- বইয়ের নামঃ পাক সার জমিন সাদ বাদ
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ইতিহাস
পাক সার জমিন সাদ বাদ
আমরা ইছলামে জিহাদে বিশ্বাস করি। সব মুসলমানের জন্য এটা ফরজ। আমরা বিশ্বাস করি যতদিন না পৃথিবীর সমস্ত কাফের ইসলামে ঈমান আনবে, ততোদিন আমাদের জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে; জিহাদ পরম রাহমানির রাহিম আল্লাহর নির্দেশ, তা আমরা হরফে হরফে পালন করবো; নিজেদের বুকের খুন দিয়ে, কাফেরদের বুকের খুন নিয়ে। আমরা কোন ভণ্ডামোতে বিশ্বাস করি না; ভণ্ডামো হচ্ছে নাছারদের, মালাউনদের ধর্ম ও কর্ম; তবে অনেক ভন্ড আছে, যারা মুছলমানের ছদ্মবেশে প’রে আছে, তারা মহান আল্লাহর বাণীর ব্যখ্যা দেয় শয়তানের মতো,- তারা শয়তান, তারা শয়তানের ছহবতে উৎপন্ন; তারা বলে, ইছলামে আর গণতোন্ত্রে কোন বিরোধ নাই। যারা একথা বলে, তারা কাফের, তারা মুরতাদ। ইছলাম হচ্ছে আল্লাহর, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের নামে খানকিবৃত্তি হচ্ছে কাফেরদের, নাছারদের ইহুদীদের খ্রিষ্টানদের; কাফেরদের ধ্বংস করা হচ্ছে রাহমানির রাহিম আল্লাহতালার অকাট্য নির্দেশ। ধ্বংস করতে হবে নিরন্তর, নিদ্রাহীন, বিরামহীন জিহাদের মাধ্যমে।
আল্লা-রছুলের বাণী ঠিক বুঝিয়েছেন হজরত আবু আলা মওদুদি ও আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি, বেহেশতে তাঁরা শ্রেষ্ঠ স্থান পাবেন। এক সময় আমি সাম্যবাদ ও সর্বহারা করেছি- নাউজুবিল্লা,- মাক্স-এঙ্গেলস-লেলিন-ট্রটক্সি-স্ট্যালিন-মাওসেতুং নামের কতকগুলো ইবলিশ, শয়তান, ডেবিলের, মেফিস্তোর, বই পড়েছি; মনে করেছি শ্রেণীসংগ্রামই আসল কথা, সর্বহারার একনায়কত্ব স্থাপনই ইতিহাসের বিজ্ঞান-নাউজুবিল্লা; তারপর পাক ইছলামের পবিত্র কিতাবগুলো প’ড়ে বুঝতে পারি আমি কাফের হয়ে গিয়েছিলাম, বইগুলো পরা সহজ বুঝাও সহজ; কোন কচকচি নেই, আছে চরম সত্য, চরম নির্দেশ; আমি তওবা ক’রে ইছলামে ফিরে আসি, যেমন ফিরে এসেছেন আমার অনেক নেতা, প্রায় সব নেতা, যারা সাম্যবাদের জন্য নিজেদের কোরবানি করেছিলেন, এখন তাঁরা অন্য রকমে বলি হয়ে গেছেন। ওই কুফরি থেকে আমাকে উদ্ধার করে ‘জামঈ জিহাদে ইছলাম পার্টি। হজরত আবু আলা মাওদুদি ও আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনির কিতাব প’ড়ে আমি বুঝতে পারি খাঁটি ইছলামকে; আমরা দিল বদলে যায়, আমি পাক হয়ে উঠি, জিহাদি হয়ে উঠি।
আমার দিল বদলে যাচ্ছিল আগে থেকেই। আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনির লেখা প’ড়ে আমার দিল সৎ পথে ফিরে আসে; আমি জোশ বোধ করি, গোলগাল দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে আমার ঘেন্না লাগে-আল্লাতালার দুনিয়ায় এখনো এত কাফের, এত নাছারা, এত মালাউন! অথচ আল্লাতালা চৌদ্দো শ বছর আগে নির্দেশ দিয়েছেন জিহাদের। আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি বলেছেন, জিহাদ সমস্ত মুছলমানদের জন্য ফরজ, শুধু ল্যাংড়া আতুর কানা খোঁড়া ছাড়া; জিহাদ ক’রে সারা দুনিয়ায় ইছলাম প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে সব দেশের সব মানুষ ইছলাম মেনে চলে। কেনো ইছলাম সারা দুনিয়া জয় করতে চায়? তা বুঝার জন্য ইছলামের কিতাব পড়তে হবে, দিলে সেগুলোকে স্থির ক’রে রাখতে হবে। জিহাদই ইছলামের মর্মবাণী; যারা ইছলামের কিছুই জানে না, তারাই বলে ইছলাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে; তাঁরা মূর্খ তাঁরা ভণ্ড, তাঁরা হারামখোর।
আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি বলেছেন, ইছলাম বলে সব কাফেরদের কতল করো, যেমন তারা তোমাদের কতল করতে চায়। মুছলমানেরা কি ব’সে থাকবে? আর কাফেররা তাদের গিলে খাবে? ইহুদিরা তাদের গোস্ত খাবে? মালাউনরা তাদের মগজ খাবে? নাছারারা তাদের রক্ত খাবে? তা হতে পারে না। আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি বলেছেন, ইছলাম বলে তাদের কতল করো, তাদের বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দাও, তাদের ছিন্নভিন্ন করো। মানুষকে তলোয়ার ছাড়া বসে আনা যায় না, তাই তলোয়ার দরকার তলোয়ার হচ্ছে বেহেশতের চাবি। মহান আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি বলেছেন, যারা জিহাদ করতে চায় না, যারা ইছলামেরর যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়, তিনি তাদের মুখে থুথু দেন। আমি তাহেরির হোলি টেরর বইটি প’ড়ে, তাতে মহান আয়াতুল্লা রুহুল্লা খমেনির ব্যাখ্যা প’ড়ে আমি আমার ধর্মকে, পবিত্র ইছলামকে, বুঝতে পারি। জিহাদ হোলি টেরর, পবিত্র সন্ত্রাস- এটা এখন আমার জীবন।
ওই যে ডেবিল মাক্স-এঙ্গেলস-লেলিন- ট্রটক্সি-স্ট্যালিন–মাওসেতুংয়ের কিছু কাফেরি বই পড়েছিলাম, সেগুলি একদিকে আমাকে সাহায্য করেছিল। ওগুলোও টেররের বই, যদিও আনহোলি, নাপাক, অপবিত্র; তাই গণতন্ত্র নামের ধাপ্পায়, মানুষের অধিকার নামের খানকিবৃত্তিতে, বাকস্বাধীনতা নামের জেনায় আমি কখনো বিশ্বাস করি নি; তাই হোলি তেড়রে আমি খুব সস্তি বোধ করি, শান্তি পাই। আমার জীবনের একটি অংশ নষ্ট হতো না যদি আমার পশম গজানোর আগেই পেতাম আবু আলা মাওদুদি ও আয়াতুল্লার কিতাব। আমি তওবা করে আল্লাহর কাছে মাপ চাই; উদ্ধারের পথ খুঁজি। আমাকে পথ দেখায় জামাঈ জিহাদে ইছলাম পার্টি। এই পার্টি হচ্ছে অন্ধুকারের আলোকবর্তিকা, আমানিশার পর সোবে সাদেকের শামস।
আমাদের জামাঈ জিহাদে ইছলাম পার্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ, কৌশলগত ও অত্যন্ত গোপন বৈঠক বসেছে; মাঝেমাঝেই এমন বৈঠককে আমরা বসি, দুনিয়াকে নাছার মুক্ত করি, দেশকে পাক স্তান করি। এমন বৈঠক-এ-খাসে সব জিহাদি থাকে না, থাকেন প্রধান কয়েকজন নেতা এবং আমরা কজন,- আমরা কজন থাকবো সেটা ঠিক করার কাজ আমার, আমি এই স্তানের জিহাদিদের মধ্যে এক নাম্বার। দেশটাকে আমারা তন্ন তন্ন করে কয়েকটি স্তানে ভাগ ক’রে নিয়েছি, আমরা ভাগের স্থানের নাম ‘মদিনাতুন্নবি’, এইটিই প্রধান অঞ্চল; ইছলামে মক্কার থেকে যেমন বেশী গুরুত্বপূর্ণ উতরিব, যার নাম বদলে রাখা হয়েছিল মদিনাতুন্নবি। আমাদের পাক সার জমিনও শুরু হবে এই স্থান থেকেই।
আমরা পাক পবিত্র ইছলামি খুনে, আল্লাহর নামে খুনে, যার ফলে দেশ দখল করবো আমরা, তাতে বিশ্বাস করি; আমরা জানি খুন ছাড়া মহাসত্য কখনো প্রতিষ্ঠিত হয় না। আমরা বিছমিল্লা ব’লে খুন করি, বলি, ‘হে আল্লা রাহমানের রাহিম আপনার নামে খুন করিতেছি, আমাদিগকে বেহেশতে নছিব করিবেন। আর যদি ভুল খুন করি, তাহলে আমাদিগকে মাফ করিয়া দিবেন।‘ খুনে, ধর্মে, ও একটি মহৎ কর্মে- যাকে নাছারা ‘দুর্নীতি’ বলে, তাতে আমরা এখন আমরা দুনিয়া এক নাম্বর আসন অধিকার ক’রে আছি। তবে আসল কথা হচ্ছে স্তানকে ফিরিয়ে আনতে হবে, শরিয়া প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দেশ মুরতাদ ও ইহুদিতে ভ’রে গেছে, দেশ নাপাক হয়ে গেছে, একে আবার পাক করে তুলতে হবে। পাক পবিত্র স্তানকে ফিরিয়ে আনতে হবে। স্থান নেই ব’লে আমাদের দিলে শান্তি নেই; আমরা সব সময় স্তানের স্বপ্ন দেখি; স্তান থেকে খেজুর, বাশমতি চাউল এনে খাই, তাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলি, আমাদের লকলকে যুবতীগুলো তাদের দাড়িঅলা দাড়িছাড়া খেলোয়াড়দের চুমো খাওয়ার, দেহ দেয়ার জন্যে পাগল হয়, তাদের হোটলে গিয়ে চিৎ হয়। তাদের দুই চারটি মেজর-লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসে মাসে ছফরে না এলে আমরা দিলে সুখ পাই না। এভাবে আমরা একটু পাকের পরশ পাই। নাপাক ওয়াতানে বাস করা শুয়োরের গোস্ত খাওয়ার থেকেও হারাম। নাউজুবিল্লা।
আমরা একলা নই; আমাদের ভাইয়েরা আছে দুনিয়া জুড়ে, তাদের কাজ ক’রে চলেছে; কোথাও যদি কোন দালানের ওপর এরোপ্লেন ঝাঁপিয়ে পরে। যদি কোন গাড়ি হাসপাতালে হোটেলে ঢুকে সব কিছু চুরমাচুর ক’রে দেয়, যদি কোন প্রমোদকেন্দ্রে বোমায় ৩০০ জন মরে, তখন বুঝি সেটা আমাদের ভাইদের কাজ। এক অর্থে আমাদেরই কাজ। এটা জিহাদ। আমরা আমাদের কাজ ক’রে চলেছি; দেশ এক রকম দখলই করে ফেলেছি, পুরোপুরি করতে বাকি নেই। আমরা মেইন পার্টির সঙ্গে আছি, মেইন পার্টিতে আমাদের লোক আছে, মেইন পার্টিতে এখন আমাদের লোকই বেশী; তারা কাজ ক’রে যাচ্ছে; বেশী দিন নেই আমরা দেশটিকে আমাদের নিশানের নিচে, আমাদের পায়ের নিচে নিয়ে আসবো। আমাদের জিহাদ চলছে চলবে।
আলহজ মওলানা করিম আলি ইছলামপুরি
নেতা, আলহজ মওলানা করিম আলি ইছলামপুরি, এসেছেন।
এতেই বোঝা যায় আমার স্তানটি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, আমার কর্মকাণ্ড কতোটা সুদূরপ্রসারী, কতোটা সম্ভাবনাময়। তিনি মনে করেন। এখান থেকেই শুরু হবে নতুন ইছলামের, নতুন পাক স্থানের, পাক জমিন সাদ বাদের।
তিনি বললেন, ‘মনে কইরো তোমরা হইলা ইছলামের আনসার, ইছলামের রাজাকার, তোমরা হইলা আল্লার তালেবান, এইখন আমরিকার ইবলিশ ইহুদিরা আপগানিস্থান দখল করছে, তয় আমরা মরি নাই, জিহাদ আমাগো চালাই যাইতে হইব, আমরা এই দ্যাশে আপগানিস্থান হাছিল করুম, এইডা হইব আল্লার দ্যাশ। সারা দুনিয়াই হইব আল্লার রাইজ্য।‘
দু-নম্বর নেতা, আলহজ মওলানা রহিমুদিন রছুলপুরি, বললেন, ‘আই চ্যাডের না সোনার বাংলা গানডাও বন্দ করতে অইব, অইডা শোনলে আমার কইলজা থিকা খুন বাইর হয়, মালাউনদের গান অইডা, অইডারে বদলাইতে হইব, সেইখানে আল্লার রহমতে আবর আসব ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’।
পাক সার জমিন গানটা আমি ইস্কুলে গেয়েছি, এই লাইনটাই মনে আছে আমার, এর পরে কী আছে বা নেই, তা আমার মনে নেই; আমার সঙ্গে যারা নওজোয়ান জিহাদি তারা এই গান শোনেই নি। তারা এদিক ওদিক তাকায়, ব্যাপারটি বুঝতে পারে না।
এক নওজোয়ান জিহাদি জানতে চায়, ‘হুজুর, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ কী, এইডা কি আল্লাপাকের বাণী?’
রহিমুদিন রছুলপুরি একটু অবাক হন, জিহাদিরা আসল কথাটিই জানে না!
তিনি বলেন, ‘এইডা হইল দুনিয়ার সেরা সঙ্গীত, কোরানহাদিছের পরই এইডা, এইডা আমাগো পাকিস্থানের কওমিসঙ্গীত, এইডা আমরা ১৯৭১-এ হারাই ফেলছি, এইডা আমাগো ফিরাই আনতে হইব, আবার দ্যাশটারে পাকিস্থান বানাইতে হইব, হুকুমতে ইছলাম করতে হইব। তোমাগো লিগা আমি ১,০০০ পাক সার জমিনের ক্যাছেট লইয়া আইছি, আমাগো পাকিস্তানের মুরুব্বিরা দিছে, আরো দিব, তোমরা সব্বাই ফজরে জহুরে এশার পর অই ক্যাছেট বাজাইয়া শোনবা, দ্যাকবা তোমাগো মইদ্যে জোশ জাইগ্যা ওঠতেছে। ওই ক্যাছেট শোনালে ছওয়াব হইব।’
মওলানা নিয়ামত আলি বললেন, ‘এইর লিগা খুন করতে অইব, আমাগো পেয়ারা রচুলুল্লাও (দঃ) খুন করতে কইছেন, উতরিবের ইহুদিগো তিনি খুন না করলে ইছলাম টিকত না, উতরিব মদিনাতুন্নবি হইত না, ইছলামের জইন্য এইখন আমাগো দ্যাশের ইহুদিদিগকে খুন করতে হইব।’
জিহাদি মোঃ পিয়ার আলি জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আমাগো দ্যাশে ত ইহুদি নাই, ইহুদি কই পাম, ইহুদি দেখতে কোমুন?’
রহিমুদ্দিন রছুলপুরি দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘নাউজুবিল্লা, আস্তাগফেরুল্লা, পোলাপানরা অখনও খাডি মুছলমান অয় নাই, এলেম শিখে নাই, দ্বিন শিখে নাই, ইহুদি চিনে নাই; ইছলামের এক নম্বর শক্ৰ হইল অই ইহুদিরা, শুরু থিকাই তারা আমাগো শত্রু।‘
মওলানা নিয়ামত আলি একটি পান মুখে দিতে দিতে, চিলমচিতে থো থো করে পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘হজরত রছুলপুরি ছাহেব, আপনে অল্পেতেই বেচইন হইয়া যান, আপনের মতন হইলে আমাদের পেয়ার রছুলুল্লাও (দঃ) ইছলাম কায়েম করিতে পারিতেন না; এইরা পোলাপান, এইগো বুঝাইত হইব দ্যাশে ইহুদি কারা।‘
আমরা একদল পোলাপান ইছলাম আর পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের জন্য জান দিতে প্ৰস্তুত, আমি অবশ্য পোলাপানের পর্যায়ে পড়ি না। আমার অঞ্চলের হাফেজিয়া ফোরকানিয়া ও নানা রকম মাদ্ৰাছার–দারছই নিজামি কওমি মাদ্ৰাছা, সাধারণ মাদ্ৰাছার তালেবানে আমার ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম পাটি’ পরিপূর্ণ। তারা আমার সৈনিক, তারা জিহাদের জন্যে তৈরি।
এক নওজোয়ান জিহাদি জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আমাগো বুজাই দ্যান এই দ্যাশে ইহুদি কারা, তারা দ্যাকতে কোমুন?’
আলহজ মওলানা করিম আলি ইছলামপুরি বললেন, ‘বাজানরা, বুজলা না? আমাগো দ্যাশে ইহুদি হইছে মুরতাদরা, কয়েকটা কবি, ল্যাখ্যক আর বুদ্ধিজীবীরা, ওই ইবলিশগুলি, আর মালাউনরা, আর মালাউনগো দালাল পার্টির ইবলিশরা; অগো আগে শ্যাষ করতে হইব, তাইলেই আমরা আরব পাক সার জমিন সাদ বাদ আর ইছলাম ফিইর্যা পাইব, তার আগে আমরা থামুম না।’
‘মনে রাইখ্য তাগো দয়া করন যাইব না, পেয়ারা রাছুলুল্লা (দঃ) নিজের চাচা আবু লাহাব আবদুল উজ্জারেও মাফ করেন নাই; এইখনও আমরা সালাতে বলি, ‘আবু লাহাবের দুই হস্ত ধ্বংস হউক, এবং ধ্বংস হউক সে নিজেও—তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিও ওয়া তাব্বা।’
তাঁরা এক এক করে দীক্ষা দিতে লাগলেন।
দীক্ষার ব্যাপারটি আমি বেশ জানি, বারবার আমি দীক্ষিত হয়েছি, দীক্ষা মাদকের থেকেও শক্তিশালী; দীক্ষা দিতে হ’লে একই কথা বারবার শোনাতে হয়, মাথা ধুয়েমুছে সেখানে দীক্ষা ঢুকিয়ে দিতে হয়, যাতে অন্য কিছু আর সেখানে ঢুকতে না পারে।
‘বোজলা, ইছলামের নামে খুন করলে পাপ নাই, আর ইহা খুন না, ইহা হইল কাফের সরাইয়া আল্লার রাইজ্য স্থাপন; তাইলে জান্নতুল ফেরদাউছ পাওয়া যাইব, যেইখানে হুরদের লগে দিনরাইত ছহবত করতে পারবো। ইছলামের জইন্য একেকটা কাফের মারবা একেকটা হুর পাইবা, সোভানাল্লা।’
‘মুরতাদগো খুন করলে জান্নতুন ফেরদাউছ পাইবাম সেইখানে হুরদের সঙ্গে শরাবন তহুরা খাইয়া রাইত দিন কাটাইবা, সেইখানে ছহবত আর ছহবত করবা, দুনিয়ার ছহবতের থিকা অই ছহবত ৭০ কোটি গুণ মিঠা, সোভানাল্লা।’
‘সেইখানে তোমাগো জইন্য আছে গেলমান, কচি পোলা, তাগোও তোমরা পাইবা, কচি পোলার স্বাদের কোন তুলনা নাই, সোভানাল্লা।’
‘এই দুনিয়ায় মালাউন মাইয়াগো জেনা করলে দোষ নাই, গুনাহ নাই, তারা হইল গনিমতের মাল, এই বয়সে তোমাগো ছহবত করনের দরকার, মালাউনগো মাইয়াগো লগে করবা, তাইতে গুনাহ নাই, সোভানাল্লা।’
মালাউনগো দ্যাশ থিকা খ্যাদাই দিতে হইব, মুরতাদগো জান কবজ করতে হইব, তা হইলেই ইছলাম আসব—তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিও ওয়া তাব্বা।‘
‘মাইয়ালোকগো, ঘর থিকা বাইর হইতে দেওয়ন যাইব না।’
‘মাইয়ালোক হইল শয়তান, ফিৎনা, গোলমাল, মাইয়ালোক আদমরে গন্দম খাওয়াইছিল, নাইলে আমরা এইখনে ভেস্তে থাকতাম, মাইয়ালোকের জন্যেই আমাগো পতন ঘটছে; এইখন হেরা পরপুরুষ দ্যাকলেই ছহবত করতে চায়, ছহবত ছাড়া তাগো দেহ আর কিছু চায় না, তাগো বিশ্বাস করব না, বোরকা পইর্যা স্বামীর পাশে বইস্যা ফাঁক পাইলেই তারা অন্য পুরুষগো দিকে চায়, দিলের জিন্না করে, আস্তাগফেরুল্লা।’
‘আপগানিস্থানে মাইয়ালোকগো যা করছিলেন মহান তালেবানরা, তা-ই হইল আসল ইছলামি নিয়ম, আমরা সেই নিয়ম করুম; অখনও আমাগো মুরুব্বি পাক সৈদি আরবে মাইয়ালোকগো বোরকা ছাড়া বাইর অইতে দেয় না, গাড়ি চালাইতে দেয় না, ইহাই সাচ্চা ইছলাম, আমরা অই আসল সাচ্চা খাডি ইছলাম কায়েম কারুম। ইছলামে মাইয়ালোক স্বাদিন থাকিব পুরুষের অধীনে থাইক্কা, আলহামদুলিল্লা, আল্লা রাহমানির রাহিম।’
‘এইখন দ্যাশ মাইয়ালোকে চালায়, এক মাইয়ালোক যায়, আবার আরেকটা মাইয়ালোক আসে, নাউজুবিল্লা, মাইয়ালোকের অধীনে থাকা হাবিয়া দোজগে৷ থাকার থিকাও কষ্টের, এইটা হারাম; মাইয়ালোক নিচে থাকিব, ওপরে থাকতে পারব না; তয় মাইয়ালোকের রুল আমরা মাইন্যা নিয়াছি ট্যাক্ট কইর্যা, ট্যাক্ট ছাড়া কাম হয় না, ইছলামের শুরুর সোমও ট্যাক্ট করতে হইছিল ইহুদিগো লগে, পরে আমরা ইহুদিগো কচুকাডা করছিলাম, অগো গদে হালাইয়া মাডি চাপা দিছিলাম, অগো মাইয়া ও মাইয়ালোকগুলিরে বান্দী বানাইছিলাম, অগো ঘরবাড়ি জমিজায়গা দখল করছিলাম, এইখন আমরা সেই রকম ট্যাক্ট করছি; সময় আসলে আমরাই দ্যাশ দখল করুম, দিন দিন দখল করতে আছি, ট্যাক্ট ছাড়া হইব না; একদিন ঘরে ঢুকাই দিমু, তোবা করামু।’
‘মনে রাইখ্য ইছলাম হইতেছে একমাত্র সলিশন, ইছলাম ছাড়া আর সলিশন নাই; আমরা কম্যুনিস্টগো কবর দিছি, ডামোক্ৰেছিরেও কবর দিমু, কবর খোড়তে হইব তোমাগোই। তোমরা হইতেছে তার সিপাহি, তার জেনারেল, তার মুহাম্মদ বিন কাশিম, বকতিয়ার খিলজি, মুসা, তারিক।’
‘এই আন্দোলনটা দিয়া দ্যাশ কাপাই দিতে হইব তোমাগো, ইছলামের দিকে আমরা দশ কদম আগাই যাইব, পাক স্থানের দিকে বিশ কদম আগাইব, আমরা আবর পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইতে পারুম। অনেক বছর না গাইতে গাইতে এই মহান গানডার দুই নম্বর লাইনডা আমিও ভুলিয়া গেছি।’
আমি বলি, ‘তুনিশানে আজমে আলিশান…’
তিনি বলেন, ‘হ, হ, মাশাল্লা, সোভানাল্লা, তুমি হইলা আসল জিহাদি, এইর লিগাই ত শ্রেইষ্ঠ স্তানের ভার তোমারে দিয়াছি।’
মওলানা নিয়ামত আলি বললেন, ‘দ্যাখ, দ্যাশে আরও অনেক জিহাদি ইছলামি পার্টি আছে, ধরো জঙ্গি আলি খিদমতরা, জঙ্গি জামতুল পার্টি, হিযবুত পার্টি, হিযবুত তৌহিদ পার্টি, ইছলামুন পার্টি, তেলায়াতে আল কুরআন পার্টি, বেরাদারানে ইছলাম পার্টি, এমুন আরও নানা পার্টি আছে, ওইগুলির মইদ্যে দুই চাইরটা ভণ্ড আছে, তয় ওইগুলির অনেকগুলিই আমাগো, নানা নামে আমরা দ্যাশে তাগো ছাইর্যা দিছি, তারা আমাগো কামই করতেছে। সময় আসলে ওইগুলির দুই-তিনডোরে শ্যাষ কইর্যা দিতে হইব, আসল কয়ডারে আমাগো মইদ্যে মার্জ কইর্যা লইতে হইব, যারা আসল জিহাদি।’
করিম আলি ইছলামপুরি বললেন, ‘পাওয়ার আমাগো দখল করতেই হইব। এইখন আমরা পাওয়ারের লগে আছি, মেইন পার্টির সহিত আছি, এক সোম পাওয়ার আমাগো হইব, আমরাই হইব মেইন পার্টি, সবখানে আমরা ঢোকতেছি, ইছলাম হইব, পাকিস্থান হইব, দ্যাশে মুরতাদ থাকিব না, মালাউন থাকব না, মুছলমানের চেহারা লইয়া মালাউন ইহুদি থাকব না, ইনভার্ছিটি থাকব না, ইনভাৰ্ছিটি হইতেছে জিনাখানা, অইখানে পোলা-মাইয়ারা একলগে বসে, হাডে, ফিরে, শয়তান তাগো মাজখানে থাকে, আস্তাগফেরুল্লা।’
তিনি আরো বলেন, ‘তয় ইনভাৰ্ছিটি, ইনজিনিয়ারিং ইনভাৰ্ছিটি, মেডিকেল ইনভাৰ্ছিটি এইসব এইখন আমাদের দখলে, সব জায়গায়ই আমাগো লোক৷’
