রীতম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, শিলিগুড়িতে নয়, কিন্তু অন্য কোথাও গাছপালার মধ্যে, নদীর ধারে আমাকে কিছুদিন নিয়ে যেতে পারো না? বিলুকে বলেছি, কিন্তু ও তেমন গা করে না। বলে, বাইরে চিকিৎসা হবে না।

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, মেজদার ওখানে গিয়েই তো অনায়াসে থাকতে পারিস।

শ্রীনাথদা? ও বাবা, শ্রীনাথদার বউ ভারী কড়া লোক শুনি। সোমনাথ বিলুকে বলেছিল, বউদিই নাকি গুন্ডা ভাড়া করে ওকে মার দিয়েছে।

বাজে কথা। বউদি তেমন লোক নয়। বরং মেজদাই কিছু কাছাছাড়া লোক, তাই বউদি সম্পত্তি আগলে রাখে। তুই গেলে কত যত্ন করবে দেখিস।

তুমি কখনও গেছ ওখানে?

অনেকবার। বড়দা তখন বেঁচে। আমি গেলেই মুরগি কাটা হত। শ্রীনাথদার আমলেও গেছি। আরও সম্পত্তি বেড়েছে। ওরা বেশ ভাল আছে। তুই যাবি?

প্রীতম ম্লান মুখে বলে, কিন্তু ওরা না ডাকলে যাই কী করে? বিলু চিঠি লিখেছিল, শ্রীনাথদা জবাব দেয়নি। এখানেই তো রোজ চাকরি করতে আসে, একবার দেখাও তো করতে আসতে পারত। সেধে যেচে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে?

দীপ গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভাই কত পর হয়ে যায়! রক্তের সম্পর্ক কথাটাই কি তা হলে এক বিকট ভুল?

মনটা খারাপ ছিলই তার। আরও একটু খারাপ হল মাত্র।

০৫. তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে

তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে। শীতকাল বলে এখন ঘুটঘুট্টি অন্ধকার থাকে। আকাশভরা জমকালো তারার ঝিকিমিকি। কখনও-সখনও ক্ষয়া চাঁদের ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নাও। পাখি ডাকে কি ডাকে না। এত নিঃঝুম যে, নিজের শ্বাস বা হৃৎপিণ্ডের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়।

বৃন্দা ঘরের দরজা জানালা খুলে ঘর আর বারান্দা ঝাঁটাতে থাকে আর গুন গুন করে প্রভাতী গায়—ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে…। এমন পাষণ্ড কে আছে যার ভোরবেলার ছাঁকা নির্জনতায় ওই আপনভোলা নদীর মতো বয়ে যাওয়া সুরের প্রভাতী ভাল না লাগবে। যার ভক্তি নেই সেও ওই গান শুনে মাঝে মাঝে প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায়। তৃষার কোনওকালে ভক্তি ছিল না, আজকাল হয়েছে কি একটু!

তামাক দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তৃষা কলঘরে চলে যায়। প্রাতঃকৃত্য সেরে এই মারুনে শীতে লোহার মতো ঠান্ডা জলে আকণ্ঠ স্নান করে সে। তামাকের ধ্বক ওই স্নান পর্যন্ত গলায় আটকে থাকে তার। স্নান করতে করতেই শুনতে পায় বাগানে ফুলচোরদের আনাগোনার শব্দ। নিচু দেয়াল টপকে লাফিয়ে নামছে ছোট ছোট পা, ফুল ছিড়ছে পুট পুট করে, চাপা গলার কথা। কুয়োর ধারে স্থলপদ্ম গাছটার ওপরেই ওদের নজর বেশি।

এই ভোরবেলায় মনে কোনও রাগ সহজে ওঠে না। তৃষা কান পেতে শোনে একটু। বাড়াবাড়ি টের পেলে গম্ভীর গলাটা একটু উঁচুতে তুলে বলে, কে রে? বৃন্দা, দ্যাখ তো!

ওইতেই কাজ হয়ে যায়। ঝুপ ঝাপ করে ফুলচোরেরা পালাতে থাকে। খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুরটা মাঝে মাঝে তাড়া করে উপর। ঝড় পাহারাদার অবশ্য ফুলচোরদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। সারারাত পাহারা দিয়ে তৃষা উঠবার পর সে ঘুমোতে চলে যায়। এ সময়টায় তাই বাড়ির তেমন প্রতিরক্ষা নেই। কিন্তু তৃষা একাই একশো।

কলঘর থেকে বেরোতে একটু সময় লাগে তৃষার। নিজের যত্ন বলতে তার এই ভোরে স্নানটুকু। তাই সে সময় নেয়। এই সময়েই সে নিজের কথাও একটু ভাবে। দিনের মধ্যে বলতে গেলে এই একবারই।

কলঘর থেকে বেরোলেই দেখে পুব আকাশে ফিকে ফিরোজা রং ধরেছে। মিলিয়ে যাচ্ছে তারার আলো। ভোৱের হয়তো বা একটা সৌন্দর্য আছে। তৃষা তা কোনওদিনই তেমন টের পায় না। মস্ত দুই টিন-ভর্তি খেজুর রস বারান্দায় নামিয়ে রেখে যায় লক্ষ্মণ। হাঁস মুরগির ঘর থেকে ডিমের আঁকা এনেও বারান্দা-সই করে দিয়ে যায় সে। নিতাই কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে উঠোনের পশ্চিম ধারে ডাই করে। রেলবাবুদের বাড়ি থেকে দুধ নিতে ছোট ছোট ঘটিবাটি হাতে নিয়ে কচি কাচা বুড়ো মন্দারা এসে জুটে যায়। ঢতুদিকে চোখ রাখতে হয় তৃষার।

গোটা সাতেক দুধেল গোরুর পনেরো-যোলো সের দুধ দুইয়ে মংলু গয়লা একটা মস্ত অ্যালুমিনিয়ামের ঘ্রামে ঢেলে দিয়ে যায়। ড্রামের মধ্যে তৃষার কিছু কারচুপি থাকে। দু’-তিন সের পরিষ্কার জল আগে থেকেই ড্রামে ভরে রাখে সে। অন্য গয়লারা যেমন গোরুকে আঁক দেয় বা দুধে মিল্ক পাউডার, চক খড়ির গুঁড়া বা হাবিজাবি মেশায় তৃষা তা কখনও করে না। তার বাড়ির দুধ খায় বহু বাড়ির আদর যত্নের বাচ্চারা। হিসেব করলে তিন টাকা সের দরে সে যথেষ্ট খাঁটি দুধই দেয়। অতটা দুধে এই সামান্য জল মেশানোটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। তৃষার অন্তত কিছু মনে হয় না। শ্রানাথ টের পেয়ে একদিন খুব রাগ দেখিয়েছিল, ভদ্রলোকের মেয়ে হয়ে কেমন করে যে তুমি এত নীচে নামতে পারলে! যদি এই কাজই করবে তবে সারাজীবন গয়লাদের সঙ্গে দুধে জল দেওয়ার জন্য। খিটিমিটি করে এলে কেন?

শ্রীনাথের রাগ অবশ্য বাওয়া ডিমের মতো। সারবস্তু নেই। সংসারে সে হচ্ছে বোঁটা আলগা ফল। যে-কোনওদিন খসে পড়বে। তৃষা বথটায় কানই দেয়নি। সামান্য মাইনের প্রুফ-রিডারের সংসার চালিয়ে সে জীবনের অনেক সত্য ও সারবস্তু চিনে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে তৃষার নিজের তেমন কোনও লোভ নেই। সে সোনার গয়নার জন্য হেঁদিয়ে মরে না, শাড়ি বা রূপটানের জন্য আকণ্ঠ কোনও অতৃপ্তি নেই। সে শুধু চায় একটা ছোটখাটো রাজত্বের ওপর নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব করতে।

বাড়ির জন্য আলাদাভাবে দু-তিন সের দুধ দোয়ানো হয়। ফেনিল, ঘন, ননী ওঠা সুস্বাদু বালতি ভরা সেই দুধ দেখে কোনওদিন এক চুমুকও খাওয়ার কথা মনে হয় না স্যার। দুধের গ্লাস মুখের কাছে আনার কথা ভাবলেও পেট গুলিয়ে ওঠে। কয়েকবার চেষ্টা করে পারেনি। সকালে সে তাই বড় পাথরের গ্লাস ভর্তি চা খায়। রোদ ভাল করে ফোটার আগেই বৃন্দা তার জন্য মাটির হাঁড়ি করে ফেনাভাত নামিয়ে দেয়। খাঁটি আঁঝালো সর্ষের তেল, ঝাল লঙ্কা আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে তৃষা জলখাবার খায়। ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়ার আছে সংসারে, এ তার মনেই হয় না।

কুটনো কোটা বা রান্না করার মতো মেয়েলি কাজ তুষ আজকাল করে না। তার জন্য লোক আছে। সকালের দিকে রোদ উঠলে সে উঠোনে জলচৌকি পেতে বসে। কোলে থাকে তার নিজস্ব হিসাব-নিকাশের খাতা। কে কত পাবে, কার কাছে কত পাওনা, কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে, কাকে রাখবে, কাকেই বা ছাড়াবে তা সব ওই খাতায় লেখা। বন্ধকি ঋণের একটা মস্ত হিসেবও রয়েছে তার। সোনা-রুপোর গয়না থেকে ঘটি-বাটি এমনকী গোরু পর্যন্ত বাঁধা রাখে সে। কখনও এক পয়সা ছাড়ে না।

ছেলেমেয়েরা কোনওদিনই খুব একটা ঘেঁষে না তার কাছে। তবে ওর মধ্যে সজলই তবু একটু সাহস রাখে। একটু মান্যাওটাও সে-ই। কিন্তু সজল যখন সুন্দর নধরকান্তি শিশু ছিল তখনও তাকে তৃষা কোনওদিন হামলে আদর করেনি। আজও এক কঠোর শীতল শাসনের দূরত্ব বজায় আছে।

কয়েকদিন জ্বরে ভুগে উঠে সজল এখন ভারী রোগা আর দুর্বল। বেলায় ঘুম থেকে উঠে একটা ব্যাপার জড়িয়ে উঠোনের রোদে এসে গুটি গুটি বসেছে। তুষার জলচৌকি থেকে অল্প দূরে।

তৃষা এক পলক তাকিয়ে বলল, পায়ে চটি নেই কেন?

ভুলে গেছি।

যাও পরে এসো।

সজল উঠল না। দুর্বল ঘাড়ের নলিতে মাথাটা খাড়া রাখতে না পেরে কাত করে মায়ের দিকে চেয়ে বলে, একটু খেজুর রস খাব মা?

না। সারারাত হিম পড়ে রস এখন বরফ হয়ে আছে। জাল দিলে গুড় খেয়ো। বেশি নয়, কৃমি হবে।

সজল চুপ করে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে।

তৃষা একবার ছেলের দিকে চেয়ে বৃন্দাকে ডেকে ওর চটিজোড়া দিয়ে যেতে বলে।

সজল উদাস চোখে আকাশের দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, বাবা কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি মা?

তৃষা সব জানে। তার অজান্তে কিছুই ঘটে না। গভীর রাতে খ্যাপা নিতাই তার জানালায় টোকা দিয়ে খবরটা দিয়ে গেছে, শেষ গাড়ি চলে গেল মা। বাবু কিন্তু ফেরেনি আজ।

খবরটা শুনে তৃষা কিছুক্ষণ জেগে ছিল। বলতে নেই, শ্রীনাথের জন্য তার খুব একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল না। তার সন্দেহ শ্রীনাথ আজকাল বাইরে ফুর্তি করার স্বাদ পেয়েছে। তৃষার খুব ভুল হয়েছিল শ্রীনাথের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে। প্রথম থেকে শ্রীনাথ দু হাতে টাকা তুলত। তৃষা সাবধান হয়েছে এখন? জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা যতদূর সম্ভব টেনে নিয়ে ডাকঘরে রেখেছে। কিছু টাকা তার বন্ধকির ব্যাবসাতে চলে এসেছে। তবু যা টেনে নিয়েছে শ্রীনাথ তাও ফ্যালনা নয়। বদ্রীর মারফত জমিজমা কেনার চেষ্টা করছে, এ খবর মদন ঠিকাদারের কাছে শুনেছে তৃষা। শ্রীনাথের কথা খুবই ঘেন্নার সঙ্গে ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়েছে তৃষা, সকালে আর ব্যাপারটা মনে ছিল না। ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তোমার বাবা কাজে আটকে পড়েছে তাই আসেনি।

সজল এ কথায় জবাব দিল না, আর জানতেও চাইল না কিছু। কিন্তু তৃষা জানে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মুখে যতই না বোঝার ভাব দেখাক, ভিতরে ভিতরে অনেক কিছু বোঝে।

পাশদোলানি চালে তৃষার হাঁসের পাল লাইন ধরে ধপধপে ফর্সা উঠোন পেরিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছে। তার মধ্যেই একটা হাঁস টপ করে দুলদুলে একটা ডিম প্রসব করে ফেলল মাটিতে, আর সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা হাঁস কপ কপ করে সেটা খেয়ে নিল। দৃশ্যটা গম্ভীর চোখে দেখল তৃষা। নন্দর কাছে ডিম বাবদ আড়াইশো টাকার মতো পাওনা। তাগাদার ভয়ে তিন-চারদিন হল সে আর এ তল্লাট মাড়ায় না। তিন-চার দিনের ডিম ডাঁই হয়ে জমে আছে। বেশিদিন জমা থাকলে দু’-চারটে করে পচতে শুরু করবে। আজকালের মধ্যেই নতুন লোক না দেখলে নয়, নন্দ অবশ্য পালাতে পারবে না। টাকা তাকে দিতেই হবে, নইলে যে ঘোর বিপদ তা সে জানে। তৃষারা যখন প্রথমে এখানে আসে তখন কাঙাল ভিখিরি প্রার্থীদের খুব আনাগোনা ছিল। কাছাখোলা বাস্তববুদ্ধিহীন এবং লোকচরিত্র সম্পর্কে অজ্ঞ মল্লিনাথ তাদের দু’হাতে বিলোত। তৃষা হাল ধরার পর সব বন্ধ হয়। বিনা কাজে ফালতু একটি পয়সাও সে কাউকে দিত না। ভিখিরি-টিখিরি এলে সে বলত, কাজ দিচ্ছি, করলে পয়সা পাবে, ভাত পাবে। নইলে রাস্তা দেখো। তৃষার পাল্লায় পড়ে কিছু কিছু নিষ্কর্মা মাগুনে লোক এখন শুধরেছে। তৃষা তাদের খাঁটিয়ে পয়সা দেয়। নন্দ তাদেরই একজন। তুষার টাকা মেরে দেওয়ার মতো অকৃতজ্ঞ হলেও সে হতে পারে কিন্তু প্রাণের ভয়েই সে তা করবে না। সুতরাং তৃষার দুশ্চিন্তা নেই।

তার পায়ের কাছে সজলের মাথার ছায়াটা পড়ে ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ তৃষা চেয়ে দেখে, সজল নেই। কোথাও উঠে গেছে। হয়তো বাপের খোঁজ করতেই গেল। অবশ্য বাপের জন্য এক পয়সার টান নেই ওর। থাকবে কেন? তৃষা তো জানে, শ্রীনাথ ওকে কী চোখে দেখে। সজলও সেই বিষ মনোভাব টের পায়। শুধু শ্রীনাথ নয়, মল্লিনাথ ও তৃষার সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেকেরই অন্যরকম ধারণা আছে। তৃষা সেসব ধারণা ভেঙে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করেনি। নিন্দের হাওয়াকে রুখতে নেই। চুপ করে থাকলে তা একদিন আপনিই কেটে যায়। গেছেও অনেকটা।

চারদিকে তাকিয়ে দেখলে এই সাদা রোদে যে নিরুদ্বেগ সম্পন্ন গৃহস্থালির দৃশ্যটা দেখা যায় তার সবটা অত সরল গল্প নয়। তৃষা তার মেধা, বোধ, কূটবুদ্ধি, দেহ ও মনকে যতদূর সম্ভব নিংড়ে এ শাখা-প্রশাখাময় ছায়াঘন সংসারবৃক্ষটিতে সার ও সেচ জুগিয়েছে। উদ্যমহীন, আচ্ছা ও অবসরপ্রিয়, হতদরিদ্র শ্রীনাথের ঘর করতে গিয়েই সে টের পেত, সতীত্ব বা এককেন্দ্রিক জীবন কত না অর্থহীন। কতই না হাস্যকর শব্দ ভালবাসা। রাজার আমলের টাকার মতোই তা অচল। তাই মল্লিনাথের। সংস্পর্শে এসে সে যখন দারিদ্র্য মোচনের পথ দেখল তখন কোনও মানসিক বাধাই তাকে আটকে রাখেনি। লোকে বলে, অবৈধ সম্পর্ক। কিন্তু তাই কি? তৃষা কোনও পুরুষকেই ভালবাসে না বটে, কিন্তু তবু তার যেটুকু স্নেহ এখনও বুকের তলানিতে পড়ে আছে তার যোগ্য পুরুষ সারাজীবনে ওই একজনকেই পেয়েছিল তৃষা। সে মল্লিনাথ। ওই একজনকেই তার তেমন পরপুরুষ বলে মনে হয়নি কোনওদিন। বরং ওই একজনের প্রতি মানসিক বিশ্বস্ততাই তাকে খানিকটা সতীত্ব বা ওই ধরনের কিছু দিয়েছে। শরীরের কোনও বোধই কোনওদিন ছিল না তৃষার। কিন্তু আজও সে দেখতে শুনতে অতীব লোভনীয় এক যুবতী। হয়তো তরুণী নয়, কিন্তু জোয়ারি যুবতী। লম্বা মজবুত চেহারা তার। শরীরের হাড় বেশ চওড়া এবং শক্ত। যথেষ্ট পুরুষালি ভাব রয়েছে তার চেহারায় এবং চালচলনে। চোখের দৃষ্টিতে মেয়েমানুষি লজ্জা বা কমনীয়তা নেই। এতগুলো ছেলেমেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার। বুকের আকার প্রকারে কোনও শ্লথ ভাব নেই, মাতৃত্বের আর্ত স্নেহশীলা নম্রভাবও নেই তার মধ্যে। এখনও সে হেঁটে গেলে মনে হয়, এই মেয়েটি কোনও পার্থিব সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। এ একা।

তৃষা বাস্তবিকই তাই। এত সুন্দর লোভনীয় চেহারা থাকা সত্ত্বেও তৃষার দেহের কোনও চাহিদা নেই। কোনওদিনই তার যৌন মিলনের কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না। বিয়ের পর সে অত্যন্ত নিরুত্তাপভাবে এবং খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে দৈহিক মিলনটা মেনে নিয়েছিল মাত্র। তবে কোনওদিনই নিজে সাগ্রহে অংশ নেয়নি। কোনওদিন ওতে কোনও তৃপ্তিও বোধ করেনি সে। এ যেন স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করার মতোই একটি কর্তব্য কাজ। কিন্তু মেয়েমানুষের শরীরের যে বিপুল চাহিদা জগতে বিদ্যমান সে সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল টনটনে। তাই কাম সম্পর্কে অতি শীতল মনোভাব সত্ত্বেও এই দেহ সে কাজে লাগিয়েছে কখনও-সখনও। তেমনি মনোভাব নিয়েই সে মল্লিনাথকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। দেহের শীতলতার জন্যই সে দেহের সতীত্ব সম্পর্কে উদাসীন। মল্লিনাথকে সে তাই বাধা দেয়নি। এমনকী দেহ দিয়ে মল্লিনাথকে খুব বেশি কিছু দেওয়া হয়েছে বলে কখনও ভাবেওনি সে। উপরন্তু তাই সে অবিবাহিত মল্লিনাথকে দিয়েছিল স্নেহ, সেবা ও সঙ্গ। শেষ জীবনটা মল্লিনাথ তার দয়ায় উদ্ভাসিত আনন্দে কাটিয়ে গেছে। মল্লিনাথের বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করতে তাই কোনও সংকোচ নেই তৃষার। সে জানে মল্লিনাথের আপনার জন বলতে ছিল একমাত্র সে-ই। লোভী শকুনরা হেঁ মারতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু তৃষার অধিকার অনেক বেশি গভীর।

তাই চারদিকে চেয়ে সংসারের সম্পন্ন দৃশ্যগুলি দেখে তৃষা নিশ্চিন্ত থাকে না, তৃপ্তি বোধ করে। গল্পটা তো অত সরল নয়। কিন্তু লড়াইটা সে খুব উপভোগ করে।

মুরগির ঘর থেকে লক্ষ্মণ ঝিমুনি রোগে ধরা তিনটে লেগহর্ন মুরগি বের করে এনে বলল, এ তিনটের হয়ে গেছে মা, আরও গোটা পাঁচেক কাল-পরশুই যাবে।

তৃষা নিরাসক্ত গলায় বলে, পাঠশালার মাঠে গর্ত খোড় গে। আমি যাচ্ছি।

লক্ষ্মণ মুরগি তিনটের পা বেঁধে তৃষার অদূরে উঠোনে ফেলে রেখে শাবল নিয়ে চলে যায়। তৃষা আবার তার হিসেবের খাতায় ঝুঁকে পড়ে। মুরগিগুলো নড়ে না, শুধু বসে বসে ঝিমোয়।

হিসেব শেষ করে উঠে পড়ে তৃষা। কাজের অন্ত নেই। কাজ ছাড়া থাকতে ভালবাসে না সে। খাতাটা ঘরে রেখে আসতে না আসতেই লক্ষ্মণ এসে পড়ে।

গর্ত হয়ে গেছে, মা। চলুন।

পাঠশালা বলতে আসলে এখন কিছুই নেই। মল্লিনাথ ভাল ভেবে তার জমির মধ্যেই পাঠশালা খুলতে জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছিল। বাঁশের বেড়া আর টিনের চালওলা খানকয়েক ঘরও উঠেছিল এবং জনা বিশ-চল্লিশ পড়ুয়া আর তিন-চারজন মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটা পাঠশালা চালুও হয়েছিল। তবে পাঠশালার জমি কতটা হবে তা চিহ্নিত করে রাখেনি মল্লিনাথ, লিখিত কোনও দলিলও ছিল না। তৃষা সাকসেসন পাওয়ার পর পাঠশালার জমি নিয়ে দাঙ্গা লাগার উপক্রম। মাস্টারমশাই বা ছাত্ররা নয়, কোমর বেঁধে বাগড়া দিতে এল স্থানীয় লোকজন। তাদের পান্ডা ছিল অল্পবয়সী এক ছোকরা রাজনৈতিক নেতা। তার তেজ দেখবার মতো। ছোকরা আলটিমেটাম দিয়ে বলল, তিন বিঘে জমি ছেড়ে দিতে হবে। নইলে ও জমি আপনি কোনও কাজে লাগাতে পারবেন না। আদালতের রায় পেলেও না। গণ্ডগোল আরও গাঢ় হয়ে উঠল ক’দিনের মধ্যেই। সমস্ত এলাকার লোক তুষার বিরুদ্ধে। এমনকী পাঠশালার পাশ দিয়ে বাড়ির লোকের যাতায়াতের পথ। একদিন কাঁটাতারের ব্যারিকেড তুলে বন্ধ করে দিল বিরুদ্ধপক্ষ। পুলিশের কাছে গিয়ে কোনও লাভ হয়নি।

এখন এই সকালের রোদে জারুল আর শিমুলের দীর্ঘ ছায়া, লম্বা ঘাসের জমির স্নিগ্ধ শ্যামল গালিচা, ইস্কুল ঘরের নিস্তব্ধতা যে শান্তির ইঙ্গিত দেয় গল্পটা অত সরল নয় মোটেই। দুঃসহ মানসিক জ্বালা, রাগ, বিদ্বেষ, অসহায় অপমান কতদিন ধরে নীরবে সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। সে তবু গো। ছাড়েনি, হাল ছাড়েনি, প্রতিপক্ষের কোনও দাবিই মেনে নেয়নি। শুধু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে, বিশ্লেষণ করে মনে মনে স্থির করল, ছোকরা রাজনৈতিক নেতাটিকে হাত করতে পারলেই বোধহয় হবে। সেটাও একটা দুরন্ত ঝুঁকি বটে। জল এত দূর গড়িয়েছিল যে, একজনকে হাত করলেই সেটা মিটবে এমনটা মনে হচ্ছিল না। তবু ঝুঁকি নিয়েছিল তৃষা।

মদন ঠিকাদারই ছিল একমাত্র নিরপেক্ষ লোক। ঝুট ঝামেলায় নেই, আপনমনে কাজ করে, টাকা কামায়, গম্ভীর, শান্ত, নিরুদ্বেগ মানুষ। হয়তো তৃষাদের প্রতি তার খানিকটা অপ্রকাশ্য সহানুভূতি ছিল। তাকে দিয়েই একদিন ছোকরা নেতা শুভঙ্করকে নেমন্তন্ন করাল তৃষা। পোলাও, মুরগি, পাকা মাছ দিয়ে এলাহি খাওয়া। ছোকরা নির্লজ্জের মতো এল এবং খেল। যাওয়ার সময় যে পাঁচশো টাকা একটা ন্যাকড়ার থলিতে ভরে হাতে দিল তৃষা, তাও নিল নির্বিবাদে, যেন পাওনা টাকা। হাসিমুখে চলেও গেল। তৃষার মন বলল, চালে ভুল হল না তো? ভুলই হয়েছিল। কারণ গণ্ডগোল মিটল না। কোনও ফয়সালা হল না। সেই ছোকরা সামনা-সামনি আর তড়পাত না বটে, কিন্তু আড়াল থেকে উস্কানি দিত। আবার সে নেমন্তন্ন খেতে এল এবং যাওয়ার সময় বেশ স্পষ্ট গলাতেই বলল, হাজারখানেক দিন। পার্টিফান্ডের জন্য চাইছি। এবার কথা দিচ্ছি, মিটে যাবে।

দাঁতে দাঁত চেপে তাও দিয়েছিল তৃষা। ফলে সামনাসামনি লড়াই বন্ধ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জমির গণ্ডগোল মিটল না। শুভঙ্কর অত্যন্ত উগ্র এবং ঘোড়েল। এখানকার সব লোক, মায় পুলিশ পর্যন্ত তাকে ভয় খায়। মাঝে মাঝেই সে আসত এবং নির্লজ্জের মতো টাকা নিত। দিতেও হত তৃষাকে। তবে তৃষা প্রতিটি দেওয়া পয়সার হিসেব রাখত। সুযোগ পেলে সুদে-আসলে উসুল করবে বলে। যারা খুব দাপের সঙ্গে চলে তারা অন্যায় করলেও লোকে কিছু বলতে সাহস পায় না। শুভঙ্কর যা করত অত্যন্ত তেজ ও জোরের সঙ্গে করত। কারও পরোয়া করত না। বেশ বড়সড় অনুকারীদের। একটা দল ছিল তার। এ জায়গা শাসন করত তারাই। আশ্চর্যের বিষয়, তুষার কাছ থেকে শুভঙ্কর। যে টাকা নিত তা ঠিকঠাক তার পার্টি ফান্ডেই জমা দিত। এক পয়সাও এদিক ওদিক করত না। চুল থেকে পা পর্যন্ত সে ছিল রাজনীতির মানুষ। তার ব্যক্তিগত কোনও দুর্বলতা আছে কি না তা অনেক খুঁজেছে তৃষা। আর কিছু না হোক কাঁচা বয়সের ছেলেদের মেয়েমানুষ সম্পর্কে কৌতূহল তো থাকেই।

সেবার মাসির বাড়ি এলাহাবাদ থেকে বহুকাল বাদে দু’মাসের জন্য মা-বাবার কাছে এসে ছিল চিত্রলেখা। এমনিতেই চিত্রা দেখতে সুন্দর, তার ওপর মাসির কাছে সে একদম মেমসাহেবি কেতায়। থাকে। দিঘল, ফর্সা যৌবনাক্রান্ত ঢলঢলে কিশোরী। বব চুল, দারুণ সব পোশাক, চলাফেরার কায়দাই অন্যরকম। কাউকেই মানুষ বলে গ্রাহ্য করে না তেমন। সে এই জায়গায় পা দিতেই চারদিকে যেন চাপা শোরগোল পড়ে গেল। শুভঙ্করকে সেই সময় পরপর কয়েকদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াল তৃষা। গেল নদীর ধারে সপরিবারে পিকনিক করতে, সঙ্গে শুভঙ্কর। চিত্রলেখাকে শুভঙ্করের সঙ্গেই একদিন পাঠাল কলকাতা দেখতে। গেঁয়ো জায়গার কাঁচা ছেলের মাথা কঁহাতক ঠিক থাকে? ততদিনে শুভঙ্কর হয়ে গেছে তৃষার একান্ত বাধ্য, ভীষণ রকমের পোষমানা। সুতরাং নদীর ধারে কাঠা পাঁচেক সস্তা জমি কিনে পাঠশালাকে একটা দানপত্র লিখে দিয়ে তৃষার পক্ষে ঘরের কোণে ঘোগের বাসা তুলে দিতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। পাঠশালা নিয়ে স্বয়ং শুভঙ্কর তখন তুষার পক্ষে জান দিতে প্রস্তুত। পাঠশালা নদীর ধারে উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৃষা জায়গাটা ঘিরে ফেলল দেয়াল দিয়ে। চিত্রলেখা এলাহাবাদে ফিরে যাওয়ার আগে একদিন তৃষাকে বলল, ওই বুদ্ধ ছেলেটার সঙ্গে তোমাদেব এত মাখামাখি কেন? তৃষা কিছু বলেনি। চিত্রলেখা এলাহাবাদে ফিরে যাওয়ার পর থেকেই শুভঙ্কর তৃষাকে মা বলে ডাকতে থাকে। রোজ আসত। দেখা করত। এলাহাবাদে চিঠিপত্রও লিখত বলে শুনেছে তুষা। শুভঙ্করকে আর তেমন খাতির করত না সে, তবে চটাতও না। চিত্রলেখার প্রেমে পড়েই কি না কে জানে, ক্রমে ক্রমে শুভঙ্করের সেই দীপ্ত তেজ। আস্তে আস্তে নিভে আসছিল। মাস ছয়েক বাদে আসানসোলে একটা চাকরি পেয়ে সে চলে যায়। এলে তৃষার সঙ্গে দেখা করে যায়, মা বলে এখনও ডাকে। কিন্তু পুরোটাই নখদন্তহীন হয়ে গেছে শুভঙ্কর।

পাঠশালার মাঠের নরম শিশিরে সিক্ত ঘাসের জমিতে পা দিয়ে চারদিকের মনোরম নির্জনতা দেখতে দেখতে তৃষা ভাবে, এতটা সরল নয় এই জমিটুকুর ইতিহাস।

একটা শিমুল গাছের নীচে হাত দেডেক গভীর গর্তের ধারে তিনটে ঝিম-ধরা মুরগিকে শাবলের ঘায়ে এক এক করে মারল লক্ষ্মণ! এই মুরগি মারার ব্যাপারটা সবসময়ে আজকাল তৃষা নিজেই তদারক করে। এর আগে লক্ষ্মণ বহুবার ঝিমুনি মুরগি নিয়ে গিয়ে বাজারে বেচে এসেছে। লোকে খেয়ে অসুখে পড়লে তৃষার বদনাম হবে।

মুরগি তিনটের মৃতদেহ দুর থেকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখে তৃষা। রক্ত, ছেঁড়া পালক, ঘাড় গোঁজা ওই অসহায় মৃত্যুর দৃশ্য দেখে তার ভিতরটা একটুও নাড়া খায় না। এইসব দুর্বলতা নেই বলে সে খুশি।

লক্ষ্মণ পা দিয়ে ঠেলে মুরগি তিনটেকে গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দেয়। কবর হয়ে গেল। তৃষা গিয়ে চটি পরা পায়ে আলগা মাটি চেপে দেয় আরও একটু।

এমন সময় লক্ষ্মণ চাপা স্বরে হঠাৎ বলে ওঠে, বাবু ওই আসছে, মা।

তৃষা শুনল কিন্তু পথের দিকে তাকাল না। অন্য বউরা হলে তাকাত। কিন্তু তার আর শ্রীনাথের সম্পর্ক ততটা সরল নেই আর। শ্রীনাথ আসছে আসুক। তা কী?

সজল দাঁড়িয়ে ছিল পুকুরের ধারে। দু’ পকেটে চার-পাঁচটা ডিম। লম্বালম্বি একটা ডিমকে দু’ হাতের চাপে কিছুতেই ভাঙা যায় না, বলেছিল ছোটন নন্দী। এখন সে ডিম নিয়ে পরীক্ষাটা করছিল। তার শরীর ভাল নেই। জ্বর থেকে উঠে খুব একটা জোর পাচ্ছে না হাতে-পায়ে। তবু প্রাণপণে ডিমে চাপ দিয়ে দেখছিল, বাস্তবিকই ভাঙে না। ইলিপস বা উপবৃত্তে যে-কোনও চাপই কাটাকুটি হয়ে যায়, বিজ্ঞানের বইতে সে এমন কথা পড়েছে। তবু বইতে যা লেখা থাকে তার সবই তো সত্যি না হতে পারে! তাই সে পরীক্ষা করে দেখছিল। আসলে সকালে এক ঝুড়ি ডিম চোখের সামনে দেখলে আজকাল তার ভারী রাগ হয়। এত ডিমের কোনও মানেই হয় না। রোজ সকালে বিকেলে ডিম দেখলে কার না ইচ্ছে করে দু’-চারটে নষ্ট করতে?

ডিমগুলো হাতের চাপে ভাঙল না ঠিকই, তবে সজল একটার পর একটা ডিম বুড়ো একটা মহানিমের গায়ে ছুড়ে মারল। ফনাক করে ফেটে কুসম আর কাথ গড়িয়ে পড়ছে কাণ্ড বেয়ে। দু’-তিনটে কাক তাই দেখে লাফিয়ে কাছে এসে খা খা করতে থাকে। পুকুরে হাঁসগুলো ভ্যাক ভ্যাক করছিল, তাদের দিকেও একটা ডিম ছুড়ে দিল সে। ডিমটা ভাসল, ড়ুবল, ভাসল এবং ড়ুবে গেল।

তারপর হঠাৎই বাবাকে দেখতে পেল। উসকোখুসকো চুল, বাসি দাডি, তুসেব চাদর গায়ে বাবা বাড়ির ভিতরে ঢুকছে। সজল চট করে সরে আসে একটা গাছের আড়ালে। সাবধানে দেখে। কিছুই দেখার নেই অবশ্য। বাবা বাড়ি ফিরছে, এইমাত্র ঘটনা। এত বেলায় যখন ফিরল, তখন আজ আর অফিসে যাবে না। তার মানে সারাদিনের মতো একটা দুশ্চিন্তা, ভয় তার অস্বস্তি থাকবে সজলের। তাকে বাবা দু চোখে দেখতে পারে না।

ঘুরতে ঘুরতে সজল খ্যাপা নিতাইয়ের ঘরে এসে হানা দেয়। নিতাই নেই। ইস্পাতকে নিয়ে কোথায় গেছে। ঘরের দরজা হাঁ হাঁ করছে খোলা। চুরি যাওয়ার মতো কিছুই নিতাইয়ের নেই। তবু অনেক কিছু আছে। বাঁশের মাচানে একটা কম্বলের বিছানায় সে শোয়। মাথার কাছে একটা কুলুঙ্গিতে কালীমূর্তি তেল-সিঁদুরে বীভৎস নোংরা হয়ে আছে। মেঝের এক ধারে পঞ্চমুন্ডির আসন। সামনে মাটিতে একটা চক্র আঁকা। নিতাই কামাবের তৈরি কাঠের বাঁটওলা পাকা লোহার কয়েকটা ছুরি পড়ে আছে পাশে। নিতাই রোজ রাতে বিভিন্ন লোককে বাণ মারে। সবচেয়ে বেশি মারে তার বউ পুতুলরাণীকে উদ্দেশ্য করে।

এ সবই সজল জানে। নিতাই একদিন তাকে খুব গুমোর করে বলেছিল, তোমার যদি কাউকে বাণ মারার থাকে তো আমায় বোলো। মেরে দেব।

সজল সঙ্গে সঙ্গে আলটপকা বলে ফেলেছিল, আছে। মারবে?

বলো। ঠিক মেরে দেব। লোকটা কে?

লোভী মুখে সজল বলেছিল, বাবা।

শুনে নিতাই খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ছিঃ ছিঃ। দাঁড়াও, বাবাকে বলে দেব।

তখন খুব নিতাইয়ের হাতে-পায়ে ধরেছিল সজল।

এখন নিতাইয়ের ঝোপড়ায় সে একা পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে ছুরি ক’টা হাতে তুলে নেয় এবং মন দিয়ে ছকটা দেখতে থাকে। মংলু, লক্ষ্মণ, বামুনদি, বৃন্দা সকলেরই বিশ্বাস খ্যাপা নিতাই মারণ উচাটন বশীকরণ জানে। আবার মদনকাকা বলে, ওটা একটা ফ্রড। পাঠশালা নিয়ে গণ্ডগোলের সময় খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুর ইস্পাত একটা ছেলেকে কামড়ে দিয়েছিল। কোথায় তার জন্য ক্ষমা চাইবে, বরং উলটে সেই ছেলেটার ওপর গিয়ে তম্বি করে এল। ফলে শুভঙ্করদা খুব মেরেছিল নিতাইকে। তারপর সেই রাতেই খ্যাপা নিতাই শুভঙ্করদাকে বশীকরণ বাণ মারে। বাণের গুণ কিছু আছেই। নইলে তারপর থেকেই শুভঙ্করদা ওরকম অন্য মানুষ হয়ে গেল কেন?

বাণ মারা না জানলেও সজল আপনমনে ছুরিগুলো ছকটার মধ্যে সজোরে ছুড়ে ছুড়ে গাঁথতে লাগল। আপনমনে বলতে লাগল, মর, মর, এ বাড়ির সবাই মরে যা।

দূর থেকে খুব চেঁচিয়ে ভীষণ রাগের গলায় বাবা ডাকছে, সজল! এই সজল!

সজল নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। এ ডাককে অগ্রাহ্য করতে খুব একটা সাহস পায় না সে। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু এখন এই দুর্বল বুকে অতটা দম নেই।

সে একটা ছুরি প্যান্টের পকেটে নিয়ে উঠে পড়ে।

বেরিয়ে দুর থেকেই দেখতে পায়, বাবা ভাবন-ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গালে দাড়ি কামানোর সাবানের ফেনা, হাতে ভোলা জার্মান ক্ষুর। দৃশ্যটা দেখেই সে বুঝতে পারে, কেন তাকে এই তলব।

জড়ানো পায়ে ধীরে ধীরে কাছে যেতেই শ্রীনাথ গলা ফাটিয়ে বলে ওঠে, কে আমার ঘরে ঢুকেছিল?

সজল জবাব দিতে পারে না। বুক ধুকপুক করছে।

কে আমার ক্ষুরে হাত দিয়েছিল?

সজল চুপ করে থাকে। মিথ্যে কথা বলতে পারে বটে, কিন্তু ওই বিকট রাগের মুখে সেটুকুও সাহস হয় না।

বলো, কে হাত দিয়েছিল?

আমি জানি না।—কোনওরকমে বলল সজল।

জানো না! জানো না!বলতে বলতে শ্রীনাথ বারান্দা থেকে দু’ ধাপ সিঁড়ি নেমে এসে প্রকাণ্ড একটা চড় আকাশ সমান তুলল।

উঠোনের দিক থেকে মা আসছে, টের পাচ্ছিল সজল। চড়টা পড়ার আগেই তৃষা একটু তফাত থেকে চেঁচিয়ে বলল, খবরদার! রোগা ছেলেটাকে মারবে না।

চড়টা পড়ল না। কেমন একটু নিভে গেল শ্রীনাথ। কোনও জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে গেল ঘরে। তৃষা কলাঝোপ পর্যন্ত এসেছিল। তারপর আর এগিয়ে এল না।

সজল মার খেল না। বুঝতে পারল, মা-বাবার মধ্যে আবার একটা ঘোরালো ঝড় পাকিয়ে উঠছে বোধহয়। যদি কিছু হয় তবে সজল বাবাকে ছাড়বে না। যতই ভয় পাক সে, একদিন কিন্তু ঠিক প্রতিশোধ নিয়ে নেবে।

বাবা ঘরে গেল। মাও ফিরে গেল উঠোনে। একা সজল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরীরে ভয়ের কাঁপুনি টের পেতে লাগল।

ভাবন-ঘর সম্পর্কে তার অগাধ কৌতূহল। ঘরে বই আছে, পুরনো দেরাজে আছে অনেক টুকিটাকি জিনিস, আছে ভাঙা দুরবিন, একটা বহু পুরনো ইঞ্জিনিয়ারিং টুল বক্স, আছে জমি-জরিপের যন্ত্রপাতি, মাপজোখ করার জন্য গোল চামড়ার খাপে ইস্পাতের লম্বা ফিতে, লোহা কাটার করাত, বৈদ্যুতিক তুরপুন, আরও কত কী। বেশিরভাগই জেঠুর জিনিস, এখন আর কেউ ব্যবহার করে না।

শ্রীনাথের শাসনের ভয় সত্ত্বেও মাঝে মাঝে সে চুরি করে ঢোকে সেই ঘরে। জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। করাত দিয়ে লোহা কাটে, ডেসকের পায়া কাটে। জরিপের যন্ত্রপাতি বের করে বাগানটা মাপবার চেষ্টা করে। কাল সন্ধের কিছু আগে সে ঘরে ঢুকে বাবার ক্ষুর দিয়ে হাতের নরম লোম চেঁচেছিল। তারপর ধার পরীক্ষা করতে কয়েকটা ফুল গাছের ডাল কেটে দেখেছিল। গাছের কষে ক্ষুরটায় ছোপ ধরতেই সে ধার দেওয়ার চামড়ার টুকরোয় অনেকক্ষণ ঘষেছিল বটে, কিন্তু দাগ ওঠেনি।

এ বাড়ির মধ্যে ভাবন-ঘরটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। পুরনো জিনিস তো আছেই। তা ছাড়া চারদিকে নিবিড় সবুজ গাছপালার ঘেরাটোপের মধ্যে নিঃঝুম ঠান্ডা ঘরখানি। ভারী খোলামেলা। সারাদিন পাখির ডাক ঝরে পড়ে, সারাদিন নিবিড় হাওয়া খেলা করে, খুব স্পষ্ট শোনা যায় ট্রেনের আওয়াজ।

একদিন সে এই ঘরখানা দখল করে থাকবে।

মনে মনে সে জানে, বাবা এই সংসারে বেশিদিন থাকতে পারবে না। এসব জিনিসপত্র, বাড়িঘর সব মায়ের। বাবা বসে বসে খায়। বাবাকে দু চোখে দেখতে পারে না মা। আর মা যা চায় তাই হয়। মা বাবাকে ইচ্ছে করলেই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। দেবেও একদিন। মাকে সে বাবার অনেক খবর দেয়, যাতে মা চটে যায় লোকটার ওপর। অনেক কথা সে বানিয়েও বলে। মা সব কথা বিশ্বাস করে না, কখনও চুকলির জন্য বকে, কিন্তু তবু বাবার ওপর মা চটেও যায় ঠিকই।

সজল এসে পুকুরের ধারে দাঁড়ায়। কালো গভীর জলের দিকে চেয়ে থাকে। হাঁসগুলো উঠে গেছে। জল এখন নিথর। ভারী ভাল লাগে এই পুকুরের ধারটা। চারদিকে ঝোপঝাড়ে একটা বুনো গন্ধ উঠছে রোদের তাপে। এই পুকুরটার ধারে এসে দাঁড়ালে তার মনে হয়, কেউ তাকে ডাকছে, টানছে। নইলে আর কারও টান সে কখনও টের পায় না।

বাবা মা দিদিরা কাউকেই তেমন গভীরভাবে ভালবাসে না সে। মাকে একটু। আর কাউকে একবিন্দুও নয়। সবচেয়ে দুর আর পর হল বাবা।

বাবা? সজল মুখ টিপে আপনমনে হাসে। সে শুনেছে শ্রীনাথ তার বাবাও নয়। তার আসল বাবা হল জেঠু।

জেঠুই বাবা? ভাবতে একরকম রোমহর্ষ আর আনন্দ হয় তার। লম্বা চওড়া হুল্লোড়বাজ ওই লোকটার কথা মনে হলেই তার ভাল লাগে।

হে ভগবান, জেঠুই যেন তার আসল বাবা হয়।

০৬. মালদা থেকে গভীর রাতে দার্জিলিং মেল

মালদা থেকে গভীর রাতে দার্জিলিং মেল ধরল সরিৎ। ট্রেনে অসম্ভব ভিড়। এই শীতে সাধারণত ভিড় এত হয় না কলকাতা-যাত্রীদের। তার কপালে হল। টিকিট কেটে ট্রেনে ওঠবার অভ্যাস বহুকাল হল তার নেই। দরকার হয় না। সব লাইনেই আজকাল রেলের রানিং স্টাফ একটা প্যারালেল ব্যবস্থা চালু রেখেছে। সেকেন্ড ক্লাস টিকিটের প্রায় অর্ধেক খরচে দিব্যি যাতায়াত করা যায়। মালদার রেলের লোকেরা প্রায় সবাই সরিতের চেনা বা মুখচেনা। স্টেশনের চ্যাটার্জিদাকে ধরতেই রেটটা আরও কিছু কমে গেল। চ্যাটার্জিদা বললেন, থ্রি টায়ারে উঠে কন্ডাক্টর গার্ডকে দুটো টাকা দিয়ে, আরামে শুয়ে যেতে পারবে।

কিন্তু সরিতের কাছে দুটো টাকাও অনেক টাকা। দু’ প্যাকেট চারমিনার আর দেশলাই হয়েও বেশি থাকবে। ফালতু ঘুমোনোর জন্য উঠতে হল। পাঁচ-সাতজন বন্ধু তুলে দিতে এসেছিল স্টেশনে। তারাও বলল, ওঠ।

কন্ডাক্টর লোকটা মহা ফ্যাচালে পার্টির। কেবল খ্যাচ খ্যাচ করে যাচ্ছিল, নেমে যান, নেমে যান। আজ কোনও অ্যাকোমোডেশন নেই।

বলে লোকটা মালদা স্টেশনেই জি আর পি ডেকে আনল। মহা ঝামেলা!

সরিৎ বেগতিক দেখে নেমে পড়েছিল। পিছন দিকে একটা মিলিটারি কামরা মোটামুটি ফাঁকা এবং দরজা খোলা দেখে আরও দশ বারোজন যাত্রীর সঙ্গে সেটাতে উঠে পড়ে সরিৎ। ঘুমন্ত আধ-ঘুমন্ত মিলিটারিরা প্রথমে কিছু বলেনি। তারপরই হঠাৎ দশ-বারোটা কালো কালো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা জওয়ান তেড়ে এসে হুমহাম করে ভারতের অচেনা কোনও ভাষায় প্রচণ্ড ধমক চমক দিতে লাগল। ধমক শুনে ভয় খেলেও ট্রেন ছাড়ার সেই শেষ মুহূর্তে কারও নামবার ইচ্ছে ছিল না। তখনই হঠাৎ বিনা নোটিশে মিলিটারিগুলো কিল চড় আর লাথি চালাতে শুরু করে। কে মার খেল আর কে খেল না তা দেখার জন্য দাঁড়ায়নি সরিৎ। মালদা শহরে সে মস্তানি করে বেড়ায় বটে, কিন্তু মিলিটারি কামরায় হুজ্জতি করলে যে জল কত দূর গড়াবে তার ঠিক নেই বলে ঝট করে নেমে। পড়ল। কিন্তু অপমানটা পুরো এড়াতে পারল না। নামবাব মুহূর্তে পাছায় একটা কেডস পরা পায়ের প্রবল লাথি হজম করতে হল।

বন্ধুরা দৃশ্যটা হয়তো দেখেনি, এই যা ভরসা। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে, সরিৎ দৌড়ে গিয়ে ফের থ্রি টায়ারে উঠে পড়ল। আবার কন্ডাক্টরের খ্যাচ খ্যাচ, ভীতি প্রদর্শন এবং যাত্রীদের দিক থেকেও প্রবল প্রতিবাদ।

সরিৎ জানে, বোবার শত্রু নেই। তাই চুপ করে কিটব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দরজা ঘেঁষে। কন্ডাক্টরকে দুটো টাকাই দিতে হবে, না কি কিছু কম-সম দিলেও হবে তা বুঝতে পারছিল না। দু’জন আর্মড পুলিশও কামরা পাহারা দেওয়ার জন্য উঠেছে। ডাকাত উঠলে আটকাবে। তবে তারা সরিৎকে কিছু বলল না। আরও জনা তিন-চার সরিতের মতোই ফালতু যাত্রী বাথরুমের গলিতে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কন্ডাক্টর অবশ্য আর বেশি খ্যাচ খ্যাচ করল না। খানিক বাদে যাত্রীরা যে যার ঘুমিয়ে পড়লে দরজার প্যাসেজে দাঁড়িয়ে একটা কাগজের দিকে খুব আনমনে চেয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, কোথায় যাবেন?

সরিৎ পকেট থেকে একটা আধুলি বের করল। কন্ডাক্টর আড়চোখে আধুলিটা দেখে বলল, ওতে হবে না। এক টাকা।

সরিৎ পয়সা বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে বলল, জায়গা করে দিতে পারলে দু টাকা দিতাম। জায়গা তো নেই, মেঝেয় বসে যাব না হয়।

আবার খ্যাচ খ্যাচ। তবে কন্ডাক্টর তার নিজের বরাদ্দ লম্বা বেঞ্চটায় সিপাইদের পাশাপাশি সব ক’জন ফালতু যাত্রীর বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে এক টাকা করেই নিল। কিছুক্ষণ বাদে সিগারেট-টিগারেট দেওয়া-নেওয়া এবং গল্পসল্পও হতে লাগল।

সরিৎ অবশ্য বুড়ো কন্ডাক্টর বা বয়স্ক যাত্রীদের সঙ্গে জমাল না। একা বসে চোখ বুজে রইল, ঘুম আসবে না জানা কথা। মিলিটারির লাথিটা মাজায় জমে টনটন করছে। ফালতু ঝামেলা যত সব। ভাবতে গেলে অপমানে গায়ের ভিতরে জ্বালা ধরে যায়। তবু এত অপমান-অনাদরের পরেও যে বসার জায়গা পেয়েছে সেটাই একমাত্র তৃপ্তি।

সেজদি এতকাল তাদের বিশেষ পাত্তা দেয়নি। পয়সা হলে কে কাকে পাত্তা দেয়? সেজদি অবশ্য উলটো কথা বলে। তার যখন পয়সা ছিল না তখন নাকি বাপের বাড়ির লোকেরাই তাকে তেমন পাত্তা দিত না। সংসারের এইসব কূটকচালে ব্যাপার অবশ্য সরিৎ অত তলিয়ে বোঝে না। এতকাল পরে সেজদি যে তার বেকার ছোট ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছে সেইটেই ঢের। সেজদির গোরু চরাতেও সে রাজি আছে, পয়সা পেলে। তারপর কলকাতায় একটা কিছু জুটে যাবে ঠিকই। কলকাতা তো আর মালদা নয়।

বড়দা মালদার সিভিল হাসপাতালের ডাক্তার। কান, নাক আর গলার স্পেশালিস্ট। কিন্তু ই এন টি-র ডাক্তারের তেমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস থাকে না। বড়দারও নেই। তার ওপর লোকটা ঘরকুনো এবং ব্রিজ খেলার পাগল। যেখানেই বদলি হয়ে যায় সেখানেই ঠিক তার ব্রিজের বন্ধু জুটে যাবেই। ওই খেলাই বড়দার কাল হয়েছে। ডাক্তারির ব্যাপারটাকে আদৌ গুরুত্ব না দিতে দিতে রুগিদের কাছে এখন আর তার আদর নেই। পসার না থাকায় বাঁধা মাইনেয় সংসার চালাতে হয়। মধ্যপ্রদেশে মেজদার কাছে মা বাবা থাকে, সরিৎ আর তার ছোড়দি পড়ে আছে বড়দার ঘাড়ে। বউদি প্রথম-প্রথম খারাপ ব্যবহার করত না। ছোড়দি এই সংসারে রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজ বুক দিয়ে করে। তবু ইদানীং বউদি বস্তিবাড়ির মেয়েদের মতো জঘন্য সব গালাগাল দিয়ে ছোড়দির ভূত ভাগিয়ে দিচ্ছে। মুশকিল হল, ছোড়দিটার বিয়ে হওয়ার চান্স খুব কম। ওর কী একটা মেয়েলি রোগ থাকায় ডাক্তার বিয়ে দিতে বারণ করেছে। তবু হয়ে যেত হয়তো, কিন্তু ছোড়দি দেখতে খুব খারাপ। রোগা, কালো, তার ওপর মুখটা এমন ভাঙাচোরা যে, বুড়ির মতো দেখায়। সুতরাং ছোড়দির আর গতি নেই বড়দার আশ্রয় ছাড়া। সেইটে সার বুঝে বড় বউদি ছোড়দির ওপর সাত জন্মের শোধ তুলে নিচ্ছে। নিক, তাতে সবিতের তেমন আপত্তি নেই। ছোড়দিও বড় কম যায় না, যখন মুখ ছোটায় তখন দিনকে রাত করে দিতে পারে। কিন্তু সরিতের বিপদ নিজেকে নিয়ে। বি এস-সি পাশ করে বহুদিন বসে আছে। বয়স ছাব্বিশের কাছাকাছি। বড়দাবউদি খাওয়াচ্ছে বটে, কিন্তু খুশিমনে নয়। সরিৎ সংসারে বাজার হাট করা থেকে জল তোলা পর্যন্ত সবই করে দেয়, তবু হাতখরচ চালাতে তিন-চারটে টিউশানি করতে হয় তাকে। বড়দা খাওয়া ছাড়া আর কিছু দেয় না। ইচ্ছে থাকলেও বউদির জন্য দেওয়া সম্ভব নয়।

বেকার জীবনের একটা শূন্যতা আছে। সর্বদাই একটা খাঁ-খাঁ করা ভাব বুকের মধ্যে। মনে হয়, ভিতরের অনেক আগুন কাজে না লেগে আস্তে আস্তে নিভে আসছে। চাকরির জন্য সরিৎ পলিটিক্স করেছে, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো থেকে শুরু করে নানাবিধ পোস্টাল ট্রেনিং নিয়েছে, শর্টহ্যান্ড আর টাইপ শিখে রেখেছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। সরকারি চাকরির বয়স পার হতে চলল। এখন কেমন যেন একটা নেতিয়ে পড়া ভাব, কিছু হবে না’ গাছের একটা ধারণার কাছে আত্মসমর্পণের ঝোক এসেছে। শুনেছিল তার গরিব সেজদির অনেক টাকা হয়েছে, ভাসুরের সম্পত্তি পেয়েছে বিস্তর, তাছাড়া নগদ টাকাও। কিন্তু তখন তার কাছে যাওয়া বা তার সাহায্য চাওয়াটা ভারী লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ সম্পত্তি পাওয়ার কিছুকাল আগেই সেজো জামাইবাবুর প্লুরিসির চিকিৎসার জন্য ভাইদের কাছে কিছু টাকা হাওলাত চেয়েছিল সেজদি। কেউই টাকাটা দেয়নি। ঘরের ঘটিবাটি গয়না বিক্রি করে সেজদিকে সে যাত্রা সামাল দিতে হয়। অভাবের সংসার থেকে বড় মেয়ে চিত্রাকে পাচার করতে হয়েছিল সেদিকে মেজদির কাছে, এলাহাবাদে। তখন সেজদিকে সবাই সাহায্য করার ভয়ে এড়িয়ে চলত। সেই সেজদি হঠাৎ বড়লোক হওয়ার পর তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে যাওয়াটা কি লজ্জার নয়?

বহুকাল বাদে সেজদি হঠাৎ একটা চিঠিতে সরিৎকে তার কাছে যেতে লিখেছে। সরিৎ বড়দার সংসার থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। সেজদির কাছেও হয়তো তেমন আদর হবে না। না হোক। আদর ভালবাসা কেমন তা ভুলেই গেছে সরিৎ। মধ্যপ্রদেশে মেজদার কাছেও আর আশ্রয় নেই। মেজদা একটা খনিতে কাজ করে। সামান্যই পায়। মা বাবা তার ঘাড়ে থাকায় সে আর কোনও দায়িত্ব নিতে নারাজ। বড়দি কেরানির ঘর করে নিউ কুচবিহারে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। মেজদি অবশ্য বড়লোক। কিন্তু বাপের বাড়ির সঙ্গে তারও বিশেষ সম্পর্ক নেই। মেজদিকে ভাল করে চোখেই দেখেনি সরিৎ। বড়লোক বলে ভয়ও পায়। সরিতের কাছে সব দরজাই বন্ধ ছিল। এখন হঠাৎ সেজদির দরজাটা খুলেছে। আদরের কথা সে আর ভাবে না, শুধু একটা আশ্রয়ের কথা ভাবে।

গাড়ি ফরাক্কা ব্যারেজ পার হচ্ছে গুমগুম শব্দ করে। প্রচণ্ড শীত। মাফলারের অভাবে সরিৎ রুমালটা দু’ভঁজ করে কান ঢেকে কপালে গেরো দিয়ে বসল। পুরনো পুলওভারে শীত মানতে চায় না। হাত-পা অবশ করা শীত থেকে পরিত্রাণ পেতে সে অনেক হিসেব করে একটা সিগারেট ধরাল। টাকার অভাব তো অনেক বড় জিনিস, তার চেয়েও ছোট জিনিস আধুলিটা সিকিটা নিয়ে সরিৎকে অনবরত মাথা ঘামাতে হয়। ছোট জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে ভিতরের মানুষটাও কি ছোট হয়ে যায় না?

বাঁপাশে দুটো পুলিশ, ডানধারে ফালতু যাত্রীরা। যাত্রীদের মধ্যে ঠিক পাশে বসা লোকটাকে সরিৎ মালদার বাজার-হাটে দেখেছে। সঠিক পরিচয় না জানলেও মুখচেনা। লোকটা হঠাৎ বলল, আপনি ডাক্তারবাবুর ভাই না?

হুঁ।—গম্ভীর গলায় আওয়াজ দেয় সরিৎ।

কলকাতায় যাচ্ছেন কি ইন্টারভিউ দিতে নাকি?

না। দিদির বাড়ি বেড়াতে।

অ। মলিনকে চেনেন? মলিন সাহা?

মলিনকে চেনে সরিৎ। তারই বয়সি ছেলে। খুব ফাঁটে একটা স্কুটার হাঁকিয়ে বেড়ায়, পরনে সবসময়ে দারুণ সব জামা প্যান্ট। শুনেছে বড়লোকের ছেলে। মলিনের বোন মলিনা বিখ্যাত সুন্দরী। তার জন্য কলেজের পথে বিস্তর ছেলে লাইন দেয়। সরিৎ দিয়েছে। সরিৎ বলল, চিনি। কেন বলুন তো!

আমি মলিনের বাবা।

শুনে সিগারেটটা ফেলে দেওয়া উচিত হবে কি না ভাবছিল সরিৎ। ভারী অবাকও হচ্ছিল সে। মলিনের বাপ বলে লোকটাকে বিশ্বাসই হয় না। কালো একটা তুসের চাদর আর মাফলার জড়িয়ে দানহীনের মতো বসে আছে। কিন্তু দীনেন সাহা যে ডাকের বড়লোক, এ সবাই জানে। লোকটা মালদায় স্থায়ীভাবে থাকে না। থাকলে চিনতে পারত সরিৎ। শুনেছে, লোকটার চারটে মিনিবাস চালসা, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া অঞ্চলে চালু আছে। আর আছে হরিশ্চন্দ্রপুরে আমরাগান, শিলিগুড়িতে ঠিকাদারি। লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক দীনেন সাহা বিনা টিকিটে এইভাবে যাচ্ছে দেখে ভারী অবাক হল সে।

সরিৎ ভেবেচিন্তে সিগারেটটা হাতের আড়াল করেই ফেলল। উঠে বাথরুমে গিয়ে খেয়ে আসবে।

দীনেন সাহা কিন্তু নিজেই পকেট থেকে বিড়ি বের করে বলল, আপনার ম্যাচিসটা একটু দিন তো!

দেশলাইটা দিতে পেরে আর সংকোচ রইল না সরিতের। মুখটা একটু নিচু করে সিগারেটে আর-একটা টান দিল।

দীনেন সাহা ম্যাচটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ট্রেন লেট আছে।

হুঁ। —আওয়াজ দেয় সরিৎ। মনে মনে বলে, হাঁ বে শালা শ্বশুর, লেট আছে।

খুব বিষয়ী চোখে সরিৎকে আর-একবার দেখে নিয়ে দীনেন সাহা বলল, রেলগাড়ির যা অবস্থা হয়েছে আজকাল, বলার নয়। গত দশ বছর আমি টিকিট কেটে কোথাও যাইনি। ব্যবস্থা যখন আছে, টিকিট কেটে যাবই বা কেন? যাদের ফালতু পয়সা আছে তারা যাক।

সরিৎ সিগারেটটা শেষ করে বাঁচল। লোকটা যদি সত্যিই কোনওদিন তার শ্বশুর হয়?

দীনেন সাহা জিজ্ঞেস করে, আপনি চাকরি-বাকরি করেন নাকি?

না। চেষ্টা করছি।

মলিনটার তো কাজকারবারে মন নেই। খুব বাবুগিরিব দিকে নজর।

সরিৎ একটু হাসে মাত্র। মনে মনে বলে, আমাকে জামাই করলে তোমার কাজকারবারে বিনে মাইনেয় খাটব, বুঝলে হে শ্বশুরমশাই?

দিদির বাড়ি কলকাতার কোথায়?—দীনেন জিজ্ঞেস করে।

কলকাতায় ঠিক নয়। কাছেই রতনপুর নামে একটা জায়গা। হাওড়া থেকে যেতে হয়।

অ। তা হলে আপনি বর্ধমান নেমে হাওড়ার লোকাল ধরবেন তো? আমিও তাই। আমি যাব দাশপুরে। জামাইবাবু কী করে?

চাকরি।

সংক্ষেপে জবাব দেয় সরিৎ। খামোখা ভ্যাজর ভ্যাজর করতে ভাল লাগে না। বয়স্ক লোকরা বড় বেশি হাঁড়ির খবর নেয়। তবু এ লোকটা মলিনার বাবা বলেই জবাব দিয়ে যাচ্ছে সরিৎ।

দীনেন সাহা বলে, আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো হয়েছে তঁাদড়। কথাবার্তা শুনতে চায় না। দাশপুরে গিয়ে মালটা নিয়ে আসতে বাবুর কোনও অসুবিধেই ছিল না। তা বলে কী জানেন? ফাস্ট ক্লাসের ভাড়া চাই, আর কলকাতায় সাতদিন থাকার জন্য পাঁচশো টাকা হাতখরচা। শুনেছেন কখনও এমন তাজ্জব কথা! এই তো আমি ছ’ টাকায় ম্যানেজ করছি। শীল লেনে বোনের বাড়িতে থাকব। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাট টাকার বেশি খরচ নয়। মলিনের সঙ্গে দেখা হলে ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন তো, এভাবে চললে দুর্দিনের বাজারে পথে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।

সরিৎ ঢুলছিল। তবু মনে মনে বলল, তোমার টাকায় মলিন একদিন পেচ্ছাপ করবে, শ্বশুরমশাই। তার চেয়ে আমাকে জামাই করো, সব দেখেশুনে রাখব। আজ মেলা বোকো না আর। গুড নাইট ফাদার-ইন-ল।

 

স্টেশন থেকে রতনপুর আধ মাইলের ওপর রাস্তা! রিকশা যায়। কিন্তু সরিৎ রিকশার কথা ভাবতেও পারে না।

স্টেশনের কাছে চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করে রাস্তাটা বুঝে নিয়ে হাঁটা দিল। মনের মধ্যে নানারকম হচ্ছে। সেজদি কেন ডেকে পাঠিয়েছে, কেমন ব্যবহার পাবে, আশেপাশে ফুটফুটে মেয়েরা আছে কি না, চাকরির সুবিধে হবে কি না, দিদিরা কতটা বড়লোক এইসব ভাবছিল।

রাস্তা ফুরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্তে। বিশাল বাগান আর গাছে ঘেরা বাড়ির ফটকে ঢুকতেই খাউ খাউ করে তেড়ে এল একটা কুকুর। কুকুরের পিছনেই এক কাপালিক।

ভয় পেয়ে সরিৎ ফটকের বাইরে ফিরে এল আবার। গেটটা চেপে ধরল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে।

কাপালিকটা বলল, কাকে চাই?

শ্রীনাথ ব্যানার্জি।

এই বাড়ি। সোজা ভিতরে ঢুকে যান। কুকুর কিছু বলবে না।

খুব ভয়ে ভয়ে, দুশ্চিন্তায়, অনিশ্চয় এক মন নিয়ে সেজদির বাড়ির সীমানায় ঢুকল সরিৎ।

 

মুড়ি চিবোতে একদম উদাস লাগছে নিতাইয়ের। রোজ মুড়ি কি ভাল লাগে?

যতদিন জ্ঞান হয়েছে ততদিন থেকে এই এক মুড়িই দেখে আসছে সে। শুকনো খাও, ভিজিয়ে খাও। তরকারি বা তেল মেখে খাও। তাও যে বরাবর জুটেছে ঠিকঠাক তাও নয়। প্রায়ই তার মুড়িটায় ভাতটায় টান পড়েছে। টান পড়লেই আদর বাড়ে। দু’দিন ফাঁক গেল তো তিনদিনের দিন এক কেঁচড় মুড়ি পেলে মনে হয়, এর কাছে অমৃত কোথায় লাগে!

আজ তবু মুড়ি বড় উদাস লাগে।

নিতাইয়ের মন ভাল নেই। অমল নন্দী গুসকরায় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে এসে কালই খবর দিয়েছে পুতুলরাণী ইয়া মোটাসোটা হয়েছে। দুটো ছেলেপুলের মা। অমল নন্দী নিতাইয়ের কথা তুলেছিল। তাতে নাকি পুতুলরাণী বলেছে, ওটা তো বদ্ধ উন্মাদ।

সে কারণে নয়। আসলে মন খারাপ তার বাণ বশীকরণে, মারণ উচাটনে কাজ হচ্ছে না বলে। প্রতিদিন যাকে মোক্ষম মোক্ষম বাণ মারা হচ্ছে সে মোটা হয় কী করে?

যে তান্ত্রিকটা শিখিয়েছিল সেটা আসলে চারশো বিশ। সব কিছুতেই যখন ভেজাল তখন তান্ত্রিকই বা ভেজাল হবে না কেন?

আজ সকাল থেকে নিতাই ভাবছে, হিমালয়ে চলে যাবে। সেখানে পাহাড়ে করে খুঁজে আসল সিদ্ধাই কাউকে খুঁজে বের করবে। যদি আসল লোককে পেয়ে যায় তবে আর ফিরবে না নিতাই। যেমন তেমন করে হোক পুতুলরাণীর গলা দিয়ে রক্ত তুলতেই হবে।

পালপাড়ার সদর রাস্তার ধারে বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে রঘু কর্মকার। শালারা দুনিয়াটাই শান বাঁধিয়ে ফেলছে আস্তে আস্তে। একদিন কি লোকে ঘরের মধ্যেই হালচাষ করবে বাবা? না হলে জমিই বা পাবে কোথায়?