‘ইনভাৰ্ছিটির দিকে চাইয়া দেখ, কি দেখ–মাইয়ালোকরাও আমাগো লগে, মাসে মাসে ওইখানে বোরখা দিতে হয়, হিজাব দিতে হয়; আগে স্কুল কলেজ ইনভাৰ্ছিটিগুলিতে আমরা বছরে দশ হাজার বোরকা হিজাব দিতাম, মারহাবা, এই বছর দশলাখ বোরকা হিজাব দিছি। বোরকা হিজাবের ডিমান্ড থিকাই আমরা বুজতে পারতেছি আমরা পাক স্তানের দিকে আগাইতে আছি, আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্ল।‘
তিনি আরো বলেন, ‘টেলিভিশনেও আমরাই আছি, চাইয়া দেখ, ফজর থিকা এশা পর্যন্ত আমরাই ওয়াজ করতেছি, মাজ রাইতেও ওয়াজ করতেছি, আর মারহাবা, আমাগো বিবিজানরাও, আওরতরাও, কি সোন্দর ওয়াজ শিখছে, মাশাল্লা, হিজাব পইরা ঠোডে রাঙ্গা লিপিসিন্টক মাইখ্যা ভুরু প্যালাক কইর্যা, মারহাবা, মাছকারা মাইখ্যা, দুই চোকে প্যালাসটিকের পাপড়ি লাগাইয়া তারা ইংরাজি বাঙলা আরবি উর্দু মিলাইয়া মিশাইয়া ওয়াজ করতেছে। তাগো ওয়াজ দেইখ্যা শুইন্যা আমিই নতুন কত মছলা শিখতে আছি, সোভানাল্লা।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেই মাইয়াগুলি আগে দুদ ফুলাইয়া পাছা দুলাইয়া কোমর নাচাইয়া মার্কেটিংয়ে যাইত, তারা এইখন বোরখা হিজাব ছাড়া বাহির হয় না। মমিনরা বল, মাইয়ালোক উচা দুদ ফুলাইয়া আর চওরা পাছা দুলাইয়া রাস্তায় বাহির হইলে কোন মমিন না পাগল আয়? মমিনের পক্ষে তখন জেনা না কইর্যা উপায় থাকে না। অহন আর সেই অবস্তা নাই।‘
‘আরও মাশাল্লা, আর কয়দিন পর তারা কাবিনও চাইব না, একটা লোয়ার আংটি হইলেই হইব; স্বামীগো চাইরটা বিবি রাখতে দিব। স্বামীরা আবার তালাক দেওনের ক্ষমতা ফিইর্যা পাইব, যার তালাক দেওনের ক্ষমতা নাই, সে পুরুষ না, যার দুই তিনডো বিবি নাই, সে খাটি মুছলমান না, আলহামদুলিল্লা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা হিশাব নিয়া দেখছি বিশ বচ্ছর আগে ইনভার্ছিটি কলেজের বিশজনও মছজিদে যাইত না, এইখন শতকরা নব্বইজন ছাত্র আর মাস্টার মছজিদে যায়, শুকুরবার দৌড়াদৌড়ি পইর্যা যায়, আমরা খবর নিছি আগে ইনভাৰ্ছিটি কলেজের শতকরা ৯৯ জন ছাত্ৰমাস্টার খাড়াইয়া মুততো, এখন ৯৯জন বইস্যা মোতে, ঢিলা কুলুপ লইয়া চল্লিশ কদম হাডে; ইনভাৰ্ছিটিগুলির মুতাগারে এইখনে আমরাই ঢ়িলা কুলুপ সাপ্লাই করি, বচ্ছরে ষাইট টন টিলা কুলুপ সাপ্লাই করি। ইনফেকশন ফ্রি ঢিলা কুলুপ। আমরা সাকসেকফুল হইতেছি, পুরা সাকসেসফুল হইতে বাকি নাই, ইনশাল্লা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আস্তাগাফেরুল্লা, আগে আয়জানের সোমও মুরতাদরা গানবাইদ্য করত, পাছা দুলাইয়া ঢেমনি মাইয়াগুলি নাচত, সোভানাদুল্লা, এইখন কি দেকাতেছি, আয়জন দিলে সব চোপ অইয়া যায়, নাচ বন্দ হয়, গান বন্দ অয়, এমুন্ন কি যেই বেলেহাজ মাইয়াগুলি মগরবের সোম নানান ইনভাৰ্ছিটির সামনে বইস্যা ছ্যামরাগে লগে পীরিত করে, ডলাডলি করে, কাপোড় নাপাক কইর্যা ফালায়, হেরাও এইখন আয়জন শোনলে মাতায় কাপোড় তুইল্যা দেয়, ডলাডলি বন্দ কইর্যা দেয়, মজনুগো হাত সরাইয়া দ্যায়, সোবাহাল্লা, আমরা আগাই যাইতেছি, বেশি দেরি নাই পাক স্তান কায়েমের।’
‘সোভানাল্লা, এককালের কম্যুনিস্টরাও আমাগো লগে জয়েন করছে, হেরা অহন পাক স্তান আর ইছলাম ছাড়া কিছু বোজে না, আলহামদুলিল্লা, গত কয় মাসে আমি দশগণ্ডী কম্যুনিস্টরে তোবা পড়াইছি। কম্যুনিস্টরাও জিহাদে বিশ্বাস করতো, শ্রেণীসংগ্রামের জিহাদ, ক্যালাশস্ট্রাগলের জিহাদ, এইখনে তারা নিজেগো ভুল বুজতে পারছে, খাডি জিহাদে ফির্যা আইছে। দ্যাহ নাই, ১৯৭১-এ একদল কম্যুনিস্ট আমাগো লগে কাম করছে, সোভানাল্লা।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডাক্তারগো ক্লিনিকে আর চেম্বারে গেলে এইখন মানুষ কি দ্যাকতে পায়? নাছারাগো কোনো বই দোকতে পায় না, দেখে আমাগো পরম মুরব্বি সৌদি রাজার উপহার দেওয়া আল কুরআন। ইঞ্জিনিয়ারগো অফিশে গ্যালে কি দেখে, দেখে আমাগো পরম মুরব্বি সৌদি রাজার উপহার দেওয়া আল কুরআন। আল্লার রহমতে নাজাতের আর দেরি নাই, আলহামদুলিল্লা।’
আমি এক সময় মার্ক্সবাদ করেছি
আমি এক সময় মার্ক্সবাদ করেছি, সাম্যবাদী ইশতেহার পড়েছি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ছাড়া আর কিছু বুঝি নি, সব কিছু ব্যাখ্যা করেছি মার্ক্স-এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ভাষায়, হেগেলকেও টেনে এনেছি; বলেছি, কম্যুনিষ্ট ইশতেহার হচ্ছে শ্ৰেষ্ঠ বই, শ্ৰেষ্ঠ ঘোষণা, নেতাদের সঙ্গে শ্লোগান দিয়েছি পথে পথে, কিছু পাই নি; আমাদের নেতারা রাশিয়ার ভোদকা আর চীনের বিড়ি পেতো, আমি তাও পাই নি; আলহজ এরশাদের সময় আমার নেতারা যখন তার পা চাটতে শুরু করে, মন্ত্রী প্ৰধান মন্ত্রী হতে শুরু করে, আমার ঘেন্না লাগে; তখন আমি সর্বহারা দলে যোগ দিই, এখানে সেখানে দু-একটি খুন করি, ডাকাতি করি—করতে ভালোই লাগে, দু-একটি মেয়েকে ধর্ষণ করি, আমি ঠিক ধর্ষণের মতো করি নি, তাদের আমি রাজি করাই, প্রথমে ছেড়েই দিই, তারপর থেকে তাদের সঙ্গে আমার কয়েকবার দৈহিক সম্পর্ক হয়, আমি ঠিক মতো পেরে উঠি নি, তারা সবাই বলে, ‘তুমি পারো না’, তখন আমি পারতাম না, এখন পারি, আমি ধীরেসুস্থে পারতে শিখেছি, তারপর আমি যোগ দিই ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম পার্টিতে। আমি মুক্তির পথ খুঁজে পাই, জীবন পাই।
জামাঈ জিহাদে ইছলাম আমাকে উদ্দীপ্ত করে, আমি প্ৰচণ্ড উত্তেজনা বোধ করি, ওই উত্তেজনা দেহের বিশেষাঙ্গের উত্তেজনার থেকে অনেক বেশি তীব্ৰ, অনেক বেশি প্রচণ্ড, আমি দেখতে পাই আমি বেঁচে উঠছি, আমি বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। মওলানা মওদুদি, ইমাম গাজালি, আয়াতুল্লা খোমেনির বই, আর কোরান-হাদিছ, নেয়ামুল কোরআন, মুকছোদুল মামেনিন, বেহেস্তের জেওর পড়ে আমি বুঝতে পারি। এতোকাল আমি ভুল পথে ছিলাম, দোজগের রাস্তায় ছিলাম, এখন আমি ঠিক পথে এসেছি; এখানে সব সময়ই খোয়াব, সব সময়ই উত্তেজনা; পৃথিবীতে মুছলমান আর ইছলাম ছাড়া আর কিছু থাকবে না, এ-বিশ্বাস আমাকে মাতাল ক’রে তোলে–নাউজুবিল্লা, ‘মাতাল’ শব্দটি ঠিক হয় নি, আল্লা আমাকে মাফ করবেন; এ-সময়ই আমি একটি চমৎকার জীবন পাই। যখন মার্ক্সবাদী ছিলাম, যখন সৰ্বাহারা ছিলাম, তখন আমার কোনো জীবন ছিলো না; জামাঈ জিহাদে ইছলামে যোগ দেয়ার পর আমি প্ৰায় সবই পাই, বেহেশত তো পাবোই। যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি জামাঈ জিহাদে ইছলাম-এর ‘মদিনাতুন্নবি’ অঞ্চলের নেতা হয়ে উঠি, আমার খুব চেষ্টা করতে হয় না; আমার প্ৰধান নেতারা বুঝতে পারেন যে-তিরিশটি মাদ্ৰাছার তালেব এলেম নিয়ে এআঞ্চলিক সংঘটি গঠিত, ওই সব হাফেজিয়া ফোরাকানিয়া কওমি কামিল দাখিল সাধারণ মাদ্ৰাছার তালেবানদের মাথায় ঘিলু নেই, যেমন তাদের মাথাও নেই, তাদের মগজ অন্য জায়গায়; তাই যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নেতা হয়ে উঠি, যা আমি কখনো হই নি।
নেতা হওয়ার মতো সুখ ও স্বাদ ও কাম আর নেই।
শুধু ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ— টাকা, তা আমার হাতে অঢেল আসতে থাকে–টাকা যে পানির স্রোতের মতো নানা খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা আগে আমি জানতাম না, এখানে এসে দেখি নানা খাল দিয়ে ঢেউ তুলে টাকা আসছে আমার দিকে। ক্ষমতা ও টাকা মানুষকে মহাপুরুষে পরিণত করে, অমরতা দেয়। মার্ক্সবাদে আমার পকেটে একটা আধুলিও আসতো না, সর্বহারা ডাকাতির সময় আসতো দু-তিন হাজার টাকা, কিন্তু তখন সব সময় বিপদের ভয়ে থাকতে হতো, এখন কোনো ভয় নেই; এখানে নেতা হওয়ার পর আমার হাতে আসতে থাকে লাখ লাখ টাকা। টাকা যে কতো সুন্দর, রূপসী, শাশ্বতী, তা আমি বুঝতে পারি নেতা হওয়ার পর থেকে; অস্ত্ৰ কেনার পর, ইছলামের সিপাহিদের টাকা দেয়ার পর, আমার বাক্সে পড়ে থাকতে শুরু করে লাখ টাকা। আল্লা আর পাক স্তান ছাড়া এতো টাকা আমাকে কে দিতে পারতো?
টাকা পেয়ে আমি একবার নফল নামাজ পড়ি, প্রতিদিনই পড়তে হয়; পড়ে আমি সুখ পাই। দিলে শান্তি পাই। আর আসতে থাকে ব্ল্যাক লেভেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন–এগুলোর নামও আগে আমি শুনি নি; সাম্যবাদের কালে মেথরূপট্টিতে যেতাম ব্যাটারি ভেজানো ধেনো খেতে, ওগুলো খাওয়ারও পয়সা ছিলো না; না থেকে ভালোই হয়েছে, বেশি খেলে এতোদিন থাকতাম না, লিভার সিরোসিসে চলে যেতাম। এখন ব্ল্যাক লেবেল, সিভাস রিগাল, ব্যালেন্টাইন ছাড়া অন্য সব আমার কাছে ভিখিরির লাল মূত্ৰ মনে হয়।
আমরা দুটি অসামান্য কর্মকাণ্ড গ্ৰহণ করেছি, যা দেশকে বদলে দেবে।
আজকে আমাদের আন্দোলন ‘ভৈরব’ উপজেলার নাম বদলের; আগামীকাল আন্দোলন ‘শ্যামসিদ্ধি’ গ্রামের নাম বদলের; আমরা দুনিয়াকে খোলনলচেসহ বদলে দেবো। ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটি নামই আমার ছেলেবেলা থেকে প্রিয়, কিন্তু তাতে কি, ভৈরব আর শ্যামসিদ্ধি দুটিই পৌত্তলিক নাম, মালাউন নাম, এই নাম আমি আর মানতে পারি না, এটা শিরক; আর শ্যামসিদ্ধির ওই মঠটি, যেটিকে দূর থেকে একবার না দেখলে ছেলেবেলায় আমার ঘুম হতো না, ওটিকে আমার মনে হয় ইছলামের ওপর পাক স্তানের ওপর আমার দিলের ওপর একটা শরকির আঘাতের মতো, লাৎ মানৎ উজ্জা যেনো এখন কাবাঘর ছেড়ে এসে বাস করছে মঠটিতে–মঠটি ভেঙে একটি মসজিদ তৈরি করতে হবে; ওখানে আমি একটি আল আকসা বা বায়তুল মোকাররাম দেখতে চাই।
ওই মঠটির দিকে তাকালি আমার এক সময়ের প্রিয় পরম শ্রেদ্ধেয় মহান অদ্বিতীয় সানগ্লাস জেনারেল নেতাকে মনে পড়েন। তিনি আমার হৃদয়ে সব সময় আছেন, সব সময় থাকবেন। আমি তাঁর দলে যোগ দিই নি, দিতে পারি নি, দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার সাম্যবাদী নেতাদের পায়ের চাপে বারবার পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম; তিনি পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমরা কঁপিছিলাম, তিনি হঠাৎ বক্তৃতা বন্ধ করে ডান হাতের তর্জন আমাদের বায়তুল মোকাররামের দিকে স্থির করে রাখেন।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই, তাঁর আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকি, নিশ্চয়ই ওই আঙুলি কোনো গভীর বাণী প্ৰকাশ করছে।
তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকেন কয়েক মিনিট, আমাদের মনে হয় তিনি হাজার হাজার বছর ধরে স্তব্ধ হয়ে আছেন, তার বদলে কথা বলছে তার জ্যোতির্ময় তর্জানি। আমি তাঁর তর্জনির ভাষায় কাঁপতে থাকি। সব কিছুরই ভাষা আছে; কিন্তু তর্জন যে এতো অর্থ প্ৰকাশ করতে পারে, যে-অর্থ আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিলো না, ওই বিরাট নীরব নিঃশব্দ অর্থের মুখোমুখি আমরা নিজেদের অসহায় বোধ করছিলাম—মহাঅর্থের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
এক সময় তিনি বলে ওঠেন, ‘চ্ছি-ল-না।’
আমরা বিস্মিত শিহরিত উত্তেজিত হয়ে ভাবতে থাকি কী ছিলো না?
আমরা কী ক’রে জানবো?
তিনি বলেন, ‘চ্ছি-ল-না, আল্লাহু আকবর ছিল না; বায়তুল মোকাররামের উপরে আপনারা যে ‘আল্লাহ আকবর’ দেখতেছেন, তা ছি-ল-না; আল্লাহু আকবর ওয়াজ নট দেয়ার।‘
আমাদের বুক থেকে একটি পাহাড় নেমে যায়, আমরা নিশ্বাস নিই।
আমরা বোধ করি তিনি কতো মহান, কতো অসাধারণ, তিনি কতো বড়ো দ্রষ্টা; আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশই ছিলো না আমাদের সবচেয়ে বড়ো জিনিশের ওপর, আমরা বুঝতে পারি নি, বুঝেছিলেন আমাদের মহান নেতা, সানগ্লাসের ভেতর দিয়েও তিনি তা দেখেছিলেন। তাঁর সানগ্নাস ছিলো দূরদৃষ্টির সানগ্লাস, পৃথিবীতে ওই সানগ্লাস একটিই ছিলো।
সত্যিই তো, এতো দিন আমরা খেয়াল করি নি, বায়তুল মোকাররামের ওপর আল্লাহ আকবর ছিলো না; মহান নেতার তা চোখে পড়েছে, তিনি সেখানে আল্লাহ আকবর বসিয়েছেন, যা রাতে জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলে রাহমানির রাহিমের গৌরব ঘোষণা করছে; মহান নেতা ইছলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন; তার থেকে বেশি। প্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের। মহান আল্লাতালা এখন নিশ্চয়ই তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে রেখেছেন। তিনি হয়তো সেখানেও সানগ্লাস পরে তাকিয়ে আছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আল্লাহু আকবরের দিকে, আর আমাদের দিকে, আমরা যারা পাক স্তান প্রতিষ্ঠা করবো, পাক সার জমিন গাইবো।
ওই ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে আছে; আমি শ্যামসিদ্ধির মঠটি ভেঙে ফেলবো, বা সেটিকে মসজিদ বানিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখবো ‘আল্লাহ আকবর’, যা মহান রাহমানির রাহিমও দেখতে পাবেন। তিনি অবশ্য সবই দেখেন, একটি পোকাও তাঁর চোখের বাইরে নয়।
তবে মালাউনদের দু-একদিন সময় দিতে পারি, একটু দয়া করতে পারি।
যদিও আন্দোলন আমাদের আজই করতে হবে, আন্দোলন কাজ করতে আমরা পারি না, দয়া ক’রে ওদের একটু সুযোগ দিতে পারি। কী সুযোগ দেবো? গতকাল রাতে আমার জিহাদিদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি, তখন ভিডিওতে এক্সএক্সএক্স চলছিলো, ডেঞ্জারাস জিনিশ, লাস্ট ফর ডগ্জ্, তারপর ইন্ডিয়ান জিফনিশ–এখন আমরা আর ফ্যাটফ্যাটে শাদা বেহায়া বেলেহাজ মেয়েগুলোর চোষাচুষি, পাছা মারামারি, ডাবল ট্রিপল স্ক্রু মারা দেখে এক্সাইটেড হই না, অনেক দেখেছি, সবই একই রকম, রাবিশ, পানসে, আমাদের পছন্দ মালাউন গুড্স্, সাউথ ইন্ডিয়ান আর মুম্বাইর–ইন্ডিয়ান এক্সএক্সএক্স দেখে আমরা সঙ্গে সঙ্গে খাড়া হই, শাদা মাইয়াগুলো দেখলে হই না, ওইগুলোর দেহে কোনো স্বাদ নেই, ওগুলো ব্লাডার ও পাম্পারের অটোমেটিক মেশিন; ওগুলো দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়ছিলে দুৰ্গা, বকুলমালা, কণকলতা, সরস্বতী, রমা, সীতা, উৰ্মিলা, মাধুরী, শুভঙ্করী, কৃষ্ণকলি, আর কী কী যেনো ওদের নাম, সেই ডবকা মেয়েগুলোকে, যদি ওদের এবং আরো কয়েকটিকে পাই, একা আমি পেলে তো হবে না, তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, জিহাদি মোঃ কেরামত আলি, জিহাদি মোঃ মোস্তফা, জিহাদি মোঃ আকবর আলিকেও ভাগ দিতে হবে, তাহলে মালাউনদের কয়েকটি দিন দিতে পারি, কয়েকটি দিন।
জিহাদিদের একটি মহান গুণ হচ্ছে তারা মালাউন মেয়ে পছন্দ করে।
আমিও করি, ওদের একটু খেলাতে পারলে ওরা উর্বশীদের মতো নাচে; আমার জিহাদিরা অবশ্য নাচটাচ পছন্দ করে না, ওরা ঢুকতে বেরোতে পারলেই শুকরিয়া আদায় করে। এতে প্ৰধান প্রতিভা তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, ও হয়তো ফেরেশতাদের কাছে থেকে বিশেষ কোনো হালুয়া লাভ করে; তবে মোঃ কেরামত আলি, মোঃ মোস্তফা, মোঃ আকবর আলিও কম যায় না, এটা আমি পছন্দই করি, জিহাদে কোনো কম যাওয়া-যাওয়ি নেই, তাতে জোশ কমে যায়। ওরা যখন একেকটি মালাউন মেয়ের ওপর চড়ে, তখন ওরা মনে করে ওরা একেকটি নাছারা নগর ধ্বংস করছে, যার নির্দেশ রয়েছে। আমি আশ্চর্য হই, ওরা রুহুল্লা খোমেনির কিছুই পড়ে নি, কিন্তু চিন্তা ও কর্মে তাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মালাউন মেয়েগুলোর গন্ধ আমার ভালো লাগে, ব্ৰাহ্মণ হোক আর চাঁড়াল হোক আর কৈবর্ত, যাই হোক, ওগুলোর গন্ধ ভালো, একটা তীব্ৰ প্ৰচণ্ড দমবন্ধ করা মহাপার্থিব গন্ধ ছুটে আসে। ওদের স্তন থেকে, বগলের পশম থেকে, উরু থেকে, ওদের কুঁচকির ঘামেও অদ্ভুত সুগন্ধ; হয়তো গাদা তুলসি রক্তজবা পদ্ম, বকুল শেফালি গন্ধরাজ ফুলের সঙ্গে ওদের একটা সম্পর্ক আছে বলে, আর ওরা ক্ৰীড়া করেও ভালো, মনে হয় ওদের প্রত্যেকেরই কামসূত্র মুখস্থ; এমনকি কৈবর্ত মেয়েগুলোর গন্ধও আমাকে পাগল করে, আমি কৈ আর গজার মাছের গন্ধ পাই, মনে হয় পুকুরে ডুব দিয়ে কাদার ভেতর থেকে মাছ ধরছি।
ওই সময়টায় সবাই আমাদের অসামান্য কর্মকাণ্ড সবাই দেখেছে, কিন্তু কেউ একটু টু শব্দ করার সাহস পায় নি; তখন অবশ্য আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।
আমাকে ছুটে চলতে হয়েছে আমার মদিনাদুন্নবি থেকে, রিয়াদ, কান্দাহার, বাগদাদ, তিকরিত, বসরা প্রভৃতি অঞ্চলে–এই অঞ্চলগুলো আমাদের সাংকেতিক নাম, সব মহান কাজেই প্ৰথম সাংকেতিক নাম লাগে, সিম্বল লাগে। তখন একটা অসামান্য মজার সময় এসেছিলো, তখনই আমরা আমাদের শক্তিটাকে পাথরের মতো করে তুলি, যে পাথর আমাদের দিল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। নির্বাচনটিাৰ্বাচনে, ইলেকশনটিলেকশনে, আমরা বিশ্বাস করি না, ওটা আমাদের পাক ধর্মে নেই, তবু আমরা অংশ নিয়েছি মেইন পার্টির সঙ্গে; মেইন পার্টির কর্মী আর আমাদের ওপর দুটি নির্দেশ ছিলো, ভোটের দিন মালাউনদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হবে না; আর জানতামই যে আমরা জিতবো–আমাদের নেতারা ওপরের দিকে সব কাজ চমৎকারভাবে ক’রে রেখেছিলেন, তত্ত্বাবধায়কদের তারা তত্ত্বাবধান করছিলেন; আমরা জানতাম জিতবোই; জেতার পর আমাদের কাজ ছিলো একদিন চুপ করে থাকা, তার পরের দিন থেকে মালাউন আর তাদের দালালদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ঝাঁপিয়ে পড়া শব্দটি ঠিক হলো না, আমাদের কাজ ছিলো শান্তির ঠাণ্ডা আগুন জ্বালানো, যা জ্বলে না, দহন করে।
আমার ভাগে পড়েছিলো মালাউনরা; আমিই বেছে নিয়েছিলাম।
আমি আমার জিহাদিদের আর মেইন পাটির জোয়ান খিলজিদের নিয়ে প্রথম ১৮টি মালাউনপল্লী চিহ্নিত করি–সীতারামপুর, হরিরামপুর, মদনগঞ্জ, মদনপুর, ব্ৰাহ্মণভিটা, কালীগঞ্জ, আর কী কী যেনো নাম–ওই নামগুলোকেও বদলে দিতে হবে; এবং বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করি। আমরা ভালো ক’রেই জানি ওরা কাফের, ওরা কাফেরদের বাক্সে ভোট দেবে; ওদের ভোট দেয়া চিরকালের জন্যে বন্ধ করে দিতে হবে। ওরা ভোট দেবে কেনো; ওরা দেবে জিজিয়া কর, ওরা আমাদের জিম্মি, আমরা ওদের রক্ষা করবো, তার জন্যে। ওরা কর দেবে।
আমি এ-ব্যাপারে সম্রাট আওরঙ্গজেবকে আদর্শ মনে করি।
আমরা তাদের পাড়ায় পাড়ায় যাই, আমাদের দেখেই তারা কেঁপে ওঠে। সালাম দিয়ে আমরা তাদের বাড়ি উঠি, তারা নমস্কার’, ‘আদাব’ বলে ব’লে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সবচেয়ে উৎকৃষ্টভাবে বলে, ‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম’।
আমিও এখনো তাদের মতো শব্দটি বলতে পারি না। আমাদের কোথায় বসাবে তা ঠিক করতে পারে না, চেয়ার টুল বেঞ্চ নিয়ে টানাটানি করতে থাকে, যদিও বসার দরকার আমাদের ছিলো না। একদিন আমরা বসবো, চড়বো, চেয়ার বেঞ্চের ওপর নয়, আরো কোমল সুখকর জিনিশের ওপর।
আমি বলি, ‘মহাশয়েরা, আপনারা কেমন আছেন, তা দেখতে এলাম; ভালো আছে সবাই?’
একেকজন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘সেইটা আমাগো ভাইগ্য, আপনেরা আমাগো বাড়িতে আসবেন, কোনদিন চিন্তাও করতে পারি নাই, আপনাগো পায়ের ধুলায় আমগো বাড়ি পবিত্র হইল।‘
আমাদের অনেকের জামার ভেতর থেকে নানা রকমের শান্তিপ্রদ জিনিস উঁকি দিচ্ছিলো–দু-একটা পিস্তল, দু-একটা কাটা রাইফেল, দু-চারটি ক্ষুর, কয়েকটি এম-১৬, আর বেশি না।
আমি বলি, ‘আপনাদের ভোটার তালিকা দিতে এলাম, যাতে ভোট দিতে আপনাদের কষ্ট না হয়।’
একেকজন বলে, ‘আপনেরা কষ্ট কইর্যা আসছেন, কি দিয়া যে আপনাগো আপ্যায়ন করি। একটু চা দেই।’
দু-চারটি মালাউন বউ মেয়ে দেখার ইচ্ছে আমাদের সবারই ছিলো। আগে থেকে দেখে রাখলে পরে কাজ দেবে।
আমি বলি, ‘তালিকায় ২৫ নম্বরে আছেন শ্ৰীমতি পদ্মাবতী দেবী, তার সঙ্গে কি একটু কথা বলতে পারি?’
পদ্মাবতী দেবী আমাদের সামনে আসেন, আমরা দেখি বেশ ভালো!
আমি বলি, ‘আপনার পিতার নাম কৃষ্ণচন্দ্ৰ দাস?’
পদ্মাবতী দেবী। খুবই লজ্জা পান, তার লজ্জা পাওয়াটা দেখার মতো, কিন্তু তখনও ভালো করে দেখার সময় আসে নি।
তিনি সলজ্জভাবে বলেন, ‘অইটা ভুল অইছে, অইটা আমার স্বামীর নাম।’
আমি জানি পিতার জায়গায় স্বামী, আর স্বামীর জায়গায় পিতার নাম বসানো আমাদের নির্বাচন কমিশনের একটি বড়ো কৃতিত্ব। তারা আজো পিতা আর স্বামীর পার্থক্য বোঝে না; তবে দল বোঝে, দালালি বোঝে, ক্ষমতা বোঝে, আর কারা ক্ষমতায় আসবে, তাও বোঝে।
আমি বলি, ‘এই জন্যে আমরা ক্ষমা চাই, মাফ ক’রে দেবেন। আপনারা ভোট দেবেন কোন দলকে?’
পদ্মাবতী দেবী চালাক মাল, বলেন, ‘আপনাগো দলরেই দিমু।’
আমি বলি, ‘তাহলে তো আপনার ভোট পেয়েই গেলাম, কষ্ট করে আর আপনার ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নেই।’
পদ্মাবতী দেবী বলেন, ‘হুজুর, অনেক কষ্ট থিকা বাচাই দিলেন, লাইনে দাড়াইতে দাড়াইতে মাজা বেদনা অইয়া যায়; তার উপর আমার এইখন আট মাস চলতেছে, হাডতেই পারি না।’
আমার এক জিহাদি হতাশ হয়, পদ্মাবতীকে তার পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু মাগিটা আট মাস বাঁধিয়ে বসেছে, আট মাসের পেটের ওপর চড়তে পারবে কি না বুঝতে পারে না; আরেক জিহাদি খুশি হয়, আট মাসের পেটের ওপর চড়তে কেমন লাগে, তা সে দেখতে চায়। দেখার সময় আসতে আসতে পদ্মাবতীর সাড়ে আট মাস হয়ে যাবে। এটা এক সুন্দর জিনিশ: কেউ খালি পেট পছন্দ করে, কেউ ভরা পেট পছন্দ করে; আল্লার দুনিয়ায় বৈচিত্র্যের শেষ নেই।
মালাউনদের পাড়ায় আগে আমি বেশি যাই নি। ইস্কুলে পড়ার সময় স্যারের বাড়িতে যেতাম প্ৰাইভেট পড়তে, স্যারকে দেখার আগে তার মেয়ে ছবিকে দেখতাম, স্যারের আগে ছবিই আসতো ছবির মতো হয়ে, একটা সুগন্ধ পেতাম, গাঁদা আর বলকুলের মেশানো গন্ধ, যা কোনো মুছলমান মেয়েকে দেখলে পেতাম না; নানাবাড়ি যাওয়ার সময় দেখতাম পুকুরপাড়ে স্নান করার আগে গোয়ালবাড়ির শাদা শাদা মেয়ে ও মেয়েলোকগুলো শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত তুলে চড়াচড় ক’রে প্রস্রাব করছে; আমি অদ্ভুত একটা গন্ধ পেতাম। কিন্তু মালাউনদের বাড়িতে বেশি যাই নি, এবারই আমার সৌভাগ্য হলো মালাউনগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের।
আমরা পাড়ায় পাড়ায় যাই, যেতে আমাদের ভালো লাগে।
আসার আগে বলি, ‘দেখেন ভোটের দিন গোলমাল হতে পারে, খুনটুনও হয়ে যেতে পারে; আপনারা ভোট দিতে যাবেন কি যাবেন না, ওই দিন বাড়ি থেকেই বের হবেন কি হবেন না, তা একটু ভেবে দেখবেন; জানেনই তো এবার আমরা পাশ করবো, আপনাগো দালালরা পারবে না।’
তারা বলে, ‘সেই কতা আমরা জানি, তাগো আর ভোট দিমু না, ভোত দিতেই যামু না, ভোট দিলে আপনাগোই দিমু, আমরা তাগো ভোট দিমু। ক্যান, আমরা কি তাগো বান্দা গোলাম?’
তবে মালাউনদের বিশ্বাস করা যায় না, ওরা চিরকাল বেঈমান; আমরা শুধু ওদের কথার ওপর চলতে পারি না।
ভালো ক’রেই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি, তারাও বুঝতে পেরেছে।
শুধু এভাবে বোঝালে ও বুঝলেই চলবে না; বোঝানোর জন্যে দু-একটি উদাহরণও ওদের চোখের সামনে থাকা ভালো; মানুষ কখনো কথায় বোঝে না, উদাহরণে সহজে বোঝে, এমনভাবে বোঝে যে আর ভোলে না। আমরা আগেই ঠিক ক’রে রেখেছি গোপালচন্দ্রের বাড়িটা, হারামজাদাটা পয়সা করেছে, সালাম দেয় না দেয়ার মতো, মালপানিও দেয় না, আবার দালালদের পার্টি করে।
ওর বাড়িটা ঠিক ক’রে রেখেছি, বেশি কিছু নয়, সন্ধ্যার পর আমাদের কয়েক জিহাদি ও মেইন পার্টির কয়েক খিলজি যাবে, এদিকে ওদিকে কয়েক গ্যালন পেট্রোল ছড়াবে, আর কয়েকটি ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে আসবে। তাতে কাজ হবে, কাজ হয়ও; ওই সন্ধ্যায় গোপালচন্দ্রের বাড়িটা একটু দাউদাউ ক’রে ওঠে, তখন আমরা কয়েকজন অসি সাহেবের সঙ্গে একটু ব্ল্যাক লেবেল একটু সিভাস রিগ্যাল টেস্ট করছিলাম।
অসি বাঞ্চতটা পঞ্চাশ হাজার চেয়েছিলো
অসি বাঞ্চতটা পঞ্চাশ হাজার চেয়েছিলো, আমি দশ হাজার দিয়েছিলাম; এখন ওই বহিনফাকার বাঞ্চতটা আমার পেছনে ঘোরে, ওর চাকুরিটা আর নেই; আমি পঞ্চাশ লাখ চেয়েছি, ও বিশ লাখ দিতে চায়। হারামজাদার চাকুরিটা ফিরিয়ে দেবো, যদি পঞ্চাশ লাখ দেয়; মাদারচোতটা দেবে, বাঞ্চতটা কয়েক বছরে কয়েক কোটি জমিয়েছে; উত্তরায় বাড়ি করেছে। দু-নম্বর বউয়ের নামে।
ওর দুই নম্বর বউট না কি টিকবে না, সে এখন একটা ঋণখেলাপির সঙ্গে ঘুমোতে ব্যাংকক যায়, উত্তরায় ঘুমিয়ে সে সুখ পায় না।
কাজ হয়েছিলো; একদিনের জন্যে আমরা মেইন পার্টির মহীয়সী লিডারেসের কথায় শান্তির কবুতর, পায়রা, ঘুঘু, চিল, শকুন, বাজ, কাক–যাই বলি না কেনো–হয়েছিলাম। আমরা দলে দলে শান্তির কবুতর, পায়রা, ঘুঘু, চিল, শকুন, বাজ, কাকরা অস্থিরভাবে আকাশে উড়ছিলাম।
একরাত, একদিন; ওটা আমাদের জন্যে সামান্য সময় ছিলো না, ছিলো হাজার বছরের সমান, এতো দীর্ঘ সময় ধরে শান্তিতে থাকা আর শাস্তিতে রাখা কতোটা কঠিন, ওই সময় আমরা ছাড়া আর কেউ বোঝে নি। শান্তি বড়োই ভারি ব্যাপার, যখন আমাদের ভেতরে বিজয়ের পবিত্র অগ্নিশিখা দাউদাউ করছিলো, তখন শান্তি দোজগের শান্তির মতো লাগছিলো।
পত্রিকাগুলো পরদিন আমাদের প্রশংসায় মেতে উঠেছিলো।
মেইন পাটির সঙ্গে আমরা ল্যান্ডস্লাইড করলেও নিজেদের শান্ত রেখেছি, অর্থাৎ মেইন পার্টির খিলজিরা শান্ত ঠাণ্ডা রয়েছে; এমনকি বিজয়োৎসবও করি নি, গণতন্ত্র একেই বলে। আমাদের মতো মহৎ আর কে? আমরা একরাতে একদিন মহত্ত্ব অর্জন করি, কৃতিত্বের বড়ো ভাগটাই মেইন পার্টির খিলজিরা নেয়, আমাদের হিশেবের মধ্যেই আনে না; কিন্তু আমরা যে মেইন পার্টির আসল ফোর্স, তারা তা বোঝে নি। তবে খিলজিরা ও আমরা বুঝতে পারি কতো দীর্ঘ হতে পারে একটি রাত ও একটি দিন, তা একশো বছরের সমান; তবে আমাদের সামনে তখন সহস্র ও একরাত, তার থেকেও বেশি।
প্ৰশংসাধন্য হওয়ার পর আমাদের আর কেউ নিন্দা করতে পারে নি; নিন্দা করার সাহস পায় নি। আমরা তখন শান্তিশৃঙ্খলার ফেরেশতা, আমাদের আগুনের ডানা থেকে ঝলকে ঝলকে শান্তি ঝ’রে পড়ছিলো।
কিন্তু বিজয়ের পর একরাত ও একদিন নিক্রিয় থাকা, শান্তিতে থাকা, শান্তিতে রাখা, আমাদের জন্যে হৃদয়বিদারক ছিলো। শাদি হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা ছহবত করতে পারছিলাম না, যদিও সব কিছু ছিলো টানটান। টানটান জিনিশ নিয়ে একরাত একদিন কাটানোর কষ্ট আমরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
তার পর দিন থেকে মেইন পার্টির নিষ্ঠাপরায়ণ, প্রচণ্ড, তীব্ৰ, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণাৰ্ত, দয়ালু, জনসেবক, মেধাবী, রাজপথের যোদ্ধা, কুয়ৎশীল নেতাকমীদের সঙ্গে আমরা জিহাদির দেশ জুড়ে শান্তির ঝড় বইয়ে দিয়েছিলাম।
ওটার নাম দিয়েছিলাম। আমরা ‘শান্তির ঠাণ্ডা আগুন’, সোভানাল্লা।
দেশ এমন শান্তির ঠাণ্ডা অগ্নি আগে কখনো দেখে নি, সোভানাল্লা।
আমরা, জিহাদিরা ও মেইন পার্টির ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজিরা, মিলেমিশে কাজ করেছি, তখন দেশ আমাদের পায়ের নিচে, আমাদের আগুনের নিচে, আমাদের পিস্তলের নিচে, এবং সবচেয়ে যেটি শক্তিমান ও উদ্ধত পিস্তল–দেশ তখন আমাদের দীর্ঘ দৃঢ় উদ্যত শিশ্নের ছায়ার নিচে, সোনার বাঙলাকে আমার তখন আসল সোনার বাঙলা ক’রে তোলার জন্যে উত্তেজিত। আমাদের শিশ্ন বারবার দৃঢ় হচ্ছিলো, হুর ও উর্বশীদের জন্যে ব্যাকুল হচ্ছিলো; কিন্তু আমরা গণতন্ত্র মেনে নিয়েছিলাম–এক রাত ও একদিন।
জিহাদি ও খিলজি, এবং জিহাদি ও খিলজিতে ভাগ হয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়ি, সন্ধ্যার একটু পরেই।
আমি মালাউন পছন্দ করি, মহান আল্লাতালাই আমাকে এই অপূর্ব রুচিটি দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লা; ওদের গন্ধ আমার পছন্দ, ওদের ঠোঁট আমার পছন্দ; আমি বেছে নিই মালাউন পাড়াগুলো, এবং আমাকে দেয়া হয় মালাউন পাড়াগুলো, তবে সবগুলো নয়। আমার প্ৰিয় দোস্ত, বিখ্যাত খিলজি, মেইন পার্টির ছৈয়দ ছব্দর আলি বন্টু,–তার পছন্দ দুটিই, একই সঙ্গে মালাউন আর আগের মেইন পার্টির দালালদের পাড়াগুলো; সে মনে করে সব কিছু তার তলোয়ার ও শিশ্নের নিচে। এটাকে সে বাস্তবায়িত করেছে, ক’রে চলছে, তবে তার কপালে যে কী আছে, তা রাহমানির রাহিমই জানেন।
আমরা ‘শান্তির ঠাণ্ডা আগুন’ দিয়ে মালাউন ও মালাউনদের দালালদের শান্ত শীতল নীরব নিথর করতে বেরিয়ে পড়ি।
আমাদের জিহাদিদের আগুন লাগাতে হয় না, আমরা ঘরে ঘরে ঢুকি, ওরা কাঁপতে থাকে; আমরা বেশি কিছু চাই না–একবারের জন্যে খুনটুন করার দরকার ছিলো না, দরকার ছিলো চিরকালের জন্যে খুন করা।
আমার দুই নম্বর, জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন, তালেবান হওয়ার জন্যে যে একবার আফগানিস্থানে গিয়েছিলো, সে বলেছিলো, ‘হুজুর, গোটা পঞ্চাশেক মালাউন ফালাই দিতে হইব।‘
আমি বলেছিলাম, ‘গোটা পঞ্চাশেক ফেলে কী হবে?’
জিহাদি মোঃ মুস্তাকিম জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘তাইলে হুজুর, কয়ড়া ফালামু?’
আমি বলেছিলাম, ‘দুটি বা দশটি নয়, সবগুলোকেই ফেলে দিতে হবে।’
ওরা ভয় পেয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলো, ‘হুজুর, সবগুলিরে। ফালামু?’
ওরা যে আর্তনাদ করতে পারে, এটা আমাকে বিস্মিত করেছিলো; ওদের মুখ দেখে আমার কখনো মনে হয় নি। ওরা এমন শব্দ করতে পারে। ওদের অশ্রুনালিতে কোনো অশ্রু আছে বলেও আমার মনে হয় নি।
আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ, সবগুলোকে।’
ওরা বলেছিলো, ‘এক রাইতে সবগুলিরে। ফালাইতে পারুম?’
আমি বলেছিলাম, ‘এক রাত কেনো, আমাদের সহস্র রাত হয়েছে।’
ওরা এবার শান্ত হয়, বলে, ‘তাইলে ফালাইতে কষ্ট অইব না।’
আমি বলেছিলাম, কীভাবে ফেলবে?
ওরা বলছিলো, ‘হুজুর, খালি চাক্কু মারুম শিনার বাঁও দিকে, আর হলকুম দুই ভাগ কইর্যা ফালামু।’
আমি বলেছিলাম, ‘চাক্কু মেরে ফেলতে হবে না, তাতে ঘরবাড়ি নোংরা হবে, লাশের গন্ধ বেরোবে, একবারে খুনের থেকে ওদের চিরকালের জন্যে খুন করতে হবে, যাতে ওরা দেশে না থাকে, আর থাকলেও যেনো না থাকে।’
ওরা ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘সেইডা কেমনে করুম, হুজুর?’
আমি বলেছিলাম, ‘হাত দিয়ে দ্যাখো তোমাদের দুই রানের মাঝখানে কী আছে? কী ঝুলছে।‘
তারা হাত দিয়ে দৃঢ় দণ্ড অনুভব করে শরম পায়; সেটি ঝুলছিলো না, দাঁড়িয়ে ছিলো কুতুবমিনারের মতো।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী আছে ওখানে?’
ওরা বলে, ‘হুজুর, আমাগো লিঙ্গ।’
আমি বলি, ‘ওটি লিঙ্গ নয়, পিস্তল, এম-১৬। ওইটা খোদার দেয়া পিস্তল, এম-১৬। ওইটা চালাতে হবে – মালাউন মেয়েগুলোর পেটে মমিন মুছলমান ঢুকিয়ে দিতে হবে, জিহাদের এইটাই নিয়ম। আর মালাউনদের ঘরভরা সোনাদানা, কলসিভরা টাকা, ওইগুলো নিয়ে আসতে হবে।’
ওরা আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলো, ‘আল্লাহু আকবর, নারায়ে তকবির।’
আমি জানতাম ওদের পিস্তল ও এম-১৬ দৃঢ় ও সদাসক্রিয়, কিন্তু জিহাদিদের পিস্তল ও এম-১৬ যে এতো দৃঢ়, ও সদাপ্রস্তুত, এবং পৌনপুনিক কুয়ৎসম্পন্ন – অটোমেটিক, একটা আমার জানা ছিলো না। মালাউনপল্লীতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মালাউনরা বুঝতে পারে আমরা ‘শান্তির ঠাণ্ডা আগুন’ ছড়াতে এসেছি। তারা একবারও চিৎকার করে না, অতো ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া ছাড়া আর কিছু সম্ভব ছিলো না; কেউ হাতে একটি সরকি বা দাও নিয়েও আসে না, তারা জমে গিয়ে বাঁচতে চায়; তারা আমাদের ঠাণ্ডা শান্তির আগুনে নিঃশব্দে পুড়ে যেতে থাকে। আমাদের হাতে অবশ্য লোহার পিস্তল, চাইনিজ রাইফেল ছিলো, এম-১৬ ছিলো; ওগুলো হাতে না থাকলে চামড়ার পিস্তল কেউ ব্যবহার করতে দেয় না।
আমার জিহাদিরা ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, ওদের মাথায় একটু ঘিলু কম, ওরা যতোটা কাজ করে, তারচেয়ে বেশি গোলমাল করে, যদিও গোলমালেও বেশ কাজ হয়; আমি ওদের নিরস্ত করি। আমি ‘শান্তির ঠাণ্ডা আগুন’ পছন্দ করি; দাউদাউ করার দরকার না হ’লে দাউদাউ করে শক্তি খরচ করতে চাই না।
বাহুর শক্তি খরচের কিছু নাই, কিছু অতিশয় মূল্যবান ধাতু খরচ করতে হবে। ধাতু ক্ষয় করবো মালাউনদের জন্যে এটা আমাদের দয়া, এক বিন্দু ধাতু প্রচুর সুখাদ্যের ফল, বহু পুষ্টিতে এক বিন্দু ধাতু উৎপন্ন হয়, তা বড়োই পবিত্র, বড়োই সৃষ্টিশীল। সে-মহান জিনিশ আমরা ওদের দান করবো, এটা আমাদের মেহেরবানি, এর জন্যে ওদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু ইহুদি ও মালাউনরা কবে কৃতজ্ঞ থেকেছে, শুকরিয়া জানিয়েছে?
সীতারামপুর গ্রামটিকে আমরা প্ৰথম বেছে নিই।
এই নামটা কেনো যেনো আমার পছন্দ হয়, হয়তো ওই সীতা মেয়েটির জন্যে, মেয়েটিকে আমার প্রথম থেকেই পছন্দ। ওকে আমার খুব সেক্সি মনে হয়েছিলো, যখন ওর জন্মের গল্পটি প্রথম পড়েছিলাম। সে খুবই সেক্সি, একটি বইতে পড়েছিলাম, সে আসলে যোনির সিম্বল, আর রাম হচ্ছে শিশ্নের সিম্বল; তাই যোনি ও শিশ্নের গ্রামটিকেই আমি প্রথম বেছে নিই। প্রতিটি পাড়াকে আমরা ঘিরে ফেলি, যাতে কেউ পুকুরেও লাফ দিয়ে না পড়তে পারে, জঙ্গলে গিয়ে লুকোতে না পারে, পায়খানায় গিয়ে বসে থাকতে না পারে, এমনকি গলায় দড়িও দিতে না পারে। জিহাদিরা অতন্দ্র প্রহরী।
প্রতিটি পাড়ায় গেলেই প্রথম জরাজীর্ণ বুড়োর বেরিয়ে আসে।
আমরা জানতাম তারাই আসবে, আমরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুবতীরা বুকের কাপড় খুলে পাছা দুলিয়ে নাচতে নাচতে স্বাগতম জানানোর জন্যে আসবে না। তবে তাদের আসতে হবে, এটা তারাও জানে, তাদের পিতারাও জানে, ভাইয়েরা জানে, আর ভাঙাচোরা পতিদেবতারাও জানে। এটাও জানে দেবতার ওপরও দেবতা আছে; একদল দেবতার পরে আরেকদল দেবতা আসে, আকাশে আসে মাটিতেও আসে। তারা কি জানে না। আমরা নতুন দেবতা হয়ে দেখা দিয়েছি? আমাদের পুজো করা তাদের কর্তব্য? নতুন দেবতারা সব সময়ই একটু ক্রুদ্ধ হয়, আমরাও বেশ ক্রুদ্ধ; তবে আমাদের মেইন পার্টির খিলজিদের মতো অতো ক্রুদ্ধ নই, আমি হ’তে দিই না, আমরা এখনো মেইন পার্টি হই নি। ওরা পাঁচ বছর রক্ত খেতে পারে নি, এখন তাদের তাড়াতাড়ি গলাভরে রক্ত খাওয়া দরকার; আমরাও খাবো, এবং খাচ্ছি, তবে মেইন পার্টির খিলজিদের একটু বেশি খেতে দেবো, যাতে তারা অল্প সময়েই রক্তপায়ী আর নারীখোর বলে খ্যাতি অর্জন করে। তাদের খ্যাতিতে এখন দুনিয়া আহ্লাদিত ও উদ্বিগ্ন।
আমি কৌশল পছন্দ করি, কৌশল হচ্ছে আমার কাছে মালাউন যুবতীদের মতো, তাদের গন্ধের মতো, তাদের ঠোঁটের মতো।
অবশ্য আমি কৌশল শিখি আমাদের পাক ধর্মের ইতিহাস পড়ে; ওই সব কৌশলে আমি মুগ্ধ হই, হোলি টেরারে ওগুলো অতুলনীয়। কৌশল ছাড়া সফল হওয়া যায় না; সন্ধি করতে হয়, সময় বুঝে সন্ধি ভেঙে ফেলতে হয়; সময় বুঝে করুণাময় হ’তে হয়, সময় বুঝে হ’তে হয় বাঘ, একটু রক্ত খেতে হয়।
আমি বলি, ‘আপনারা কেমন আছেন?’