রঘু হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে রাজমিস্ত্রিদের কাজ দেখছে। নতুন বাড়ির লাগোয়া তার পুরনো টিনের ঘর। রঘুর মেয়ে এসে বাপকে এক কাপ চা দিয়ে গেল। রঘু রোদে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে।

নিতাইয়ের এখন একটু চা-তেষ্টা পেয়েছে ঠিকই। সে দাঁড়িয়ে গেল। ইস্পাত একটু এগিয়ে রঘুর দিকে মুখ তুলে ধমকমক করছে। কুকুরটা লোক চেনে। সোনা চুরি করে রঘুর পয়সা হয়েছে, এ কে না জানে!

নিতাই বলল, চা খাচ্ছ নাকি রঘুবাবু? বাড়িটা তো খুব সুন্দর হচ্ছে গো। তা তোমার বুদ্ধির বলিহারি যাই, পশ্চিমমুখো সদর করে কেউ? এ বাড়ি যে গরম হবে খুব।

রঘু ফিরে দেখে বলল, তাই নাকি? তবে তো বড় ভুল হয়েছে রে সম্বন্ধীর পুত!

তা একটু হয়েছে। অত গরম চা খেয়ো না। ফুয়ে ঠান্ডা করে খাও। বেশি গরম খেলে পেটে ক্যানসার হয়।

বলে নিতাই ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখে। বলে, তিনতলার ভিত গেঁথেছ মনে হয়।

তাতেও কোনও ভুল হল নাকি?

না, ভাবছি রঘু স্যাকরার কত পয়সা হয়েছে।

রঘু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার আবার পয়সা! আর পয়সাটাই সব রে, নিতাই? তোর মতো মারণ উচাটন শিখতে পারলে কত কাজের কাজ হত! তা শুনলাম তোর বউটা এখনও নাকি মরেনি?

নিতাই মৃদু হেসে বলে, আস্তে আস্তে মরবে। ভুগে ভুগে। পট করে মরে গেলে কর্মফল ভোগ হবে কী করে বলো!

তা বটে। তবে আমি বলি কী, তুই একদিন গুসকরায় গিয়ে সামনাসামনি বাণ মেরে আয় না। তাতে অনেক কাজ হবে।

ও বাবা! পুলিশে ধরবে না? ফাঁসি হয়ে যাবে।

তখন পুলিশ বশীকরণ করবি।

ইয়ারকি হচ্ছে?

রঘুর বউ বেরিয়ে এসে উঁকি দিয়ে দেখে বলল, এই সাত-সকালে খ্যাপাকে রাগাচ্ছ কেন? কু বাক্যি বলবে যে নামতা পড়ার মতো!

রঘু বউকে বলে, কু-বাক্যি না বলছে কে? তোমারটা তো পুরনো হয়ে গেছে, এর কাছে একটা নতুন রকম শুনি না হয়।

আহা, আমার কথা আলাদা। আমি ঘরের লোক বলি সে একরকম। তা বলে নিতাই বলবে কেন?

রঘু খুব ভাবুকের মতো বলে, কুবাক্যি শোেনা কিছু খারাপ নয়। তাতে মন মেজাজ পরিষ্কার হয়ে যায়, মনের ময়লা কেটে যায়, শরীরটাও চনমনে হয়ে ওঠে। বলরে, নিতাই!

জিভ কেটে রঘুর বউ ঘরে ঢুকে যায়।

নিতাই এখন সেয়ানা হয়েছে। কোমরে হাত দিয়ে রঘুকে বলে, আমাকে দিয়ে মেহনত করাবে তো বাপ! তোমার চালাকি জানি। তুমি হচ্ছ সেই স্যাকরা যে নিজের মায়ের সোনা চুরি করে। আগে বলল চা খাওয়াবে, তবে বলব।

খাওয়াব।–রঘু বলল। তারপর সামনের একটা মস্ত জামরুল গাছের তলায় গিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বলল, শুরু করে দে।

নিতাই অমনি শুরু করল, তুমি শালা শুয়োরের বাচ্চা…

এমন মুখ চোটাল নিতাই যে রাজমিস্ত্রিরা পর্যন্ত কাজ থামিয়ে হাঁ করে শুনছিল। বাপ-মা চৌদ্দপুরুষ ধরে সে কী গালাগাল! রঘু চোখ বুজে বসে মাথা নাড়ে আর মিটিমিটি হাসে। মাঝে মাঝে বলে ওঠে, হোত আচ্ছা। চালাও।

নিতাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। আবার চনমনে হয়ে রঘুর বউ মেয়ে থেকে শুরু করে মা মাসির কেচ্ছা গাইতে শুরু করে দিল।

আধ ঘণ্টাখানেক ঝিম ধরে বসে শুনল রঘু।

ঠোঁটের কোণে ফেনা তুলে নিতাই থেমে দম নিতে নিতে বলল, এবার চা খাওয়াও মাইরি। রোজ রোজ বিনিমাগনা তোমার ভূত ঝেড়ে দিই, কিছু চেয়েছি কখনও?

রঘু তার মেয়েকে ডেকে নিতাইকে চা দিতে বলে দেয়। ফুড়ুক ফুড়ুক হাসছে রঘু। একটু আগের ম্যাড়ম্যাড়ে চেহারাটায় এখন যেন একটু জলুস খুলেছে। বলল, আহা, কী শোনালি রে নিতাই! এমন বহুকাল শুনিনি।

এক গ্লাস চা রোজগার করে ভারী খুশি হয় নিতাই। গাছের তলায় বসে রক্তাম্বরে পেঁচিয়ে গরম পেতলের গ্লাসটা ধরেছে সাপটে। ইস্পাত মাঝে মাঝে কোলে লাফিয়ে উঠে গ্লাসের গন্ধ শুকছে।

রঘু মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে দেখতে বলে, ও বাড়ির খবরটবর আছে নাকি রে কিছু?

নিতাই উদাস গলায় বলে, খবর আর কী? বাবু আর গিন্নির মুখ দেখাদেখি নেই।

সে তো পুরনো কেচ্ছা।

আজ এইমাত্র একটা নতুন ছোকরা এসে ঢুকল। কাঁধে ব্যাগ। দেখে মনে হয়, বাড়িতে সেঁধিয়ে গেল পাকাপাকি। ছোট মামাবাবুর আসার কথা ছিল। বোধহয় সে-ই।

মামাবাবু কাকাবাবু অনেক আসবে এখন। নরক গুলজার হবে। চোখ কান খোলা রাখিস। কাল রাতে বাবু বাড়ি ফিরেছিল?

ফিরেছিল।

কদিন ফিরছে না খেয়াল রাখিস।

চায়ে চিনি কম হয়েছে রঘুবাবু। তোমার মেয়েকে একটু চিনি দিয়ে যেতে বলো।

চিনি সস্তা দেখলি? এক ডেলা গুড় নে বরং।

তাই দাও। হাত আসুক।

এক জায়গায় বসে থাকলে নিতাইয়ের কাজ চলে না। গুড়ের ডেলাটা মুড়ির কোঁচড়ে ভরে চা-টা তলানি পর্যন্ত খেয়ে উঠে পড়ল নিতাই।

পথে নামতেই মুখোমুখি কালো এবং গম্ভীর প্রকৃতির মদন ঠিকাদারের সামনে পড়ে গেল। এ লোকটাকে কেন যেন একটু ভয় খায় নিতাই। মাঝে মাঝে মদনকেও বাণ মারে সে।

মদন ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলে, এতক্ষণ ওসব অসভ্য কথা বলে কাকে গালাগালি করছিলি?

তা আমি কী করব? স্যাকরা শুনতে চায় যে।

শখ করে কেউ গালাগাল শোনে?

শোনে কি না রঘুকেই জিজ্ঞেস করে না! দেখা হলেই আমাকে খোঁচায় বলার জন্য।

মিছে কথা বলবি তো মুখ ভেঙে দেব।

বলতে বলতে মদন ঘুসি পাকিয়ে এক পা এগোতেই ভারী আত্মসম্মানে ঘা লাগে নিতাইয়ের। এটা কেমন কথা যে, যার তার হাতে সে বরাবর মারধর খাবে, আর অপমান সহ্য করবে?

নিতাই দু পা পিছিয়ে গেল বটে, কিন্তু আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল, খবরদার মদন! বদন বিগড়ে দেব কিন্তু।

কিন্তু মদটা চিরকেলে ডাকাবুকো। লাফিয়ে এসে এক খামচায় জটা ধরে ফেলল। নিতাই দেখল, গায়ের জোরে পারবে না। টানতে গেলে জটাও ছিড়বে। সুতরাং সে দু’হাত ওপরে তুলে নাচতে নাচতে বিকট সুরে চেঁচাতে থাকে, ব্যোম কালী! ব্যোম কালী! মহাকালী প্রলয়ংকরী! ভাসিয়ে দে মা! ড়ুবিয়ে দে মা! জ্বালিয়ে দে মা! কানা করে দে। ঠ্যাং ভেঙে দে। শেষ করে দে মা!

মদন ঠিকাদার কালী দুর্গা মারণ উচাটনে বিশ্বাসী নয়। নিতাইয়ের জটা আর দাড়ির কিছু ক্ষয়ক্ষতি হল। মদনের কিলগুলো সাংঘাতিক, চড়ও ভয়ংকর। ফলে নিতাইয়ের কষের দাঁতের গোড়া টনটন করতে লাগল, মাজায় বিষফেঁড়ার যন্ত্রণা। আরও ব্যথা পেত, কেবল নাচানাচির ফলে মদন তেমন জমিয়ে মারতে পারেনি বলে।

মার দেখতে কিছু লোক জুটে গিয়েছিল। শেষমেশ তাদের মধ্যেই দু-একজন এসে ছাড়িয়ে দিল। মদন শাসিয়ে গেল, শ্রীনাথের ছেলেকে তুইই তা হলে অসভ্য গালাগাল শেখাচ্ছিস। কোনওদিন আর মুখ খারাপ করতে শুনলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব।

মদন চলে গেলে হি হি করে হাসে নিতাই খ্যাপা। সকলের দিকে চেয়ে বলে, লাগেনি মোটেই। বাহুবন্ধ বাণ চালিয়ে দিয়েছিলাম তো, মদনের হাতে আর শক্তি ছিল না। মারগুলো যেন বাতাসে। ভেসে গেল।

মুখে যাই বলুক, নিতাইয়ের চুলের গোড়া থেকে মাজা পর্যন্ত জ্বালা আর ব্যথা করছে খুব। ভাল করে হাটতে পারছে না। দিনটা ভাল করে গড়ায়নি, এর মধ্যেই যে যার বরাদ্দ তুলে নিচ্ছে। বিড়বিড় করে নিতাই বলতে থাকে, একটাই তো নিতাই বাপ, রয়েসয়ে মারলেই হয়। এই নিতাই হিমালয়ে চলে গেলে কেরানিটা কার ওপর দেখাবে।

মদন শালা লোকও অদ্ভুত। মল্লিবাবুর সে ছিল জিগির দোস্ত। দু’জনের একই সঙ্গে খানাপিনা, একই মেয়েমানুষের কাছে যাতায়াত। মদন ঠিকাদার ছাড়া মল্লিনাথ কারুকে চোখেও দেখতে পেত না। আর মদন ছিল মল্লিনাথের পোষা জীব, এই যেমন ইস্পাত হল খ্যাপা নিতাইয়ের। মল্লিনাথেরও এরকম হঠাৎ হঠাৎ রাগের পারদ লাফিয়ে একশো দশ ডিগ্রিতে উঠে যেত। মল্লিবাবু কত লোককে যে ঠেঙিয়েছে! কিন্তু মদন ঠিকাদার নিজে কখনও মারপিট করত না। তার হয়ে মারপিট করার লোক আছে। কিন্তু আজ হঠাৎ মদনার কী যে হল! নিতাই সহসা বাড়ি ফিরতে সাহস পেল না। মদন যদি গিন্নিমার কাছে গিয়ে লাগিয়ে থাকে যে, সে সজলখোকাকে খারাপ কথা শেখায়?

আসলে দোষ তো নিতাইয়ের নয়। সজলখোকাবাবু নিজেই এসে শিখতে চায় যে। খারাপ কথা শুনলে খুব খুশি হয়, হেসে গড়িয়ে পড়ে। এই যেমন রঘু স্যাকরা। নিতাইয়ের তা হলে দোষটা হল কোথায়?

নদী পেরিয়ে গোরুবাথানের জঙ্গলে গিয়ে ইস্পাতকে নিয়ে অনেক ঘোরাফেরার পর বেলা গড়িয়ে নিতাই ফিরে আসে। কোঁচড়ের মুড়ি যেমন কে তেমন থেকে নিউড়ে গেছে। গুড়ের ডেলাটা বের করে খেয়ে জল খেল নিতাই। তারপর কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

টের পেল, জ্বর আসছে। ব্যথার তারসে আসে ওরকম। শুয়ে শুয়ে সে পুতুলরাণীর কথা ভাবে।

ভারী নাকি মোটাসোটা হয়েছে। তা হলে দেখতে এখন ভালই লাগে নিশ্চয়ই। মহাকালী ভয়ংকরী! শক্তি দে মা। শক্তি দে। মন্ত্রের জোর দে।

যন্ত্রণায় পাশ ফিরে শোয় নিতাই। হিমালয়ে যেতেই হবে। আসল বিদ্যে শিখে আসতে হবে।

০৭. প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়

প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়, যখন সূর্য ওঠে না, যখন চারদিক এক ভুতুড়ে আবছায়ায় নিঃঝুম হয়ে পড়ে থাকে। তখনই কি প্রথম ঘুম ভাঙে প্রীতমের? তা তো নয়। সারারাত আরও বহুবার ঘুম ভেঙে যায় তার। খুব তুচ্ছ সব কারণে। কখনও রান্নাঘরের এঁটো বাসনে ধেড়ে ইঁদুরের শব্দ, আরশোলার পাখার আওয়াজ, কখনওবা নিছকই স্বপ্ন দেখে, কখনও এমনিই।

ঘুম ভাঙলেই বড় একা। ভীষণ একা। পাশের ঘরে এক খাটে বিলু আর লাবু, খাওয়ার ঘরের মেঝেয় বিন্দু নামে নতুন কিশোরী ঝি। তাদের ঘুম খুব গাঢ়। প্রীতমের কোনওদিনই গাঢ় ঘুম ছিল না। আর বরাবরই সে ঘুম ভেঙে একাকিত্বকে হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় মজ্জায় টের পেয়েছে।

এখন প্রীতম আরও একা। সামান্য সর্দিজ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলেও বরাবর বিলু ছোয়াচ বাঁচিয়ে চলেছে প্রীতমের। এখন দীর্ঘ রোগভোগের কালবেলা চলছে। এখন তার নিরেট নিচ্ছিদ্র একা থাকা, একা হয়ে যাওয়া।

কিন্তু মনকে দুর্বল হতে দেয় না প্রীতম। জানে, একবার ভয়কে প্রশ্রয় দিলে আর পরিত্রাণ নেই। মৃত্যুর চেয়েও বহুগুণ ভয়ংকর মৃত্যুভয় ধারেকাছে তরুণ উৎসাহী চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করে আছে। প্রীতম তার অন্ধকার নড়াচড়া চোখের নীল আগুন সব টের পায়, দেখতে পায় তার শরীরের কটাশে ছাপচকর। এক মুহূর্তে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভাব দেখলেই লাফিয়ে পড়বে।

ঘুম ভাঙলে তাই প্রীতম একা বোধ করা থেকে নিজের পরিত্রাণ খুঁজছিল প্রাণপণে। সে জানে তার বহু বহু দুর পরিধির মধ্যেও কোনও মানুষ নেই। বউ না, আত্মীয় না, ডাক্তার বা বন্ধুও না। সে একা, আর তার শরীরের অজস্র জীবাণু।

এইসব রহস্যময় জীবাণু কীরকম, কোথা থেকে এল তা জঁহাবাজ ডাক্তারেরাও জানে না। তারা শুধু জানে হাড়ে-মজ্জায় কোনও গোপন অদ্ভুত রন্ধ্রপথে জীবাণুরা দিনরাত অবিরাম কাজ করে চলেছে।

একদিন তারা মেরুদণ্ডের হাড়ের জোড়গুলি পেরিয়ে মগজে পৌঁছে যাবে। আজও অবশ্য ততদূরে পৌঁছয়নি তারা। প্রীতমের চিন্তাশক্তি আজও পরিষ্কার। থট প্রসেসে কোনও গোলমাল নেই। মাঝে মাঝে সে এখনও জটিল কুটিল সব এন্ট্রি দু’বার না ভেবেই করতে পারে। হায়ার অ্যাকাউন্টেন্সির কয়েকটা বই তার শিয়রের কাছে থাকে, সব সময়ে পাশে খাতা, ডটপেন।

তবু প্রীতম জাগে এবং কিছুক্ষণ একা বোধ করে। এই বোধের সঙ্গে তার লড়াই চলছে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে। প্রায় হারতে হারতেও লড়াইটা টিকিয়ে রেখেছে সে। বাঘের চোখ বোজ অন্ধকারে দপ দপ করে জ্বলে উঠে তাকে দেখে নেয়।

কিন্তু এক বিপুল গভীর অন্ধকারের বাঁধভাঙা স্রোত জানালা দরজার সব রন্ধ্রপথ দিয়ে হুড়হুড় করে ঘরে ঢুকে আসে। বর্ণ গন্ধ আকারহীন সে এক নিষ্ঠুর অন্ধকারের বিপুল সমুদ্র। এই আবছা ভোরে ভয় ভয় করে। কাছে এগিয়ে আসে কি বৈতরণী? প্রীতম তখন খুব খেলোয়াড়ের মতো চোখ বুজে নিজের শরীরের ভিতরে চিরজাগ্রত অবিরাম ক্রিয়াশীল নিদ্রা ও বিশ্রামহীন জীবাণুদেরই ডাকতে থাকে। বলে, তোমরা তো আছ। তোমরা তো আছ! আমি তো একা নই! মৃত্যু পর্যন্ত তোমরা তো থাকবেই সঙ্গে। তারপর একসঙ্গেই মরণ আমাদের।

কথাটা কতদূর ঠিক কে জানে। তবে প্রীতম টের পায় যখনই সে ডাকে তখনই শরীরের ভিতরে ঝাকে ঝাকে কী যেন জেগে ওঠে, সাড়া দেয়। সে কেমন? যেন শরীরের ভিতরে ভিতরে এক রোমাঞ্চ, এক সচেতনতা, এক চনমনে ভাব।

তখন নিশ্চিন্ত হয় প্রীতম। একা কথা বলছে দেখলে বিলু হয়তো তাকে পাগল ভাববে। কিন্তু মাঝরাতে বা খুব ভোরের বেলায় কেউ তাকে দেখার জন্য জেগে থাকে না। তাই প্রীতম একা একা কথা বলে, তোমাদের দোষ নেই। তোমাদের কাজ তোমরা করছ মাত্র। জীবাণুরাই কি শুধু মারে মানুষকে? মানুষ নিজেও কি মারে না? কষ্ট দেয় না? তোমাদের তা হলে দোষ কী বলো? আমার। তাতে কোনও দুঃখ নেই। শরীরটাই তো শুধু আমি নয়। এই হাত, এই পা, এই চোখ, কান, এগুলো আলাদাভাবে কোনওটাই তো আমি নয়। তবে আমি কেন তোমাদের শত্রু ভাবব? তোমরা একটা বাসা দখল করেছ মাত্র, তোমরা জোগাড় করছ বেঁচে থাকার রসদ। অন্যায় ভাবেও তো নয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষও তো কত কী করে। তবু বলি, আমাকে তোমরা ছুঁতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কী করে পারবে? দেহটাই তো আর আমি নয়। এর ভিতরেই কোথাও আছে আর-এক আমি, তাকে স্পর্শ করা যায় না।

খুবই আন্তরিকভাবে কথাগুলি বলে প্রীতম। আর তখন তার পুবের জানালার অন্ধকার ক্রমে ফ্যাকাসে হতে থাকে। ভবানীপুরের এই গলির মধ্যে সরাসরি জানালার ওপর সূর্যের আলো এসে পড়ে না প্রথমেই। একটু সময় নেয়। ততক্ষণ এবং যতক্ষণ বিলু না ওঠে এবং চতুর্দিকের কাজকর্ম যতক্ষণ না শুরু হয় ততক্ষণ ঠোঁট অবিরাম নড়ে যায় প্রীতমের। ততক্ষণে সে এক ভয়াবহ লড়াই চালিয়ে যায়। এবং টিকে থাকে একের পর এক দিন।

একটা দিনের বাড়তি আয়ু পাওয়া, আর-একটা দিনের সূর্যের আলো দেখাই কি এখন যথেষ্ট বেশি আহ্লাদের বিষয় নয়?

তাই সকালের দিকে প্রীতম ক্লান্ত থাকলেও মনটা একরকম শক্ত সমর্থ রয়ে যায়। চোখ বুজে সে মৃদু মৃদু একটু হাসতেও থাকে। যতক্ষণ না বিলু এসে মশারি তুলে উঁকি দেয়।

মাঝে মাঝে মশারির মধ্যে এক-আধটা মশার গুনগুন শুনে মাঝরাতে চোখ মেলে চায় প্রীতম। খুব কান পেতে শোনে। বেড় সুইচ টিপে আলোও জ্বালায়। অবশ্যই মশা মারবার জন্য নয়। সে সাধ্য তার নেই। হাঁটু গেড়ে বসো, সাবধানে মশাটাকে খুঁজে বের করো, সেটাকে কোথাও নিশ্চিন্তে বসতে দাও, তারপর এগিয়ে গিয়ে দু হাতে চটাস করে মারো। না, এতসব প্রীতমের কাছে বিরাট বিরাট কাজ। মারবার কথা তার মনেও হয় না।

ঘুম ভেঙে সে মশারির মধ্যে কোনও মশার অস্তিত্ব টের পেলে চুপ করে শব্দ শোনে, তারপর ফিসফিস করে বলতে থাকে, তোমরা অন্য জগতের। তোমরা এক চিন্তাশূন্য কর্তব্যের জগৎ থেকে আসা জীব। সূখীও নও, দুঃখীও নও। জেগে থাকো, আমার সঙ্গে জেগে থাকো।

বিলু মশারি তুলে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি জেগেছ?

হুঁ।

বাথরুমে যাবে এখন?

একটু পরে।

পরে আবার কেন? এখনই সেরে নাও। গরম জল বসিয়ে এসেছি। ওঠো।

বলে হাত বাড়িয়ে পাঁজাকোলা করে প্রীতমকে বসায় বিলু। প্রীতম তখন বিলুর শরীরে বাসি জামাকাপড়ের গন্ধ পায়। বিলুর শরীরে কোনও উৎকট গন্ধ নেই। গ্রীষ্মকালেও বিলুর ঘাম হয় না। তবু সব শরীরেই যেমন একটা না একটা গন্ধ থাকে তেমনি বিলুরও আছে। প্রীতম গন্ধটা ভালই বাসে।

দাঁড় করানোর সময় বিলুর মুখ প্রীতমের মুখের কাছাকাছি এসেছিল। বিলু বলল, আজ ভাল করে তোমার পঁত মেজে দিতে হবে। মুখে দুর্গন্ধ হচ্ছে।

দাঁড়ানোটা ভারী কষ্টকর প্রীতমের কাছে। তবু এখনও বিলুর ওপর শরীরের পুরো ভর ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াতে পারছে। বিলু বলল, কতবার বলি বাথরুমে যাওয়ার দরকার নেই। বিছানাতেই তো

প্লাস্টিকের গামলায় মুখ ধোওয়া যায়।

আমার ঘেন্না করে।

ঘেন্না করলে চলবে কেন? যেমন অবস্থা তেমনি তো ব্যবস্থা হবে।

এখনও পারছি।

কষ্টও হয় তো!–বিলু বলল।

আমার চেয়ে তোমার কষ্টই বেশি।

আমার কষ্ট! আমার আবার কষ্ট কী!

সকালের দিকে বিলুর মন ভাল থাকে। এই সময়টায় বিলুর শরীরটা যেন মায়ের শরীরের মতো নতা ও সুঘ্রাণে ভরা থাকে।

বিলুর শরীরে ভর দিয়ে হাঁটি হাঁটি পা-পা করে বাথরুমে যায় প্রীতম। বিলু খুবই সাবধানে তার বগলের নীচে কাঁধ দিয়ে, কোমরে হাত জড়িয়ে ধরে থাকে তাকে।

বাথরুমে বাচ্চা ছেলের মতো তাকে ধরে থেকে হিসি করায়, তারপর একটা বেতের চেয়ারে বসিয়ে মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে গুঁড়ো মাজনে আঙুল দিয়ে খুব যত্নে তার দাঁত মেজে দেয়। কোষে জল নিয়ে কুলকুচো করায়।

এসব করতে করতেই বলে, আজ স্নান করাব তোমাকে।

ভাল লাগে না। বড্ড ঝামেলা।

স্নান না করলে শরীর কষে যাবে।

আজকের দিনটা থাক।

রোজই তো থাকছে। ডাক্তার বলেছে সপ্তাহে তিন দিন স্নান করাতে।

আবার ধরে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে চিরুনিতে চুল পাট করে দেয়। বাসি জামাকাপড় বদলে দেয়। বিছানার চাদর, বালিশের তোয়ালে পালটে দেয়। বোজই চাদর আর তোয়ালে পালটানো হয়, ডেটল-জলে কাচা হয়। বেডসোর যাতে হতে না পারে তার জন্য পিঠে সযত্নে একটা ওষুধ দেওয়া পাউডার ছড়িয়ে দেয়।

এইসব প্রাতঃকৃত্যের পর শরীরের ভার অনেক কমে যায় প্রীতমের। বিলু তাকে সকালের ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে জামার ওপর গরম সোয়েটার পরিয়ে দেয়, হালকা শাল টেনে দেয় গলা অবধি।

তারপর বিছানায় হাত রেখে মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, আজ কী খাবে?

এই সময়ে রোজ প্রীতমের মনে হয় বিলু এখন খুব আলতো আমাকে চুমু খেলে কত ভাল হত! এরকম অবস্থায় খাওয়াই তো নিয়ম। খাবে কি?

কিন্তু বিলু কখনওই তা করে না। প্রীতমও কোনওদিন এরকম কোনও প্রস্তাব মুখ ফুটে করতে পারেনি।

প্রীতম বলে, যা খেতে দেবে তাই খাব।

কোনও বায়না নেই তো?

প্রীতম স্নিগ্ধ হেসে বলে, না। কোনওদিন বায়না করেছি? বলো!

বিলু হাসে না। ভ্রু কুঁচকে কেমন একটু আনমনা হয়ে যায়। আর ঠিক এই সময় প্রীতমের মনে হতে থাকে, এবার বিলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। নিশ্চয়ই ফেলবে।

কিন্তু বিলুর দীর্ঘশ্বাস নেই। কোনওদিনই দীর্ঘশ্বাস ফেলে না বিলু।

প্রীতম বলে, আজকাল ডিমে বড় আঁশটে গন্ধ লাগে। আজ আমি ডিম খাব না।

এই তো বায়না করছ! করো না বলে?

এটা তো না খাওয়ার বায়না। একে বায়না বলে না।

এটাও বায়না।—বিলু বলল, কিন্তু হাসল না। অথচ এরকম কথায় একটু হাসাটাই কি নিয়ম নয়?

বিলু বলল, ঠিক আছে, মাখন দিয়ে ডিমের পোচ করে দিচ্ছি, তা হলে অতটা আঁশটে গন্ধ লাগবে না।

দাও। আর জানালার কাছে ইজিচেয়ারটা পেতে দাও। একটু বাইরেটা দেখি।

বিলু লোহার ইজিচেয়ারটা পেতে দেয়, ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বসায়, সযত্নে গলা পর্যন্ত চাপা দিয়ে দেয়।

প্রীতম বিলুর দিকে চেয়ে বলে, সকালে উঠে রোজ একটু ফিটফাট হয়ে নাও না কেন? চুল উড়ছে, সিদুর লেপটে আছে, ওরকম চেহারা দেখতে কি ভাল?

আমার এখন সাজবারই সময় কিনা!

প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বলে, কেন? তোমার কি দুঃসময় চলছে?

তবে কি সুসময়?

তাও নয়। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি সব হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছ।

বিলু মৃদু স্বরে আত্মবিশ্বাসহীন গলায় বলে, হাল ছাড়ার কী আছে! ঘরে রুগি থাকলে কার সাজতে ইচ্ছে করে বলো তো!

প্রীতম ঘুনঘুনে নেই-আঁকড়া স্বরে বলে, না, ওরকম দেখতে ভাল লাগে না। ওভাবে কখনও আমার সামনে এসো না। আমার খারাপ লাগে।

আচ্ছা।-বলে বিল চলে যায়।

জানালা দিয়ে কিছুই দেখার নেই প্রীতমের। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে রাস্তা দেখা যায় না। শুধু কয়েকটা বাড়ির তিন বা চারতলা আর আকাশ দেখা যায়। কিন্তু প্রীতমের কোনও অন্যমনস্কতা নেই। যেটুকু দেখে সেটুকুই যথাসাধ্য চেতনা আর প্রখর অনুভূতি দিয়ে গ্রহণ করে অভ্যন্তরে।

বিলু খাবার নিয়ে আসে। প্রীতমের গলায় বাচ্চাদের মতো একটা ন্যাপকিনের বিপ বেঁধে দেয়। তারপর পাশে একটা টুলে বসে আস্তে আস্তে খাইয়ে দেয় তাকে। খাওয়া জিনিসটা বরাবরই প্রীতমের কাছে খুব বিরক্তিকর ছিল। খেতে হবে বলেই তার খাওয়া। বরাবর সে খায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং খুব তাড়াতাড়ি। বিলু এখন তা হতে দেয় না। প্রীতমও বুঝেছে খাওয়াটা খুবই জরুরি ব্যাপার। যদি বেঁচে থাকতে হয়, যদি লড়াই চালাতে হয়, তবে যথেষ্ট রসদের দরকার।

প্রীতম মুখ ফিরিয়ে বলে, আজকাল আমার খাওয়া কি খুব বেড়ে গেছে বিলু?

অন্য বউ হলে বলত, ছিঃ ছিঃ, ওসব কথা কি বলতে আছে? বিলু গম্ভীর মুখে বলল, আরও একটু বাড়লে ভাল হয়।

প্রীতম লক্ষ করল, বিলুর চুল এখনও রুক্ষ, এলোমেলো, কপালে সিঁদুর লেপটানো। এ নিয়ে আর বলতে গেলে সকালের নরম-সরম বিলু আর নরম-সরম থাকবে না। রেগে যাবে, ঠান্ডা কঠিন এক ব্যবহার দিয়ে সারাদিন প্রতিবাদ জানিয়ে যাবে।

খাওয়া শেষ হলে প্রীতম মুখ তুলে ফের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। ও-ঘরে লাবু ঘুম ভেঙে মাকে ডাকতে থাকে, মা! ও মা! মা! ও মা! মা! ও মা! ঠিক নামতা পড়ার মতো। বিলু বোধহয় বাথরুমে। সাড়া দিচ্ছে না। কিন্তু যতক্ষণ না সাড়া দেবে ততক্ষণ এক সুরে, এক গলায় একঘেয়ে ডেকেই যাবে লাবু।

মেয়েকে পারতপক্ষে ডাকে না প্রীতম। বড় মায়া। এই বাসায় এই এক পুকুর ভালবাসার ড়ুবজল অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। বড় গভীর জল। একবার পা বাড়ালে তলিয়ে যেতে হবে। এখন ভালবাসায় ভেসে যেতে নেই। মন নরম হবে, মৃত্যুভয় এসে যাবে তবে। প্রীতম তাই কান কাড়া করে মেয়ের ডাক শোনে, কিন্তু নিজে তাকে ডাকে না বা সাড়াও দেয় না। লাবুর সঙ্গে তার এখন আড়ি।

ঝি-টা বাড়িতে নেই, দোকানে গেছে। প্রীতম লাবুর ওই অবিকল পাখির স্বরের ডাক সইতে পারছে না। ছটফট করে ভিতরটা। আপনা থেকেই শরীরটা দাঁড়িয়ে পড়তে চায়। সরু হাত তুলে সে কপাল টিপে ধরার এক অক্ষম চেষ্টা করে।

বাথরুম থেকে বন্ধ দরজা ভেদ করে বিলুর ক্ষীণ স্বর এল এই সময়ে, আসছি-ই।

লাবু শোনে এবং চুপ করে। মেয়েটা কেমন একরকম হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে চায় না। সারাদিন খাওয়া নিয়ে বিলু ওকে মারে, বকে। বিলুকে ভয়ও পায় ভীষণ, আবার অবাধ্যতাও করে যায় অনবরত। মার খেলে মায়ের কাছ থেকে সরে যায় না, পালায় না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অসহায় ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে।

যত ভাববে তত মায়ার পলি জমবে মনের মধ্যে। তাই প্রাণপণে নিজের অনুভূতির অন্য জগৎ জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে প্রীতম। আগে উদাস ছিল প্রীতম, এখন সে অনেক অনুভূতিপ্রবণ হয়েছে। কীটপতঙ্গ জীবাণুদের জগৎকে সে আজকাল স্পষ্ট টের পায়। বাড়িময় যেসব আরশোলা ওড়ে, যে একটা-দুটো ইঁদুর বা ছুঁচো আনাগোনা করে তাদের গতিবিধি, সময়জ্ঞান ও চরিত্র সম্পর্কে সে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে ইদানীং। একটা দুধের শিশু বেড়াল অনেক তাড়া খেয়েও এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে নাছোড়বান্দা হয়ে ঘুরে বেড়াত। তাকে দু চোখে দেখতে পারত না প্রীতম। এখন সেই বেড়ালটা বড় হয়েছে। সারাদিন পাড়া বেড়ায়, কিন্তু মাঝে মাঝে এসে প্রীতমকে দেখা দিয়ে যায় ঠিকই। আর রোজ রাতে নিয়মিত এসে প্রীতমের খাটের তলায় শুয়ে থাকে। কখন শুতে আসবে বেড়ালটা, তার জন্য ঘুমের আগে উন্মুখ হয়ে থাকে প্রীতম, এলে নিশ্চিন্ত হয়।

মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে তার তো কোনও বাঁধাধরা ছক নেই। প্রীতম এইভাবে বেঁচে আছে, সুতরাং যতদূর সম্ভব এই বাচাটাকে সে সইয়ে নেয়। খুব কঠিন কাজ কিন্তু প্রীতমকে পারতেই হবে।

লাবু ছিল তার প্রাণ। যতক্ষণ বাসায় থাকত প্রীতম ততক্ষণ লাবু এঁটুলির মতো লেগে থাকত তার সঙ্গে। মেয়ের প্রতি তার ভালবাসা ছিল একবুক তেষ্টার মতো, সহজে মিটতে চাইত না। মেয়েকে ছুঁয়ে না থাকলে রাতে ঘুমোত পারত না প্রীতম। অসুখ হওয়ার পর বিলু লাবুকে সরিয়ে নিয়েছে। সরিয়ে নেওয়া নয়, যেন ছিড়ে নেওয়া। প্রথমদিকে লাবুকে ছাড়া খাঁ খাঁ শুন্য লাগত বুক। তারপর সয়েও গেছে। আগে আগে লাবু বাবার কাছে আসতে না পারায় ভীষণ কাঁদত, নিষেধ। মানতে চাইত না, ফাঁক পেলেই এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত কোলে। কিন্তু ক্রমে সেও দুরত্ব রক্ষা করে চলতে শিখল তো! পারতপক্ষে প্রীতমও আর মেয়েকে ডাকে না, কথা বলে না। তাও সইল তার।

বিলুর সঙ্গে বরাবরই একটু দূরত্ব ছিল প্রীতমের। ঝগড়াঝাটি নয়, মন কষাকষিও নয়, ঠান্ডা লড়াইও বলা যায় না। তবে বিলু একটু অন্যরকম, কোনওদিনই প্রীতমের কাছে নিজের মনটা সবটুকু খুলে দেয়নি সে। বিয়ের পর প্রথম ভাব হলে মানুষ কত আগড়ুম বাগড়ম বলে, কত তুচ্ছ কথার পাহাড় বানায়। বিলু কোনওদিন সেরকম ছিল না। কথা বরাবর কম বলত। কিন্তু একথাও বলা যাবে না যে, বিলুর প্রীতমের প্রতি ভালবাসা নেই। বললে খুব মিথ্যে বলা হবে, ভুল বলা হবে। গড়পড়তা বাঙালি বউরা যা করে বিলু তার চেয়ে একরত্তি কম করে না তার জন্য। কিন্তু তার ওই সেবার মধ্যে কোথায় যেন দক্ষ নার্সের পটুত্ব আছে, কোনও আবেগ নেই। অন্য কারও স্বামীর এরকম শক্ত অসুখ হলে চোদ্দোবার কেঁদে ভাসাত, বিলু একদিনও চোখের জল ফেলেনি। কিন্তু যারা কেঁদে ভাসায় তারাও হয়তো ওষুধ দিতে এক-আধবার ভুল করে, রুগির সেবা করতে করতে হয়তোবা কখনও বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলে। বিলুর সেরকম ভুল হয় না, বিরক্তির প্রকাশও তার নেই। তবে বিলুর মুখ সর্বদাই গম্ভীর, বিষণ্ণ। যে স্থায়ী বিরক্তির ছাপ বিলুর মুখে আছে তার সঙ্গে প্রীতমের অসুখের কোনও সম্পর্ক নেই।

বিয়ের আগে বিলুর সঙ্গে ভাব ছিল না প্রীতমের। তবে শিলিগুড়িতে বিলু মাঝে মাঝে তার পিসির বাড়ি বেড়াতে যেত। তখন দেখেছে। বিলুর হাতে কখনও এক গ্লাস জল বা এক কাপ চা খেয়েছে প্রীতম। দুটো-চারটে কথাবার্তাও হত তখন। পরে সেই পিসিই বিয়ের সম্বন্ধ আনে এবং বিয়ে হয়েও যায়। মনে আছে, প্রথম রাত্রে বিলু তাকে বলেছিল, তুমি খুব শান্ত স্বভাবের। আমার শান্ত মানুষ খুব ভাল লাগে।

এটা কি ভালবাসার কথা নয়?

আজকাল ঘরবন্দি প্রীতম প্রায়ই ভালবাসার কথা ভাবে। কিন্তু ভালবাসার কথা ভাবলে কখনওই তার বিলুর মুখ মনে পড়ে না, কী আশ্চর্য! মনে পড়ে বনগন্ধ ভরা শিলিগুড়ির মাঠঘাট, আকাশ উপুড় করা শীতের ঢালাও রোদ, নীলবর্ণ মেঘের মতো দিগন্তে ঘনীভূত পাহাড়, মহানন্দার সাদা চর, মনে পড়ে তাদের ভরা সংসারের কলরোল। ভালবাসা ছিল ঝুমকো ভোরে ফুল চুরি করতে যাওয়ায়, ভালবাসা মাখা থাকত জোহা চালের ফেনা ভাতে গলে-যাওয়া ঘিয়ের গন্ধে, হাইস্কুলের নরেশ মাস্টার মশাইয়ের বিজবিজে কাঁচাপাকা দাড়িওলা মুখে ভালবাসার নিবিড় একটা ছায়া দেখেনি কী? প্রীতম, শতম, রূপম আর মরম এই চার ভাইয়ের মধ্যে ছিল অবিরাম খুনোখুনি ঝগড়া, বিছানায় বালিশকে গদা বানিয়ে প্রবল মারপিট, খাওয়া নিয়ে, খেলা নিয়ে, জামাকাপড় নিয়ে বরাবর রেষারেষি। এখন মনে হয় তার মধ্যেই ভালবাসার কীট গোপনে গোপনে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এর হৃদয়ের সঙ্গে ওর হৃদয়ের পথ করে দিয়েছিল। আর মা? বাবা? কোনওদিন তারা কেউ তো মুখ ফুটে বলেনি, প্রীতম তোকে বড় ভালবাসি। কিংবা, তুই বড় ভাল ছেলে। জ্ঞান বয়সে তাদের মুখে কখনও আদরের কথা শোনেনি প্রীতম, তবু সেই বাড়ি বুকসমান ভালবাসার জলে ছিল আধোবা। চিরদিনই কলকাতা ছিল প্রীতমের কাছে নিষ্ঠুর প্রবাস। আজও তাই আছে। ভবানীপুরের এই ফ্ল্যাটটা তার কাছে নিতান্তই এক বাসাবাড়ি, মেসবাড়ির মতো, হাসপাতালের মতো একটা নিরাপদ আশ্রয় মাত্র। এখানে ড়ুবজলে স্নান নেই।

যখনই শিলিগুড়ির কথা, ভালবাসার কথা মনে পড়ে তখনই বুকের মধ্যে নাটবল্ট ঢিলে হয়ে একটা কপাট যেন ভেঙে পড়তে চায়। ভারী ঘুঘুনে এক নেই-আঁকড়া ভাব আসে মনে, শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছে জাগে। সেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয় না প্রীতম। কাগজ খাতা ডটপেন নিয়ে অঙ্কে ড়ুবে যাওয়ার চেষ্টা করে।

আচমকাই কলিং বেল বেজে ওঠে রি-রি করে।

প্রীতম তখনও আনমনে ভালবাসার কথাই ভাবছে। ভাবছে, তুমি কি অকৃতজ্ঞ নও প্রীতম? বিলু কি তোমার জন্য নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছে না? দিচ্ছে তো? শুধু সকালে মুখের কাছে মুখ এনেও চুমু খায়নি বলেই কি এ বাড়িতে ভালবাসা নেই? এ কেমন ইল্লতে কথা?

কে গিয়ে দরজা খুলে দিল সদরের। হঠাৎ একটা আফটার-শেভ লোশনের সুগন্ধে ভরে গেল। শুধু আফটার-শেভ নয়, সঙ্গে হয়তো আরও কোনও সুগন্ধ আছে।

এ গন্ধ চেনা প্রীতমের। মুখে হাসি নিয়ে চোখ তুলে সে বলল, আসুন।

আজ ভালই আছেন মনে হচ্ছে! নইলে এই সাতসকালে কেউ কি অ্যাকাউন্টস নিয়ে বসে? বলতে বলতে অরুণ ইজিচেয়ার টেনে এনে বসে।

প্রীতম লক্ষ করল, অরুণ জুতোসুষ্ঠু ঘরে ঢুকেছে। প্রীতম এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না কখনও। কিন্তু বিলু পারে। অরুণের এ ধরনের ভুল প্রায়ই হয় এবং বিলু বকলে ফের গিয়ে জুতো ছেড়ে আসে। আজও বিলু ওকে বকবে ঠিক।

প্রীতম কিছুতেই অরুণের জুতোজোড়া থেকে চোখ তুলতে পারে না। কী সাংঘাতিক দামি এবং ঝকঝকে উঁচু হিলের জুতো! জুতো থেকে চোখ তুললে গাঢ় খয়েরি রঙের ঢোলা প্যান্ট এবং তার ওপর ডাবল ব্রেস্টেড কোট, কোটের ফাঁকে গাম্ভীর্যপূর্ণ টাই চোখে পড়বে। তার ওপর অরুণের সুন্দর গোলপানা ফর্সা মুখখানা। বেড়ালের মতো একটু কটা চোখ, সামান্য লালচে এক ঝাক চুল, চোখ দুখানা বিশাল। আভিজাত্যের স্থায়ী ছাপ তার সর্বাঙ্গে। হাতের আঙুলগুলো দেখ, কী মোলায়েম, লাল টুকটুকে পেলব।

প্রীতম হাসছিল। বলল, আজ একটু ভালই।

অরুণ খুব চোখা হেসে বলল, খুব ভাল কি থাকবেন আজ! ডাক্তার যে আজ বিকেলে আবার গোটা দশ বারো ছুঁচ ফোটাবে। আমি ঠিক ছ’টায় গাড়ি নিয়ে চলে আসব।

প্রীতম অস্বস্তি বোধ করে বলে, আপনার আসার কী দরকার? বিলুই ঠিক নিয়ে যেতে পারবে। এতদিন তো নিয়ে গেছে।

বিলু পারবে না, বলিনি তো! তবে কষ্ট হবে। দিন দিন কলকাতার কনভেয়ানস কেমন ডিফিকাল্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে জানেন তো! ঠিক সময়ে ট্যাক্সি না পেলে? ডেটটা মিস হওয়া কি ভাল?

প্রীতম কৃতজ্ঞতাবোধে অস্বস্তি বোধ করে সবচেয়ে বেশি। একটা লোক নিজের পেট্রল পুড়িয়ে গাড়ি নিয়ে আসবে, নিয়ে যাবে, ফের দিয়েও যাবে–এতটা কি পাওনা প্রীতমের ওর কাছে? অথচ অরুণের জন্য কিছু করারও নই,তার।

হতাশ হয়ে প্রীতম বলে, ঠিক আছে তা হলে।

ঠিকই আছে। খামোখা আমার অসুবিধের কথা ভেবে নিজেকে ব্যস্ত করেন কেন? আমার অসুবিধে হচ্ছে না।

অরুণ এরকম। কোনও জড়তা নেই, অকারণ বেশী ভদ্রতার ধার ধারে না। সবদিক দিয়েই ঝকঝকে প্রকৃতির মানুষ। ভীষণ ধারালো। উচিত কথা বলতে বা রুখে দাঁড়াতে ভয় খায় না। প্রীতমের মতো।

রান্নাঘর থেকে এলোচুল দু হাতে পাট করতে করতে তড়িৎ পায়ে বিলু ঘরে ঢুকতেই প্রীতমের বুক কেঁপে ওঠে। এইবার ঠিক অরুণের পায়ের জুতোজোড়া নজরে পড়বে বিলুর। সে চোখ কুঁচকে উদ্যত মারের অপেক্ষা করতে থাকে।

বিলু খুব ঝাঁঝালো গলায় অরুণকে বলে, আমার কমলা রঙের উলের কী হল? কবে থেকে বলছি, মেয়েটা জানুয়ারি থেকে স্কুলে যাবে! ওর ইউনিফর্ম লাগবে না?

অরুণ বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে অন্যদিকে চেয়ে বলে, কমলা রং কাকে বলে তাই তো আমি বুঝি না। আমি একটু রংকানা আছি।

তা জানি। কানা শুধু নয়, ঠসাও। কতবার জুতো নিয়ে রুগির ঘরে ঢুকতে বারণ করেছি?

 ০৮. বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত

বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত তখন প্রীতম ওর সঙ্গে বিলুর সঠিক সম্পর্কটা জানত না। আজও জানে কী? আসলে মানুষে মানুষে সঠিক সম্পর্ক বলে তো কিছু নেই। সম্পর্ক পালটে যায়।

সাহস করে একদিন তবু প্রীতম জিজ্ঞেস করেছিল বিলুকে, অরুণের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বটা কেমন ছিল? খুব গাঢ়?

বিলু খুব একটা সংকোচ বা লজ্জা বোধ করেনি প্রশ্ন শুনে। তবে চোখের পাতাটা একটু নত করেছিল। কয়েক সেকেন্ডের দুর্বলতা মাত্র। তারপর বলল, আমরা একসঙ্গে স্কটিশ চার্চে পড়তুম বলিনি তোমাকে?

বলেছ।

অরুণ ছিল আমার দু’ বছরের সিনিয়র। এমন পাজি না, একদিন ওর পোষা বেজিটাকে এনে ছেড়ে দিয়েছিল করিডোরে। মেয়েদের মধ্যে সে কী চেঁচামেচি আর আতঙ্ক! আমি তো একটা জানালায় উঠে বসে রইলুম।

সেই থেকে তোমাদের ভাব?

সেই থেকেই। তবে আরও অনেক কাণ্ড আছে। শুধু যে ইয়ারকি করে বেড়াত তা নয়। ইয়ারকিটা ওর মুখোশ। ভিতরে ভিতরে ভীষণ সিরিয়াস।

অরুণ তোমার চেয়ে বয়সে বড়, ছাত্র হিসেবেও সিনিয়র। তবু ওকে তুমি-তুমি করে ডাকো কেন?

ঠোঁট উলটে বিলু বলল, ওকে আপনি বলতে যাবে কে? মেয়েরা সবাই ওকে নাম ধরে তুমি-তুমি করে বলত। তুমি কি অরুণ সম্পর্কে জেলাস ফিল করো প্রীতম?

না, না, তা নয়।লজ্জা পেয়ে প্রীতম বলেছিল, আসলে আমি মানুষের সম্পর্কে জানতে ভালবাসি।

বিলু মৃদু হেসে বলল, তুমি কী জানতে চাও জানি। তুমি খুব শান্ত, ভালমানুষ। কিছু মনে করবে তো?

না, কী মনে করব? মনে করার কিছু থাকলে কবেই তা বলে ফেলতাম।

বিলু একটু যেন আধোগলায় বলল, ওর সঙ্গে আমার ভাব ছিল। খুব ভাব। হয়তো বিয়েও করতুম। করলে না কেন?

একটা কথা ভেবে।

কী কথা?

ও ভীষণ মেয়েদের সঙ্গে মিশত। বাছবিচার ছিল না। ওরকম পুরুষ একটু আনফেইথফুল হয়। জানো তো, পুরুষরা প্রকৃতির নিয়মেই পলিগেমাস। তারা কখনও একজন মহিলাকে নিয়ে খুশি নয়। তার ওপর অরুণ আবার ভীষণ ফ্রি-ওয়ার্লড তত্ত্বে বিশ্বাসী। ও বিয়ে, বন্ধন, সংসার, সন্তান ইত্যাদি রেসপনসিবিলিটি একদম জানে না। আমি বাপু অতটা আধুনিক নই। তাই ভেবেচিন্তেই ওকে বিয়ে করিনি, তোমাকে করেছি।

সেজন্য আজ তোমার দুঃখ হয় না বিলু?

ধুস, দুঃখ কিসের? আমার অত সেন্টিমেন্ট নেই। যা করেছি তা হিসেব করেই করেছি।

আমার সঙ্গে অরুণকে কখনও তুলনা করতে ইচ্ছে হয় না তোমার?

যাঃ! নেভার। তুলনা করব কেন? ও একরকম তুমি অন্যরকম।

প্রীতম হাসিঠাট্টার হালকা চালটা বজায় রেখেই বলল, ধরো আমি তো বেশ রোগা, আর অরুণ কত স্বাস্থ্যবান। অরুণ আমার চেয়ে অনেক ফর্সা। ও প্রচণ্ড বড়লোক আর দুর্দান্ত স্মার্ট—যে গুণগুলো আমার নেই।

তেমনি তুমি আবার শান্ত, দায়িত্বশীল, গভীর মনের মানুষ। সকলের ততো সব গুণ থাকে না। শোনো তুমি কি অরুণ সম্পর্কে সত্যিই জেলাস নও?

প্রীতম হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, না, নই বিলু। বরং অরুণকে আমার বেশ পছন্দ।

বিলু খুব গভীর মনের মেয়ে নয়, প্রীতম জানে। তবু সেদিন বিলু খুব গভীর অতল এক চোখে প্রীতমের মুখখানা মন দিয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর শুকনো গলায় বলল, অরুণের এ বাড়িতে আসা যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে বলে দিয়ে, আমি ওকে বারণ করে দেব। তাতে ও কিছু মনেও করবে না।

ছিঃ বিলু!

বিলু নতমুখ হয়ে বলল, তুমি অত করে জানতে চাইছিলে বলে আমার মনে হচ্ছিল, তুমি বোধহয় ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখছ না।

প্রীতম খুব স্পোর্টসম্যানের মতো কলার উঁচু করা গলায় বলে, আমার কাছে ব্যাপারটা নিতান্তই মজার। মফস্সলের ছেলে তো, আমরা জানি, প্রাক্তন প্রেমিকরা তাদের হাতছাড়া প্রেমিকাদের মুখোমুখি বড় একটা হয় না। তা হলে আর জীবনে ট্র্যাজেডি বলতে কিছু থাকে, বলো?

এ কথায় বিলু হেসে ফেলল। বলল, দেব-দানবের যুগ তো এখন আর নেই।

ফলে এ বাড়িতে অরুণের যাতায়াত বহাল থাকল। ঢাকা চাপার কিছু রইল না।

 

এখন বিলুর ধমক খেয়ে এই যে অরুণ উঠে গেল বাইরের ঘরে, জুতো ছেড়ে আসতে, তার মধ্যেও যেন অরুণের ওপর বিলুর গভীর অধিকারবোধ ফুটে উঠল। বুকের মধ্যে সামান্য চিনচিন করে ওঠে প্রীতমের। এত অধিকারবোধ নিয়ে আর এত জোরের সঙ্গে বিলু কোনওদিন তাকে কোনও হুকুম করেনি।

কিন্তু মানুষে মানুষে স্থায়ী সম্পর্ক বলেও তো কিছু নেই। প্রেমিকা চিরকাল প্রেমিকা থাকে না, স্ত্রীও থাকে না স্ত্রী। এইসব সম্পর্ক ভাঙচুর করতে করতে পৃথিবী খুব দ্রুত এগোচ্ছে।

মোজা পায়ে অরুণ ফিরে এসে বসে এবং বলে, তোমার বড় নিচু নজর বিলু, আজ আমি এত সুন্দর পোশাক পরে এসেছি, তবু তুমি আমার জুতোজোড়াই দেখলে?

বিলু একটু কঠিন গলায় বলে, এটা রুগির ঘর মনে রেখো।

সেকথা ঠিক। ভুলে যাই।বলে একটু লজ্জার হাসি হাসে অরুণ।

প্রীতম লক্ষ করে, সবকিছু অরুণকে মানাল। ওর ওঠা, হাঁটা, হাসি, লজ্জা এ সবকিছুই যেন বহুকাল ধরে রিহার্সাল দিয়ে যত্নে রপ্ত করা।

আবার একটু চিনচিন করে প্রীতমের।

বিলু কথার ফাঁকেই গিয়ে মেয়েকে বাথরুমে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে অরুণকে বলে, সবকিছুই তো আজকাল তুমি ভুলে যাও। একটা হুইল চেয়ারের কথা বলেছিলাম, মনে আছে?

ভুলিনি, কিন্তু প্রীতমবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, উনি হুইল চেয়ার পছন্দ করেন না।

বিলুর মুখ থমথমে হয়ে যায়। প্রীতমের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলে, হুইল চেয়ার হলে তোমার একা থাকতে তেমন কষ্ট হবে না।

বলতে নেই, আগের তুলনায় তার ধৈর্য ও স্থৈর্য বেশ কমে আসছে। যেমন বিলুর এই হুইল চেয়ারের ব্যাপারটায় এখন হল। অত্যন্ত তেতো স্বরে সে বলল, না না, ওসব আমি পছন্দ করি না। ঘরে একটা জবরজং জিনিস ঢুকিয়ে জঙ্গল বানাতে হবে না।

যদি এরকম স্বরে অরুণ কিছু বলত তা হলে বিলু ওকে তেড়ে মারতে যেত। কিন্তু প্রীতমের সঙ্গে বিলুর ব্যবহার অন্যরকম। কথাটা শুনে বিলু নিজের নখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি না চাইলে অন্য কথা। হলে তোমার সুবিধেই হত।

আমার কোনও সুবিধে হবে না বিলু। কেন কথা বাড়াচ্ছ?

বালিশে এলিয়ে চোখ বোজে প্রীতম। চোখের পাতাটা পুরো বন্ধ হওয়ার আগেই এক পলকের দৃশ্যটা চোখে পড়ল। অরুণ হাতের ইশারায় বিলুকে সরে যেতে বলছে।

বাথরুম থেকে লাবুও ডাকছিল। বিলু নিঃশব্দে চলে যায়।

অরুণ চেয়ারটা বিছানার আরও একটু কাছে টেনে এনে বসে। নরম গলায় বলে, ঘরে বসে থেকে থেকে তো পচে গেলেন মশাই! একটা কথা বলব? একদিন চলুন দিল্লি বা বম্বে রোড ধরে খানিকটা বেড়িয়ে আসি। এ বছর ওয়েদারটাও ভাল।

ইচ্ছে করে না যে! শরীরে অত শক্তিও নেই।

দূর মশাই! এই মনোবল নিয়ে আপনি লড়ছেন! শক্তি কারও শরীরে, কারও মনে। মনটা শক্ত করুন, ঠিক পারবেন।

ভাল লাগে না।

তবে কী ভাল লাগে? ঘরে বসে থাকতে?

প্রীতম ক্ষীণ হেসে বলে, ঘর আমার খারাপ লাগে না। বাইরেই তো যত গোলমাল।

বিলু ঠিকই বলে, আপনি ভীষণ ঘরকুনো এবং ঘোর সংসারী। সেইজন্যই কি বউকে চাকরি করতে দিতেও চান না?

মেয়েদের চাকরি করা আমাদের পরিবারে কেউ পছন্দ করে না।

সে তো বুঝলাম। বলে হঠাৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অরুণ আবার বলল, কিন্তু এখন বিলুর চাকরি করা একটু দরকারও যে।

কেন?–বুলেটের মতো প্রশ্নটা বেরোয় প্রীতমের মুখ থেকে।

অরুণ মৃদু স্বরে বলে, আপনি নিজে অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আপনাকে আমি আর কী বোঝাব?

প্রীতমের চিন্তার স্রোত খুব ধীরে ধীরে খাত বদল করে। সে আবার চোখ বুজে নিঃঝুম হয়ে শুয়ে মনে মনে খুব দ্রুত হিসেব করে দেখে নেয়। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টের দরুন সে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো পেয়েছিল। সেই টাকার ওপরেই এতদিন সংসার চলছে। বসে খেলে রাজার ভাঁড়ারও শেষ হয়।

অরুণ মৃদু স্বরে বলে, খরচও তত কম নয়। মেয়েদের চাকরি করা হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ভাল না হতে পারে আপনার কাছে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই তাতে আপনার আপত্তি হবে না?

বিলু তো আমাকে কিছু বলেনি।

বিলু আপনাকে বলতে তেমন জোর পাচ্ছে না।

প্রীতম দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়। বিলু তাকে বলতে জোর পাচ্ছে না, তবে অরুণকে বলছে কিসের জোরে? প্রীতম বিরক্তির গলায় বলে, বলতে জোরের দরকার কী?

অরুণ আরও একটু কাছে এগিয়ে আসে এবং খুবই নিচু গলায় বলে, আপনি যতটা শান্তশিষ্ট দেখতে, ঠিক ততটাই কি ডেনজারাস নন? বিলু বলে, প্রীতমের মুখোমুখি হলে ওর ঠান্ডা গভীর চোখের দিকে চেয়ে আমার বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে।

কথাটার মধ্যে খুশি হওয়ার মতো কিছু একটা ছিল বোধহয়, নইলে প্রীতমের ভিতরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল কেন? চোখ খুলে সে বলল, আমি ডেনজারাস হতে যাব কেন? বিলু ওসব বলে

বুঝি!

অরুণ হাসিমুখে চেয়ে থাকে। তার চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি। চাপা গলাতেই বলে, ডেনজারাস বলতেই তো আর মারদাঙ্গাবাজ লোক নয়। আপনার বিপজ্জনকতার উৎস হচ্ছে স্ট্রং লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। আপনি মুখে কিছু তেমন বলেন না, কিন্তু একটু নাকের কুঞ্চন বা ঠোঁট ওল্টানো কিংবা চোখের এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেন। যারা কম কথা বলে এবং যারা চাপা স্বভাবের, তাদের সবাই ভয় পায়।

প্রীতম নিজের এত গুণের কথা জানত না। কথাগুলো যে সত্যি নয় তাও সে একটা মন দিয়ে বুঝতে পারে। সে জানে তুখোড় বুদ্ধিমান অরণ তাকে তেল দিচ্ছে। একটা উদ্দেশ্য নিয়েই দিচ্ছে। তবু অন্য একটা অবুঝ মন এই এত সব মিথ্যে গুণের কথা হাঁ করে গিলল। নিজের খুশির ভাবটা চাপা দেওয়ার জন্য সে একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমাকে কারও ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

প্রীতমকে এক মোহময় সম্মোহনে আচ্ছন্ন করে দিতে দিতে বড় আন্তরিকভাবে অরুণ বলে, আছে। আপনি তা হয়তো টের পান না। বিল পায়।

প্রীতম একটু অন্যমনস্ক থেকে বলে, ব্যাংকের টাকা কি ফুরিয়ে এসেছে?

তা নয়। এখনও অনেক আছে। হয়তো দু-চার বছর চলে যাবে। কিন্তু তারপর একদিন ফুরোবে।

কত আছে?

বিলু বলছিল কত যেন!

আমাকে বললে পারত।

প্রীতম আবার চোখ বাজে। গোঁ আঁকড়ে ধরে থেকে লাভ নেই সে জানে। চোখ খুলে আবার তাকায় এবং বলে, লাবুর কী হবে? বিলু চাকরি করতে গেলে ওকে দেখবে কে?

আয়া থাকবে। আপনিও তো রয়েছেন। লাবুর জন্য চিন্তা নেই। যেসব বাড়ির স্বামী স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে তাদের ছেলেমেয়েও তো মানুষ হচ্ছে।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, ঠিক মানুষ হচ্ছে বলা যায় না। মায়ের সঙ্গ না পেলে বাচ্চারা ভীষণ রাগী, অভিমানী, জেদি আর হিংসুটে হয়ে ওঠে।

কথাটা স্বীকার করে অরুণ মাথা নাড়ে। সাদা একটা হাসিতে প্রীতমের মাথা গুলিয়ে দিয়ে বলে, লাবু তার বাবাকে তো পাবে। লাবু তো বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না।

প্রীতম স্নিগ্ধ হয়ে গেল। দুর্বল হয়ে গেল। মোহাচ্ছন্ন হল। আনমনা গলায় বলল, বিলু কি কোথাও চাকরি পেয়েছে?

একটা ব্যাংকে অ্যাপ্লাই করেছিল। পেয়ে গেছে।

আমাকে বলেনি।–দুঃখের সঙ্গে বলে প্রীতম।

অরুণ কথাটার জবাব দেয় না। শুধু হাসে।

 

অরুণ চলে যাওয়ার পর প্রীতম বিলুকে ডেকে বলে, তুমি চাকরি পেয়েছ, আমাকে বলোনি কেন?

বিলু প্রীতমের দিকে খুব সহজ চোখে তাকাল, আর সেই দৃষ্টি দেখেই প্রীতম বুঝল, বিলু কস্মিনকালেও তাকে ভয় খায় না। অরুণ এমন সুন্দর সাজিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলে!

বিলু জবাব দেয়, বললে তো তুমি খুশি হবে না। কিন্তু চাকরির এখন দরকার।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রীতম টাকার হিসেব জানে। তাই রোগা দুর্বল হাতে মাথার লম্বা চুল একটু পাট করতে করতে বলে, সেটা বুঝি। কিন্তু লাবু আর-একটু বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে না বিলু?

ততদিন কি আমারই চাকরির বয়স থাকবে? না কি ইচ্ছে করলেই এই বাজারে চাকরি পাওয়া যাবে?

চাকরি নেওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলে না একবার?

বিলু ভ্রু কুঁচকে বলে, এখনও নিইনি। তোমার অসুবিধে হলে না হয় নেব না।

কথাটায় ঝাঁঝ ছিল। প্রীতম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ভাবাবেগ আসছিল। সেটা সামলে নিতে পারল। বলল, রাগ কোরো না। টাকার হিসেব আমি কারও চেয়ে কম বুঝি না। আমার জন্যও অনেক খরচ হচ্ছে। জমানো টাকা আর কত আছে?

খুব বেশি নেই।–বিলু অন্যদিকে চেয়ে বলল, যা আছে তা দিয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি একটু শহরের বাইরের দিকে হয়ে যেতে পারে।

তুমি বাড়ি করার কথা ভাবছ?

তুমি বারণ করলে ভাবব না। কিন্তু এইবেলা কিছু না করলে টাকাটা খরচ হয়ে যাবে।

বাড়ি করার কথা আমি কখনও ভাবিনি।

কেন ভাবোনি? সবাই তো এসব ভাবে।

শিলিগুড়িতে আমাদের একটা বাড়ি তো আছে।

বিলু কথাটার জবাব দিল না। কিন্তু মুখে একটা কঠিন ভাব ফুটে উঠল।

প্রীতম সবই জানে। বিলু কোনওদিন শিলিগুড়ি যাবে না। ও বাড়িটাকে সে নিজের বাড়ি বলে ভাবতেও পারে না। প্রীতম একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জমিটমি দেখেছ?

দেখিনি। তবে দু-একটা খবর পেয়েছি। অরুণের ছুটির দিন দেখে তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে সবক’টা দেখে আসব ভেবে বেখেছি।

আমি জমির কিছু বুঝি না। তোমরা থাকবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।

কেন, সেই বাড়িতে তুমিও তো থাকবে।

প্রীতম এই কথায় বিলুর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ মনে হয়, তাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য বিলু আর অরুণ আড়ালে কোনও ষড়যন্ত্র করছে না তো! প্রীতমের ঠোঁটে জবাবটা ঝুলছিল, যদি ততদিন পৃথিবীতে থাকি। কিন্তু অত সহজ ভাবপ্রবণতার কথা বলল না প্রীতম। ভাবের ঘোরে ভেসে গিয়ে লাভ নেই। তার বড় শক্ত লড়াই।

তাই প্রীতম স্বাভাবিকভাবে বলে, ঠিক আছে। যাব।

বিলু একটু যেন সংকোচের সঙ্গে বলে, এসব টাকা-পয়সা বা বাড়ির কথা বলতে আমার খারাপ লাগে। তুমিও হয়তো খুশি হও না। কিন্তু ভাল না লাগলেও তো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়।

এত তাড়াতাড়ি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে তা কখনও চিন্তা করিনি।

বিলু কঠিন মুখে চুপ করে থাকে।

প্রীতম হাসে একটু। আশপাশ থেকে রেডিয়োতে দূরাগত একটা ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণীর শব্দ আসছে। প্রীতম নিজের পাজামায় ঢাকা পা দু’খানা দেখতে থাকে। ইডেনে টেস্ট খেলা দেখে দু’বছর আগেও সে হেঁটে ভবানীপুর ফিরেছে।

বিলু মৃদু স্বরে বলল, আমি লাবুকে নিয়ে কেনাকাটা করতে বেরোচ্ছি। বিন্দু রইল।

প্রীতম চোখ বন্ধ করে হুঁ দিল।

ভালবাসা থাক বা না থাক, বিলু বাড়িতে না থাকলে প্রীতমের বড় ফাঁকা আর নিরর্থক লাগে।

বিলু চলে গেলে প্রীতম বিন্দুকে ডেকে খবরের কাগজটা চাইল। কাগজ মুখের সামনে মেলে ধরে শূন্য চোখে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। কিছুতেই মন দিতে পারল না।

পা দুটো ঝিন ঝিন করছিল। আজকাল প্রায়ই এটা হয়। অনেকক্ষণ ধরে কুঁচকি থেকে পাতা পর্যন্ত পা দুটোয় ঝিঝি ছাড়তে থাকে। প্রীতম তার অস্ত্রশস্ত্রের জন্য হাত বাড়ায়। নিরন্তর শরীরের সঙ্গে তার লড়াই। তাকে তো বাঁচতেই হবে। অসহনীয় ঝিনঝিন অনুভূতিটাকে সহনীয় করতে সে প্রাণপণে চোখ বুজে সেতারের বাজনার শব্দ মনে আনতে থাকে। বহুক্ষণের চেষ্টায় শরীরের ঝিনঝিনকে সে সেতারের ঝালার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। তাতে অস্বস্তি কমে যায় না, কিন্তু খানিকটা সহনীয় হয়। সেতার হয়ে যাওয়ার একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতাও হতে থাকে তার।

এ বাড়িতে কেউ গানের তেমন ভক্ত নয় বলে রেকর্ড প্লেযাব কেনা হয়নি। প্রীতম ভাবল বিলুকে একটা সস্তার রেকর্ড প্লেয়ার কিনতে বলবে। আর অনেক সেতার-সরোদের রেকর্ড। তার

অস্ত্র চাই।

বিলু তার জন্য হুইল চেয়ার কেনার কথা ভাবছে, চাকরি করার কথা ভাবছে, ভবিষ্যৎ চিন্তা করছে। আসলে এসবের পিছনে প্রীতমের অনস্তিত্বের কথাই কি ভাবা হচ্ছে না? বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ভয় হঠাৎ চিনচিন করে ব্যথিয়ে ওঠে, ককিয়ে ওঠে। মরে যাব নাকি?

বে-খেয়ালে হাত মুঠো পাকায় প্রীতম, চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ভাল আছি। ভাল আছি। ভাল আছি। ভাল আছি। এবার থেকে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? তক্ষুনি খুব হোঃ হোঃ করে হেসে আনন্দে ভেসে যেতে যেতে প্রীতম বলবে, ভাল আছি।

 

রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছোট্ট লাবু মুখ তুলে মায়ের দিকে চাইল। সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভরসা পায় না। মা মারবে।

বিলু আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রূ কোঁচকানো। ভাবছে’ লাবু আবার মুখ তুলে মায়ের মুখটা দেখে। তারপর ডাকে, মা!

উঁ!

লাল আলো জ্বলে গেছে। পেরোবে না?

হুঁ। চলো।–বিলু শক্ত মুঠিতে মেয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হয়।

আনমনে হাঁটছিল বিলু। লাবু হঠাৎ হাত টেনে ধরে বলে, মা! জল!

বিলু বিরক্ত হয়। দেখে মাংসের দোকান থেকে অঢেল রক্তমাখা জল ফুটপাথ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ায় পিছন থেকে একটা লোক বিলুব ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে সামলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বিলু মেয়ের চুল টেনে দিয়ে বলে, কতবার বলেছি না, রাস্তায় সভ্য হয়ে চলবে। জল তো কী হয়েছে?

লাবু মায়ের দিকে চেয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। আস্তে করে বলে, জুতোয় লাগবে তো!

জুতোয় নোংরা লাগেই, তাতে কী?

লাবু আর জবাব দেয় না। টুকটুক করে মায়ের পাশে পাশে হাঁটে। আবার হঠাৎ ডাকে, মা।

আবার কী?

ফিতে।

তোমার অনেক ফিতে আছে। আর নয়।

চশমা?

তাও নয়। বায়না করবে না একদম।

লাবু ঘাড় হেলিয়ে রাজি হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি হাঁটো লাবু। বাবা একা রয়েছে।

পায়ে লাগছে।

কী হয়েছে পায়ে?

লাবু থামে এবং হেঁট হয়ে নিজের পায়ের জুতো খুলতে চেষ্টা করে। পারে না। অসহায় মুখে মার দিকে চেয়ে থাকে।

উবু হয়ে স্ট্র্যাপটা খুলে বিলু জুতোর ভিতর থেকে একটা কমলালেবুর বিচি বের করে ফেলে দেয়। বলে, কতবার শিখিয়েছি জুতো পরার আগে ঝেড়ে নিয়ে পরবে! মনে থাকে না কেন?

বিলু দোকান থেকে গুঁড়ো সাবানের প্যাকেট, মাখন, বিস্কুট ইত্যাদি কেনে। তারপর লাবুকে বলে, তুমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও তো লাবু। বেশি দূরে যেয়ো না। সিঁড়িতে রোদ আছে, ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখো।

লাবু বাধ্য মেয়ের মতো সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা যতক্ষণ টেলিফোনে কথা বলবে ততক্ষণ তাকে দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে জানে।

বিলু ফোনে অরুণকে পেয়ে বলে, ওর অ্যাটিচুড কেমন দেখলে?

খারাপ কিছু নয়। মেনে নেবে।

তুমি চলে আসার পর ও চাকরি নিয়ে আবার কথা তুলেছিল। ভারী অবুঝপানা করে। বলে, লাবু বড় হলে চাকরি কোরো। তাই কি হয়?

তুমি রাগ-টাগ দেখাওনি তো!

আমি বুঝি শুধু রাগই দেখাই? তোমরা আমাকে কী ভাবো বলো তো?

এই তো আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছ।

তোমার কথা আলাদা।

আলাদা কেন? আমি রিঅ্যাক্ট করি না বলে?

ঠিক তাই। তোমার মতো কম রিঅ্যাকশনারি আমি বেশি দেখিনি।

অরুণ হাসল। বলল, তা হলে আমি তোমার রাগের জিম্মাদার রইলাম। প্রীতমবাবুকে অনুরাগটুকুই দিয়ো।

ছি ছি।

হঠাৎ ছিছিক্কার কেন?

এত বাজে অনুপ্রাস বহুকাল শুনিনি। তুমি না স্মাট ছিলে? রাগের সঙ্গে অনুরাগ মেলানো কি তোমাকে মানায়? শোনো, ও জমি দেখতে রাজি হয়েছে। তুমি কবে ফ্রি হবে বলো তো! গাড়ি নিয়ে সব কটা জমি একদিনে ঘুরে দেখতে হবে।

বিলু, জমি কেনার ডিসিশনটা পাল্টাও আবার বলছি। কে তোমার বাড়ি তৈরির খবরদারি করবে? তার চেয়ে ফ্ল্যাট কেনো।

ফ্ল্যাটেই যদি থাকব তবে তা কিনতে যাব কেন? ভাড়া দিয়েই তো থাকতে পারি।

ফ্ল্যাট কিনলে ভাল পাড়ায় যে মেটিরিয়ালের তৈরি বাড়িতে থাকতে পারবে, জমি কিনে বাড়ি করলে সেটা তো পাবে না। খরচ বেশি, ঝামেলা বেশি।

তবু আলাদা বাড়িই আমার পছন্দ।

তোমার যে এস্টিমেট তাতে জমি কেনার পর দু’খানা ঘর তৈরির টাকাও থাকবে না।

চাকরি করলে টাকা হবে। ধীরে ধীরে করব।

অরুণ একটু চুপ করে থেকে বলে, তুমি হয়তো পারবে। তুমি চিরকালই অন্যরকম ছিলে।

ছাড়ছি।

ফোন রেখে বিলু দেখে, লাবু হাটুর কাছে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেয়ে আছে। তাকাতেই বলল, একটা পাগল আমাকে ডাকছিল। বিলু সামান্য একটু লজ্জা পেল কি?

 

লাবু ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। বাবা কাত হয়ে শুয়ে আছে। বালিশ থেকে মাথাটা নীচে পড়ে গেছে। বাবার শরীরের ওপর মস্ত পাতা খোলা খবরের কাগজটা পড়ে আছে।

মা বাথরুমে ঢুকে যেতেই খুব আস্তে আস্তে হেঁটে বাবার বিছানার কাছে আসে লাবু। সে জানে, মানুষ মরে গেলে শ্বাস ফেলে না।

লাবু বাবার নাকের কাছে ছোট্ট হাতটা বাড়িয়ে দিল। খুব জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে বাবার। সন্তর্পণে খবরের কাগজটা টেনে আনে লাবু। ছোট হাতে অত বড় বড় পাতা ভাজ করতে পারে না। কোনও রকমে ঘুচুমুচু করে দলা পাকিয়ে টেবিলে সরিয়ে রেখে দেয়।

একটু ছোঁবে বাবাকে? ভয় করে। কত রোগা না লোকটা! এত রোগা কেন? এত অসুখ কেন?

প্রীতমের একটা রোগা হাত খাট থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে। লাবু খুব ভয়ে ভয়ে একবার হাতটা ছোয়। ভয় করে। হাতটা ঠান্ডা। কত বড় বড় নখ বাবার হাতে! ভয় করে।

বাবা চুল কাটে না কেন মা?–ভাত খেতে বসে লাবু মাকে জিজ্ঞেস করে।

বিলুর খেয়াল হয়, তাই তো। অনেকদিন প্রীতমের চুল ছাঁটানো হয়নি। সে লাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ও মেয়ে। বাবার দিকে তো খুব নজর তোমার!

০৯. দীপের ঘুম ভাঙল

দীপের ঘুম ভাঙল কানের কাছে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ কথাটা শুনে। তার বিছানা ঘেঁষেই জানালা এবং জানালার পাশেই রাস্তা। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। একেই শীতকাল, তার ওপর বাইরে কিছু কুয়াশা থাকতে পারে। শীতকালে ঘরের জানালা বন্ধ থাকে, মাথার জানালাটা কিছু তফাতে বলে ভোলা। কিন্তু কোনওটা দিয়েই আলো বা হাওয়া আসে না তেমন। অতিশয় ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এই ঘর। এখান থেকে সব সময়ে মনে হয়, বাইরে মেঘ করে আছে কিংবা সন্ধে হয়ে এল।

ঘুম ভাঙলেই রোজ আঁশটে, কটু একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। জানালার ধারেই পাড়ার রাজ্যের তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, এঁটোকাটা জমা হয়ে থাকে। করপোরেশনের টিনের ঠেলাগাড়ি একটু বেলায় এসে নিয়ে যায়। ততক্ষণ গন্ধটা বেশ তীব্র। তারপরও গন্ধ একটা থাকেই। একতলার ঘর বলে এইসব অস্বস্তি। তবে এখন আর অতটা টের পায় না দীপ। সয়ে গেছে। শুধু এই সকাল বেলায় ঘুম ভাঙলে এখন কয়েকটা শ্বাসে গন্ধ পায়।

দীপনাথ বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ে। আজও গা থেকে কম্বলটা একটু আলসেমিভরে সরিয়ে উঠে পড়ল। কাজ আছে। সাতসকালে রাস্তায় কে কাকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলল সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু কথাটা শুনে ঘুম ভাঙল বলে দীপনাথের মন থেকে সহজে গেল না সেটা।

কম্বলটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে দীপনাথের একটু কষ্ট হল মনে। দাদা মল্লিনাথ তাকে এই বিলিতি কম্বলটা দিয়েছিল। ওয়াড় কবে ছিড়ে গেছে, উদ্যোগহীন মল্লিনাথ আর ওয়াড় করায়নি। অযত্নের ব্যবহারে গায়ের ঘষটানিতে রোয়া উঠে ভিতরের বুনোট বেরিয়ে পড়েছে কয়েক জায়গায়, তেলচিটে ময়লা ধরায় সবুজ আর হলুদ চৌখুপিগুলোও আবছা হয়ে এসেছে। আর একটা বা দুটো শীতের পরই ভিখিরি-কম্বল হয়ে যাবে।

কেন কোনও জিনিসেই তার যত্ন নেই? এ কথা ভাবতে ভাবতে দীপনাথ নিজের ওপর বিরক্ত হয়। শিয়ালদার মোড় থেকে কিনে আনা তেতো ও রসাল নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করতে করতে কলঘরে যাওয়ার আগে সে দু’জন চিত ও কাত হয়ে পড়ে থাকা রুমমেটকে দেখে নেয়। একটি নিতান্তই বাচ্চা ছেলে, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। অন্যজন ফুড ডিপার্টমেন্টের মধ্যবয়সি ইন্সপেক্টর। দীপনাথের সঙ্গে কারওরই খুব একটা ভাব নেই। লেপের তলায় দু’জনেই এখন নিথর। ছাত্রটি উঠবে সাতটা নাগাদ, ইন্সপেক্টর আরও পরে। এখন বাজে পৌনে ছ’টা মাত্র।

ভিতরে একটু দরদালান মতো। দরদালানের শেষে একটু চৌখুপি কাটা একধাপ নিচু করে বাঁধানো চৌবাচ্চার চাতাল। জলের চাপ কম বলে সকলেই আজকাল গ্রাউন্ড-লেভেলের নীচে ঢৌবাচ্চা বানায়।

চৌবাচ্চার ধারে অবশ্য যেতে পারল না দীপ। সেখানে ম্যানেজারের বউ তার ছোট ছেলেকে বড়-বাইরে করাতে বসেছে। দীপ সুতরাং দরজায় দাঁড়িয়ে দাতন চিবোতে থাকে। ম্যানেজারের বউয়ের মুখখানা কোনওদিনই দেখেনি দীপ। বউটি লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকে। কিন্তু আন্দাজ করা যায় বউটি তরুণী এবং দেখতে ভালই। গায়ের রং বেশ ফর্সা। তবে এর মতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলাও হয় না। দু’ঘরের মাত্র ছ’জনকে নিয়ে এই ছোট্ট বোর্ডিং-এর লোকদের ম্যানেজার এমনিতেই যাচ্ছেতাই খাবার দেয়, তার ওপর এই বউটি ইচ্ছে করেই এত খারাপ রাধে যে মুখে দেওয়া যায় না। ফলে কেউই পুরোপেট খেতে পারে না। প্রতিদিনই থাকে রসুন দেওয়া শাক, কলাইয়ের ডাল আর তেলাপিয়া মাছের একটি গাদার টুকরো। দীপনাথ খাওয়ার সময় প্রতিদিনই বমি-বমি ভাব টের পায়। এ দিয়েও হয়তো খাওয়া যেত কিন্তু এই বউটি তা হতে দেয় না। কলাইয়ের ডাল ফোড়ন ছাড়া বেঁধে দেয়, যা খাওয়া সম্ভবই নয়। সর্ষেবাটা আর গুঁড়োমশলা দিয়ে রাঁধা মাছটিও গলা দিয়ে নামানো শক্ত। দীপনাথ প্রায়দিনই বাইরে খেয়ে নেয়। বউটির ঘোমটার আবরু আছে বটে কিন্তু মানবিক লজ্জাবোধটুকু নেই।

দীপনাথ দাঁতন করতে করতে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কঠোর দৃষ্টিতে বউটিকে দেখছিল। সে যে অপেক্ষা করছে তা টের পেয়েছে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে চকিতে দেখে নিল তাকে, তারপর ন্যাংটো এবং ভেজা ছেলেটাকে দুহাতে আলগা করে শূন্যে তুলে হরিণের পায়ে। পালাল।

প্রাতঃকৃত্যের পর, রুমমেটরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দীপনাথ তার ব্যায়াম সেরে নেয়। নিজেকে ফিট রাখতে হলে এটুকু অবশ্যই দরকার। গোটা ষাটেক বৈঠক আর ত্রিশটা বুকডন, কয়েকটা যোগাসন এবং বুলওয়ার্কার নিয়ে একটু পেশি খেলানো। চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা যায়। তা যাক। দীপনাথ জানে, শরীরকে সক্ষম রাখতে গেলে ব্যায়াম ছাড়া পথ নেই। বসিয়ে রাখলেই শরীরে ঘুণ ধরে, আজ গ্যাস অম্বল, কাল রক্তচাপ, হার্টের ব্যামো দেখা দেবেই। শরীরের যত্ন নিতে দীপনাথ ঠেকে শিখেছে। এর আগে মেস বোর্ডিং-এ বার দুয়েক সে শক্ত টাইফয়েড আর হাইপার-অ্যাসিডিটিতে ভুগে বিছানা নিয়েছিল। ফলে শৌখিন শরীর হলে তার চলবে না। দুর্ভাগ্যবশত তার আপনজন বলতে কেউই নেই। দাদা, ভাই বা বোন আছে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠেনি বলে সম্পর্ক তেমন গাঢ় হয়নি। ফলে অসুখ বা বিপদ ঘটলে ভাই-বোনদের কাছে ধরনা দিতে তার লজ্জা করে। নিজের দায়িত্ব তার একেবারেই নিজের। অসুখ হয়ে পড়ে থাকা তার পোষায় না।

ব্যায়ামের পর কাচের গেলাসে ভেজানো কাবলি ছোলা খেয়ে স্টেটসম্যানটা খুলে বসে দীপ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এবং আড়চোখে ঘড়ি দেখে। অফিস টাইমের আগেই বোসের ফাইবার গ্লাসের সুটকেসটা সারাতে চাদনি চক যেতে হবে। সুটকেস সারিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। অফিসে তার বাঁধাধরা কাজ নেই। গেলেই হয়। আসলে সে বোস সাহেবের চব্বিশ ঘণ্টার চাকর।

পৃথিবীর খবর খুব ভাল নয়। খবরের কাগজওলারা সেই নিরানন্দ ছবিই তুলে ধরে বারবার। এনার্জি ক্রাইসিস, ইনফ্লেশন, পৃথিবী জুড়ে উগ্রপন্থীদের উৎপাত, দুর্ঘটনা। খবরের কাগজ ভাজ করে রেখে দীপ উঠে পোশাক পরে নেয়। চৌকির তলা থেকে সুটকেসটা বের করে টেনে। ওজনে হালকা হলেও বেশ বড়সড় জিনিস। বাসে-ট্রামে নেওয়া কষ্টকর। বোস এটার জন্য ট্যাক্সির ভাড়া দেয়নি।

কৌতূহলবশে সুটকেসটা খুলল দীপ। ভিতরটা ভেলভেটের মতো নরম কাপড় দিয়ে ঢাকা, গভীর বেগুনি তার রং, অনেকগুলো পকেট রয়েছে নানা মাপের। দীপনাথ লোভী নয়, চোর নয়। তবু তার আঙুল প্রতিটি পকেটের ভিতর খুঁজতে লাগল। কী খুঁজছে তা সে জানে না। একেবারে সামনের দিকে লম্বা পকেটটাতে তার আঙুল একটুকরো কাগজ চিমটি দিয়ে তুলে আনল।

একটু অবাক হয়ে দীপনাথ দেখে মিসেস বোসের সই করা একটা বেয়ারার চেক। টাকার অঙ্ক লেখা আছে আড়াই হাজার। কে একজন স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে লেখা হয়েছে। চেকটা অবশ্য ব্যাংক থেকে ফেরত দিয়েছে। লাল কালি দিয়ে আগাগোড়া চেকটাকে আক্রোশভরে কেটে দিয়েছে কেউ। দীপনাথ চেকটা পকেটে রেখে দিল।

সকালের দিকে বোস সাহেবকে তার বাড়িতে রোজ একটা ফোন করার নিয়ম আছে। কোনও কাজ থাকলে বোস সাহেব তা ফোনেই বলে দেন।

আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে দীপ ফোন করতেই মিসেস বোসের গলা পাওয়া গেল। গলাটি মিষ্টি বটে, কিন্তু বেশ ঝাঁঝালো।

দীপনাথ সবিনয়ে বলে, আমি দীপ।

বুঝেছি। মিস্টার বোস এইমাত্র বাথরুমে গেলেন।

দীপনাথ আড়চোখে ঘড়ি দেখে। এ সময়ে বোস সাহেবের বাথরুমে যাওয়ার কথা নয়। ঘড়ির কাঁটায় চলা মানুষ। বাথরুমে থাকেন আটটা থেকে সওয়া আটটা। এখন সাড়ে আটটা বাজছে প্রায়।

দীপ মৃদু স্বরে বলে, আজ যেন একটু ইররেগুলার হলেন মিস্টার বোস।

ওপাশে মিসেস বোস থমথমে গলায় বললেন, হ্যাঁ। কয়েকজন ভিজিটর এসে পড়েছিল বলে দেরি। আপনি কি একটু ধরবেন?

দীপনাথ সংকোচের সঙ্গে বলে, আমি ডাকঘর থেকে ফোন করছি। এখানে তো বেশিক্ষণ লাইন আটকে রাখতে দেবে না।

উঃ, আপনার যে কত প্রবলেম দীপনাথবাবু! ঠিক আছে, আপনি না হয় পরে ফোন করবেন।

শুনুন মিসেস বোস, আপনাদের সুটকেসটার মধ্যে একটা জিনিস ছিল।

কী জিনিস? দামি কিছু?

না। স্ক্র্যাপ একটা চেক। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে দেওয়া আপনার সই করা চেক।

হঠাৎ খুব কঠিন হয়ে গেল মিসেস বোসের কণ্ঠস্বর। বললেন, আপনি সুটকেসটা খুলেছিলেন কেন?

দীপনাথ একটু হাসল আপনমনে। বলল, সারাতে হলে মিস্ত্রিরাও তো খুলবে। তাই আমি আগেভাগে দেখে নিচ্ছিলাম, ভিতরে কিছু রয়ে গেছে কি না।

ও। ঠিক আছে।

চেকটা কী করব?

স্ক্র্যাপ চেক যখন, ফেলে দিন।

বলেই পরমুহূর্তেই মিসেস বোস হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, না, না। শুনুন, চেকটা আপনি নিজে নিয়ে এসে আমাকে দেবেন। প্লিজ, হারিয়ে ফেলবেন না।

আচ্ছা।

ফোন রেখে রাস্তার মোড়ের কাছে স্টার সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিতে বসে নিমীলিত চোখে আয়নায় নিজের সাবানের ফেনায় অর্ধেক ঢাকা মুখের দিকে চেয়ে দীপ ভাবে, মিসেস বোস খুব সাবধানি মেয়ে। চেকটা দীপ নষ্ট করে নাও ফেলতে পারে এবং সেটা দিয়ে কোনওদিন মিসেস বোসকে ব্ল্যাকমেল করতেও পারে, এই ভয়েই না ফেরত চাইল! আজকাল মানুষ মানুষকে একদম বিশ্বাস করে না।

দীপ স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির একটা কাল্পনিক চেহারা ভাবতে চেষ্টা করল। নামটাই এমন মোলায়েম এবং দেবত্বে ভরা যে, যতবার চোখ বুজল ততবার শিবনে এক জটাধারী পুরুষকে দেখতে পেল। নিশ্চয়ই ওরকম নয় আসল স্নিগ্ধদেব। সম্ভবত পায়জামা পাঞ্জাবি পরা দাড়িওলা, রোগা ও রগচটা এবং ভীষণ পড়াশুনো জানা কোনও উগ্রপন্থী যুবাই হবে। মিসেস বোসের একটা পলিটিক্যাল লাইন আছে, সে জানে। কিন্তু কিছুতেই স্নিগ্ধদেবকে মিসেস বোসের গোপন প্রেমিক বা জার বলে মনে হয় না। কারণ, মিসেস বোস ওরকম নয়। গোপনতার ধারও ধারে না। যা চায় তা মুখ ফুটে চাইতে জানে। দরকার মতো স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট হিম্মত আছে। না, মিসেস বোসের চরিত্রের সঙ্গে গুপ্তপ্রেম ব্যাপারটা একদম খাটে না। তবু কোথাও একটা গোপনীয়তা আছেও। নইলে শেষ মুহূর্তে চেকটা অত আকুলভাবে ফেরত চাইত না।

দীপ যখন চাঁদনি চওকে পৌঁছোল তখন বেলা সাড়ে ন’টা। নানু মিয়ার দোকানে সুটকেসটা জমা করে বেরোল আবার ফোন করতে। মিস্টার বোস এতক্ষণে অফিসে এসে গেছেন।

ফোন ধরেই মিস্টার বোস বলেন, আজ শনিবার খেয়াল আছে তো?

হ্যাঁ।

আপনি বেলা একটার মধ্যে রেসের মাঠে পৌঁছে যাবেন। আজ অফিসে আসার দরকার নেই। আর শুনুন মিসেস বোস নিউ মার্কেটে গেছেন। যদি অসুবিধে না হয় তা হলে গো দেয়ার অ্যান্ড ট্রাই টু বি সাম হেলপ টু হার।

আচ্ছা।–বলতে গিয়ে দীপ অনুভব করে একটা অদ্ভুত আনন্দে তার গলাটা হঠাৎ কাঁপছে।

বোস ফোনেই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বলেন, বেটার ট্রাই টু রেসট্রেন হার ফ্রম বায়িং থিংস। ও কে?

ও কে।

বোস ফোন রেখে দেন।

চাঁদনি চক থেকে নিউ মার্কেটে লম্বা পায়ে এক লহমায় পৌঁছে যায় দীপ। কিন্তু ভারী হতাশ হয়ে দেখে, নিউ মার্কেটে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। লোডশেডিং-এর মধ্যে টিমটিমে মোম জ্বলছে মাত্র। এই আলোয় কাউকে চিনে বের করা খুবই মুশকিল।

দীপ পরিস্থিতিটা একটু ধীর স্থিরভাবে বুঝে নিল। নিউ মার্কেটের গোলকধাঁধায় কীভাবে, কোন প্ল্যানমাফিক এগোলে মিসেস বোসকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে না সেই স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক করে শিকারি বেড়ালের মতো লঘু সতর্ক পায়ে এগোতে লাগল।

দীপের ভিতরে যে আর-একটা দুর্মুখ, দুর্বাসা টাইপের দীপ বাস করে সে ঠিক এই সময়ে প্রশ্ন করল, মিসেস বোসকে খুঁজে বের করার পিছনে তোমার আসল স্বার্থটা কী বলো তো বাপ! নিছক ডিউটি না অন্য কিছু?

দীপ ধমক দিয়ে বলে, চোপ শালা! ওসব বললে মুখ ভেঙে দেব। জানো না, আমি চব্বিশ ঘণ্টার চাকর! ডিউটি করছি।

ডিউটি? না কি রথ দেখা আর কলা বেচা। ভাঁড়িয়ে না বাপ, সব বুঝি। এই ঘুটঘুটে লোডশেডিং-এ খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার যে জোস দেখছি তোমার, তার পিছনে কেবল ডিউটি আছে বললে ঘোড়ায় পর্যন্ত হাসবে।

দূর গাড়ল। মিসেস বোসকে নিয়ে ভেবে ফালতু লাভ কী? একে বড়লোকের বউ, তার ওপর চাবুকের মতো তেজি মেয়ে। আমার মতো ম্যান্তামারাকে পাত্তা দেবে নাকি? স্বপ্নের পোলাও আমি খাই না হে।

রাখো রাখো! মেয়েছেলে ইজ মেয়েছেলে। সে যেমনই হোক, আর যারই বউ হোক। পুরুষের আবার অত কাণ্ডজ্ঞান থাকে নাকি? যার থাকে তার থাকে, কিন্তু তোমার অন্তত নেই।

আমার মন অত নরম নয়। এই তো দেখলে সেদিন দশ-বারো বছরের পুরনো সিগারেটের নেশা, কেমন ছেড়ে দিলাম। ভিতরের ইস্পাতে একটুও মরচে পড়েনি।

যত যা-ই বলল, আমার খুব ভাল ঠেকছে না। মেয়েছেলেটাও ইদানীং তোমাকে একটু একটু নজর করছে। চাকরির কথা ভেবে সাবধান থেকো। গ্যাড়াকলে পড়ে গেলে বোস তোমাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে।

আরে না না। বলতে বলতে দীপ আবছায়ায় একটা মুঠো গয়নার দোকানের সামনে মিসেস বোসের মতো একজনকে দেখতে পেয়ে খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রায় ঘাড়ে শ্বাস ফেলে বলল, মিসেস বোস?

মহিলা মুখ ফেরালেন।

দীপ বলল, সরি।

গলির পর গলি খুঁজে যাচ্ছে দীপা পাচ্ছে না।

তার ভিতরকার দুর্বাসাটা অক্রূর-সংবাদ দিল, লোডশেডিং বলে কেটে পড়েনি তো? খামোখা নাকাল হোচ্ছ খুঁজে খুঁজে।

উহু! দীপ মাথা নেড়ে ভাবে, অন্ধকারে ভয় খাওয়ার মেয়ে নয়।

মার্কেটের মাঝমধ্যিখানে গোল চত্বরটায় দাঁড়িয়ে দীপ চারদিকে গলির মুখের দিকে চিন্তিত চোখে ঢায়। স্ট্র্যাটেজি ভাবে।

ভিতরকার দীপ খুব হাসে, মিসেস বোসকে খোঁজার জন্য যে পরিমাণে হামলে পড়েছ তাতে মনে হচ্ছে না পেলে হার্টফেল করবে। তবে আমি তোমাকে বরং একটা টিপস দিই বুন্ধুরাম। বাইরে গিয়ে কার-পার্কটা খোঁজো। যদি বোসের অফিসের গাড়িটা দেখতে পাও তবে সেখানে একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের নাড়িটা বরং দেখো।

দীপ লম্বা পায়ে দক্ষিণের ফটকের দিকে এগোল। তড়িঘড়িতে কোনওদিকে নজর করছিল না। কিন্তু ভাগ্য সহায়। আচমকাই একটা হ্যাজাকের আলোয় সামনের দোকান থেকে হাতে মস্ত বেতের বাস্কেট ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন মিসেস বোস। পরনে জিনস আর কামিজ।

দীপের বুকের মধ্যে একটা ব্যাং হঠাৎ তার স্থবিরতা ঝেড়ে ফেলে মস্ত এক লাফ মারল।

মিসেস বোস!–দীপের গলা কাঁপছে।

আরে! আপনি এখানে?

আপনার খোঁজেই।

মিসেস বোসের হাত থেকে বাস্কেটটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় দীপ। উনি বাস্কেটটা সরিয়ে নিয়ে বলেন, আই নিড নো হেলপ। আমার খোঁজে আপনাকে কে পাঠাল? মিস্টার বোস নাকি?

আর কে!–দীপ যতদূর সম্ভব অধস্তনের মতো বিনয়ী হেসে বলে।

অন্ধকারটা দীপের চোখে সয়ে গেছে। হ্যাজাকের আলোটাও বেশি চোখ ধাঁধাচ্ছে না। কাজেই আলো-অন্ধকারের সমস্যায় দীপ আর পীড়িত নয়। মিসেস বোসের ভ্রু-র ভাঁজ স্পষ্টই দেখতে পেল সে। এবং ভয় পেল।

তবে ভ্রু কুঁচকেও মিসেস বোস হেসে ফেললেন। বললেন, এটা স্পাইং নয় তো! ফিনানসিয়াল অফেনস ধরার জন্য মিস্টার বোস হয়তো আপনাকে লাগিয়েছেন।

না, না। আমি জাস্ট হেলপ করতে এসেছি।

মিসেস বোস মাথা নেড়ে বলেন, আমার হেলপ দরকার নেই। আমি ওয়ার্কিং উয়োম্যান। নিজেকে আমি শ্রমিক বলে মনে করি।

দীপ বলল, তা হলে মিস্টার বোসকে সেই কথাই বলব তো? আপনি আমার সাহায্য নেননি।

যা খুশি বলবেন। সেটা আপনার ভাববার কথা।

মিসেস বোস চোখে পরকলাটা পরেননি। পরলে ভাল হত। বাগডোগরার পর থেকে মিসেস বোস সম্পর্কে খুব সচেতন হয়ে পড়েছে দীপ। এতকাল তেমন লক্ষ করেনি, কারণ মিসেস বোসও লক্ষ করেননি তাকে। এখন দীপ টের পায়, মিসেস বোসের চোখে একটা অত্যন্ত শানিত এবং সৌজন্যহীন কঠিন দৃষ্টি রয়েছে। ইচ্ছে করলে উনি খুবই অভদ্র হতে পারেন।

দীপ একটু নিভে যায় মনে মনে। ম্লান মুখে বলে, শ্রমিক তো আমিও।

মিসেস বোস হাতের বাস্কেটটা দোলাতে দোলাতে দক্ষিণের ফটকের দিকে হাঁটছিলেন। পিছনে পিছনে বশংবদের মতো দীপ। মিসেস বোস মাথা ঝাঁকিয়ে বব চুলের ঝাপটা মেরে বললেন, কক্ষনও আপনি শ্রমিক নন। খাঁটি শ্রমিক হলে আপনাকে শ্রদ্ধা করতাম। আপনি হলেন মিস্টার বোসের কোর্ট জেস্টার, যাকে পারিষদ বলে।

রাগ অভিমান ইত্যাদি বহুকাল হল দীপের নেই। তার আদ্যন্ত চিন্তা হল টিকে থাকার। নানা ঘষটানিতে তার অনেক ফালতু জিনিস ভোতা হয়ে গেছে। কাজেই এ কথায় সে অপমান বোধ করল না! বলল, কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার পজিশনে না থাকলে আমার প্রবলেমটাও বোঝ যাবে না মিসেস বোস।

মিসেস বোস ঘাড় ফিরিয়ে দীপের দিকে তীক্ষ নজরে এক ঝলক তাকালেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, যদি আমাকে নিতান্তই সম্বােধন করতে হয় তবে দয়া করে আমার নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম মণিদীপা। নিজেকে আমি মিসেস বোস বলে ভাবতে ভালবাসি না। আমাকে যারা চেনে তারা সবাই মণিদীপা বলে ডাকে। মিসেস বোস বলে নয়।

দীপ একটু থমকায়। তারপর আস্তে করে বলে, আমার পক্ষে সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি? মিস্টার বোসই বা কী ভাববেন?

মণিদীপা কঠিন স্বরেই বলেন, আপনি শ্রমিক নন, স্লেভ। বন্ডেড লেবারার। শ্রমিকদের আত্মমর্যাদা আপনার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। তবু আপনাকে বলে দিচ্ছি, যদি মণিদীপা বলে ডাকতে পারেন তবেই ডাকবেন। নইলে সম্বােধন করার দরকার নেই।

অন্ধকার থেকে বাইরের উজ্জ্বল রোদে এলে মণিদীপার চেহারাটা যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠে। পরনে রং-চটা নীল জিনস, গায়ে একটা হলদেটে খাটো টি-শার্ট, বাঁ হাতে গালা দিয়ে তৈরি মোটা একটা বালা, ডান হাতে ঘড়ি। কিন্তু এই নির্মোকের ভিতরে মণিদীপাকে সুন্দর না কুৎসিত দেখাচ্ছে সে বিচার এখন দীপের কাছে বাহুল্য মাত্র। পোশাকের চেয়ে এখন বহুগুণ বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির ব্যক্তিত্ব।

দীপ তার অসফল জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির চোখে চোখ রাখারই সাহস পাচ্ছিল না। আড়চোখে দেখে, শ্যামল দিঘল চেহারা ও কমনীয় সুশ্রী মুখের মেয়েটি যেন তার যাবতীয় বাঙালিয়ানা আর মেয়েলিপনা ঝেড়ে ফেলে বেপরোয়া দাঁড়িয়ে আছে। এত নির্ভয় হাবভাব দীপ কোনও মেয়ের মধ্যে দেখেনি।

মার্কেটের চাতালে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চারদিকে চাইলেন মণিদীপা। কার পার্কে বোস সাহেবের পুরনো মরিস গাড়িটা ধূলিধূসর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপেক রাষ্ট্ররা তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে বোস নিজের গাড়ি আর গ্যারাজ থেকে পারতপক্ষে বের করেন না। অফিসের গাড়িই ব্যবহার করেন। মণিদীপা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে গাড়ির লক করা দরজা খুললেন।

ভদ্রতাবশে দীপ কাছে গেল। দাঁড়িয়েও রইল। কিন্তু কিছু বলার ছিল না বলে কথা বলল না।

মণিদীপা একরকম কঠিন মুখ করে সামনের দিকে চেয়ে থেকে গাড়ি ছাড়লেন।

আস্তে আস্তে হেঁটে দীপনাথ চাদনির দিকে ফিরে আসে। হঠাৎ খেয়াল হয়, মিসেস বোসকে চেকটা দেওয়া হল না। উনিও চাইলেন না।

ভারী অন্যমনস্ক বোধ করে দীপ। রাস্তাঘাট কিছুই খেয়াল করে না। এক রিমোট কন্ট্রোলে চালিত হয়ে সে বিপজ্জনক রাস্তাঘাট পেরোয় এবং নানু মিয়ার দোকানে এসে কাঠের টুলে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। সুটকেসটা সারাই করতে আরও একটু সময় লাগবে।

দীপ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুঝতে পারে, মিস্টার বোস তাকে হয়তো খামোখা শুধুমাত্র তার বউকে হেলপ করার জন্য নিউ মার্কেটে পাঠাননি। তাকে দেখে মণিদীপাও খামোখা রেগে যায়নি। এই দুইয়ের মধ্যে তার বোধের অগম্য কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে।

ঢাউস সুটকেসটা নিয়ে প্রায় দমসম হয়ে রেসের মাঠে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দীপ লম্বা দৈত্যের মতো বোস সাহেবের মুখের বিরক্তিটা লক্ষ করে। গেটের কাছেই ধৈর্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। দীপের দিকে একবার অবহেলায় চেয়ে দেখে বললেন, ফার্স্ট রেস এখুনি শুরু হবে।

দীপ দুঃখিত মুখে বলে, সারাই করতে অনেক সময় লাগল। বাসেও ভিড় ছিল।

ট্যাক্সি নিলেই তো পারতেন।

খুঁজেছি। পেলাম না।

কথাটা ডাহা মিথ্যে। ট্যাক্সি খুঁজলে হয়তো সত্যিই পাওয়া যেত না। কিন্তু দীপ ট্যাক্সির চেষ্টাই করেনি। কারণ, ট্যাক্সি ভাড়া কে দেবে সেটা স্পষ্ট নয়। এমনকী গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে ঢোকার টিকিটের দামটা নিয়েও সে দুশ্চিন্তা করছে।

বোস হিপ পকেট থেকে আনকোরা নতুন এক বান্ডিল দশ টাকার নোট আর একটা প্যাডের কাগজ বের করে দীপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, খুব তাড়াতাড়ি করুন। বেটিং কাগজে লেখা আছে, একটু দেখে কাটবেন।

দীপ এ কাজে নতুন নয়। মাথা নাড়ল এবং সুটকেসটা নিয়েই কাউন্টারের দিকে দৌড়োল। লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজটা আড়চোখে দেখে নেয় সে। সব কটা রেসেই আলাদা করে উইন আর প্লেস খেলছেন বোস সাহেব। ট্রেবল-টোট আর জ্যাকপটের বাছাই রয়েছে পাঁচটা করে। টাকা থাকলে কী দেদার ওড়ানো যায়!

সরু চ্যানেলে সুটকেসটা নিয়ে ভারী অসুবিধে হচ্ছিল। সামনের ও পিছনের লোকেরা তাকাচ্ছে। বিরক্তও হচ্ছে। কিন্তু দীপের কিছু করার নেই। সে পরিষ্কার বুঝে গেছে, লোকলজ্জা জিনিসটার কোনও মানেই হয় না। তার যা কাজ তা তাকে কারও পরোয়া না রেখেই করে যেতে হবে।

দীপ বোস সাহেবের কাগজ দেখে টিকিট কাটল। তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে নিজের জন্যও একটা উইন কাটল। দু’নম্বর ঘোড়ার নাম মালকা। নামটা পছন্দ হল দীপের। নইলে ঘোড়ার সে কিছুই বোঝে না।

বোস সাহেবের সঙ্গে এখন আর দেখা করার দরকার নেই। একদম রেসের পর দেখা হলেই হবে। তাকে শুধু কাগজ দেখে টিকিট কেটে যেতে হবে।

রেস দেখার জন্য স্ট্যান্ডে গেল না দীপা মজবুত সুটকেসটা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার ওপর বসে একটু দম নিল। এই শীতের দুপুর আর তেমন শীতল নয়। তার বেশ ঘাম হচ্ছে। নিজামে ঢুকে রোল খেয়েছিল সস্তায়, এখন সেই রোলের উদগার উঠল একটা। কিন্তু বস্তুত তার পেটে এখনও যথেষ্ট খিদে আছে। দুপুরে ভাত না খেলে সে কোনওদিনই স্বস্তি বোধ করে না।

প্রথম রেসের ঘোড়াগুলিকে দেখতে পেল না দীপ। ভিড়ের মাথা টপকে জকিদের টুপিগুলিকে ছুটে যেতে দেখল শুধু। প্রচণ্ড চেঁচানিতে কান ঝালাপালা। নিস্তেজ হয়ে বসেই রইল দীপ। শুনতে পেল, কিং আরথার বাজি মেরেছে। সে জেতেনি, বোস সাহেবও নন।

দ্বিতীয় রেসের টিকিট কাটতে গিয়ে নিজের জন্য আবার দু’নম্বরই কাটে দীপ। ঘোড়ার নাম স্পার। স্পার কথাটার মানেই জানে না সে। তবু সেই অচেনা নামের ঘোড়ায় সে তার মহার্ঘ টাকা বাজি রেখে মনে মনে বলল, কোনও ঘোড়াই তো চিরকাল হেরে যায় না। একদিন না একদিন একবার হলেও জেতে।

কিন্তু স্পর জিতল না। তবে বোস সাহেবের উইন লেগে গেল এবার।

তৃতীয় রেসেও দু’নম্বর ঘোড়ায় নিজের বাজি ফেলল দীপ। যা থাকে কপালে, আজ লাগাতার দু’নম্বরেই খেলে যাবে। এবার দুনম্বরের বামটাও সুন্দর। ফ্লোরা। লাইনে তার সামনের লোকটাও বোধহয় ফ্লোরাই কাটবে। কারণ সেই লোকটার সামনে আর-একজন মুখ ফিরিয়ে বলল, ফ্লোরার ওপর ধরছিস! ওর কি আগের দিন আর আছে! ফ্লোরার টাকা অনেক খেয়েছি, কিন্তু আর ও টাকা দেবে না।

কিন্তু তাতে দীপের কিছু যায় আসে না। সেই ফ্লোরাতেই বাজি ধরল। এবং জিতল না। বোস সাহেবের ঘোড়াও আর সে মেলায় না। রেসের পর টাকা নেওয়ার সময়েই দেখবে।

চতুর্থ বাজিতে টিকিট কাটতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ল দীপ। দু’নম্বরের নাম লাকি ডিপ। কিন্তু পাঁচ নম্বরের নাম মণিদীপ। আশ্চর্য! কিন্তু পাঁচ নম্বর না কেটে দীপ করেই বা কী! মণিদীপারা যে ভারী তেজি হয়।

দীপ সুটকেস সামলে চ্যানেল থেকে বেরিয়ে এল। এবং খানিকটা অবাক হয়ে দেখল, একটা চেনা মুখের লোক হাঁ করে তাকে দেখছে। কে লোকটা?

পরমুহূর্তেই ভারী লজ্জা পায় দীপ। এ যে মেজদা শ্রীনাথ। কতকাল দেখা নেই।

 ১০. রেসের মাঠে

রেসের মাঠে অবশ্য চেনা লোককেও চেনা দেওয়ার নিয়ম নেই। এই সত্যটা মিস্টার বোসের সঙ্গে রেসের মাঠে এসে এসে বুঝেছে দীপনাথ। তাই সে শ্রীনাথকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এবং আড়চোখে দেখে, শ্রীনাথও অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।

এইভাবেই তারা দুই ভাই দুই দিকে আলাদা হয়ে চলে যেতে পারত এবং দীর্ঘকাল আর তাদের হয়তো দেখা হত না। কিন্তু পরের রেসে টিকিট কাটতে গিয়ে দীপনাথ আর শ্রীনাথ একেবারে আগুপিছু পড়ে গেল। বস্তুত দীপনাথের শাস শ্রীনাথের ঘাড়ে পড়ছে।

তবু কথা বলছিল না দীপ। অন্য দিকে চেয়ে ছিল। টিকিট কেটে বেরিয়ে আসার পর হঠাৎ শ্রীনাথই মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করল, কত নম্বরে ধরলি?

দুই।–খুব লজ্জার সঙ্গে দীপনাথ বলে।

গাধা।–শ্রীনাথের উত্তর।

একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দীপনাথ বলে, বাজে ঘোড়া নাকি?

ঘোড়াই নয়। বললাম তো, গাধা। এসব না বুঝেসুঝে পয়সা নষ্ট করতে আসিস বুঝি?

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, আমি আসি না। বসের সঙ্গে আসতে হয়।

পরেরগুলো অমন আনতাবড়ি খেলিস না। টিপস দিচ্ছি, টুকে নে।

দীপনাথ দ্বিধা করতে থাকে। তার এমন অনেক টাকা নেই যে নষ্ট করবে। টিপস নেওয়াই হয়তো ভাল। শ্রীনাথ এসব হয়তো তার চেয়ে বেশিই বোঝে। সে বলল, টুকতে হবে না। বলল, আমার মনে থাকবে।

শ্রীনাথ সে কথায় কান না দিয়ে একটা বাতিল টিকিটের পিছনে ডটপেন দিয়ে কয়েকটা নম্বর লিখে তার হাতে দেয়। বলে, বিলুদের খবর কী? প্রীতমের নাকি অসুখ! তোর বউদি বলছিল।

খুব অসুখ। হয়তো বাঁচবে না।

কথাটা শুনে শ্রীনাথ একটু কেমন হয়ে যায় যেন। বলে, কী অসুখ? ক্যানসার নাকি?

না। হাড়ের ভিতরে আর নার্ভে ইনফেকশন। ডাক্তার কিছু ধরতে পারছে না।

চিকিৎসার কী হচ্ছে?

যা হওয়ার সবরকম হচ্ছে। আকুপাংচারও।

পরের রেসটা শুরু এবং শেষ হল। তুমুল হট্টগোলেও দুই ভাই তেমন উত্তেজিত হল না। কিন্তু বোর্ডে নম্বর উঠলে দু’জনেই পুতুলের মতো টিকিটের নম্বর মিলিয়ে নিল। দীপ জেতেনি। কিন্তু শ্রীনাথের মুখে সামান্য হাসির ফুসকুড়ি গলে যাওয়ায় দীপ বুঝল, মেজদা জিতেছে। সে বলল, প্রীতমকে কোথাও একটু চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া দরকার। কাছেপিঠে হলেই ভাল হয়।

এতক্ষণ আড়চোখে দীপনাথের হাতের সুটকেসটা বারবার দেখছিল শ্রীনাথ। হঠাৎ বলল, কোথাও যাচ্ছিস নাকি? হাতে সুটকেস কেন?

না, এটা সারানো হল।

শ্রীনাথকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল দীপনাথের। কোনও দিকেই যেন ঠিক মন নেই অথবা বহু দিকেই মন দিতে হচ্ছে। কথা বলতে বলতে ভিড়ের মধ্যে কার দিকে চেয়ে যেন একটু চোখের ইশারাও দিল।

দীপনাথের মনে হয়, শ্রীনাথের কোথাও একটা গূঢ় পরিবর্তন ঘটেছে। চালচলতির মধ্যেই একটা উড়ুউড় ভাব।

শ্রীনাথ আনমনে কী একটু ভেবে হঠাৎ বলল, ওদের টাকা-পয়সা কীরকম?

সেটা এখনও কোনও দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। অফিস থেকে প্রীতম বেশ কিছু টাকা পেয়েছে।

শ্রীনাথ ভ্রু কুঁচকে বলল, গত বছরই তো ভাইফোঁটা নিয়ে এলাম। বিলু সেবার মস্ত মস্ত গলদা চিংড়ি আনিয়েছিল, চল্লিশ না পঞ্চাশ টাকা কেজি। তখনও খারাপ কিছু দেখিনি প্রীতমের।

গত বছর! ভুল বলছ। গত বছর নয়, তার আগের বার।

তাই নাকি? হতে পারে। বিলুর সদ্য একটা মেয়ে হয়েছিল তখন। সেটা তখনও খুব ছোট। আর কিছু হয়েছে তার পরে?

না। তুমি বহুকাল যাও না বিলুর বাসায়।

এবার একদিন যাব।

দীপ একটু রাগ করে বলল, রেসের মাঠ পর্যন্ত আসতে পারলে। বিলুর বাসা আর কত দূর! এখান থেকে ভবানীপুর তো হেঁটেই যাওয়া যায়।

শ্রীনাথ একটু হাসল। একসময়ে সে সুপুরুষ ছিল। বয়েসকালে আবার চেহারাটা জেল্লা দিচ্ছে। তবে বড়ই নরম পৌরুষহীন চেহারা। কিন্তু হাসলে চেহারার জেল্লা ভেদ করে একটা বিষণ্ণতা যেন ফুটে বেরোতে চায়। বলল, এই পথটুকু পার হওয়া যে কত শক্ত!

পুতুলের মতোই নিজেদের অজান্তে পরের রেসটার জন্য টিকিট কাটতে কাউন্টারে এসে দুই ভাই দাঁড়ায়। দীপনাথ বলে, ওটা কোনও কাজের কথা নয়। একটা লোক মরতে চলেছে, তাকে এই বেলা একবার শেষ দেখাও তো দেখে আসতে হয় মেজদা। নইলে কথা থাকবে।

যেতেই হবে!–দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীনাথ বলে।

দীপনাথ শ্রীনাথকে নিশ্চিন্ত করার জন্য খুব সাবধানে বলল, ওদের টাকা-পয়সার বা অন্য কোনওরকম হেলপ দরকার নেই। জাস্ট মাঝে মাঝে গিয়ে একটু মনোবল বাড়িয়ে আসা আর কী! প্রীতমটা বেঁচে থাকার জন্য কত যে আকুলি-বিকুলি করে।

শ্রীনাথ আবার একটু হাসে। বলে, টাকাপয়সার দরকার হলে দিতে ভয় পাব নাকি?

আমি সেভাবে বলিনি।

দূর বোকা! আমিও সেভাবে বলছি না। আসলে আমার যেটুকু আছে তা নিতান্তই আমার। সে অবশ্য সামান্যই। দাদার টাকা তো আর আমার নয়। তোর বউদির। আমারটুকু আমি দিতে পারি।

এই একটা রহস্য থেকে গেল চিরকাল। কেন যে বড়দা মল্লিনাথ তার যাবতীয় বিষয়-আশয় ভাইয়ের বউকে লিখে দিয়ে গেল তা কে বলবে! দীপনাথের কোনও লোভ নেই বটে, কিন্তু ব্যাপারটা মনে পড়লে তার খুব ধাঁধা লাগে। কিছু কুকথাও শুনেছে সে মল্লিনাথ আর বউদিকে নিয়ে। কথাগুলো সুখশ্রাব্য নয়। গায়ে জ্বালা ধরে যায়।

দীপনাথ বলল, বলছি তো, ওদের টান্সার দরকারটা আদপেই প্রধান নয়। ওদের যেটা নেই সেটা হল আপনজন।

কথাটা শ্রীনাথের বোধহয় মনোমত হল। ওপর নীচে বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলল, ওইটেই তো সবচেয়ে বড় সমস্যা। আপনজন পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন। জন থাকলেও তারা আপন হতে চায় না। তুই নম্বর দেখে টিকিট কাট।

তাই কাটে দীপনাথ।

বাইরে এসে শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে, এখন কী করছিস?

একটা গুজরাটি কোম্পানির ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সেক্রেটারি।

কত দিচ্ছে-থুচ্ছে?

দেয় একরকম। চলে যায়।

ওটা কোনও কাজের কথা নয়। পে স্কেল আছে তো?

না। চাকরিতে সদ্য ঢুকেছি, ওসব এখনও ঠিক হয়নি।

বিয়ে করে বসিসনি তো?

না।

করিস না। ও ঝামেলায় না যাওয়াই ভাল।’

শ্রীনাথের মুখে এ কথা শুনবে বলে আশা করেনি দীপনাথ। বউদির সঙ্গে কি তা হলে ওর বনিবনা হচ্ছে না!

শ্রীনাথ নিজেই রহস্য পরিষ্কার করে দিয়ে বলল, চারদিকে এত থিকথিকে মানুষজন দেখে আমার বিয়ের ওপর বিতৃষ্ণা এসে গেছে। আর লোক বাড়িয়ে লাভ কী? তা ছাড়া আজকালকার মেয়েরা যত্নআত্তিও জানে না। ঘাড়ে চেপে বসে বসে খায় আর রক্ত শোষে।

কথাগুলো নীরবে শুনল দীপ। মনে মনে হাসল। দীপনাথের ভালমন্দ ভেবে এত কথা বলেনি মেজদা। ও নিজের কথা ভেবে বলছে। দুনিয়ার সব মানুষই আজকাল নিজের নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আর পাঁচটা লোকের ভালমন্দ বিচার করে।

শ্রীনাথ আর দীপনাথ দু’জনেই এই রেসটায় মার খেল। শ্রীনাথের টিপস মেলেনি। তবে দীপ অন্যমনস্কতার মধ্যেও চমকে উঠে দেখল, এই রেসে বাজি মেরেছে দু’নম্বর ঘোড়া। তারও আজ আগাগোড়া দু’নম্বরে বাজি ধরারই সংকল্প ছিল। ধরলে ঠকতে হত না।

শ্রীনাথ নিজের টিকিটটা দুমড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোর মেসের ঠিকানাটা দিয়ে রাখিস তো। একবার দিয়েছিলি, সেটা বোধ হয় হারিয়ে গেছে।

দীপ বলে, হারিয়ে ভালই হয়েছে। সেই বোর্ডিং-এ আমি আর থাকি না। এখনকার ঠিকানা আলাদা। অনেকদিন আমার কোনও খোঁজ রাখো না মেজদা!

তুই নিজেই কি রাখিস!

রতনপুরে সবাই ভাল আছে?

আছে ভালই। সবজি, ডিম, মাছ সব বাড়িতে বা জমিতে হচ্ছে। খাঁটি সব জিনিস পাচ্ছে, ভাল থাকার কী?

সজল কত বড় হল?

এঁচড়ে পাকা।

অনেকদিন আগে ওকে চিড়িয়াখানা দেখাব বলে কথা দিয়েছিলাম। সেটা আর হয়নি।

চিড়িয়াখানা বহুবার দেখেছে। চিন্তা নেই। তা ছাড়া নিজেদের বাড়িতেই তো চিড়িয়াখানা। কত পাগল, ছাগল, সাধু, বদমাশের আনাগোনা।

শ্রীনাথের কথার ভিতর একটা ভয়ংকর বিদ্বেষ আর ঘৃণা ফুটে বেরোচ্ছে। ঠিক অনুধাবন করতে পারছে না দীপনাথ। তবে আঁচটা গায়ে লাগছে। শ্রীনাথ কখনও বোধহয় কাউকে সুখী করেনি, সুখী সে নিজেও হয়নি।

পরের রেসগুলিতে একের পর এক দু’নম্বর ঘোডা বাজিমাত করে গেল। শ্রীনাথের একটা টিপসও মিলল না। সেজন্য শ্রীনাথকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্বধর্মে মরাও যে ভাল এই আপ্তবাক্যটা যে মনে রাখেনি দীপ! নিজের সংকল্পে অচল থাকলে সে আজ বহু টাকা জিততে পারত।

শ্রীনাথ দাঁড়াল না। রেস শেষ হতেই বলল, চলি রে।

ভিড়ের ভিতর দুর থেকে মেজদাকে লক্ষ করছিল দীপনাথ। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল, রেসের মাঠে মেজদা একা আসেনি। দীপনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ভিড়ের মধ্যে কাকে যেন চোখের ইশারা দিচ্ছিল।

দীপনাথের অনুমান মিথ্যে নয়। শ্রীনাথ পেমেন্ট কাউন্টারের কাছ বরাবর পৌঁছলে একটা কালো মতো বদমাশ চেহারার লোক আর ফর্সা মতো একটা মেয়ে তার সঙ্গ নিল।

গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড থেকে বোস নেমে আসে। সঙ্গে তার সমপর্যায়ের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং তাদের দু’জনের দু’রকম সুন্দরী দুটি স্ত্রী। সবাই খুব হাসছে। প্রায় সবাইকেই চেনে দীপ।

ক্লাইন ওয়ালকটের পি আর ও দত্ত দীপকে দেখে বলে উঠল, হ্যাল্লো! হাউ ইজ লাইফ?

দত্তর মুখটা রক্তাভ। আলগা একটা চকচকে ভাব তার চোখে। অঢেল বিয়ারের প্রভাব। দীপ মৃদু হেসে বলল, টেরিফিক।

তার হাতের সুটকেসটা সবাই দেখছে, তবে ভদ্রতাবশে কেউ জিজ্ঞেস করছে না কিছু। সবাই ফটকের দিকে হাঁটছে। দীপ বুঝতে পারছে না উইনিং টিকিটের পেমেন্টগুলো কে নেবে! সে জানে, বোস নিজে পেমেন্ট নিতে ভালবাসে। আজও নিজেই নেবে কি? সুটকেস নিয়ে দলের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে এই ছোট সমস্যাটা আবার ভাবিয়ে তুলল তাকে। কোনও ব্যাপারেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে দ্বিধাগ্রস্ত ও সমস্যাপীড়িত মন নিয়ে সে মহিলা দু’জনের সৌন্দর্যও ভাল করে উপভোগ করতে পারছে না।

ফটকের কাছাকাছি এসে অবশ্য বোস তাকে সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়ে বলল, দীপবাবু, আপনি বরং পেমেন্টটা নিয়ে আসুন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।

সুটকেস দুলিয়ে দীপ দৌড়ল। বোস প্রায় হাজার দুয়েক টাকা জিতেছে। টাকায় টাকা আনে। বেশি টাকা না খেললে এ টাকাটা উসুল করতে পারত না বোস। দীপ নিজে একটির বেশি দুটি টিকিট কাটার সাহস পায়নি। সামনের লাইনে দু-চারজনের মুখে খুব ফ্যাকফেকে হাসি। একজন চেঁচিয়ে বলছে, আজ ছিল দুইয়ের দিন।

দীপ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মেজদার সঙ্গে দেখা না হলে সে আজ দুই নম্বর ঘোড়াগুলোর ওপর খেলত। কিছু অন্তত জিতেও যেত। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার নামই তো ঘোড়দৌড়।

পেমেন্ট নিয়ে দীপ বাইরে এসে দেখে, বোসের গাড়িতে বসার জায়গা নেই। বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীরা জায়গা জুড়ে বসে আছে। বোস দীপকে বলল, সুটকেসটা লাগেজবুকে দিয়ে দিন।

টাকাটা?–দীপ জানালায় ঝুঁকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে।

আপনার কাছে থাক। একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসুন।

গাড়ি ছেড়ে দেয়।

দীপ তার প্যান্টের গুপ্ত পকেটে টাকার বান্ডিলটা অনুভব করতে করতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বসের কোনও সন্দেহ নেই, তা সে জানে। কিন্তু ভয় কলকাতার চাল পকেটমারদের। টাকাটা মার গেলে শশাধ করার সাধ্য তার নেই।

রেসের মাঠ থেকে শেয়ারের ট্যাক্সি ছাড়া গতি নেই।

রেসে হারা চারজন গোমড়ামুখো লোকের সঙ্গে একটা ট্যাক্সিতে জায়গা পেল দীপ। সামনের সিটে ড্রাইভার আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং আর-একজন যাত্রীর মাঝখানে খুবই ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়েছে তাকে। শীতকাল বলে অতটা কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ভারী আড়ষ্ট লাগছে। পিছনে হেরে রেসুড়েরা বলছে, কে জানত লাইটনিং জিতবে? পুরো গট আপ কেস।… আমি নিজে দেখেছি টপ স্কোরারকে বাঁকের মুখে ইচ্ছে করে জকি টেনে রাখছিল।… মন্দাকিনী বোধ হয় জীবনে এই প্রথম জিতল।… স্টেটসম্যান ওটাকে ফ্লকে রেখেছিল….

দীপ অত্যন্ত সজাগ হয়ে বসে আছে। তার সমস্ত মনপ্রাণ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে গুপ্ত পকেটের দু’হাজার টাকার ওপর। হাত দিয়ে ছুঁয়ে টাকাটা আছে কি না দেখতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু সেটা ভারী বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। লোকে জেনে যাবে, টাকা আছে।

তারাতলায় নেমে আর বাস-টাস ধরল না দীপ। সোজা হাঁটা দিল। নিউ আলিপুরের ও ব্লক অনেকটা দূর। তবু হাঁটাই ভাল।

শীতের অন্ধকার দেখতে না দেখতে নেমে আসে। দীপের ঘেমো শরীরে উত্তরের হাওয়া লেগে শিরশির করতে থাকে। তবু একটু রোমাঞ্চও আছে কোথাও। মনের গভীরে কি সত্যিকারের পাপ আছে তার? তবে কেন বোস সাহেবের ফ্ল্যাটে যেতে তার একরকম তীব্র সুখের অনুভূতি হচ্ছে? এখনও সেই কাটা চেকটা তার বুক পকেটে। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামটা সে একটুও ভুলে যায়নি।

বোসের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দীপ দেখল, বোস এখনও আসেনি। সাদা উর্দিপরা একজন বেয়ারা দরজা খুলে দিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ের মাঝখানে প্ল্যাস্টিকের ফুলছাপ পরদাটা টেনে দিল। ড্রয়িংরুমের ফাঁকা নির্জনতায় বসে দীপ টের পাচ্ছিল ডাইনিং হলে আজ কোনও ভোজর আয়োজন হচ্ছে। অন্তত দু-তিনজন বেয়ারা নিচু স্বরে কথা বলতে বলতে টেবিল সাজাচ্ছে। প্লেট আর চামচের শব্দ হচ্ছে টুং টাং।

বড়লোকদের ড্রয়িংরুম যেরকম হয় বোসেরটাও তাই। ভাল সোফাসেট, পেতলের ছাইদানি, মেঝেয় কার্পেট, কাচের স্ল্যাব বসানো সেন্টার টেবিল, ঘোমটা দেওয়া স্ট্যান্ডের আলো, টি ভি সেট এবং অপরিহার্য বুক-কেস।

মিসেস বোস বা মণিদীপার কোনও সাড়াশব্দই পেল না দীপ। ভদ্রমহিলা আদৌ বাড়িতে আছেন কি না তাও বুঝতে পারছে না। এ বাড়িতে তার যাতায়াত বেশ কিছু দিনের। কিন্তু এখনও সে ড্রয়িংরুমের সীমানা পার হতে পারেনি।

খবর না দিলে মণিদীপা হয়তো খবর পাবেন না ভেবে দীপ উঠে গিয়ে পরদা সরিয়ে একজন বেয়ারাকে বলল, মেমসাহেব বাড়িতে নেই?

আছেন। ড্রেস করছেন।

তাঁকে একটু সেলাম দেবে? বলো, দীপনাথবাবু এসেছেন।

বেয়ারা তেমন গা করল না যেন। তবে মাথা নাড়ল।

দীপ আবার এসে সোফায় বসে এবং একটি ইংরেজি ফ্যাশনের পত্রিকা তুলে নিয়ে ছবি দেখতে থাকে।

মণিদীপা নিঃশব্দে এলেন না। এলেন চাকরবাকর বা বেয়ারাদের কাউকে অনুচ্চস্বরে বকতে বকতে। কারও কোনও দোষ হয়ে থাকবে।

ড্রয়িংরুমের পরদা সরিয়ে ভিতরে এসে চুপ করে দাঁড়ালেন মণিদীপা। ‘কী খবর’ বা ‘এই যে, কখন এলেন’ গোছের কোনও প্রশ্ন করলেন না। দাঁড়িয়ে খুব খরচোখে দীপকে দেখছিলেন। পরনে একটা কাপতান। জাপানি কিমোনো ধরনের ভারী ঝলমলে পোশাক। মুখে রূপটান মাখা শেষ হয়েছে। মস্ত মৌচাকের মতো করে বাঁধা খোঁপা। দীপের যতদূর মনে পড়ে, ওঁর মাথার চুল বব করা। তবু খোঁপাটা কী করে সম্ভব হল তা ভেবে পায় না সে। মণিদীপার গা থেকে ভারী মোহময় একটা সুবাসও আসছিল। সম্ভবত ফরাসি সেন্ট।

দীপ মুখ তুলে বলল, সকালে সেই চেকটা দেওয়ার কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

মণিদীপা একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা নিয়ে আপনি অত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? খুব ইমপর্ট্যান্ট কিছু নয়।

দীপ বুকপকেটে চেকটা খুঁজতে খুঁজতে বলে, আপনার কাছে না হলেও আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। আপনিও চেয়েছিলেন।

বুকপকেট থেকে রেসের বাতিল টিকিট, ঠিকানা লেখা কাগজ এবং ভাউচার ইত্যাদি একগাদা কাগজ বেরোল বটে, কিন্তু চেকটা নেই। নেই তো নেই-ই। পোশাকে যে ক’টা পকেট ছিল সবই হাঁটকে ফেলল দীপ। মুখ লাল হয়ে উঠছে তার, কান মাথা ঝা ঝা করছে। চেকটা তার সঙ্গে হঠকারিতাই করে বসেছে শেষ পর্যন্ত।

মিসেস বোস নিঃশব্দে ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন। মুখে মৃদু জ্বালাভরা হাসি। দীপের খোঁজা এবং পাওয়ার পালা শেষ হলে বললেন, খামোখা ব্যস্ত হচ্ছেন। আমিই তো বলছি চেকটার কোনও দাম নেই।

দীপ নিভে গিয়ে বলে, আমি কিন্তু পকেটেই রেখেছিলাম। রেসের মাঠে হয়তো–

আপনি নিশ্চিন্তে বসুন। ওটা কেউ পেয়ে থাকলেও ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমাকে ব্ল্যাকমেল করা অত সহজ নয়।

দীপ শিউরে ওঠে। আজ সকালে সেও ব্ল্যাকমেলের কথাই ভেবেছিল না কি? সে তাড়াতাড়ি বলল, না, ব্ল্যাকমেলের কথা নয়।

তবে আর কিসের ভয়? চেকটা এমনভাবে কাটা হয়েছে যে ওটা আর ক্যাশ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ব্যাংকে আমার অত টাকাও নেই। স্নিগ্ধ বেচারা খামোখা ব্যাংকে গিয়ে হয়রান হয়েছিল।

দীপ চুপ করে বসে থাকে। ভারী লজ্জা করছে চেকটা হারিয়ে ফেলায়। উনি হয়তো ভাবছেন, চেকটা সে-ই রেখে দিয়েছে। প্রয়োজনমতো কাজে লাগাবে।

মণিদীপা অতিরিক্ত স্নেহের সঙ্গে বললেন, মিস্টার বোস বোধ হয় রেসের পর কোথাও বসে বিয়ার-টিয়ার খাচ্ছেন। আপনাকে বসতে হবে। একটু চা বলে দিই?

চা!–বলে দীপ একটু ভাবে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, দরকার নেই। আমি বরং উঠে পড়ি। উইনিং টিকিটের টাকাটা যদি আপনি রেখে দেন—

বলতে বলতে দীপ উঠে প্যান্টের গুপ্ত পকেটের দিকে হাত বাড়ায় এবং ভাবে, হায় ভগবান! চেকটার মতো টাকাগুলোও যদি এতক্ষণে ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে গিয়ে থাকে।

মণিদীপা মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে বোস সাহেব অত বিশ্বাস করেন না দীপনাথবাবু। আমি বিশ্বস্তও নই। টাকাটা আমার হাতে এলে আমি নিশ্চয়ই খরচ করে ফেলব। তখন আপনি খুব মুশকিলে পড়বেন। বরং একটু বসুন, মিস্টার বোস এসে যাবেন।

দীপ সুতরাং বসে পড়ে। বলে, টাকাটা যে আপনার হাতে দেওয়া যাবে না এমন কথা কিন্তু মিস্টার বোস আমাকে বলেননি।

মণিদীপা হেসে বলেন, ও কখনও বলবে না। কিন্তু এইসব ছোটখাটো ঘটনার ভিতর দিয়ে আপনার বুদ্ধিকে ও পরীক্ষা করবে। নাড়ুগোপালের মতো চেহারা দেখে ওকে বোকা ভাববেন না। ও শেয়ালের মতো চালাক। পরীক্ষায় আপনি পাশ করলেই যে ও আপনাকে কোনও চান্স দেবে তাও ভাববেন না। মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করাটা ওর হবি। আমাকেও অনবরত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।

বলে মণিদীপা ইংগিতপূর্ণভাবে চুপ করে থাকেন।

দীপ বোঝে, এটাও একটা পরীক্ষা। মণিদীপা দেখছেন, সে ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করে কি না। সে ইদানীং চালাক হয়েছে, তাই ওসব কথার ধার দিয়েই গেল না। বলল, টাকাগুলো যতক্ষণ সঙ্গে থাকবে ততক্ষণই অস্বস্তি।

টাকার কিছু হ্যাজার্ডস তো আছেই।–বলে মণিদীপা একটু হাসলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবাব পাশের কৌচে বসে বললেন, কত টাকা জিতেছে ও?