তারা বলে, ‘আল্লার দয়ায় ভালো আছি, হুজুর।’
আমি বলি, ‘আল্লার রহমতে আপনারা ভালো থাকেন, তাই আমরা চাই, আল্লাতালাও তাই চান। আপনাদের ভালো রাখার জন্যেই আমরা এসেছি।’
তারা বলে, ‘হুজুর, আপনের দয়া।’
আমি বলি, ‘আপনারা কি রকম আগুন পছন্দ করেন? ঠাণ্ডা না গরম?’
খুব ভয় পায় ওরা, এতো ভয় পায় যে ওদের মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখাতেও ভয় পায়; কারো মুখে ভয় দেখলে আমি পুলক বোধ করি।
তারা বলে, ‘হুজুর, আপনের কতা বুজতে পারতেছি না, একটু বুজাই বলেন। ঠাণ্ডা আগুন আবার কেমুন?’
আমি বলি, ‘ঠাণ্ডা আগুন শীতল, নিঃশব্দ, কেউ বুঝবে না যে পুড়ে গেছে, পুড়ে যাওয়ার পরও আগের মতোই সুন্দর দেখাবে।’
তারা কথা বলে না, ঠাণ্ডা আগুনে পুড়তে থাকে।
আমি বলি, ‘আমার জিহাদিরা এসেছে একটু বিজয় উৎসব করার জন্যে, বিজয়ের পর উৎসব করার নিয়ম আছে, আপনারা জানেন, তাদের একটু উৎসব করতে দিন।‘
তারা বলে, ‘হা, জয়ের পর ত উৎসব করতেই অয়। তাইলে আমরা বাইদ্যকরগো লইয়া আহি।‘
আমি বলি, বাদ্যকর লাগবে না, জিহাদিরা একটু উৎসব করবে, একটু দোল যাত্রা আর ঝুলন পূর্ণিমা করবে, বাধাটাধা দিয়েন না, তাহলে পাঁচ দশটা লাশ পড়বে, আর আপনাদের মেয়েদের জিহাদিরা ধর্ষণ করেছে, এটা জানাজানি হ’লে আপনারা মুখ দেখাতে পারবেন না।’
তারা বলে, ‘হুজুর, আমাগো মাফ করেন, আমাগো ট্যাকপিয়সা যা আছে লইয়া যান, খালি আমাগো মাইয়াগুলিরে। মাফ করেন।’
আমি বলি, ‘জিহাদিরা ধর্ষণ করবে না, জেনা করা হারাম, তারা বিছমিল্লা বলে একটু ছহবত করবে, তাতে গুনাহ হবে না।’
তারা কাঁদতেও ভুলে যায়, পায়ে পড়তেও ভুলে যায়। তারা তাদের টাকা পয়সা সোনারুপো এনে জড়ো করে আমাদের সামনে, জিহাদিরাও খুঁজে বের করে নানা বিস্ময়কর স্থান থেকে। মালাউনগুলো জিনিশপত্ৰ লুকোতেও দক্ষ, তাই আমরা হই দক্ষতার; হয়তো ওরা মেয়েদের নরম ফাঁকে ফাঁকে আর নিজেদের পাছায়ও জিনিশপত্র লুকিয়ে রেখেছে। তাই প্রতিটি গর্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
আমি তাজ্জব হই জিহাদিদের পিস্তলের শক্তি দেখে।
তারা একের পর এক পিস্তল চালাতে থাকে।
বাপমায়ের সামনেই, কেউ কেউ মেয়ের পর মাকে, মায়ের পর মেয়েকে পরখ করে; আমরা কোনো তাণ্ডব করি না, আমার জিহাদিরা পাড়ায় পাড়ায় ঠাণ্ডাক্স আগুনের মতো জ্বলতে থাকে, ঠাণ্ডা আগুনের মতো আর কোনো আগুন নেই, ওই আগুন ছাই করে, কিন্তু পোড়ে না, তার শিখা দেখা যায় না। পাড়ায় কোনো তাণ্ডবের শব্দ ওঠে না, বরং একটু বেশি নিঃশব্দ হয়। ঠাণ্ডা আগুনে তারা জ’মে যায়, তাই নিঃশব্দ হওয়াই ছিলো স্বাভাবিক।
একটু অসুবিধা হয়ে যায় আমার দশ জিহাদিকে নিয়ে।
কিন্তু তারা জিহাদি, পাক বিজয়োৎসব করতে এসেছে, আমি বাধা দিই না; আমার ইতিহাসের নানা অধ্যায় মনে পড়ে, একে আমি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ব’লেই গণ্য করি; এবং এক্সএক্সএক্স দেখতে দেখতে ইতিহাসকে রিওয়াইন্ড ও রিপ্লে করতে আমার বেশ লাগে। আমার দশ জিহাদি ইতিহাস রিপ্লে করতে চায়, আমি বাধা দিয়ে ওদের বিজয়ের আনন্দ মাটি করতে পারি না।
ওদের দশজনেরই পছন্দ হয় দশ বছরের একটি বালিকাকে, ঠিক ছোটো এক সুচিত্রা সেনকে; ওরা একসঙ্গে তার ওপরে বাঁপিয়ে পড়তে চায়। ওরা অবশ্য সুচিত্রা সেনকে দেখে নি, দেখেছে মাধুরী দিকষিতকে, তাই একটু বেশি উত্তেজিত হয়; আমি দেখি এক বালিকা সুচিত্রাকে, বালিকাটি তরুণী সুচিত্রা সেন হ’লে ‘অগ্নিপরীক্ষা’র শেষ দৃশ্যের উত্তমের মতো আমিই জড়িয়ে ধরতাম। সুচিত্রা সেনকে বাল্যকাল থেকেই আমি পছন্দ করি, তবে তার ওপর চড়ার স্বপ্ন আমি কখনো দেখি নি, শুধু বুকে লেণ্টে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষার গ্ৰীবায় একটু ঠোঁট রাখার স্বপ্ন দেখেছি।
মেয়েটির বাবা আর মা আমার পায়ে এসে পড়ে; বলে, ‘হুজুর, দশজন জিহাদি মাইয়াডার উপুর একলগে ঝাপাই পরছে।’
আমি বলি, কীভাবে ওরা করলে আপনারা খুশি হন?’
মেয়েটির মা বলে, ‘হুজুর, আমার মাইয়াডার মাত্র দশ বছর, আর অহনও রক্ত দেহা দেয় নাই, ও নাবালিকা, হুজুর।’
আমি বলি,’ রক্তের দরকার নেই, রক্ত আমরা অনেক দেখেছি।‘
মেয়েটির মা পায়ে পড়ে বলে, ‘মাইয়াডা মইর্যা যাইব, হুজুর।’
আমি বলি, ‘তাহলে জিহাদিরা কীভাবে উৎসব করবো?’
মেয়েটির মা বলে, ‘হুজুর, আমার মাইয়াডা কচি, আপনেরা একজন একজন কইর্যা যান, একলগে যাইয়েন না, হুজুর।‘
আমি জিহাদিদের লাইন করে দাঁড় করাই, বলি, জিহাদিরা, তোমরা একজন একজন করে যাও, বেশি সময় নিও না।’
লাইনের প্রথম জিহাদি মোঃ আল জমিরুদিনের বাড়িতে দুটি বিবি আছে, সে এক প্ৰচণ্ড শক্ত পুরুষ, তার পুরুষাঙ্গ হয়তো পিস্তলের থেকেও প্ৰচণ্ড। সে নিজেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটি দণ্ডায়মান পুরুষাঙ্গ। তার ভাগ্য ভালো, লাইনে সে প্ৰথম, সেই প্রথম ঢোকে। ঢোকার কিছুক্ষণ পর মেয়েটির একটি চিৎকার শুনতে পাই, মনে হয় মেয়েটির ভেতরে হয়তো একটি কামান ঢুকেছে।
সে অভিজ্ঞ পুরুষ, তার বের হতে একটু সময় লাগে।
হয়তো সে সুযোগ বুঝে দুটি চান্স নেয়, কিন্তু আমি কী করতে পারি? তিনটি চান্স নিলেও আমার করার কিছু ছিলো না; জিহাদকে আমি বাধা দিতে পারি না।
তারপর একের পর এক জিহাদিরা ঢুকতে ও বেরোতে থাকে, বুঝতে পারি আগে থেকেই তারা টানটান ছিলো, ক্ষরণে সময় লাগে নি। মেয়েটির আর কোনো চিৎকার শুনি নি। মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী।
শুধু আমার পায়ের নিচে বসে কাদছিলো মেয়েটির মা আর বাবা।
একরাতে হয় না, রাতের পর রাত আমরা ঠাণ্ডা আগুনে শীতল করতে থাকি মালাউন পাড়াগুলো।
আমার জিহাদিদের ছহবতের শক্তি আমাকে মুগ্ধ করে, অজস্র হুর কেনো দরকার। আমি রাতের পর রাত বুঝতে পারি। আমার মেইন পাটির নেতা বিখ্যাত খিলজি ছৈয়দ ছব্দর আলি বন্টু ঠাণ্ডা আগুনকে গরম আগুনে পরিণত করে, কিন্তু আমি অকাজে গরম হতে চাই না। যা চাই, তা পেলে গরম হওয়ার কী দরকার? আমার জিহাদিরা মালাউন পাড়ায়ই হুর লাভ করে, গফুরুর রাহিম এতো হুর যে জিহাদিদের জন্যে পাঠিয়েছিলেন, তা আমি ভাবতে পারি নি। মালাউনপাড়াগুলো নানা রকম হুরের পল্লী, ওগুলো হুরস্বর্গ। যারা আল্লার কাজ করে, আল্লা তাদের তৌফিক দান করেন; কিন্তু এতো তৌফিক দেবেন, ভাবি নি।
জিহাদিরা ছহবতের পর ছহবত করতে থাকে, কিন্তু একটু টু শব্দও করে না মালাউন হুরগুলো; ওরা জানে জিহাদির সঙ্গে তারা পারবে না। মাঝখান থেকে তাদের ক্ষতি হবে, মুখ দেখাতে পারবে না। এই হুরিগুলো কি সবাই পিল খেয়ে আমার জন্যে প্রস্তুত ছিলো?
টাকা পয়সা সোনারুপায় আমাদের বস্তা ভ’রে ওঠে। এটাই আসল দরকার। আমি অবাক হই হুণ্ডি করে টাকা পাঠানোর পরও ওদের ঘরে এতো টাকা? ঠিক ইহুদিদের মতো, আর কিছু ছিলো না, টাকা ছিলো।
জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন এক অপূর্ব প্রস্তাব নিয়ে আসে আমার কাছে।
সে বলে, ‘হুজুর, মালাউন ছহবতে ত গুনাহ্ নাই।’
আমি বলি, ‘না।‘
সে বলে, ‘হুজুর, আমার দিলে একটা খায়েশ আইছে।’
আমি বলি, ‘কী খায়েশ, মোঃ ফাফিজুদ্দিন?’
সে বলে, ‘আমার খায়েশ চাইর বিবির লগে একসঙ্গে ছহবত করুম।’
সে একটি ঘরে মা, দুই মেয়ে, ও এক নববধুকে পেয়েছে; তাদের ঘরে আটকে রেখে এসেছে আমার দোয়া নেয়ার জন্যে। বিজয়ের ওই অপূর্ব সময়ে বাধা দেয়া অমানবিকতা হতো, আমি বাধা দিই না।
আমি বলি, ‘তোমার খায়েশ তুমি পূর্ণ করো, খায়েশ পূর্ণ না হ’লে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তোমার এখন সুস্থ থাকা দরকার।’
তার বডিগার্ডরা তাকে পাহারা দেয়, সে একের পর এক মা, দুই মেয়ে, ও নববধুর সঙ্গে ছহবত করে–খায়েশ পূর্ণ করে, ঘণ্টা দুয়েক সময় নেয়, চারজনের জন্যে ১২০ মিনিট বেশি সময় নয়, হয়তো পরম সুখ পেয়ে সে রিপ্লে করে, যেমন এক্সএক্সএক্সের সময় করে; যখন সে বেরিয়ে আসে দেখি সে নওজোয়ান হয়ে গেছে; তবে ওই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দেখি বাপটি ও মরদ ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়ে আমগাছের ডালে ঝুলছে।
কেউ যদি আমগাছের ডালে ঝুলে সুখ পেতে চায়, তাহলে তার সুখে আমি বাধা দিতে পারি না; সকল প্ৰাণীর সুখে আমি বিশ্বাস করি।
পরে মা, দুই মেয়ে, ও নববধুটি আমগাছের ডালে বুলেছিলো শুনেছিলাম; তা ঝুলুক, শ্রাবণের ঝোলনে ঝোলার অভ্যাস ওদের আছে; শ্যামের সঙ্গে ঝুলে যদি ওরা পুলকিত হয়, আমি কী করতে পারি?
ছহবত আমারও দরকার, কিন্তু জিহাদিদের মতো, মোঃ হাফিজুদিনের মতো, যাকে তাকে ঘরের মেজেতে চিৎ ক’রে ফেলে দাপাদাপি করে টানাটানি ক’রে ছহবত আমাকে মানায় না।
আমার তেমন রুচিও নেই; আর আমি যদি জিহাদিদের মতো যাকে তাকে ছহবত করি, তাহলে তারা আমাকে মানবে না; আমি নেতা, নেতার মতোই আমার ছহবত করতে হবে। এতে কোনো গুনাহ নেই; আমি জামাঈ জিহাদে যোগ দেয়ার পর অনেক কিতাব পড়েছি, যুদ্ধের পর গনিমতের মাল কীভাবে ভোগ করতে হয়, তা আমি জানি।
এখন সেই মহান যুগও নেই যে মিসর বা সীতারামপুর থেকে কেউ আমাকে একটি দুটি রূপসী দাসী পাঠাবে; তাই আমার রীতিতেই আমি কাজ করি।
গোটাদশোক উৰ্বশী আমার পছন্দ হয়। শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাহেবের একটি কবিতা পড়ার পর নিহ মাতা নহ কন্যাদের জন্যে আমার স্বপ্ন জেগে উঠেছিলো; চিত্ত আত্মহারা হয়েছিলো, রক্তধারা কেঁপেছিলো, আমি তো পুরুষ।
আমি ওদের দিকে জিহাদিদের হাত বাড়াতে দিই না; এবং তাদের পিতাদের আমি একটি বিশেষ বরকত দিই। উর্বশীদের পিতা হওয়ার জন্যে বিশেষ বরকত তাদের প্রাপ্য, কৃতিত্বের জন্যে সকলেরই বরকত প্ৰাপ্য।
একেকটি উর্বশীকে আমি মেপে মেপে দেখি; ঠোঁট দেখি, মোটা ঠোঁট আমার পছন্দ; জিভ দেখি, মোটা ধারালো চ্যাপ্টটা খসখসে জিভা আমার পছন্দ; স্তন দেখি, মাঝারি স্তন আমার পছন্দ, পানিভরা ব্লাডারের মতো স্তন আমি সহ্য করতে পারি না; উরু দেখি, সরু মাংসল উরু, আমার পছন্দ।
আমার মনে হয় আমি মহারাজ মধ্যযুগের ক্রীতদাসীদের হাঠে গেছি, বেছে বেছে ক্রীতদাসী কিনছিং আমার অবশ্য পয়সা লাগবে না। আমি তাদের দয়াই করি: আমার মেইন পার্টির খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টু বা আমার দুই নম্বর জিহাদি তা করে না, তাতে একটু গোলমাল হয়। কিন্তু গোলমাল আমাদের জন্যে গানের মতো, আমরা যে-গোলমালই করি না কেনো, সেটা গিয়ে পড়ে। আমাদের আগের মেইন পার্টির ঘাড়ের ওপর।
আমার মেইন পার্টির খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টু ও তার দলের অসামান্য কৃতিত্বের উপাখ্যান এখানে আমি বলতে চাই না, সেটা খুবই দীর্ঘ ও মহৎ। জিহাদি না হয়েও যে সে ও তারা এতোটা জিহাদ করতে পারে, তাতে আমি বিস্মিত হই। সে পছন্দ করে প্রথমে গুলি করতে, তারপর আগুন লাগাতে, তারপর লুঠ করতে, তারপর ছহবত করতে; এবং তার আদর্শ অন্যান্য খিলজিরাও মেনে চলে। আগের মেইন পাটি বা মালাউনদের দালালদের শিকার করতে সে পছন্দ করে; শিকারে তারা আমাদেরও ছাড়িয়ে যায়। খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টু ও অন্যান্য খিলজির কাহিনী এখন পুবেপশ্চিমে অনেকেরই জানা। তবে আমাদের লিডাররা মনে করেন, টেলিভিশনে, মঞ্চে, গলা ফাটিয়ে বলেন, ওগুলো অপপ্রচার, প্রপাগ্যান্ডা, আসলে ওগুলো আগের মেইন পার্টির শেখদেরই কাজ। আমাদের লিডাররা সত্যের সেবক।
হোসেনপুরে আগে দুর্ধর্ষ শেখ ছিলো আগের মেইন পার্টির কুদরত মোল্লা।
সে চেয়ারম্যান ছিলো, এবং সব ছিলো; আসি তার পা ধরে সালাম করতো, ইউএনও তাকে ‘স্যার’ বলতো, সে থুতু খেতে বললে ইউএনও আর অসি থুতু চাটার জন্যে কামড়াকামড়ি করতো। কিন্তু এখন কোথায় সেই কুদরত মোল্লা? কেউ চিরকাল থাকে না, এটাই ইতিহাসের কৃতঘ্নতা।
খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টু প্ৰথম তার বাড়িতে আগুন লাগায়, তার গুণ্ডা ছেলে দুটির লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়, বউটাকে পুড়ে মারে, কুদরত মোল্লাকে অবশ্য পাওয়া যায় নি, কিন্তু পাওয়া যায় তার একটি কিশোরী ও একটি যুবতী মেয়েকে; তাদের সে একা ছহবত করে নি, একশো জন মিলে ছহবত করে, পরে তাদের বিলে ফেলে দেয়। একটুকু দয়া সে করেছে, বিলে ফেলে দিয়েছে; ছহবতের পর পুড়িয়েও ফেলতে পারতো।
খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টু মেইন পার্টির, ব্যাটা একটু গাধাও, কোনো ট্যাক্ট জানে না; একদিন বুঝতে পারবে ট্যাক্ট ছাড়া কাজ করলে কী ফল পেতে হয়। আমি ট্যাক্ট শিখেছি ইতিহাস থেকে, ও শেখে নি।
আমার কষ্ট হয় খিলজি ছৈয়দ মোঃ ছব্দর আলি বন্টুর জন্যে; ও হয়তো একদিন অন্য কোনো খিলজির হাতেই শেষ হয়ে যাবে; ও অন্য খিলজিদের কিছু দেয় না, ও জানে না। শুধু যোনিতে পেট ভরে না, টাকাও লাগে। টাকাগুলো সবই ছব্দর আলি ঘরে তুলছিলো, আর তার খিলজিরা ধাতু খরচ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলো; টাকা ছাড়া যে ধাতু উৎপন্ন হয় না, এটা সে বুঝতে পারে নি; সে ধর্মের কোনো বই পড়ে নি:–শুনেছি। এর মাঝেই তার একটি চোখ ওপড়ানো হয়ে গেছে, খিলজিরাই উপড়িয়েছে, যদিও নাম দেয়া হচ্ছে শেখদের।
আমার পছন্দের উর্বশীরা কুমারী।
আসলে তারা সেই কাজ করেছে কি না জানি না, মালাউনগুলো কি না করে পারে? এটাই তো ওদের প্ৰিয় খেলা। তবে বিয়ে হয় নি, আর সতীচ্ছদের ও বিছানায় রক্তপাতের প্রতিও আমার মোহ নেই; আমি তো সতীচ্ছদ ভাতে মেখে খাবো না, আর অনেক রক্ত আমি দেখেছি, একটুখানি পর্দা ছেড়া রক্ত দেখার জন্যে আমার কোনো সাধ নেই। দেহখানি, স্তনগুচ্ছ, আর মুখখানি সুন্দর হ’লেই হয়, আমি যোনি নিয়ে সতীচ্ছদ নিয়ে মাথা ঘামাই না; আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলার অজস্র কর্মকাণ্ড রয়েছে।
তাদের পিতারা মাথা নিচু ক’রে থাকে, এটা অভিনব কিছু নয়। নিচু মাথাই আমি পছন্দ করি, এতে আমি আমার মহিমা পরিমাপ করতে পারি। নিজের সামনে অন্যের নিচু মাথা দেখলে আমার মাথাটি আকাশে ঠেকে।
পিতাদের বলি, ‘আপনাদের জানমাল আমার হেফাজতে, আপনাদের একটুও ক্ষতি কেউ করতে পারবে না, আপনাদের টাকা পয়সাও নেবো না।’
তারা এসে পায়ে পড়ে, বলে, ‘হুজুর।’
আমি একেকজনের জন্যে একেকটি দিন ঠিক ক’রে দিই।
কমলাকলি, মৃণাল, মাধুরীলতা, দ্ৰৌপদী, সুবৰ্ণলেখা, রাজলক্ষ্মী, মায়ারাণী, চম্পাবতী, মঞ্জরাণী ধরনের নাম তাদের; তাদের দেখার সময়ই আমি সুগন্ধ পাই, তারা জিনিশ খুবই ভালো, সোভানাল্লা। মঞ্জরাণীটা আবার এমএ পাশ, শুনেছি চাকুরির নামে শহরে খানকিগিরি করে, চাকুরিও করে, এতে আমি দোষ দেখি না একটু বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা সবারই থাকা দরকার; একটা এমএ পাশ জিনিশ চাখার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের, ওইটিকেই আমি প্ৰথম অপয়েন্টমেন্ট দিই। কিন্তু দেখি পাশ হ’লেই জিনিশ ভালো হয় না।
পিতাদের বলি, ফজরের আগেই একেকজনকে আমার গোলাপ-ই-সাহারায়, পৌঁছে দিতে হবে, কেউ জানবে না। সম্ভবত আরব্যরজনীর অমর কাহিনী আমার মাথায় তখন কাজ করছিলো, তবে ফজরে গর্দান নেয়ার বা রাতে শাহেরজাদির গল্প শোনার কোনা ইচ্ছে আমার ছিলো না; কাজ না করে রাতভর যে গল্প শোনে সে অবশ্যই সন্ট্রপিড, আর এটা গল্প শোনার যুগ নয়, আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় বাদশারা গল্প শুনতো, এখন গল্প সৃষ্টি করে, ভিডিওতে তা অক্ষয় ক’রে রাখে; আমি অবশ্য পর্নোভিনেতা হতে চাই না।
উর্বশীদের পিতা হওয়ার জন্যে তারা আমার কাছে থেকে বিশেষ সুবিধা পায়, দু-একটি গ্রাম তাদের আমি দান করতে পারি না, তবে তাদের টাকা পয়সা নিই না, বাড়িঘর জমি দখল করি না; এটা তাদের প্রাপ্য; এজন্যে তাদের আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকার কথা।
তবে ইহুদি ও মালাউনরা কবে কৃতজ্ঞ থেকেছে, ওরা মোনাফেক।
ওই মালাউন উর্বশীগুলো আমাকে অপছন্দ করে নি।
আমি তাদের সুখ দিয়েছি, জিহাদিদের মতো আমি পুরোপুরি বর্বর বেদুয়িন হয়ে উঠতে পারি নি, তারাও আমাকে সুখ দিয়েছে; তাদের ঘরবাড়িগুলো আমি বঁচিয়েছি। ঘরবাড়ি বড়ো, না দেহের একটু ছোট্ট জায়গা বড়ো? আমি অবশ্য একটু ছোটো জমিতে, এককাঠা জমিতে, চাষ করতে পছন্দ করি না। আমি চাষ করি। সারা দেহজমি ভ’রে, এটা তারা পছন্দ করে, সোভানাল্লা। ছেলেবেলায় দেখেছি বাবা যখন জমি চাষ করাতো, একবারেই পুরো জমি চাষ করাতো; আমারও সেটা ভালো লাগতো, একপাশ চাষ ক’রে বাকিটা ফেলে রাখা বাবা সহ্য করতে পারতো না, আমিও পারতাম না।
আমার একটি প্রিয় অভ্যাস হচ্ছে ছহবতের পর তাদের কিছু উপহার দেয়া।
আমার মধ্যে একটি আরব্যরজনীর হারুনর রশিদ বাস করে।
যদি এখন সোনার দিনার আশরাফির চল থাকতো, তাহলে আমি ছহবতের পর তাদের অমৃতনির্ঝর সোনার খনিতে কয়েকটি দিনার আশরফি ঢুকিয়ে দিতাম উপহার হিশেবে, যাতে আমাকে তারা চিরকাল মনে রাখে; স্তনে দুটি স্বর্ণমুদ্রা গেঁথে দিতাম, যাতে ওখানে আমি চিরকাল থাকি। এখন যা চলে, তা ঢোকানো যায় না; তাই আমি তাদের কয়েক হাজার করে দিই, তারা খুশি হয়।
ওরা অনেকেই এক সঙ্গে কয়েক হাজার দেখে নি।
আমি কিছু সোনার হার, আংটি, লকেটও কিনে রেখেছি; যারা আমাকে বেশি সুখ দেয়, বেহশতের স্বাদ দেয়ম তাদের খনিতে আমি ধীরেধীরে দামি সোনার হার, আংটি, লকেট ঢুকিয়ে দিই, ফ্র্যাংক হ্যারিস নামে এক অতিশয় মহাপুরুষের অকপট আত্মজীবনী পড়ে আমি এটি শিখেছিলাম, তাদের টেনে বের করতে বলি; তারা টেনে বের ক’রে সুখে তা গলায় আঙুলে পরে।
তাই আমি ঠিক ধর্ষণ, বলাৎকার, বা জেনা করি না, পেয়ার করি, প্ৰেম করি; যেমন দিল্লির বাদশারা, বাগদাতের সুলতানরা, তুরস্কের সুলতানরা করতো; হয়তো তাদের থেকে একটু বেশি রাজকীয়ভাবেই করি, যদিও আমার রাজত্ব ও দিনার নেই, কিন্তু আমি প্ৰেমকলা শিখেছি। বাৎস্যায়নের থেকেও ভালো। আমার সঙ্গে যারাই ঘুমিয়েছে, আমার সাম্যবাদ সর্বাহারার যুগের পর, তারা সবাই তা স্বীকার করেছে, আবার আসতে চেয়েছে।
বিজয়ের পর আমাদেরও উৎসব আছে, প্ৰাপ্য আছে।
আমাদের প্রাপ্য উর্বশী, রম্ভা, আর উর্বশী-রুম্ভার থেকেও যা সুন্দরী ও সেক্সি ও সেক্সাইটিং, মেরেলিন ও সুচিত্রার সংমিশ্রণ, সেই অজর অমর টাকা, যাতে খোজাও দিনরাত রতিতে মত্ত থাকতে পারে, খোজারও সর্বাঙ্গে অজস্র দৃঢ় শিশ্ন বিকশিত হয়, সেই চিরকামবেদনময়ী, অনন্তযৌবনা, কামদেবী, যার আছে অজস্র পীনোন্নত স্তন ও মধুময় যোনি, ও প্রশস্ত নিতম্ব–টাকা, সোনারুপো, যা ৭০ বিলিয়ন ছওয়াবের থেকেও আকর্ষণীয়; একদিন পাবো বাড়িঘর, যাতে আমরা পবিত্ৰ গাৰ্হস্থ্য জীবন যাপন করবো, ধর্মকর্ম করবো, মক্কা-মনোয়ারায় যাবো। টাকার মতো শাহেরজাদি আর হয় না; সে সহস্র একরােত নয়, লক্ষ লক্ষ দিনরাত ভরে চাঞ্চল্যকর গল্প বলে; তার গল্প চলে ঢাকা থেকে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মুম্বাই, সোনারগাঁও, শেরাটনে।
ঠাণ্ডা আগুন এখনো আমরা থামিয়ে দিই নি, ঠাণ্ডা আগুনের থেকে গরম আগুন আর নেই; এর মাঝে ওরা অনেকেই ওদের আপনি দেশে চলে গেছে, কিন্তু ঠাণ্ডা আগুনে পোড়া দাগ কোনো দিন। সারবে না।
আমার মদিনাতুন্নবি এলাকার অনেককেই খবর দেয়া হয়েছে।
কাশিনাথপুরের শ্ৰীধর দাস এসেছিলো পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে। এক সময় এই টাকা পেলে আমি পাগল হয়ে যেতাম, মজনু হয়ে যেতাম, এখন এগুলোকে মনে হয় ভিক্ষুকের ভাঙা থালের ওপর পড়ে থাকা কয়েকটি কানা পয়সা। তার ওপর থুতু ছিটোতে ইচ্ছে করে, ছিটাই।
শ্রীধর বলেছিলো, ‘এই ট্যাকাডা নেন, হুজুর, আমার মায়াডারে নষ্ট কইরেন না, আমার মাইয়াডা ফুলের মতন।’
এটা বেশ অদ্ভুত, মালাউনরা সবাই তাদের মেয়েদের ফুলের সঙ্গে তুলনা করে। ব্যাটারা ধর্ম ও বিজ্ঞান কিছুই জানে না; ফুল যে গাছের যোনি ও শিশ্ন, এটা ওরা জানে না; আমি জানি; তাই ফুলই তো আমি পছন্দ করি। আমি ওকে এসব বোঝাতে যাই নি, কোনো দরকার নেই; আমার যা দরকার, তা পেলেই আমি তৃপ্ত:–কয়েকটি সুন্দর সুগন্ধি রঙিন তীব্ৰ পুষ্প।
আমি বলেছিলাম, ‘দ্যাখ, ফুলই তা আমি পছন্দ করি, ফুলের সুগন্ধ নেয়ার কথা আমাদের ধর্মে আছে, তোমাদের মালাউন কবিই তা অনুবাদ করেছে–যদি জোটে দুইটি পয়সা ফুল কিনো হে অনুরাগী।’
শ্ৰীধর বলেছিলো, ‘আমার মাইয়াডারে আপনে নষ্ট কইরেন না, হুজুর, ট্যাকাডা নেন, আমারে বাঁচান।‘
আমি বলেছি, ‘একরােত থাকলে সে নষ্ট হবে না, ফুল আমি নষ্ট করি না, ফুলের সুগন্ধ নিই, আর মালাউন ফুল আমার পছন্দ, তোমাকে কথা দিচ্ছি। কেউ জানবে না, তোমার মেয়েটা নষ্ট হবে না, পরে হয়তো সেই আমার কাছে বারবার আসতে চাইবে, নইলে সবাই জানবে, তোমার মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেছে।‘
শ্ৰীধর বলেছিলো, ‘তাইলে আর পঞ্চাশ হাজার দেই হুজুর, মাইয়াডারে ক্ষেমা কইর্যা দ্যান, অরে ইন্ডিয়া পাডাই দিমুনে।’
আমি বলেছি, ‘তিন লাখ, আর এক রাত লাগবে শ্ৰীধর, তোমার মেয়েকে আমি ধর্ম শিখাবো, বিছমিল্লা ব’লে ছহবত করবো, কোনো ক্ষতি হবে না, চাইলে তোমার মেয়েটাকে মুছলমানও বানিয়ে দিতে পারি; কালই লাগবে, নইলে মেয়েটাকে তুমি বিলে পাবে, তখন আমি একলা করবো না। আর তুমি কি মনে করো ইন্ডিয়ায় আমার থেকে ভালো পুষ্পানুরাগী আছে?’
শ্ৰীধর বলেছিলো, ‘হুজুর, আপনের পায়ে পড়ি।’
কিন্তু শ্ৰীধর ও তার মেয়ে দুৰ্গা আত্মহত্যা করে আমার বেশ ক্ষতি করে, আর থানার অসি আর দারোগাগুলোর উপকার করে যায়।
ওই বাঞ্চতের পুত্রের আর তার পাছাভারি চিকন কোমরের মেয়েটির বিষ ওয়ার কি দরকার ছিলো; বিষ কি আমার খৎনাকরা হুজুরের থেকে উত্তম? মালাউনদের বিশ্বাস করা অসম্ভব, আর করবো না। দুর্গার ওপর অসিটারও চোখ পড়েছিলো, কয়েকবার শ্ৰীধরের বাড়িতেও গেছে; কিন্তু তার গোটা পাঁচেক চাকরানি আছে, আর সপ্তাহে সপ্তাহে নতুন নতুন চাকরানি আসে, সে কচি মেয়েদের থেকে কচি টাকার ওপর চড়তেই বেশি পছন্দ করে; তার কোনো ক্ষতি হয় নি, লাখ দুয়েক সে আদায় ক’রে নিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে আমার।
তাই অসিটিকে একটু দেখিয়ে দিতে হয়েছে, জামাঈ জিহাদে ইছলামের হুজুরকে ছেড়ে সে কীভাবে দু-লাখ হজম করে? এখন সে আমার পিছে পিছে ঘুরছে, চাকুরটিও নেই; পঞ্চাশ লাখ ছাড়া ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
আজ ও আগামীকাল আমাদের কর্মকাণ্ড
দেশের দশটা জায়গা জুড়ে আজ ও আগামীকাল আমাদের কর্মকাণ্ড; একযোগে আমরা কাজ করবো দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, বরিশাল, ভোলা, মাইজদি, লালমনিরহাঠ, নারায়ণগঞ্জ, আর আমার মদিনাতুন্নবি অঞ্চলে–এক সঙ্গে আমরা জিহাদ শুরু করবো।
আমাদের আজকের দিনটির নাম দিয়েছি। আমরা ‘ওমর দিবস’, আগামী কালের নাম ‘আলি দিবস’। দুটি পবিত্র দিবস। ওমর দিবসে আমরা ভৈরবের নাম বদলে রাখবো ‘ওমরপুর’, আলি দিবসে শ্যামসিদ্ধির নাম বদলে রাখবো ‘আলিগঞ্জ’, বদলে দেবো সব কিছু।
দিবস দুটির আর জায়গা দুটির নাম আমার মাথা থেকে বেরোয় নি।
বেরিয়েছে আমার দু-নম্বর মোঃ হাফিজুদিনের মগজ থেকে; আমি ক্রমশ ওর সম্পর্কে একটু একটু সাবধান হচ্ছি, খুনে আর নামকরণে ওর অলৌকিক প্রতিভা রয়েছে, যা আমাকে মুগ্ধ ও ভীত করে। ওর সম্ভবত কোনো জিনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, যেটি খুবই শক্তিশালী, যেটি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে; ওর দিকে তাকালে আমার মনে হয়ে একটি অসম্ভব সম্ভব হয়ে আছে। একদিন ও আমাদের ওসামা বিন লাদেন হয়ে উঠতে পারে, তখন ও আমাকে কানা মোল্লা উমর করে রাখবে না, আমাকে কাফের বলে আমার মাথায় কয়েকটি বুলেট ঢুকোবে।
আমাকে সাবধান হ’তে হবে।
আমি অবশ্য সাবধান, সাম্যবাদ ও সর্বহার করে করে আমাকে সাবধান হতে হয়েছে; এখন জামাঈ জিহাদে ইছলাম করতে এসে আমাকে আরো সাবধান হতে হচ্ছে। হোলি টেরর আনহোলি টেরারের থেকে ভয়ঙ্কর।
জিহাদি হাফিজুদিনটা একটু বেতমিজ, মুখে চমৎকার চাপদাড়ি, স্বাস্থ্যটাও ভালো; একাই দু-তিনটি দোকান ভাঙতে পারে, কয়েকটিতে আগুন লাগাতে পারে, গুলি চালাতে পারে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’ বলে ছুরি ঢুকোতে পারে; ফিরে এসে একটির পর একটি এক্সএক্সএক্স দেখতে পারে, সবই ইন্ডিয়ান, বড়ো দুধ আর বড়ো মাজা ওর পছন্দ, চাকরানিটাকে ডেকে এনে ঘন্টাখানেক ধীরে অরাল-অ্যানাল-ভ্যাজাইনাল করতে পারে, তারপর উঠে গিয়েই মধুর স্বরে ওয়াজ করতে পারে, ফতোয়া দিতে পারে।
ও একটি সাংঘাতিক প্রতিভা, আমি তার প্রতিভায় মুগ্ধ ও সন্ত্রস্ত।
‘ওমর দিবস’-এ আমরা কী করবো, সেটা আমি আলোচনা করি।
আলোচনা করতে বাধ্য হই, মোঃ হাফিজুদিনের সঙ্গে–আগের সন্ধ্যায় মাগরেবের নামাজটা সোরে, একটা এক্সএক্সএক্স দেখতে দেখতে, একটু ব্ল্যাক লেবেল একটু সিভাস রিগ্যাল খেতে খেতে। এই কাজটাও মোঃ হাফিজুদ্দিন পারে বেশ, আমাকে সহজেই ছাড়িয়ে যায়, ঢাকাঢািক ক’রে পানি ছাড়াই গিলে ফেলে, তখন ওকে অলৌকিক মনে হয়; ওর দাড়ি আর সুরমামাখ্যা চোখ দেখে এটা কেউ বুঝবে না, আমিই অনেক সময় বুঝতে পারি না।
দাড়ি অবশ্য আমিও রেখেছি, তবে আমার দাড়িটা ওর দাড়ির মতো কিছুতেই লম্বা হচ্ছে না, তাই মাঝেমাঝে আমি দাড়িগুলো টানি; এটা আমাকে একটা হীনম্মন্যতা বোধ দেয়, কিন্তু আমি এটা ওকে বুঝতে দিই না।
হাফিজুদ্দিন বলে, ‘কাউলকা দুই চাইরড লাশ ফেলতে অইব, মালাউনগো পাঁচ সাতটা দোকানো আগুন লাগাইতে হইব, ওগো দালালগো দোকান ঘরবাড়ি পুড়তে হইব, আর বিরিজটার পুব দিকটা চুরমার কইর্যা ফ্যালতে হইব।‘
আমি একটু চমকে উঠি ব্রিজটার কথা শুনে।
ব্রিজটা সব সময়ই আমাকে বিস্মিত করেছে, অনেকদিন মনে হয়েছে ওটির ওপর আমি শুয়ে থাকি, শুয়ে নদী দেখি; নিজেকেই আমার ব্রিজ মনে হয়েছে। এতো বড়ো একটি ব্রিজ কাফেররা কীভাবে বানিয়েছে, সেটা ভেবেও আমি অবাক হয়েছি। একটি দোয়া পড়ে কি আমরা এমন একটি ব্রিজ বানাতে পারি না? হজরত মুসাকে আমার মনে পড়ে, তবে তাঁর রাস্তাটি ছিলো ক্ষণস্থায়ী, আর ওইটা ছিলো ইহুদিদের জন্যে, তাই রাস্তাটিকে আমি একটি অপচয় মনে করি।
আমি বলি, ‘খুন তিন চারটা করলেও ক্ষতি নেই, সারা বাজারে আগুন লাগালেও ক্ষতি নেই, তাতেই আমাদের জিহাদ সফল হবে, আমরা ইছলামের দিকে পাক স্তানের দিকে বেশি এগিয়ে যাবো, আমাদের দলের শক্তি বাড়বে, তবে ব্রিজটা চুরমার করা ঠিক হবে না, মানুষের অসুবিধা হবে।’
মোঃ হাফিজুদিন বলে, ‘মাইনষের কথা ভাবনের সময় এইটা না, এইটা আসল কামের সময়, পাকিস্থান ভাঙ্গনের জইন্যে যেমন এই বিরিজ ভাঙছিল, আবর পাকিস্থান বানানের জইন্য এই বিরিজ ভাঙতে হইব।’
ব্রিজটার জন্যে আমার মায়া লাগে; আমি বলি, ‘ব্রিজ ভাঙার সময় পরেও পাবো, আগামীকালই দরকার নেই।’
মোঃ হাফিজুদিন হুইস্কির গেলাশে একটি বড়ো চুমুক দিয়ে, এক্সএক্সএক্স ছবিটার একটি দৃশ্য রিওয়াইন্ড করে, বলে, ‘হুজুর, জিহাদি জোশে আপনার দিল আইজও ভাইর্যা ওঠে নাই। তয় আপনের কতার ওপর কতা নাই, কয়ড ডিনামাইট মাডির নিচে জমা কইর্যা রাকাছি, পরে কামে লাগাম, ইনশাল্লা।’
আমি বলি, ‘মোঃ হাফিজুদিন ব্রিজটা তুমি ভাঙতে চাও, তা খুবই উত্তম। তারপর কি একটি দোয়া পড়ে ওটি বানাতে পারবে?’
মোঃ হাফিজুদ্দিন খুব বিব্রত হয়, বলে, ‘হুজুর, এমুন দোয়া অহনও পাই নাই।’
আমি বলি, ‘এমন দোয়া কি নেই?’
মোঃ হাফিজুদিন বলে, ‘হুজুর, আল্লার কিতাবে নিচই আছে, তয় অইডা খুঁইজ্যা দোকতে অইব।’
আমি বলি, ‘এখনো খোঁজো নি কেনো?’
মোঃ হাফিজুদিন বলে, ‘অহন থিকা খুজুম, হুজুর।’
আমি বলি, ‘এতো দেরি করলে কেনো?’
মোঃ হাফিজুদ্দিন বলে, ‘দোয়াডা খোজনের কতা মনে আছিল না, হুজুর।’
আমি বলি, ‘কোন কোন দোকানে আগুন লাগাতে চাও?’
মোঃ হাফিজুদ্দিন বলে, ‘গোডা দশেকের কমে হইব না; কয়ড়া মালাউনগো দোকানে আর কয়ড়া মালাউনগো দালালগো দোকানে; মালাউনগো আর তাগো দালালগো বাইচা থাকতে দিমুনা।’
আমি বলি, ‘বেশ, আলহামদুলিল্লা।’
আমার মোবাইল বেজে ওঠে, ঢাকা থেকে আমার বড়ো খলিফা।
খলিফা বলেন, ‘কাইল হইব ইছলামের জিহাদের, আমাগো পাকিস্থানের জইন্যে একটা বড় দিন, সেইভাবে কাজ করবা, ডরাইও না, আল্লার রহমত তোমাগো উপরে আছে।’
আমি বলি, ‘হুজুর, ডরানের কোন কারণই নেই, আল্লার রহমতে দেখবেন কালকে আমরা ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বকতিয়ার খিলজিকেও ছাড়িয়ে গেছি, পরের দিন পত্রিকা ভ’রে আমরাই থাকবো, ইনশাল্লা।’
খলিফা বলেন, ‘মাশাল্লা, থাকার সঙ্গে আমরা কতা বইল্যা রাখছি, আর পাওয়ারফুল তিন চাইরডা মিনিস্টারগো সঙ্গেও কতা বলছি, তারা এক সোম আর আমাগো প্যাট্রন এমবেছেডারগো লগেও কতা কইছি, ডোনারগো সঙ্গেও কতা বলছি। তারাও তোমাগো দিকে তাকাই আছে।’
আমি বলি, ‘আমরা সব ট্যাকটিক্স ঠিক ক’রে ফেলেছি, আল্লার রহমতে কোনো চিন্তা নাই, ইনশাল্লা কালকে দেখবেন। হুজুর, আপনি মেইন পাটিরে বোঝাবেন।’
খলিফা বলেন, ‘মেইন পার্টিরে বুজাইতে হইব না, তারাই এইখন আমাগো কাছে বুজতেছে। যেইর লিগা ফোন করলাম সেই কথাটা শোনো, ঘণ্টা দুইয়ের মইদ্যেই তোমার কাছে বিশ তিরিশজন ট্রেনিং পাওয়া জিহাদি যাইব, তাগো তালেবানের ট্রেইনিং আছে, আপগানিস্থানে এক বছর আছিল, তাগো পাঠাই দিছি, লগে দশ লাক ট্যাকাও দিছি তোমারে দেওনের জইন্যে।’
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা।‘
খলিফা বলেন, ‘মনে রাইখ্যো আমাগো মিডিল ইস্টের ভাইগো আমরিকার ইহুদিরা শ্যাষ কইর্যা দিতেছে, সেইজন্য এইখানে নতুন মিডিল ইস্ট বানাইতে হইব, আমাগো ডোনাররা আমাগো দিকে চাইয়া আছে।’
আমি বলি, ‘ইনশাল্লা, কাল আর পরশু হবে আমাদের দিন, আমেরিকারে আমরা বুঝিয়ে দেবো জিহাদ কাকে বলে। অগো অ্যামবেসিটাকে একদিন জ্বালিয়ে দিতে হবে।’
খলিফা বলেন, ‘সেইটা পরে হইব, ইনশাল্লা, অখন আমরিকারে খোপান আক্কেলের কাম হইব না, তা তো তুমি বুঝ।’
আমি বলি, ‘হুজুর, আমাদের দোয়া করবেন।‘
খলিফা বলেন, ‘তোমার জইন্য দোয়া রইল, আইজ রাইতে ছুরা ইয়াছিন পাচবার পইর্যো; আল্লা হাফেজ।’
মোঃ হাফিজুদিনের সঙ্গে আরো আলোচনা করি, কিন্তু আমরা জিহাদের ও পাটির নিয়ম মেনে চলি, নেতার ওপর আর কোনো কথা নেই, তাই আমি যা বলবো, তাই হবে। কৌশল আমি আগেই ঠিক করে রেখেছি, তাতে জিহাদি মোঃ হাফিজুদিনের কৌশলগুলোও আছে, আর আমার নিজের কৌশলগুলো।
কালকের দিনটিকে জিহাদের শ্রেষ্ঠ দিন ক’রে রাখতে হবে, যাতে বছর বছর তা আমরা পালন করতে পারি, আমাদের একটি চিরস্মরণীয় শহিদাও দরকার।
আমাদের কাটা এম-১৬ গুলো, রাইফেলগুলো, পিস্তলগুলো, গ্রেনেডগুলো, দাও, শরকিগুলো ঠিক আছে, কয়েক শো বোমাও প্রস্তুত আছে; কে কী করবে: তাও ঠিক করা আছে। তীক্ষ ক্ষুদ্রগুলোও আছে; ওগুলো গোখরোর জিভের মতো, ভেতরের দাঁতের মতো, কিন্তু কাজ করে মনোরমভাবে হাত আর পায়ের রাগ কাটে নিঃশব্দে, আমাদের রয়েছে একদল দক্ষ ক্ষৌরকার। সব কাজে এটম হাইড্রোজেন বোমা দরকার হয় না, আমাদের নানা কাজে ক্ষুর এটম হাইড্রোজেন বোমার থেকেও শক্তিশালী আর নিপুণ; ওগুলো আমাদের পকেটে রাখা এটম হাইড্রোজেন বোমা দরকার হয় না, আমাদের নানা কাজে ক্ষুর এটম হাইড্রোজেন বোমার থেকেও শক্তিশালী আর নিপুণ; ওগুলো আমাদের পকেটে রাখা এটম হাইড্রোজেন বোমা। আমাদের জিহাদিরা সবাই খালেদ ইবনে ওয়ালিদ, মুহম্মদ বিন কাশিম, ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার, তারিক, ওসামা লাদেন, তাদের ওপর আমার ভরসা আছে; যাকে যা কাজ দিয়েছি, তা ঠিক মতো করবে। এইটাই পছন্দ আমার জামাঈদ জিহাদে ইছলামের।
আমরা সব এলাকার নেতারাই থাকি মাদ্ৰাছায়।
এখানে নদীর পারে লম্বা একটি মাদ্ৰাছা ক’রে দিয়েছে আমাদের দলেরই এক মহান সেবক আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি, ইছলাম আর পাকিস্থান যার প্ৰিয় ধন, যে গার্মেন্টস, কন্ট্রাকটরি, এনজিও, সোনা ও অন্যান্য সোনার থেকে দামি জিনিশ চোরাচালানি করে কোটি কোটি টাকা করেছে; প্রত্যেক বছরই হজে যায়, আমি গেছি। একবার। মাদ্ৰাছটির নাম মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবি; সে অবশ্য তার জান্নাতবাসিনী মায়ের নামেই এটির নাম রাখতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমার পরামর্শে সে এ-নামটি রাখে, রেখে ধন্য হয়।
সে অবশ্য নিজের টাকায় মাদ্ৰাছা করে নি, লিবিয়া, ইরাক, আর সৌদি এনজিও থেকে টাকা পেয়েছে, এটা আমি জানি, আল কায়েদার টাকা পেয়েছে কি না জানি না; যতো টাকা পেয়েছে ততোটা খরচও করে নি, আমাকে বেশ কিছু দিয়েছে, এখানকার অন্যরা জানে না; তাই সে আমাকে মান্য করে। মাদ্ৰাছার সঙ্গেই আছে মসজিদ, সেটিও কোরবান আলি ব্যাপারিই করেছে। এতো পরহেজাগার, ঈমানদার, ও পাক স্তান প্ৰিয় আদমি কমই আছে।
ব্ল্যাক লেবেল, ব্যালেনটাইন, সিভাস রিগ্যালের সাপ্লাইটাও সাধারণত সেই দেয়, এক্সএক্সএক্সও সেই নিয়ে আসে, আমার সঙ্গে পান করতে করতে এক্সএক্সএক্স দেখতে তার ভালো লাগে; তার পছন্দ আবার ব্যাংককের মেয়েগুলো, তার মতে মেয়েগুলোকে চেপে ভর্তা বানালেও তারা বাধা দেয় না, তারা রসগোল্লার মতো নরম, জিভের নিচে রেখে চিপলে রস বেরোয়।
সে একটু মুশকিলে পড়েছিলো, সেটা থেকে তাকে আমি বঁচিয়েছি।
আল্লায়ই আপদ দেন, আর মহান আল্লাতালাই তার বান্দাদের আপদমছিবত থেকে বাঁচান; তার জন্যে সে আমাকে মাঝেমাঝে ‘হুজুর’ বলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। একেকবার একেকটি পাজেরো নিয়ে আসে, আমার মাত্র একটি পাজেরো, তাও পুরোনো মডেলের। একটি নতুন মডেল চাইলেই পাবো, তবে চাইতে ইচ্ছে করে না।
বুড়ো বিবিটিকে তালাক দিয়ে সে একটি মডার্ন যুবতী বিবি নিতে চেয়েছে, বুড়ো বিবিটার মস্তান ছেলেটি, মুহাইমেন বিন কোরবান, তা মেনে নিতে রাজি হয় নি, তাই কোরবান আলি ব্যাপারি একটু মছিবতে পড়েছিলো।
আমি মস্তানটিকে রাজি করিয়েছি, কোটি পাঁচেক লেগেছে তাতে; আমারও কিছু থেকেছে। আমার চাইতে হয় নি, আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি নিজেই আমার পায়ের কাছে রেখে গেছে, যা রেখেছে তিন লক্ষ বছর সাম্যবাদ করলেও আমি তা চোখেও দেখতে পেতাম না। জিহাদ আমাকে দিচ্ছে আর দিচ্ছে, আল্লার রহমতে আরো দেবে। মডার্ন বিবিটা বিএ পাশ, আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির ফার্মে গিয়েছিলো একটি চাকুরির জন্যে; মিস লাইলাতুল কদর আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির মুখোমুখি চেয়ারে বসতেই কোরবান আলি ব্যাপারি উত্তেজনা বোধ করে, তার ঠোঁট, আর ব্রেস্টের উচ্চতা আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারিকে ছহবতের জন্যে উত্তেজিত করে। এটা শয়তানের কাজ; পুরুষ আর মেয়েলোক কাছাকাছি বসলে শয়তান কাজ করবেই, এসে মাঝখানে বসবেই, কোরবান আলির ফার্মেও শয়তান গন্ধম ফল নিয়ে হাজির হয়। আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির ফার্মে কোন মেয়েলোক কাজ করে না, এটা নিয়মবিরুদ্ধ, কিন্তু মিস লাইলাতুল কদরকে সে একটি চাকুরি দিতে চায়।
কোরবান আলি ব্যাপারি জিজ্ঞেস করে, ’আপনের নামটা আমার কাছে পাক মনে অইতেছে, আপনি কি বোরখা হিজাব পইর্যা আসতে পারবেন, মিস লাইলাতুন কদর?’