প্রায় দু’হাজার।

মণিদীপা ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে বললেন, টাকা আয় করা কারও কারও কাছে কত সোজা!

তা ঠিক। মণিদীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আপনিও রেস খেললেন নাকি?

আমার ভাগ্যটা একদম কানা। চল্লিশ টাকার মতো হেরে গেছি।

কোনও দিন জিতেছেন?

না।

তা হলে আপনাকে ভাগ্যবানই বলতে হয়।

কেন?

 

জিতলে রেসের মাঠের নেশা আপনাকে ভূতের মতো পেয়ে বসত। আমিও প্রথম প্রথম ওর সঙ্গে খুব যেতাম। কিন্তু প্রত্যেকবার হেরে হেরে বিরক্তি ধরে যাওয়ায় আর যাই না। কিন্তু টের পেতাম যারা এক-আধবার জেতে তারা আর নেশাটা কিছুতেই ছাড়তে পারে না।

দীপ একটু হেসে বলল, আমার প্রবলেমটা তা নয়। আমি যে-কোনও নেশাই ছাড়তে পারি।

মণিদীপা মাথা নেড়ে বলেন, ইউ আর নট একসেপশন।

দীপ হঠাৎ টের পায় তার নামের সঙ্গে মণিদীপার নামের একটা আশ্চর্য মিল আছে। সে দীপনাথ, আর মিসেস বোস মণিদীপা। এতক্ষণে এ মিলটা তার মনে পড়েনি তো! আশ্চর্য!

দীপ বলল, আসলে আমি কোনও কিছুতেই তেমন ইন্টারেস্ট পাই না। আমার আগ্রহ শুধু কোনওক্রমে বেঁচে থাকার।

মণিদীপা উদাসভাবে বললেন, আমারও কি তাই নয়? সকলেরই তাই। তবু মানুষের ইন্টারেস্টেরও তো শেষ নেই। রেসের মাঠে আমি আমার স্কুলের একজন পুরোনো মাস্টারমশাইকে দেখতে পেয়েছিলাম, যাকে সবাই সাধুসন্ত বলে মনে করত।

মণিদীপা চায়ের কথা বলেননি, কিন্তু তবু চা এল। ট্রে ভরতি চায়ের পট, দুধের পাত্র, চিনির বোল, একটা মস্ত প্লেটে নিউ মার্কেটের ভাল কেকের একটা বড় টুকরো, দুটো বড় সন্দেশ আর একটা কাটলেট গোছের জিনিস। এ বাড়িতে দীপ কদাচিৎ আপ্যায়িত হয়েছে। এতটা তো কোনওদিনই নয়। সে বলল, এত?

আমার বাপের বাড়িতে লোক এলে চা আর খাবার দেওয়ার নিয়ম। গরিবদের বাড়িতেই ওসব নিয়ম থাকে। বড়লোকরা খুব কাঠ-কাঠ ডিসিপ্লিনে চলে, তাই অতিথি আপ্যায়ন না করলেও বলার কিছু নেই। তবে মাঝে মাঝে গার্টি দিতে হয়। আজ যেমন।

দীপ চুপ করে রইল। চুপ করে থাকার চেয়ে বড় কূটনীতি তার জানা নেই। অল্পস্বল্প খাচ্ছিলও সে। তবে খুব সংকোচের সঙ্গে।

মণিদীপা হঠাৎ খুব হেসে উঠে বললেন, সত্যিই আপনার কোনও ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নেই দেখছি!

দীপ কৌতূহলে মুখ তুলে বলে, কেন?

একবারও তো জিজ্ঞেস করলেন না স্নিগ্ধদেব লোকটা কে!

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, আমার জানার দরকার তো নেই।

দরকার নেই, সে তো ঠিকই। কিন্তু কৌতূহলও কি হয় না?

দীপ কেকটার তেমন স্বাদ পাচ্ছিল না, ভালই হওয়ার কথা। বলল, কেউ একজন হবেন। হয়তো আপনার ভাই-টাই।

কী বুদ্ধি! আমি বোসের বউ হলে আমার ভাই চ্যাটার্জি হয় কী করে?

অসবর্ণ তো হতে পারে!

মোটেই না। আমার বাপের বাড়ি মিত্র।

ও। তা হলে বন্ধু?

মণিদীপা মস্ত এক শ্বাস ছেড়ে বললেন, শুনলে হাসবেন। স্নিগ্ধদেবের বয়স চল্লিশের ওপর। রং কালো, চেহারা রোগা এবং দেখতে মোটেই ভাল নয়। মাথার চুল পাতলা হয়ে টাক পড়ে এল প্রায়। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে আছে। স্কুলমাস্টার এবং বেশ গরিব।

গরিবকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন?

না। টাকাটা ওকে দিচ্ছিলাম, ও পার্টি-ফান্ডে জমা দেবে বলে।

রাজনীতির লোক নাকি?

ভীষণ। এবং এত গাটসওয়ালা লোক এ দেশে দুটো নেই। আপনি যদি ওর সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলেন তা হলেই আপনার লাইফ-ফিলজফি পালটে যাবে।

দীপ খুব চালাকের মতো বলে, তা হলে দেখা না করাই ভাল।

আসলে দীপ ব্যক্তিপূজা ভালবাসে না। এলেমদার যে-কোনও লোককে বিগ্রহের আসনে বসাতে সে রাজি নয়।

মণিদীপা বললেন, আপনি ওকে চেনেন না।

দীপ লক্ষ করে মণিদীপার চোখে হঠাৎ স্বপ্নের সুদূর ফুটে উঠল।

 ১১. এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি

এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি আছে। দাম পঁচিশ হাজার।

বড্ড বেশি। নাকতলায় এত বেশি জমির দাম নয়।

নাকতলা কি আগের নাকতলা আছে বউদি? জমির সামনে যোলো ফুট চওড়া রাস্তা হবে।

সে যখন হবে তখন দাম বেশি দেব।

আসলে জমিটা পছন্দও নয় বিলুর। বড় ঘিঞ্জি পাড়ার মধ্যে, চারধারে বড় বড় বাড়ি। রাস্তাও ভাল নয়। কাঁচা ড্রেন থেকে ঝাঁঝালো কটু গন্ধ আসছে। সে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে একটু পিছিয়ে এল। পাশেই একটা দোতলা বাড়ি থেকে একটা বউ তাকে লক্ষ করছে।

দালাল লোকটা মরিয়া হয়ে বলল, দুটো প্লট ছেড়ে পরের প্লটে একজন ফিল্ম স্টার থাকে।

কৌতূহলে বিলু জিজ্ঞেস করে, কে?

দালাল যার নাম বলল সে আসলে পড়তি অভিনেত্রী। বিলু তাই আগ্রহী হল না। বলল, গলফ ক্লাবের একটা প্লটের কথা বলেছিলেন যে।

দালাল খদ্দেরের ধাত বুঝে একটু অবহেলার স্বরে বলে, সে বিক্রি হয়ে গেছে। আরও বেশি দাম ছিল।

এই শীতেও পরিশ্রান্ত বোধ করে বিলু। সকাল থেকে এ পর্যন্ত গোটা চারেক প্লট দেখল। বেহালা, কসবা, গড়িয়া আর নাকতলা। সবই কলকাতার বাইরের অঞ্চল। কিন্তু কোথাও তেমন খখালামেলা নেই আর। অবারিত মাঠঘাট নেই। আবার লোকবসতি বেশি বলে তেমন ফ্যাশনদুরস্ত বাজারহাট বা দোকান-পসারও তেমন হয়নি। ভবানীপুরে থেকে থেকে অভ্যাসটাই খারাপ হয়ে

গেছে।

গাড়িটা অনেক দূরে রাখতে হয়েছে। এত দূরে গাড়ি আসেনি। হয়তো আসত, কিন্তু দালালই সাহস পায়নি রাস্তা ভাল নয় বলে।

বিলু একটু উম্মার সঙ্গে বলে, পছন্দসই একটা জমিও কিন্তু আপনি দেখাতে পারলেন না।

দালাল লোকটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, কোনওটা তো অপছন্দের নয় বউদি। এই জায়গাগুলো সবই ডেভেলপ করবে, তখন দেখবেন প্লটটা নিয়ে রাখলেন না বলে দুঃখ হবে।

ডেভেলপ করেনি বলছেন, তা হলে দামই বা অত বেশি কেন? এসব জায়গার দাম আরও কম হওয়া উচিত।

দালাল মাথা নেড়ে বলে, পঁচিশ হাজার আজ বলছে। এক মাস পরেই দেখবেন, ত্রিশ উঠে গেছে। আর জমির দাম একবার উঠলে আর কখনও নামে না। ওই একটা জিনিস কেবল উঠেই যাবে।

শীতের রোদ বলে রোদের তেজ কম নয়। মাথা বাঁচাতে ঘোমটা দিয়েছে বিলু, চোখ বাঁচাতে গগলস্‌। এখন বেলা বাড়ায় একটু গরমও লাগছে। হেঁটেছে অনেকটা।

দালাল শেষ কথা বলল, জমির তো আর সাপ্লাই বাড়বে না। ও ভগবান যা মেপে দিয়ে রেখেছেন। তাই চিরকাল থাকবে। কিন্তু চাহিদা বেড়েই যাবে, দামও চড়বে। যত সব বড় ফ্যামিলি ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে জমির জন্য হন্যে হয়ে উঠছে লোক। বাপ নিজে বাড়ি করল তো তার তিন উপযুক্ত ছেলে তিনটে বাড়ি হাঁকাল, কেউ কারও সঙ্গে থাকতে চায় না আজকাল। প্রত্যেকেই চায় আলাদা সংসার, আলাদা বাড়ি। তা ছাড়া বাড়িওয়ালারা হুড়ো দেয় বলেও লোকে নিজে বাড়ি করতে চায়।

অরুণের সাদা অ্যামবাসাডার গাড়ি রোদে ঝিকোচ্ছে বড় রাস্তায়, অরুণ পিছন ফিরে প্রীতমকে কী যেন বলছে। পিছনের সিটে প্রীতম বসে আছে নির্জীব হয়ে। সে কিছুই শুনছে বলে মনে হল না। চোখ বোজা, ঠোঁটে ক্লান্ত একটু হাসি।

অরুণ বলল, পছন্দ হয়েছে?

না, বড্ড ঘিঞ্জি।

তোমার জন্মেও পছন্দ হবে না।

বিলু কুটি করে বলে, পছন্দের মতো হলেই পছন্দ হবে।

দালাল লোকটা সামনের সিটে অরুণের পাশে উঠে বসে। বিলু পিছনের সিটে প্রীতমের পাশে বসে বলে, তোমাকে খামোখা কষ্ট দিলাম।

প্রীতম চোখ মেলে চেয়ে বলে, খুব নয়, তবে এখন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

শোবে? শোও না!–বলে বিলু নিজের কোল দেখিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসে।

প্রীতম শোয় না। অরুণের সামনে কেমন দেখাবে। সে বলল, না, পারব।

একটা বা দুটো বালিশ আনলে পারতে।–অরুণ গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলে।

ভুল হয়ে গেছে।–বিলু জবাব দেয়।

প্রীতম লজ্জার সঙ্গে বলে, না না, সেটা খারাপ দেখাত। আমার অত বেশি কষ্ট হচ্ছে না।

হলেই কি আপনি বলবেন!–অরুণ মুখ ফিরিয়ে একটু হাসে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, আপনি তাজ্জব লোক।

কেন?–মৃদু উদাস গলায় প্রশ্ন করে প্রীতম। ঠিক প্রশ্নও নয়। সে যে একটু তাজ্জব লোক তা সে জানে।

আপনি ভাবেন, নিজের কষ্টের কথা স্বীকার করার মানেই হল, ডিফিট।

এ কথার নিশ্চয়ই জবাব হয়। কিন্তু প্রীতম জবাব দেওয়ার মতো দমে কুলিয়ে উঠতে পারে না। বহুক্ষণ সে বসে আছে। হেলান দিয়ে যথেষ্ট নরম গদিতে ড়ুবে থাকা সত্ত্বেও তার শরীর এখন খাড়া থাকতে চাইছে না। শরীরের জীবাণুরা খেপে উঠছে। ঝিঝি ডাকছে সারা পা জুড়ে।

একটু মাথা হেলিয়ে দিতেই বিলুর কাঁধে আশা পায় সেটা। বিলু বলে, তোমার লজ্জার কী? ভাল করে মাথা রাখো।

প্রীতম আবার ঘাড় সোজা করে বসে।

উঠলে কেন?

রাস্তাঘাট দেখি। বহুকাল এসব দিকে আসিনি।

বিলু মৃদু স্বরে বলে, দেখতে হবে না। মাথাটা আমার কাঁধে রেখে চোখ বুজে থাকো। কোনও কাজ হল না আজ, শুধু শুধু তোমাকে টেনে আনলাম।

প্রীতম উদাসভাবে বসে থাকে। বলে, পছন্দ হল না কেন?

পাড়াগুলো কেমন যেন!

কেমন?

ভাল নয়।

সব জায়গাতেই মানুষ থাকছে। তুমিও থাকতে পারবে।

এটা বুঝি কোনও কথা হল? মানুষ তো উত্তর মেরুতেও থাকে, মরুভূমিতেও থাকে।

নাকতলা তো মেরুও নয়, মরুও নয়।–অরুণ সামনে থেকে বলে।

তুমি থার্ড পারসন। তোমার কথা বলা সাজে না।–বিলু ধমক দেয়।

প্রীতম উদাসভাবে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। এই পৃথিবীতে তার কোনও জমির আর প্রয়োজন নেই। ভেবে দেখলে কারওরই প্রয়োজন নেই। তবে সেটা সকলে সব সময়ে টের পায় না। প্রীতম আজকাল পায়। তবে তার কাছে গোটা পৃথিবীটাই একটা সুন্দর সম্পূর্ণ বাস্তুজমি। সবটুকুই তার দরকার। আসমুদ্র পর্বত, অরণ্য, বৃষ্টি, আকাশের নীল রোদ, জ্যোৎস্না মিলিয়ে তার বিশাল বাড়ি। গোটা পৃথিবীকেই তার বড় দরকার ছিল। আরও কিছুদিন।

বিলু শালটা ভাল করে জড়িয়ে দিচ্ছিল তার গলায়। একটু বিরক্তির মাথা ঝাকুনি দিয়ে আপত্তি জানাল সে। বাইরে ঝকঝকে রোদে রাসবিহারীর মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। বাঁ ধারে একটা ঘেয়ো চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে এই রকম সরল রোদে শীত-গ্রীষ্মে দাঁড়িয়ে থাকত বীতশোক। কোনও কাজ ছিল না, সারা জীবন কোনও পয়সা রোজগার করেনি। ভাল আড়বাঁশি বাজাতে পারত বলে সিনেমা-থিয়েটারে কাজ করেছে বহু। কিন্তু পয়সা আদায় করার এলেম ছিল না। চাইতে জানত না। বেশ বয়স হয়ে যাওয়ার পর যখন বুঝেছিল আর কিছু করার নেই তখন থেকে এইখানে চুপ করে সকাল-সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছিল। ভাইদের সংসারে অনাদরের ভাত জুটে যেত। দু’আনা-চার আনা হাতখরচও। সেই ছিল তার অঢেল। ট্রামে বাসে চড়ত না। বিড়ি খেত। দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও এক নাগাড়ে চেয়ে থাকত পশ্চিম ধারে। কখনও পুব ধারে। কিছু দেখত না। কেবল চেয়ে থাকত। অমন নির্বিকার মানুষ, অমন অহং ও আমি-শুন্য লোক জীবনে দুটো দেখেনি প্রীতম। বীতশোককে সে বহুবার টাকা বা পয়সা দিয়েছে যেচে। হাত পেতে নিত। বলত, খুব ভাল হল। কয়েকদিন আর বাড়িতে পয়সা চাইতে হবে না। বড্ড বকে।

বীতশোকের দীন ভাব বহুবার নকল করার চেষ্টা করেছে প্রীতম। কিছুতেই হয় না। অভিনয় হয়ে যায়, কৃত্রিম হয়ে যায়। কতগুলো জিনিস কিছুতেই নকল করা যায় না। ভিতরে ওই দীনতার কোনও প্রস্রবণ না থাকলে হওয়ার নয়।

গাড়ি বাড়ির সামনে এসে গেল হু হু করে।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে লাবু। একটু ঝুঁকে, চোখে প্রবল উৎকণ্ঠা। পাখির মতো স্বরে ডাকল, মামণি।

প্রীতমকে ডাকল না। আজকাল প্রীতমকে ডাকে না লাবু।

অরুণ দরজা খুলে কাঁধ এগিয়ে দিয়ে হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে।

প্রীতম নামে। পায়ের ওপর খাড়া হওয়ার চেষ্টা করে এবং বুঝতে পারে বৃথা চেষ্টা।

অন্য দিক দিয়ে সযত্নে জড়িয়ে ধরে বিলু। পাড়ার লোকজন দেখছে। রোজই দেখে। কী লজ্জা!

দোতলায় নিজের ঘরে বিছানায় পৌঁছে গড়িয়ে পড়ে প্রীতম। বাইরের পৃথিবী থেকে এসে এই খণ্ড ছোট্ট ঘরের মধ্যে তার যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায় সে।

বিলু রান্নাঘরে গেল। অরুণ বাইরের ঘরে দালাল লোকটার সঙ্গে বসে কথা বলছে। রাস্তায় পাড়ার ছেলেদের খেলার হা শোনা যাচ্ছে।

প্রীতম ঝিম মেরে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ।

চা খাবে?–বিলু নিঃশব্দে এসে চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে জিজ্ঞেস করে।

খাব।

খুব হাফিয়ে পড়োনি তো?

না না।–বলে উঠে বসতে চেষ্টা করে প্রীতম।

উঠো না। আমি জানি, তোমার কষ্ট হচ্ছে।

তবু উঠে বসে প্রীতম। এইমাত্র মৃত্যু সম্পর্কে তার নতুন একটা কথা মনে হল। সে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে। ওরা চলে গেলে একবার আমার কাছে এসো।

ওরা এক্ষুনি চলে যাবে চা খেয়েই। তুমি শুয়ে থাকো, আমি আসছি।

কিন্তু প্রীতম শোয় না। বসে থাকে। বাইরের ঘর থেকেই অরুণ বিদায় নিয়ে চলে যায়। সদর বন্ধ করে বিলু ঘরে এসে প্রীতমের বিছানায় বসে।

কী বলছিলে?

প্রীতমের মুখে একটা নরম উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। মৃদু হাসি তার মুখে। সে বলে, মনে আছে বিয়ের পর অভিমান হলেই আমি তোমাকে বলতাম, আমি যখন মরে যাব তখন দেখো?

মনে থাকবে না কেন?

কিন্তু আমার মনে হয় কী জানো?

কী?

মানুষ মরে কিছু প্রমাণ করতে পারে না, কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

সে তো ঠিকই।

অমন আলগা জবাব দিয়ো না। ভেবে দেখো। খুব গভীরভাবে ভাবো।

আমার কি অত সময় আছে? মেয়েকে চান করাব, তোমাকে চান করাব, রান্নাও অনেক বাকি।

আঃ বিলু! শোনো। যেয়ো না।

বলো।

অংশুকে তোমার মনে আছে?

কোন অংশু?

আমার কলিগ ছিল।

ওঃ। নামটা চেনা। ঠিক মনে পড়ছে না।

অংশু কেন সুইসাইড করেছিল জানো?

কেন?

মা আর বউয়ের ওপর রাগ করে। বনিবনা হত না। ভীষণ গণ্ডগোল হত বাড়িতে। তার মায়ের সঙ্গে বউয়ের ছিল সাংঘাতিক ঝগড়া। অংশু সেই ঝগড়ার মাঝখানে থেকে শুকিয়ে যেতে লাগল দিনকে দিন। তারপর একদিন জ্বালা জুড়োতে ঘুমের ওষুধ খেল।

তাতে কী?

অংশু মরার পর তার মা আর বউ দুজনেই প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। হুলুস্থুল কান্নাকাটি বিলাপ। তারপর এ ওকে দুষত। পরে যতদিন একসঙ্গে ছিল ততদিন আবার ঝগড়া করত দু’জনেই। অংশু হয়তো ভেবেছিল, সে মরলে দুজনেরই শিক্ষা হবে। হয়নি। অংশু হয়তো ভেবেছিল মরলে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু তা পেয়েছে কি না তা পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রমাণিত নয়। সুতরাং মৃত্যু দিয়ে অংশু প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ঠিক সেই রকম যারা আত্মহত্যা করে তারা কিছুই প্রমাণ করতে পারে না।

সে তো ঠিক।

আমি কয়েকদিন খুব আত্মহত্যা নিয়ে ভাবছি বিলু। আমার জীবনে যে কটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সব ক’টার চুলচেরা বিচার করছি। দেখলাম, মৃত্যু একটা মাইনাস পয়েন্ট। জীবনের কোনও কিছুর সঙ্গেই তার মেলে না।

বুঝেছি। এবার কাজে যাই?

তুমি কখনও মরা নিয়ে কিছু ভাবোনি?

সময় কোথায় যে দু’দণ্ড কিছু ভাবব?

প্রীতম খুব সন্দেহের চোখে বিলুর দিকে তাকায়, তারপর বলে, তুমি কি সত্যিই খুব ব্যস্ত? না কি আমাকে অ্যাভয়েড করার জন্য বলছ?

বিলু এ কথার জবাব না দিয়ে একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেলল, তারপর একটু ঘন হয়ে বসল প্রীতমের কাছে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?

কী হয়েছে তা প্রীতম নিজেও বুঝতে পারছে না। ভিতরে একটা বাঁধ ভেঙেছে। খুব আবেগ আসছে, এলোমলো হয়ে যাচ্ছে মন। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে মৃত্যুভয়। বিলুর কাছে যে এর কোনও নিদান নেই তাও সে জানে। কিন্তু বিভ্রমশে আজ তার মন ভীষণ কেন যে বিলুবিলু করছে।

প্রীতম কী বলছে তা হিসেব না করেই বলল, তুমি আজ সারা দিন আমার কাছে কাছে থাকো।

থাকব। কাছেই তো থাকি।

প্রীতম মাথা নেড়ে হতাশভাবে বলে, কিছুই আমার কাছে নয়। ওই বাথরুমটাকে মনে হয় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। খাট থেকে মেঝেটাকে মনে হয়, দোতলা থেকে একতলার ফুটপাথের মতো নিচুতে। এ ঘর থেকে ও ঘর যেন এ পাড়া থেকে ও পাড়া। কেন সব কিছুই এত দুর লাগে বলো তো?

বিলু চুলে হাত বোলাচ্ছে, মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত অবাক চাউনি দিয়ে দেখছে তাকে। আস্তে করে বলল, কিছুই তো দূর নয়।

সবচেয়ে দূরে তুমি আর লাবু।— এ কথা বলার সময় প্রীতমের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তার চোখে কি জল আসছে? ছিঃ ছিঃ! চোখে হাত দিয়ে দেখতে তার লজ্জা করল। কিন্তু বুকের মধ্যে। যে একটা কান্না গোঙাচ্ছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। হঠাৎ হল কী তার? যদি দুর্বলতা আসে, যদি হাল ছেড়ে দেয়, তবে এ লড়াইয়ে তার হার নিশ্চিত।

বিলু একটু রাগ করে বলে, অত ভাবের কথা জানি না বাবা। আমরা তোমার থেকে দূরে হতে যাব কেন? ওইসব ভাবো বুঝি সারা দিন?

প্রীতম গাঢ় স্বরে বলে, মানুষ কতটা মানুষের কাছে হতে পারে বিলু? একজন অন্যজনের ভিতরে ঢুকে যেতে পারে না?

বিলু হাসল। বলল, এও তো ভাবের কথা। যাই তোমার দুধ নিয়ে আসি গে। দুধ খেয়েই ওষুধ খাবে–

প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, যেয়ো না। এ সময়টা খুব ডেনজারাস। এক মুহূর্তও আমাকে ছেড়ে থেকো না এখন। আমাকে ছুঁয়ে বসে থাকো।

বিলু সহজে ভয় পায় না, সহজ আবেগে ভেসেও যায় না। কিন্তু এখন হঠাৎ তার চোখে ঘনিয়ে উঠল ভয়। ঠোঁট সাদাটে দেখাল। শরীরটাও হঠাৎ শিউরে উঠল কি? প্রীতমকে এত চঞ্চল কখনও দেখেনি সে। দু’হাতে প্রীতমের রোগা শরীরটা আঁকড়ে ধরে। সে বলল, আছি, আছি। কোনও ভয় নেই তোমার। কেন এরকম করছ? আমি যে ভেবে মরছি।

প্রীতম লক্ষ করে সকালের উজ্জ্বল রোদে ধোয়া এই ঘরে সিলিং থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে কালো কালো অন্ধকার। ঝুলছে, দোল খাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে থেকে অতিকায় ডানায় উড়ে আসছে তাদের আরও দোসর। বুক-কেসের তলায়, খাটের নীচে, আলনার পিছনে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের ভূপ। শরীরের জীবাণুরা ঝিনঝিন শব্দে গাইছে মুক্তিসংগীত।

সে বিলুর হাত আঁকড়ে ধরেছিল। তার বড় বড় নখের আঁচড় লেগে বিলুর হাত ছড়ে গিয়েছিল বলে বিলু অক্ষুট ব্যথার শব্দ করল, উঃ!

প্রীতম বড় বড় শ্বাস ফেলছিল। উদভ্রান্ত চোখে বিলুর দিকে চেয়ে বলল, যেয়ো না।

যাচ্ছি না তো।

থাকো। আর একটু থাকো।

সারা দিন থাকব, ভেবো না। ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছ?

প্রীতমের মন বলল, আর খুব বেশি সময় নেই। দিনের আলোর ওপর একটা অন্ধকারের ঘোমটা নেমে এসেছে। হালকা ফিকে অন্ধকার। কিন্তু ক্রমে তা গাঢ়তর পুঞ্জীভূত হয়ে উঠবে। শরীরের জীবাণুরা তাদের প্রবল সংগীত গেয়ে চলেছে।

হাল ছেড়ে প্রীতম বালিশে মাথা রাখে। চোখ বোজ। বিলুর সঙ্গে জমির প্লট দেখতে যাওয়া তার ঠিক হয়নি। যেই প্লট দেখতে গেল অমনি এল বিষয়-চিন্তা। সে গাড়িতে বসে থেকে অন্তত গোটা তিনেক প্লট দেখেছে। আর বাজমি কেনার প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবতে গিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, আমি মরে গেলে বিলু আর লাবুর তো একটা স্থায়ী আস্তানা দরকার। এইসব ভাবতে ভাবতে জীবাণুদের প্রবল প্রশ্রয় দিয়েছে সে। মন মৃত্যুর পুকুরে ড়ুব দিয়ে উঠে এসেছে। এখন তার সমস্ত সত্তা এক ঢালু বেয়ে একমুখী টানে নেমে যাচ্ছে মৃত্যুর উপত্যকায়। একে ফেরানো খুব মুশকিল।

বালিশের কোনা আঁকড়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ভাল আছি, আমি ভাল আছি; আমার কোনও অসুখ নেই, আমি রোগমুক্ত, সুস্থির, আমি অজর, অমর। ভাল আছি, আমি ভাল আছি…

ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রীতম।

বিলু তার গায়ে লেপটা সাবধানে টেনে দিয়ে উঠে পড়ল।

 

মনটা হঠাৎ বড় ভার লাগছে বিলুর। অঘটনের জন্য মনকে সে প্রস্তুত রেখেছে। তবু হঠাৎ সর্বনাশ এসে দরজায় দাঁড়ালে বুক কেঁপে উঠবে না কি?

লাবুকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দিল বিলু। রান্না দেখিয়ে দিল ঝিকে। তারপর একটু একা হয়ে বারান্দায় এসে উদাসভাবে চেয়ে রইল দূরের আকাশের দিকে।

কলেজে পড়ার সময় এবং তার পরবর্তী কালেও বিলুর প্রিয় বন্ধু ছিল পুরুষরা। মেয়েদের সঙ্গে সে কখনওই মিশতে ভালবাসত না তেমন। পুরুষদের সঙ্গে বেশি মিশে তার স্বভাবও অনেকটা পুরুষের মতো হয়ে গেছে। সে সহজে অসহায় বোধ করে না, ভেঙে পড়ে না। সে অনেকটাই স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা। তবু আজ প্রীতমের হাবভাব দেখে তার বুকের মধ্যে ধকধক করছে। শুকিয়ে আছে গলা, জিভ। একটু কান্না কান্না ভাব থম ধরে আছে কণ্ঠার কাছে। এখন কোনও আপনজনকে বড় দরকার। কিন্তু কে আছে বিলুর! দাদারা যে যার সংসারে জড়িয়ে থেকে দূরের মানুষ হয়ে গেছে। সেজদা দীপনাথ নানা কাজে ব্যস্ত। ছোড়দা সোমনাথের কাছে আছে বুড়ো অথর্ব বাবা। বিলুর এই অসহায় অবস্থায় কেউই এগিয়ে আসবে না, কাজে লাগবে না।

আপনজনের অভাব এমন কোনওদিন টের পায়নি বিলু। এই রোগা মানুষটাকে এতদিন তো ভারী মনে হয়নি তার। প্রীতম কোনওদিনই বিলুর ওপর নিজেকে ছেড়ে দেয়নি। মনে হচ্ছে, আজ থেকে দিল। ফলে বিলুর ভারী বিপদ হল এখন থেকে। কেউ পাশে থাকলে সে অনেকটা জোর পেত।

প্রীতমের ভার সে একা বইবে কী করে?

মা! আমি একটু খেলনা ধরব?

বিলু ফিরে তাকিয়ে লাবুকে দেখে। ছোট্ট অসহায়, একান্ত নির্ভরশীল। লাবুকেও তো বইতে হবে তার, যতদিন না লাবু নিজের ভালমন্দ বুঝতে শেখে! বাপন্যাওটা লাবুকে বাপের কাছ থেকে কেড়ে নিতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরেছে বিলু। ফলে লাবুর ভারও তাকে একা বইতে হয়।

মেয়ের দিকে চেয়ে একটা বড় শ্বাস ফেলে বিলু। লাবু তাকে ভীষণ ভয় পায়। সব সময়ে চোর হয়ে থাকে। সামান্য নড়াচড়া করতেও মায়ের অনুমতি নেয়। তবু এরকম কড়া শাসন ছাড়া উপায়ই বা কী বিলুর! দুষ্টু, দামাল, অবাধ্য মেয়ে হলে বিলুর বড় বিপদ হত।

বিলু গলায় সামান্য মাপমতো আদর মিশিয়ে বলল, খেলো। তবে শব্দ কোরো না। বাবার ঘুম যেন না ভাঙে।

লাবু মাথা নেড়ে চলে গেল।

অনিয়ম বিলু পছন্দ করে না। তবুও প্রীতমকে অঘোরে ঘুমোতে দেখে বিলু স্নান-খাওয়া বাকি রেখে বাইরের ঘরের সোফায় শুয়ে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল।

উঠল বেলায়, প্রীতমের ডাকে। বিলু! বিলু! আমার খিদে পেয়েছে।

ঘুম ভেঙে বিলুর কেমন একরকম লাগতে থাকে। মাথাটা ফাঁকা এবং টলমলে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে তেষ্টায়। কেবল মনে হচ্ছে, কেউ নেই, আমাদের কেউ নেই।

প্রীতমের মাথা ধুইয়ে খাওয়াতে বসে বিলু হঠাৎ আজ বলে ফেলল, শিলিগুড়ি থেকে কাউকে আনাবে?

প্রীতম অবাক হয়ে বলে, কেন?

আমাদের এখন একজন সহায়-সম্বল দরকার। আপনজন বলতে তো কেউ নেই।

প্রীতম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, কে আসবে?

তুমি চাইলে নিশ্চয়ই আসবে কেউ না কেউ।

আসার মধ্যে এক আসতে পারে না। কিন্তু তারই বা এসে লাভ কী?

লাভ হয়তো একটু আছে। আমার না হলেও তোমার।

অসময়ের ঘুম থেকে উঠে প্রীতম দেখেছে, ঘরের বাদুড়ঝোলা অন্ধকারগুলো আর নেই। সে ঘৰকে বলেছে, আমি বেশ ভাল আছি। আর এখন সত্যিই সে অনেক ভাল আছে।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, মা! মায়েদের ভীষণ মায়া। আমার এ চেহারা মায়ের না দেখাই ভাল। তা হলে আর যে ক’দিন বাঁচত তাও বাঁচবে না।

বিলুর কোনওদিন সহজে অভিমান-টান হয় না। আজ এ কথায় হল। বলল, শুধু মায়ের দিকটাই দেখলে! আমি কীভাবে বেঁচে আছি তা দেখলে না!

মা আমাকে পেলে বড় করে দিয়েছে। এখন মায়ের পালা শেষ। ছেলেরা বড় হলে মায়েদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

বিলু দীর্ঘশ্বাস কখনও ছাড়ে না। এখন ছাড়ল। বলল, তুমি আর বড় হলে কোথায়? এখনও মায়ের আঁচলই তোমাকে ঘিরে আছে।

কথাটার মধ্যে একটু খোঁচা ছিল। প্রীতম মাথা নেড়ে বলল, তুমি যদি না পারো তবে আমাকে কোনও নার্সিং হোম বা হাসপাতালে দাও। আমার মাকে বা আর কাউকে এর মধ্যে টেনে এনো না।

বিলুর মুখ থমথম করে উঠল। ভাতের চামচ তুলেছিল প্রীতমের মুখের কাছে, প্রীতম মুখ ফিরিয়ে নিল বিরক্তিতে। আর খাবে না জানে বিলু। সে নিজে যেমন পুরুষালি স্বভাবের, প্রীতম তেমনি ঠিক মেয়েলি স্বভাবের।

বিলুর ঠোঁটের আগায় অনেক জবাব এসেছিল, কিন্তু সংযত রাখল নিজেকে। ভাতের প্লেট নিয়ে উঠে চলে গেল।

ছাদের দিকে অপলক চেয়ে শুয়ে রইল প্রীতম। চেয়ে থাকলেও তার মন অন্য কাজ করছে। ভিতরে একটা বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়ে গেছে। সেই বাঁধ মেরামত চলছে। এত সহজে সে কি ধরা

পড়বে মৃত্যুর ফাঁদে? আগে বেঁচে থাকাটাকে মাঝে মাঝেই খুব অর্থহীন মনে হত। মনে হত, মৃত্যুটা কেমন? এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয়, বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। এর প্রতিটি মুহূর্তের দাম কোটি কোটি টাকা। মৃত্যু একটা মাইনাস পয়েন্ট। তা দিয়ে কিছুই প্রমাণ করা যায় না।

১২. কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে

কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে পাঠশালার বারান্দায় দুটো লোক জবুথুবু হয়ে বসে আছে। আজ একেবারে রক্তজমানো ঠান্ডা। থেকে থেকে উত্তুরে হাওয়া মারছে, তাতে ভিতরের প্রাণবায়ুটা পর্যন্ত যেন নিবু নিবু হয়ে আসে। জ্যোৎস্নায় দেখা যায়, নদীর বুকটা খাঁ খাঁ করছে, শুকনো আর সাদা। একধার দিয়ে শুধু নালার মতো একটা জলধারা কষ্টেসৃষ্টে বয়ে যাচ্ছে। নদীর খাত আগে গভীর। ছিল। এখন মাটি আর বালি জমে জমে তা প্রায় মাঠঘাটের সমান উঁচু হয়ে এল। বর্ষার প্রথম চোটেই জলের ঢল উপচে মাঠঘাট ভাসায়, পাঠশালায ক্লাসঘরে গোড়ালিড়ুব জল দাঁড়িয়ে যায়। তাই এখন গ্রীষ্মের বদলে পাঠশালায় বর্ষার লম্বা ছুটি দেয়।

এই পাঠশালা, এই নদী, চারদিকের মাঠঘাট এসব কিছুর সব গল্পই জানে নিতাইখ্যাপা। খুব যত্নে ছোট কলকেয় গাঁজা সাজতে সাজতে বলল, এ জায়গার একটা নেশা আছে। থাকো কিছুদিন, টের পাবে। মেরে তাড়ালেও যেতে চাইবে না।

ধুর! এ তো ব্যাকওয়ার্ড জায়গা।

নিতাই ইংরিজি কথাটা বুঝল না। তবে আন্দাজে ধরল, নিন্দের কথাই হবে। একটু চড়া স্বরে বলল, এ জায়গার মাটির তলায় কী আছে জানো? বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গ। তাকে জড়িয়ে আছে সাতটা জ্যান্ত সাপ। মাকালতলার মোড়ে যে বটগাছ আছে, ঠিক তার দেড়শো হাত নীচে। একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ আছে, তা দিয়ে যাওয়া যায়। তবে সুড়ঙ্গের হদিশ কেউ জানে না।

যত সব গুলগপ্পো।

নিতাইখ্যাপা এবার খেপে গিয়ে বলে, আর চাঁদে যে মানুষ গেছে সে গপ্পোটা কী? সেটা গুল নয়? হিমালয় পাহাড়ে মানুষ ওঠার গল্প গুল নয়? নিতাই সব জানে। বেশি বকিয়ো না।

সরিৎ হাসে। বলে, এখানে আর কী কী আছে?

সে অনেক আছে। শুনলে মহাভারত। থাকো, জানতে পারবে।

বলে নিতাই কলকেটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ধরাও। অগ্রে ব্রাহ্মণং দদ্যাৎ। প্রসাদ দিয়ো।

আমার পৈতে নেই, ব্রাহ্মণ-টাহ্মণ আবার কী?

ও বাবা, গোখরো সাপের বিষাত উপড়ে ফেললেই সেটা তেঁাড়া হয়ে যাবে নাকি? পৈতে থাক থাক ব্রাহ্মণ বলে কথা।

কলকেটা নিয়ে সরিৎ সন্দেহের গলায় বলে, খুব কড়া নয় তো! মাথাটাথা ঘুরে গেলে মজা দেখাব।

আরে না। মিহিন ধোঁয়া, ভারী মিষ্টি, শরীরটা গরম হবে, মাথাটা হালকা লাগবে। একটার বেশি টান দিয়ো না, ধোঁয়াটা বেশিক্ষণ ধরে রেখো না।

রাখলে কী হবে?

নেশা করেছ টের পেলে তোমার দিদি আমাকে ঠেঙিয়ে তাড়াবে।

তা তুমি তো হিমালয়ে চলেই যাচ্ছ। তাড়ালে ভয় কী?

সে তো যাবই। খাঁটি জিনিস এখনও সেখানেই পাওয়া যায়। আমাকে এক পোটকা সাধু এসে ভেজাল মাল দিয়ে গেছে। মন্ত্রে তেমন কাজ হচ্ছে না।

সরিৎ খুব আস্তে ন্যাকড়া জড়ানো কলকেয় টান দিল। মিষ্টি, মাতলা ধোঁয়া। ধক করে গলায় লাগল না, কিছু তেমন টেরই পাওয়া গেল না। ফলে আর-একটা জোর টান মেরে ধোয়াটা ধরে রাখল বুকে।

হাত বাড়িয়ে নিতাই কলকেট নিয়ে বলে, সাবধান কিন্তু। ধরা পড়লে আমার নাম কোরো না।

আরে না!–বলে ধোঁয়াটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয় সরিৎ।

নিতাই কলকেটা জুতমতো ধরে বলে, নিতাইয়ের কপালটা খুব ভাল কিনা! যেখানে যত খারাপ ব্যাপার হবে সবাই ধরে নেয় এ নিশ্চয়ই নিতাইয়ের কাজ। তোমার ভেঁপো ভাগনেটা কোথা থেকে খারাপ খারাপ কথা শিখে এসেছে, সে দোষটা পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চালান করল মদনা।

বাণ মারতে পারো না! বাণ মেরে সব ফিনিশ করে দাও।

নিতাই অভিমানভরে বলে, বাণমারা নিয়ে সবাই আমাকে খ্যাপায়। তুমিও নতুন এসেই পেছুতে লাগলে?

সরিৎ বাঁশের ঠেকনোয় মাথা রেখে কুয়াশামাখা আধখানা চাদের দিকে চেয়ে বলল, খ্যাপাব কেন? বাণ মারা জানলে আমিও বিস্তর লোককে বাণ মারতাম।

নিতাই শ্বাসটা সম্পূর্ণ ছেড়ে কলকেয় একটা চুমু খেয়ে মুখ লাগাল, তারপর হাপরের শব্দ করে টেনে নিতে লাগল ধোঁয়া। ধিইয়ে উঠল কলকের আগুন। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বলল, আমিও মারি। কিন্তু মদনা শালা মরে না।

মদনটা কে বলো তো?

ঠিকাদারবাবুকে চেনো না? ভুশুণ্ডির কাক। দেখলেই চিনবে। মল্লিবাবুর সঙ্গে খুব মাখামাখি ছিল।

সরিৎ খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল, মল্লিবাবু লোক কেমন ছিল?

নিতাই আবার টান মেরেছে। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল না। তারপর নাক দিয়ে দুটো সাদা সাপ ছেড়ে দিয়ে বলল, যারা বিয়ে করে না তারা লোক খারাপ হয় না। পুরুষদের খারাপ করে তো মেয়েছেলেরা। যাদের এগারো হাতেও কাছা হয় না।

মেয়েছেলের ওপর তোমার অত রাগ কেন বলো তো?

মা বোন পর্যন্ত মেয়েছেলেরা ভাল। যেই বউ হল অমনি সর্বনাশ।

সরিতের নেশা হয়েছে কি না তা বুঝতে পারছে না। তবে মাথাটা হালকা লাগছে, টলমল করছে। শরীরে তেমন ঠান্ডা টের পাচ্ছে না। বরং একটা যেন হাঁসফাঁস লাগে। তবু সেজদির বাড়ির রহস্যটা জানবার একটা আগ্রহ সে এসে থেকেই বোধ করছে। গত সাত দিনে সে শুধু রহস্যটা টের পেয়েছে। বোঝেনি। এ ব্যাপারে কাউকে প্রশ্নও করা যায় না। কেবল নিতাইখ্যাপার কথা আলাদা।

সরিৎ খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করল, মল্লিবাবু বিয়ে করল না কেন?

বিয়ে করেনি তাতে কী? ভালই ছিল। অনেক মেয়েমানুষ ছিল তার। লাইনের ওধারে মঙ্গলহাটের চামেলীর কাছে খুব যাতায়াত ছিল, কলকাতাতেও তো ছিলই শুনি। ফুর্তিতে থাকত। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কোনও বাঁধাবাঁধি নেই।

বিয়ে করবে না তো এত সব সম্পত্তি করতে গিয়েছিল কেন? কার ভোগে লাগবে?

ও হচ্ছে পুরুষ মানুষের একটা নেশা। রোজগার করবে, সম্পত্তির মালিক হবে, এ না হলে পুরুষ কিসের? ভোগের কথা যদি বলল তো ভোগ মল্লিবাবু একাই কিছু কম করেনি।

এত লোক থাকতে সেজো জামাইবাবুকেই বা সম্পত্তি দিয়ে গেল কেন, জানো?

সে অনেক গুহ্য কথা আছে। থাকলে টের পাবে। তবে সম্পত্তি তোমার ভগ্নিপোতের নয়, দিদির।

তাও জানে সরিৎ। সেই শশাকেই কি জামাইবাবু বাড়ি থেকে অনেকটা বাইরের দিকে আলাদা ঘরে পর-মানুষের মতো বসবাস করছে? সেজদির সঙ্গে জামাইবাবুর কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই হয়। এ বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো একটু নির্জীব যেন। গাছপালা, পুকুর, আলো-হাওয়া, প্রচুর খাবার-দাবার সত্ত্বেও বাড়িটায় যেন আনন্দ নেই।

খ্যাপা নিতাই আর কী বলে শোনার জন্য উৎকণ্ঠ হয়ে থাকে সরিৎ।

নিতাই বোম ভোলানাথের মতো চোখ বুজে থাকে খানিক। তারপর গদগদ স্বরে বলে, জয় কালী।

সরিৎকেও গাঁজাটা বেশ ধরেছে। চোখে অনেক ঝিকিমিকি দেখছে সে। শরীরের মধ্যে দে দোল দোল ভাব। চিন্তাশক্তি ঠিক থাকছে না, একটু একটু গুলিয়ে যাচ্ছে বোধভাষ্যি।

কী খাওয়ালে গো নিতাই! বাড়ি যেতে পারব তো! পা টলবে না?

আরে দূর দূর। খুব পারবে বাড়ি যেতে। অত ভয় খেলে কি নেশা করে সুখ আছে? চেপে বসে থাকো, চারদিককার কাণ্ডকারখানা দেখো আর হাসতে থাকো। জয় কালী!

নিতাইয়ের দেখাদেখি চোখ বুজে ধ্যানস্থ হতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তন্দ্রা এসে যায় সরিতের। হালকা মাথাটা বাঁশের ঠেকনোয় কিছুতেই আটকে থাকতে চায় না। ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে।

ঝিমুনি কাটিয়ে চোখ চাইতেই বুঝতে পারে, নিতাই তাকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে।

কী বলছ?

বলি, দিদি তোমাকে মালদা থেকে এখানে আনাল কেন?

কী জানি। লিখেছিল এখানে কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

তা কে জানে! জমিজিরেত সম্পত্তির ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না।

নিতাই একটা শ্বাস ফেলে বলে, শ্রীনাথবাবুও বোঝেন না। বোঝেন বটে তোমার দিদি। জঁহাবাজ মেয়েমানুষ। মল্লিবাবু ঠিক লোক চিনত, তাই শ্রীনাথবাবুর নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে যায়নি। গেলে এতদিন পুরোটা ফুঁকো হয়ে যেত।

কেন বলো তো?

সে আর বলে কাজ নেই। শ্রীনাথ কর্তা মল্লিবাবুর দোষগুলো পুরোমাত্রায় পেয়েছেন, গুণগুলো পাননি। এবার বুঝে নাও। আমি এই ছোট মুখে বড় কথা বলতে চাই না বাবা। তবে ঠাকরোনের সঙ্গে ওঁকে মানায় না।

সরিৎ হেসে বলে, তা আমার দিদিও তো মেয়েমানুষ, তারও এগারো হাতে কাছা হয় না।

আ ছি ছি, তোমার দিদির কথা এখানে হবে কেন? ওসব কথা এলেবেলে মেয়েছেলে সম্পর্কে খাটে। ঠাকরোন কি তেমনধারা মেয়েমানুষ?

তবে কেমনধারা?

নিতাই একটু ফাঁপরে পড়ে গিয়ে বলে, তোমার দিদিকে আসলে কেউ আমরা মেয়েছেলে বলে ভাবিই না। সবাই যমের মতো ভয় খাই।

সরিৎ মৃদু-মৃদু হাসে। সেজদিকে কুমারী অবস্থাতেও লোকে একটু সমঝে চলত। লম্বা সুগঠিত চেহারার সেজদির দিকে নজর দিত অনেকেই, কিন্তু ভিড়তে ভয় পেত। একবার সেজদির সঙ্গে রাস্তায় যেতে পিছনে একদঙ্গল ছেলের মন্তব্য কানে এসেছিল সরিতে, এ যা ফিগার মাইরি, সাতটা মিলিটারিও ঠান্ডা করতে পারবে না।

কথাটা শ্লীল নয়, শুনে সরিৎ লজ্জাও পেয়েছিল বটে। কিন্তু কথাটা মিথ্যেও নয়। বলতে কি সেজ জামাইবাবুর আদুরে মোলায়েম চেহারার পাশে সেজদিকে মানায় না। ভাই হিসেবে তার কথাটা ভাবা উচিত নয়, তবু তার মাঝে মাঝে ইদানীং সন্দেহ হচ্ছে, নরম-সরম জামাইবাবু তার পাঞ্জাবি মেয়ের মতো ফিগারওলা সেদিকে ঠান্ডা করতে পারে কি না। কথাটা এই নেশার ঘোরে মনে হওয়ায় হাসিটা চাপতে পারল না সরিৎ। ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। বিয়ের আসরে সেজদি আর জামাইবাবুকে দেখে মুখ-পাতলা বড় জামাইবাবু বলেই ফেলেছিল, এ যে প্রশান্ত মহাসাগরে একটা কাঁচকলা। কথাটা মনে হওয়ায় সরিৎ আবার হাসে। হাসতেই থাকে।

খ্যাপা নিতাই চোখ খুলে গম্ভীর গলায় বলল, হাসছ যে!

একটা কথা ভেবে।

কী কথা?

সে আছে!

নেশাটা খুব ধরেছে তোমায়। বাড়িতে গিয়ে খানিকটা দুধ খেয়ে নিয়ো। নইলে এ নেশায় শরীর শুকিয়ে যায়।

আর কী হয়?

ব্রেন খুব কাজ করে। লোকে গাঁজাখোরকে গাঁজাখোর বলে বটে, কিন্তু মগজকে এমন তরতরে করার মতো জিনিস আর নেই। গাঁজা হচ্ছে কুলোর মতো, ঝেড়ে ঝেড়ে আজেবাজে চিন্তা মগজ থেকে ফেলে দেয়। কাজের জিনিসগুলো রাখে।

কুলোর উপমায় সরিৎ আবার ফিক করে হাসে। বুঝতে পারে, হাসিটা কিছুতেই সে সামলাতে পারছে না। খুব ডগমগ লাগে ভিতরটা। সেজদিকে এখানকার এরা সবাই ভয় খায় জেনেও তার হাসি আসতে থাকে। সে বলে, সেজদিকে তোমরা যে মেয়েমানুষ বলে মনে করো না সেই কথাটা আমি আজই সেদিকে বলে দেব।

নিতাই আবার ফঁপরে পড়ে গিয়ে বলে, তাই কি বললাম নাকি?

তাই তো বললে!

দূর বাপু, তুমি সব কথারই সোজা মানেটা ধরো। এ কথার মধ্যে একটা প্যাঁচ আছে, সেটা তো বুঝবে।

প্যাঁচটা আবার কী?

নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তখন মল্লিবাবু বেঁচে। গুঁতে নামে একটা বিখ্যাত চোর ছিল এ তল্লাটে। গুণী লোক। তার হাত খুব সাফ ছিল। তো সে একবার এ রকম মাঘের রাত্তিরে। তোমাদের দক্ষিণের ঘরে হানা দিয়েছিল। সে ঘরে ঠাকরোন আর তার মেয়েরা শোয়। শ্রীনাথবাবু তখন কলকাতায়। সজলখোকা তখনও হয়নি।

গল্পটা বলতে বলতে নিতাই একবার আঁধারভেদী বেড়ালচক্ষুতে সরিতের মুখখানা দেখে নেয়। শালা শুনছে তো ঠিক? প্যাঁচটা ধরতে পারছে তো?

সরিৎ শুনছে। মন দিয়েই শুনছে। এসব কথাই তো সে শুনতে চায়।

সরিৎ বলল, হুঁ।

নিতাই থুঃ করে কৃত্রিম থুথু ফেলে বলে, তা ঘরে ঢুকতে অবশ্য গুঁতেকে কষ্ট করতে হয়নি। ঠাকরোন বুঝি বাইরে গিয়েছিলেন দরজাটায় শেকল দিয়ে। গুঁতে তক্কেতক্কে ছিল, সেই ফাঁকে গিয়ে ঢুকে মেয়েদের গলার হার, হাতের বালা হাতাচ্ছে।

তুমি তখন কোথায় ছিলে?

আমি তখনও সাধু হইনি। গোলাঘরের পাশে মল্লিবাবু একটা কাঁচা ঘর করে দিয়েছিলেন, সেইখানে মড়ার মতো পড়ে ঘুমোতাম।

তো কী হল?

গুঁতে যখন বেরোতে যাচ্ছে সেই সময় ঠাকরোন উঠোন পেরিয়ে ফিরে আসছিলেন।

উঠোন পেরিয়ে কেন? কলঘর কি তখন উঠোনের অন্যধারে ছিল?

নিতাই একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল। যাক বাবা, ছেলেটা একেবারে গাড়ল নয়। ঠিক ঠিক শুনছে, জায়গামতো প্যাঁচটা ধরতেও পারছে।

নিতাই একটু আমতা আমতা করে বলল, ঠিক তা নয়। ঠাকরোন হয়তো বাড়িটা চক্কর মারতে বেরিয়েছিলেন। খুব ডাকাবুকো মানুষ তো। ভূত-প্রেত চোর-ডাকাত কাউকে ভয় নেই।

উঠোনের এধারে কে থাকত?

নিতাই অবাক হওয়ার ভান করে বলল, কে আবার থাকবে? তখন তো এত ঘর ওঠেনি। উত্তরধারে মল্লিবাবুর সেই ঘর এখনও আছে, উনিই থাকতেন।

সরিৎ মৃদু হাসে। গোলমালটা সে আগেই আন্দাজ করেছিল, এখন ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে। গাড়ল নেতাইটা বুঝতে পারছে না যে, গুহ্যকথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

সরিৎ বলল, তারপর?

ঠাকরোনের হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ ছিল। চোখধাঁধানো আলো হত সেটাতে। গুঁতে যেইমাত্র চৌকাঠ ডিঙিয়েছে অমনি ঠাকরোন টর্চটা মারলেন। এঁতে এক লাফে উঠোনে নেমেই ঠাকরোনের হাতের টর্চটা কেড়ে নিয়ে উঠোনে ফেলে দিয়ে দু’হাতে মুখ আর হাত চেপে ধরে বলল, টু শব্দ করলে মেরে ফেলব। গুঁতে ভেবেছিল, মেয়েমানুষকে আর ভয় কী? মতলব ছিল,ঠাকরোনকে ঘরে ভরে দিয়ে বাইরে থেকে শেকল টেনে পালাবে। অন্য সব মেয়েমানুষ হলে তা পারতও। ওই অবস্থায় বেশির ভাগ মেয়েছেলেরই দাঁত কপাটি লাগার কথা। কিন্তু ঠাকরোনের ধাত অন্য। এক ঝটকায় গুঁতের হাত ছাড়িয়ে এমন এক চড় কষালেন গুঁতে সেইখানে বসে পড়ল। আশ্চর্য যে ঠাকরোন কাউকে ডাকাডাকি করেননি, হাল্লাচিল্লা ফেলেননি। সেইখানে পুঁতেকে ধরে লম্বা টর্চখানা দিয়ে এমন উত্তম কুস্তম পেটালেন যে, তার ধাত ছাড়ার জোগাড়।

সাংঘাতিক তো। সেজদির এই সাহসে সরিৎ ভারী বিস্মিত হয়।

সেই তো কথা। কাণ্ডটা মল্লিবাবু তার ঘর থেকে আগাগোড়া দেখেছিলেন।

সে কী? দেখেও বেরোননি?

বেরোননি কেন তার কারণ আছে। পরে বলেছিলেন, আমি তৃষার সাহস আর বীরত্বটা দেখছিলাম। স্বীকার করতে হয়, হ্যাঁ, মেয়েমানুষ বটে। এরকম একজন ঘরে থাকলে পুরুষমানুষের আর চিন্তা-ভাবনা থাকে না।

সেজদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন বুঝি মল্লিবাবু?

খুব। শুনিয়ে শুনিয়েই বলতেন, শ্রীনাথের বউ যেন গোবরে পদ্মফুল। দেখেছ তো মল্লিবাবুকে?

অনেকবার। দারুণ চেহারা ছিল। মিলিটারির মতো।

তবে বলো ঠাকরোনের পাশে মানাত কাকে? ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবু বলি শ্রীনাথ কর্তাকে একেবারে গোবরগণেশ লাগে ঠাকরোনের পাশে। মল্লিবাবুর ঊচেগোটে জম্পেশ চেহারাখানা ছিল। কার্তিকঠাকুরটি নন, রীতিমত খাঁটিয়ে-পিটিয়ে শরীর।

সে কথা ঠিক।

তবেই বোঝে মল্লিবাবু কেন ঠাকরোনের নামে সম্পত্তি দিয়ে গেলেন। জানতেন, এঁর কাছ থেকে লোকে ভয় দেখিয়ে নিতে পারবে না।

লোকে কি চেষ্টা করেছে?

করে আবার নি! বিস্তর করেছে। তবে ঠাকরোনের সঙ্গে এটে ওঠেনি কেউ। গুঁতেকে যেমন হাজতবাস করিয়ে দেশছাড়া করেছিলেন তেমনি আরও অনেক কীর্তি আছে। থাকো, শুনবে।

দু’-চারটে বলল না শুনি।

সে অনেক আছে। লোকে সাধে কি ঠাকরোনকে মেয়েছেলে বলে ভাবে না।

কেউ ভাবে না?

নিতাই আবার মুখটা দেখার চেষ্টা করল। ছেলেটা ল্যাজে খেলাচ্ছে না তো? ভাল মানুষের মতো বলল, ঠাকরোনের সমান সমান পাল্লা টানার মতো মরদ কে আছে বলো! একমাত্র ছিলেন মল্লিবাবু। তার সামনে ঠাকরোন মাথা উঁচু করে কথা বলতেন না।

বটে! বটে!–সরিৎ নড়েচড়ে বসে।

মরদ এ তল্লাটে ওই একজনই ছিল। আর দিনে কালে আর একজনও হয়তো হয়ে উঠবে।

কে? কার কথা বলছ?

সজল খোকাবাবু।

সরিৎ একটু ধাঁধায় পড়ে যায়। সজলকে নিয়ে সে কখনও কিছু ভাবেনি। এখন হঠাৎ ভাবনাটা শুরু হল। ঝিম হয়ে খানিক এলেবেলে চিন্তা ও টলোমলো মাথায় সে সজলের মুখটা ভাববার চেষ্টা করল। তারপরই তার মনে হল, সজলের চেহারাটা বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। হাড়গুলো মজবুত এবং কাঠামোেটাও শক্ত, ভারী জেদি ছেলে। মায়ের শাসনে মিনমিনে হয়ে থাকে বটে, কিন্তু ওর ধাত তা নয়। পরশু কি তার আগের দিনই হবে, সজল মুরগির ঘর থেকে একটা মস্ত মোরগ চুরি করে নিয়ে যায় এবং তার বাবার দাড়ি কামানোর জার্মান ক্ষুর দিয়ে সেটাকে জবাই করে। সেই অবস্থাতেই ফেলে রেখেছিল পুকুরের ধারে। হুলো বেড়ালটা মুখে করে সেটাকে নিয়ে গোলাঘরের পিছনে ঘেঁড়াঘেঁড়ি করছিল। স্বপ্ন দেখতে পেয়ে চেঁচামেচি করায় ঘটনাটা ধরা পড়ে। প্রথমে সজলকে কেউ সন্দেহ করেনি। কিন্তু সেজদি সহজে ছেড়ে দেয়নি, সবাইকে প্রশ্ন করে অবশেষে ঠিক আসামিকে ধরতে পারে। সজল কবুল করেছে সে মাংস খাওয়ার জন্য মোরগটা চুরি করেনি। তবে? তার কোনও জবাব নেই।

খ্যাপা নিতাই বলল, ঠিক মল্লিবাবুর মতো।

কে?

সজল খোকাবাবু।

কথাটার মানে কী নিতাই?

সরিতের গলার স্বরটা হঠাৎ কঠিন হয়ে ওঠায় নিতাই সাবধান হয়ে বলে, কোনও মানে-টানে নেই বাপু। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।

নেশাটা যত জোর ধরেছে বলে ভেবেছিল সরিৎ ততটা নয়। হঠাৎ এই সং-সাজা ভাড়টার ওপর তার রাগ হল প্রচণ্ড। টাপে টোপে বলছিল সে এক রকম কিন্তু এ তো পষ্টাপষ্টি সেজদির কলঙ্ক রটানো।

সরিৎ মালদায় বিস্তর মারপিট করেছে। অনেকগুলো কাজিয়া ছিল না-হক খামোখা। অনেক সময় নির্দোষ লোককেও মেরেছে। আজ একটা মতলববাজ হারামজাদাকে মারলে কেমন হয়?

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ উঠে একটা লাথি চালায় সরিৎ, এই শালা! যত বড় মুখ ন তত বড় কথা।

নিতাই পোঁটলার মতো গড়িয়ে পড়েছে বারান্দা থেকে। পড়েই চেঁচাল, মেরে ফেললে! মেরে ফেললে!

সরিৎ লাফিয়ে নামে। মাথায় আগুন ধরে গেছে। পর পর কয়েকখানা লাথি ঝাড়ল কঁকালে। বলল, শব্দ করলে মেরে চরে পুঁতে ফেলব।

কে শোনে কার কথা। মাটিতে পড়ে খ্যাপা নিতাই গড়ায় আর জটাজুটে ধুলো মাখে আর প্রাণপণে চেঁচাতে থাকে, নির্বংশ হবি। অন্ধ হয়ে যাবি। কুষ্ঠ হবে।

১৩. বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল

বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল, খবর পেয়েছিল শ্রীনাথ। তারপর থেকে সে আর আসছে না। নদীর ওধারে মাইল দশেক ভিতরে শ্যামগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে। যেখানে এক লপ্তে প্রায় বিঘে দশেক জমি আছে। তাতে বর্গা নেই। খবরটা ভালই ছিল। কিন্তু বদ্রী একদম নাপাত্তা। সে থাকেও বহু দূরে। লাইনের ওধারে অনেকটা যেতে হয় কাঁচা রাস্তায়। জায়গাটা খুব ভাল চেনেও না শ্রীনাথ।

দাদার এই বাড়ি থেকে তার যে বাস উঠে গেছে সেটা সে টের পেয়েছে বহুকাল। ভাবন-ঘরের চাবি তার সঙ্গে থাকে। মজবুত তালা ঝোলে দরজায়। ড়ুপলিকেট চাবিটা সে বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখেছে। সেটা যেমন কে তেমনই আছে। খোয়া যায়নি। তবু সজল কী করে ঘরে ঢোকে এবং তার জিনিসপত্র ঘাঁটে তা প্রথম-প্রথম ততটা খেয়াল করে ভাবেনি সে। কদিন আগে আবার তার ক্ষবে হাত পড়ায় হঠাৎ খেয়াল হল।

স্বপ্না এসেছিল সকালে, চা দিতে। তাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, আমার ঘরের তালাটা সজল খোলে কী করে জানিস?

স্বপ্না বা স্বল্পলেখা রোগা মেয়ে। খুব শান্ত, খুব নীরব এবং দুঃখী চেহারা। মুখখানা ভীষণ ধারালো বটে, কিন্তু স্বভাবের সঙ্গে তার মুখশ্রীর কোনও মিল নেই। নিজের এই মেয়েটিকে শ্রীনাথ কখনও ঠিক বুঝতে পারে না।

শ্রীনাথের প্রশ্ন শুনে স্বপ্ন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থেকে বলল, বোধ হয় চাবি আছে।

চাবি তো আমার কাছে।

তা হলে ঠিক জানি না।

সজলকে দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিস তে।

ও আসবে না।

কেন?

সেদিন সেই মোরগ চুরির পর থেকে মা ওকে দক্ষিণের ঘরে সারাদিন শেকল দিয়ে আটকে রাখে।

ও।–বলে একটু গম্ভীর হয়ে যায় শ্রীনাথ। ভিতরবাড়িতে কী হয় না হয় তার সব খবর তার কানে এসে পৌঁছয় না। শ্রীনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা যা।

স্বপ্ন চলে যাচ্ছিল। শ্রীনাথ ডাকল, শোন।

বলো।

চাবির কথাটা তোর মায়ের কানে তুলিস না।

স্বপ্ন একটু হেসে বলল, কে ওসব কথা তুলবে বাবা! মা যে রেগে আছে দু’দিন ধরে! ভাইকে শুধু গলা টিপে মেরে ফেলতে বাকি রেখেছে। ছোটমামা না আটকালে কী যে হত!

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলল, দোষ যখন স্বীকারই করেছে তখন অত মারধরের কী দরকার ছিল!

মা জানতে চাইছিল মোরগটাকে ও মারল কেন! সেই কথাটার জবাব দেয়নি যে। শুধু বলেছে, আমি চুরি করেছি. আমিই কেটেছি। কিন্তু কেন তা বলতে পারছে না।

কেন আবার! রক্তের দোষ! মায়াদয়াহীন বলেই তরতাজা মোরগটাকে মেরে মজা দেখেছে। আমি তো দেখেছি ও প্রায়ই ডিম চুরি করে এনে ঢিল ছোড়ে তাই দিয়ে।

স্বপ্না চলে গেল। চাবির রহস্যটা বসে বসে ভাবতে লাগল শ্রীনাথ। ভেবে কোনও হদিশ করতে পেরে বাগানে নেমে গেল।

গাছপালার মধ্যে শ্রীনাথের আনন্দ অগাধ। আচার্য জগদীশ বোস গাছপালার মধ্যে প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন। সারা দুনিয়ার বোকা লোকেরা এক বাঙালির কাছে শিখেছিল এই মহান সত্য, তবু নোবেল প্রাইজ দেয়নি। শ্রীনাথের হাতে ক্ষমতা থাকলে জগদীশবাবুকে চারবার নোবেল প্রাইজ দিত। গাছপালার প্রাণ যে কত বড় আবিষ্কার তা কেন যে তেমন স্বীকার করল না সাহেবরা! জগদীশ বোস নেটিভ বলেই কি? হবে। সাহেবরা বড় নাকউঁচু জাত।

প্রতিদিন শ্রীনাথ নিজেও গাছপালার প্রাণ আবিষ্কার করে। এখানে এক অদ্ভুত নীরব অনুভূতির সাম্রাজ্য। বাক্য নেই, শ্রবণ নেই, যৌনতা নেই, তবু জন্ম আছে, বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার আপ্রাণ প্রয়াস আছে। ক্রিসেনথিমাম, কসমস, পপি বা গোলাপ বলে কথা নেই, নগণ্য আগাছাও শ্রীনাথের প্রিয়। ফুলের বাগান থেকে বহুবার ওপোনো আগাছা সে ঘের-দেয়ালের ধারে ধারে পুঁতে দিয়ে। এসেছে। আজও বীজ থেকে গাছের জন্ম দেখে অবাক হয় শ্রীনাথ। বসে বসে ভাবে। চোখে। সবুজের ঘোর লেগে যায় তার। মাটির ভিতব পোঁতা শুকনো বীজ থেকে গুপ্ত সৈনিকের মতো সারি সারি ওরা কী করে যে বেরিয়ে আসে! কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য! একই মাটি থেকে বীজের রকমফেরে কী করে জন্মায় এত রকমের গাছ!

শ্রীনাথের হাতের গুণে সামনের বাগানটা হয়েছে দেখবার মতো। অবশ্য কারও চোখে পড়ে না তেমন। লোক লাগিয়ে শুকনো ডালপালা দিয়ে দেড় মানুষ সমান উঁচু দুর্ভেদ্য একটা বেড়া দিয়ে রেখেছে শ্রীনাথ, যাতে তেমন চোখে না পড়ে। খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুরটা আর কোনও কাজের না হোক, গাছের পাতা খসলেও চেঁচায়। শুধু চেঁচাতে জানে। তবু সেই ভয়েই ফুলচোররা বড় একটা হানা দেয় না। এ হল শ্রীনাথের নিজস্ব বাগান। নার্সারি থেকে বিচিত্র ফুলের বা ফলের বীজ আর চারা নিয়ে আসে সে। সার দেয়, জল দেয়, আর দেয় অগাধ মায়া মেশানো ভালবাসা। গাছ তেজে বেড়ে ওঠে। বার বার অবাক করে, আনন্দে ভরে দেয় শ্রীনাথকে। যতক্ষণ সে বাগানে থাকে ততক্ষণ সে অন্য মানুষ। কাম নেই, ক্রোধ নেই, লোভ নেই, অভিমান নেই, এমনকী অহংবোধটুকু পর্যন্ত থাকে না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা বিভূতিভূষণের মতো সেও তখন অর্ধেক নিজেকে প্রকৃতির মধ্যে বিসর্জন দেয়। সম্মোহিত হয়ে থাকে নীরব প্রাণের খেলা দেখে।

একটা নাইট কুইনের গোড়া উসকে দিচ্ছিল শ্রীনাথ। হঠাৎ নজরে পড়া বাগানের পিছন দিয়ে তাগাছায় ঢাকা পড়ো এক ফালি জমির দিকে। কেউ চলাচল করে না, দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢেকে আছে। কিন্তু ওই পড়ো জমি দিয়ে যেতে পারলে সকলের অলক্ষে দক্ষিণের ঘরের পিছন দিকটায় হাজির হওয়া যায়।

একটু ভাবল শ্রীনাথ। যাওয়াটা ঠিক হবে কি?

তারপর ভেবে দেখল, তার সংকোচের কোনও কারণ তো নেই। সে তো এখনও এ বাড়ির কর্তা।

খুরপি রেখে শ্রীনাথ উঠল। জঙ্গলে কাঁটাগাছ থাকতে পারে বলে ঘরে গিয়ে বাগানের কাজের হাওয়াই চটি ছেড়ে একজোড়া পুরনো রবারের বর্ষার জুতো পরে নিল। সা বা অন্য কিছুর ভয় তার নেই। জন্মসুত্রেই বোধ হয় সে কোনও জায়গায় সাপ আছে বা নেই তা টের পায়। গত গ্রীষ্মেও একদিন ভোররাতে অন্ধকারে বারান্দার সিঁড়িতে পা বাড়িয়েও সে পা ফেলেনি। মন থেকে কে যেন সাবধান করে দিয়েছে। পা আটকে গেছে। পরে টর্চ জ্বেলে দেখেছে, কেউটে। এখন শীতকাল বলে আরও ভয় নেই।

পড়ো জমিটা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পেরিয়ে গেল শ্রীনাথ। দক্ষিণের ঘরের পিছনে নিষ্পত্র ঝোপঝাড়। একটু খড়মড় শব্দ হয়ে থাকবে।

ঘরের ভিতর থেকে ভয়ে ভয়ে সজল বলল, কে রে?

শ্রীনাথ জানালায় পৌঁছে দেখল, পড়ার টেবিলে বসে সজল সোজা জানালার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হয়ে আছে। চোখে অবাক চাউনি।

বাবা!

শ্রীনাথ মৃদু ম্লান একটু হাসল। বলল, ভয় পাওনি তো!

না। তুমি ওখানে কী করছ?

তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

সজল আরও অবাক। বাবার কথা থাকলে এমন চোরের মতো পিছনের জানালা দিয়ে কেন? কিন্তু সেটা বলল না সজল। চেয়ে রইল।

শ্রীনাথ বলল, তোমাকে তোমার মা আটকে রেখেছে বুঝি?

সজল মৃদু একটু হাসল। চমৎকার দেখাল ওকে। সুপুরুষ ছেলেটি। গালে টোল পড়ল। ঘন জ্বর নীচে চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল বুদ্ধির দীপ্তিতে। চাপা স্বরে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না।

আটক থাকলে তো খারাপ লাগারই কথা। তোমার তবে লাগছে না কেন?

খারাপ লাগলে তো আমি মার কাছে হেরে যাব। তো চায় আমার খারাপ লাগুক।

এ কথায় একটু অবাক হয় শ্রীনাথ। সজল যে অনেক গভীর করে ভাবতে পারে তা টের পায়নি কখনও। এ প্রসঙ্গে আর না গিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, সারাদিন তুমি কী করো?

বই পড়ি। আর পাটাতনের ওপর অনেক পুরনো জিনিস আছে। এত জিনিস যে অবাক হতে হয়।

পাটাতনে ওঠা না তোমার বারণ? ওঠবার মইটা তেমন ভাল নয়। নড়বড় করে। পড়ে গেলে?

সজল ভয় খেয়ে বলে, সব সময় নয়। যখন একঘেয়ে লাগে, ঘুমটুম পায়, তখন উঠি। সাবধানে।

উঠে কী করো?

জিনিস দেখি। ওপরে অনেক জিনিস বাবা! আমি রোজ ওখানে গুপ্তধন খুঁজি।

এত সহজভাবে সজল কখনও শ্রীনাথের সঙ্গে কথা বলে না। এখন কেন বলছে তাও বোঝে শ্রীনাথ। সজল জানে তার বাবা আর মা দুই প্রতিপক্ষ। সব সময়েই সজল তার মায়ের পক্ষে। কিন্তু সেই মোরগ চুরির ঘটনার পর মায়ের ওপর গভীর ও তীব্র বিরাগ থেকে সজল সাময়িকভাবে তার বাবার পক্ষ নিয়েছে। এবং এও হয়তো কারণ যে, শ্রীনাথকে এভাবে চুপি চুপি পিছনের জানালায় হাজির হতে দেখে সে বাবার গুরুত্বটা খানিক হারিয়ে ফেলেছে।

শ্রীনাথ বলল, আমি কখনও ওই পাটাতনে উঠিনি। কী আছে বলো তো!

অনেক ট্রাংক বাক্স। পুরনো সব মেটে হাঁড়ির মুখে মালসা দিয়ে ঢেকে ন্যাকড়া জড়িয়ে রাখা। পুরনো বই আর খবরের কাগজের ভাই।

আর কী?

একটা টর্চ থাকলে বুঝতে পারতাম। পাটাতনটা দিনের বেলাতেও এত ঘুটঘুটি অন্ধকার যে কিছুই ভাল করে বোঝা যায় না।

আর উঠো না। মা টের পেলে আবার শাস্তি দেবে।

দিলেই কী? আমাকে যে গুপ্তধন খুঁজতে হবে।

ভ্রুকুটি করে শ্রীনাথ বলে, শাস্তিকে তুমি ভয় করো না?

সজল বাবার দিকে চেয়ে ফাঁকাসে হয়ে গিয়ে বসা স্বরে বলে, করি।

করবে। শাস্তিকে ভয় যে না করে তার সর্বনাশ।

সজল চুপ করে চেয়ে থাকে।

বাবা-ছেলের মধ্যে একটু আগের সহজ সম্পর্কটা হঠাৎ কেটে যায়।

শ্রীনাথ গলা খাকারি দিয়ে বলে, ইয়ে, তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। জবাব দিতে ভয় খেয়ে। সত্যি কথা বললেও আমি রাগ করব না।

কী?

আমার ঘরের তালাটা তুমি কীভাবে খোলো? চাবি দিয়ে, না অন্য কোনও যন্ত্রপাতি আছে?

সজল একটু অবাক হয়ে বলে, কেন? চাবি দিয়েই খুলি। অবশ্য খোলাটা অন্যায় হয়েছে। আর কখনও–

বাধা দিয়ে শ্রীনাথ বলে, অন্যায় তুমি স্বীকারও করেছ। সেটা নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। কথা হল, চাবি দিয়েই বা খোলো কী করে? চাবি তো আমার কাছে থাকে।

সজল একটু আমতা-আমতা করে বলে, মায়ের কাছে যে চাবিটা আছে, সেইটে চুরি করি।

মায়ের কাছে! শ্রীনাথ ভীষণ অবাক হয়। ঘরের তালাটা সে মাস দুই আগে চাদনি বাজার থেকে বাইশ টাকায় কিনেছে। নামকরা তালা। দুটো চাবিই তার কাছে। তৃষার কাছে আর একটা চাবি যায় কী করে? এলেবেলে তালা নয় যে, যে-কোনও চাবিতে খুলে যাবে। শ্রীনাথ কঠিন স্বরে বলে, তোমার মায়ের কাছে তো চাবি থাকার কথা নয়।

সজল বাপের দিকে চেয়ে আবার ফ্যাকাসে হয়। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে, গুরুপদ চাবিওলা মাকে চাবিটা বানিয়ে দিয়েছে।

শ্রীনাথ অবাক ভাব চেপে রেখে বলে, ও তালার চাবি কি বানানো যায়? চাবি বানাবে কীভাবে? সজল মাথা নেড়ে বলে, জানি না তো! গুরুপদদা একদিন চাবিটা দুপুর বেলায় মাকে দিয়ে যায়। সেই চাবি দিয়ে মা একদিন তোমার ঘর খুলে বৃন্দাদিকে দিয়ে ঘর পরিষ্কার করিয়েছিল।

ও।–বলে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে শ্রীনাথ।

সজলের ভয় কাটেনি, বরং বাড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলল, দোষটা আমারই।

তুমি মোরগটাকে মেরেছিলে?

হ্যাঁ।

মরার সময় মোরগটা কেমন করেছিল?

খুব ডানা ঝাপটাচ্ছিল। ভীষণ ডাকছিল। আমাকে ঠোকরানোর চেষ্টা করছিল। অথচ যখন চুরি করে ঠ্যাং ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কিছু করেনি। ঠিক যখন কাটব তখন ওই রকম করতে লাগল। কী করে যেন টের পেল, আমি ওকে কাটব।

মোরগের তো অত বুদ্ধি নেই, তবে টের পেল কী করে?

সজল কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ক্ষুরটা দেখে বোধ হয়।

ওরা তো ক্ষুর চেনে না।

অসহায় ভাব করে সজল বলে, তা হলে কী?

শ্রীনাথ একটু হেসে বলল, ওরা অস্ত্র চেনে না ঠিকই। তবে বোধ হয় ওরা কখনও-সখনও মানুষের চোখ মুখ আর হাবভাব দেখে কিছু টের পায়। আর কিছু না হোক, নিষ্ঠুরতাটা বুঝতে পারে, মৃত্যুর গন্ধও পায় নিশ্চয়ই।

সজল একটু অন্যমনস্ক হয়ে বোধ হয় দৃশাটা কল্পনা করে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, আমি অতটা বুঝতে পারিনি।

শ্রীনাথ সান্ত্বনার গলায় বলে, তোমার এখনও বোঝার বয়সও হয়নি। বয়স হলেও অনেকে ব্যাপারটা বোঝে না।

কাজটা খুব অন্যায় হয়েছিল, না?

শ্রীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলে, আমরা সবাই যখন মাছ মাংস খাচ্ছি তখন কাজটাকে একা তোমার অন্যায় বলি কী করে? মোরগ তো সবাই মারছে। সজল একটু হেসে বলে, তা হলে অন্যায় নয় তো?

তা ঠিক বলতে পারি না। হয়তো অন্যায়ই হবে। কিন্তু তুমি ওটা করতে গেলেই বা কেন? মাংস খেতে ইচ্ছে হয়ে থাকলে মংলুকে বললেই তো পারতে। ও কেটে দিত।

মাংস খেতে ইচ্ছে হয়নি তো! মা রোজ টেংরির জুস খাওয়ায়। রোজ খেতে ভাল লাগে, বলল? খেতে খেতে এখন মাংসের গন্ধে আমার বমি আসে।

শ্রীনাথ বলে, তা হলে কাটলে কেন?

এমনিই।

শ্রীনাথ হাসে, দূর পাগল! এমনি এমনি কিছু করে নাকি মানুষ? কারণ একটা থাকেই। একটু ভেবে দেখ তো!

আমার খুব রাগ হয়েছিল।

কার ওপর?

সকলের ওপর।

আমার ওপরেও?

সজল লজ্জা পায়। মাথা নেড়ে বলে, না, তোমার ওপর নয়।

তবে কি মায়ের ওপর?

হুঁ।

কেন?

সজল এবার আবার একটু ভাবে। ভেবে বলে, ঠিক মায়ের ওপরেও নয়।

তবে কার ওপর?

এই বাড়িটার ওপর। গাছপালার ওপর। হাঁস-মুরগির ওপর।

তোমার অত রাগ কেন?

এক-একদিন খুব রাগ হয়।

শ্রীনাথ আবার ক্ষীণ হাসে। বলে, রেগে যদি মোরগ মারতে পারো, তা হলে একদিন মানুষকেও খুন করে বসবে যে!

না, তা নয়। –সজল মাথা নিচু করে।

শ্রীনাথ এই বাক্যালাপে আগাগোড়া কৌতুক বোধ করছে। সে হেসেই বলল, স্কুলে যাচ্ছ না?

না। দু’দিন মা স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখেছে।

কবে তোমার ছুটি হবে?

বোধ হয় আজ। বৃন্দাদি সকালে এসে বলে গেছে পড়া করে রাখতে। আজ স্কুলে যেতে হবে।

রাত্রে তুমি এই ঘরে একা থাকো?

না, ছোটমামা শোয়।

ও।–শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলে, শোনো। তোমার সঙ্গে আমার আরও কয়েকটা কথা আছে। সন্ধের পর একবার আমার ঘরে এসো।

আচ্ছা।

তারপর শ্রীনাথ একটু ইতস্তত করে বলে, আমার সঙ্গে এই যে কথা হল এটা কাউকে বোলো না। আমি লুকিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম।

সজল এক গাল হেসে বলল, জানি।

শ্রীনাথও হাসল।

বলতে কী, মল্লিদাদার ওপর শ্রীনাথের কোনও রাগ নেই।

 

আগাছায় ভরা পড়ো জমি পেরিয়ে সামনের দিকে ফিরে আসতে আসতে শ্রীনাথ ভাবে, স্ত্রী বা মেয়েমানুষের ওপর অধিকারবোধটা ভুলে যেতে পারলে পৃথিবীটা কি আরও একটু সুন্দর হয়? কুকুব, বেড়াল, পাখি, পতঙ্গের তো বউ থাকে না। ওরকম হলেই কি ভাল? তা হলে সজল কার ছেলে, তার বউ কার সঙ্গে শুয়েছে, না শুয়েছে এসব বাজে চিন্তায় আর কষ্ট পেতে হয় না। ভেবে দেখলে, সজলের ওপরেও তার বিরাগ থাকা উচিত নয়। নিজের জন্মের জন্য সে তো দায়ী ছিল না!

গাছপালা, কীটপতঙ্গের কাছ থেকে শ্রীনাথ আজকাল অনেক শিখছে।

পালং ক্ষেতে সরিৎ দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বলল, জামাইবাবু, কোথায় ছিলেন? কখন থেকে খুঁজছি।

শ্বশুরবাড়ির কারও ওপর খুব খুশি নয় শ্রীনাথ। অবশ্য ওদের কোনও দোষও নেই। ভালমন্দে মিশিয়ে যেমন মানুষ হয়, ওরাও তেমনি সাধারণ। তবু তৃষার ওপর থেকে যেদিন তার মন সরে গেছে সেদিন ওদের ওপর থেকে গেছে।

শ্রীনাথ জোর করে মুখে হাসি এনে বলল, খুঁজছিলে?

হ্যাঁ। ভাবলাম, কোনও কাজ নেই যখন, জামাইবাবুর বাগানটা দেখে আসি। আমি খানিকটা বাগানের কাজ জানি।

খুব ভাল। এর পর থেকে এই বাগান তোমরাই দেখবে।

কেন, ওকথা বলছেন কেন? বাগান তো আপনারই।

কিছুই আমার নয়। জানো না?–মুখ ফসকে কথাটা বেরোল।

সরিৎ বোধ হয় মুখোমুখি কথাটা শুনে লজ্জা পেল। বলল, আমার বেশি জানার দরকার কী?

শ্রীনাথ অবশ্য সামলে গেল। বলল, আসলে কী জানো? এসব এখন ভাল লাগে না। এখন ভাল লাগে চুপচাপ সময় কাটিয়ে দিতে। কেউ একজন যদি বাগানটা দেখে তো ভালই।

সরিৎ মাথা নেড়ে বলে, আমি দেখব। আপনি কী করে কী করতে হয় বলে দেবেন।

বেশ তো!

সরিৎ বেশ লম্বা-চওড়া ছেলে। ওদের ধাতটাই ওরকম। সা জোয়ান সব। তবে খুব একটা বুদ্ধি বা রুচি নেই। একটু ভেতা, ব্যক্তিত্বহীন। এক সময়ে এই সরিৎ খুব প্রিয় ছিল শ্রীনাথের।

সরিৎ বলল, আগে আপনি আমাকে সব সময়ে ব্রাদার বলে ডাকতেন। এবার এসে একবারও ডাকটা শুনিনি।

শ্রীনাথ হাসল। বলল, কতকাল দেখা হয়নি। কী ডাকতাম তা মনেই ছিল না। এবার থেকে ডাকব।

আমাদের ভুলে গিয়েছিলেন তবে?–সরিৎ সকৌতুকে প্রশ্ন করে।

শ্রীনাথ বিপাকে পড়ে বলে, আরে না। ডাক ভুলতে পারি, মানুষকে কি ভোলা যায় সহজে!

শুধু মানুষ কেন, আমরা তো আত্মীয়। নয় কি?

সে তো বটেই।

তবে?

শ্রীনাথ কথার পিঠে কথা বলতে জানে না। তাই লজ্জা পেয়ে বলল, এসো, ঘরে এসো।

ঘরে ঢুকেই সরিৎ বলে, দারুণ তো! ঘর না বার তা বোঝা যায় না এত আলো বাতাস!

শ্রীনাথ তার ইজিচেয়ারে বসে বলল, তোমাদের বাড়ির সকলের খবর-টবর কী?

সরিৎ জবাবের জন্য তৈরিই ছিল। বলল, দিন পনেরো হল এসেছি, এই প্রথম এ কথাটা জিজ্ঞেস করলেন।

শ্রীনাথের বাস্তবিকই কারও কোনও খবর জানার কৌতূহল হয়নি। এইসব নীতি-নিয়ম ভদ্রতাবোধ তার মাথা থেকে উবে যাচ্ছে কেন?

সরিৎ ফের বলল, এ কয়দিন ভাল করে কথাই বলছিলেন না। আমি ভাবলাম, আমাদের ওপর বুঝি রাগ করে আছেন।

কথাটার জবাব হয় না। শুধু হাসি দিয়ে সেরে দিতে হয়। শ্রীনাথ যতদূর সম্ভব অপরাধী হাসি হেসে বলল, সংসারের নানা রকম ব্যাপার। আমি ঠিক এত বড় একটা এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অভ্যস্ত নই কিনা। তাই বড় ভুলও হয় সব কাজে।

সরিৎ বিছানায় বসে বলল, কার খবর জানতে চান?

শ্রীনাথের মনে পড়ল প্রথমেই শাশুড়ির কথা। বিয়ের সময় শ্রীনাথ খুব খেতে পারত। শাশুড়িও তাকে তখন প্রাণভরে খাইয়েছেন। থালার চারদিকে বাটি সাজিয়ে গোটা দুই বৃত্ত রচনা করে ফেলতেন প্রায়। প্রথমেই সেই ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ে। শুনেছে, খুব সুখে নেই। শ্বশুর রিটায়ার করার পর ছেলের হাততোলা হয়ে আছেন।

শ্রীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জিজ্ঞেস না করাই বোধ হয় ভাল। বরং মনে মনে সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করাটাই এখন দরকার।

সরিৎ কথাটা বুঝল। একটু গম্ভীর হয়ে বলল, এটা খুব ঠিক কথা। জানতে গেলেই মন খারাপ হবে। কেউই তো ভাল নেই।

তুমি কেমন সরিৎ?

সরিৎ না, ব্রাদার।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্রাদার।

আমিও ভাল না জামাইবাবু। বড়দার কাছে ছিলাম। ভাল ছিলাম না। সেজদি ডেকে আনল, এলাম। দেখি এখানে কেমন থাকি।

খারাপ লাগছে না তো এখানে?

ভাল কি লাগার কথা! বেকারকে কাজ না দিয়ে যত ভালই রাখুন সে ভাল থাকে না।

শ্রীনাথ চিন্তিত মুখে বলে, সেটা তো সকলেরই প্রবলেম ব্রাদার।

আমারও। তাই বলি, কেমন আছি না জানতে চেয়ে বরং আমারও মঙ্গল প্রার্থনা করুন।

দূর পাগলা! তোমার তো বয়স কম, জীবনটাই পড়ে আছে।

একটা চাকরি দিন, তবেই জীবন থাকবে। নইলে কবে শুনবেন, ট্রেনের তলায় গলা দিয়েছি।

যাঃ!–বলে হাসে শ্রীনাথ।

মাইরি জামাইবাবু! বিশ্বাস করুন।

 ১৪. চাবিটার কথা

চাবিটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না শ্রীনাথ। তৃষা তাকে গোপন করে ভাবন-ঘরের একটা চাবি করিয়ে রেখেছিল কেন তা বুঝতে অবশ্য তার কষ্ট হয় না। সোজা কথা শ্রীনাথের এই একটেরে ঘরখানার ভিতরেও তুষার দখলদারি রয়ে গেল। অবারিত হল ঘরখানা। শ্রীনাথের কিছু লুকোনোর রইল না, তার অনুপস্থিতিতে নিরাপত্তাও রইল না ঘরখানার।

মানুষ ঘর ঘর’ করে গলা শুকোয়। শ্রীনাথেরও শুকোত এতদিন। আজকাল সে ঘরের অসাড়তা বুঝতে পারে। এই সব অবসেসন অভিভূতির কোনও মানে হয় না। একখানা ঘর আর কতখানিই বা আশ্রয় দেয় মানুষ্য, যদি না ঘরের লোক আপন হয়। মিস্ত্রি এসে যে ঘর তৈরি করে দিয়ে যায় তার কোনও ব্যক্তিত্ব নেই, বিকার নেই। সেই ঘরে যে সব মানুষজন বসবাস করতে আসে তারাই ইট-কাঠ-টিনের ওপর নানা মায়া ভালবাসার পলেস্তারা দেয়, স্মৃতিব রং মাখায়, কত ঠাট্টা ইয়ারকি খুনসুটি, আদর ভালবাসা দিয়ে পূরণ করে তোলে ঘরের শূন্যতাকে। শ্রীনাথ তবে কেন ঘর ঘর করে মরবে? ঘর তো তুষার।

সরিৎ চলে যাওয়ার পর খানিক বসে এই তত্ত্বকথা চিন্তা করল সে। তারপর উঠে খুব তীক্ষ্ণ নজরে নিজের দেরাজ খুলে সব পরীক্ষা করল। বাক্স তোরঙ্গ উলটে পালটে দেখল। সবই ঠিক আছে। দেরাজের বা বাক্সের চাবিও হয়তো করিয়েছে তৃষা। কে জানে? তার চেক বই, পাশ বই, ইনসুয়েরেনসের পলিসি, শেয়ার সার্টিফিকেট, নগদ টাকা এসবই বোধ হয় খুঁটিয়ে দেখেছে।

মালদা থেকে সরিৎকে কেন আনিয়েছে তৃষা তাও খানিকটা আন্দাজ করতে পারে শ্রীনাথ। এ কথা তৃষা ভালই জানে যে জমিজিরেতের ওপর নির্ভর করে থাকার বিপদ আছে। মল্লিনাথের সব জমি আইনত তার নয়ও। ভুতুড়ে জমি মেলাই আছে। যে-কোনওদিন শত্রুরা খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে আর সরকার জমি কেড়ে নেবে। কানাঘুষোয় শ্রীনাথ শুনেছে, তৃষা বড় পাইকারি দোকান দেবে। চালকল খুলবারও ইচ্ছে আছে। হয়তোবা সেই সব কাজের জন্য বিশ্বস্ত লোকের দরকার বলেই আনিয়েছে সরিৎকে।

সরিতের ইতিহাসটা খুব পরিষ্কার জানে না শ্রীনাথ। শেষবার যখন দেখেছিল তখন বোধ হয় সদ্য কলেজে ঢুকেছে। তখনও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়নি। এক বছরে ছেলেটা মানুষ হয়েছে না অমানুষ তা এই অল্প সময়ে বোঝা গেল না। কিন্তু সে যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সরিৎ তৃষারই লোক, শ্রীনাথের কেউ নয়।

শ্রীনাথের লোক পৃথিবীতে খুবই কম। নেই বললেই চলে।

গভর্নমেন্ট প্রেসে স্ট্রাইক চলছে বলে শ্রীনাথের প্রেসে এখন বিস্তর জব ওয়ার্ক এসে জমা হয়েছে। উঁই ভঁই হরেক রকমের ফর্ম, বিল, বিজ্ঞপ্তি ছাপার কাজ চলছে। মালিক বলে দিয়েছে, কামাই করা চলবে না। কাজ তুলে দিতে পারলে সবাইকে একটা থোক টাকা দেওয়া হবে। মিনি বোনাস।

বোনাসের ওপর শ্রীনাথের কোনও টান নেই। তবে সে হল জব ওয়ার্কের বিশেষজ্ঞ। বহুকাল প্রেসে কাজ করায় সে হেন কাজ নেই যে জানে না। মল্লিনাথের সম্পত্তি হাতে আসায় কিছুকাল আগে সে নতুন ফেসের কিছু টাইপ তৈরি করার জন্য ভূতের মতো খাটছিল। বাংলা টাইপরাইটার সংস্কারের কাজেও বিস্তর মাথা ঘামাচ্ছিল। কাজ এগিয়েছিল অনেকটাই। লেগে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত হয়তে। কিন্তু, দেদার সম্পত্তি আর নগদ টাকা হাতে আসায় কেমন যেন গা ঢিলে দিয়ে দিল। তবু এখনও বোধ হয় প্রেসের কাজকে সে এক রকম ভালই বাসে। প্রেসটার ওপরেও তার গভীর মায়া। তাই এই কাজের চাপের ব্যস্ততা তার খারাপ লাগে না।

স্নান করে খেয়ে বেরোতে একটু দেরি হল তার। তা হোক। মালিকপক্ষ জানে, দেরি করে গেলেও শ্রীনাথ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে। দরকার হলে সারা রাত খেটে কাজ তুলে দেবে। কাজের চাপে থাকলে শ্রীনাথ অন্য মানুষ। সেই কাজের জন্য সে বোনাস ইনক্রিমেন্ট বা প্রোমোশনও চাইবে না! ওসব কথা তার মনেই আসে না। শুধু মনটার মধ্যে একটা কথাই খচখচ করছে, সজলকে বিকেলে আসতে বলেছিল ঘরে। যদি দেরি হয় তবে সজল এসে ফিরে যাবে। কথার খেলাপ হবে তার। বাচ্চাদের কাছে কথার খেলাপ করা ঠিক নয়। এতে ওরা শ্রদ্ধা হারায়, হতাশায় ভোগে।

অফিসে পৌঁছে এক গ্লাস জল খেয়ে, একটা পান মুখে দিয়ে কাজে ড়ুবে গেল শ্রীনাথ। চাবির কথা মনে রইল না, ঘরের কথা মনে রইল না, তৃষা বা সজলের কথাও বেমালুম গায়েব হয়ে গেল মন থেকে।

কিন্তু মনে পড়ল বিকেলের দিকে। মনে করিয়ে দিল সোমনাথ।

বোসবাবু এসে খবর দিলেন, আপনার ভাই এসেছে।

সন্ধে হয়-হয়। শ্রীনাথের ঘাড় টনটন করছিল। কপি ধরে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোধরানো কম কথা নয়। ভুল থাকলে প্রেসের রাক্ষুসে মেসিন এক লহমায় সেই ভুল কপি কয়েক হাজার ছেপে ফেলবে। ভুল ধরা পড়লে ছাপা কাগজ সব ফেলে দিতে হবে। এখন কাগজ কালি লেবারের খরচার যে বহর তাতে ক্ষতির পরিমাণটা বড় কম দাঁড়াবে না। তাই মালিক নিজে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কাজ দেখে গেছে। প্রিন্ট-অর্ডার দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছে শ্রীনাথকে। তাতে শ্রীনাথের ঝামেলা বেড়েছে। মাথা তোলার সময় পায়নি।

ভাই কথাটা কানে শুনেই বুঝেছিল সোমনাথ। দীপনাথ কিছুতেই নয়। কারণ দীপ ভাই হলেও একটু দূরের ভাই।

প্রেসটা বিরাট বড় দরের হলেও রিসেপশন বা ওয়েটিং রুম বলে কিছু নেই। বাইরের দিকে সুপারিনটেনডেন্টের ফাঁকা অফিসে বসে আছে সোমনাথ। মুখটায় চোর-চোর ভাব, চোখের দৃষ্টিতে শেয়ালের মতো একটা এড়ানো-এড়ানো ভাব।

প্রকৃতির নিয়মে বাপের মেজো ছেলেরাই নাকি সবচেয়ে পাজি হয়। তাদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। শ্রীনাথ নিজেই মেজো। সে কতটা পাজি তা হিসেব করে দেখেনি এখনও। কিন্তু পাজি বলতে সত্যিকারের যা বোঝায় তা হল সোমনাথ। মল্লিনাথের সম্পত্তির ভাগ চাইছে বলেই নয়, সোমনাথ বুড়ো বাবাকে নিজের কাছে রেখে অন্য দুই ভাইয়ের কাছ থেকে সেই বাবদ টাকা নেয়। ভয়ংকর কৃপণও বটে। সরকারের একটা বিল সেকশনে কাজ করে। ঠিকাদারদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা ঘুষ নেয়।

শ্রীনাথ বলল, কী রে?

তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

সোমনাথের কপালে এখনও সেই মারের দাগ রয়েছে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল।

শ্রীনাথ দারোয়ানকে দু’ভড় চা আনতে পাঠিয়ে বসে বলল, সব ভাল তো?

সোমনাথের চেহারাটা মন্দ নয়। মোটাসোটা, গোলগাল, গোপাল-গোপাল চেহারা। যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ছোট ছেলেকে চূড়ান্ত আদর দিয়ে গেছে। সেই সুবাদেই এই চেহারা।

সোমনাথ বলল, বাবার অবস্থা তো জানোই! যে-কোনওদিন হয়ে যাবে।

জানা কথা। বাবার খবরের জন্য ব্যস্ত নয়ও শ্রীনাথ। এই সব নিষ্ঠুরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আসে। বাবা যে কবে ফালতু হয়ে গেল তা টেরও পায়নি। কিন্তু হয়েছে।

শ্রীনাথ একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সে তো জানি।

সোমনাথ মার খাওয়ার পর দু-তিন বার ওকে দেখতে এসেছিল শ্রীনাথ। তখন বাবার সঙ্গেও দেখা হয়। কিন্তু দেখা হওয়া আর না হওয়া সমান। বাবা এখনও তোক চিনতে পারছেন বটে কিন্তু কারও জনাই কোনও অনুভূতি নেই। সোমনাথ যে হাসপাতালে তা শুনেও নির্বিকার। বিকেলের জলখাবার নিয়ে শমিতার কাছে বায়না করছিল বলে শমিতা কটকট করে উঠল। বলল, আপনার ছেলে হাসপাতালে সিরিয়াস অবস্থায় পড়ে আছে, আর আপনি চিড়েসেদ্ধ চিড়েসেদ্ধ করে পাগল হচ্ছেন! এ রকমই ধারা নাকি আপনাদের?

কথাটা তা নয়। বাবা এখন সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ এই সব অনুভূতির বাইরে চলে গেছে। বোধ-বুদ্ধি ছোট হয়ে হয়ে এখন কেবল নিজের জৈবিক চাহিদাটুকু নিয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এও হয়তো এক ধরনের পাগলামি। তবে যাই হোক, বাবাকে নিয়ে তাদের আর খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা নেই। তৃষা কিছুকাল আগেই শ্রীনাথকে একবার বলেছিল, শ্বশুরমশাইকে এখানে এনে রাখলেই তো হয়। এখানে অনেক ফাঁকা ঘর, খোলামেলা জায়গা, দেখাশুনো করার লোকও আছে, তবে কেন উনি সোমনাথদের খুপরি বাসায় পড়ে থাকবেন?

যখনকার কথা তখনও সোমনাথ মার খায়নি। ফি-রবিবারে সস্ত্রীক ঝগড়া করতে আসত। প্রস্তাব শুনে কিন্তু সোমনাথ বা শমিতা কেউ রাজি হল না। বলল, না, উনি আমাদের কাছেই থাকতে চান। অন্য কোথাও যাওয়ার নাম করলেই রেগে ওঠেন।

কথাটা মিথ্যেও নয়। বুড়ো বয়সে অনেক সময়েই অভ্যস্ত জায়গা ছেড়ে লোকে অন্য কোথাও যেতে চায় না। যুক্তি হিসেবে ছেলেমানুষের মতো বলে, এ বাড়িতে পায়খানাটা কাছে হয়, এখানে জলের সুবিধে, সোমনাথ রোজ মাছ আনে ইত্যাদি। তবু বাবাকে জোর করে আনাও যেত এবং তাতে ফল খারাপ হত না। কিন্তু সোমনাথ রাজি হল না অন্য কারণে। বাবার খরচ বাবদ তৃষা মাসে মাসে ওকে তিনশো টাকা করে পাঠাত এবং শ্রীনাথ যত দূর জানে, এখনও পাঠায়। কর্তব্যের ব্যাপারে তৃষার কোনও ত্রুটি নেই। আর কিছু সোমনাথ আদায় করে বিলু আর দীপনাথের কাছ থেকে। দীপ মাসে মাসে দেয় না, কিন্তু কখনও-সখনও থোক পাঁচ-সাতশো টাকাও দিয়ে ফেলে। সুতরাং বাবাকে নিজের কাছে রাখলে সোমনাথের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।

সোমনাথ একটু চুপ করে থেকে বাবা সম্পকে ট্র্যাজেডি শ্রীনাথের মাথায় বসতে সময় দিল। তারপর বলল, আমি ছেলে হিসেবে কোনও ত্রুটি রাখি না, সব কর্তব্যই করি।

হুঁ।— শ্রীনাথ ওর মতলব বুঝতে না পেরে সাবধান হয়ে সংক্ষেপে উত্তর দিল।

সোমনাথ দুঃখী-দুঃখী মুখ করে গম্ভীর গলায় বলল, শমিতার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।

কী হয়েছে?

সোমনাথ অপরাধীর মতো মুখ নিচু করে বলে, ছেলেপুলে হবে।

ও।

তাই বলছিলাম এ অবস্থায় বাবার যত্ন-আত্তি ঠিক মতো হবে না। বাবার অবশ্য অত বোধটোধ নেই, কিন্তু আমার তো বিবেক আছে। ডাক্তার শমিতাকে কাজকর্ম করতে একদম বারণ করেছে, বেশি নড়াচড়া করলে মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে।

কোনও ডিফেক্ট আছে নাকি?

আছে।

তা হলে এখন কী করতে চাস?

যদি কিছু মনে না করো তো বলি, এখন বাবাকে কিছুদিন তোমাদের কাছে নিয়ে রাখো।

শ্রীনাথ টক কবে প্রস্তাবটায় রাজি হতে পারে না। তৃষা এক সময় শ্বশুরকে তার কাছে রাখতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু এতদিনে যদি মত পালটে থাকে? বাড়ি তো শ্রীনাথের নয় যে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে।

শ্রীনাথ বলল, তোর বউদিকে একটু বলে দেখ।

সোমনাথ একটু উম্মার সঙ্গে বলল, বউদিকে বলব কেন? বউদি কে? তুমি কর্তা, তুমিই ডিসিশন নেবে।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আমি কিসের কর্তা? কোনও ব্যাপারেই আজকাল আমি থাকি না।

সোমনাথ ওপরওয়ালার মতো চড়া গলায় বলল, থাকো না কেন? থাকো না বলেই তো মেয়েমানুষের বাড় বাড়ে।

বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ বলে, ওসব কথা থাক। আমি না হয় তোর বউদিকে আজ জিজ্ঞেস করব’খন, কাল এসে জেনে যাস।

কী জেনে যাব? জানাজানির মধ্যে আমি নেই। বাবা তো তোমারও। তোমরা এক সময়ে বাবাকে রাখতেও চেয়েছিলে। তা হলে এখন আবার পিছোচ্ছ কেন?

শ্রীনাথ একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইল। এটা যে পিছানো নয় তা সোমনাথও কি জানে? ও এখন একটা চাল খেলছে, সেটা যে কী তা অবশ্য শ্রীনাথ বুঝতে পারছে না।

সোমনাথ বলল, তা ছাড়া অত মতামতেরই বা দরকার কী বুঝি না, বাবা! বড়দা তো বাবারই ছেলে। তার বাড়িতে বাবা তো নিজের রাইট নিয়েই থাকতে পারে।

ছেলের সম্পত্তির ওপর বাবার অধিকার আছে, এমন কথা কোন আইনের বইতে আছে তা একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল শ্রীনাথের। কিন্তু তাতে কথা বাড়বে বলে বলল না।

শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলল, আমি তো অমত করছি না। তবে আমার মতামতের দামও নেই।

একশো বার দাম আছে।–সোমনাথ গলার জোরে কথাটাকে যত দূর সম্ভব গেঁথে দিতে চেষ্টা করল শ্রীনাথের মাথায়। তারপর মোলায়েম আদুরে গলায় বলল, তুমি মেজদা, দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছ বলো তো! তোমার টাকাপয়সা বা বিষয়-সম্পত্তির লোভ নেই সেটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু তা বলে সংসারের সব কর্তৃত্ব বউদির হাতে ছেড়ে দেবে?

শ্রীনাথ যে নির্লোভ সেটা যে সোমনাথ জানে তা শুনে খুশিই হয় শ্রীনাথ। বলে, আমি যেমন আছি তেমনিই থাকতে দে। গণ্ডগোলে জড়াস না।

সন্নিসি তো নও। সংসারে থাকলে গা বাঁচিয়ে চলবে কী করে? তা ছাড়া চোখের সামনে এত বড় সব অন্যায় ঘটে যাচ্ছে দেখেও যদি চুপ করে থাকো তবে তোমার ভালমানুষির কোনও দাম থাকে

ভালমানুষির দামই বা চাইছে কে! কথাটা বলতে পারত শ্রীনাথ, বলল না। শুধু আনমনে একবার হুঁ দিল।

সোমনাথ বলল, বউদি যে তোমাকে বাড়ির চাকর-বাকর মনে করে সেটা আমাদেরও খারাপ লাগে। তুমি যদি একটু রোখাচোখা হতে তবে এমনটা হতে পারত না।

শ্রীনাথের একটু রাগ হচ্ছিল। কিন্তু সোমনাথকে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। কোনওকালেই ও কারও পরোয়া করে না। শ্রীনাথ তাই চুপ করে থাকে।

সোমনাথ নিজেই বলে, তুমি চুপ করে থাকলেও আমি ছেড়ে দেব বলে ভেবো না। তোমাদের ওখানকার লোকেরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তারা কেউ বউদির পক্ষে নয়। তারা নিজেরাই বলছে বড়দার সম্পত্তিতে বউদি কোনও রাইট নেই। দরকার হলে তারা ওখানকার মাতব্বরদের সালিশি মানবে। বউদির রাজত্ব অত নিষ্কণ্টক হবে ভেবো না।

এটা যে অপমান তা শ্রীনাথ বুঝতে পারছে। তৃষার সঙ্গে তার বনিবনা থাক বা না থাক এই কথাগুলো তৃষাকে জড়িয়ে তাকেও বলা। তবু জবাব দেওয়ার মতো জোর পায় না শ্রীনাথ। সে নিজেও বোঝে, দাদার সম্পত্তি নিয়ে একটা অন্যায় দখলদারি চলছে।

শ্রীনাথ বলল, এসব আমাকে বলছিস কেন? আমি তোদের কী করেছি? যা করবি করিস, আমার কিছু বলার নেই।

সোমনাথ একটু নরম হয়ে বলে, তোমাকে কষ্ট দিতে চাইও না। দুঃখ হয় বলে বলি।

ওখানকার কে কে তোর কাছে এসেছিল?

অনেকেই আসে। বহু গুপ্ত খবর দিয়ে যায়। বউদি নাকি তার গুন্ডা ক্লাসের সেই ভাইটিকে মালদা থেকে আনিয়েছে।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সরিৎ! সরিৎ গুন্ডা নাকি?

সোমনাথ একটু হেসে বলে, তুমি তো মানুষ চেনো না। নিতাই খ্যাপাকে মেরে তোমার শালা পাট পাট করে দিয়েছিল। বউদি ঘটনাটা চেপে দিয়েছে। এতকাল ভাড়াটে গুন্ডা ছিল, এখন নিজের ভাইকে দিয়েই গুন্ডামি চালাবে।

নিতাইকে সরিৎ মেরেছে, এ কথা কেউ তো আমাকে বলেনি।

তুমি কোন খবরটাই বা রাখো! বউদি যে বন্দুকের লাইসেন্স চেয়ে অ্যাপলিকেশন করেছে তা জানো?

না তো। বড়দার একটা জার্মান বন্দুক ছিল তা মনে আছে?

আছে। আমি নিজেও কয়েকবার শিকার করতে গিয়ে চালিয়েছি। তারপর সেটা থানায় জমা করে দিই।

বউদি সেইটেই ফেরত চেয়েছে। তবে লাইসেন্স হবে সরিহেব নামে।

শ্রীনাথের কাছে এগুলো খুব একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার নয়। সে বলল, ও, তা হবে।

ছেলেপুলের ঘর বলে মারাত্মক অস্ত্রটা শ্রীনাথ ঘরে রাখতে চায়নি। নইলে সে দরখাস্ত করলে বন্দুকটার দখল পেয়ে যেত। কিন্তু দখল করার ইচ্ছেই তার ছিল না। তাই থানায় জমা করে দিয়েছিল। তৃষা বন্দুকটা ফেরত চেয়েছে, ভাল কথা, কিন্তু সেটা একবার তাকে জানালেও পারত।

সোমনাথ বলল, সরিৎ হল বউদির রঙ্গরাজ।

শ্রীনাথ বুঝল না। বলল, কে রঙ্গরাজ?

দেবী চৌধুরানির বড় সাকরেদ, মনে নেই? আর বউদি নিজে হতে চাইছে দেবী চৌধুরানি।

শ্রীনাথের গম্ভীর থাকা উচিত ছিল। কিন্তু উপমাটা এমন অদ্ভুত যে, অনিচ্ছেসত্ত্বেও ক্ষীণ একটু হেসে ফেলল।

সোমনাথ আঁশটে মুখে বলে, হেসো না মেজদা। ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস।

শ্রীনাথ এবার গম্ভীর হয়ে বলল, তা আমি কী করব বল?

কিছুই যদি না করো তবে অন্তত দেখে যাও। চতুর্দিকে লক্ষ রেখে চলো।

চাবির কথাটা আবার মনে পড়ে গেল শ্রীনাথের। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে। বলল, লক্ষ রেখেই বা লাভ কী? আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

সোমনাথ অধৈর্যের গলায় বলল, বাবার ব্যাপারটা কী হবে?

বললাম তো।

শোনা, মেজদা!–সোমনাথ খুব জোরালো গলায় বলে, বউদির মত থাক বা না থাক আমি সামনের রবিবার বাবাকে নিয়ে গিয়ে তোমাদের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসছি। তারপর আর আমার দায়িত্ব থাকবে না।

দারোয়ান চা দিয়ে গেল। শ্রীনাথ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, তাতে হয়তো আপত্তি উঠবে না। কিন্তু আমি বাবার কথাটাই ভাবছি।

কী ভাবছ?

বাবার খুব কষ্ট হবে হয়তো।

বাবার কষ্টের কথা যদি সত্যিই ভাবো তবে কষ্ট দিয়ো না।

মুখের মতো জবাব পেয়ে শ্রীনাথ চুপ করে গেল। চা খেয়ে উঠল সোমনাথ। বলল, তা হলে ওই কথাটাই ফাইনাল।

শ্রীনাথ উর্ধ্বমুখে ভাইয়ের মুখখানা দেখল। বাবাকে ও কেন রতনপুরে চালান করছে তার সত্যি কারণটা বুঝতে চেষ্টা করল। সম্ভবত সোমনাথ বাবাকে ওখানে পাঠিয়ে ক্ষীণ একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। নইলে মাসে তিনশো টাকার ফালতু আয় জলাঞ্জলি দিত না।

 

সোমনাথ চলে যাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ কাজ করল শ্রীনাথ। যখন উঠল তখন সন্ধে সাতটা।

খারাপ পাড়ায় যেতে হলে প্রথম প্রথম একটু বুকের জোর চাই। একা যেতে সাহসও হয় না। কিন্তু আশ্চর্য আশেপাশে বন্ধুবেশী আড়কাঠিরা ইচ্ছেটাকে ঠিক টের পেয়ে যায় এবং তারাই পৌঁছে দেয় মেয়েমানুষের ঘরে। শ্রীনাথেরও তাই হয়েছিল। যখন ফেবারিট কেবিনে আড্ডা মারত তখন কানাই বোস নামে একজন ঠিকাদারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সে খারাপ পাড়ায় যেত এবং সেইসব গল্পও করত খুলে মেলে। শ্রীনাথকে খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল সে-ই। তারপর থেকে অবশ্য আর বাধা হয়নি। যেতে যেতেই শ্রীনাথের অভিজ্ঞতা হয়েছে, কলকাতা শহরে নাম লেখানো এবং ন-লেখানো খারাপ মেয়ে অঢেল। আজকাল তার চোখ পাকা হয়েছে। রাস্তায় ঘাটে যে-কোনও মেয়েকে একনজর দেখলেই বুঝতে পারে, খারাপ না ভাল। তা ছাড়া যাতায়াতে বহু দালালের সঙ্গে চেনা হয়েছে। তারাও খোঁজ দেয়। বাবুল দস্তিদার নামে একজন বন্ধু গোছের দালাল কদিন আগে বলেছিল, শ্রীনাথবাবু, আপনি লো ক্লাসের মেয়েদের কাছে যান কেন? ওরা তো পান্তা ভাত। কোনও মজা নেই। যাদের রেস্ত আছে তারা নানারকম এনজয়মেন্ট করবে। শরীরের ব্যাপারটারও তো অনেক রকম স্টাইল আছে।

বাবুল তাকে হাওড়া ময়দানের কাছে নমিতার খোঁজ দেয়। দেখে খারাপ মেয়ে মনে করা বেশ কঠিন। একদম আধুনিকা। ফটাফট ইংরেজি বলে, দারুণ সাজে, গিটার বাজায়, বি এ পাশ। রবি ঠাকুর থেকে বিষ্ণু দে পর্যন্ত কোটেশন দেয়।

খরচ অনেক বেশি বটে, কিন্তু নমিতা কেবলমাত্র শরীরী তো নয়। সে শ্রীনাথের সঙ্গে বেড়ায়, রেস্টুরেন্টে খায়, সিনেমা-থিয়েটারও দেখে। সারাক্ষণ বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগ কথাই প্রেম-ভালবাসা ঘেঁষা। এমন সব কথা যা শ্রীনাথের বয়ঃসন্ধির যৌবনকে ফিরিয়ে আনে। নমিতার চোখের চাউনি, ঠোঁটের হাসি সব কিছুই অত্যন্ত উষ্ণ, নিবিড় এবং অনেকটাই যেন আন্তরিক। বিভ্রমই বটে, তবে বিভ্রমই তো মানুষ চায়।

শ্রীনাথ তাই সম্প্রতি নমিতার খাতায় নাম লিখিয়েছে। জমানো টাকা হু-হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা যাক। জীবনে টাকা দিয়ে তো কিছু পাওয়া চাই। শ্রীনাথ মনে করে নমিতার কাছে সে কিছু পাচ্ছে। কৃত্রিম হলেও পাচ্ছে।

নমিতার খদ্দেরের সংখ্যা বেশি নয়। দিন ও সময় বাঁধা থাকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া যাওয়া যায় না। এইটেই একমাত্র যা অসুবিধে।

আজ শ্রীনাথের দিন নয়। তবু মনটা ভাল ছিল না বলে হাওড়ায় এসে গাড়ি ধরতে গিয়ে ধরল। বেরিয়ে বাসে উঠে ময়দানের কাছে নমিতার দোতলার ফ্ল্যাটে এসে উঠল।

আশ্চর্য! নমিতা একা ফাঁকা ঘরে সেজেগুজে বসে আছে। তাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে বলল, আজ একটা ছোটলোকের আসার কথা ছিল। দেখো তো, সারা বিকেলটা বসে বসে নষ্ট করলাম। তুমি এলে, কী ভাগ্যি!

খুশি হয়েছ?

সকলের বেলায় হই না। তুমি তো সকলের মতো নও!

নই?

নমিতা হেসে ফেলে বলে, বললে ভাববে তেল দিচ্ছি। তা কিন্তু নয়।

সোফায় বসে শ্রীনাথ হাসিমুখে বলল, আমি কীরকম ৩ আজ তোমার মুখে শুনব। বলো তো।

যাঃ।–লজ্জায় যেন লাল হল নমিতা। মুখ দু’ হাতে ঢেকে বলল, এভাবে বলা যায় কি? বোঝো না কেন?

নমিতার দোভাঁজ করা বিনুনির সঙ্গে অনেকগুলো আলগা ফিতে বাঁধা! তাতে ভারী ছুকরি দেখাচ্ছে ওকে। কানে মস্ত রুপোর কানপাশা। হাতে রুপোর চুড়ি। একটু অবাঙালি সাজে আজ ওর আকর্ষণ তিনগুণ বেড়েছে।

মায়া ও মতিভ্রমের দিকে অভাসবশে হাত বাড়াল শ্রীনাথ।

কিন্তু তারপর শরীরে সেই খিতখিত ভাব। যেন অপবিত্রতা, অশৌচ। বাড়িতে ফিরে কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে গরম জল বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। স্নান করবে।

এমন সময় দরজার বাইরে সজল এসে দাঁড়ায়।

বাবা!

এসো।

শ্রীনাথ নরম স্বরে ডাকে। মনে মনে ভাবে সজলের সঙ্গে এই দেখা হওয়ার আগে স্নানটা সেরে নেওয়া উচিত ছিল। স্নান না করে যেন এই অবস্থায় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে নেই। কোথায় যেন আটকায়।

সজল একটু যেন সংকোচের সঙ্গে ঘরে আসে। মুখে একটু লজ্জার হাসি।

সজল দেখতে ভারী মিষ্টি। মুখখানা যেন নরুন দিয়ে চেঁচে তৈরি। শরীরের হাড়গুলো চওড়া। লম্বাটে গড়ন। বড় হলে ও খুব লম্বা চওড়া আর শক্তিমান পুরুষ হয়ে দাঁড়াবে।

সজল ঘরে ঢুকে কৌতূহলভরে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা দেখতে থাকে। হঠাৎ বলে, জল গরম করছ কেন বাবা? চা খাবে? ছোড়দিকে বলো না, করে দেবে।

না, চা খাব না।

তবে?

চান করব।

এত রাতে!–সজল অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়।

কী বড় বড় অন্তর্ভেদী চোখ। কিছুতেই শ্রীনাথ ওর চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল, পায়ে নোংরা লেগেছিল।

বুকটা ঢিব ঢিব করে ওঠে শ্রীনাথের। হে ভগবান! আর যাই হোক ছেলের কাছে যেন কোনওদিন মুখ কালো না হয়।

সজল বলে, তোমার শীত করবে না?

শীত করবে বলেই তো গরম জল করছি।

বাড়িতে বলে পাঠালেই তো মা গরম জল করে দিত।

লোককে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! এটুকু নিজেই পারা যায়।

তোমার ক্ষুরটা ধরেছিলাম বলে রাগ করেছ, বাবা?

একটু করেছিলাম। এখন আর রাগ নেই। টেবিলের ডান ধারের দেরাজে আছে। বের করে নাও। ওটা তোমাকে দিলাম।

দিলে?–উজ্জ্বল হয়ে সজল জিজ্ঞেস করে।

হুঁ। কিন্তু খুব সাবধান। অসম্ভব ধার। হাত-টাত কেটে ফেলো না।

না, আমি দাড়িই কাটব।

দাড়ি!— অবাক হয়ে শ্রীনাথ তাকায়।

হি হি। নিতাইদা যখন ঘুমোবে তখন চুপি চুপি গিয়ে ওর দাড়ি কামিয়ে দিয়ে আসব।

সর্বনাশ।–শ্রীনাথ প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ে, খবরদার ওসব করতে যেয়ো না। কখন গলায় বসিয়ে দেবে অসাবধানে। তা হলে কিন্তু ফাঁসি।

আচ্ছা। তাহলে রেখে দেব। বড় হলে নিজের দাড়ি কামাব।

ক্ষুরটা ওকে দেওয়া ভুল হল কি? হয়তো। কিন্তু এখন দেওয়া জিনিস ফেরত নেওয়া ঠিক হবে না।

শ্রীনাথ বলে, তুমি মাকে জিজ্ঞেস করে এখানে এসেছ তো!

হ্যাঁ।–ঘাড় নাড়ে সজল। বলে, মা বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।

তোমার মা!— বলে আবার সচকিত হয়ে খাড়া হয় শ্রীনাথ।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার আড়াল থেকে কালো শাড়ি পরা তৃষা দরজার আলোয় দেখা দেয়।

অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তার স্ত্রী এই ঘরে আসতেই পারে। তবু ভীষণ যেন চমকে যায় শ্রীনাথ। যেন তার লুকোনো কোনও ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে। প্রকাশ পেয়েছে তার ভীষণ কোনও গোপনীয়তা।

শ্রীনাথ বলল, তুমি!

তৃষা গম্ভীর মুখে বলে, অবাক হওয়ার কী হল? আমি তো ভূত নই। মানুষ।

 ১৫. শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল

শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এসো। কিছু বলবে?

তৃষা খুব তীক্ষ্ণ চোখে সজলের দিকে চেয়ে ছিল। চৌকাঠের ওপাশ থেকেই বলল, ক্ষুরটা কি তুমি সজলকে দিয়ে দিলে?

হুঁ।

কেন দিলে?

ওর ওটার ওপর খুব লোভ। প্রায়ই চুরি কবে আমার ঘরে ঢুকে ক্ষুরটা নিয়ে দুষ্টুমি করে বেড়ায়।

তাই দেবে? বাচ্চা ছেলের হাতে ধারালো জিনিস থাকলে কত কী বিপদ হতে পারে।

শ্রীনাথের যে কথাটা মনে হয়নি তা নয়। কোথায় যেন একটু অপরাধবোধ জেগে ওঠে তার। বলে, ওকে বলেছি রেখে দিতে।

তৃষা কঠিন গলায় বলল, সজল কি খুব বাধ্য ছেলে? ওকে তুমি চেনো না?

শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, অ৩ ভেবে দেখিনি। না দিলেও তো নিজে থেকেই নেবে।

তাই ওই সর্বনেশে জিনিস হাতে তুলে দিতে হবে? ওইটে দিয়েই মুরগি কেটেছিল!

সজল টেবিলের ধারটায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা বাবা দু’জনকেই সে সাংঘাতিক ভয় পায়। ক্ষুরটা নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে মুঠোয় ধরে রেখেছে। চোখ দরজার দিকে।

শ্রীনাথ কঠিন স্বরে বলে, তার আগে আমার জানা দরকার মুরগি কাটার জন্য ক্ষুরটা ও পেয়েছিল কী করে! আমার ঘরে ঢুকল কী করে?

তৃষা শ্রীনাথের দিকে স্থির তীব্র চোখে চেয়ে বলে, সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কোরো। আমার সেটা জানার কথা নয়।

শ্রীনাথ এ নিয়ে কথা বাড়াতে চায় না। চাবিব কথা উঠলে সজলের নাম ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সে তৃষার চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল, আমার দেওয়ার ভাগ দিয়েছি। তোমার ভয় করলে ওর কাছ থেকে নিয়ে নাও।

তৃষার গলায় বেশির ভাগ সময়ে উম্মা থাকে না, কাঠিন্য থাকে। ঠান্ডা নিরুত্তাপ একরকম রক্ত জল করা গলায় বলল, ও খুব স্বাভাবিক নয়। ক্ষুর, ছুরি বা ওরকম কিছু পেলে ও যা-খুশি করতে পারে। নিজের গলাতেও বসিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়। এটা তোমার না জানার কথা নয়। নিজেও দেখছ।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আমি জানব কী করে? আমাকে কেউ এ রকম কিছু বলেনি তো!

নিজের ছেলে সম্পর্কে আর-একটু খোঁজ-খবর রাখাটা বোধ হয় ছেলের ভালর জন্যই দরকার।

বলে তৃষা সজলের দিকে তাকাল। খুবই শান্ত গলায় বলল, ক্ষুরটা তোমার বাবাকে ফেরত দাও।

সজল টেবিলের ওপর ক্ষুবটা রেখে দেয়। আস্তে করে বলে, বাবা বলছিল আমি যেন বড় হয়ে ওটা দিয়ে দাড়ি কামাই।

তৃ তেমনি শান্ত স্বরে বলে, দাড়ি যখন হবে তখন ক্ষুরেরও অভাব হবে না!

এর মধ্যে শ্রীনাথের কিছু বলা সাজে না। সে তাই অপমানিত বোধ করেও চুপ করে থাকে।

তৃষা চৌকাঠ ডিঙোল না। দরজার কোণে বাঁকা হয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু বলতে আসিনি। সজলকে বিকেলে আসতে বলেছিলে, ও অনেকবার তোমার খোঁজ করে ফিরে গেছে। রাতে আবার এল। অন্ধকার উঠোন পেরোতে ভয় পায় বলে সঙ্গে এসেছি। দেরি দেখে সজল ভাবছিল।

শ্রীনাথ বলল, অফিসে কাজ ছিল। বিকেলে ফিরতে পারিনি।

সে তো থাকতেই পারে।–তৃষা স্টোভে বসানো জলটার দিকে চেয়ে বলল, তোমার জল ফুটে গেছে।

ডেকচির ঢাকনা ঠেলে ফুটন্ত জল পড়ে স্টোভের আগুন লাফাচ্ছে। শ্রীনাথ উঠবার আগেই অবশ্য তৃষা গিয়ে আঁচল দিয়ে ডেকচিটা নামিয়ে স্টোভটা এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে বলল, আজকাল বোজ রাতে স্নান করছ! কী ব্যাপার?

শ্রীনাথ বাধোবাধো গলায় বলে, কলকাতায় যা ধুলো ময়লা… তার ওপর প্রেসের কালিঝুলি… শরীরটা কেমন খিত খিত করে।

আগে তো এই অভ্যাস ছিল না!

এখন হচ্ছে।

তৃষা আর এ নিয়ে ঘাঁটাল না। বলল, প্রীতমবাবুর অসুখের খবর পেয়েছিলাম। তাকে একবার দেখতে গিয়েছিলে?

শ্রীনাথ একটু লজ্জা পায়। বলে, না। সময় হয়নি।

কী হয়েছে তাও তো জানা দরকার ছিল। তুমি যাবে বলে আমি বিলুর চিঠির জবাব পর্যন্ত দিইনি। এটা ভীষণ অভদ্রতা হল। ওরা কী মনে করছে!

শ্রীনাথ শ্বাস ফেলে বলল, জেনে আর হবেটা কী? ওসব না জানাই ভাল।

তৃষার গলা একটু তীক্ষ্ণ হল, কেন?

আমরা ওদের জন্য আর কী করতে পারি?

করতে না পারলেই বা, বিপদের দিনে গিয়ে একটু সামনে দাঁড়ালেও মানুষ জোর পায়। তোমারই বোন-ভগ্নিপতি, তাই বলেছিলাম।

শ্রীনাথ উদাস গলায় বলল, কেউ কারও না। আমার আর ওসব সেন্টিমেন্ট নেই।

না থাকলে তো মুক্ত পুরুষ। তবে তুমি যাবে না জানলে আমি বিলুর চিঠির জবাব দিতাম। চাই কি একবার নিজেই যাওয়ার চেষ্টা করতাম।

শ্রীনাথ আজকাল সংসারের কোনও দায়দায়িত্বের কথা শুনলেই রেগে যায়। যখন চাকরির টাকায় সংসার টানত তখন অভ্যাস ছিল। এখন দায়দায়িত্ব না নিয়ে নিয়ে তার ভেতরটা অলস হয়ে গেছে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতে তার গায়ে জ্বর আসে।

শ্রীনাথ বলল, তুমি গেলেই তো ভাল হয়।

তাই যেতে হবে দেখছি।

সজল মা-বাবার কথা শুনছিল না। খুব সাবধানে হাত বাড়িয়ে ক্ষুরটা ছুঁয়ে দেখছিল। কী দারুণ ধার!

শ্রীনাথ কথাটা কী ভাবে তুলবে বুঝতে পারছিল না। একটু দোনোমোনো করে বলল, আজ বুলু অফিসে এসেছিল।

তৃষা অবাক হল না। শান্ত স্বরে বলল, তাই নাকি?

শমিতার বুঝি বাচ্চা হবে।

ও। ছোটবাবু কি সেই খবর দিতেই এসেছিল? না কি অন্য মতলব আছে?

মতলবের কথা বলতে পারব না। তবে বলছিল সামনের রবিবার বাবাকে এখানে দিয়ে যাবে। বাবার ওখানে খুব অসুবিধে হচ্ছে।

তৃষা মৃদু একটু হেসে বলে, তা তুমিও কী বললে?

আমি মতামত দিইনি।

ওমা! কেন?

আমি তো মতামত দেওয়ার মালিক নই। তোমার সঙ্গে কথা বলে জানাব বলেছি।

এতে আমার সঙ্গে পরামর্শ করার কী আছে? ছোটবাবু যদি শ্বশুরমশাইকে না রাখতে চায় রাখবে। আমাদের এখানে অনেক ঘর আছে। উনি স্বচ্ছন্দে এসে থাকতে পারেন। এর আগেও তো আমি বলেছি, শ্বশুরমশাইকে দিয়ে যেতে। ছোটবাবু রাজি হয়নি।

শ্রীনাথ এ কথা শুনে খুশি হল না, অখুশিও হল না। তবে একটু অবাক হল। তৃষা এখনও সম্পর্ক অস্বীকার করছে না, এখনও উদারভাবে দায়দায়িত্ব নিতে চাইছে। অথচ এক সময়ে শ্বশুর-শাশুড়ির দায়দায়িত্ব নিয়ে গরিব অবস্থায় অনেক মন কষাকষি হয়েছে তাদের। তৃষা কেন এত উদার হয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝা মুশকিল।

শ্রীনাথ বলল, ঠিক আছে। বুলুকে তাই বলে দেব।

বোলো। না বললেও ছোটবাবু দিয়ে যাবে ঠিকই। বাবা এখানে থাকলে ওরও যাতায়াতের একটু উপলক্ষ হয়।

তৃষার বুদ্ধি দেখে একটু তাক লাগে শ্রীনাথের। তৃষার বুদ্ধি বরাবরই প্রখর ছিল৷ এখন মানুষ চরিয়ে সেটা আরও সাংঘাতিক ধারালো হয়েছে।

শ্রীনাথ মাথা নিচু করে বসে নিজের হাতের দিকে চেয়ে রইল। কিছু বলার নেই।

তৃষা বলে, তোমার জল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। স্নান করলে করে নাও।

হুঁ।–বলে শ্রীনাথ ওঠে।

সজলকে আর কিছু বলবে?

না। ক্ষুরটা দেওয়ার জন্যই ডেকেছিলাম।

ক্ষুরটা ও নেবে না। ওটা সাবধানে রেখে দাও যাতে কেউ নাগাল না পায়। আর কখনও আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওকে কিছু দিয়ো না।

শ্রীনাথ একটু বিষ-হাসি হেসে বলেই ফেলল, ক্ষুরের চেয়ে বন্দুক অনেক বিপজ্জনক। তুমি বন্দুকটাও সাবধানে রেখো।

বন্দুকের কথা যে তৃষা শ্রীনাথকে বলেনি সেইটে মনে করেই শ্রীনাথ চিমটিটুকু কাটল।

তৃষা অবশ্য চোখের পাতাও ফেলল না। মুখের ভাবেরও কোনও বদল হল না তার।

শান্ত স্বরে তৃষা বলল, তুমি কোনও ব্যাপারেই মাথা ঘামাও না বলে বন্দুকের কথাটা তোমাকে বলিনি। আজকাল অনেক সময়ে নগদ টাকা বা সোনাদানা ঘরেই রাখতে হয়। চারদিকে যে ভীষণ ডাকাতি হচ্ছে সেই কথাটা ভেবেই বন্দুকটা ফেরত চেয়েছি। বন্দুক থাকবে আমার স্টিলের আলমারিতে। কোনও ভয় নেই।

আমাকে বলোনি বলে কিছু মনে করিনি। তবে কথাটা বুলুর মুখ থেকে শুনে জানতে হল বলে খারাপ লাগে। বাইরের লোকেও যা জানে তা ঘরের নোক হয়েও আমি জানি না।

তৃষা সজলের দিকে চেয়ে বলল, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত হয়েছে।

মা-বাবার কথা চালাচালি হাঁ করে শুনছিল সজল। তৃষা বলার পর বাধ্য ছেলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় মেঝের ওপর তৃষা তার মস্ত ফ্লাশলাইট উপুড় করে রেখে এসেছিল। বাতি জ্বালিয়ে সজলকে পথটা দেখিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসে তৃষা। আগের ভঙ্গিমাতেই দরজায় ঠেস দিয়ে একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ছেলের সামনে ওসব কথা না তুললেই ভাল।

আমি তুলতে চাই না। কথা আপনি ওঠে।

বন্দুকের কথা তোমাকে হোটবাবু বলেছে?

হ্যাঁ।

অনেক খবর রাখে তা হলে?

নিজের স্বার্থেই রাখে। বোধ হয় এখানকার লোকজনকে নিয়ে একটা ঘোঁটও পাকাচ্ছে।

সেটা জানি। এখানকার অনেক লোকও মুখিয়ে আছে আমাকে জব্দ করার জন্য।

শ্রীনাথ অধৈর্যের গলায় বলে, সেটা নতুন কথা নয়। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে কবে এখনও লোকে আমাদের শত্রু ভাববে কেন?

সবাই ভাবে না।

কিছু লোকেই বা ভাববে কেন?

শ্রীনাথ সামান্য উঁচুতে তোলে গলা। বরাবর সে অসম্ভব শান্তিপ্রিয় ফুর্তিবাজ মানুষ। কোনও ঝুট ঝামেলা পছন্দ করে না। কোনও বিরুদ্ধতা দেখলেই সে গুটিয়ে যায়।

তৃষা বলল, তাতে তোমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তারা আমাকেই শত্রু ভাবে। তোমাকে নয়।

শ্রীনাথ শ্লেষের হাসি হেসে বলল, যাক এতদিনে তবু স্বীকার করলে যে তুমি আর আমি দুটো সম্পর্কহীন আলাদা লোক।

তৃষা ভ্রু কুঁচকে বলে, কথাটার মানে কি তাই দাঁড়াল?