লাইলাতুন কদর বলে, ‘তা পারবো, ইনশাল্লা।‘
কোরবান আলি বলে, ‘তাইলে তুমি আইজই কামে জয়েন কইর্যা হালাও, রাহমানির রাহিম চান তুমি এইখানে কাম কর।’
লাইলাতুন কদর বিস্মিত হয়, ‘আজই?’
কোরবান আলি, ‘দেরি করনের কাম কি?’
লাইলাতুল কদর ওই দিনই কাজে যোগ দেয় ১৫,০০০ টাকা বেতনে।
ছুটির সময় কোরবান আলি লাইলাতুন কদরকে বলে, ‘থাউক, মিস লাইলাতুল কদর, তোমার বোরখা হিজাব পরন লাগব না, তোমার এই রকমেই সোন্দর দেহায়।‘
লাইলাতুন কদর বলে, ‘আপনে সত্য বলতেছেন? আমারে সোন্দর দেহায়?’
কোরবান আলি বলে, ‘মিছা কামু ক্যা? তোমার দেহডা নুরজাহানের মতন, হ্যামা মালিনির মতন, তোমারে এইভাবে দেখতেই আমার সুক লাগিব, আল্লার রহমতে আমি সোন্দর জিনিস দ্যাকতে পছন্দ করি।‘
লাইলাতুন কদর বলে, ‘তাহলে দেইখ্যেন।‘
কোরবান আলি কয়েক দিন সুন্দর জিনিশ দেখে, দেখে বেচইন হয়ে ওঠে।
কয়েক দিন পরই মহামান্য শক্তিধর শয়তান সন্ধ্যার একটু পর এসে ঢোকে আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির অফিস রুমে, সে মিস লাইলাতুল কদরকে একটুখানি জোর ক’রে অফিসের সোফার ওপর ফেলে বিছমিল্লা বলে ছহবত করে। বেশি জোর করতে হয় নি, লাইলাতুল কদর রাজিই ছিলো অনেকটা; বহুদিন পর ছহবতে দিল ভরে কোরবান আলি ব্যাপারির।
ছহবতের পরই মিস লাইলাতুন কদর বলে, ‘আমারে কাইলই বিয়া করতে হবে, দেরি করন যাইব না।‘
কোরবান আলি বলে, ‘বিয়া ত করুমই তয় আমার বুড়া বিবিটার মত লইতে হইবে, নাইলে করুম কেমনে?’
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘আইজ আমি প্ৰেগনেন্ট হইতে পারি, কাইলই বিয়া করতে হবে, বুড়ির মতের দরকার নাই।’
কোরবান আলি বলে, ‘বুড়ি বিবির মত লইয়া লই।‘
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘তারে তালাক দেও।’
কোরবান আলি বলে, ‘তালাক দিতে হইব?’
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘হ।’
কোরবান আলি বলে, ‘আইচ্ছা, তারে তালাক দিমু; তয় আমার একটা গুণ্ডা পোলা আছে, সেইডা যে কি করব।’
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘সেইটারে তুমি সামলাও।’
কোরবান আলি বলে, ‘হ, দেহি।‘
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘নাইলে তোমার বিপদ হইব, আমারও বিপদ হইব, তোমার কোটি কোটি ট্যাকা ধইর্যা টান দিমু।‘
কোরবান আলি বলে, ‘আইজ রাইতে বুদ্ধি বাইর করতে হইব।‘
কোরবান আলি আরেকবার ছহবত করতে করতে বলতে থাকে, ‘অ, আমার লাইলাতুন কদর, এমুন সুক আর আমি পাই নাই, তুমি আবার বিবি, বুড়িডারে তালাক দিমু, তোমার দ্যাহ ভইর্যা মদু।‘
মিস লাইলাতুল কদর বলে, মদু পাইবা, কাইলই বিয়া করতে অইব মদু খাইতে চাইলে, নাইলে মদু বিষ হইয়া যাইব।’
কোরবান আলি বলে, ‘তোমার মদু ছাড়া আমি বাচুম না, তুমি চিন্তা কইর্য না, কাইল নাইলে পরশুই তোমারে শান্দি করুম।’
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘তাইলে আরেকটু মদু খাও, দরজাটা আটকাইয়া লও, ভাল কইর্যা খাও, জানি আমিও মদু পাই।’
কোরবান আলি বলে, ‘ক্যান, লায়লাতুল কদর, তুমি মদু পাও নাই?’
মিস লাইলাতুল কদর বলে, ‘বুড়ির লগে হুইতে হুইতে তুমি মদু খাইতে আর খাওয়াইতে ভুইল্যা গ্যাছ, তোমারে শিখাই দিমুনে। তোমার শাবলডা চিলা অইয়া গ্যাছে, ওইডারে শক্ত করতে অইব, নইলে খুড়বা ক্যামনে?’
কোরবান আলি বলে, ‘হ, ঠিকই কইছা, বিবি লায়লাতুল কদর, ওই বুড়িডা ভাল কইর্যা চিৎ অইতে পারে না, কোনমতে কাম সারতে অয়।’
লাইলাতুল কদর বলে, ‘আর আমার কাম?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘তুমি বিবি হগুরগো ছারাই গেছো। তোমার জান্নাতুল ফেরদাউসে আমি দিনরাইত ঢুইকা থাকুম।’
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি আমার সাহায্যের জন্যে ছুটে আসে। আমি সাহায্য করি; সাচ্চা মুছলমান হয়ে আরেকজন সাচ্চা পরহেজাগার পাক স্তান, সার জমিন সাদ বাদ, দিওয়ান মজনু মুছলমানকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। এতে তার কয়েক কোটি ব্যয় হয়, কিন্তু ওটা তার কাছে সামান্য টাকা; লাইলাতুল কদরের সঙ্গে ছহবত করার জন্যে এটা কিছু নয়। তারা ছহি ছালামতে আছে, লাইলাতুল কদরকে এ-পর্যন্ত সে তিনবার গর্ভবতী করেছে; তার জান্নাতুল ফেরদাউসকে সে সব সময় ভরে রাখে; সে প্রোডাকশনে বিশ্বাস করে, প্রোডাকশন ছাড়া ফরিন করেন্সি আসে না।
আলহজ বেগম লাইলাতুল কদর এখন আর অফিসে যায় না, বোরখা হিজাব পরে পাজেরোতে চেপে পেট ফুলিয়ে সে ইস্টার্ন প্লাজা থেকে ওয়েস্টার্ন প্লাজা থেকে সাউদার্ন প্লাজায় ছোটাছুটি করে, সিঙ্গাপুর যায়, লণ্ডন যায়, বছরে বছরে হজ করে, হজ থেকে ফেরার সময় বস্তা ভরে সোনা নিয়ে আসে। শুধু দ্বিনের কাজ করলে তো চলে না, মমিন বান্দাকে দুনিয়ার কাজও করতে হয়।
মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবি শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা; তালেবানরা কোরান হাদিছ পড়ে–ওদের গলায় মধুর সুর, লতামঙ্গেশকারের মতোই–আমার ঘর থেকে বেশ দূরে, অন্য দিকে থাকে আমার দু-নম্বর নেতা মোঃ হাফিজুদ্দিন, খুবই শানশওকতের সঙ্গে। আমাদের দুজনেরই বডিগার্ড আছে, পাঁচটি তালেবান আমার বডিগার্ড, তিনটি তালেবান হাফিজুদিনের বডিগার্ড; তারা আমাদের ঘর পাহারা দেয়, বাইরে গেলে আমাদের পাহারা দেয়; আর আমাদের একান্ত গোপন পাক জিহাদি কাজের সময় পাহারা দেয়।
তারা আল কোরান ছুঁয়ে শপথ করেছে–তাদের খুন না ক’রে আমাদের কেউ খুন করতে পারবে না; আর আমরা যখন একটু পাক আনন্দ ফুর্তি করবো, তখন তারা একটি কাককেও ঢুকতে দেবে না, কাউকে কিছু কখনো বলবে না।
ওদের ঈমান আছে, ঈমানের জন্যে ওরাও যা পায়, তা কম নয়।
আমার বাপমা আমার একটি বড়ো ক্ষতি করেছে, তারা হাবিয়া দোজগে যাবে এর জন্যে, তারা আমাকে মাদ্ৰাছায় না পাঠিয়ে হাইস্কুলে কলেজে পাঠিয়েছিলো, তাই জীবনের শুরুতে আমি পাক জ্ঞান লাভ করি নি, নাছারা কাফেরদের বিদ্যা শিখেছি–নাউজুবিল্লা। তবে আল্লার রহমতে আর জামাঈ জিহাদে ইছলাম পার্টির দয়ায় আমি তা কাটিয়ে উঠেছি। আসল বিদ্যা, প্রকৃত বিদ্যা শেখানো হয় মাদ্ৰাছায়। মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবি একটি ফোরাকানিয়া হাফেজিয়া মাদ্ৰাছা, এখানে ছহিহ কোরান তিলাওয়াত ও কোরান মজিদ হিফজ করানো হয়। এতে যার যতো বছর লাগে, ততো বছর থাকতে দেয়া হয়। তারা হয় খাঁটি মুছলমান।
এখানে আমরা শেখাই জিহাদ, জিহাদের জ্ঞান যার আছে, সেই শ্ৰেষ্ঠ মুছলমান। দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল আমরা শেখাই না; শেখাই ছোরা মারা, বোমা তৈরি, গ্রেনেড মারা, পিস্তল চালানো, ক্ষৌরকর্ম–রাগাকাটা ইত্যাদি জ্ঞান, যা ছাড়া জিহাদ সম্ভব নয়। তবে দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল একত্রে শেখানোর দায়িত্ব আমিই নিয়েছি; এই তত্ত্বগুলো আমি তাদের বোঝাই আবু আলা মওদুদ আর আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনির কিতাব থেকে। আমরা শেখাই হোলি টেরর, ডিভাইন টেরর, বেহেশতি সন্ত্রাস।
আসল জ্ঞান হচ্ছে জিহাদ, আসল শিক্ষা হচ্ছে।আবার পাকিস্থান।
সন্ধ্যা পেরিয়ে যেতে থাকে, একটির পর একটি এক্সএক্সএক্স দেখতে দেখতে ও জিহাদের আলোচনা করতে করতে, আবু আলা মওদুদি, রুহুল্লা খোমেনি, ওসামা লাদেন, মদিনার ইহুদিদের নিয়ে কথা বলতে বলতে, আমরা দুজনেই ছহবতের জন্যে উত্তেজিত হই। এই কয়েক মাস আগে মালাউনদের বাড়িঘরে মাঝরাতে ঢুকে ছহবত করেছি, দরকার হলে আবারও করবো; তবে এখন বাড়িঘরে ঢুকে হাল্কা ছহবতে আমার সুখ হয় না, আমার সারারাত লাগে।
মোঃ হাফিজুদিনের অবশ্য কোনো চিন্তা নেই, আজ তার গেলমানের রাত; তার কয়েকটি গেলমান আছে এখানেই, অন্য মাদ্ৰাছা থেকেও আসে, কিন্তু আমি যাকে আসতে বলেছি, সে এখনো এলো না।
মালাউনগুলো কথা দিয়ে কথা রাখে না; ওদের গায়ের গন্ধ আমি পছন্দ করি, এটা ওদের সৌভাগ্য; আজ কথা না রাখলে কালকে ওর দোকানটা পাক পবিত্ৰ আগুনে ছাই হয়ে যাবে।
গেলমান জিনিশটা জিহাদি মোঃ হাফিজুদিনের খুব পছন্দ।
বাড়িতে ওর একটি বিবি আছে, এর আগে একটি বিবিকে তালাক দিয়েছে, ওর পছন্দ গেলমান; হয়তো জিনিশটা খুবই ভালো, আমি কখনো পরখ ক’রে দেখি নি, দেখতে আমার ইচ্ছে করে না; আমি পছন্দ করি প্রথাগত জিনিশ, তবে মোঃ হাফিজুদ্দিনের মতে সকল জিনিসের সেরা, আসল জিনিস, হলো গেলমান, সোভানাল্লা। ও খুব কচি গেলমান পছন্দ করে, ন-দশ বছরের; একটু একটু ক’রে সে তাদের ট্রেনিং দেয়, নানা রকম ক্রিম সে কেনে ঢাকা গিয়ে।
গেলমানরাও রোজগার ভালোই করে।
হাফিজুদ্দিন বলে, ‘আইজ রাইতে একটা গেলমান ছহবত কইর্যা দেখেন, এইটাই আসল জিনিশ, এইজন্যে বেহেশতেও গেলমান আছে, সোভানাল্লা।’
আমি বলি, ‘না, এটা আমি পারবো না।’
হাফিজুদিন বলে, ‘হুজুর, আপনে আইজও খাটি মুছলমান হইতে পারেন নাই, একবার কইর্যা দেখেন, পরে আর মাইয়ামাইনষের দিকে চোকও দিতে ইচ্ছা হইব না।’
আমি বলি, ‘এই দুনিয়ায় মালাউন উর্বশী আমি পছন্দ করি, ওরা যখন কাপড় তুলে চনচন ক’রে প্রস্রাব করে সেই শব্দটাও আমার ভালো লাগে। মহান পাক রাহমানির রাহিম আমাকে এইভাবেই সৃষ্টি করেছেন।’
হাফিজুদ্দিন বলে, ‘আগে জানলে মহা আল্লাহতাআলা আদমের বদলে আপনারেই সৃষ্টি করতেন।‘
আমি হাফিজুদ্দিনকে একটু বিব্রত করতে চাই, যাতে সে আরো বেশি করে আমার অধীনে থাকে; তাই আমি বলি, ‘নাউজুবিল্লা।’
হাফিজুদিন বলে, ‘হুজুর, মাপ কইর্যা দেন; এইটা আপনের আমার মইদ্যে ক’তা, হুজুর, কারে কোন দিন বইল্যেন না।’
আমি বলি, ‘তুমি আমাকে সন্দেহ করো?’
হাফিজুদিন বলে, ‘না, হুজুর, আপনে সব সন্দেহের বাইরে।’
আমি বলি, ‘মোঃ হাফিজুদ্দিন, তুমি গোলমানের কথা বলেছে, এতে আমি নাখোশ হইনি।’
মোঃ হাফিজুদিন বলে, ‘বুক থিকা আমার একটা পাত্থর নাইম্যা গেল।’
আমি বলি, ‘তুমি কি সক্রেটিসের নাম শুনেছো?’
মোঃ হাফিজুদ্দিন বলে, ‘না, হুজুর।‘
আমি বলি, ‘সে দুনিয়ার এক মহাজ্ঞানী ব’লে পরিচিত, তাঁরও দুটি কচি গেলমান ছিলো, তাদের মধ্যে তাকে নিয়ে মারামারি লাগতো।’
মোঃ হাফিজুদ্দিন বলে, ‘হুজুর, আমারগুনি মারামারি করে না।’
মালাউনটার আসার কথা ছিলো
মালাউনটার আসার কথা ছিলো, সে এলো না; কাল ওর দোকান আর চাউল কল কীভাবে পুড়বে, সে দৃশ্য আমি দেখতে থাকি।
এমন সময় দেখি মালাউনটা কথা রেখেছে, দশটার দিকে সে এসেছে, সঙ্গে তার মেয়ে কণকলতা।
কণকলতাকে আমি প্ৰথমে চিনতে পারি নি, হরিপদর সঙ্গে বোরখাপরা একটি মেয়েলোক দেখে চমকে উঠেছিলাম। হরিপদ পাল আর মূর্তিটুর্তি বানায় না, ওতে আর পয়সা নেই, দুর্গাটুর্গা বানালেই তো রাতে গিয়ে আমার জিহাদিরা ভেঙে দেয়। বাজারে ওর বড়ো দুটি দোকান রয়েছে, একটি চাউল কলও আছে; আমি জানি হুণ্ডি করে সে টাকা পাঠায় চন্দননগরে, আমাকেও বেশ দেয়; না দিয়ে ওর উপায় নেই। তাই ভালো আছে।
হরিপদীর বিধবা মেয়েটির ওপরই আমার প্রথম চোখ পড়েছিলো।
তার ওপর সবারই চোখ পড়ে, যেমন রাস্তার পাশে কালীমূর্তির ওপর চোখ না পড়ে পারে না। মোটাগোটা, দারুণ মাজা, দারুণ দুধ, দারুণ ঠোঁটযুক্ত শক্ত কালো ঝকঝকে তাজা মেয়ে; একটা মারাত্মক কালী, কাজেও কালীর মতোই, জিভ দিয়ে বুকের সব রক্ত শুষে নিতে পারে; বাইশ-তেইশ বছর হবে। ওকে দেখে আমার মনে হয় ও যদি রাস্তার পাশে কালীমন্দিরে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, তাহলে ও আসল কালীকেও ছাড়িয়ে যেতো; তখন পুজোরীর সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যেতো। তবে আমরা কালীমন্দিরগুলো চুরমার করে দিয়েছি, দেশে কোনো মন্দির থাকবে না; তাই ও মন্দিরে না দাঁড়িয়ে চাউল কল দেখাশোনা করছে। দেবীরা এখন নানা পেশায় নিয়োজিত।
একদিন হরিপদার চাউল কলেই ওকে প্রথম দেখি।
হরিপদ নাম রাখতে শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাহেবের মতোই প্ৰতিভাবান, ফুল পুষ্প মালা লতা ছাড়া আর কিছু সে বোঝে না; এই মেয়েটার নাম রেখেছে সে বকুলমালা, ওকে দেখলেই ওর গায়ে কালো বকুলের গন্ধ পাওয়া যায়। আমি কখনো কৃষ্ণবকুল দেখি নি, কিন্তু বকুলমালা হচ্ছে কৃষ্ণ বকুলের মালা, হয়তো আফ্রিকায় বা দক্ষিণ ইন্ডিয়ায় ফোটে। বকুলমালা বিএ পাশ, যেটা আমি সাম্যবাদে সর্বাহারায় যোগ দেয়ার জন্যে করতে পারি নি, একটা মুর্খ বুড়োর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো, সেটা ওর ওপর উঠতে পেরেছিলো কি না জানি না, না পারারই কথা, ওর ওপরে উঠতে হলে হিলারি তেনজিং দরকার, তবে বছরখানেকের মধ্যেই চিতায় ওঠে।
বকুলমালা এখন রক্তজবার মতো লাল টকটকে শাড়ি পরে চাউল কলি দেখাশোনা করে; রক্তজবার লাল আর ওর কালীর কালো মিলে এক রোজকেয়ামতের রঙ সৃষ্টি হয়; কলের ভেতরে একপাশে তার ছোটো অফিস ঘর, বেশ আছে মনে হয়। ওকে ঠিক রাখার জন্যে, সুখে রাখার জন্যে একটা কলই দরকার, হরিপদ তা বুঝতে পেরেছে।
আমি ঢুকতেই সে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম, আসেন হুজুর।’
আমি বলি, ‘ওয়ালাইকুমছালাম।‘
বকুলমালা বলে, ‘হুজুর, আপনে একদিন আসবেন, এইটা আমি জানতাম; কত দিন আপনের দিকে চাইয়া রাইছি, একবারও আপনে চান নাই। আপনে কি সব সোম আল্লার দিকেই চাইয়া রন নি?’
আমি বলি, ‘তুমি আমাকে চেনো না কি? আর এতো সুন্দর ছালাম দিতে কখন শিখলে?’
বকুলমালা বলে, ‘আপনেরে চিনিব না, কী যে কন। ভগবানরে না চিনতে পারি, আপনেরে না চিন্না পারি না।’
আমি বলি, ‘কেনো?’
বকুলমালা বলে, ‘আপনে জামাঈ জিহাদে ইছলামের বড় নেতা, বড় হুজুর, আপনেরে চিনুম না? আর ছালামের কতা কন, এখন ত আমরা বারো আনি মুছলমান হয়েই গেছি–লাই লাহা ইল্লাল্লা মুহম্মদের রছুলুল্লা। আরো শোনবেন?–আলিফ লাম মিমা জালোকাল কিতাবা লা রায়বা ফিহা হুদাল্লিল মুত্তাকিন।’
বছর দশেক আগে এটা আমি বলতে পারতাম না।
আমি বলি, ‘মাশাল্লা, চমৎকার, মারহাবা।’
বকুলমালা বলে, ‘হুজুর আপনেরে আমি পছন্দ করি, আপনে দেখতে অন্য জিহাদিগো মতন না, আপনে হিরোগো মতন।’
বকুলমালা রক্তজবার মতো হাসতে থাকে, মেয়েটিকে অসামান্য মনে হয়, আমার সঙ্গে এতো সহজে কেউ রসিকতা করতে পারে না।
আমি বলি, ‘তোমার কথায় বড়ো রস, তুমি বড়ো সরস।‘
বকুলমালা বলে, ‘হুজুর, আল্লার রহমতে আমার সব কিছুতেই রস, চাউল কলের ঝকঝক্কিার মইদ্যে তা বোজন যাইব না।’
আমি বলি, ‘তোমার পুরো মুছলমানই হওয়া উচিত, তোমার মুখে কালাম শুনে আমি মুগ্ধ হচ্ছি, মুছলমান হয়ে যাও না কেনো? আল্লা তোমাকে রহমত দেবেন।’
বকুলমালা বলে, ‘তা ত হইতে চাইছিলামই, ভাইগ্যে হইল না। আল্লা ত রহমত দিল না।’
আমি বলি, ‘কেনো? আল্যা সব সময়ই রহমত দেন।‘
বকুলমালা বলে, ‘কলেজে পড়নের সময় একটা মুছলমান ক্লাশমেটের সঙ্গে প্যাট ভইর্যা এক বছর প্রেম করছিলাম, ভাবছিলাম মুছলমান হইয়া যামু, নিজের নাম রাকুম মোছাম্মৎ উজমাতুন্নেছা।’
আমি বলি, ‘বেশ চমৎকার নাম রেখেছিলে, রাখলে না কেনো?’
বকুলমালা বলে, ‘আহা, আমার লাভার মোহাম্মদ তমিজুদ্দিন মিয়া, যে আমারে অনেকগুনি কালাম শিগাইছিল, সে আমার প্যাট বানাই দিয়া কাঁইট্যা পড়লো, আমি একলা গিয়া চিৎ অইয়া এম আর করলাম। তারপর একটা মূর্খ খোজা বুড়ার সঙ্গে বিয়া হইল, সেইটার ত জোর আছিল না, দারাইত ত না, তবে হে আমারে বেশি কষ্ট দেয় নাই, আমারে মইর্যা বাচাইলো।’
আমি বলি, ‘তুমি ও তোমার দেহখানা আল্লাপাকের অদ্ভুত সৃষ্টি।’
বকুলমালা তার চাউল কলের চাকার থেকেও প্রখরভাবে চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আল্লাপাকের অদ্ভুত সৃষ্টিটা পুরাপুরি দেখনের সাধ হইছে হুজুরের?’
আমি বলি, ‘খালি দেখলে কি হবে?’