তাই দাঁড়ায়।

আমি তো ওরকম ভেবে বলিনি।

শ্রীনাথ ইজিচেয়ারে বসে পড়ে আবার। মাথার পাতলা চুলে উত্তেজিত আঙুল চালাতে চালাতে বলে, কী ভেবে বলেছ তা তুমি জানো আমিও জানি।

তৃষা শান্ত গলায় এতটুকুও উত্তেজিত না হয়ে বলে, তুমি বিষয়-সম্পত্তির মধ্যে থাকে না। সে হয়তো তোমার অভিমান। সম্পত্তি যেহেতু আমার নামে। তুমি দেখো না বলেই আমাকে দেখতে হয়। লোকেও লক্ষ করছে বিষয়-সম্পত্তি আমিই দেখি। আমিই সংসার চালাই। লোকে সেটা সহ্য করতে পাবে না। একজন মেয়েমানুষকে ক্ষমতায় দেখতে পুরুষরা পছন্দ করে না। তার ওপর এখানকার বেশির ভাগ পুরুষই অপদার্থ, কুচুটে, পরশ্রীকাতর। তাদের তেমন কোনও কাজ না থাকায় ওইসব করে বেড়ায়। তবে তোমার সম্পর্কে তাদের কোনও রাগ নেই।

শ্রীনাথ অধৈর্যের গলাতেই বলে, সেটাই বা তুমি কী করে জানলে?

তৃষা একটু ফিচেল হাসি হেসে বলে, লোকে বলে আমি নাকি তোমার মতো ভাল লোককে পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছি। তুমি নাকি খুবই ন্যায়বান, যুক্তিবাদী, সৎলোক। এমনকী তুমি আমাকে ছেড়ে নাকি অন্য জায়গাতে চলে যাওয়ারও চেষ্টা করছ। এ রকম খারাপ একজন মহিলার সঙ্গে বাস করতে তোমার নাকি ভীষণ ঘেন্না হয়। এ সব শুনেই বুঝি, লোকের রাগ তোমার ওপর নয়।

তৃষা ইদানীং একসঙ্গে এত কথা বলেনি শ্রীনাথের সঙ্গে। তৃষা আজকাল তর্ক করে না, আলোচনা করে না, কথার পিঠে পিঠে খানিকক্ষণ জবাব দিয়ে এক সময়ে চুপ করে যায়। আজ তৃষার এত কথা এবং কথার মধ্যে চাপা একটা হতাশার ভাব লক্ষ করে অবাক মানে শ্রীনাথ।

সে বলল, এখানকার লোক কী বলে তা আমার কানে বেশি আসে না। তবে এটা বুঝি যে, এতদিনেও আমরা এ জায়গার লোক হয়ে উঠতে পারিনি।

তৃষা একটা শ্বাস ফেলে বলে, এক জায়গায় বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে বসলেই সেই জায়গা আপন হয় না। পুরুষানুক্রমে থাকলে আত্মীয়তা জ্ঞাতিগুষ্টি বাড়লে তবে হয়।

তবু চেষ্টা করা উচিত ছিল।

কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছ?

তবে আর কাকে?

আমাকে দায়ী করছ কেন? এ জায়গার আপন হতে তুমিও তো চেষ্টা করছ না। কেবল একটা পালাই-পালাই ভাব।

শ্রীনাথ সাবধান হয়। বদ্রীকে দিয়ে সে যে জমি কেনার চেষ্টা করছে অন্য জায়গায় সেটাও কি তৃষা জানে? জানার কথা নয়। বদ্রীও বেশ কিছুদিন হল আসে না।

একটু চিন্তিত দেখাল শ্রীনাথকে। আস্তে করে বলল, এ জায়গাকে আমার আপন করে কী লাভ? তুমি থাকবে, সুতরাং দায়িত্ব তোমারই।

কেন? তুমি থাকবে না?

আছিই তো। যতদিন থাকা যায় থাকবও।

তৃষা বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, বিষয়-সম্পত্তি আমার হলেও সংসারটা কিন্তু আমার নয়। ছেলেমেয়েও আমি বাপের বাড়ি থেকে আনিনি। সুতরাং এখন থাকা না থাকার কথা তোলা খুব বীরপুরুষের কাজ হবে না।

আমি বীরপুরুষ নই বলেই কথাটা উঠল।

তুমি স্নান করে এসো। আমি যাই।— বলে তৃষা নিচু হয়ে বারান্দা থেকে তার ফ্ল্যাশ লাইট কুড়িয়ে নিল। তারপর অন্ধকারে তাকে আর দেখা গেল না।

শ্রীনাথ ডেকচির জল নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে খুব ঘষে ঘষে স্নান করল আজ।

কলপাড় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, পুকুরের ধারে আজও শুকনো কাঠকুটো দিয়ে মস্ত আগুন জ্বেলেছে নিতাই।

স্নান করে ফিরে এসে বারান্দায় উঠে শ্রীনাথ হাঁক পাড়ল, নিতাই নাকি রে?

হ্যাঁ।

শুনে যা।

ভেজা গায়ে উত্তুরে হাওয়ায় ভোলা বারান্দায় শীতে কাঁপছিল শ্রীনাথ। নিতাই কাছে আসতেই বলল, শুনলাম এর মধ্যে কবে যেন সরিৎবাবু তোকে মেরেছে।

নিতাই হাসে, দুর। দূর। মারবে কী? গাঁজার নেশায় তখন বাবুর গায়ে জোর ছিল নাকি?

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সরিৎ গাঁজা খেয়েছিল?

বোজ নয়। সেদিন খেয়েছিল।

মারল কেন?

আজ্ঞে নেশা-ভাঙের মুখে কোন কথা থেকে কোন কথা বেরিয়ে যায়। তার কোনটা শুনে বাবুর রাগ হল কে বলবে?

মেরেছিল যে, সেটা আমাকে বলিসনি কেন?

নিতাই খুব হেসে-টেসে বলল, পরদিনই আবার খাতির হয়ে গিয়েছিল কিনা।

সরিৎ ছেলেটা কেমন? গুন্ডামি-টুন্ডামি করে না তো!

আজ্ঞে না। লোক খুব ভাল।

বদ্রী তপাদারের বাড়িটা চিনিস?

খুব চিনি। লাইনের ওধারে উত্তরদিকে আমরাগান পেরিয়ে মাইলটাক।

কাল ওকে গিয়ে খবর দিবি তো। বলবি জরুরি দরকার। আসে যেন একবার কাল পরশু।

দেবোখন। এই সেদিনও মা ঠাকরোন ডাকিয়ে এনেছিলেন। আমিই গিয়ে খবর দিয়েছিলাম কিনা।

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, সজলের মা বদ্রীকে ডাকিয়েছিল?

আজ্ঞে।

কেন?

তা জানি না। আশ্চর্য তো!

আচ্ছা, তুই যা।

খুবই অন্যমনস্ক হয়ে গেল শ্রীনাথ। এত অন্যমনস্ক যে ঘরে ঢুকেও সে ঘরটাকে লক্ষই করল না। ডেকচি, বালতি, মগ, গামছা সব যন্ত্রের মতো যেখানকার জিনিস সেখানে রাখল। ধোয়া লুঙ্গি পরল, উলিকটের গেঞ্জি গায়ে দিয়ে চাদর জড়াল। চুল আঁচড়াল।

তারপর ইজিচেয়ারে বসতে গিয়েই সাপ দেখার মতো চমকে উঠল ভীষণ। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করে হৃৎপিণ্ড আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে।

তার বিছানায় খুব অলস ভঙ্গিতে টর্চ হাতে তৃষা বসে আছে।

বোধ হয় চমকানোতে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল শ্রীনাথের। বোধ হয় চমকটা বাইরে থেকেও বুঝতে পেরেছিল তৃষা। উঠে এসে বুকে হাত রেখে বলল, আমারই অন্যায়। একটা জানান দেওয়া উচিত ছিল। ভয় পেয়েছ?

শ্রীনাথ কথা বলতে পারল না বুকের অসহ্য ধড়ধড়ানিতে। শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।

আমাকে তোমার ভয় কিসের?

অনেকক্ষণ দম নিয়ে স্বাভাবিক হল শ্রীনাথ। বুকটা তার বোধ হয় ভাল নয়। ক্ষীণ একটু যন্ত্রণা হচ্ছে যেন। এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিটিভ বন্ধু কে সাবধান করে দিয়েছিল, দেখো ভায়া, যদি বাঁ দিকের বুকের নিপলের দুইঞ্চি নীচে কখনও ব্যথা-ট্যথা হয় তবে ঠিক হার্ট ট্রাবলের লক্ষণ বলে জেনো।

ব্যথাটা হচ্ছে। শ্রীনাথ চোখ বুজে অনুভব করে।

তৃষা ইজিচেয়ারের ধারে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বলল, তোমার তো কখনও এমন শরীর খারাপ হয় না।

শ্রীনাথ চোখ মেলে বলল, ওটা কিছু নয়। বলল, কী বলবে?

এখন তোমার ভাল লাগছে তো!

হ্যাঁ। ভাল।

তৃষা আবার বিছানায় গিয়ে বসল। তোমার খাবারটা আমি এ ঘরেই পাঠিয়ে দিতে বলেছি। এই শীতে আবার অত দূরে যাবে?

শ্রীনাথ মৃদু স্বরে বলে, ভালই করেছ।

আবার ভেবে বসবে না তো যে, তোমাকে এইভাবে আলাদা আর পর করে দিচ্ছি! লোকে কত ভুল ভাবতে ভালবাসে।

আজ এত আদুরেপনা কেন তা বুঝল না শ্রীনাথ। কিন্তু একটু হাসল। বলল, না, তা কেন?

তৃষা বসে রইল। গেল না। ভারী অস্বস্তি হতে লাগল শ্রীনাথের। আজ কেন সব অন্য রকম হচ্ছে?

একটু বাদেই খাবার নিয়ে এল বৃন্দা। সামান্য খেল শ্রীনাথ। বৃন্দা দাঁড়িয়ে থেকে এঁটো পরিষ্কার করে নিয়ে গেল। তবু তৃষা বসে আছে।

শ্রীনাথ ইজিচেয়ারে বসে বলল, কিছু বলবে?

তৃষা মৃদু হেসে বলে, বলার জন্যই বসে আছি।

বলো।

তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?

খুব ভাল। কিছু হয়নি।

তৃষা উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল। আবার বিছানায় বসে অদ্ভুত এক হাসি হেসে বলল, আমি তোমার বউ না?

তাই তো জানি!–অবাক, ভীষণ অবাক হয়ে বলে শ্রীনাথ।

তৃষা বলে, বউ হলেও আমি ভাল বউ নই। তোমাকে একটা জিনিস থেকে বহুকাল বঞ্চিত করে রেখেছি। তাই না?

শ্রীনাথ খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বুকের মধ্যে আবার সেই ধড়াস ধড়াস। সারা গায়ে শীতকাঁটা।

বলল, ঠিক নয়?–তৃষা আদুরে গলায় বলে।

শ্রীনাথ তৃষার মুখের দিকে তাকায়। না, তৃষার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। যেমন দৈনন্দিন মানুষটি ছিল, তেমনি আছে। শুধু চোখ-দুটো একটু দিপ-দিপ করে জ্বলছে। মুখে অদ্ভুত এক মোহিনী হাসি।

তৃষা বসা স্বরে ফিস ফিস করে বলল, আজ নাও। দিতে এসেছি। অভিমান কোরো না, মুখ ফিরিয়ে থেকো না। লক্ষ্মীটি!

শ্রীনাথের গলা শুকিয়ে আসছিল। তার শরীরের কামনা মরে যায়নি বটে, বরং সে রোজই তীব্র কাম বোধ করে। তবু এখনও এক রাত্রে দু’জন মেয়েমানুষের পাল্লা টানবার ক্ষমতা তার নেই। হাওড়া ময়দানের নমিতা তাকে আজ নিঃশেষ করেছে।

মৃদু স্বরে শ্রীনাথ বলে, আজ নয়।

আজই!–বলে উঠে আসে তৃষা। পাশে দাঁড়ায়। কানের কাছে মুখ এনে বলে। আজই। আজ আমি ভীষণ পাগল হয়েছি।

শ্রীনাথ সিঁটিয়ে যায়। কাঠ হয়ে বসে থাকে। তারপর বলে, তোমার এত ইচ্ছে ছিল না তো কখনও!

তুমি তার কী জানবে!

আমি জানব না তো জানবেটা কে?

আজ জেনে দেখো।

আজ নয়, তৃষা।

আজই। আজই চাই। এসো।

তৃষা শ্রীনাথের কোমর ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। তৃষার গায়ে অনেক জোর। এত জোর যে শ্রীনাথ ওকে ঠেকাতে পারল না।

বুকের বাঁ দিকে নিপলের ঠিক দু ইঞ্চি নীচে ক্ষীণ ব্যথাটা আবার টের পেল শ্রীনাথ।

তৃষা কানে কানে বলে, আমার যদি ইচ্ছেই না থাকবে তাহলে তোমার এতগুলো ছেলেপুলে হল কী করে?

শ্রীনাথ হঠাৎ বলে ফেলল, ইচ্ছে হয়তো আছে, তবে তা আমাকে নিয়ে নয়। আমার প্রতি তুমি বরাবর ক্যালাস ছিলে।

অবাক গলায় তৃষা বলে, তোমাকে নিয়ে নয়? তবে কাকে নিয়ে?

অনেক কথাই বলতে পারত শ্রীনাথ। কিন্তু ভদ্রতাবোধ এসে গলা টিপে ধরল। বাধা হয়ে দাঁড়াল লজ্জা। মৃত দাদা মল্লিনাথের প্রতি একরকম মায়া হল এ সময়ে। এত অকপটে তৃষার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাঙচুর করতে বুঝি-বা হল ভয়। তাই বলতে পারল না।

তৃষা বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে এল বিছানায়। এক ঝটকায় নিজেকে খুলে ফেলল। শ্রীনাথকেও শরীরে কোনও আবরণ রাখতে দিল না। নগ্ন শরীরে লেপটা টেনে নিল। বলল, লেপটা ভীষণ গণ্ডা কাল বের করে রেখে যেয়ো, রোদে দেব। চাবিটা রেখে যেয়ো, তাহলেই হবে।

শ্রীনাথ জবাব দেওয়ার আগেই তৃষা তার মুখ বন্ধ করে দিল জোরালো এক চুমুতে। বড় ঘিনঘিন করছিল শ্রীনাথের। মুখে লালা, ঠোঁট, শ্বাস কিছুই তার শরীরে সাড়া তুলছে না। নেতিয়ে অবশ হয়ে আছে শরীর।

এসো।–বলে হাত বাড়ায় তৃষা।

না তৃষা, আজ আমার ইচ্ছে নেই।

কানের কাছে হঠাৎ তীক্ষ্ণ শোনায় তৃষার গলা, ইচ্ছে নেই কেন? বহুদিন তো এসব হয়নি। ইচ্ছে না হওয়ার কথা নয়।

তৃষার হাত দারোগার মতো খানাতল্লাস করতে থাকে তার শরীরে।

শ্রীনাথ লড়াই করে, না তুষা, আজ আমার মন ভাল নেই।

তবু তৃষার সমস্ত শরীর হামলে পড়ে তার ওপরে। তার হাত তৎপর হয়। এমনকী টর্চ জ্বেলেও কী যেন দেখার চেষ্টা করে সে।

হঠাৎ শ্রীনাথ বুঝতে পারে, তৃষার এক ফোটাও কাম নেই। এতটুকুও ভালবাসা জাগেনি আজ ওর এই রাতে। তৃষার চোখ আর হাত একটা কিছু বুঝতে চাইছে। দেখতে চাইছে।

শ্রীনাথ ভয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। নিজেকে ঢাকতে চায়। তৃষাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে সে।

কিন্তু জোরালো হাতে পায়ে বিছানার সঙ্গে তৃষা তাকে বেঁধে রাখে। পুরুষকে জাগিয়ে তোলার যতরকম মুদ্রা আছে তা প্রয়োগ করে যায় সে। টর্চ জ্বেলে পরীক্ষা করে তাকে।

তারপর গভীর এক খাস ফেলে তাকে ছেড়ে দেয়।

শ্রীনাথ উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে থাকে ঘেন্নায়। তৃষা জানল, সে আজ অন্য মেয়েমানুষের কাছে গিয়েছিল।

১৬. রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি

রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি থাকে। বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো, আড্ডা, বিকেলের দিকে প্রীতম বা সোমনাথের বাড়িতে যাওয়া কিংবা আর্ট একজিবিশন, ভাল নাটক, বিচিত্র কোনও অনুষ্ঠান দেখে বেড়ানোর প্রোগ্রাম থাকে তার।

কিন্তু এই রবিবার ছুটি পেল না সে। বোস সাহেব বিরাট দল নিয়ে শিকারে যাচ্ছেন। মিঠাপুকুরের বাগানবাড়ি ছেড়ে দিয়েছে একজন বড় মহাজন। সেখানে কেটারারের এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

দীপনাথের এইসব আমোদ-ফুর্তিতে কোনও সম্মানজনক ভূমিকা নেই। তাই সে আনন্দ পায় না, বরং যথেষ্ট উৎকণ্ঠিত থাকে। তবু এবার তার কোথায় একটু উত্তেজনাময় আনন্দের অনুভূতি হচ্ছিল। তার কারণ, অন্যান্য মহিলাকুলের সঙ্গে মণিদীপাও যাচ্ছেন।

নিজের মনের এই সাম্প্রতিক পাপবোধ দীপনাথকে যথেষ্ট খোঁচা দেয়। কিন্তু সে যেন তপ্ত ইক্ষু চর্বণ, জ্বলে গাল না যায় তাজন।

মিঠাপুকুরের মস্ত ঝিলে যে বালিহাস থাকবেই এমন কোনও কথা নেই। তবে ঝোপ-জঙ্গল বাঁশঝাড়ে বিস্তর নিরীহ পাখি-টাখি এসে বসবে। তাদের দু-চারটে মারা পড়লেও পড়তে পারে। কারণ সঙ্গে যাচ্ছে তিন-তিনটে বন্দুক।

অ্যামবাসাডরে ড্রাইভারের কনুইয়ের তো আর আলবার্ট টমসনের চিফ অ্যাকাউনট্যান্ট মিস্টার গুহর ভারী উরুর পার্শ্বচাপ সহ্য করতে করতে সেই তিনটে খাপে ভরা ভারী বন্দুক খাড়া করে ধরে থাকতে হচ্ছে তাকে আগাগোড়া। লাগেজ বুট জায়গা হয়নি, সেখানে বিস্তর জিনিস।

আর দীপনাথ থাকতে অন্য কোথাও জায়গা হওয়ার দরকারই বা কী?

তবে দৃশ্যটা মণিদীপা দেখছে না। মেয়েরা দুটো গাড়ি বোঝাই হয়ে আগে আগে যাচ্ছে। পিছনে আর দুটো গাড়িতে পুরুষমানুষের দল। মণিদীপা দেখলে একটু অস্বস্তি বোধ করত দীপ। ভদ্রমহিলা মনে করেন, দীপনাথ বোস সাহেবের চামচা। কথাটা হয়তো তেমন মিথ্যেও নয়।

সকালের নরম রোদে শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা রাস্তা আর দু’ধারে প্রাকৃতিক সবুজের মধ্যে পড়ে দীপনাথের ভাল লাগার কথা। বন্দুকগুলোর জন্য তেমন লাগছে না। মুখের সামনে তিনটে খাপে ঢাকা নল উঁচু হয়ে তার চোখ আড়াল করে আছে। এই বন্দুকে পাখি মারা পড়বে ভাবতেই তার বুকে কষ্ট হয়। খুনখারাপি—তা সে পাখিই হোক আর বাঘই হোক—দীপনাথ সহ্য করতে পারে না। বড়দা মল্লিনাথ তাতে বন্দুক চালাতে শিখিয়েছিল। মলিনাথের হাত ছিল সাফ। মাথা ঠান্ডা, আর বুকে ছিল যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা। একজিকিউটিভ ইনজিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন উত্তর বাংলায় ছিল মল্লিনাথ। তখন বনে-জঙ্গলে তার সঙ্গে ঘুরে দীপনাথ তালিম নিয়েছিল। কিন্তু আজও সে বন্দুক জিনিসটাকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি।

গুহ সাহেব পিছনে একটু ঘুরে ব্যাক সিটে বসা বোস সাহেব এবং আর তিন কোম্পানির তিন বড় মেজো কর্তার সঙ্গে অফিস নিয়ে কথা বলছিলেন। ফলে ঊরুর চাপে দীপনাথ আরও চ্যাপটা হয়ে গেল। শীতকালেও তার অল্প ঘাম হচ্ছে। দমফোট লাগছে।

হাওড়া ছেড়ে উনিশ কুড়ি মাইল দূরে মিঠাপুকুর। ইতিমধ্যেই গাছ-গাছালি ঘন হয়ে উঠেছে। বসতির ঘনত্ব কমে এসেছে। চাষের মাঠ দেখা যাচ্ছে। বন্দুকের নল সরিয়ে দেখতে থাকে দীপনাথ। সামনের একটা গাড়িও খুব তৃষিত চোখে দেখে নেয় সে। সবুজ একটা ফিয়েট গাড়ি। ওতে মণিদীপা রয়েছে। মণিদীপা আজও শাড়ি পরেনি। জিনস আর টি শার্ট। তার ওপর একটা কাশ্মীরি কোট। বড্ড বেশি চমকি দেখাচ্ছিল।

গাড়িটা ডাইনে বাঁক নিল। আর দেখা গেল না।

বিশুদ্ধ মার্কিন ইংরেজিতে এ গাড়ির সাহেবরা অফিস বিজনেস আর বিভিন্ন একজিকিউটিভের দোষ-ত্রুটি নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। দীপনাথ বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করে না। চোখ বুজে সে মনের চোখটি খোলে। অমনি নীল আকাশের গায়ে স্বর্গের সমান উঁচু মহান পর্বতের দৃশ্য ভেসে ওঠে।

সব তুচ্ছতা ছেড়ে একদিন কি সে পাহাড়ে যাবে না?

গাড়ি ডাইনে বাঁক নিয়ে একটা গাছপালায় নিবিড় শুড়িপথে ঢোকে। কাঁচা রাস্তা। গাড়ি হোঁচট খাচ্ছে। খুব আস্তে চলছে। প্রচণ্ড ধুলো উড়ছে চাকার ঘষড়ানিতে। চারদিকের গাছপালার ডাল আর পাতা ছটাছট আছড়ে পড়ছে গাড়ির গায়ে। বাঁশের একটা ডগা গুহ সাহেবের গালে চুমু খেয়ে গেল। উনি একটু সরে এলেন। ঊরুর চাপে দীপনাথ আরও সরু হল এবং ড্রাইভারের কনুই তার পেটে ঘোত করে বসে গেল।

প্রায় আধ ঘণ্টা এই যন্ত্রণা সহ্য করে বাগানবাড়িতে পৌঁছল দীপনাথ।

ধূলিধূসর দুটো গাড়ি থেকে মহিলারা নেমেছেন। বাগানময় অজস্র সুন্দর নিবিড় গাছপালা, কুঞ্জবন, পুকুর, বাড়িটাও বিশাল। চারদিকে উঁচু দেয়ালের প্রতিবোধ। চারদিক ম ম করছে কফির গন্ধে। বাগানে পুকুরের ধারে মস্ত গার্ডেন আমব্রেলার নীচে টেবিল সাজানো। এখুনি হালকা জলখাবার দেওয়া হবে। ড্রিংকস চাইলে ড্রিংকসও। কেটারের বেয়ারারা ট্রে নিয়ে তৈরি হচ্ছে।

বন্দুকগুলো ঘাসে শুইয়ে রেখে দীপনাথ হাত-পা টান টান করল। পুলওভার গায়ে রাখা যাচ্ছে এই রোদে। সেটা খুলে পিঠে ঝুলিয়ে হাত দুটো গলায় ফাঁস দিয়ে রাখল। একটা ফাঁকা টেবিলে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে হাঁফ ছাড়ল সে।

কিছুক্ষণ সে হাঁফ ছাড়তে পারবেও। শিকারের প্রোগ্রামে সে সাহেবদের সঙ্গে যাবে না, এ কথা বোসকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে।

বোস শুনে একটু হেসে বলেছেন, রক্ত দেখলে ভয় পান নাকি?

ওসব আমার ঠিক সহ্য হয় না।

ঠিক আছে। মিসেসরাও কেউই নাকি যাবেন না। আপনি না হয় ওঁদের সঙ্গে সময়টা কাটাবেন।

কথাটায় খোঁচা আছে। কিন্তু সারা দিন কত খোঁচাই তাকে হজম করতে হয়।

শিকারের পর লাঞ্চ এবং লাঞ্চের পর কলকাতা থেকে আসা এক ম্যাজিসিয়ান ম্যাজিক দেখাবেন। এক গায়িকা গান শোনাবেন। তারপর মিস্টার এবং মিসেসরাও হয় গাইবেন, না হলে মজার গল্প বলবেন, কবিতা আবৃত্তি করতে পারেন, যার যা খুশি।

সুতরাং দীপনাথের খুব একটা কাজ নেই। অনেকটা সময় সে একা কাটাতে পারবে।

কফির কাঁপের কানার ওপর দিয়ে তার চোখ খুব আলতোভাবে লক্ষ করছিল, কিন্তু মণিদীপাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। রাই মাখিয়ে গোটা দুই ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ খেয়ে ফেলল সে। তারপর আবার বসে বসেই খুঁজতে লাগল চোখ দিয়ে। অবাধ্য চোখ বশ মানছে না। বড় জ্বালা।

অনেকটা দূরে একটা লিচু গাছের আড়ালে ক্যাম্বিসের চেয়ারে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে মণিদীপা বসে আছে, এটা আবিষ্কার করতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। মণিদীপার সঙ্গে জনা দুই মহিলা ও জনা তিনেক পুরুষ রয়েছে। হাত পা নেড়ে প্রচণ্ড কথা বলছে তারা।

দীপনাথ উঠল এবং একটু লক্ষ্যহীন পায়ে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে লিচুতলার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। মণিদীপার চোখে পড়ার জন্য সে ইচ্ছে করেই ওর মুখোমুখি উলটো দিক থেকে খানিকটা হেঁটে কাছাকাছি চলে গেল প্রায়।

কিন্তু মণিদীপা একদমই পাত্তা দিল না তাকে। ডাকল না, তাকালও না।

দীপনাদের কাছে এটুকুই যথেষ্ট অপমান। মণিদীপা সম্পর্কে যত বেশি সচেতন হয়ে উঠছে সে, তত বেশি অভিমান আর অপমানবোধ বেড়ে যাচ্ছে তার।

দীপনাথও স্পষ্ট করে তাকাল না। উদাস মুখে হটা অব্যাহত রেখে সে ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা পরিচ্ছন্ন ঘাসজমিতে চলে এল। খুঁজে-পেতে একটা পছন্দসই গাছের ছায়ায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল সে, হাতে মাথা রেখে। চোখ জ্বালা করছে রোদের তেজে। তাই চোখ বুজল। তারপর পাহাড়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ।

কিন্তু ঘুমোলেও দীপনাথের ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ু সব সময়ে সজাগ থাকে। সামান্য শব্দ বা সামান্য চলাফেরাও সে টের পায়। ঘুমের চটকার মধ্যেই সে একটা ভারী সুন্দর গন্ধ পেল। ঘুম ভাঙলে চোখ চাইল না সে, কে এসেছে তা সে জানে।

বড় অভিমান হল তার। পাশ ফিরে শুল।

মণিদীপা আস্তে করে ডাকল, দীপনাথবাবু!

প্রথমে উত্তর দিল না দীপনাথ।

আরও দু’বার ডাক শুনে হঠাৎ উঠে বসল।

মণিদীপা হাসছিল। বলল, কুম্ভকণ।

দীপনাথ হাইটা চেপে দিয়ে বলল, কিছু কাজ নেই, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছু বলছেন? তেমন কিছু নয়। আমার ভাল লাগছে না।

কেন?

এরা কেউ তো আমাদের ক্লাসের লোক নয়। আপনি যেরকম মধ্যবিত্ত পরিবারের, আমিও তাই। আই হেট দেম।–বলতে বলতে মণিদীপা একটু জ্বলে ওঠে।

দীপনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, তা বললে হবে কেন? একজন একজিকিউটিভের বউকে এই সমাজে মিশতেই হবে। অন্য উপায় তো নেই।

খুব জেদের গলায় মণিদীপা বলে, আমার যা ভাল লাগে না তা মানিয়ে নিতে আমি রাজি নই।

তা হলে কী করবেন?

আমি এখানে সারা দিন থাকতে পারব না।

একটু আগে তো লিচুতলায় হাই সোসাইটির লোকদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছিলেন।

ওঃ আই ওয়াজ প্রিচিং কমিউনিজম।

কী সর্বনাশ!

মণিদীপা মৃদু হেসে বলে, খুবই সর্বনাশ। মিস্টার বোস শুনলে মূৰ্ছা যাবেন। উনি কমিউনিজমকে সাংঘাতিক ভয় পান। আমাদের বাড়িতে লাল মলাটের কোনও বই ঢুকতে পারে না। তা বলে ভাববেন না হাই-সোসাইটিতে কমিউনিস্ট নেই। বরং অনেক আছে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তাদের একজনই তো কট্টর মার্কসিস্ট।

হতেই পারে।

হচ্ছেও। কমিউনিজম ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে সব ক্লাসের মধ্যে।

খুব ভাল। দীননাথ আবার হাই তোলে। মণিদীপার এই একটা ব্যাপারই তার যা একটু–পছন্দ। সে জিজ্ঞেস করল, বসরা সব কোথায়?

মণিদীপা ঘাসে বসে বলল, শিকার শিকার খেলা করতে গেল সব। প্রত্যেকটাই মাতাল। কারও হাতে টিপ নেই।

থাকলেই ভাল। পাখি মারা আমার একদম ভাল লাগে না। মণিদীপা হাসে। বলে, আপনাকে দেখেই মনে হয়, আপনি ভীষণ সফট-হার্টেড।

মণিদীপার হাসিটা এতই ঝকমকে এবং হাসলে বয়সটা এতই কম দেখায় যে, দীপনাথের চোখ আঠাজালে পড়া পাখির মতো মণিদীপার মুখে আটকে থেকে ছটফট করছিল।

মণিদীপা হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলে, দি হামবার্গস আর অ্যাওয়ে। চলুন আমরা একটু ঘুরে আসি।

কোথায় যাবেন?

যে-কোনও জায়গায়। জাস্ট টু কিপ ডিসট্যানস ফ্রম দি হবুচন্দ্র কিংস অ্যান্ড গবুচন্দ্র মিনিস্টারস। কোনও চাষার বাড়িতে গেলে কেমন হয়?

দীপ শঙ্কিত হয়ে বলে, ও বাবা!

ভয় পাচ্ছেন কেন? চলুন। রিয়্যাল হিউম্যান বিয়িং-এর কাছে গেলে অনেক ভাল লাগবে।

চাষা বলতেই যে রিয়্যাল হিউম্যান বিয়িং নয় এ কথাটা বোঝনোর বৃথা চেষ্টা করল না দীপ। তবে উঠল।

মণিদীপা হাঁটতে হাঁটতে বলে, ধারে-কাছে দেখার মতো কোনও জায়গা নেই?

দীপ মাথা নেড়ে বলে, জানি না, তবে কয়েক মাইলের মধ্যে রতনপুর নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে আমার মেজদা থাকে।

মণিদীপা তুলে বলে, উনি কি বড়লোক?

না। তবে একটা খামার মতো আছে ওদের। গেরস্থ।

আমি যদি যেতে চাই আপনার কোনও অসুবিধে নেই তো?

থাকলে তো কথাটা বলতামই না। চেপে যেতাম।

মণিদীপা ঘড়ি দেখে বলে, এখন মোটে সাড়ে নটা বাজে। গিয়ে লাঞ্চের আগে ফেরা যাবে তো?

তা যাবে।

তবে গাড়ি জোগাড় করি? বলে প্রায় দৌড়ে চলে যায় মণিদীপা।

বেশ খুশি ও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল মণিদীপাকে। দীপনাথ স্পষ্ট টের পায়, একা সে নয়। মণিদীপাও তার প্রতি টানে টানে একটু একটু এগিয়ে আসছে। বেশ আগ্রহী। হয়তো সেটা প্রেম নয়। কারণ মণিদীপার সত্যিকারের ভালবাসার লোক একজন বয়স্ক স্কুলমাস্টার, যার নাম স্নিগ্ধদেব এবং যে সাংঘাতিক বিপ্লবী। কিন্তু মণিদীপার মন উপচে যে বাড়তি লাবণ্যটুকু ঝরে পড়ছে তার কিছু ভাগ অবশ্যই দীপেরও। আপাতত এই রবিবারটার যাবতীয় কষ্ট, কাজ ও অপমানকে ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে সেটুকুই ঢের।

মণিদীপা ফিয়েট গাড়িটা জোগাড় করেছে। দীপ সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসতে যাচ্ছিল, মণিদীপা বলল, ও কী? পাশাপাশি না বসলে কথা বলব কার সঙ্গে?

দীপ লজ্জা পেয়ে মণিদীপার পাশে উঠে বসে।

মণিদীপা বলে, আপনি ড্রাইভিং জানেন?

না, একটু শিখেছিলাম, ভুলে গেছি।

জানলে ড্রাইভারটাকে কষ্ট দিতাম না।

আপনি তো জানেন।

মণিদীপা মাথা নেড়ে বলে, জানলে কী হবে? এসব অচেনা জায়গায় কি পারব? ঠিক সাহস পাচ্ছি না।

পারবেন।–দৃঢ় স্বরে বলে দীপনাথ।

পারব?–মণিদীপা উজ্জ্বল চোখে তাকায়।

নিশ্চয়ই। বেচারাকে খামোখা কেন কষ্ট দেবেন? ছেড়ে দিন।

দীপনাথ এ কথা বলার সময়েও টের পাচ্ছিল, তার বুক কাপছে। নির্জন গাঁ-গঞ্জের রাস্তায় এই অ্যাডভেঞ্চারে ড্রাইভার না থাকলে মণিদীপা অনেক খোলামেলা হবে না কি? মুখ-ফাঁকা দু’-একটা কথা ঠিক বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর-একটু ভেবে মণিদীপা বলে, না, থাক। আমি যে আপনার সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছি না ড্রাইভারটা তার সাক্ষী থাকবে।

ভীষণ লাল হয়ে গেল দীপ। বলল, কী যে বলেন।

রতনপুর কোন দিকে এবং কত দূর তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না দীপের। খুব দূর যে নয় তার একটা ধারণা হয়েছিল মাত্র।

কিন্তু লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে গিয়ে সে নিজেও অবাক। মণিদীপা মেজদার বাড়িতে কে কে আছে এবং তারা কেমন লোক তা জানতে চেয়েছিল। সেই সব। প্রশ্নের জবাবও ভাল করে দেওয়া হল না।

ফটকের কাছে গাড়ি থেকে মণিদীপাকে সঙ্গে নিয়ে নামবার সময় দীপনাথ একটু লজ্জা বোধ করছিল। এই পোশাকে একজন সধবাকে দেখে মেজো বউদি আবার কী ভাববে!

ঢুকতেই ডান ধারে শ্রীনাথের বাগান।

মণিদীপা দাঁড়ায় এবং বাগান থেকে মাটিমাখা হাত-পায়ে উঠে আসে শ্রীনাথ।

কাকে চাইছেন?

দীপনাথ হাতের ইশারা করে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে মেজদাকে। তার পর এগিয়ে গিয়ে বলে, মজদা, ইনি মিসেস বোস। আমার বসের স্ত্রী।

শ্রীনাথ একটু অবাক। বলে, ও, তুই! আসুন! আসুন!

শ্রীনাথ আর তাদের মধ্যে বেড়ার বাধা। শ্রীনাথ বেড়া বরাবর এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ওই সামনের ঘর। আসুন।

বোঝাই যাচ্ছিল, মেজদা একটু ঘাবড়ে গেছে। তটস্থ হয়ে পড়েছে। হবেই। কী একখানা মেয়ে। সঙ্গে নিয়ে বেরোলে বাজারে প্রেস্টিজ বেড়ে যায়।

মণিদীপা মুখ ফিরিয়ে দীপনাথকে বলে, ঘর নয়। আমি বাগানটা দেখব। দারুণ সুন্দর বাগান।

শ্রীনাথ কথাটা শুনে মুখ ফিরিয়ে বলে, বাগান দেখবেন? খুব খুশি হলাম। তা হলে ওই সামনের ফটক ঠেলে চলে আসুন।

বাস্তবিকই দেখার মতো বাগান করেছে শ্রীনাথ। সাজানো গোছানো নয়। বরং জংলা, এলোপাথাড়ি সব গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। কিন্তু তার বিচিত্র রকমফের মানুষকে হতভম্ব করে দেয়। প্রাইজ জেতার মতো বড় বড় আকারের মরশুমি ফুল থেকে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপনের ভাষায় রাক্ষুসে ফুলকপি পর্যন্ত সবই ফলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাগানের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালে নিবিড় গাছপালার আবডালে বাইরের পৃথিবী একদম আড়াল পড়ে যায়।

আপনি বাগান করতে খুব ভালবাসেন, না?–মণিদীপা শ্রীনাথকে জিজ্ঞেস করে।

শ্রীনাথ একটা চার-রঙা তারাফুল তুলে মণিদীপার হাতে দিয়ে বলে, আচার্য জগদীশ বোস গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, জানেন তো! আমি নতুন করে সেই প্রাণটার সন্ধান করছি।

রোদচশমার ওপর দিয়ে মণিদীপার ভ্রু-তে একটু কুঞ্চন দেখা দেয়। সে বলে, অনেক বাঙালি এ কথাটা বলে বেড়ায়। কিন্তু আচার্য জগদীশ গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, এ কথাটা মোটেই ঠিক নয়।

শ্রীনাথ একটু যেন ভয় খেয়ে তাকায়। বলে, তা হলে?

মণিদীপা এবার সুন্দর করে হাসে। বলে, গাছের প্রাণের কথা লোকে তো বহু দিন ধরে জানে। জগদীশ বোস বোধ হয় গাছের সেনসিটিভিটি প্রমাণ করেছিলেন। ডিটেলস জানি না। তবে ওইরকমই কিছু।

শ্রীনাথ একটু নিভে গিয়ে বলে, তাই হবে।

মণিদীপা খুব সমবেদনার সঙ্গে বলে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। গাছের প্রাণ আপনিই আবিষ্কার করেছেন। এত বড় আর লাইভলি ফুল আমি আগে দেখিনি। প্রত্যেকটা গাছই এত হেলদি!

আপনি গাছ ভালবাসেন?

কে না বাসে?

শ্রীনাথের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে যায়। সে বলে, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিচি দেখে গাছ চিনতে পারে না। লেখাপড়া শিখে তা হলে কী লাভ?

ঠিকই তো!

বলতে বলতেই গাছপালা এবং বাগানের ওপর মণিদীপার কৌতূহল শেষ হয়ে যায় এবং দীপনাথ সেটা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারে।

দীপ বলে, চলুন, আমার বউদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

মণিদীপার চোখ চারদিকটা গিলে খাচ্ছে। বলল, বাঃ, বেশ তো জায়গা। এ রকম একটা জায়গায় থাকতে পারলে কলকাতার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে আমি এক্ষুনি রাজি।

ভাবন-ঘর থেকে ভিতরবাড়ি যাওয়ার পথেই খবর রটে গিয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের ধারে। তৃষা এগিয়ে এসে মণিদীপার হাত ধরে বলল, আসুন। আপনার জন্যই বোধ হয় আমার একজন হারানো দেওরেরও খোঁজ পাওয়া গেল।

বাকি সময়টুকু দীপনাথ আর মণিদীপার নাগালও পেল না। মেয়েমহলে গিয়ে ঘুরঘুর করা তার স্বভাব নয়। মণিদীপাকে এগিয়ে দিয়ে সে ফিরে এল ভাবন-ঘরে।

শ্রীনাথ হাত-মুখ ধুয়ে এসে বলল, কোথায় এসেছিলি?

মিঠাপুকুর। তোমার আস্তানাটা যে এত কাছে কে জানত?

শ্রীনাথকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বলল, আমি ভাবলাম বুঝি সোমনাথ তোকে খবর দিয়ে আনিয়েছে।

না তো! সোমনাথ আনাবে কেন?

আজ বাবাকে নিয়ে ওরও এখানে আসার কথা।

দীপনাথ ভারী লজ্জিত হয়। বাবা যে সোমনাথের কাছে সেটা সে মাঝে মাঝে ভুলেই যায়। বাবাকে দেখেওনি বহুদিন।

সে বলল, বাবা আসছে কখন?

কে জানে?

দীপনাথ ঘড়ি দেখে বলে, বেলা বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারি। তারপর লাঞ্চে যেতে হবে। এর মধ্যে যদি বাবা এসে যায় তবে দেখাটা হতে পারে।

এখানে দুপুরে খাবি না?

উপায় নেই। একা হলে কথা ছিল। বসের বউ সঙ্গে রয়েছে।

মেয়েটা একটু খ্যাপা নাকি?

কেন?

কেমন যেন অন্যরকম।

দীপনাথ হাসে। বলে, খ্যাপা নয়। আজকালকার মেয়েরা এরকমই। সজলকে ডাকো তো। বহুকাল ওকে দেখি না।

শ্রীনাথ বারান্দায় বেরিয়ে খ্যাপা নিতাইকে ডেকে সজলকে পাঠিয়ে দিতে বলে।

 ১৭. সজল এসে প্রণাম করে

সজল এসে প্রণাম করে হাসিমুখে দাঁড়াতেই মনটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল দীপনাথের। সজলের মুখখানা ভারী মিষ্টি হয়েছে। দু’খানা বুদ্ধিদীপ্ত বড় বড় চোখ, জড়তাহীন ভাবভঙ্গি। চেহারাখানাও বেশ লম্বা এবং কাঠামোটাও মজবুত।

আমাকে চিনতে পারিস, সজল!

হুঁ-উ। বড়কাকা।

এখানে আসব বলে ঠিক ছিল না। তাই তোর জন্য কিছু আনতে পারিনি। বলে মানিব্যাগটা হিপ পকেট থেকে বের করে কুড়িটা টাকা সজলের হাতে দেয় দীপনাথ। বলে, জামাটামা কিছু একটা কিনে নিস।

শ্রীনাথ ধমক দিয়ে বলে, কেন? কোনও পালপার্বণ পড়েছে এখন! কিছু দিতে হবে না।

সজলও হাত গুটিয়ে নিয়ে বলে, না না, আমার এখন জামার দরকার নেই, কাকু। তুমি টাকা রাখো।

দীপনাথ শ্রীনাথকে ধমক দিয়ে বলে, তুমি থামো তো। সজল কি আমার কুটুম নাকি? বলে সজলের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, কাকার সঙ্গে ভদ্রতা হচ্ছে? এক চড় খাবি। নে!

সজল টাকাটা নেয়। খুব লজ্জার সঙ্গে হাসে।

দীপনাথ মানিব্যাগ পকেটে পুরতে পুরতে বলে, আজেবাজে ব্যাপারে খরচ করিস না। জামা কিনে নিস। লেখাপড়ায় কেমন হয়েছিস? ক্লাসে ফার্স্ট হোস নাকি?

শ্রীনাথ বলে ওঠে, আরে না না। কোনওরকমে পাসটাস করে যায় আর কী। লেখাপড়ায় মনই নেই। অতি বাঁদর।

দীপনাথের নিকট-আত্মীয় বলতে এরাই। বড়দা মল্লিনাথ বিয়েই করেনি। তবে দীপনাথ একবার এক গোপনসূত্রে খবর পেয়েছিল বৈধ সন্তান না থাকলেও নাকি এই রতনপুরেই মল্লিনাথের একজন বাঁধা মেয়েমানুষ ছিল এবং তার গর্ভে মল্লিনাথের এক অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়। মল্লিনাথকে বাদ দিলে আর থাকে সে নিজে আর সোমনাথ। সোমনাথের এখনও ছেলেপুলে হয়নি। এখনও পর্যন্ত শ্রীনাথই যা বংশরক্ষা করছে।

বংশরক্ষা কথাটা এ যুগে প্রায় তামাদি হয়ে গেছে। তবু দীপনাথ এই কথাটার মধ্যে এক গভীর মায়া ও তীব্র আকাঙক্ষা বোধ করে।

সে উঠে পড়ে বলল, চল, তোদের বাড়িটা ঘুরে দেখি।

সজল খুব রাজি। বলল, চলো।

কাকাকে সজলের খুব পছন্দ হয়ে গেছে। সে শুনেছে এই কাকা নাকি খুব উদাস ধরনের। সংসারে মন নেই। আত্মীয়দের সঙ্গে তেমন সম্পর্কও নেই। ছোটকাকার মতো এই কাকা কোনওদিন জেঠুর সম্পত্তি দাবি করতে আসেনি।

সজল মুখ তুলে সকালের রোদে দীপনাথের মুখখানা ভাল করে দেখল। উদাস একরকম চোখ। একটু যেন ছটফটে ভঙ্গি। মুখখানা লম্বা ধরনের এবং খুবই সুশ্রী। সব মিলিয়ে কাকাটিকে তার ভীষণ পছন্দ হয়ে যায়।

খ্যাপা নিতাইয়ের ঝোপড়াটা দেখিয়ে দীপনাথ বলে, ওটা কী রে?

নিতাই খ্যাপার ঘর।

কোন নিতাই? সেই যে তান্ত্রিক?

সজল অবাক হয়ে বলে, তুমি চেনো?

চিনব না কেন? বহুকাল আগে বড়দার ফাইফরমাশ খাটত। তখন দেখেছি। তখন অবশ্য তান্ত্রিক হয়নি। এখন কী করে?

ওঃ, সে অনেক কিছু করে। বাণ মারে।

সর্বনাশ! কাকে বাণ মারে?

হি হি করে হাসে সজল। বলে, সবাইকেই মারে। যার ওপর যখন খেপে যায়। একদিন সরিৎমামাকেও বাণ মেরেছিল।

সরিৎ! কোন সবিৎ? বউদির এক ভাই ছিল সরিৎ, সেই নাকি?

হুঁ, সরিৎমামা এখন আমাদের এখানে থাকে।

ওকে বাণ মারল কেন?

সরিৎমামা ওকে মেরেছিল যে! মার নামে কী যেন সব বলেছিল, তাই মেরেছিল।

বউদির নামে?–ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে দীপনাথ বলে, তবে বউদি ওকে এখানে রেখেছে কেন? তাড়িয়ে দিলেই তো হয়।

সজল মাথা নেড়ে বালে, মা ওকে তাড়াবে না।

কেন?

নিতাইদাকে মা খুব ভয় পায়।

পুকুরধারে বিস্ময়ে প্রায় থেমে যায় দীপনাথ। বলল, বউদি ওকে ভয় পায়, বলিস কী রে? ওকে ভয় পাবে কেন?

বাণ মারে যে!

কথাটা দীননাথ হেসেই উড়িয়ে দেয়। তৃষা বউদি খ্যাপা নিতাইয়ের বাণকে ভয় খাওয়ার মেয়ে নয়।

পুকুরের গভীর ছায়াচ্ছন্ন জলের দিকে চেয়ে ছিল দীনাথ। চারদিকে গাছপালার নিবিড়তা। এত সুন্দর ছায়া আর গভীর জল যেন বহুকাল দেখেনি দীনাথ। কী নির্জনতা এখানে। বলল, এ পুকুরে বড়দা অনেক মাছ ছেড়েছিল।

এখনও অনেক মাছ।–সজল আগ্রহের সঙ্গে জবাব দেয়।

মাছগুলো তোরা কী করিস?

মাঝে মাঝে ধরা হয়। ধরলে কাকা? আমার হুইল আছে।

না রে, আজ সময় নেই।

তবে কবে আসবে বলো, সেদিন দুজনে মিলে ধরব।

আসব’খন একদিন।

তুমি রবিবারেরবিবারে আসতে পারো না?

ভারী স্নেহের হাতে সজলের মাথার এক টোকা চুল একটু নেড়ে দেয় দীপনাথ। বলে, তোর বুঝি খুব মাছ ধরার শখ?

খুব। তবে মাছ খাই না।

তা হলে ধরিস কেন?

ভাল লাগে। তুমি কখনও মুরগির গলা কেটেছ কাকু?

দীপনাথ ভ্রু কুঁচকোয় আবার। বলে, না তো! কেন রে?

মুরগি কাটতে খুব ভাল লাগে, না?

দীপনাথ একটু দুশ্চিন্তার দৃষ্টিতে ভাইপোর দিকে তাকায়। মুরগি কাটার মধ্যে ভাল লাগার কী আছে বুঝতে না পেরে মাথা নেড়ে বলে, আমার ভাল লাগে না। অবোলা জীবকে কাটতে ভাল লাগবে কেন? তুই কাটিস নাকি?

লুকিয়ে কেটেছিলাম। মা টের পেয়ে তিন দিন ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।

কাটতেই বা গেলি কেন?

নিতাই কাটে, সরিমা কাটে, লক্ষ্মণ কাটে, তবে আমি কাটলে কী দোষ?

ইতস্তত করে দীপনাথ বলে, দোষ নেই। তবে তোর বয়সে সবাই তো রক্ত দেখলে ভয় পায়।

আমিও পেতাম। এখন পাই না। জানো কাকু, বাবার কাছে একটা দারুণ জার্মান ক্ষুর আছে। সেইটে দিয়ে কাটতে যা ভাল না!

সর্বনাশ! ক্ষুরে হাত দিস নাকি? ভীষণ ধার যে, কখন হাত-ফাত কেটেকুটে ফেলবি।

কাটবে কেন? বাবা তো নিজেই ক্ষুরটা আমাকে দিতে চেয়েছিল। মা দিতে দিল না। তাই নিয়ে দু’জনের কী ঝগড়া! জানো, মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না।

দীপনাথ একটু মুশকিলে পড়ে যায়। কারও হাঁড়ির খবরে তার তেমন আগ্রহ নেই। তার ওপর। এই বাচ্চা ভাইপোটার মুখ থেকে পাকা পাকা কথা শুনতে তার ভাল লাগে না। কিন্তু এ বাড়ির আবহাওয়া যে খুব পরিশ্রুত নয় তা সে জানে। যদি এদের জন্য কিছু করা যেত!

দীপ বলল, ঝগড়া নয়। মা-বাবার মধ্যে ওরকম একটু-আধটু হয়েই থাকে।

সজল মাথা নেড়ে বলে, আমার বন্ধুদের মা-বাবার মধ্যে ওরকম হয় না তো।

কী নিয়ে তোর মা-বাবার এত ঝগড়া?

মুখে মুখে ঝগড়া হয় না। কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক ভাল না। সবাই জানে। বাবা তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

তোকে কে বলল?

আমরা জানি। বদ্রীকাকু আছে না, ওই যে লাইনের ওধারে থাকে, সে ই বলেছে।

বদ্রীটা আবার কে? যা হোক, হবে কেউ। ভাবে দীপ।

সজল বলে, মা একদিন বদ্রীকাকুকে ডাকিয়ে এনে খুব ধমকাল। বদ্রীকাকু নাকি বাবার জন্য চারদিকে জমি খুজছিল। জমি পেলেই বাবা চলে যাবে।

ও।

মা অবশ্য বদ্রীকাকুকে এমন ভয় দেখিয়েছে যে আর এদিকে আসে না। ছোটকাকুর মতোই অবস্থা।

কেন, ছোটকাকুর আবার কী হয়েছিল?

বাঃ, ছোটকাকুকে দুটো লোক মিলে মারল না? এখনও কেস চলছে তাই নিয়ে।

সে জানি। তার সঙ্গে তোর মায়ের সম্পর্ক কী?

সেই লোক দুটোকে যে আমি চিনি!

তারা কারা? কী নাম?

বললে মা আমাকে মেরে ফেলবে।

বিরক্তি চেপে দীপ বলে, তা হলে বলিস না।

সজল একটু দ্বিধায় পড়ে। আসলে এই বড়কাকুকে তার ভীষণ ভাল লেগে গেছে। একে সে সব কথা বলতে চায়। সে তাই চুপি চুপি বলল, এর পরের বার যখন তুমি আসবে তখন চিনিয়ে দেব। ওই ইটখোলার দিকে থাকে।

দীপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, চিনেই বা কী করব? তুই বরং ওসব কাউকে বলিস না। সেই লোক দুটো কি তোর মায়ের লোক?

না তো কী? মদনজেঠুর লোক। মদনজেঠুকে বলে মা ওদের কাজে লাগিয়েছিল।

পুকুরপাড় ছেড়ে সবজিবাগানের ধার ঘেঁষে একটা কুলগাছের ছায়ায় এসে পড়েছিল দু’জন। সবজিবাগানে মুনিশ খাটছে। ভারী সুন্দর ফুলকপি বাঁধাকপি হয়ে আছে। এক ফালি জমি ঘন সবুজ ধনেপাতায় ছাওয়া। কঁঠালের ডালে মস্ত মৌচাকে গুন গুন শব্দ।

কিন্তু এই সুন্দর দৃশ্যের ওপর যেন এক বিষণ্ণতার পরদা ঠেলে দিয়েছে কে। দীপ আধখানা চোখে দেখছে। মন অন্যত্র।

সে জিজ্ঞেস করল, তুই খেলাধুলো করিস না?

খুব করি।

কী খেলিস?

ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সিজনের সময় ফুটবল।

আবার যখন আসব তখন তোর জন্য কী নিয়ে আসব বল তো?

একটা এয়ারগান আনবে? যা দিয়ে পাখি মারা যায়?

পাখি মারবি কেন? টারগেট প্র্যাকটিস করবি?

সরিৎমামা বলেছে আর কিছুদিন পরেই আমাকে আসল বন্দুক চালাতে শিখিয়ে দেবে।

আসল বন্দুক পাবি কোথায়?

জেঠুর বন্দুক থানায় জমা আছে না? মা সেইটে আনাচ্ছে।

বন্দুক দিয়ে তোর মা কী করবে?

আমাদের নাকি অনেক শত্রু।

দীপনাথ হেসে ফেলে। বলে, তাই নাকি?

সজল হাসে না। গম্ভীর মুখ করে বলে, এ জায়গায় কেউ আমাদের দু চোখে দেখতে পারে না। বিশেষ করে মাকে।

কেন?

সবাই বলে, মা নাকি ভাল নয়।

দীপ গম্ভীর হয়ে বলে, ছিঃ সজল, ওসব কখনও মনে ভাববে না। বলবেও না কাউকে। তোমার মাকে আমি বহুকাল চিনি। উনি খুব ভাল।

আমি তো খারাপ বলিনি। লোকে বলে।

লোকে যা খুশি বলুক, কান দিয়ো না।

তুমি এখানে এসে থাকবে, কাকু? থাকো না, খুব মজা হবে তা হলো এখানে একটাও ভাল লোক নেই।

আমি যে ভাল তোকে কে বলল?

আমি জানি। মাও বলে।

মা কী বলে?

বলে ভাইয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল হল বড় ঠাকুরপো। সাতে-পাঁচে থাকে না, নিজের মনে আছে।

বলে বুঝি?

তুমি থাকলে এখানকার লোকেরা আমাদের পিছনে লাগবে না।

এখন লাগে বুঝি?

ভীষণ। স্কুলেও আলোচনা হয়। সবাই বলে, আমরা নাকি জেঠুকে ঠকিয়ে সব সম্পত্তি নিয়ে নিয়েছি। এমনও বলে, মা নাকি জেঠুকে বিষ খাইয়ে মেরেছে।

যাঃ।— বলতে বলতে তারা একটা ডাঙা জমিতে উঠল।

সামনেই মেহেদির বেড়া। তারপর উঠোন। অন্তঃপুর।

আগড় ঠেলে উঠোনে পা দেওয়ার আগে সজল মুখ ফিরিয়ে বলল, আজ দাদুর আসার কথা, জানো?

জানি।

দাদু এলে খুব মজা হবে। আমি দাদুকে যা খ্যাপাই না!

খ্যাপাবি কেন? দাদু বুঝি বন্ধু?

তা নয়। ভাল লাগে। দাদু যে একটুতেই রেগে যায়।

রাগলেই বুঝি রাগাতে হবে?

কথা কইতে কইতে তারা উঠোনে ঢোকে।

মঞ্জু ছুটে এসে দীপনাথের হাত ধরে বলে, উঃ কাকু, ভদ্রমহিলা যা স্মার্ট না!

দীপ একটু হাসে। বলে, তা তো বুঝতেই পারছি। ভদ্রমহিলাকে পেয়ে কাকাকে একদম ভুলে গেছিস। একবার কাছেও গেলি না।

বড় বড় চোখে চেয়ে মঞ্জু বলে, আহা, তুমি তো আসবেই। উনি তো আর আসবেন না। এত সুন্দর কথা বলেন না, কী বলব!

খুব ভাব হয়ে গেছে তোদের?

ভীষণ। আর একটু থাকবে, কাকু?

উপায় নেই রে। লাঞ্চে ফিরে যেতে হবে।

আর কতক্ষণ?

দীপ ঘড়ি দেখে বলে, বড় জোর ঘণ্টাখানেক।

উনি কিন্তু যেতে চাইছেন না।

সে কী?

হ্যাঁ গো। বার বার বলছেন, তোমাদের বাড়িটা আমার খুব ভাল লেগে গেছে। ইচ্ছে হচ্ছে সারা দিনটা এখানেই কাটিয়ে যাই। থাকবে কাকু সারাদিন?

তাই হয় না কি? চারদিকে খোঁজ পড়ে যাবে। শোন, গাড়ির ড্রাইভারটা বসে আছে, ওকে একটু চা-টা পাঠিয়ে দিস শে।

ওঃ, সে কখন দিয়ে এসেছে মংলু! চা, পরোটা, ডিমভাজা। তোমাদের জন্য মা তাড়াতাড়ি কিমারি তৈরি করছে।

ওরে বাবা, এখন ওসব খেলে লাঞ্চ খাব কোন পেটে?

পারবে। এসো না আমাদের ঘরে। মণিদি কীরকম গল্প করছে দেখে যাও।

দীপনাথ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, দুর পাগলি। মেয়েমহলে পুরুষদের যেতে নেই। তুই বরং ওঁকে গিয়ে বল, হাতের ঘড়িটার দিকে যেন একটু নজর রাখে।

দাদুর সঙ্গে দেখা করে যাবে না? আজ ছোটকাকু দাদুকে নিয়ে আসবে যে!

আজ যদি দেখা না হয় তবে অন্য দিন আসব।

সজল গেল না। মঞ্জু দৌড়ে চলে গেল মণিদীপার গল্প শুনতে। দীপ আনমনে চিন্তা করে, মণিদীপা ওদেরও কমিউনিজম বোঝাচ্ছে না তোর

রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দীপনাথ ডাকল, বউদি!

তৃষা দারুণ সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে কিমা রান্না করছিল। দুটো বিশাল চোখে ফিরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, অন্যের বউ নিয়ে টানাটানি না করে নিজে একটা বউ জুটিয়ে নিলেই তো হয়।

ভীষণ বিব্রত বোধ করে লাল হয়ে গেল দীপনাথ। বলল, যাঃ, কী যে বলো!

অন্যের বউটি অবশ্য সাংঘাতিক স্মার্ট। সুন্দরীও।

তাতেই বা আমার কী?

তৃষা রান্নার ভার বৃন্দার হাতে ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বলে, এসো, আমার ঘরে বসবে।

দীপনাথ তুমার পিছু পিছু এসে যে ঘরটায় ঢোকে সেটাতেই এক সময় বড়দা মল্লিনাথ থাকত। চমৎকার পাকা ঘর। আবলুস কাঠের দেয়াল-আলমারি, বন্দুকের স্ট্যান্ড থেকে এইচ এম ভি-র বাক্স গ্রামোফোনটি পর্যন্ত এখনও সযত্নে সাজানো। বিশাল একখানা চিত্র-বিচিত্র খাট। একপাশে টেবিল। হল্যান্ডের ফিলিপস রেডিয়ো।

দীপনাথ বহুকাল বাদে এই ঘরে এল। তৃষা বলল, অবশ্য রংটা আমার মতোই।

কার রং?–দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

মণিদীপার। তোমার বন্ধুর বউ নাকি?

বন্ধু নয়! বস। ওপরওয়ালা।

বস মানে জানি মশাই, বাংলা করে বলতে হবে না।

দীপ হাসে। বলে, আমি আনিনি। উনিই আসতে চাইলেন।

আজকালকার মেয়েদের কোনও জড়তা নেই। লজ্জা-উজ্জাও কম। আমরা হলে পাঁচটা কথা উঠে পড়ত।

কথা ওঠার ব্যাপার নয় বউদি। দিনের বেলায় সামান্য আউটিং। দোষের কিছু দেখলে নাকি?

তৃষা মাথা নেড়ে বলে, দোষের কী দেখব আবার, তবে একটা জিনিস দেখে একটু মজা পেয়েছি।

কী সেটা?

মেয়েটা দু’-পাঁচ মিনিট পর পরই তোমার খোঁজ করছে। উনি কোথায় গেলেন? দূরে যাননি তো? উনি যদি চা খান তা হলে আমিও খাব।

দীপনাথ আবার লাল হয়। বুকের মধ্যে এমন একটা শিবশিৱানি ওঠে যে গায়ে কাঁটা দিতে থাকে।

১৮. তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে

তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাই করতে গেল বোধহয়।

মল্লিনাথের এই ঘরখানায় বসে হারানো বহু স্মৃতিই মনে পড়ার কথা। আশ্চর্য, দীপনাথ একবারও মল্লিনাথের কথা ভাবল না! তার শরীর বার বার কাঁটা দিল এক শিহবনে। মণিদীপা তার খোঁজ করছে।

সত্য বটে দীপনাথের ভিতরে এক সময় ইস্পাত ছিল। তাদের সব ভাইবোনের মধ্যেই কিছুটা করে আছে। একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে মেজদা শ্রীনাথ। কিন্তু দীপনাথের সেই ইস্পাতই বা কোথায় গেল?

ভিতর থেকে দীর্দাশ্বাস ফেলে অন্য এক দীপনাথ বলল, জং ধরে গেছে হে!

দীপনাথ বলল, অত সস্তা নয়। আমি সহজে হার মানি না।

হার মেনেছ কে বলল? বরং তথ্য বিশ্লেষণ করে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, তুমি ভয় করেছ! হার মেনেছে অন্য পক্ষ।

ইয়ারকি নয়! আমি কারও প্রেমে পড়িনি।

তাও বলা হচ্ছে না। ঘুরিয়ে বলতে গেলে অন্য পক্ষই পড়েছে। তাতে তো তোমার দোষ ধরা যায় না।

অন্য পক্ষের দায়-দায়িত্ব তো আমি নিতে পারি না। কে কবে কার প্রেমে পড়বে আর দোষটা আমার ঘাড়ে চাপাবে–

ধীরে বন্ধু, ধীরে। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবব। মণিদীপার বয়স কত বলো তো?

কে জানে? কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে বোধহয়।

তা এ বয়সে আজকালকার মেয়েদের খুকিই বলা যায়।

যত খুকি ভাবছ তত নয়।

তবু বলছি ততটা পাকেনি এখনও। মনটা কাঁচা আছে। জাম্বুবান স্বামীটার জন্য একটা আনহ্যাপি লাইফ লিড করতে হচ্ছে বলে রাগে আক্রোশে প্রতিহিংসায় মাথাটাও ঠিক নেই কিনা।

মিস্টার বোসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই মহিলাও যে সাংঘাতিক বিপ্লবী।

স্বামী সিমপ্যাথিটিক হলে বিপ্লবটা এমন চাগিয়ে উঠত না মাথার মধ্যে। যাকগে যা বলছিলাম, মিসেস বোসের কাচা মাথাটা খাওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না। তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলেও খেতে পারত।

এই কথায় দীপের একটু অভিমান হল। বলল, তা হতে পারে। তবে মাথাটা আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই।

একেবারেই নেই কি?

মোটেই নেই।

তা হলে বা তুমি মুক্ত পূৰুয। অত লজ্জা শরম পাচ্ছ কেন?

আমি মুক্ত পুরুষই।

তবু বলছি, ভিতরকার মরচে-পড়া ইস্পাতে একটু শান দাও। শক্ত হও। নইলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। চাকরিও নট, মণিদাপাও নট।

যায় যাক। পরোয়া করি না।

চাকরিব পরোয়া কবো না করো, মণিদীপার পরোয়া একটু-আধটু করছ, উনিও করছেন। বউদির চোখে ধরাও পড়ে গেছে। এখন বেশ সাবধানে পা ফেলো।

আমার কোন দুর্বলতা নেই। এই মুহূর্তে সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিলাম।

বলে দীপনাথ খুব বুক চিতিয়ে উঠে এল। আর সেই মুহূর্তেই মল্লিনাথের বার্মা সেগুনের বিশাল আলমারির গায়ে লাগানো খাঁটি বেলজিয়াম আয়নায় তার আপাদমস্তক প্রতিবিম্ব সামনে দাঁড়াল।

ব্যায়াম-ট্যায়াম করে এবং দৌড়ঝাপের মধ্যে থেকে তার চেহারাটা হয়েছে গুন্ডা শ্রেণির। খুবই শক্তপোক্ত। লম্বাটে আখাম্বা। মুখশ্রীতে কিছু রুক্ষত সত্ত্বেও বংশগত লাবণ্য কিছু রয়ে গেছে। চেহারাটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল সে। বেশ খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে মন থেকে এক বিচারপতি রায় দিল, এই চেহারার পুরুষ মানুষের প্রেমে পড়তে কোনও মেয়েরই বাধা নেই।

ভালই গো ভালই। অত দেখতে হয় না নিজেকে।–বলে তৃষা পিছন দিকে একটা টুলের ওপর খাবারের রেকাবি রাখল।

খুবই চমকে গিয়েছিল দীপনাথ। হেসে ফেলে বলল, চেহারা নয়। আয়নাটা দেখছিলাম। খাঁটি বেলজিয়াম গ্লাস।

তৃষা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ, আজকাল আর এসব জিনিস পাওয়া যায় না।

দীপনাথ আবার একটু অস্বস্তিতে পড়ে। জিনিসটা বড়দার। বউদি আবার ভাবল না তো, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব জিনিসের ওপর দাবিদাওয়া রাখছি?

সে তাড়াতাড়ি বলল, অত সব কী এনেছ? লাঞ্চ আছে যে!

তৃষা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, এসে থেকেই তো বাপু কেবল শুনছি লাঞ্চ আর লাঞ্চ। ওসব সাহেবি কেতার লাঞ্চ কী রকম হয় তা একটু-আধটু জানি বাপু। ওখানে তুমি কম খেলে না বেশি খেলে, ফেললে না রাখলে তা কেউ খেয়ালও করবে না। এসব আমাকে শিখিয়ো না।

কথাটা ঠিক। দীপনাথ যদি বুফে লাঞ্চে একটা পদ নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে তা হলেও কেউ লক্ষ করবে না। তা ছাড়া লাঞ্চের আগেই সকলে নিরাপদ রকমের মাতাল হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। তাই সে প্লেটের সামনে বসে বলল, তা বটে। খেয়াল ছিল না।

তৃষা মুখ টিপে হেসে বলে, ভেবো না, উনিও পেট ভরে খেয়েছেন। লাঞ্চ নিয়ে মণিদীপার একটুও মাথাব্যথা নেই। এমনকী যেতে চাইছেন না।

সর্বনাশ! না গেলে পরস্ত্রী হরণের দায়ে পড়ে যাব, বউদি।

পড়ে যাবে কেন ভাই? পড়ে অলরেডি গেছ।

তার মানে?

ভাল চাও তো এদের কনসার্নে চাকরি আর কোরো না।

দীপনাথ আবার লাল হয়ে একটা লুচি ছিড়ে দুই টুকরো করে বলে, তুমি না একদম বাজে।

তৃষা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, তুমিই বা কেন এরকম কিম্ভূত? দেশে কুমারী মেয়ের তো অভাব নেই, তবে এই কচি বউটার মাথা খেয়ে বসে আছো কেন?

দীপনাথ এবার স্পষ্টতই একটু বিরক্ত হয়। তেতো গলায় বলে, এ যুগটা তোমাদের যুগের মতো নয় বউদি। এখনকার মেয়েরা অত সহজে প্রেমে পড়ে না। মণিদীপার তুমি কী বেহেড অবস্থা দেখলে?

তৃষা হেসে ফেলে বলে, ঠাট্টা বোঝো না, তুমি কেমন হয়ে গেছ বলো তো!

ঠাট্টা! হতেও তো পারে। দীপনাথ আবার লাল হয়। বলে, বসের বউ নিয়ে ইয়ারকি নয়। কানে গেলে সর্বনাশ।

তৃষা নীরবে একটু হাসে। বলে, প্রেমে পড়েছে এমন কথা কিন্তু একবারও বলিনি। বরং বলছিলাম, বসের বউকে ভাল জপিয়ে নিয়েছ। টক করে প্রোমোশন পেয়ে যাবে।

জপিয়েছি তাই বা বলছ কী করে?

ওসব বোঝা যায়।

তবে তুমিই বোঝো যাও।

রাগ করলে নাকি গো!–বলে তৃষা আবার গা জ্বালানো হাসি হাসে। বস্তুত একমাত্র এই দেওরটির কাছেই সে বরাবর একটু তরল। শ্বশুরবাড়ি বা বাপের বাড়ির আর কারও সঙ্গে তার কোনও ঠাট্টা বা ইয়ারকির সম্পর্ক নেই। দীপনাথকে বরাবরই তার ভাল লাগে। এই এক সংসার-উদাসী মানুষ। বড় ভাল মানুষ। কখনও কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না, কারও কাছে কোনও প্রত্যাশাও নেই তার। বিয়ের পর হয়তো বদলে যাবে। বেশির ভাগ ভাল পুরুষই বিয়ের পর সেয়ানা হয়। দীপনাথ যতদিন বিয়ে না করছে ততদিন তৃষার তাকে বোধহয় এইরকমই ভাল লাগবে।

দীপনাথ বলল, না, রাগ করব কেন? অনুরাগের কথাই তো বলছ। তবে তুমি বরাবরই ফাজিল।

তৃষা স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে বলে, আমি যে ফাজিল সে শুধু দুনিয়ায় একমাত্র তুমিই বললে! আর কেউ কিন্তু বলে না।

আর সবাই কী বলে তোমাকে?–খেতে খেতে চোখ তুলে দীপনাথ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে।

সে অনেক কথা। সোমবাবু তো নাকি বলে, আমি দেবী চৌধুরানি হওয়ার চেষ্টা করছি। এখানকার লোকেও বলে, আমি মেয়ে গুন্ডা, নারী ডাকাত।

বলে নাকি?

শুনি তো।

ঠিকই বলে।–দীপনাথ গম্ভীর মুখে বলল।

তৃষা মৃদু হাসল। বলল, কেন, তোমারও কি তাই মনে হয়?

ডাকাত না হলে ভিলেজ-পলিটিকসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারতে না, বউদি। ডাকাত তো তুমি বটেই।

তোমার মেজদাও আমাকে খুব ভাল চোখে দেখেন না। ওঁর ধারণা আমি ইচ্ছে করে এখানকার লোকেদের সঙ্গে পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করছি।

করছ নাকি? সর্বনাশ! লোকাল লোকদের খুব সমীহ করে চলবে। এরা গ্রাম্য হোক, অশিক্ষিত হোক, খেপলে কিন্তু নাজেহাল করে ছাড়বে।

কঠিন হয়ে গেল তৃষার মুখ। ঠাট্টা-ইয়ারকির ভাবটা একদম রইল না আর। বলল, সহজে আপস করি না। করবও না।

দীপনাথ চোখ তুলে বউদির মুখটা একবার দেখে নিয়ে বলল, মামলা-মোকদ্দমা চলছে নাকি?

চলছে।

আচমকাই দীপনাথের মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল, সোমনাথকে কারা মেরেছিল জানো?

তৃষা এক ঝলক তাকিয়ে বলল, না। জানলে চুপ করে থাকতাম নাকি?

তা বলিনি। এইটুকু ছোট একটা জায়গায় ক্রিমিন্যাল ধরতে পুলিশের এত দেরি হচ্ছে কেন সেইটেই বুঝতে পারছি না।

সে পুলিশ জানে।

সে তো ঠিকই। দীপনাথ আবার মাথা নিচু করে। তারপর একটু ধীর গলায় বলে, সজলকে কি এখানেই বরাবর রাখবে?

তৃষা অবাক হয়ে বলে, কেন বলো তো! এখানে রাখব নাই বা কেন?

দীপনাথ বিজ্ঞের মতো বলে, এই পরিবেশটা হয়তো তেমন ভাল নয়, বউদি।

তা তো নয়ই।

তা হলে সজলকে কোনও ভাল স্কুলে দিয়ে দাও। হোস্টেল বা বোর্ডিং-এ রাখো।

তৃষা বোকা নয়। সে স্থির দৃষ্টিতে দীপনাথের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, সজলের সঙ্গে তোমার কথা হল বুঝি?

হুঁ।

কী বুঝলে?

বুঝলাম সজল এখানে খুব হ্যাপি নয়। ওকে বাইরে পাঠানোই ভাল।

হ্যাপি নয় কেন? কিছু বলল?

অনেক কিছু বলল। সেগুলো কিছু খারাপ কথাও নয়। তবে বুঝতে পারলাম ওর একটা অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি গ্রো করছে।

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সেটা আমি মাঝে মাঝে টের পাই, আগে আমাকে যমের মতো ভয় পেত। আজকাল কেমন যেন ভয়ডর কমে যাচ্ছে।

বাইরে পাঠিয়ে দাও। ঠিক হয়ে যাবে।

দেখব।

যদি বলো তো আমিও ভাল বোর্ডিং স্কুল দেখতে পারি।

তৃষা খুবই অন্যমনস্ক ছিল। জবাব দিল না।

রওনা হওয়ার আগে পর্যন্ত সোমনাথ বাবাকে নিয়ে এল না। একটা বেজে গেল। রওনা না হলে নয়।

বিদায়ের সময় বড় ফটকের কাছে বাড়ির সবাই জড়ো হল। সমস্বরে বলল, আবার আসবেন।

খুব অকপটে মণিদীপা ঘাড় হেলিয়ে বলল, আসবই। আমার এরকম একটা স্পট দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।

গাড়ি চলতে শুরু করার বেশ খানিকক্ষণ পর দীপনাথ সাবধানে বলল, একটু দেরি করে ফেললাম আমরা! মিস্টার বোস ভাবছেন।

একটু ভাবুক না! রোজ তো ভাবে না, আজ ভাবুক।

আপনার যা মানায়, আমাকে তো তা মানায় না। দোষটা বোধহয় আমার ঘাড়ে এসে পড়বে।

কেন? আপনার দোষ কিসের? আমিই তো আসতে চেয়েছিলাম।

দীপনাথ একটু শ্বাস ফেলল। সব কথা মণিদীপা বুঝবে না। বোঝানো যাবেও না।

মণিদীপা আবার তার স্বভাবসিদ্ধ শ্লেষের হাসি হেসে বলে, ইউ আর এ স্লেভ। বন্ডেড লেবারার। বোসের মতো একজন কাকতাড়ুয়াকেও ভয় পান।

আমিই যে সেই কাক।

মণিদীপা সামান্য ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, কথাটা মিথ্যে নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, দীপনাথবাবু, আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কারও কাছে দাসখত লিখে দিইনি, দেবও না। আমি কোথায় যাব না যাব সেটা আমিই ঠিক করতে ভালবাসি এবং তার জন্য কোনও জবাবদিহি করতে ভালবাসি না।

মণিদীপা যে মোটেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েনি সেটা হঠাৎ চোখের দৃষ্টির খর বিদ্যুৎ এবং স্বরের কঠিন শীতলতায় হাড়ে হাড়ে টের পেল দীপনাথ। তার ভিতরে যে প্রত্যাশা, লোভ ও তরল এক রকমের আবেগ তৈরি হয়েছিল তা চোখের পলকে কেটে গেল। সে সচেতন হয়ে নড়েচড়ে বসল। তার পাশে যে মেয়েটা বসে আছে সে মোটেই মেয়েছেলে নয়। একজন দৃপ্ত কমরেড, একজন নির্বিকার বিপ্লবী। যদি কারও প্রেমে কখনও পড়ে থাকে মণিদীপা তবে সে দীপনাথ •ায়। সেই ভাগ্যবান বা দুর্ভাগা একজন স্কুলমাস্টার, স্নিগ্ধদেব।

দীপনাথ কথার তোড়ে একটু কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলতে পারল, আমার দাদা-বউদি একটু সেকেলে। আপনার বোধহয়–

মণিদীপা কথাটার জবাব দিল না। বাইরের দিকে চেয়ে শিথিল শরীরে বসে ছিল। মুখ গম্ভীর।

দীপনাথ আর কিছু বলার সাহস পেল না।

 

বাগানবাড়িতে তাদের অনুপ্রবেশ বিন্দুমাত্র আলোড়ন তুলল না। কেউ জিজ্ঞেস করল না কিছু। শিকারের পার্টি এখনও ফিরে আসেনি।

দীপনাথ এতক্ষণ মনে মনে এই এক ভয়ই পাচ্ছিল। বোস সাহেব ফিরে এসে যদি শোনে—

দীপনাথ নিশ্চিন্ত হল। মণিদীপা গাড়ি থেকে নেমে তাকে কোনও কথা না বলে সেই যে গটগট করে হেঁটে কোথায় চলে গেল তাকে আর দেখতে পেল না সে। খুঁজতেও সাহস হল না। মুহুর্মুহু মেয়েটার মেজাজ পালটে যায়।

দীপনাথ চারদিকে চেয়ে দেখল, দুপুরের রোদে উঁচু সমাজের গৃহিণীরা গাছতলার টেবিলচেয়ারে থ ভঙ্গিতে বসে আছে। দুটো তাসের আড্ডা বসেছে। কয়েকজন পুরু আনাড়ির মতো ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছেন। বেয়ারারা বিয়ারের ট্রে নিয়ে ঘুরছে।

দীপনাথ একটা নিরিবিলি গাছতলা বেছে নিয়ে মাথার ওপর হাত রেখে শুয়ে পড়ল। বউদি অঢেল খাইয়েছে। লাঞ্চে সে আজ অব কিছু খাবে না। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছিল সে।

স্বপ্নের মধ্যে মণিদীপা এসে সামনে দাঁড়াল। পিছনে চাবুক হাতে বোস সাহেব। বোস সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ডে মণিদীপাকে আরও কঠিন ও সাংঘাতিক দেখাচ্ছে।

মণিদীপ বলল, দীপনাথবাবু।

দীপনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল, জানি।

কী জানেন?

আপনি আমাকে অপমান করবেন এইবার। অপমানটা আমি সবার আগে টের পাই।

কী করে বুঝলেন?

কারণ আমি সবসময়েই অপমানই প্রত্যাশা করি বলে। জীবনে আমি এতবার এত মানুষের অপমান সহ্য করেছি যে, আমাকে আর অপমান করার দরকারই নেই কারও। প্লিজ, আপনিও করবেন না।

যারা কাপুরুষ তারাই অপমানিত হয়। কই, করুক তো স্কুলমাস্টার স্নিগ্ধদেবকে কেউ অপমান! এমন রুখে উঠবে যে যত বড় লোকই হোক না কেন, ওর চোখের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না।

জানি।

স্নিগ্ধর আপনি কতটুকু জানেন?

স্নিগ্ধদেবকে জানি না। কিন্তু চরিত্রবান মানুষদের জানি। তাদের কেউ অপমান করতে সাহস পায়। ব্যক্তিত্বওলা লোকদের চেনা শক্ত নয়। আপনার চোখের দৃষ্টি দেখেই আমি স্নিগ্ধদেবকে অনুমান করতে পারি। আমি তার চেয়ে বোধহয় অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান, কিন্তু তার জোর অন্য জায়গায়। আমি জানি।

মণিদীপা হাসল না। গম্ভীর মুখে বলল, স্নিগ্ধদেবের জোরটা কোথায় জানেন?

না, বলুন শুনি?

স্নিগ্ধদেব কখনও আমাকে কামনা করেনি। আর করেনি বলেই সে আমাকে কিনে রেখেছে। আর আপনি?

আমি করেছি।–চোখ নামিয়ে দীপ বলল।

আর কী জানেন?

কী?

স্নিগ্ধদেব কখনও তার বসকে খুশি করে জীবনে উন্নতি করতে চায়নি। স্নিগ্ধদেব কখনও টাকা-পয়সায় বড়লোক হতে চায় না। স্নিগ্ধদেব একা বড় হতে চায় না। তাই স্নিগ্ধ অত বড়।

মানছি। আমি বড় নই।

কেন বড় নন?

সারা জীবন আমার কেটেছে বড় ভয়ে-ভয়ে। আতঙ্কে। নৈরাশ্যে। অনিশ্চয়তায়।

স্নিগ্ধরও কি তার চেয়ে বেশি ভয়, আতঙ্ক, নৈরাশ্য বা অনিশ্চয়তার কারণ নেই?

আছে। মানুষ যত বড় হয় তার সমস্যার বহরও তত বাড়ে।

তা হলে? স্নিগ্ধদেব পারলে আপনি পারবেন না কেন?

আমি যে বড় নই।

ওটাও কাপুরুষের মতো কথা।

আমার যে স্নিগ্ধদেবের ট্রেনিংটা নেই। আমার জীবনের তেমন কোনও লক্ষ্যও নেই।

হতাশ হয়ে মণিদীপা বলে, কোনও লক্ষ্যই নেই?

দীপ একটু ভেবে বলে, একটা লক্ষ্য আছে হয়তো। কিন্তু বললে আপনি হাসবেন। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। একদিন স্বর্গের সমান উঁচু মহান এক পাহাড়ে উঠব। উঠব, কিন্তু চুড়ায় পৌছোব না কোনওদিন। পাহাড়ের ওপর উঠলে তাকে ছোট করে দেওয়া হয়। আমি পাহাড়ের চেয়ে উঁচু নই। আমি চাই উঠতে উঠতে একদিন সেই পাহাড়ের কোলেই ঢলে পড়ব।

রোমান্টিক ইডিয়ট। সেন্টিমেন্টাল ফুল।

শুনুন মিসেস বোস, আমার কথাটা একটু শুনুন। যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি তখন একটা হারমাদ ছেলের সঙ্গে আমার লড়াই বাধে। খুবই সাংঘাতিক ছেলে। তার নাম ছিল সুকু। সে অসম্ভব ভাল সাইকেল চালাত, ছিল খুবই ভাল স্পোর্টসম্যান। তার গায়ে ছিল আমার দ্বিগুণ জোর। কী নিয়ে তার সঙ্গে আমার প্রথম লেগেছিল মনে নেই। বোধহয় বেঞ্চে জায়গা দখল করা নিয়ে। প্রথমে ছোটখাটো তর্কাতর্কি। একদিন মনে আছে, সে সামনের বেঞ্চে বসে পিছনের ডেস্কে আমার বইয়ের ওপর ইচ্ছে করে কনুই তুলে দিয়ে ভর রেখেছিল। আমি তার কনুই ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সে নির্বিকারভাবে পিছনে ফিরে আমার বইগুলো টান মেরে নীচে ফেলে দিল। ক্লাসে তখন মাস্টারমশাইও ছিলেন। কিন্তু আমি তার বেপরোয়া নির্ভীক হাবভাব দেখে নালিশ করারও সাহস পেলাম না। কিন্তু ঝগড়াটার শেষ সেখানেও হল না। আমার মধ্যে অপমানবোধ বড় তীব্র কাজ করছিল। পরদিন আমি সকলের আগেই স্কুলে পৌঁছে সুকুর সামনের বেঞ্চে বসলাম এবং মাস্টারমশাই ক্লাসে আসার পর ইচ্ছে করেই সুকুর বইয়ের ওপর কনুই তুলে দিলাম; কী হল জানেন? সুকু তার বইগুলো এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল। আমি পিছনে হেলে ধড়াস করে ডেস্কে ধাক্কা খেলাম। ডেস্কের তলা দিয়ে সুকু একটা লাথিও মেরেছিল কোমরে। সেদিনও কিছু বলিনি ভয়ে। কিন্তু ক্লাসে সবাই সুকুর আর আমার ঝগড়ার কথা জেনে গেল। সবাই তাকাত, হাসত, মজা পেত। বলা বাহুল্য, নামকরা স্পোর্টসম্যান বলে সবাই ছিল সুকুরই পক্ষে। এরপর থেকে ক্লাসে প্রায়ই সুকু আর তার কয়েকজন চেলাচামুন্ডা, আমাকে হাবা বলে ডাকতে শুরু করেছিল। অঙ্ক কষছি, ট্রানস্লেশন করছি, ফাঁকে ফাঁকে শ্বাসবায়ুর শব্দের সঙ্গে কানে আসত, এই হাবা! এমন কিছু খারাপ কথা নয়, এখন বুঝি। কিন্তু তখন পিত্তি জ্বলে যেত শুনে। উলটে কিছু বলতে হয় বলে আমি গালাগাল দেওয়া শুরু করি। প্রথম বলতাম শালা, গাধা, গোরু, এইসব। পরে একদিন বেশি রাগ হওয়ায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, শুয়োরের বাচ্চা। হেডসারের ক্লাস ছিল। উনি চলে যেতেই রাগে টকটকে রাঙা মুখে উঠে এল সুকু। কোনও কথা না বলে আমার জামা ধরে এক ঝটকায় পঁড় করিয়ে কী জোর এক চড় মারল যে তা বলে বোঝানো যাবে না। মাথা ঘুরে গেল চড় খেয়ে। আর চড় খেয়ে যখন আমার বুদ্ধিনাশ হয়ে গেছে তখনই সুকুর সাঙাতরা এসে আমার পরনের হাফপ্যান্ট খুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে এল। সম্পূর্ণ গাড়লের মতো হতবুদ্ধি হয়ে আমি বসে ছিলাম। গায়ে শুধু শার্ট, পরনে আর কিছু নেই। ক্লাসসুদ্ধ ছেলে হাততালি দিয়ে চেঁচাচ্ছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি যেন আর অপমান নেই। দু’হাতে লজ্জা ঢেকে আমি হতভম্বের মতো তখন জানালা দিয়ে বাইরে চাইলাম। সেই প্রথম যেন আবিষ্কার করলাম উত্তরের হিমালয়কে। দেখলাম পৃথিবীর সব তুচ্ছতাকে অতিক্রম করে কত উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওই মহান পর্বত। জানালা দিয়ে সে যেন হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বিড়বিড় করে বড় অভিমানে আমি বললাম, এরা তো কেউ আমার নয়। এরা বড় যন্ত্রণা দেয় আমাকে। আমি একদিন তোমার কাছে চলে যাব। সেই থেকে, মিসেস বোস, সেই থেকে ওই পাহাড় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেউ অপমান করলেই আমি পাহাড়ের কথা ভাবি। কেবলই মনে হয়, আমি একদিন সব ক্ষুদ্রতা ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যাব। যখন যাব তখন আর কোনও অপমানই আমার গায়ে লেগে থাকবে না।

 

ঘুমের মধ্যেও দীপের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিকই কাজ করছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কলের পুতুলের মতো সোজা হয়ে বসল সে। সূর্যের শেষ একটু আলো গাছের গাঢ় ছায়া ভেদ করে ঘোলা জলের মতো ছড়িয়ে আছে এখনও। লাঞ্চ কখন শেষ হয়ে গেছে।

যে জায়গায় দীপ শুয়ে ছিল সেটা বাগানের শেষ প্রান্তে, একটা পুকুর পেরিয়ে। এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না।

প্রচণ্ড শীত করছিল তার। মাটির ওপর শুয়ে থাকায় জামা কাপড়ে একটা ভেজা-ভেজা ভাব। শুকনো মরা ঘাস লেগে আছে গায়ে।

উঠে সে দ্রুত পায়ে বাড়ির সামনের চাতালে চলে আসে।

দেখে কোনও লোক নেই। একটা গাড়িও নেই। সবাই চলে গেছে।

দীপনাথ একটু হতবুদ্ধি হয়ে যায়। পার্টি সন্ধে পর্যন্ত চলার কথা ছিল। তবে কি সাহেবরা মদ খেয়ে বেশি মাত্রায় বেচাল হয়ে পড়েছিল?

তাই হবে।

রাস্তায় এসে সে দেখতে পায়, একটা ভ্যানগাড়িতে কোরারের লোকেরা মালপত্র তুলছে।

সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, পার্টি ভেঙে গেল ভাই?

একটা ছেলে খুব সুন্দর করে হেসে বলে, হ্যাঁ! সাহেবরা মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন।

দীপনাথ মনে মনে হিসেব কষছিল। তাকে ফিরতে হবে। কেউ তাকে ফেলে গেছে বলেই তো সে আর পড়ে থাকতে পারে না।

সে বলল, আমি বোস সাহেবের সেক্রেটারি। একটা জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম। তোমাদের গাড়িতে আমাকে একটু পৌঁছে দাও।

কেটারারের লোকেরা রাজি হচ্ছিল না। সন্দেহ করছে।

পাঁচটা টাকা কবুল করে এবং প্রায় হাতে-পায়ে ধরে অবশেষে জায়গা পেয়ে গেল দীপ। ড্রাইভারের পাশেই। খুব ঠাসাঠাসি চাপাচাপির মধ্যে বসে সে বন্দুকগুলোর কথা ভাবছিল। বন্দুকগুলো ঠিকঠাকমতো ওরা নিয়ে গেছে তো? ফেরার সময়ে বন্দুকগুলো ধরে বসে ছিলই বা কে?

১৯. তুমি বেলুন ফোলাবে

তুমি বেলুন ফোলাবে? না, না, কখনও নয়! কখনও নয়!–বলে বিলু তেড়ে এল।

বেলুন-ধরা রোগা হাতখানা বিলুর নাগালের বাইরে সরিয়ে নিয়ে প্রীতম একটু ছেলেমানুষের হাসি হেসে বলল, পারব। দেখো, ঠিক পারব।

পারলেই কী? রোগা শরীরে যদি শেষে না সয়?

কিছু হবে না। লাবুর জন্মদিনে আমার তো কিছু করার সাধ্য নেই। এটুকু করতে দাও।

অনেকগুলো চোপসানো বেলুন দু’ হাতের আঁজলায় নিয়ে লাবু একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। বিকেল হয়ে এসেছে, তবু কেউ বেলুনগুলো ফোলাচ্ছে না দেখে তার একটু দুশ্চিন্তা হয়েছিল বলে সে শেষ পর্যন্ত বাবাকে এসে ধরেছিল, বেলুনগুলো একটু ফুলিয়ে দেবে, বাবা? সবাইকে বলেছি, কেউ শুনছে না। কিন্তু বাবার যে বেলুন ফোলানোও বারণ তা সে বুঝতে পারেনি।

বিলু মেয়ের দিকে ফিরে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, বেলুন ফোলানোর জন্য আর লোক ছিল? কে তোকে বাবার কাছে আসতে বলেছে?

লাবু ভয়ে কাঁটা হয়ে বলে, বিন্দুদিকে বলেছিলাম। দিল না তো! তুমিও দিচ্ছ না।

তাই বাবার কাছে আসতে হবে?

প্রীতম গম্ভীর স্বরে বলে, ওকে বকছ কেন? ও কী বোঝে?

বিলুও বোঝে না। ওর যখন রাগ হয় তখন ও কিছুই বুঝতে চায় না। না যুক্তি, না ভাল কথা। একনাগাড়ে তখন কেবল নিজের ঝাল ঝেড়ে যায়। লঘু অপরাধে লাবু প্রায়ই অত্যন্ত গুরু দণ্ড ভোগ করে। প্রীতমের সে বড় জ্বালা। তার চেয়ে লাবুর জন্ম না হলেও বুঝি ভাল ছিল!

বিলু প্রীতমের দিকে চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, খুব বোঝে। তুমি ওর হয়ে একদম কথা বলবে না। সারাদিন আমি ভোগ করছি, শাসন করার অধিকারও আমার হাতেই ছেড়ে দাও।

প্রীতম মৃদু স্বরে বলে, আজকের দিনটা যাক। আজ ওর জন্মদিন।

বিলু মেয়েকে নড়া ধরে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, ছেড়ে দিয়ে দিয়েই তো এরকম বেয়াড়া হয়ে উঠেছে।

প্রীতম বালিশে শরীরের ভর ছেড়ে দিল। চোখ বুজল। শরীরে তেমন কোনও ক্লান্তি নেই, কিন্তু এই ছোট্ট ব্যাপারটায় মনটা চুমকে গেল।

বাঁ হাতে ধরা বেলুনটাকে বার বার আঙুলে নিষ্পেষিত করল সে। স্থিতিস্থাপক রবার তার শক্তিহীন আঙুলের ফাঁকে লুকোচুরি খেলল কিছুক্ষণ।

লাবুর আজ তিন বছর পূর্ণ হল। তখন ডিসেম্বরের শেষ। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই লাবু একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়তে যাবে। বিন্দু ওকে পৌঁছে দেবে, আবার নিয়ে আসবে ছুটির পর। তারপর একদিন একা একাই স্কুলে যাবে লাবু। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরবে। তখন প্রীতম কোথায়?

আমি তখন কোথায়? এ কথা ভাবতে গিয়েই বোধহয় প্রীতমের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুর ওত পেতে থাকা জীবাণুরা কোলাহল করে ওঠে শরীর জুড়ে। তারা এই সব দুর্বল মুহূর্তগুলির জন্যই তো অপেক্ষা করে থাকে!

প্রীতম বিপদের গন্ধ পেয়ে টপ করে চোখ খোলে। বালিশ থেকে মাথা তুলে চারদিকে চায়। বলে, ভাল আছি। ভাল আছি। খুব ভাল আছি। কিছু হয়নি আমার।

বলতে বলতে হাতের বেলুনটা মুখে নিয়ে এক ফুয়ে টনটন করে ফুলিয়ে তোলে সে। তারপর ডাকে, লাবু! লাবু!

লাবু প্রথমে সাড়া দেয় না। আরও কয়েকবার ডাকে প্রীতম।

লাবু খুব মৃদু, ভিতু পায়ে পরদাটা সরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরে ঢুকে চৌকাঠের কাছেই দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে।

বিছানায় ডিমসুতো রেখে গিয়েছিল লাবু। বেলুনের মুখটা বেঁধে ফেলতে পারল প্রীতম। একগাল হেসে বেলুনটা লাবুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, হয়নি?

লাবুও ছোট ছোট ইঁদুরের মতো দাঁত দেখিয়ে হাসল।

প্রীতম বলল, সব বেলুন নিয়ে এসো, ফুলিয়ে দিই।

মা জানলে?

জানুক। তুমি আনো তো!

অধৈর্যের গলায় বলে প্রীতম! এক্ষুনি কোনও কাজ নিয়ে তার ব্যস্ত হয়ে পড়াটা দরকার। শরীরের ক্ষিপ্ত জীবাণুরা আফ্রিকার নরখাদকের মতো মৃত্যুনাচ নাচছে।

লাবু চোখের পলকে পাশের ঘর থেকে আঁজলা করা বেলুন নিয়ে এসে প্রীতমের বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে বলে, মা বাইরে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি করো, বাবা।

মেয়ের সঙ্গে একটু বোঝাপড়ার চোখাচোখি হয় প্রীতমের। দু’জনেই একটু হাসে।

একটা বুটিদার হলুদ বেলুন ফুলিয়ে দিয়ে প্রীতম বলে, তোমার মা কোথায় গেছে?

মিষ্টির দোকানে। অর্ডার দেওয়া ছিল, নিয়ে আসতে গেছে। তুমি দেরি কোরো না।

প্রীতম দেরি করে না। যথেষ্ট দম পাচ্ছে সে। বুকভরা অফুরন্ত বাতাস। মুহুর্মুহু ফুয়ে সে বেলুনগুলি ফুলিয়ে তুলছে। আপনমনে হাসছেও সে। এ যেন এক অদ্ভুত জীবনমরণের খেলা।

মা আসছে কি না বারান্দায় গিয়ে দেখি, বাবা?

দেখো। আসতে দেখলেই একটা টু দিয়ে।

আচ্ছা।–বলে লাবু ছুটে ঝুলবারান্দায় চলে যায়।

আজ তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেল লাবুর। কেমন যেন বিশ্বাস হয় না। তিন-তিনটে বছর যেন মাত্র কয়েক মাস বলে মনে হয়।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে এক বিকেলে জগুবাজারে বিলুকে নিয়ে দু’-চারটে জিনিস কিনতে বেরিয়েছিল প্রীতম। বিলুর তখন দশমাস চলছে। যে-কোনওদিনই বাচ্চা হতে পারে। নার্সিং হোম ঠিক করা ছিল। ঘন ঘন চেক-আপ চলছিল।

জগুবাজারে এক মনোহারি দোকানে কেনাকাটা করার সময় বিলু হঠাৎ তার কানে কানে বলল, বাড়ি চলো। আমার শরীর ভাল লাগছে না।

কীরকম লাগছে?

ভাল নয়। চিনচিনে ব্যথা।

প্রীতম এক সেকেন্ডও দেরি করেনি। ট্যাক্সি না পেয়ে টানা-রিকশায় বিলুকে তুলে সোজা চলে গেল ডাক্তার বোসের চেম্বারে। বোস তৈরিই ছিলেন। হেসে বললেন, দেরি আছে। তবু এখনই ভরতি করে দেওয়া ভাল। নইলে বেশি রাত হয়ে গেলে বিপদ হতে পারে।

বাড়ি ফিরে এসে তারা নার্সিং হোমে যাওয়ার জন্য গোছগাছ করতে বসল। কিন্তু নিরেট অনভিজ্ঞতার দরুন কী লাগবে না লাগবে তা না জেনে সুটকেস বোঝাই করছিল শাড়ি আর ব্লাউজ আর কসমেটিকসে! বিলু একটু পরেই হাঁফিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রীতম তখন বেডিং বাঁধছে। পাশের ফ্ল্যাটের মাদ্রাজি পরিবারের এক বুড়ি এসে এখন সহজ বাংলায় বিলুকে বললেন, তুমি এখন কেবল হাঁটাচলা করতে থাকো, একটুও বসবে না। তারপর প্রীতমকে ধমকে বললেন, নার্সিং হোমে বিছানা আছে। তোমাকে বেডিং নিতে কে বলেছে? সুটকেসে পাউডার-ক্রিম-ফাউন্ডেশন দেখে বুড়ি হেসেই খুন। বললেন, নার্সিং হোমে যা লাগে তা হল প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার ন্যাকড়া। যত পারো ছেড়া কাপড় নাও। আর পরবার জন্য দামি শাড়ি কক্ষনও নেবে না, নার্সিং হোমের জমাদারনি, আয়া, ঝি-রা সব নিয়ে নেবে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ বিলু নার্সিং হোমে ভর্তি হয়ে গেল। তখনও ব্যথা-ট্যথা ওঠেনি ভাল করে। একজন সিস্টার প্রীতমকে বললেন, আপনি বাড়ি চলে যান। এখও অনেক দেরি আছে।

মানুষের আত্মীয়স্বজন কাছে না থাকা যে কত মারাত্মক তা সেদিন হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিল। প্রীতম। কেউ কাছে নেই, একটা সান্ত্বনার কথা বলার মতো লোক নেই, আগ বাড়িয়ে সাহায্য করার মতোও কেউ নেই, আছে শুধু পকেটভর্তি টাকা। কিন্তু টাকা দিয়ে কি সব কেনা যায়?

ডাক্তার বোস চিকিৎসক খারাপ নন। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নামও আছে। কিন্তু লোকটা অসম্ভব টাকা চেনে। অফিসের এক কলিগই প্রীতমকে ডাক্তার বোসের কথা প্রথম বলেছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে সে এও বলেছিল, দেখবেন, এ কিন্তু কথায় কথায় সিজারিয়ান করে। সিজারিয়ানে টাকা বেশি তো! আপনি সহজে সিজারিয়ানে রাজি হবেন না।

কিন্তু রাজি হতে হয়ওনি প্রীতমকে। নার্সিং হোমে মাদ্রাজিদের ফ্ল্যাটের ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। সারা রাত জেগে দুশ্চিন্তা ভোগ করে যখন সকালের দিকে একটু ঘুমিয়েছে প্রীতম, তখনই তাকে জাগিয়ে সেই বুড়ি খবর দিয়ে গেলেন, অপারেশন করে বিলুর বাচ্চা বের করতে হবে। অবস্থা ভাল নয়। বিছানা ছেড়ে কোনও রকমে পোশাক পরে প্রায় মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটেছিল প্রীতম।

নার্সিং হোমে গিয়ে গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না প্রীতমের। বিলুকে ও টি-তে নিয়ে গেছে। তার অবস্থা কীরকম তা কেউই বলতে পারছে না।

কতগুলো সময় আসে যখন মানুষের কিছুই করার থাকে না। তখন তাকে অসহায়ভাবে দর্শকের আসনে বসে থাকতে হয়। তার সামনে তখন যা করার তা করে যায় ভাগ্য বা নিয়তি। প্রীতম নার্সিং হোমের লাউঞ্জে বসে রইল স্থির হয়ে! শরীর স্থির, কিন্তু মনের মধ্যে এক ঘূর্ণিঝড়। বিশাল, ব্যাপ্ত প্রচণ্ড এক সর্বনাশের ভয়। তার ওপর সে একা, একদম একা। বোজানো চোখের পাতা ভিজিয়ে জল নেমে এল ফোঁটায় ফোঁটায়, বিলুর মৃত্যু সে সহ্য করতে পারবে না। বিড় বিড় করে সে বলল, ওকে বাঁচিয়ে দাও, বাঁচিয়ে দাও। কাকে বলল কে জানে! এমন সময় ডাক্তার বোস এসে কাঁধে হাত রাখলেন।

বিলু তখন হতচেতন। হাতে ছুঁচ, কবজি বাঁধা। আয়া ন্যাকড়ায় জড়ানো রক্তের দলা বাচ্চাটাকে এনে দেখাল। হতবুদ্ধি প্রীতম তখন কী দেখল, কীই-বা বুঝল, তা আজ আর মনে করতে পারে না। শুধু মনে আছে বিলুর হাতে বেঁধানো সেই স্যালাইনের চুঁচ, ফ্যাকাসে মুখ, মৃত্যুনীল চোখের দুটো পাতা। আর রক্তাভ একটা মাংসের পুঁটলির মতো সদ্যোজাত লাবু। কোনও ভালবাসা, টান, স্নেহ কিছুই বোধ করেনি সেদিন।

কিন্তু তারপর যত দিন গেছে, যত লাবুর চোখ-মুখ স্পষ্ট হয়েছে, যত পাকা হয়ে উঠেছে সে ক্রমে ক্রমে, তত তার দিকে ভেসে গেছে প্রীতম। কিন্তু সে কি তিন বছর? এই তো মোটে সেদিনের কথা!

 

নিজের কৃতিত্বে খুবই তৃপ্ত হল প্রীতম। মোট পনেরোটা বেলুন ফুলিয়েছে সে। তার মধ্যে অন্তত চারটে বিশাল লম্বা, আর চারটে বিশাল গোল। বিছানা উপচে ফোলানো বেলুনগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছিল। গোটা দুই দুমদাম ফেটেও গেল।

ছুটে এসে লাবু অবাক।

ওমা, কত কটা ফুলিয়েছ, বাবা!

প্রীতম গর্বের হাসি হেসে বলে, আরও ফোলাব। তুমি বেলুনগুলো কুড়িয়ে আনো, তোড়া বেঁধে দিই। সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিলে সুন্দর দেখাবে।

কে ঝোলাবে? তুমি?

কে ঝোলাবে সেইটেই প্রশ্ন। প্রীতম একটু গম্ভীর হয়ে যায়। তাদের যে কেউ নেই। সে, বিলু আর লাবু। ব্যস, এইটুকুতেই তারা শেষ।

প্রীতম বলল, কেউ না ঝোলালে আমিই ঝুলিয়ে দেব।

পারবে?

পারব। চেষ্টা করলে পারা যায়।

মা বকবে না?

বকলে বকবে।

লাবু বেলুন কুড়িয়ে নেয়। খুব যত্নের সঙ্গে অতিকায় বেলুনের তোড়া বাঁধতে বসে যায় প্রীতম। হাত-পায়ের প্রবল আড়ষ্টতা, শরীরের দুর্বলতা, কোনওটাকেই গ্রাহ্য করে না। দাঁতে দাঁত চেপে সে মনে মনে বলে, ভাল আছি। ভাল আছি। কিছুই হয়নি আমার।

এবং পারেও প্রীতম। গোড়ায় গোড়ায় বেঁধে বেলুনের একটা সুন্দর তোড়া তৈরি করে ফেলে সে।

ভীষণ অবাক হয়ে যায় লাবু। স্তম্ভিত হয়ে বাবার হাতের এই শিল্পকর্ম দেখে সে। দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে সে বাবার খুব কাছে চলে আসে। এমনকী বাবার ঊরুর ওপর কনুইয়ের ভর রেখে মাথাটা পাঁজরে ঠেকিয়ে বসে লাবু। তারপর বলে, আরও বেলুন আনব, বাবা?

আগে চলো এটা ঝুলিয়ে দিই।

বিন্দুদিকে ডাকি? ডাকো। ওকে বাইরের ঘরে ফ্যানের নীচে একটা চেয়ার দিতে বলো।

ফ্যানের সঙ্গে বাঁধবে?

হ্যাঁ।

দৌড়ে গিয়ে লাবু বিন্দুকে ধরে আনে।

বিন্দু এমনিতে বেশি কথা বলে না। সারাদিনই সে চুপচাপ। কিন্তু এখন থাকতে না পেরে বলল, আপনি টাঙাবেন? একা বাথরুমে যেতে পারেন না আপনি, টাঙাতে গেলে পড়ে যাবেন যে।

পারব। তুমি চেয়ারটা একটু ধরে থেকো।

আমিও ধরব, বাবা।–লাবু বলল।

সবটাই প্রীতমের কাছে লড়াই। সাংঘাতিক এক লড়াই। কোটি কোটি জীবাণুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ।

শোওয়ার ঘর থেকে বসার ঘরের দূরত্ব তার কাছে এখন কয়েক মাইল। বিন্দু বাইরের ঘরে ফ্যানের নীচে একটা কাঠের মজবুত চেয়ার পঁড় করিয়েছে। প্রীতম বিছানা থেকে নেমে তার শুকিয়ে আসা দুই থরোথরো পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই মনে হয়, পারব না।

বিন্দু পরদা সরিয়ে দেখছিল। সেও বলল, পারবেন না।

প্রীতমের পা দুটো এই কথা শুনেই যেন লোহার শিকের মতো শক্ত হয়ে গেল। বাতাসে হাত বাড়িয়ে অভ্যাসবশে একটা অবলম্বন খুঁজল প্রীতম। পেল না।

একটু টলে গেল সে। তারপর আবার সোজা হল। লাবু আর বিন্দুকে অন্যমনস্ক রাখার জন্য সে খুব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, আজ কাদের নেমন্তন্ন করেছ, লাবু?

পাশের ফ্ল্যাটের ঊষারা সবাই। আর সেজোমামা, অরুণমামা, ছোটমামা আরও অনেক আছে, বাবা।

প্রীতম চার-পাঁচ পা এগিয়ে গেল। দরজার চৌকাঠ হাতের নাগালে পেয়ে ধরে ফেলল। বলল, কী কী খাওয়াবে?

মিষ্টি, মাংস, লুচি।

আচ্ছা।–বলে চৌকাঠ পেরিয়ে প্রীতম নিরালম্ব হয়ে আবার কয়েক কদম এগোয়।

পারবে, বাবা?

পারব। ভেবো না।

বিন্দু চেয়ারটা শক্ত করে ধরে। নিচু সিলিঙের আধুনিক ফ্ল্যাট বলে পাখাটাও খুব উঁচুতে নয়। প্রীতম একটু দম নিয়ে ওপরের দিকে চেয়ে স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক করে নিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে চেয়ারে উঠে পড়ল ধীরে ধীরে।

মাথাটা একটু ঘুরছে।

সে বলল, মাংসটা কি বাড়িতেই রান্না হবে?

লাবু বলে, না তো। অরুণমামা বাইরে থেকে মাংস আনবে।

ও। খুব ভাল। আর লুচি?

লুচিও বাইরে থেকে আনা হবে।—এ কথাটা বিন্দু বলল।

ঘরে কিছু হচ্ছে না?

বলতে বলতে প্রীতম চেয়ারের পিঠে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ফ্যানের বাটিটা ধরেও ফেলে সে।

পারবেন তো?—বিন্দু প্রবল উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করে।

খুব পারব। কাজটা মোটেই শক্ত নয়।

বাবা ঠিক পারবে, দেখো। না, বাবা?

হ্যাঁ মা। এবার তোড়াটা আমার হাতে দাও। লাবু তোড়াটা বিন্দুর হাতে দেয়। বিন্দু সেটা তুলে ধরে প্রীতমের নাগালে। বুদ্ধি করে প্রীতম তোড়ার গোড়ায় আলগা সুতো রেখেছে। যাতে বাঁধতে অসুবিধে না হয়।

পা দুটো আবার থরথরিয়ে ওঠে যে। হাঁটু ভেঙে ভেঙে আসছে না? মাথাটা বেভুল চক্কর মারছে।

তুমি কবে থেকে স্কুল যাবে, লাবু?

জানুয়ারি ফার্স্ট উইক।

সুলটা কেমন?

খুব ভাল, বাবা। ইংলিশ মিডিয়াম।

ও।

বলতে বলতে ফ্যানের একটা ব্লেডের সঙ্গে তোড়ার সুতো জড়িয়ে দিতে পারে প্রীতম।

স্কুলে যেতে তোমার ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ-অ্যাঁ!

ভয় করে না। আমার তো ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে খুব ভয় করত।

আমার করে না। স্কুলে কত খেলা, গল্প, হইচই।

তোমাদের স্কুল খুব ভাল। আমার স্কুলটা তো ভাল ছিল না।

কেন, বাবা?

আমরা পড়া না পারলে স্কুলে খুব মারত।

আমার স্কুলে মারধর নেই।

সেইজন্যই তো ভাল।

বলতে বলতে দ্বিতীয় সূতোটা জড়িয়ে দেয় প্রীতম। অবাধ্য পা দুটোর পথবানি সমানে চলছে। মাথাটা অদ্ভুতভাবে ঘুরছে তার। চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে বারবার।

তোমাকে স্কুলে খুব মরত, বাবা?

হ্যাঁ মারত। ৩বে আমার চেয়েও বেশি মার খেত তোমার সেজোমামা। ভীষণ দুষ্টু ছিল।

ছি ছি। সেজামামা কাঁদত না?

বেলুনের তোড়া খুবই সুন্দরভাবে সিলিং ফ্যানটাকে ঢেকে ফেলেছে! প্রীতম পারল। ধোঁয়াটে চোখে নিজের এই তাসম্ভব দুর্দান্ত কীর্তিটি দেখে একটা বিরাট শ্বাস ছাড়ল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটা হঠাৎ কাচের পুতুলের মতো ভেঙে পড়ল তার।

কী হল তা বুঝতেও পারল না প্রীতম। টেব পেল চেয়ারটা টাল খেয়ে তাকে নিয়ে পড়ে যাচ্ছে। ঘরের চারটে দেয়াল চোখের ওপর পর পর ঘুরে গেল। তারপর দেখল ঘরের মেঝেটা একশো মাইল বেগে ছুটে আসছে তার দিকে।

আতঙ্কে চিৎকাপ করছে বিন্দু তার লাবু। নিরালম্ব দুই হাতে বাতাস আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে পড়ে গেল প্রীতম। হাড্ডিসার শরীব কঠিন শানের ওপর পড়ে ঝনৎকার তুলল।

নীলাভ এক অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ ড়ুব রইল সে। চেতনা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত নয়। সে টির পাচ্ছিল, বহু দূরে কারা যেন কথা বলছে। কেউ কি কাঁদল? কিন্তু সেসব তাকে স্পর্শ করছে না। এক অপরূপ লীলাভ অন্ধকারের মধ্যে অগাধ সাঁতার দেয় প্রীতম। ভারী ঠান্ডা, বড় মোলায়েম ভীণ সুদ এই তান্ধকার। কোনও শব্দ নেই। শুধু বিস্তার আছে। সীমাহীন অগাধ অফুরান আকাশের মতো।

আস্তে আস্তে অন্ধকার থেকে আলোয় চোখ মেলল সে। এত আলো যে চোখে ধাধা লেগে যায়। চালদিকটা প্রবলভাবে তার্থহীন। একটা ঘর, আসবাব, কয়েকটা মুখ। কানও মানে নেই এর। এরা কারা, এসব কী, এ জায়গাটা কোথায়?

কিছুক্ষণ এরকম পন্দের মধ্যে কাটাবার পর পরিপূর্ণ চেতনায় ফিরে এল প্রীতম।

লাবু বিছানার কাছেই ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। বিন্দু চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। বিলু হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বুকে। কিন্তু প্রীতম টের পায়, তার শরীরে জীবাণুদের কোলাহল থেমে গেছে। কাছেপিঠে ওত পেতে থাকা মৃত্যুভয়ের বাঘটার গায়ের গন্ধও পাচ্ছে না সে। ভাল হতেই তার সমস্ত মনপ্রাণ ছুটে গেল লাবুর দিকে।

বিলুর দিকে চেয়ে প্রীতম বলল, লাবুকে মারোনি তো? ওর কিন্তু কোনও দোষ নেই।

বিলু প্রীতমের চোখ থেকে অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, একটা থাপ্পড় দিয়েছি। একটু বাইরে যেতে না যেতেই এসব কী কাণ্ড বাঁধালে তোমরা বলো তো? পাগল হয়ে গেছ নাকি সবাই?

প্রীতম মৃদু স্বরে বলে, লাবুর দোষ নেই। ওকে কেন মারলে?

তবে দোষটা কার? বেলুন বেলুন করে এতক্ষণ ও-ই সকলের মাথা গরম করে তুলেছিল।

ও আমাকে বেলুন ঝোলাতে বলেনি। আমি নিজে থেকেই যা কিছু করেছি।

কিন্তু কেন করতে গেলে? এসব বাহাদুরি কাকে দেখাচ্ছিলে?

লাবুর জন্মদিনে আমারও তো কিছু করতে ইচ্ছে হয়।

আমিই তো বেলুন সাজাতে পারতাম।

আমিও তো পেরেছি।

পেরেছ ঠিকই। কিন্তু পড়ে গিয়ে হাড়গোড ভেঙেছে কি না কিংবা আর কিছু হয়েছে কি না। বুঝতে এখন ডাক্তার ডাকতে হবে।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, দরকার নেই।

তুমি চুপ করে থাকে। দরকার আছে কি না আমি বুঝব।

না, প্লিজ ডেকো না। আজকে আনন্দের দিনে ডাক্তার এলে সব মাটি হয়ে যাবে।

এখন তো আর কিছু করাব নেই। ডাক্তাবকে ফোন করে দিয়েছি। এক্ষুনি চলে আসবে।

আবার ফোন করো। আসতে বারণ করে দাও। আমার কিছুই হয়নি।

হয়নি কী করে বুঝব?

হঠাৎ প্রবল চেষ্টায় উঠে বসে প্রীতম, এই দেখো, উঠেছি। এই দেখো হাত, এই দেখে পা। বুকে হাত দাও। দেখো, হাট ঠিক ঠিক চলছে। দাও না হাত।

বিলু তবু সন্দিহান চোখে চায়। কিন্তু প্রীতমের মুখ-চোখে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। তবু সে বলে, তা হলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে কেন?

ওটা পড়ার ইমপ্যাকটে। সকলেরই হয়। এখন যাও ডাক্তারকে আসতে বারণ করে দিয়ে এসো।

বলতে বলতে প্রীতম বিলুকে বিছানা থেকে প্রায় ঠেলে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

বিলু বলে, আচ্ছা, আচ্ছা, যাচ্ছি।

বিলু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে প্রীতম মেয়ের দিকে চেয়ে একটু বুঝদারের হাসি হাসে। লাবুর কান্না থেমেছে। কিন্তু চোখভরা জল নিয়ে সে ফোঁপাচ্ছিল। বাবার দিকে চেয়ে সেই ফোঁপানি আর চোখের জল নিয়েই গাল ভরে হাসল।

প্রীতম জরুরি গলায় বলে, রঙিন কাগজ নেই? না থাকলে বিন্দু দোকান থেকে নিয়ে আসুক। দরজায় কাগজের শিকলি না টাঙালে কি ভাল লাগে?

লাবু হি-হি করে হাসতে থাকে আনন্দে। হাততালি দেয়।

অগত্যা দোকান থেকে রঙিন কাগজ নিয়ে আসে বিন্দু। কাঁচি আর আঠার শিশি নিয়ে বিছানায় শিকলি বানাতে বসে যায় প্রীতম। লাবু মাছির মতো লেগে আছে গায়ের সঙ্গে। বিলু দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু খুব থমথমে দেখাচ্ছিল তাবে।

বিলু বুঝবে না, এ শুধু লাবুর নয়, প্রীতমেরও জন্মদিন। বিলু কেন, পৃথিবীর কেউই কোনওদিন বাইরে থেকে টের পাবে না, প্রীতমের ভিতরে এক ধুন্ধুমার কুরুক্ষেত্রে চলছে কৌরব আর পাণ্ডবের লড়াই। আজ সেই লড়াইতে অনেকখানি হারানো জমি দখল করে নিয়েছে প্রীতম। লাবুর সঙ্গে তাই আজ তারও জন্মদিন।

প্রীতমের শিকলি তৈরির অভ্যাস ছিল ছেলেবেলায়। সরস্বতী পূজোর প্যান্ডেল সে বড় কম সাজায়নি আবার সেই উত্তাপ ফিরে এল আজ। অল্প সময়ের মধ্যেই সে মস্ত মস্ত শিকলি বানিয়ে ফেলে। ঘরদোর সাজাতে সাজাতে এসে বিলুও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে দেখছে। কিছু বলছে না, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে অবাক হওয়ার ভাবটা স্পষ্টই ফুটে উঠেছে। একবার মুখ ফুটে বলেই ফেলল,

আমি তো ভেবেছিলাম তোমার অসুখ বলে এবার লাবুর জন্মদিনটা নমো-নমো করে সারব।

প্রীতম একটু বিবর্ণ হয়ে বলে, আমার অসুখ! না, আমার তো অসুখ নেই। আমি ভাল আছি। শোনো বিলু, লাবুর জন্মদিনে কেবল দোকানের খাবার দিয়ে অতিথিদের বিদেয় করাটা কি ভাল?

তবে কী করব? আমার তো খাবার তৈরি করার সময় নেই।

বেশি নয়, অন্তত একটা কোনও আইটেমে এই ঘরের কীর হাতের ছোঁয়া থাকা ভাল।

বিলু একটা ক্লিষ্ট শ্বাস ফেলে বলে, এখন তো সময়ও নেই। তবু হুকুম করো, করব।

প্রীতম হেসে ফেলে। বলে, দুঃখের সঙ্গে নয়, আনন্দের সঙ্গে যদি করতে পারো তা হলে বলি।

বিলু ক্ষীণ একটু হাসল, ঠিক আছে। আনন্দের সঙ্গেই করব না হয়।

বলছিলাম কী, লুচির সঙ্গে একটু বেগুন ভেজে দাও। অতিথির সংখ্যা তো খুব বেশি নয়। পারবে না?

পারব।

ভারী তৃপ্ত হল প্রীতম। গভীর শ্বাস ছাড়ল একটা। মনে মনে বলল, আজ আমারও জন্মদিন! আমারও জন্মদিন! ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীরে ঝিমুনি এল। বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল প্রীতম।

 

যখন আবার চোখ মেলল তখন বাইরের ঘরের দরজায় রঙিন শিকলি ঝুলছে, ঘরের এ-কোণ ও-কোণ জোড়া রঙিন কাগজের ফেস্টুন, বেলুনের তোড়া থেকে বহুরঙা আনন্দ ঝরে পড়ছে। বাইরের ঘর গম গম করছে অতিথিদের কলরোলে।

এসো সেজদা।–বলে বিছানায় উঠে বসল প্রীতম। দীপ ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বিছানার কাছে বসল।

কেমন আছিস, প্রীতম?

ফাইটিং। জোর লড়াই দিচ্ছি সেজদা।

তোকে একটু ব্রাইট দেখাচ্ছে।

ভিতরেও খুব ব্রাইটনেস ফিল করছি।

খুব ভাল। খুব ভাল। তোর কোনওদিন খারাপ কিছু ঘটতেই পারে না। তুই বড় ভাল যে।

প্রীতম লজ্জায় লাল হয়ে বলে, বহুকাল আসোনি, সেজদা। ব্যস্ত ছিলে?

ব্যস্ত? তা বলা যায়। আসলে একটা হুইমজিক্যাল লোকের খিদমত করতে হয় তো। মাঝখানে দুম করে আমেদাবাদ, বোম্বে আর হায়দ্রাবাদ ঘুরে আসতে হল বাসের সঙ্গে।

বেশ চাকরি তোমার, সেজদা। খুব টুর পাও!

দীপনাথ বিষণ্ণ হেসে মাথা নেড়ে বলল, টুর পাওয়াটা তখনই ভাল লাগে যখন দুশ্চিন্তা থাকে।

তোমার আবার দুশ্চিন্তা কী? বিয়ে করোনি, দায়দায়িত্ব নেই। ঝাড়া হাত-পা।

অনেক উঞ্ছবৃত্তি করতে হয় রে, প্রীতম। তুই বুঝবি না।

প্লেট হাতে বিলু খুব ব্যস্তভাবে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ঘুম ভাঙল কখন?

এইমাত্র।—প্রীতম হাসিমুখে বলে, বেগুনভাজা কি করেছ, বিলু?

করিনি আবার! কতার হুকুম, না করে উপায় আছে? তোমাকে এবার কিছু খেতে দিই। অনেকক্ষণ খাওনি।

দাও।—খুব আগ্রহের সঙ্গে বলে প্রীতম, সব আইটেম দিয়ে।

বিলু চোখ কপালে তোলে, সব আইটেম মানে? তোমার জন্য স্টু করা আছে, পাউরুটি টোস্ট করে দিচ্ছি।

প্রীতম প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলে, না, না। আমি লাবুর জন্মদিনের নেমন্তন্ন খাব।

বিলু হাসে, তাই কি হয়? ওসব দোকানের জিনিস। তুমি রুগি মানুষ, সইবে কেন?

ফের বিবর্ণ হয়ে যায় প্রীতম, কে বলল আমি রুগি? তাহলে বেলুন টাঙাল কে? শিকলি বানাল কে?

ওঃ! তাই তো! আমার ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছিল।

যেভাবে লাবুকে মাঝে মাঝে ভোলায় ঠিক সেইভাবে প্রীতমকে ভুলিয়ে বিলু বলল, আচ্ছা, তাহলে অল্প করে দেব।

বলে বিলু চলে যায়।

বিলুর যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে দীপ মাথা নেড়ে বলে, বিলুকেও আজ একটু ব্রাইট দেখাচ্ছে।

শুধু তোমাকেই দেখাচ্ছে না, সেজদা।

গোটা দুনিয়াটারই ব্রাইটনেস কমে যাচ্ছে রে প্রীতম, আমি কোন ছাড়!

আমার কাছে পৃথিবীর ব্রাইটনেস একটুও কমছে না, বরং বাড়ছে। দিনে দিনে বাড়ছে। বেঁচে থাকাটাই যে কী ভীষণ আনন্দের তা লোকে বোঝে না কেন বলল তো!

দীপনাথ একটু চুপ করে বসে মিটিমিটি হাসে। তারপর আচমকা বলে, আজকাল যেন বিলুর সঙ্গে তোর একটু বেশি ভাবসাব হয়েছে রে, প্রীতম!

যাঃ, কী যে বলো! আমাদের ভাব আবার কবে ছিল না?

সে ছিল ঠান্ডা ভাব। এখন যেন সম্পর্কটা ফ্রিজ থেকে বের করে উনুনে চড়ানো হয়েছে। বেশ হাতে-গরম!

খুব হাসে প্রীতম। রান্নাঘরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে উঁচু গলায় বলে, বিলু! বিলু! শুনে যাও সেজদা কী বলছে।

 ২০. হাসিমুখে, স্নিগ্ধ মনে

হাসিমুখে, স্নিগ্ধ মনে কিছুক্ষণ দীপনাথের দিকে চেয়ে থাকে প্রীতম। বাইরের ঘরে কোনও বাচ্চা বুঝি কচি গলায় ইংরিজি গান গাইছে। বেশ সাহেবি উচ্চারণ। সঙ্গে বোঙ্গো আর মাউথ-অর্গান। মন দিয়ে শোনে প্রীতম। তারপর বলে, ও ঘরে কী হচ্ছে তা আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

দীপনাথ জিজ্ঞেস করল, যাবি?

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, না। থাকগে।

দীপনাথ বলে, নতুন কিছু হচ্ছে না। সেই কেক কাটা, মোমবাতি নেভানো, সাহেবরা যা সব করত আর কী।

বলে একটু হাসে দীপ।

প্রীতমও হাসে। বলে, সাহেবরা দেশ ছেড়ে গেলেও সাহেবদের ভূত তো আর আমাদের ছেড়ে যায়নি সেজদা। আমার জন্মদিনে মা পুজো দিত, পায়েস রাঁধত। আজও তাই করে শুনেছি, আমি কাছে না থাকলেও করে।

থাকগে। তুই এ নিয়ে বিলুকে কিছু বলতে যাস না। তোদের সম্পর্কটা একটু ভাল যাচ্ছে দেখছি। সেটা যেন বজায় থাকে।

ও নিয়ে ভেবো না। আমি কখনও ঝগড়া করি না। তাছাড়া, বিলু যা করে আনন্দ পায় তাই করুক।

বলে প্রীতম ছাদের দিকে চেয়ে একরকম উদাস অভিমান মুখ করে শুয়ে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, তোমার কথা বলো সেজদা, শুনি।

আমার আর কী কথা! নাথিং নিউ।

আমি তোমার কথা মাঝে মাঝেই ভাবি। মনে হয়, তোমার সত্যিই আরও ওপরে ওঠার কথা ছিল। এতদিনে একটা বেশ হোমরাচোমড়া হতে পারতে তুমি। একজন সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করতে পারতো কিছুই করলে না। কেমন যেন উদাস হয়ে যাচ্ছে।

দীপ হাসছিল মৃদু-মৃদু। বলল, দুনিয়াটা যে সস্তা নয় তা কি নিজে এতদিনেও বুঝিসনি প্রীতম?

দুনিয়া সস্তা নয় জানি। কিন্তু তোমার যে ভীষণ রোখ ছিল। স্কুলে তুমি কত ভাল ছাত্র ছিলে। বিলু খুব দ্রুত পায়ে এসে প্রীতমের বিছানায় একটা প্লাস্টিক ফেলে তার ওপর চিনেমাটির বড় প্লেট রেখে বলল, লাগলে বোলো, বিন্দু দেবে।

বলেই বাইরের ঘরের দিকে চলে গেল বিলু। ওই ঘর থেকে হট্টগোল আর গানবাজনার শব্দ আসছিল কিছুক্ষণ ধরে। বিলু সাবধানে মাঝখানের দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

প্রীতম প্লেটের দিকে তাকাল, কিন্তু নড়ল না।

খা।—দীপনাথ সস্নেহে বলে।

ইচ্ছে করছে না।

এই তো বলছিলি খিদে পেয়েছে।

এইমাত্র খিদেটা চলে গেল।

দীপনাথ মৃদু হেসে বলে, আসলে বোধ হয় কিছু একটা ভেবে তোর মনটা খারাপ হয়েছে।

প্রীতম ক্লিষ্ট একটু হাসে। বলে, তোমার মতো এত ভাল করে আমাকে কেউ চেনে না মেজদা। তুমি খুব সহজেই আমাকে বুঝতে পারো। কী করে পারো বলো তো!

দূর পাগলা!—দীপনাথ উদাস মুখ করে বলে, আসলে তোকে ছেলেবেলা থেকেই দেখছি তো!

তাই হবে।বলে প্রীতম আবার ছাদের দিকে চেয়ে থাকে। বলে, তোমার কথা ভেবেই আমার মনটা খারাপ লাগছে সেজদা। তোমাকে এত আনসাকসেসফুল দেখব বলে কোনওদিন ভাবিনি।

তবে তুই কী ভেবেছিলি? এয়ারকন্ডিশনড চেম্বার? চার হাজার টাকা মাইনে? ফ্লুয়েন্ট ইংরিজি বলিয়ে বাঙালি-মেম বউ নিয়ে পার্টিতে যাওয়া?

প্রীতম উদাস গলায় বলে, হলেই বা দোষ কী ছিল?

দোষ কিছু নয়। তবে সেরকম হলে এই যেমন তোর কাছটিতে এসে বসে আছি এরকম বসতে পারতাম না। বাইরের ঘর থেকেই হয়তো বিদায় নিতাম। নয়তো লাবুর জন্মদিনে আসতামই না। হয়তো লাবুর জন্মদিনের চেয়েও ইমপর্ট্যান্ট কোনও পার্টি থাকত।

তাও মেনে নিতে রাজি আছি সেজদা। আমার কাছে এসে তোমাকে বসতে হবে না, লাবুর জন্মদিনের কথাও না হয় ভুলে গেলে, তবু সাকসেসফুল হও।

এসব কথায় ঠিক হাসি আসে না দীপনাথের। একটু বিষঃ স্বরে সে বলে, তুই আমাকে খামোখা হিরো বানাচ্ছিস। এর চেয়ে বড় কিছু হওয়ার যোগ্যতাই আমার ছিল না। আমি এই বেশ আছি। আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তাই কমপিটিশনও নেই কারও সঙ্গে, আর তাই অযথা উদ্বেগ নেই, অশান্তি নেই। এই একরকম কেটে যাচ্ছে তো।

প্রীতম দীপনাথের মুখের দিকে চেযে বুঝল, প্রসঙ্গটা আর বানানো ঠিক হবে না। দীপনাথ সত্যিকারের অস্বস্তি বোধ করছে। সে আবার ছাদের দিকে চেয়ে রইল। তারপর যেন দীপনাথের নয়, খুব দুরের কাউকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার মনে আছে সেজদা, একবার আমার দশ বারো বছর বয়সের সময় তুমি আমাকে হাকিমপাড়ার রাস্তায় খুব মেরেছিলে?

দীপনাথ প্রথমে জবাব দিল না। স্থির হয়ে বসে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, হুঁ, তখন তো ছেলেমানুষ ছিলাম।

আমি জানি সেজদা, সে কথা ভাবলে তুমি আজও দুঃখ পাবে। কিন্তু মজা কী জানো?

কী?

মজা হল, তুমি আমাকে মেরে মস্ত এক উপকার করেছিলে। বোধ হয় মার্বেলের জেত্তাল নিয়ে তোমার সঙ্গে ঝগড়া লাগে। তারপর তুমি আমাকে হঠাৎ দুমদাম প্রচণ্ড মারতে শুরু করে দিলে। আশ্চর্য এই যে, তার আগে বা পরে জীবনে আমি কারও হাতে মার খাইনি। স্কুলে নিরীহ ভাল ছেলে, বাড়িতে চুড়ান্ত আদরে, বড় হয়ে ল-অবাইডিং সিটিজেন, তাই আমাকে কেউ কখনও মারধর করার স্কোপ পায়নি। একমাত্র তুমি মেরেছিলে। জীবনে ওই একবারই আমি মার খাই।

দীপনাথ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, সে কথা ভাবলে আজও আমার খারাপ লাগে। তুই-ই বা কেন ওসব ভাবিস? কোন ছেলেবেলার কথা!

প্রীতম হাত তুলে দীপনাথকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ভাবলে আমার দুঃখ হয় না। বরং খুব আনন্দ পাই। ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না। সেই বয়সে তুমি পাড়ায় পাড়ায় মারপিট করে বেড়াতে, ওসব। ছিল তোমার জলভাত। আমার কাছে তো তা ছিল না। কেউ আমাকে ঘুসি চড় লাথি মারবে, ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেবে এমন ঘটনা কল্পনাও করতে পারতাম না কোনওদিন। আমার গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগেনি তখনও। তুমি যখন মারলে তখন ভয় বা ব্যথার চেয়েও বেশি হয়েছিল বিস্ময়। একজন আমাকে মারছে! ভীষণ মরছে! বীভৎস রকমের মারছে! আমি মার খাচ্ছি! আমার নাক আর দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমি নোংরা ড্রেনের মধ্যে পড়ে আছি! এইসব ভেবে আমি ভীষণ ভীষণ অবাক হয়ে গেছি তখন। আর চোখের সামনে চেনা পৃথিবীটাই তখন হঠাৎ বদলে যাচ্ছে। ঠিক সেন পুনর্জন্মের মতো একটা ব্যাপার! মার খেয়ে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছিলাম। সবাই তাই দেখে হেসেছিল। অপমানে তখন মাথা পাগল-পাগল। পারলে তোমাকে তখন খুন করি। কিন্তু কী হল জানো? অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসে গেল আমার মধ্যে। তুমি জানো না, বড়সড় বসেও মাঝে মধ্যে আমি রাতে ঘুমের মধ্যে বিছানায় পেচ্ছাপ করে ফেলতাম। তোমার হাতে মার খাওয়ার পরই সেই বদ অভ্যাস। একদম চলে গেল। সেই সঙ্গে আমার যে সাংঘাতিক ভূতের ভয় ছিল সেটা অর্ধেকের বেশি কমে এল। খেতে শুতে, জামা-জুতো পরতে আমি সবসময়ে মা বা দিদিদের ওপর নির্ভর করতাম। সেই থেকে সেই নির্ভরশীলতা আর একদম রইল না। মনে মনে ভাবতাম, যে রাস্তার ছেলের হাতে মার খায় তার বাড়ির আদর খাওয়া মানায় না। তার ভূতের ভয় হলেও চলে না। এইভাবে নিজের ওপর ধপত্য এল। তোমার ওপর শোধ নেব বলে আমি একটা ব্যায়ামাগারে ভরতি হয়ে বহুদিন ব্যায়াম-ট্যায়াম করে মাসলও ফুলিয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে তোমার সঙ্গে আমার খুব গভীর ভাব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মার খাওয়াটা কোনওদিন ভুলিনি। আজ যে আমি একটা অসুখের সঙ্গে লড়াই করতে পারছি তা কী করে পারছি জানো? তোমার সেই মারের জন্য। তোমার হাতেব মার আজও আমাকে চাবকে চালায়। বাইরের ঘরে যে বেলুনের থোপা ঝুলছে, দরজায় যে রঙিন কাগজের শিকলি তা আজ আমি নিজে তৈরি করলাম। সেই যে তুমি আমাকে দুনিয়ার সব বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার করে লড়াই করার দম দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলে, সেই দমে আমি আজও বহাল আছি সেজদা। নইলে কবে রোগের কথা ভেবে ভেবে শুকিয়ে মরে থাকতাম।

দীপনাথ ম্লান হেসে বলল, কোনওদিন তো বলিসনি এসব!