বকুলমালা বলে, ‘আল্লাপাকের অদ্ভুত সৃষ্টি কি খালি দেখনের লিগা, সেইটার একটু রস না খাইলে আল্লাপাক বোজার হইব। হুজুরের কি ইচ্ছা?’
আমি বলি, ‘আল্লার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তোমার রস তোমাদের খেজুর গাছের রসের থেকেও মিঠা হবে।’
বকুলমালা বলে, ‘হুজুররে কি খাজুরের রস খাওয়ান যায়?’
আমি বলি, ‘কিসের রস খাওয়াবে?’
বকুলমালা বলে, ‘খাড়ি আঙ্গুর বেদানার রস, পাক পাকিস্থানেও এই রকম আঙ্গুর বেদানার রস পাইবেন না, হুজুর।’
আমি বলি, ‘কয়েক গেলাশ খাওয়ার তিয়াষ হচ্ছে।’
বকুলমালা বলে, ‘তাইলে সন্ধ্যার পর আইসেন, কোনো অসুবিদা হইব না; তয় হুজুর, একটা কতা দিতে হইব।’
আমি বলি, ‘কী কথা?’
বকুলমালা বলে, ‘বাবার দোকান দুইডা আর চাউল কনডা একটু দেকবেন, হুজুর, আমাগো বাড়িডাও একটু দেখবেন, তাইলেই অইব।’
আমি বলি, ‘আমি কি দেখছি না?’
বকুলমালা বলে, ‘হুজুর, আপনে দেকছেন। বইল্যাই ত অহনও টিইকা আছি আপনের রহম থাকলে কোনো ডর নাই; এখন তা দিকে দিকে আপনের তালেবানরা মালাউনগো বাড়ি পুড়তেছে, মাইয়ালোকগো জিনা করতেছে, আর আপনেগো মেইন পার্টির সৈন্যদের কতা না অয় ছাইর্যাই দিলাম।’
আমি বলি, ‘তোমাদের বাড়িতে তো তা হয় নি।’
বকুলমালা বলে, ‘না, হয় নাই, বাবায় অবশ্য বলছে আমাগো ডর নাই, আপনের লগে বাবার খাতির আছে, বাবায় সামান্য কিছু আপনেরে দিছে, নাইলে আমিই আপনের কেছে যাইতাম।’
আমি বলি, ‘আল্লার রহমতে তোমাদের ডর নাই, আমি আছি; তবে তুমি আমার কাছে যদি আগেই যেতে তোমার বাবার একটি কড়িও দিতে হতো না।’
বকুলমালা বলে, ডরে যাই নাই, হুজুর, আপনের বকুলমালা পছন্দ না ট্যাকার থলি পছন্দ, তা বুজতে পারি নাই।’
আমি বলি, ‘আমি দুটোই পছন্দ করি, তবে তুমি গেলে তোমার বাবার থলেটা হয়তো নিতাম না, আমি দয়া করতেও পছন্দ করি।’
বকুলমালা বলে, ‘আইজ রস খাইতে আইসেন, হুজুর।’
সেই সন্ধ্যায় বডিগার্ড নিয়ে হরিপদর বাড়ি যাই, বকুলমালা আমাকে তার ঘরে নিয়ে যায়; ঘরটি বকুলমালার মতোই। মালাউনগুলো এতো বালামছিবতের মধ্যেও সব কিছু গুছিয়ে রাখে, এটা বেশ বিস্ময়কর।
তার দেহটি মালাউনদের কষ্টি পাথরের শিলামূর্তির মতো, আর তার শক্তি কালীমাতার থেকেও বেশি। ভাগ্য ভালো আমি তার স্বামী নই, নইলে সে আমার কলজেটা ছিড়ে রক্ত খেতো, তার জিভটা দিয়ে সে সারা দুনিয়ার রক্ত চেটে খেতে পারে, আমার কলজেটা তো সামান্য। বকুলমালা এখন আমার প্রিয় রক্ষিতা, স্বেচ্ছাবন্দিনী, এমনকি বাদি বলাই ভালো; এতে দোষ নেই, আমি পাক বইপত্র পড়ে দেখেছি, এতে কোনো গুনাহ নেই, এটা জায়েজ। তার কালো রঙটার প্রতি আমার একটা মোহ আছে, সৌন্দৰ্য শুধু শাদায়, এটা আমি বিশ্বাস করি না, বকুলমালার রঙ কালো কিন্তু দেহখানি তেলতোলে, আর সেটি মরা লাশের মতো নয়, ওই দেহের সংস্পর্শে দেহে কুয়ৎ জন্মে।
বকুলমালার সঙ্গে সঙ্গম করা ভৈরবীর সঙ্গে সঙ্গমের সমান।
বকুলমালার ছোটাবোন কণকলতাটিকে লতার মতো দুলতে ঝুলতে বুলতে ফুলে ফুলে ভরে উঠতে দেখতে দেখতে ওই লতার প্রতিও আমার একটু আগ্ৰহ জন্মে, গাছের ডালে ঝুলে থাকা স্বর্ণলতা চিরকালই আমাকে ব্যাকুল করেছে; তাই বকুলমালার সামনেই জড়িয়ে ধ’রে তাকে আমি আদর করি, এতেও কোনো দোষ নেই, বকুলমালাও এতে দোষ দেখে না; সতেরো বছরের কণকলতা বকুলমালার থেকে ভিন্ন; বকুলমালা রক্ত খেতে চায়, ও হয়তো ওদের দেবী কালীর বকুলমালারূপ, জিভা ভরে রক্ত, আর কণকলতা রক্ত খেতে দিতে চায়, কণকলতা গা বেয়ে ঝুলে থাকতে চায় স্বৰ্ণলতার মতো, ওর রঙটাও কণকলতার, ও সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা।
বকুলমালা হচ্ছে মহাকালী, আর কণকলতা লক্ষ্মী বা সরস্বতী বা দুৰ্গা, হয়তো মরুভূমি থেকে বিতাড়িত লাৎ বা মানৎ।
তাই আজি কণকলতাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম হরিপদকে। কালীদেবীকে অনেক দেখেছি, একটু লক্ষ্মী সরস্বতী দুৰ্গা দেখার সাধ হয়।
হরিপদকে আমি বাইরের ঘরে বসিয়ে রাখি, আমার বডিগার্ডরা তাকে কোক পান সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করবে।
হরিপদ বলে, ‘হুজুর, একটা কতা আছে আপনের লগে।‘
আমি অন্য দিকে নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বলো, কী কথা?’
হরিপদ বলে, ‘দেইখ্যেন, হুজুর, মাইয়াডার জানি প্যাট না অয়।‘
আমি বলি, ‘পিল খাওয়াও না?’
হরিপদ বলে, ‘কি কইলেন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘পিল, মায়াবড়ি না সতী বড়ি, কী যেনো নাম। এখন মালাউন মাইয়াদের জন্মের দিন থেকেই পিল খাওয়া দরকার, নইলে তাদের পেট থেকে একের পর এক মমিন বেরোবে।’
হরিপদ বলে, ‘তা তা জানি না।’
আমি বলি, ‘তোমারই তো ওগুলো কিনে আনা উচিত, পিতার কর্তব্য পালন করা উচিত।‘
হরিপদ বলে, ‘বাপ হইয়া কি কইর্যা আমি মাইয়াগো খাইতে দেই?’
আমি বলি, ‘অসুবিধা কী? এটাই তো এখন প্ৰধান খাদ্য।‘
হরিপদ বলে, ‘হুজুর, কি যে কন।’
আমি বলি, ‘চিন্তা করো না, আমার ঘরে সুলতান আছে।‘
হরিপদ সুলতান চেনে না মনে হয় বা হয়তো চেনে, সে খুশি হয়।
হরিপদ বলে, ‘হুজুর, চৈদ্দ পুরুষের দ্যাশে আর থাকতে পারুম না মনে অয়। বাপদাদার ভিড়ামাডি ছাইরা চইল্যা যাইতে অইব মনে অয়।’
আমি বলি, ‘কেনো পারবে না? আমি তো আছি।’
হরিপদ বলে, ‘হুজুর, আরো কহন নিতে আসুম?’
আমি বলি, ‘ফজরের আগে, আজানের আগে এসো।‘
হরিপদ বলে, ‘আচ্ছালাতু খাইরুম মিনাননাইউম শোননের আগেই আমি আসুম হুজুর, রাইতে আমার ঘোম হইব না।’
আমি বলি, ‘তোমার মেয়ের ঠিকই ঘুম হবে, তাকে আমি ভালো করে ঘুম পাড়াবো, তোমার মেয়ের কথা তুমি কতোটা জানো? বাপের কাজ মেয়ে জন্ম দেয়া, মেয়েকে নিয়ে আসা, দিয়ে যাওয়া, মেয়ে কীভাবে ঘুমোবে তা বাপের জানার কথা নয়।’
হরিপদ বলে, ‘জি, হুজুর; আমার কলডারে একটু দেইখ্যেন, দোকান দুইডারে দেইখ্যেন, ঘরবাড়িড়া একটু দেইখ্যেন, আপনের আতেই সব সাইপ্যা দিলাম।’
আমি বলি, ‘তোমার কল, মেয়ে, দোকান, বাড়ি নিয়ে চিন্তা কোরো না; তোমার মেয়ে সুন্দর ঘুমোবে, পারলে এখন তুমি গিয়ে ঘুমোও।’
হরিপদ চ’লে যায়, ঘরে ঢুকে দেখি কণাকলতা বোরখা পরেই দাঁড়িয়ে আছে, মুখটিও খোলে নি। আমি ঢুকতেই সে নাচের ভঙ্গিতে মুখের পর্দাটি সরিয়ে বলে, ‘জাহাপনা, আমারে দেখতে কেমন লাগছে?’
আমি বলি, ‘তুমি বোরখা পেলে কই?’
কণকলতা বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, একটা ক্যান, আমার তিনটা বোরখা আছে, হিজাব আছে; আর হুজুরের বিবি হওনের জন্যে আসছি, বেশিরম বেলেহাজ হয়ে ত আসতে পারি না। আমারে বিবিজান মনে হইতেছে না?’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি বেহেশতের হুর, তুমি উর্বশী।’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আমারে বিবি কইর্যা লন, হুজুর।’
আমি বলি, ‘তোমার রঙ্গ আমার পছন্দ তোমার দেহটির মতোই।‘
কণকলতা বলে, ‘জাহাপনা, আপনে ত সব দেখেন নাই, আইজ আপনে পাগল হইয়া যাবেন। তয় আমারে একটু সুরা পইরা আপনের বিবি বানান।’
কণকলতা আমাকে চেনে, আমিও কণকলতাকে চিনি।
ওর ঠোঁট আর বুক দুটি আমার ভালোভাবেই চেনা, ওগুলো আমি খেয়েছি, সেদ্ধ ডিমের ভর্তা বানিয়েছি, ভর্তা আমি ভালোই বানাতে পারি; দাঁত দিয়ে কেটেছি, আমার দাঁতগুলো স্নায়ুহীন নয়, ওগুলোরও বোধ আছে, স্তনে দাঁতের লাল দাগ আমার চুনির থেকেও সুন্দর লাগে, আর সব সৌন্দৰ্যই আমার খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, শুধু দেখে আমার সুখ হয় না; আর মহান আল্লাই জানেন আমার কোনো যেনো মালাউনদের গন্ধ ভালো লাগে, ওর গন্ধ নিয়েছি, কোনো ফুলের সঙ্গে ওই গন্ধ মেলাতে না পেরে আমি বিহবল হয়েছি।
শুধু সারাদেহটি আর নিচের মধুঝর্নাটি চিনি না; বকুলমালার ঘরে অতোটা দেখতে আমার খারাপ লেগেছে। আজই ওকে আমি ভালো করে দেখবো, ওর ঝর্নধারায় ভাসবো; বকুলমালার গাঙটা একটু বেশি প্রশস্ত, অনেকটা মেঘনার মতো; কণকলতারটি দিনাজপুরের কাঁকড়া নদীটিার মতোই হবে, ওর কথা ভাবলেই আমার কাঁকড়া নদীটার কথা মনে পড়ে।
ওর ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে? দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি?
আমি সালোয়ার পাঞ্জাবি খুলে লুঙ্গি পরি, লুঙ্গি পরার সময় আমার লুঙ্গিটা টেনে ফেলে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কণকলতা।
কণকলতা জীবনকে সুন্দরভাবে নিয়েছে, আমাকে ও সামান্য ক’রে ফেলেছে। কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের আলহজ মওলানা ছাহেব হুজুরট দেখি এখনই খাড়া তালগাছ হইয়া আছে।’
আমি বলি, ‘খাঁটি মমিনের হুজুর এমনই হয়, তার কোনো অবসর নেই, আর এখন তো আমাদের সব সময় দণ্ডায়মান থাকা দরকার।’
কণকলতা হাসতে হাসতে বলে, ‘হুজুর, জাহাপনা, আপনে আমারে বিছমিল্লা আলহামদুলিল্লা রাহমানের রাহিম শয়তানের রাজিম বইল্যা শাদি কইর্যা লন; আমি আপনের চাইরডা বিবির একটা হইয়া থাকি, আপনেরে আমার ভাল লাগে, আপনের সঙ্গে পেয়ার করতে আমি সুখ পামু, আমার দেহডা সুন্দর, আপনের দিলডা সুন্দর, আমারে বউ পাইলে আপনের দিলও সুক পাইব।’
আমি বলি, ‘আমার কোনো বিবি নেই।’
কণকলতা খিলখিল করে হাসে. বলে, ‘তাইলে আমারেই আপনের এক নম্বর বিবি কইর্যা লন, হুজুরের বিবি হইতে আমার ভাল লাগবো, আমার নাম রাইখ্যেন বিবি রহিমা।‘
আমি বলি, ‘কণকলতা।’
কণকলতা বলে, মালাউন হইয়া থাকতে আমার ভাল লাগে না, আইজ এইডার লগে কাইল অইডার লগে হুইতে হইতে আমি বেশ্য হইয়া যামু, বেশ্যা অইতে আমার ভাল লাগবে না, দৌলতদিয়া গিয়া আমি থাকতে পারুম না।’
আমি বলি, মুছলমান হ’তে চাইলে পরে আমার কোনো জিহাদির সঙ্গে তোমার শাদি দিয়ে দেবো, সে তোমাকে খাঁটি মুছলমান বানাবে।’
কণকলতা বলে, ‘সে কি আপনের মতন পারব? আমি ত আপনের হুজুররেই চাই, ওই হুজুররেই আমি ছেজদা করতে চাই, পারবেন হুজুর? আর আপনের জিগাদিগো দেকলে আমার বমি আহে।‘
আমি বলি, ‘তারা মমিন মুছলমান, বমি আসবে কেনো?’
কণকলতা বলে, ‘মমিন মালাউন দেকলেও আমার বমি আহে, মমিন মুছলমান দেকলেও আমার বমি আহে।’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি পিল খাও?’
কণকলতা খিলখিল ক’রে বলে, ‘পিল খামু ক্যান?’
আমি বলি, ‘যদি পেট হয়ে যায়?’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে তা আলহামদুলিল্লা। আইজ আমি আইছি প্যাডে একটা পাক মমিন নেওনের জন্যে, হুজুরের পোলা নেওনের জন্যে, যে এক সময় পাহাড়ের মতন মুছলমান হইয়া দুনিয়ায় ইছলাম কায়েম করব, যে দ্যাশটারে পাকিস্থান বানাইব।’
আমি বলি, ‘এখন আমি পোলা চাই না।‘
কণকলতা খিলখিল করে বলে, ‘আল্লায় না কইছে একটা বীজও নষ্ট অইতে দেওন যাইব না? প্ৰত্যেকটা বীজ থিকা মমিন মুছলমান বানাইতে হইব, যাতে জীবন ভইর্যা জিহাদ করতে পারে? আইজ আমি একটা মমিন পোলা চাই।‘
আমি বলি, ‘তুমি এসব জানলে কী করে?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, জানুম না ক্যা? এই পাক দ্যাশে থাকুম আর ইছলাম জানুম না, তা কি কইর্যা অয়? আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতোয়ানির রাজিম, লাই লাহা ইল্লাল্লা মুহম্মদের রছুলুল্লা। আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামিন, আররাহমনির রাহিম, মালিকি ইয়াওমিদ্দিন, ইয়াকানা বুদু ওয়া ইয়াকানাস্তাইন।’
আমি বলি, ‘তুমি কাফের নও, খাটি মুছলমান, বেহেশতের আওরাত।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমার বাপের দোকান দুইডা আর কলডা জানি না পোড়ে, আমাগো ঘরবাড়ি জানি না পোড়ে।’
আমি বলি, ‘পুড়বে না, আল্লার রহমতে পুড়বে না।‘
কণকলতার দেহটি কণকলতার মতোই; একবার ছেঁড়াফাড়া ভাঙাচোরার পরই ও ঘুমিয়ে পড়ে, মেয়েটির মনে হয় এইবারই প্ৰথম, আমার হুজুরকে প্রবেশ করাতে বেশ পেরেশান হ’তে হয়, তবে ওই পেরেশানিটাই হলো বেহেশতের সুস্বাদ, মেয়েটা কণকলতার মতোই নরম, শুধু গলতে জানে, গলতে গলতে কণকলতার ধারা হয়ে যায়। বকুলমালা শুধু চায়, আমার রক্ত শুষে খায়, ও জীবন্ত কালী, আমি না পারলেও পারার চেষ্টা করি, বকুলমালা হেসে বলে, ‘একবারেই কাহিল হুজুর? আমার যে আরও দশবার লাগিব’; এই কণকলতা কিছু চায় না; একে শেফালি ফুলের মতো পিষে ফেলা যায়, ওকে নিয়ে শিউলির বিছানায় ঘুমোনো উচিত। পিষে ফেলেছি, ও এখন ঘুমোচ্ছে, ঘুমোলেও ক্ষতি নেই, আমার কাজ আমি করেছি, আবার যদি পারি তখন আমার কাজ আমি করতে পারবো–কয়েকবার পাকিস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। মনে মনে পাক সার জমিন সাদ বাদ গানটা গাইবো, যদিও গানটা আমার ঠিক মনে নেই; শাইতোয়ানির রাজিম বলে কিছু বললেও চলবে।
ঢাকা থিকা জিহাদিরা আইসছেন
এক বডিগার্ড দরোজায় টোকা দিয়ে বলে, ‘হুজুর, ঢাকা থিকা জিহাদিরা আইসছেন।’
আমি বলি, ‘জিহাদিদের বসতে বলো, কোক ফান্টা সেভেন আপ দাও।’
আমি ওজু করে, পাজামাপাঞ্জাবি পারে বাইরে বেরোই, দেখি একদল জিহাদি ব’সে আছে, তিরিশজনের মতো।
জিহাদিদের আমি যতোই দেখি ততোই বিস্মিত হই।
আমাকেও পুরোপুরি ওদের মতো হ’তে হবে, সাম্যবাদ ও সর্বহার করেও আমি ওদের মতো হয়ে উঠতে পারি নি, কিন্তু পারতে হবে; খুন করার সময় ওরা ছুরির থেকেও ধারালো আর নিষ্ঠুর, ছহবতের সময় ওরা লোহার মতো শক্ত, শক্ত হতেও সময় নেয় না, ক্ষরণেও সময় নেয় না, আবার শক্ত হয়, বিছমিল্লা বলে আবার শুরু করে; এবং বিনয়ের সময় ওরা পা ধ’রে ছালাম করতেও দ্বিধা করে না, পায়ে পড়ে যায় অবলীলায়, পচা ময়লার মতো প’ড়ে থাকে।
এটা খুবই দরকার, দীক্ষিত করতে হ’লে এমনই দীক্ষা দরকার।
ওরা সবাই মাদ্ৰাছার তালেবেলেম, ওরাও পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষায় নকল করার সময় ওরা আশমানি কেতাবের পাতা জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে নেয়, একটুও ভয় পায় না, যদিও সাম্যবাদ করার পরও এটা আমি কোনো দিনই করতে পারবো না, আবার খুনের সময় ওরা দশগুণ শিমার ও মুহম্মদি বেগ, ছুরি হাতে পথে পথে ছুটতে পারে।
আমার এক দোস্ত, হারামজাদা এক সময় সাম্যবাদ করতো, পরে বিসিএস দিয়ে আমলা হয়ে গেছে, তবে ওর বাড়িটা এক সময় ছিলো আমার বড়ো আশ্ৰয়, কিছু হ’লেই গিয়ে ওর বাসায় উঠতাম। একদিন গিয়ে দেখি হারামজাদা বাসায় নেই, হারামজাদার না কি অনেক মিটিং।
ভাবি বলেন, ‘কি হে মহামতি কার্লমার্ক্স, কমরেড লেনিন, কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড চে গুয়েভারা, খতমি হক সাহেব? বিপদ হয়েছে না কি?’
ভাবিটি বাঙলার ছাত্রী ছিলেন, পরিহাস করতে পারেন যখন তখন; তাঁর পরিহাস আমার ভালোই লাগে, আর বুকে একটু কষ্ট লাগে।
আমি বলি, ‘না, ক্ষুধা লেগেছে; আর ওই ট্রেইটরটা কই?’
ভাবি বলেন, ‘ট্রেইটরটা তার উপজেলায় মাদ্ৰাছার হিশেবে করতে গেছে, আর ফাজিল দাখিল কামিল কাহিল কুহিল পরীক্ষার সেন্টার দেখতে গেছে।’
আমি বলি, ‘ট্রেইটরটা এখন মাদ্ৰাছা নিয়েই আছে?’
ভাবি বলেন, ‘ক্ষুধা কেমন লেগেছে?’
আমি বলি, ‘দুই চারটি হাতি খেতে পারি।’
ভাবি বলেন, ‘তাহলে খেয়ে ঘুম দিন, সন্ধ্যায় ট্রেইটরের সঙ্গে দেখা হবে।’
অনেক দিন পর পেট ভ’রে ভাত খাই। মুরগির গোস্ত, লাউডগা দিয়ে কই মাছ, গোলশা, চিংড়ির ভর্তা দিয়ে কয়েক থাল ভাত খেয়ে একটি লম্বা ঘুম দিই, সন্ধ্যার পর উঠে দেখি ট্রেইটরটা এসেছে। দেখি ট্রেইটরটার সব কিছুই আগের থেকে ভালো, বউটা ভালো—ভাবিকে আমি আগে থেকেই চিনি, তাঁর জন্যেই তো সাম্যবাদীটা ট্রেইটর হয়ে গেলো,–চেহারাটা আরো ভালো হয়েছে, জিপটাও ভালো, একটা মেয়ে হয়েছে, সেটিও ভালো।
সাম্যবাদ। আমাকে ভালো কিছু দেয় নি।
আমি বলি, ‘আই ট্রেইটর, তুই না কি এখন মাদ্ৰাছায় মাদ্ৰাছায় ঘুরিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘এই ইছলামেরর পাণ্ডাগুলো আমাকে পাগল ক’রে দিচ্ছে, ইচ্ছে হয় আবার সর্বহারা হয়ে যাই।’
আমি বলি, ‘কী হয়েছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘সাত দিন ধ’রে আমার কাজ পড়েছে আমার উপজেলায় আসলে কটি সরকারি মাদ্ৰাছা আছে, কজন হুজুর আছে, তার হিশেবে বের করা। তারপর আবার এখন ফাজিল কামিল দাখিল কাহিল কুহিল পরীক্ষা চলছে, ওই সব পরীক্ষার হলে গিয়ে নকল ধরতে হচ্ছে।’
আমি বলি, ‘কী দেখছিস?’
ট্রেইটর বলে, ‘সন্ধ্যার পরই তুই তা দেখতে পাবি।’
সমাজের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না, সমাজ কীভাবে কাজ করে তা আমি জানি নি; আমি জানতাম সমাজ হচ্ছে শ্রেণীদ্বন্দ্বের ব্যাপার, আর আমাদের কাজ হচ্ছে শোষণকারীদের শোধন ও নিধন করা। এর জন্যে দরকার অস্ত্ৰ, কাটা রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড, বোমা, মাইন প্রভৃতি, এবং নিউজপ্রিন্টের অজস্র ইশতেহার। সন্ধ্যা হতে হয় না, বিকেলেই দেখি টুপি দাড়ি নিয়ে একদল ঢুকছে ট্রেইটরের ড্রয়ি রুমে।
সবাইকে সে ঢুকতে দেয় না, অধিকাংশই দাড়িয়ে থাকে বাড়ির বাইরে গাছতলায়; কেউ কেউ গাছতলায় গামছা পেতে নামাজ পড়তে থাকে।
ট্রেইটর ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই জনদশেক বুড়ো মওলানা মৌলভি তার পায়ে পড়ে যায়, তার পায়ে চুমো খায়, সেজদা দেয়ার মতো পড়ে থাকে। আমি সর্বহারা হ’লেও এতে একটু কেঁপে উঠি; কিন্তু আমার ট্রেইটরটা এরই মাঝে সমাজকে বুঝে ফেলেছে, সে কাঁপে না, সে তাদের পা থেকে উঠতে বলে না, যেনো তার পা দুটি ওদের পড়ে থাকার জন্যেই সরকার বাহাদুর দিয়েছেন; ট্রেইটর একবার আমার দিকে তাকায়, যেনো বলছে, ‘দ্যাখো।‘
ট্রেইটর, যদিও জানে এরা কারা, তবু বলে, ‘আপনারা কারা?’