আজ মনে হল তাই বললাম।

দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বুঝলাম। কিন্তু এখন তোর বেলুন-টেলুন ফোলাতে যাওয়া উচিত নয়। বিলু আমাকে বলছিল, তুই নাকি কিছু মানতে চাস না। চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলি নাকি আজ!

খুব অকপটে বাচ্চা ছেলের মতো হাসে প্রীতম। বলে, ও কিছু নয়। ব্যালান্সটা রাখতে পারিনি।

একটু সাবধান হওয়া ভাল। বেশি বাড়াবাড়ি না-ই করলি।

প্রীতম করুণ মুখ করে বলে, কিন্তু আমি যে ভাল আছি সেজদা। খুব ভাল আছি।

তাই থাকিস।

কিন্তু তুমি কেন ভাল নেই?

আমি!—অবাক হয়ে দীপনাথ বলে, আমি কি খারাপ আছি? বেশ আছি তো! ভালই আছি। তোমার মুখ দেখে তা মনে হয় না। দীপনাথ বেখেয়ালে নিজের গালে হাত বোলাল, তারপর খুব বোকার মতো একটু হাসল। বলল, কেন? আজ তো দাড়িটাড়ি কামিয়ে এসেছি। মুখ দেখে খারাপ লাগার কথা তো নয়।

ইয়ারকি মেরো না সেজদা। মনে রেখো, রোগে ভুগলে মানুষের অনুভূতি ভীষণ বেড়ে যায়। তুমি স্নো পাউডার মেখে এসে হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ করতে থাকলেও আমি ঠিক বুঝতে পারতাম যে, তুমি আসলে ভাল নেই।

তখন থেকে কেন যে তুই কেবল টিকটিক করছিস! এমন পিছনে লাগলে আর ঘন ঘন আসব না দেখিস, বহুদিন বাদে বাদে আসব।

প্রীতম একটু অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল, তারপর একেবারে আপাদমস্তক দীপনাথকে চমকে দিয়ে প্রশ্ন করল, তুমি কারও প্রেমে-টেমে পড়োনি তো?

এত চমকে গিয়েছিল দীপনাথ যে, বুকটা ধুকধুক করে উঠল ভীষণভাবে। আর ঠিক সেই সময়ে বাইরের ঘরের ভেজানো দরজাটা কে যেন খুলে ধরল। উন্মুক্ত বোঙ্গো, ব্যানজো আর মাউথঅর্গানের সঙ্গে মার্কিনি গানের দুর্দান্ত শব্দ এসে তছনছ করতে লাগল ঘর। দীপনাথ কোনওকালেই ভাল অভিনেতা নয়। তার ধারণা, সে যা ভাবছে তা আশেপাশের সবাই টের পেয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত কোনও গোপন কথাই ঠিকমতো গোপন করতে পারেনি দীপনাথ।

বাইরের ঘরের দরজা ভেজিয়ে বিলু রান্নাঘরের দিকে চলে যাওয়ার পর দীপনাথ মৃদু স্বরে বলল, দূর দুর!

প্রীতম কথাটা বিশ্বাস করল না। কিন্তু তেমনি অদ্ভুত গোয়েন্দার মতো দৃষ্টিতে চেয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল দীপনাথকে। বাস্তবিক তার অনুভূতি আজকাল প্রখর থেকে প্রখরতর হয়েছে। এমনকী সে আজকাল বাতাসে অশরীরীদেরও বুঝি টের পায়। দীপনাথের চোখে মুখে সে আজ একটা হালকা ছায়া দেখতে পাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি বড় চঞ্চল, চোখে চোখ রাখতে চাইছে না। প্রীতম আজকাল উকিলের মতো সওয়াল করতে পারে। তাই সে সহজ সরল পথে গেল না। বলল, তোমার কি আজকাল বকুলের কথা খুব মনে পড়ে?

বকুলের কথা!—একটু যেন অবাক হয় দীপনাথ। বকুলের কথা একসময়ে ভুলে যাওয়া শক্ত ছিল বটে। কিন্তু এখন তো একদম মনে পড়ে না। সে মাথা নেড়ে বলল, কী যে বলিস পাগলের মতো। কোন ছেলেবেলার কথা সব! কবে ভুলে গেছি।

একটুও মনে নেই?

তা মনে থাকবে না কেন? মনে করতে চাইলে মনে পড়ে। এমনিতে পড়ে না।

বকুল কিন্তু দেখতে ভারী সুন্দর ছিল। একদম রবি ঠাকুরের কোনও উপন্যাসের নায়িকার মতো।

দীপনাথ ম্লান হাসল। বলল, তা হবে। তোর মতো চোখ তো সকলের নেই। আমার অত সুন্দর লাগত না।

তবে ওর সঙ্গে ঝুলেছিলে কেন?

তা সে বয়সে কি আর বাছাবাছি থাকে!

তোমার আর সব ভাল, কিন্তু বরাবরই তুমি একটু চরিত্রহীন ছিলে কিন্তু সেজদা।

বহুক্ষণ বাদে হঠাৎ খুব হোঃ হোঃ করে হাসে দীপনাথ। বলে, চরিত্রহীন। বলিস কী?

একটু ছিলে। হাসলে কী হবে, আমি তো জানি।

কী জানিস?

সাইকেল নিয়ে বাবুপাড়ায় একসময়ে শীলাদের বাড়ির কাছে টহল মারতে। তারপর নজর দিলে রেল-কোয়ার্টারের লাবণ্যর ওপর। তোমাকে সবচেয়ে জব্দ করেছিল কলেজপাড়ার বকুল।

স্মিত হাসছিল দীপনাথ। একটা শ্বাস ফেলল।

প্রীতম বলল, অবশ্য জব্দ করতে গিয়ে বকুল নিজেই জব্দ হয়ে গেল শেষ অবধি।

পাশের ঘরে উৎসব চলছে। এই ঘরে দু’জন মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে আস্তে আস্তে ফিরে যাচ্ছিল উজানে।

বকুলকে কে যেন শিখিয়েছিল, ছেলেদের সঙ্গে মিশতে নেই। তার বিষণ্ণ, গম্ভীর, সুন্দর মুখে সবসময়ে একটা অদৃশ্য নোটিশ ঝুলত : আমার দিকে কেউ তাকাবে না, একদম তাকাবে না, খবরদার তাকাবে না।

বকুল নিজেও বোধহয় কোনও ছেলের দিকে তাকায়নি কোনওদিন।

বকুল এমনিতে বাড়ি থেকে বেরোত না কখনও। তবু স্কুলের পথে বা এ বাড়ি ও বাড়ি কখনও যেতে হলে ছেলেরা তো টিটকিরি দিতে ছাড়ত না। কিন্তু বকুল উদাস অহংকারে রানির মতো হেঁটে চলে যেত। যখন কলেজে ভরতি হল তখন কো-এড়ুকেশনেও তাকে কাবু করতে পারেনি। দীপনাথ তখন কলেজের শেষ ক্লাসে। সে বকুলের হাবভাব দেখে বলত, হাতি চলে বাজারে, কুত্তা ভুখে হাজারে।

দীপনাথ বকুলের প্রেমে পড়েছিল কি না তাতে সন্দেহ আছে। তখন সে ছিল শিলিগুড়ির চালু মস্তান টাইপের ছেলে। দল পাকাত, ইউনিয়ন করত, মেয়েছেলে নিয়ে দেয়ালা করার সময় পেত না।

তবু বকুলকে নজরে পড়েছিল দীপনাথের। ভারী সুন্দরী, ভীষণ শান্ত, অদ্ভুত অহংকারী। কাউকে পাত্তা দিত না। কারও দিকে তাকাত না। এমনকী পাছে তার দিকে কেউ তাকায় সেই ভয়েই বোধ হয় ভাল করে সাজগোজও করত না সে। অত্যন্ত সাদামাটা শাড়ি পরে আসত, মুখে কোনও রূপটান মাখত না, আঁচল জড়িয়ে শরীরটাকে খুব ভাল করে মমির মতো ঢেকে রাখত। নজর থাকত সবসময়েই মাটির দিকে। সাহস করে দু-চারজন ফাজিল ছেলে তার সঙ্গে নানা ছুতোয় কথা বলার চেষ্টা করেছে, বকুল জবাব দেয়নি।

এই বকুলের সঙ্গে দীপনাথের সেবার লেগে গেল হঠাৎ। ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে কোনও মেয়ের সঙ্গে প্লাস চিহ্ন দিয়ে কোনও ছেলের নাম লেখাটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। সর্বত্রই হয়ে থাকে। বকুলের নামও বহুবার ব্ল্যাকবোর্ডে কেউ কোনও ছেলের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লিখেছে। একদিন সংস্কৃত ক্লাসে প্রফেসর এসে দেখলেন গোটা গোটা অক্ষরে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা : বকুল, তোমাকে আমি ভালবাসি—দীপনাথ চট্টোপাধ্যায়। লেখাটা ডাস্টার দিয়ে মুছবার আগে রসিক অধ্যাপক একটা ছোট রসিকতা করেছিলেন। লেখাটার জন্য বকুল হয়তো কিছু মনে করত না, কিন্তু রসিকতাটার জন্যই বোধ হয় হঠাৎ ফুঁসে উঠেছিল মনে মনে।

পরদিন ঘটনাটা আর-একটু গড়ায়। বকুল দীপনাথের লেখা একটা কুৎসিত প্রেমপত্র পায়। সেই চিঠিতে আদিরসের ছড়াছড়ি। বকুল এমনিতেও বোধ হয় কিছু প্রেমপত্র পেত। সেগুলোকে পাত্তা দিত না। এই চিঠিটাকে একটু বেশি পাত্তা দিল।

সেদিন সোজা প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে চিঠিটা তাঁর হাতে দিয়ে ভীষণভাবে কেঁদে ফেলল বকুল, দেখুন স্যার, কীসব লিখেছে।

প্রিন্সিপ্যাল অপ্রস্তুতের একশেষ। চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখলেন। তারপর ডেকে পাঠালেন দীপনাথকে।

ইউনিয়নের পান্ডা হিসেবে দীপনাথকে ভাল করেই চিনতেন তিনি এবং অপছন্দও করতেন।

দীপনাথ এলে জিজ্ঞেস করলেন, এই চিঠি তোমার লেখা?

দীপনাথ চিঠিটা পড়ল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল পলকে। এ চিঠি সে লেখেনি। তার রুচিবোধ কখনও অত নীচে নামতে পারে না। তবু হাতের লেখাটা তার চেনা-চেনা ঠেকেছিল বলে চিঠিটা পকেটে রেখে সে অকপটে বলল, না। কিন্তু কে লিখেছে তা খুঁজে বের করতে পারব।

বলে সে বকুলের দিকে ইঙ্গিত করে প্রিন্সিপ্যালকে বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এই মহিলার প্রতি আমার কোনও দুর্বলতা নেই।

এই কথাটা দীপনাথ তেমন কিছু ভেবে বলেনি, শুধু আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া। প্রকৃতপক্ষেও বকুলের প্রতি তার কোনও দুর্বলতা তো ছিলও না। মেয়েটিকে সে আর পাঁচজনের মতোই সুন্দরী বলে লক্ষ করেছিল মাত্র। তার বেশি কিছু নয়।

কিন্তু শান্ত, শামুক স্বভাবের লাজুক ও অহংকারী বকুল কথাটার মধ্যে কেন সাংঘাতিক অপমান খুঁজে পেল সেই জানে। হঠাৎ সে দিশাহারার মতো দাঁড়িয়ে তা স্বরে বলল, মিথ্যে কথা। আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।

দীপনাথ অবাক হয়ে বলল, কোনটা মিথ্যে কথা?

এ চিঠি আপনার লেখা। কাল ব্ল্যাকবোর্ডেও আপনি যা-তা লিখে রেখেছিলেন। আপনি অনেকদিন আমার পিছু নিয়েছেন। আপনি মিথ্যেবাদী, স্কাউন্ড্রেল :

বলতে বলতে রাগে বুদ্ধিবিভ্রমে, আক্রোশে বকুল হঠাৎ নিজের পায়ের চটি খুলে ছুড়ে মারল দীপনাথের দিকে।

দীপনাথের কপাল খারাপ। চটিটা এদিক-ওদিক না গিয়ে সোজা এসে লাগল তার কপালে।

প্রিন্সিপ্যালের চোখের সামনে এই ঘটনা।

দীপনাথ তেমন কিছু বলেনি। পকেট থেকে চিঠিটা বের করে প্রিন্সিপ্যালকে ফেবত দিয়ে বলেছিল, আমি এ কাজ করিনি। আপনি এনকোয়ারি করে দেখতে পারেন। যদি আমার কথা সত্যি হয় তবে এ মেয়েটির পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করবেন কি? আমি বিচার চাই।

ব্যাপারটা নিয়ে সারা কলেজ এবং শহরেও বেশ একটা হইচই পড়ে গিয়েছিল। ফয়সালা হতেও অবশ্য দেরি হয়নি। চিঠির হাতের লেখা দীপনাথের ছিল না, সুব্রত নামে একটি মিটমিটে ডান ছেলে ওই কাজটি করে দীপনাথকে ফাসায়। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাটা কার তা অবশ্য ধরা পড়েনি।

প্রিন্সিপ্যাল একদিন ইউনিয়নের পা সমেত দীপনাঘকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বললো, ব্যাপারটা মিটিয়ে নাও। আফটার অল একটা মেয়ের ভবিষ্যৎ বলে একটা কথা আছে। তাকে। তোমরা পাবলিকলি অপমান করলে তোমাদের পৌরুষ বলে কিছু থাকে না।

কিন্তু ইউনিয়নের নেতারা বলল, না জেনে যখন অন্যায় কাজ করেছে তখন পানিশমেন্টও তাকে নিতেই হবে। একজন নির্দোষ ছেলেকে আপনার সামনেই ও চটি ছুড়ে মেরেছে। এ কাজ কোনও ছেলে করলে তো আপনি ছেড়ে দিতেন না!

এই নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা, তর্কাতর্কি হল।

অবশেষে প্রিন্সিপ্যাল বললেন, বকুলের কী শাস্তি হবে তা লেট হারসেলফ ডিসাইড। মেয়েটির স্বভাব চমৎকার। আমার মনে হয় ওকে সেলফ-ইমপোজড পানিশমেন্ট নেওয়ার স্বাধীনতা তোমাদের দেওয়া উচিত।

এতে দীপনাথ ও তার বন্ধুরা আপত্তি করেনি।

বিকেলের দিকে জানা গেল বকুল নিজের শাস্তি নিজেই ঠিক করে নিয়েছে। সে ছ’মাস খালি পায়ে কলেজে আসবে।

এ পর্যন্ত ঘটনাটা ছিল অপমান, আক্রোশ, বিবাদে ভরা।

কিন্তু বকুল যখন পরদিন থেকে খালি পায়ে কলেজে আসতে লাগল তখন ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল ভারী করুণ।

বকুলের মাথা আরও হেঁট, চোখে-মুখে অহংকারের বদলে নিরুদ্ধ কান্না। মেয়েটাকে প্রায় ভিখিরি করে ছেড়ে দিয়েছিল দীপনাথ। আর তখনই তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছিল।

কিন্তু মফস্‌সল শহরে তখনকার দিনে মেলামেশা বা ভাব করা অত সহজ ছিল না।

মাসখানেক বাদে ভরা বর্ষার একটি দিনে যখন কলেজে ভিড় খুব কম, তখন বারান্দায় হঠাৎ বকুলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল দীপনাথের।

দীপনাথ বলল, বকুল, একটা কথা বলব? মাথা নত করে বকুল মৃদু স্বরে বলল, বলুন।

আমি ব্যাপারটা মনে রাখিনি। আপনি কাল থেকে আর খালি পায়ে কলেজে আসবেন না। তার দরকার নেই।

বকুল বিনীত এবং দৃঢ় স্বরে বলেছিল, আপনার কথায় তো হবে না।

কেন হবে না! ভিকটিম তো আমিই। আমিই সব অভিযোগ তুলে নিচ্ছি।

তা নিলেও হয় না। পানিশমেন্টটা তো আমি নিজেই নিয়েছি। ডিসিশনটা আমার। সেখানে অন্যের কথায় কিছু যায় আসে না।

দীপনাথ উদ্বেগের সঙ্গে বলল, খালি পায়ে হেঁটে অভ্যাস নেই, শেষে যদি পেরেক-টেরেক ফুটে ভাল-মন্দ কিছু হয় তো লোকে আমাকেই দায়ী করবে যে!

করবে না। এতে আপনার কোনও হাত ছিল না।

শান্ত স্বভাবের আড়ালে বকুলের যে একটি জেদি, একগুয়ে, নিজস্ব মন আছে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল দীপনাথ। এও বুঝল, এ মেয়েটির সঙ্গে জমানো ততটা সহজ হবে না। বরফ এখনও গলেনি।

বরফ অবশ্য কোনওদিনই তেমন করে গলল না। তবে বকুলের সঙ্গে একটু মাখামাখি করার রাস্তা দীপনাথ অনেক চেষ্টায় করে নিয়েছিল। প্রায়ই দেখা হত তাদের। কথাবার্তা হত।

শেষ পর্যন্ত বুঝি দীপনাথেব ওপর একটু টান এসেছিল বকুলের। একদিন বলল, আপনি কি চাকরি-বাকরি করবেন না? বি-এ পাশ করে ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছেন যে বড়!

চাকরি করলে কী হবে?

হবে একটা কিছু। আপনি একটা চাকরি জোগাড় করুন তো আগে।

মনে মনে তখন বকুলকে প্রশ্ন করেছিল দীপনাথ, আমাকে বিয়ে করবে বকুল?

মনে মনে বকুলের জবাব এল, হ্যাঁ।

পিসেমশাইয়ের এক চেনা লোকের সূত্র ধরে কৌটোর কারখানায় চাকরি পেয়ে গেল দীপনাথ। কলকাতায় চলে এল।

তারপর যা হয়। চাকরি বাঁচাতে আর কাজ শিখতে হিমশিম খেতে খেতে একদিন বকুল তার মন থেকে বেরিয়ে গেল। বকুলের কী হয়েছিল কে বলবে! সে দীপনাথকে কোনওদিন মনের কথা তেমন করে জানায়নি তো! তবে একজন মিলিটারি অফিসারকে বিয়ে করে সে ইউ পিবাসিনী হয় বলে খবর পেয়েছিল দীপনাথ। খুব একটা দুঃখ পায়নি তার জন্য।

এখন প্রীতমদের এই ঘরে অনেকখানি উজিয়ে দৃশ্যটা দেখে আবার বর্তমানে ফিরে আসে দীপনাথ। একটা বড় করে শ্বাস ছাড়ে।

প্রীতম বলে, তাহলে বকুল নয়।

দীপনাথ মৃদু ম্লান হেসে বলে, না, বকুল নয়।

তবে কে সেজদা?

কেউ নয়।

আজ নয়, তবে কোনওদিন ইচ্ছে হলে বোলো।

বলার কিছু নেই রে। আজ চলি।

বলে উঠল দীপনাথ।

আবার এসো। তুমি এলে ভাল লাগে।

আসব। তুই ভাল থাকিস।

আমি ভাল আছি। খুব ভাল আছি।

দীপনাথ চলে গেলে প্রীতম খানিকক্ষণ চোখ বুজে থাকে। সে কিছু ভোলে না, সে অনেক কিছু দেখতে পায়, অনেক বেশি অনুভব করে। বিড়বিড় করে সে বলল, তোমার কিছু হয়েছে সেজদা। তুমি ভাল নেই। তুমি কি এমন কারও প্রেমে পড়েছ যে তোমাকে ভালবাসে না?

 

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই স্কুলে যেতে শুরু করল লাবু। ফেব্রুয়ারিতে বিলু যোগ দিল চাকরিতে। আড়াইশো টাকা মাইনে আর খাওয়া-দাওয়া কবুল করে একজন বেবি সিটার রাখা হয়েছে লাবুর জন্য।

এইসব ঘটনাগুলো বাইরে থেকে দেখতে কিছুই নয়। কিন্তু প্রীতমকে এইসব ছোটখাটো পরিবর্তন বড় গভীরভাবে স্পর্শ করে। বিলু বাড়িতে না থাকলে তার কাছে ভীষণ একঘেয়ে আর ফাঁকা লাগে বাড়িটা। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। লাবু যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণ সে ভিতরেভিতরে অস্থির হয়ে থাকে। সবচেয়ে খারাপ লাগে বেবিসিটার মেয়েটিকে। বয়স বেশি নয়, লেখাপড়া জানে, চেহারারও খানিকটা চটক আছে। কিন্তু মেয়েটা খুব অবাক চোখে প্রীতমকে বারবার তাকিয়ে দেখে। কী দেখে মেয়েটি? প্রীতমের অস্বাভাবিক রোগা, শুকিয়ে যাওয়া হাত-পা? প্রীতমের নিরন্তর শুয়ে থাকা? ও কি ভাবে, এ লোকটা আর বেশিদিন বাঁচবে না?

যদি সবসময়ে একজন লোক প্রীতমকে লক্ষ করে তাহলে প্রীতম কীভাবে তার লড়াই করবে? বারবার যে সে আত্মসচেতন হয়ে ওঠে! চমকে যায় মাঝে মাঝে! অস্বস্তি বোধ করে।

সে একদিন বলেই ফেলল, বিলু, ওকে তাড়াও।

কাকে?

অচলাকে।

কেন? ও কী করেছে?

কিছু করেনি। কিন্তু বাইরের অচেনা একজন সবসময়ে ঘরে থাকলে আমার ভারী অস্বস্তি হয়।

ও মা! তাহলে লাবুকে দেখবে কে?

কেন, বিন্দু!

বিন্দুর যে ট্রেনিং নেই! অচলা ট্রেইনড নাস। ভাল বেবিসিটার। অরুণের চেনা বলে কম নিচ্ছে। নইলে ট্রেইনড বেবিসিটারের মাইনে কম করেও তিনশো।

প্রীতম জানে, বলে লাভ নেই। সে যত ঘ্যানঘ্যান করবে তত বিলু তাকে খুব ভদ্রভাবে বোঝাবে, রাজি করানোর চেষ্টা করবে। কিছুতেই তবু ছাড়বে না অচলাকে। বিলু ওইরকম। খুব ঠান্ডা আর কঠিন ওর প্রতিরোধ।

প্রীতম তাই হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু তবু তো তাকে বাঁচতেই হবে! সব বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধেই তো তার লড়াই। তাই সে অচলার বিস্ময়কে সহ্য করার নতুন শিক্ষণ নিতে চেষ্টা করে।

শোনো অচলা।

বলুন।

পাখাটা একটু আস্তে করে খুলে দাও। গরম লাগছে।

দিচ্ছি।

তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

স্বামী, একটা ছেলে।

তোমার ছেলেকে কে দেখাশোনা করে?

সে এখন বড় হয়েছে। দশে পড়ল। কাউকে দেখতে হয় না।

তোমার যে দশ বছরের ছেলে আছে তা তো মনে হয় না। কত বয়স তোমার?

কত আর হবে! আমার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল।

স্বামী কী করে?

বিজনেস।

এবার একটু শীত-শীত করছে। পাখাটা আর-একটু কমিয়ে দাও বরং।

পাখা তো এক-এ আছে, আর তত কমবে না। তাহলে বন্ধ করে দিই?

দাও। এখন কি গরম পড়েছে?

তা একটু পড়েছে।

তাই বলল, আমারও আজকাল গরমই লাগে।

শীত তো চলে গেল।

বিন্দুকে একটু চা করতে বলবে?

বিন্দু বাড়ি নেই, এ বেলা ছুটি নিয়েছে।

ও। তাহলে থাক।

ও মা! থাকবে কেন? আমি করে দিচ্ছি।

এইভাবে লড়াইটা লড়তে থাকে প্রীতম। বেশ ভালই লড়ে। একদিন অচলার চোখ থেকে কৌতূহল খসে যায়। সে প্রীতমের দিকে আর আড়ে-আড়ে তাকায় না।

২১. কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে

আপনি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন কেন? এখন তো আর শীতকাল নেই!

শীতকাল নেই? তবে এটা কী কাল?

ফাল্গুনের শেষ। এখন আর শীত কোথায়?

তাই বলো। আমারও কেমন হাঁসফাঁস লাগে আজকাল! চোখে ভাল দেখি না, বাইরে কি রোদের খুব তেজ?

খুব তেজ। কিন্তু চোখে ভাল দেখেন না কেন? ছোট ছেলে তো ছানিটা কাটিয়ে দিতে পারত।

চেয়েছিল কাটাতে। আমিই ভাবলাম, সে ছা-পোষা মানুষ। চোখ কাটাতে খরচ তত কম নয়। আর এ বয়সে চোখ নিয়ে আমি করবটাই বা কী?

চোখ কাটানোর নাম করে টাকা নিয়েছিল সেই গেলবার। শুনি দীপু ঠাকুরপোও টাকা দিয়েছিল। তা হলে কাটাল না কেন?

সে টাকা কি আর রেখেছে? গরিবের সংসার, কবে বোধহয় ভেঙে খেয়ে ফেলেছে।

খুব গরিব নয়। মাইনে তত খারাপ পায় না যতদুর জানি। থাকে অবিশ্যি গরিবের মতো। কিন্তু তা বলে নিজের বাবার চোখের ছানিটা পর্যন্ত কাটাতে নেই? অমন ছেলের কাছে ছিলেন কী করে এতদিন?

না, এমনিতে অযত্ন করত না। ডাক-খোজও করত খুব। বউমাটিও ভাল।

ভাল হলেই ভাল। কিন্তু চোখ যখন কাটায়নি, তখন টাকাটা আমাদের ফেরত দিয়ে দিক।

সে কি আর দিতে পারবে? পাবে কোথায়? ওদের সংসারে সারাদিন হা-টাকা যো-টাকা।

আপনার নিজেরও তো কিছু টাকাপয়সা ছিল শুনেছি। সেটাও খুব কম হবে না। সেটাও কি গিয়েছে নাকি?

আমার টাকা!

তা নয় তো কী? কিছু টাকা তো আপনার ছিল। অন্তত পনেরো-বিশ হাজার তো হবেই।

কে জানে! কোথাও আছে বোধ হয়। ডাকঘরে বা ব্যাংকে।

আছে ঠিক জানেন?

মনে নেই। আজকাল ভুলে যাই বড্ড।

শাশুড়ি-মায়ের কিছু গয়নাও ছোট কর্তার কাছে ছিল।

বুলুর কাছে? না, না, বুলুর কাছে থাকবে কেন? গয়না ছিল আমার কাছে।

ছিল মানে? এখন কি নেই?

কথাটা তা নয়। আসলে গয়নাগুলো আমি বউমাকে দিয়েছিলাম তার লকারে রাখতে।

তবেই হয়েছে। বউমা তার লকার বোধহয় আর জীবনেও খুলবে না।

মটরমালা একটা হার কিন্তু দিইনি।

সেটা তবে কোথায়?

সেটা বউমা স্যাকরাকে দেখাতে চেয়ে নিয়েছিল। বেশি দিনের কথা নয়। বলল, ওরকম একটা হার গড়বে। স্যাকরা প্যাটার্নটা দেখতে চেয়েছে।

ফেরত দিয়েছিল?

দিয়েছে বোধহয়। আমার বাক্সটা খুলে দেখো তো! বাঁ দিকে একটা বহু পুরনো সিগারেটের কৌটো আছে। ওপরে কয়েকটা পইতে, তার তলায়।

দেখতে হবে না। ধরেই নিচ্ছি ওটাও নেই।

না, না, দেখোই না ভাল করে। আমি লুকিয়েই রেখেছিলাম।

লুকিয়ে রাখতে গেলেন কেন? চোর-ডাকাত না ছেলের ভয়ে?

ভয়ে ঠিক নয়। তোমার শাশুড়ি যখন মারা যান তখন গলায় ওইটে ছিল। আমি খুলতে চাইনি। ভাবলাম যার জিনিস তার সঙ্গে যাক। সুরবালাকে মনে আছে তোমার?

ও মা। নিজের পিসশাশুড়িকে মনে থাকবে না কেন?

তা সেই সুরবালাই ওটা গলা থেকে খুলে আমার হাতে দিল। বলল, ওটা কাউকে দিয়ো না। এখনও রাঙা বউঠানের গায়ের তাপ এতে লেগে আছে। সেই থেকে হারটা ছিল। তোমার শাশুড়ির কথা খুব মনে পড়ত বলে হারটা দেখতাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে! কী যেন বলছিলাম!

বলছিলেন, হারটা লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ঠিক তাই। পাছে কেউ চুরি করে সেই ভয়ে। ভেবেছিলাম একেবারে শেষ সময়ে যে সেবা করবে তাকে দিয়ে যাব। সময় করে একবার খুঁজে দেখো তো!

আমি দেখব কেন? আপনার জিনিস আপনিই খুঁজুন। আমার ওতে লোভ নেই। তবে এও জানি, খুঁজলেও পাবেন না।

তবে কি ফেরত দিতে ছোট বউমা ভুলে গেল?

ভুলে যাবে কেন? অত ভুলো মন তো ওর নয়।

তা হলে?

তা হলে আর কী? মনে মনে ওটা ছোট বউমাকেই দান করে দিন।

দান করাই যায়। ছোট বউমা আমার সেবা কিছু কম করেনি।

সেটা করেছে নিজের গরজেই। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই মাসে মাসে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল যে! আমরা পাঠাতাম। দীপু ঠাকুরপো পাঠাত।

দীপু! বহুকাল দীপনাথকে দেখি না। সে কি তোমাদের এখানে মাঝে মাঝেই আসে?

না, বহুকাল বাদে ওই সেদিন এসেছিল, যেদিন আপনাকে সোমনাথ পৌঁছে দিয়ে গেল এখানে। তাড়া ছিল বলে চলে গেল একটু। সঙ্গে ওর বসের বউ ছিল!

কী করছে এখন?

চাকরিই করছে।

ভাল আছে তো! বহুদিন দেখিনি।

দেখবেন। আসতে লিখে দেব।

তোমাদের এই বাড়িটা খুব ভাল। বেশ খোলামেলা, হাওয়া-বাতাস আছে। আগেরবার দেখে গেছি, তখন এত দালান-কোঠা ওঠেনি।

এসব ঘর পরে হয়েছে।

মল্লিনাথের কি অনেক সম্পত্তি, বউমা?

খুব কম নয়।

আমার ছেলেদের মধ্যে মল্লিনাথই ছিল সবচেয়ে সাকসেসফুল। অথচ দেখো, তারই ভোগ করার কেউ নেই।

কেউ নেই কেন? এই তো আমরা ভোগ করছি।

সে ঠিক কথা। তবে তার নিজের তো কেউ নেই। পাঁচ ভূতে লুটে খাচ্ছে।

আমরা কি ভূত, বাবা?

তোমাদের কথা নয়। কী মুশকিল! আমার কি বুড়ো বয়সে সব কথা ঠিকঠাক আসে?

বললেন বলেই জিজ্ঞেস করলাম। সোমনাথ কী বলে? আমরাই সেই পঞ্চভূত?

বুলুকে তোমরা দেখতে পারো না কেন বলো তো? সে কিন্তু তার মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিল।

বেশি আদর দিয়েছেন বলেই তো এরকম।

ছেলেপুলেরা তো বাপ-মায়ের আদরেরই হয়। তুমি কি আদর দাও না?

দেব না কেন? তবে অন্যায় আদর দিই না!

দীননাথ চট্টোপাধ্যায় তার নিবিড় চুলে ভরা মাথাটা নাড়ালেন। বললেন, সবাই সেকথা বলে।

কী বলে?

বলে মেজো বউ খুব কড়া ধাতের। তা ভাল, আমরা সে আমলে সত্যিকারের ছেলেপুলে মানুষ করতে জানতাম না। ছেলেরা নিজেরাই যে যার মানুষ হত। এখনকার দিনের মা-বাবারা অনেক বেশি ছেলেপুলের যত্ন করে। তবে শাসনটা তেমন করে না। তুমি অবশ্য করো।

আপনারাও যদি ছেলেপুলেকে শাসন করতেন তবে এরকম হত না।

দীননাথ শঙ্কিত চোখ তুলে বলেন, কীরকম বলো তো? আমার ছেলেপুলেরা কি খুব খারাপ?

ভালও কিছু নয়।

কেউ নয়?

ভাশুর ঠাকুরকে ধরছি না।

দীননাথ খুশি হয়ে আবার মাথা নেড়ে বললেন, মল্লিনাথ ছিল ব্রিলিয়ান্ট। ওরকম ছেলে হয় না।

দীপুও বড় ভাল। আপনার ছেলেপুলেদের মধ্যে এই দু’জন অন্যরকম।

শ্রীনাথ কি খুব সৃষ্টিছাড়া? তাকে এখানে এসে অবধি ভাল করে দেখলামই না।

কখন দেখবেন? সেই সকালে বেরোন, রাত করে ফেরেন। কখনও ফেরেনই না।

ফেরে না? তবে রাতে কোথায় থাকে?

তা কে বলবে?

দীননাথ একটু ভাবেন। বলেন, ওর কি চরিত্র খারাপ?

খোঁজ নিয়ে দেখিনি।

খারাপ হতে দিয়ো না। এখনও আটকাও। স্বামী ছাড়া মেয়েদের কিছু নেই।

আমি ওসব মানি না।

আজকালকার মেয়েরা অবশ্য মানে না। পুরুষগুলোও তো যাচ্ছেতাই। একটা কথা বলব, বউমা?

বলুন।

আমি মরে গেলে বুলুকে একটু দেখো। যত খারাপ ভাবো ও তত খারাপ নয়।

দেখব কী, দেখার আছেই বা কী? সোমনাথ তো আর কচি খোকা নয়। বয়স হয়েছে, বিয়ে করেছে, নিজের এবং অন্যের ভালমন্দ ভালই বুঝতে শিখেছে।

ও ওর মায়ের খুব আদরের ছিল।

তাতে আমার কী? আমি তো মায়ের আদর দিতে পারব না।

তা বলিনি। বলছি, ওর বড় অভাব। ওকে একটু দেখো।

আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝেছি। বোধহয় সোমনাথই আপনাকে এসব বলতে শিখিয়ে দিয়েছে।

দীননাথ একটু লজ্জা পেয়ে বলেন, যত যা-ই হোক, ওর দাদারই তো সম্পত্তি।

সেটা দাদা বেঁচে থাকতে বুঝে নিল না কেন?

তুমি কি ওকে খুব অপছন্দ করো?

করলেই বা। ওর তাতে কী যায় আসে?

ও তোমারই দেওর।

তা হলেই বা কী? আমাকে তো বউদি বলে ভাবে না। ভাবলে এখানকার লোকদের আমার ওপর খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করত না।

ও কি তাই করছে?

হ্যাঁ।

দীননাথ তাঁর এই বয়সেও প্রচুর কালো চুলে ভরতি মাথাটা চুলকোন দু’ হাতে। তারপর বলেন, ওকে কি তুমি তোক দিয়ে মার খাইয়েছিলে?

ও তাই বলে নাকি?

ঠিক তা বলে না। তবে আন্দাজ করে। মরতে মরতে বেঁচে গেছে।

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

দীননাথ তৃষার দিকে গভীরভাবে চেয়ে দেখছিলেন। ভাল দেখতে পান না বলে ভ্রু কোঁচকানো। বললেন, তবে এই কম্বলটা আর গায়ে দেব না বলছ?

না। শীত করলে পাতলা সুতির চাদর গায়ে দেবেন।

চাদর তো নেই।

আপনার যে কিছুই নেই তা আমি জানি। ওসব নিয়ে ভাববেন না। চাদর বিছানায় ঠিক থাকবে। আচ্ছা। খুব ভাল। তোমার বেশ চারদিকে চোখ।

চোখ ছিল বলে বেঁচে আছি। নইলে চিল-শকুনে খেয়ে যেত। কম্বল দিন, রোদে দিয়ে তুলে রাখব।

থাক না, বিছানাতে আছে থাক। এ কম্বল বিলেতে তৈরি। মল্লিনাথ দিয়েছিল। একটা স্মৃতির মতো।

ভয় নেই বাবা। আমি শমিতা নই যে, নিয়ে ফেরত দেব না।

ওই দেখো, কী কথা থেকে কী কথা!

কম্বলটা দিন। শীত এলে ফেরত পাবেন।

আর শীত কি আসবে আমার জীবনে? এটাই শেষ শীত বোধহয়।

তৃষা কম্বলটা নিয়ে চলে যায়। বিছানাটা একটু ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে দীননাথের। কম্বলটার জন্য বড় উদ্বেগ। নিয়ে গেল, আবার দেবে তো! ঠেকে ঠেকে শিখেছেন, একবার নিলে লোকে আজকাল আর কিছু ফিরিয়ে দেয় না।

দীননাথ আর শুয়ে রইলেন না। বসে বসে নিজের ছেলেপুলেদের কথা ভাবতে লাগলেন। দীপনাথ মানুষ হয়েছিল বেদবালার কাছে। বেদবালার প্রথম সন্তান বাঁচেনি। তাই দীপুকে নিয়ে গেল। পরে আরও ছেলেপুলে হয়েছিল বটে, কিন্তু দীপুকে খুব বুক দিয়ে মানুষ করেছিল। বলত, দীপ হল আমার মেজো ছেলে।… বিলুর বড় বিপদ চলছে। জামাইয়ের নাকি বাড়াবাড়ি অসুখ!… শ্রীনাথ রাতে ফেরে না মাঝে মাঝে, এ ভাল কথা নয়।… ওদিকে ছোট বউমা কী করছে কে জানে। সোমনাথ বলেছিল, রবিবারেরবিবারে আসবে। তা কত রবিবার চলে গেল। এল না তো! বউমার কি কিছু হল-টল?

 

খবর দেওয়া সত্ত্বেও বদ্রী এল না দেখে এক ছুটির দিনে বিকেলে নিজেই তার খোঁজে বেরিয়েছে শ্রীনাথ।

তাড়া নেই। বাজারের কাছটায় মাদারির খেল হচ্ছে, তাই দাঁড়িয়ে দেখল খানিক।

আবার রওনা হওয়ার মুখে পিছন থেকে রঘু স্যাকরা ডাকল, কে, শ্রীনাথদা নাকি?

আরে রঘুবাবু, খবর কী?

কোন দিকে চললেন?

যাই একটু ঘুরে-টুরে আসি।

খবরটা শুনেছেন নাকি?

কী খবর?

আপনার শালাবাবুর নামে যে শচীন সরকারের ভিটেটা কেনা হয়ে গেল।

সরিতের নামে? কে কিনল?

কোনও খবরই রাখছেন না আজকাল।

শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, ওসব খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই, রঘুবাবু।

রঘু শ্রীনাথের বিরক্তিটা গায়ে মাখল না। খুব জরুরি গলায় বলল, পুকুর আর বাঁশবন সমেত বিঘে সাতেক জায়গা। টাকাও নেহাত কম লাগেনি। বিঘেতে তিন হাজার, তার ওপর পাকা একতলা বাড়িটার জন্য আরও হাজার আষ্টেক। আপনার শালা কি ব্ল্যাক-ট্যাক করে নাকি?

কে জানে কী করে?

সবাই এ নিয়ে খুব গরম। শচীন সরকারের বউয়ের সঙ্গে বিনোদ কুণ্ডুর ব্যবস্থা হয়েছিল বিঘেতে দুই হাজার আর বাড়ির বাবদ পাঁচ। আপনার শালা চড়া দাম ছেঁকে কিনে নিল।

তার আমি কী করব?

বিনোদ সহজে ছাড়বে না। টাকাটা কোত্থেকে এল তার খোঁজ নিচ্ছে। বাগে পেলে জেলে ভরে দেবে। বিনোদের এক ভায়রাভাই সার্কেল অফিসার।

দিক। আমি ওসবের মধ্যে নেই।

তা আমরা জানি।

আপনারা মানে?

এ অঞ্চলের সবাই। আমরা বলি, শ্রীনাথ চাটুজ্জে কখনও কারও পাকা ধানে মই দিতে আসেনা। বলে থেমে গিয়ে রঘু গেলাসের ইঙ্গিত করে বলল, চলবে নাকি? এই কাছেই খালধারে আমার একটা ঠেক আছে।

না। কাজে যাচ্ছি।

আপনার বাবা এলেন শুনেছি! কদিন থাকবেন?

তা জানি না। আছেন তো এখন।

বাপ-মায়ের মতো জিনিস হয় না। গৃহদেবতা। যত্ন-আত্তি করবেন। ওঁদের আশীর্বাদেই সব।

তা বটে।

সোমনাথবাবু বাবাকে মাথায় করে রেখেছিলেন। ওই হল ছেলের কাজ।

ঠিকই তো।

যাই তা হলে। ডানদিকে এই কাছেই রামলাখন সিং-এর ঘর। চেনেন তো?

না। আসিনি কখনও।

ভাল জায়গা। সব ব্যবস্থা আছে।

কী ব্যবস্থা?

যা চান। সবই চলে ওখানে। দরকার হলে বলবেন।

রঘু খালধারের ধুলোভরতি রাস্তায় নেমে গেলে অনেকক্ষণ ভাবমাভরতি মাথা নিয়ে আনমনে হাঁটে শ্রীনাথ। বাজার পেরিয়ে রেললাইনের ধারে উঠে হাঁটাপথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একটু হাসে শ্রীনাথ। এরা তৃষাকে চেনে না।

তার মায়া হয়। ভাবে রঘু স্যাকরাকে ডেকে বলে দিয়ে আসে, শুনুন মশাই, তৃষা আপনাদের একদিন এখান থেকে উচ্ছেদ করে ছাড়বে। কোন দিক থেকে ওর মার আসবে তা টেরও পাবেন না।

বদ্রী ঘরে ছিল। ডাকতেই বেরিয়ে এসে খাতির করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।

ঘরটা পাকা হলেও ছোট আর গরম। পশ্চিম দিকে খোলা বলে রোদে তেতে আছে।

বদ্রী একটা হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বলল, ক’দিন খুব ঝামেলায় ছিলাম বলে যেতে পারিনি। যাব-যাব করছিলাম।

তুই তো গিয়েছিলি শুনলাম।

কোথায়?—বদ্রী আকাশ থেকে পড়ে।

তৃষা তোকে ডেকে পাঠিয়েছিল না?

বদ্রী হেসে বলে, ওঃ, সে বহুদিন হল।

কেন ডেকেছিল?

রায়পাড়ার একটা জমি বেচতে চাইছেন।

তৃষা জমি বেচতে চাইছে?–শ্রীনাথ খুব অবাক হয়।

তাই তো বললেন।

মিথ্যে বলিস না, বদ্রী। তৃষাকে আমি জানি সে কোনওকালে এক ইঞ্চি জমিও বেচবে না। পারলে সে গোটা অঞ্চল, গোটা দেশ, মায় গোটা দুনিয়া কিনে নেবে।

বী ফঁপরে পড়ে বলে, আজ্ঞে, আমি যা জানি তাই বললাম।

তুই চেপে যাচ্ছিস। তৃষা তোকে অন্য কাজে ডেকেছিল।

আজ্ঞে না।

আর তারপর থেকেই তুই আমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করেছিস।

বললাম তো, ঝামেলায় ছিলাম খুব। আমার সম্বন্ধীর অসুখ গেল। ছোটাছুটি, ডাক্তারবদ্যি, হাসপাতাল অবধি হয়ে গেল।

তৃষা তোকে কী বলেছে?

আপনার ব্যাপারে কিছু নয়। জমি নিয়েই কথা ছিল।

আমার জন্য যে জমির খোঁজ এনেছিলি তার কী হল?

যেরকম চাইছেন সেরকম পাচ্ছি না।

বলেছিলি দূরের দিকে পাওয়া যাবে।

শেষতক হয়নি। সব জায়গায় হুড়োহুড়ি করে বর্গা রেজিস্ট্রি হয়ে যাচ্ছে।

ভাল দাম পেলে বর্গা ছাড়া জমিও লোকে বেচবে। আমি তো টাকায় পিছোচ্ছি না।

দেখব। কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে যাবেন।

না বদ্রী, খবর পাব না। খবর তুই দিবিও না।

আমার তাতে কী লাভ বলুন। খবর দিয়েই তো দু’পয়সা ঘরে তুলি।

তৃষা কি তোকে ঘুষ দিয়েছে?

কী যে বলেন!–বদ্রী জিব কাটে।

লুকোস না। তৃষা কি চায় না যে আমি কোথাও জমি কিনি, চাষবাস করি?

কোন স্ত্রীই বা চায় বলুন? কিন্তু কথাটা তা নয়।

তবে কী?

কথাটা হল, আপনি অন্য জায়গায় যেতে চাইছেন কেন? এদিকে তো আপনার জমিজায়গার অভাব নেই।

জমি কি আমার?

বদ্রী চোখ লুকিয়ে বলে, আপনার ছাড়া আর কার? বউঠান তো আর আপনার পর-মানুষ নন।

এসব কথা তোকে শেখাল কে? তৃষা?

না, না। কী যে বলেন!

বদ্ৰী, আমি জানি তৃষা তোকে হয় ভয় দেখিয়েছে, নয় তো ঘুষ দিয়েছে।

বীর মুখটা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল। কেমন অসহায়, ফ্যাকাসে, ভয়ে ভরা।

হাতপাখা রেখে বদ্রী নিচু স্বরে বলল, দোষ ধরবেন না তো? তা হলে বলি।

বল, বদ্রী। আমি কাউকে কিছু বলব না। কিন্তু ব্যাপারটা আমার জেনে রাখা দরকার।

বউদিকে আমরা ভয় খাই। উনি চোখ রাঙালে সে কাজ করতে ভরসা হয় না।

তা হলে তৃষা তোকে চোখই রাঙিয়েছে?

ঠিক চোখ রাঙানো নয়। বরং ডেকে পাঠিয়ে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথাই বললেন। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে জমির খোঁজ দিতে পেরেছি কি না।

তুই কি গাড়লের মতো সব বলে দিলি?

বললেও উনি ঠিকই খোঁজ রাখেন। চতুর্দিকে ওনার চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রমথবাবুর জমি কিনতে চেয়েছিলাম সেকথা প্রমথবাবুই বলে এসেছেন বউদিকে।

তোকে কী বলল তৃষা?

আমার কাছ থেকে সব কথা বের করে নিয়ে বললেন, উনি এখন অন্য জায়গায় জমি-টমি কিনলে এখানকার সব দেখাশোনার অসুবিধে হবে।

বাজে কথা। আমি এখানকার কিছুই দেখাশোনা করি না।

সে আমি জানি। বউদি যা বললেন তাই বললাম আপনাকে।

তারপর কী হল?

উনি বললেন, আর জমি-টমি তোমাকে দেখতে হবে না। নিজের কাজ নিয়ে থাকো। জমির যদি তেমন কোনও খবর পাও তা হলে আমাকে জানিয়ো। কাছেপিঠে হলে আমরা কিনব।

শ্রীনাথ একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বদ্রীর দিকে চেয়ে বলল, তুই আমার নিজের লোক ছিলি রে, বদ্রী। তৃষা তোকেও হাত করল।

বদ্রী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমার দোষ নেই দাদা, ছা-পোষা মানুষ।

শচীন সরকারের ভিটে কেনা হচ্ছে, সে খবর রাখিস?

রাখি। আপনার শালার নামে।

কেন?

ল্যান্ড সিলিং আছে না? জমি কিনে গেলেই তো আর চলবে না। আপনার নামেও বিস্তর জমি কেনা হয়েছে, আপনি কি জানেন?

না তো!–খুব অবাক হয়ে শ্রীনাথ বলে।

হয়েছে।

কিনলেই হল? আমার সইসাবুদ লাগবে না?

আপনার ওকালতনামায় অন্য লোক কিনছে।

ওকালতনামা আমি কাউকে দিইনি তো?

তার আমি কী বলব বলুন? যা জানি তাই বলছি।

জানিস যদি তবে খোলসা করে বল। আমার ওকালতনামা অন্যে পায় কী করে?

পেয়েছে। আমি ভাল করে জানি।

তবে কি বলছিস আমার সইও জাল হচ্ছে আজকাল?

আমি তাই বললাম নাকি? হয়তো কোনও সময়ে দিয়েছেন, এখন মনে নেই।

বাজে কথা বলিস না। আমার এখনও ভীমরতি ধরেনি।

বদ্রী জবাব দিল না। আস্তে আস্তে হাতপাখা নাড়তে লাগল। খুব আস্তে করে বলল, শুধু আপনি নয়। বৃন্দা, মংলু, এমনকী খ্যাপা নিতাইয়ের নামেও বিস্তর জমি কেনা হয়েছে।

 

সেই যে সেজোকাকা এসে গেছে তারপর থেকে সজলের প্রায়ই খুব সেজোকাকার কথা মনে পড়ে। সজলের হাত ধরেছিল সেজোকাকা। হাতটা দারুণ শক্ত। ধরলেই বোঝা যায় সেজোকাকার গায়ে খুব জোর। অত চওড়া কবজি আর কারও দেখেনি সে।

স্কুলে সে একদিন বন্ধুদের বলল, আমার সেজোকাকা একবার খালি হাতে বাঘ মেরেছিল।

খালি হাতে? যাঃ।

সেজোকাকার গায়ের জোর তো জানিস না। ঘুসি মেরে পাথর ফাটিয়ে দেবে।

তোর সেজোকাকা কুংফু জানে? ক্যারাটে?

ফুঃ। সেজোকাকা যখন শিলিগুড়িতে ছিল তখন একবার সিনেমাহলে মারপিট লাগে। একা পঞ্চাশজনকে মেরে ঠান্ডা করে দিয়েছিল।

গুল ঝাড়িস না।

আচ্ছা, আবার এলে তোদের দেখাব সেজোকাকাকে।

কীরকম দেখতে?

ইয়া লম্বা, অ্যায়সা গুল্লু গুলু মাসল্‌।

বুকের ছাতি কত?

ছেচল্লিশ।

আমার দাদারই তো বাহান্ন।

তোর দাদাকে আমি দেখেছি রে, কমল। মোটেই বাহান্ন হবে না।

তবে কত?

বিয়াল্লিশ হবে বড়জোর।

দাদা কার কাছে ব্যায়াম শেখে জানিস? বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়।

জানি। সেজোকাকা আমাকে কুংফু শিখিয়ে দেবে বলেছে। ক্যারাটেও।

আমার দাদাও ক্যারাটে জানেন।

আমার সেজোকাকার মতো নয়।

তোর সেজোকাকা যে বাঘটা মেরেছিল সেটা কত বড়?

দশ ফুট। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দেখিসনি?

আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ রাখাই হয় না।

বেরিয়েছিল। আসল রয়েল বেঙ্গল।

তোর বাবার গায়ে কিন্তু একদম জোর নেই।

সজল ফুঁসে উঠে বলে, কী করে বুঝলি?

একদিন দেখি স্টেশনের দিক থেকে আসছে তোর বাবা। চায়ের দোকানে কতকগুলো লোক বসে থাকে না সব সময়? সেই লোকদের একজন চেঁচিয়ে তোর বাবাকে আওয়াজ দিল, ওই যে শ্রীচরণনাথ যাচ্ছে, দেখ দেখ।

বাবা কী করল?

তোর বাবা মাইরি সব শুনতে পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালও। তখন সেই লোকটা না— হিঃ হিঃ—

সেই লোকটা কী?

সে যা অসভ্য কাণ্ড না!

বল না!

সেই লোকটা দু’হাতের আঙুল দিয়ে তোর বাবাকে খুব অসভ্য একটা জিনিস দেখিয়ে বলল, যাও যাও, এইটে করে গে।

লোকটা কে?

নাম জানি না। খুব মস্তানের মতো দেখতে।

বাবা কিছু বলল না?

কিছু না। মাথা নিচু করে চলে এল ভেড়ুয়ার মতো।

সজলের গা রি রি করে রাগে। সে বলে, ঠিক আছে, মামাকে বলে দেব।

তোর মামা কী করবে?

মামাকে তো চেনো না। কী করবে দেখো।

যাঃ, যাঃ, তোর মামাকে জানি। ওই তো মহাদেবের দোকানে বসে থাকে বিকেলের দিকে। লোকে যলে বেকার।

মালদায় মস্তান ছিল, জানো না তোর

বাড়িতে ফিরে সজলের নানা সময়ে বারবার কথাটা মনে পড়ে। স্টেশনের কাছে একটা লোক তার বাবাকে আওয়াজ দিয়েছিল।

বাবা যে কেন এরকম তা বোঝে না সজল। সে অবশ্য বাবাকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সেই সঙ্গে এও জানে, বাবাকে সে ছাড়া আর কেউ ভয় পায় না। পাত্তা দেয় না কেউ।

বাবার জায়গায় সেজোকাকু হলে নিশ্চয়ই অন্যরকম হত। যেই মস্তানটা আওয়াজ দিত অমনি সেজোকাকু গিয়ে দুই চটকানে লোকটাকে মাটিতে ফেলে মুখ দিয়ে রক্ত বার করে ছেড়ে দিত। বাবা কেন সেজোকাকুর মতো নয়!

দাদু এসে সজলের কথা বলার আর-একটা লোক হয়েছে। নইলে মা, দিদিদের বা বাবাকে সে নাগালে পায় না কখনও। দাদুকে পায়।

দাদু!

বলল, ভাই। তুমি সেজোকাকুর ঠিকানাটা জানো?

না। তবে তোমার বাবা বোধহয় জানে। ঠিকানা দিয়ে কী করবে?

চিঠি লিখব। কাকু আমাকে একটা এয়ারগান দেবে বলেছিল।

এয়ারগান দিয়ে কী করবে?

লোককে ভয় দেখাব। আচ্ছা দাদু, সেজোকাকু কি কুংফু জানে?

কী ফু বলছিস?–বলে দীননাথ কানের পিছনে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়েন।

হি হি করে হেসে ফেলে সজল। দাদু এসব জানে না।

২২. রতনপুরে পাঁচখানা নতুন সাইকেল রিকশা

রতনপুরে পাঁচখানা নতুন সাইকেল রিকশা চালু হল। পাঁচখানাই তৃষার। মাইল তিনেক দূরে তৃষা খুলেছে হাসকিং মিল। এই পাঁচখানা রিকশা আর মিল অবশ্য তৃষা নিজের নামে করেনি, করেছে সরিতের নামে।

একটা হালকা পলকা সস্তা মোপেড় কিনে দিয়েছে সরিৎকে। সে এখন হাসকিং মিল আর রিকশা নিয়ে দিনরাত গলদঘর্ম। প্রথমটাতেই বুঝতে যা একটু সময় লাগে। তারপর আস্তে আস্তে সব কাজেরই একটা বাঁধা ছক দাঁড়িয়ে যায়। তখন আর কষ্ট হয় না। বহুকাল বাদে খাটুনিতে নেমে প্রথমটায় হাঁফ ধরে যাচ্ছিল সরিতের। এখন ক্রমে সয়ে যাচ্ছে।

মোপেড জিনিসটা সরিতের তেমন পছন্দ নয়। মোপেড মানেও সে জানে না। তবে আন্দাজ করে, মোটর কাম পেডাল, অর্থাৎ যখন মোটরে চলবে তখন একরকম, মোটর খারাপ হলে পেডাল মেরে সাইকেলের মতোও চালানো যাবে। সুতরাং গাড়িটা না রাম না গঙ্গা। সাইকেলও নয়, মোটর সাইকেলও নয়। তবে কলকবজা বিশেষ জটিল নয় বলে সহজেই সারানো যায়। বেশি খরচাও নেই। এক লিটার তেলে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন কিলোমিটার চলে যেতে পারে। তবু এই কলের গাড়িতেও দুইদিক সামলাতে সরিতের দমসম হয়ে যায়।

আজকাল রোদের তেজ বেড়েছে। গরম পড়ে গেছে বেশ। ভোর হতে না হতেই হাসকিং মিলে গিয়ে হাজির হতে হয়। মিল চালু করে দিয়েই কাজ শেষ হয় না। খাতায় এনট্রি রাখতে হয়। মাঝে মাঝে ধান কিনতেও বেরোতে হয় তাকে। দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার নিয়ম নেই। এক গেরস্তর ঘরে মাসকাবারি বন্দোবস্তে দুপুরের ভাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে তৃষা। কাজেই সারাদিন সরিৎ এখানে বন্দি। বিকেলে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে একটু জিরোতে না জিরোতেই বেরোতে হয় দোকানঘরে।

তৃষা তিন মেয়ের নামে ঝকঝকে এক স্টেশনারি আর মুদির দোকান দিয়েছে বাজারের কাছে। দোকানের নাম ত্রয়ী। রতনপুরে যা পাওয়া যেত না সেইসব জিনিস মনে করে রেখেছিল তৃষা। ত্রয়ীতে এখন সেইসব জিনিস পাওয়া যায়। নুডল, লিপস্টিক, স্টেনলেস স্টিলের বাসন; ভাল শ্যাম্পু কিংবা সাবান, দামি সিগারেট পর্যন্ত। প্রথম-প্রথম খুব একটা বিক্রি ছিল না। কিন্তু লোকের আজকাল নতুন নতুন জিনিস কেনার আগ্রহ দেখা দিয়েছে। দোকানও তাই রমরম করে চলছে। লোকে তৃষাকে দেখতে পারুক চাই না-পারুক তার দোকান থেকে চোখ বুজে জিনিস কেনে।

দোকানে দু’জন কর্মচারী রেখেছে তৃষা। সন্ধেবেলায় সরিৎ গিয়ে বসে স্টক আর বিক্রির টাকা মেলায়। মুদির দোকানের স্টক মেলানো রোজ অসম্ভব। তবু যথাসাধ্য হিসেব নিতে হয়। রাত দশটা পর্যন্ত এই করতে চলে যায়। তারপর বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই শেষ ট্রেনের ট্রিপ মেরে রিকশা ফেরত দিতে আসে রিকশাওয়ালারা। তাদের কাছে রোজের পয়সা গুনে নিতে হয়। সব কিছুতেই লাভের অর্ধেক বখরা সরিৎ পায়। শুধু ত্রয়ীর আয় থেকে তার ভাগ নেই। দোকানের টাকা জমা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের জন্য। তবু প্রথম মাসের হিসেবেই সরিৎ পেল প্রায় চারশো টাকা পেয়ে তার মাথা ঘুরে গেল।

এত টাকা একসঙ্গে নিজের করে কোনওকালে পায়নি সরিৎ। কী করবে তা ভেবে পাচ্ছিল না। টাকাটা অবশ্য এক রাত্রির বেশি রইল না তার কাছে। পরদিনই তৃষা ডেকে একশো টাকা মায়ের নামে আর পঞ্চাশ টাকা মালদায় বড়দার নামে পাঠাতে বলে দিল। আর বলল, বাকি টাকা থেকে খাইখরচ বাবদ মাকে একশো টাকা দিবি। যা থাকবে তা থেকে পঞ্চাশ টাকার বেশি হাতখরচ রাখবি না। বাকিটা ডাকঘরে অ্যাকাউন্ট খুলে জমা দিয়ে আয়। পাশবই আমার কাছে দিয়ে যাবি।

সরিৎ কিছুটা ম্লান হয়ে গেল বটে, কিন্তু মেজদির ওপরে যে কথা চলে না তাও সে জানে।

পরের মাসেই তার আয় আরও পঁচিশ টাকার মতো বেড়ে গেল। সরিৎ বুঝতে পারছিল, এই হারে চললে তার টাকা খায় কে। তবে মুশকিল হল, তার একটু গানবাজনা আসত, সিনেমা দেখার নেশা ছিল। সেগুলো এবার যায় বুঝি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেজদি একেবারে নিচ্ছিদ্র করে দিয়েছে তার।

এর মধ্যেই আবার তাকে অন্যরকম কাজেও লাগায় তৃষা। একদিন ডেকে বলল, স্টেশনের কাছে চায়ের দোকানে কয়েকটা বাজে লোক নাকি বসে থাকে, একটু নজর রাখিস তো। তোর। জামাইবাবুকে টিটকিরি দেয়, সজল স্কুলে শুনে এসেছে।

সরিৎ একটু চনমনে হয় কথাটা শুনে। মারপিট, হাঙ্গামা তার পছন্দসই জিনিস।

তৃষা বোধহয় তার মনের ভাব বুঝেই বলল, তা বলে খুনোখুনি করতে হবে না। সঙ্গে গঙ্গা থাকবে, যা করার সেই করবে। তুই তোর জামাইবাবুকে আগলে রাখিস।

জামাইবাবু যে ভেড়ুয়া তা সরিৎ জানে। তবে আবার অন্যরকম তেজও আছে। পাঁচখানা। রিকশার মধ্যে একখানা রোজ রাতে স্টেশন থেকে শ্রীনাথকে নিয়ে আসবে, এরকম একটা কথা হয়েছিল। কিন্তু শ্রীনাথ রাজি হয়নি। বলেছে, না, আমি এমনিই আসতে পারব।

সরিৎ ব্যাপারটা খুব ভাল বুঝল না। গঙ্গাকে সে চেনেও না। তবে মেজদির কাছে বেশি কিছু জানতে চেয়ে লাভ নেই। দরকারও নেই।

পরদিন সন্ধেবেলা হাসকিং মিল থেকে ফিরে আসার পর গঙ্গার দেখা পেল সরিৎ। বড় ঘরের দাওয়ায় এক কোণে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে। সামনে একটা কাঠের চেয়ারে তৃষা।

তৃষা ডেকে বলল, এই গঙ্গাকে দেখে রাখ। কাল তোর সঙ্গে যাবে।

সরিৎ দেখল, আবছা অন্ধকারে গোঁয়ার গম্ভীর ধরনের একটা লোক। চোখে চোখ রেখে তাকাতে জানে না। চেহারাটা খুব মজবুত। পরনে ধুতি আর হাফহাতা শার্ট। সরিতের সঙ্গে কথাই বলল না। শুধু যাওয়ার আগে ভাঙা চাষাড়ে গলায় বলল, আমি স্টেশনের ধারেই থাকব। আপনি রাতের দিকে আসবেন।

গঙ্গা কে, কী তার পেশা তা কিছুই জানা গেল না। এমনকী মুখটাও ভাল করে দেখতে পায়নি সরিৎ। মেজদিও কোনও পরিচয় দেওয়ার দরকার মনে করল না। তবে সরিৎ বুঝল, এ হল মেজদির পোষা গুন্ডা। শহুরে গুন্ডাদের মতো চতুর না হলেও বোধহয় কাজের লোক। গাঁইয়া গুন্ডারা বোধহয় অন্যরকম হয়।

 

স্টেশন থেকে একটা পাকা রাস্তা আঁকাবাঁকা হয়ে ঢুকে এসেছে জনবসতির মধ্যে। সামনেই একটা চৌরাস্তা। তার মোড়ে কয়েকটা কাঁচা ঘরে চা মিষ্টির দোকান। বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে সর্বদাই কিছু লোককে সন্ধের পর বসে থাকতে দেখা যায়। হ্যাজাক জ্বলে, চায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

পরদিন রাত আটটা নাগাদ সরিৎকে তাদের রিকশাওয়ালা ফাগুলাল স্টেশনের চত্বরে এনে নামিয়ে দিল। লোকজন কেউ নেই এত রাতে। জামাইবাবু কোন গাড়িতে আসবে তাও কিছু ঠিক নেই। সরিৎ মালদা থেকেই একটা চেন সঙ্গে করে এনেছে। খুব কাজের জিনিস। প্যান্টের পকেট থেকে সেটা বের করে একবার দেখে নিল। ধারেকাছে গঙ্গা নেই, তবে নিশ্চয়ই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। কী করতে হবে মেজদি তা বলে দেয়নি। রতনপুরে তার দু-চারজন বন্ধু হয়েছে। তাদের কাউকে সঙ্গে আনলেও হত। কতজনের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে তা তো জানে না।

আজকাল সরিতের পকেটে সিগারেটের প্যাকেট এবং দেশলাই থাকে। এতকাল থাকত না। বরাবর দুটো বা চারটে সিগারেট কিনে খালি প্যাকেটে ভরে রাখত। সিগারেট থাকলেও বেশির ভাগ সময়েই দেশলাই থাকত না। পথচলতি লোককে থামিয়ে তাদের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ধরিয়ে নিত। এমন সব উঞ্ছবৃত্তি আজকাল করতে হচ্ছে না। স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে বসে নিজের ভরা প্যাকেট থেকে সিগারেট ঠোঁটে তুলে নিজেরই দেশলাই দিয়ে সেটা ধরিয়ে খুব একটা আত্মতৃপ্তি বোধ করল সরিৎ। মাস গেলে এখন তার রোজগার সোয়া চারশো। মেজদির জন্য এখন জান দিয়ে দিতে পারে সে।

একটা ডাউন গাড়ি চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আপ গাড়িরও আলো দেখা যাচ্ছিল। গাড়ি থেকে অনেকজনাই নামল, কিন্তু শ্রীনাথকে দেখা গেল না।

হাই তুলে বসে বসে নিজের অবস্থার এই পরিবর্তনের কথা সুখের সঙ্গে ভাবছিল সরিৎ। আর কিছুদিন পর ইচ্ছে করলে সে বিয়েও করতে পারে। মালদায় দু-চারটে মেয়ের সঙ্গে তার ভাব হয়েছিল বটে। কিন্তু আজ, বেশ কিছু দূরে বসে এবং অনেকটা সময়ের পার্থক্যে সে আবেগহীন ভাবে বিচার করে দেখল সেই মেয়েদের কাউকেই তার খুব একটা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে না। বরং রতনপুর হাইস্কুলের একজন ছাত্রীকে তার চোখে ধরে গেছে। আলাপ-টালাপ অবশ্য হয়নি এখনও। কিন্তু সেটা কোনও ব্যাপার নয়।

আবার একটা আপগাড়ি হল। চলেও গেল। দুটো সিগারেট শেষ হয়ে গেল সরিতের। ফাগুলাল এসে বলল, গাড়ি কি গ্যারাজ করে দেব বাবু? আমার মেয়েটার জ্বর।

সরিৎ একটু কড়া চোখে চেয়ে বলল, আরও দুটো গাড়ি দেখব। তারপর যা হয় করা যাবে। এখন যা।

পরের গাড়িটাতেই শ্রীনাথ এল।

জামাইবাবু যে কলকাতায় ফুর্তি লোটে এ কথা সবাই জানে। জামাইবাবুর চোখে-মুখে ফুর্তি করার একরকমেব ছাপও পড়ে গেছে। প্রায় রোজই সামান্য নেশা করে আসে। আজও এসেছে। ঠিক মাতাল নয়, তবে খুব আয়েসে পা ফেলছে, শরীরে গা ছাড়া ভাব, চোখ লালচে এবং উজ্জ্বল।

গেটের কাছে শ্রীনাথের কনুইটা ছুঁয়ে সরিৎ ডাকল, জামাইবাবু!

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আরে তুমি?

ভচাক করে মদের গন্ধটা সরিতের নাক দিয়ে পেটে ঢুকে যায়। সেও এক সময়ে খেয়েছে এসব। তবু এখন গা গুলিয়ে উঠল।

শ্রীনাথের অহংকারী স্বভাবের কথা সবাই জানে। সরিৎ তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। জানলে মারাত্মক চটে যাবে। সরিৎ তাই সাবধানে বলল, এদিক