তারা এবার মাথা নিচু ক’রে দাঁড়ায়, দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘ছার, হুজুর, আমরা আপনের অধীনের মাদ্ৰাছার হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনারা কেনো এসেছেন?’
হজুররা বলে, ‘ছার, আমরা শুনছি আপনে আমাগো মাদ্ৰাছা ভিজিটে গেছিলেন, আমরা সেই সোম এবাদত বন্দেগি করতেছিলাম, তাইতে আপনে আমাগো পান নাই, ছার আপনে আমাগো বাচান।’
ট্রেইটর বলে, ‘তখন তো এবাদতের সময় ছিলো না।’
হুজুররা বলে, ‘ছার, আমরা সব সোমই আল্লার এবাদত বন্দেগি করি, এবাদত বন্দেগি সব সোমাই করন যায়।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু আপনাদের তো বেতন দেয়া হয় পড়ানোর জন্যে, সব সময় এবাদতের জন্যে নয়।’
হজুররা বলে, ‘ছার, আল্লা রছুলের পরই আপনে আমাগো মালিক, এইবার আমাগো মাফ কইর্যা দ্যান, আল্লায় আপনেরে ভেস্ত দিবো।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার উপজেলায় কাগজেকলমে ১৫০টি মাদ্ৰাছা আছে, আমি ভিজিটে গিয়ে দেখেছি আছে পাঁচটি; অন্য কোনোটির নাম হিজল গাছের ডালে, কোনোটির নাম আমগাছের ডালে, কোনোটির নাম মুদিদোকানের চালে, ওই সব মাদ্রাছা আমি দেখতে পাই নি।‘
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা গুনাহর কাম করছি, আমাগো মাফ কইর্যা দেন, নাইলে পোলাপান লইয়া মরুম।’
ট্রেইটর বলে, ‘কিন্তু বেহেশতে তো ভালো থাকবেন, হুর আর গেলমান পাবেন বলে শুনেছি।’
গেলমান শব্দটি আমি ওই প্ৰথম শুনি, বুঝতে পারি ট্রেইটর বিসিএস হওয়ার জন্যে অনেক কিছু শিখেছে গাইড বই প’ড়ে।
হজুররা বলে, ‘কে ভেস্ত পাইব আর না পাইব, তা কি কওন যায়, ছার? তয় দুনিয়ায় ভাতকাপড় না আইলে বাচন যায় না। দুনিয়ায় বউ পোলাপান ভাত না পাইলে হুরে গোলমানে কি হইব?’
ট্রেইটর বলে, ‘১৫০টি মাদ্ৰাছায় আপনারা কতোজন হুজুর আছেন?’
হজুররা বলে, ‘গড়ে পাঁচজন কইর্যা ধরলেও ৭৫০জন আছি, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, ‘আপনাদের বেতন কতো?’
ট্রেইটর বলে, ‘চার হাজার ক’রে ধরলে ৭৫০জনের বেতন কতো হয়?’
তারা হিশেবে করতে শুরু করে, হিশেবে করে উঠতে পারে না; কিন্তু আশ্চৰ্য, তারা কোটি কোটি ছোয়াব সহজে হিশেব করতে পারে।
হজুররা বলে, ‘হিছাব করতে পারতেছি না, হুজুর।’
ট্রেইটর বলে, মাসে তিরিশ লক্ষ টাকা, আর ওই টাকাটা আপনারা ফাঁকি দিয়ে নিচ্ছেন; দেশকে ফাঁকি দিচ্ছেন, আল্লাকে ফাঁকি দিচ্ছেন।’
হজুররা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, নাউজুবিল্লা।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমি রিপোর্ট দিচ্ছি যে পাঁচটি মাদ্ৰাছা রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিতে, কারণ ওগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।’
হুজুররা আবার ট্রেইটরের পায়ে পড়ে হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
ট্রেইটরটা বয়সে আমার সমান, ওর পায়ে পড়ছে এতোগুলো হুজুর, যারা ওর পিতার সমান, এটা দেখে ট্রেইটরটাকে আমি শ্ৰদ্ধা করতে শুরু করি। আমি অবশ্য ট্রেইটর হতে পারবো না, রাইফেল হাতে নিয়ে শ্রেণীশক্ৰ খতম করতে গিয়ে আমি নিজেকে অনেক আগেই খতম করেছি।
হজুররা বলে, ‘ছার, পোলাপান লইয়া আমরা মারা যামু, আপনে আমাগো বাচান, আপনে আমাগো বাপের মতন।’
ট্রেইটর বলে, ‘আমার তো কিছু করার নেই, সরকার জানতে চেয়েছে, আমার কাজ হচ্ছে সত্য রিপোর্ট দেয়া, মিথ্যে বললে তো আমি দোজগে যাবো। আপনারা কি চান আমি দোজগে পুড়ি?’
আবার হুজুররা তার পায়ে পড়ে, হুহু ক’রে কেঁদে ওঠে।
হজুররা বলে, ‘না, না, হুজুর, আপনে দোজগে যাইবেন না, আমরা বালবাচ্চা লইয়া মইর্যা যামু, আমগো বাচান। ‘
আমি দেখি ট্রেইটর খুব পাকা হয়ে উঠেছে, বুড়ো হুজুরগুলো ওর পায়ে পড়ছে, হুহু ক’রে কাঁদছে, কিন্তু সে অটল থাকছে সততায়। ট্রেইটর বিস্ময়কররূপে সৎ হয়ে উঠেছে, সততায় সে অটল।
ট্রেইটর বলে, ‘কী ক’রে বাঁচাবো, বলুন, আপনারা তো ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আল্লার বিরুদ্ধে কাজ করছেন, আমাদের পাক আল কোরানে তো মানুষকে সৎ থাকতে বলা হয়েছে।’
হজুররা বলে, ‘হুজুর, আমরা মমিন মুছলমান থাকতে পারি নাই, আল্লাপাকের কোছে গুনাহ্ করছি, তয় আপনে আমাগো বাচাইতে পারেন, আল্লা রজুলের পরই আমাগো কাছে আপনে৷’
ট্রেইটর বলে, ‘কী করে বাঁচাবো?’
হুজুররা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করে। একটি ব্যাপার আমাকে বেশ বিস্মিত করে, আমরা দুজন সোফায় বসে আছি, কিন্তু ট্রেইটর ওই বুড়োগুলোকে একবারও বসতে বলে নি। হুজুররা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে মনে হয়, আমরা দুজন তখন চা খাচ্ছি।
এক হজুর বলে, ‘ছার, হুজুর, আমাগো একটা আরজি আছে আপনের কাছে, আপনে মাফ করলে আরজিটা আপনারে কইতে পারি।‘
ট্রেইটর বলে, বলুন।’
হজুর বলে, ‘আপনের শ্ৰদ্ধেয় বন্ধুর সামনেই বলুম?’
ট্রেইটর বলে, ‘বলুন।’
হুজুর বলে, ‘আমাগো তিরিশ লোকের থিকা পনর লাক আপনে রাইকা দেন, বাকিটা আমাগো দেন, তাতেই আমরা বালবাচ্চা লইয়া বাচতে পারুম।‘
ট্রেইটর বলে, ‘রিপোর্ট আমি দু-একদিনের মধ্যে দেবো, তার আগেই আপনারা সব ব্যবস্থা করবেন।’
‘জি হুজুর’ বলে হুজুররা ট্রেইটরের পায়ে চুমো খেয়ে, বারবার পদধুলো নিয়ে, অনেকে আমার পায়েও চুমো খেয়ে, খুশিতে ‘আলহামদুলিল্লা’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায়।
আমি একদল জীর্ণ মেরুদণ্ডহীন ভাঙা গাধাকে বেরিয়ে যেতে দেখি।
ট্রেইটর আমাকে বলে, ‘এরা দরকার হ’লে পায়ে চুমো খেতে পারে, দরকার হ’লে খুনও করতে পারে, তবে ওরা আমাকে খুন করবে না; ওরা সেজদা দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
আমি ট্রেইটরের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হই, সম্ভবত শিক্ষা নিই।
আমি সাম্যবাদ করেছি, সর্বহারা করেছি, খুন করেছি, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, কিন্তু এতোটা দক্ষতা কখনো দেখাতে পারি নি, আমলারা দক্ষতায় পবিত্ৰ শয়তানের থেকেও নিপুণ; কিন্তু আমার মধ্যে দক্ষতা দেখানোর একটি স্বপ্ন জেগে ওঠে। কিন্তু কী করে আমি এটা পারবো? আমার নেতারা একের পর শ্রেণীসংগ্ৰাম ছেড়ে একনায়কদের বুটের নিচে পড়ছে, আমি বুটের কাছাকাছিও যেতে পারছি না; কিন্তু আমি ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। আমাকে। আমি তো খারাপ ছাত্র ছিলাম না, স্টার ছিলো মাধ্যমিকে উচ্চমাধ্যমিকে, আর আমার এই প্রিয় ট্রেইটর আমার থেকে খুব বেশি ভালো ছাত্র ছিলো না; মনোয়ারা নামে একটি তরুণী তাকে তুলে আনে সাম্যবাদ, সর্বহারা থেকে, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়; তখন মনোয়ারা বাঙলায় অনার্স পড়তো, গ্রিনরোডে তাদের বাসা ছিলো; ট্রেইটরটি ওই বাড়িতে ঢুকে আর বেরোয় নি। মনোয়ারা তাকে শ্রেণীসংগ্রামের থেকে বেশি দিয়েছে; আমাকে কোনো মনোয়ারা উদ্ধার করে নি, পৃথিবীতে আমার জন্যে কোনো মনোয়ারা আনোয়ারা সালেহা জন্মে নি; একটি আগুন আমার বুকে জ্বলছিলেই; আমাকে একদিন নিয়ন্ত্রক হ’তে হবে।
কিছুক্ষণ পরে দেখি মঞ্চে অন্য মঞ্চনাটক, আমলারা নিপুণ অভিনেতা।
পিয়ন সংবাদ দিতেই আমার প্রিয় ট্রেইটর দৌড়ে গিয়ে আঙিনা থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে আসে। এবারও আমি অবাক হই, একদল বুড়ো হুজুরকে যে পদতলের বেশি দেয় নি, সে-ই একজন ভদ্রলোককে দৌড়ে বাইরে গিয়ে ‘স্যার, স্যার’ ব’লে নিয়ে আসে! ট্রেইটর তাঁকে বারবার ‘স্যার, স্যার’ বলছে দেখে আমিও উঠে সালাম দিই।
তাঁকে সালাম দিতে আমার কোনো দ্বিধা হয় না; বেশ শুভ্ৰ সুন্দর মার্জিত মানুষ, কথা বলছেন চমৎকার বাঙলায়, মুখে সুন্দর শাদা দাড়ি।
তাঁকে দেখেই আমার মনে দাড়ি রাখার স্বপ্ন জাগে, তাঁর মতো দাড়ি; যখন বুড়ো হবো তখন আমাকে হয়তো তাঁর মতো দেখাবে। ভদ্রলোক কে, আমি জানি না; কিন্তু আমার ট্রেইটর তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে ‘স্যার, স্যার’ করছে দেখে বুঝি তিনি শক্তিমান কেউ। কিন্তু তাঁর কথায় কোনো শক্তির আভাস পাচ্ছিলাম না, পাচ্ছিলাম একটু মহত্ত্বকে, যা আমি কোনো দিন পাই নি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আরো কয়েকজন এসেছে, তাদেরও আমার বেশ ভদ্ৰ মনে হয়।
ট্রেইটর ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার সঙ্গে।
বলে, ‘স্যার, আমার উপজেলার সবচেয়ে মান্যগণ্য ব্যক্তি, স্যারকে আমি শ্রদ্ধা করি’, আর আমার সম্পর্কে বলে, ‘আমার প্রিয় বন্ধু।’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, আমাকে ডাকলেই আমিই যেতাম আপনার কাছে, আপনি কেনো এতো কষ্ট করে এলেন?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনাকে ডাকা অনুচিত হতো, আপনাকে ডাকার মতো পাওয়ারেও আমি নেই, আমি এসেছি আমার একটি দরকারে।’
ট্রেইটর বলে, ‘কী দরকার, স্যার?’
ভদ্রলোক বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পাঁচটি মাদ্ৰাছা আছে, আজ ওদের পরীক্ষা ছিলো। আপনি না কি পরিদর্শনে গিয়ে সব ছেলেকে বহিষ্কার করেছেন?’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, বহিষ্কার করেছি; কেন্দ্ৰ বন্ধ করে দিয়েছি।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘এবারের মতো ওদের একটু মাফ করে দিন।’
ট্রেইটর বলে, ‘জি, স্যার, মাফ ক’রে দেবো, যদি আপনি বলেন; কিন্তু তারা যে-অপরাধ করেছে, তা একটু আপনাকে শুনতে হবে।’
ভদ্ৰলোক বলেন, ‘কী অপরাধ করেছে?’
ট্রেইটর বলে, ‘স্যার, গিয়ে দেখি ওরা সবাই জুতোর ভেতরে কোরান হাদিসের পাতা ঢুকিয়ে নিয়ে এসেছে; আমি ওদের জুতো খুলে রেখেছি, জুতোয় ওদের নাম লিখে রেখেছি। চলুন স্যার, জুতোগুলো আপনাকে দেখাবো।’
ভদ্রলোক ‘নাউজুবিল্লা’, ‘আস্তাগাফেরুল্লা’ বলে চিৎকার ক’রে দাঁড়িয়ে যান, বলেন, ‘ওইগুলি কাফেরের থেকে কাফের, পাক কিতাবের পাতা ওরা জুতার ভিতর ঢুকিয়ে এনেছে? ওইগুলোকে আপনি শাস্তি দিন, আমার কিছু বলার নেই, আমি নিজেই ওইগুলোকে জুতা দিয়ে পিটাবো।’
শান্ত স্নিগ্ধ ভদ্রলোক আগুনের মতো দাউদাউ ক’রে ওঠেন।
তার কিছু দিন পরই আমি জামাঈ জেহাদে যোগ দিই। আমি বুঝতে পারি ওখানে গেলে আমি নেতা হতে পারবো।
আমি ঢাকা থেকে আসা জিহাদিদের সঙ্গে কথা বলি, টাকার বান্ডিলটি নিয়ে ভেতরে রাখি, ভৈরব দিবসে কী করতে হবে, সব বুঝিয়ে দিই: ওরা সহজেই বোঝে, বুঝতে বুঝতেই ওরা এসেছে। ওরা ওদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে, আর ওরা নিজেরাই অস্ত্ৰ। ওদের জন্যে খাওয়ার, থাকার ব্যবস্থা ঠিক করা আছে; ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছি, মাদ্রাছার দশজন তালেবানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওদের খাওয়ানোর, দেখাশোনা করার। মাদ্ৰাছার পশ্চিমে মসজিদে ওরা থাকবে, যেনো মুসাফির; ওরা প্ৰথমে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে।
ওদের ব্যবস্থা ক’রে ঘরে ঢুকে গিয়ে দেখি কণাকলতা জেগে উঠেছে। অল্প ঘুমে ওর মুখটি দ্বিগুণ কণকলতা হয়ে উঠেছে।
আমি আমার পাক পবিত্র কিতাবরাশির পেছন থেকে একটি বোতল বের করি; সিভাস রিগ্যালই আমার একটু বেশি পছন্দ। আহা, যখন সাম্যবাদী সর্বহার লেনিন স্ট্যালিন ট্রটস্কি গুয়েভারা ছিলাম, তখন একঢোক ধেনোও পেতাম না, মেথরপট্টিতে যেতাম, পেলে মনে হতো স্বর্গীয় শারাব পেয়েছি, এখন ব্ল্যাক লেভেল আমার কাছে ট্যাপের পানির মতো। পরম করুণাময় গফুরুর রাহিম কখন কাকে কী দেবেন, তা কে বলতে পারে?
কণকলতা বলে, ‘বতলটি তো খুব সোন্দর, হুজুর, এমুন বতল ত আগে কহনও দেহি নাই।‘
আমি বলি, ‘তোমার দেহখানির মতো সুন্দর নয়, তোমার দেহটি হচ্ছে স্বর্গের বোতল, আর ওই বোতলভরা অমৃত।‘
আমি গ্লাশে রিগ্যাল ঢালি, একটু পানি মেশাই, রঙটা সোনার মতো হয়ে ওঠে; কণকলতার মতো হয়ে ওঠে, তবে কণাকলতা আরো সোনালি।
আমি প্রথমে কণকলতার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘একটু খেয়ে দ্যাখো, ভালো লাগবে।’
কণকলতা বিছমিল্লা’ বলে চুমুক দিয়েই বলে, ‘কী যে ঝাঁজ, তয় অনেক মজার, কী কোক এইটা, হুজুর? এইটা কি আমরিকার কোক?’
আমি বলি, ‘কতোটা মজার?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুরের ছ্যাপের মতই মজার।’
কণকলতা আর আমি নগ্ন শুয়ে একটু একটু পান করতে থাকি, কণকলতার দেহটি পান করবো না সিভাস রিগ্যাল পান করবো বুঝতে পারি না; এক সঙ্গে দুই রকমের সিভাস রিগ্যাল পেলে কোনটি বেশি উৎকৃষ্ট, তা ঠিক করতে আমার মতো জ্ঞানীরও কষ্ট হয়। আমি কণকলতা থেকে সিভাস রিগ্যালে, সিভাস রিগ্যাল থেকে কণকলতায় যেতে থাকি। কণকলতাকেই আমার বেশি অ্যালকোহলময় মনে হয়, ১০০% ভলিউম।
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনে আমার সোয়ামি।’
আমি বলি, ‘তোমাকে একদিন আমি মুছলমান বানাবো।’
কণকলতা বলে, ‘সোয়ামি, আপনের ওই বান্ডিলটায় কী?’
আমি বলি, ‘সোনা।’
কণকলতা বলে, ‘আমি দেখুম?’
আমি বাণ্ডিলটা এনে ওকে খুলে দেখাই, লাখ লাখ টাকার নতুন নোট দেখে ও কাঁপতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, আপনের এতো ট্যাকা?’
আমি পঞ্চাশ হাজারের একটা বান্ডিল তুলে বলি, ‘কণকলতা, এই বাণ্ডিলটা কি আমি তোমার সোনার খনিতে ঢুকাবো?’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আমি মইর্যা যামু, হুজুর, বাণ্ডিলটা আমার হুজুরের হুজুরজির থিকাও মোডা, আর আমার খনিডা ত ট্যাকার খনি না, এইডা তো সোনালি ব্যাংক না, অগ্রণী ব্যাংক না, ইছলামি আরব-দুবাই ব্যাংক না, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবাৰ্গও না, এইডা হইল হুজুরের মধুর খনি, হুজুর ছাড়া আর কিছু ঢুকবো না।’
তবু আমি একটা বান্ডিল ঢুকোতে চেষ্টা করি। কণকলতা চিৎকার করে ওঠে; সব কিছু সব জায়গায় ঢোকে না, যা ঢোকার তা ঢোকে। না ঢুকবে না, কিন্তু আমি এটা ওকে দিতে চাই।
কণকলতা বলে, ‘বান্ডিলডা। আমার দুধের মাঝখানে থোন।’
আমি নিজে খনিতে ঢুকতে থাকি; কণকলতা বলে, ‘বিছমিল্লা শয়তানের রাজিম কইলেন না, হুজুর?’
আমি বলি, ‘বান্ডিলটা তোমার, যাওয়ার সময় নিয়ে যেও; এটা তোমার তিন নম্বর ব্রেস্ট, তবে আসল দুটো আমার।‘
কণকলতা বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, এমুন ব্রেস্ট মাঝেমইদ্যে দিয়েন, হুজুর, আমি পুরা আলকোরান মোখস্থ কইর্যা ফেলুম, মুছলমান হইয়া যামু। কিন্তু হুজরি, এত ট্যাক দিয়া আমি কি করুম?’
আমি বলি, ‘টাকা হাতে এলেই দেখবে করার কাজের অভাব নেই, তখন দেখবে কতো কিছু করার আগে, কিন্তু হাতে টাকা নেই।’
কণকলতা বলে, ‘তাই না কি, হুজুর? বাবায় আমারে দুই মাস আগে এক শ ট্যাকা দিছিল, অহনও অইডা বালিশের নিচে পইর্যা আছে।‘
কণকলতা সুখের খনি, আমার দিলকে সুখে ভরে দিয়েছে; তাকে শুধু পঞ্চাশ হাজার দিয়ে আমি সুখ পাই না। ড্রয়ার থেকে আমি সবচেয়ে দামি সোনার হারটি বের করি, ওটি কণকলতার মতোই কণকলতা।
কণকলতা ওটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, ‘কণকলতা, এটিও তোমার জন্যে।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমার গলায় পরাই দ্যান, বিবি। অইয়া যাই।’
আমি বলি, ‘গলার থেকেও সুন্দর জায়গায় এটি পরাবো, সোনার খনিতে থাকবে এই সোনার হার।’
কণকলতা বলে, ‘সেইটা আবার কি?’
আমি বলি, ‘তুমি কণকলতার মতো ঘুমিয়ে পরো।’
কণকলতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে; আমি সোনার হারটি কণকলতার সোনার খনিতে ধীরেধীরে বিলুপ্ত করি, কণকলতা সুখে কেঁপে কেঁপে ওঠে। সোনার হারও কি তাহলে এক ধরনের শিশ্ন?
আমি বলি, ‘কণকলতা, তোমার খনিতে সোনা আছে, তুমি খনন করে সোনা বের করে নাও, এই সোনা তোমার।’
কণকলতা সেটি বের করে চমকে ওঠে, চোখ ভরে তার সোনা জ্বলতে থাকে, বলে, ‘হুজুর, এইটা আমার গলায় পরাই দ্যান।’
আমি পরিয়ে দিই; কণকলতা আমাকে নমস্কার করে বলে, ‘হুজুর, আইজ থিকা আমি আপনের বিবি হইলাম; আর কেও এই দ্যাহ পাইব না।’
আমি বলি, ‘এর আগে কে পেয়েছে?’
কণকলতা বলে, ‘কতজনে পাইতে চাইছে, কেরেও দেই নাই; কুত্তাগো লগে গাইট বান্ধনের কতা মনে আইলেই আমার ঘিন্না লাগছে।’
আমি বলি, ‘আমিও তো কুত্তা।’
কণকলতা বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আপনে আমার দিল, আমার সোয়ামি, আমরা বাগদাদের বাদশাহ হারুনর রশিদ, দিল্লির সম্রাট শাজাহান। হুজুর, আমি মইর্যা গেলে আপনে আমারে কবর দিয়েন, কবরডার নাম দিয়েন কণকমহল।’
কণকলতা ও বকুলমালা দুই জিনিশ, দুই ফুল, দুই রকম তাদের গন্ধ, দুই রকম তাদের স্বাদ। কণকলতার দেহে আর কথায় কথায় মধুর রস, এই রসটা আমি পছন্দ করি, তার রস অমৃতসমান, নিজেকে আমার পুণ্যবান মনে হয়।
হরিপদ আচ্ছালতু খায়রুম মিনাননাউমের আগেই এসেছে, হয়তো সারারাত মাদ্ৰাছার পাশে নদীর পারেই ব’সে ছিলো। হরিপদটা আহম্মক, ব্যবসা বোঝে, কিন্তু বকুলমালা ও কণকলতাকে বোঝে না।
ওমর দিবস
আমরা সকাল নটার সময় ‘ওমর দিবস’ শুরু করবো, ভৈরবের নাম আজ বদলে দেবো; যেমন উতরিবের নাম বদলে দেয়া হয়েছিলো। মুরতাদ আর ইহুদিদের খতম করবো, একবারে না হ’লেও ধীরেধীরে; আমি নিশ্চিত জানি, একবার কোনো মহান কাজ শুরু হ’লে তা বিপত্তির মুখে পড়তে পারে, কিন্তু তার জয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না; আমাদেরটিও কেউ পারবে না।
সকাল থেকেই আমার তিনটি মোবাইল (নাউজুবিল্লা, এগুলোও কাফেররা, নাছারারা তৈরি করেছে, তা তো করবেই, ওই শয়তানগুলো আমাদের পাক কিতাব থেকে গোপনে এসব বানানোর নিয়ম শিখে আমাদের ফতুর করে দিয়েছে) পাগল হয়ে ওঠে, জ্যাম হয়ে যেতে চায়; ঢাকা থেকে নেতারা, কয়েকটি সেক্রেটারি, কয়েকটি মিনিস্টার আমাদের মোবারকবাদ জানায়, আমাদের সঙ্গে তারা আছে; কলের পর কােল আসতে থাকে চট্টগ্রাম, মাইজদি, সিলেট, দিনাজপুর, যশোর, লালমনিরহাঠ থেকে।
তারা আমাদের দিকে, আমার দিকে, তাকিয়ে আছে।
এখান থেকেই তো শুরু হ’তে যাচ্ছে পাক সার জমিন সাদ বাদ।
মিনিস্টার আব্দুল হান্নান মোল্লা বলেন, ‘আমিও তো তোমার মতো সাম্যবাদ করতাম, মিনিস্টার হওয়ার জইন্যে এখন এই মেইন পার্টিতে আছি, কিন্তু আল্লার রহমতে মনে মনে আছি তোমার সঙ্গেই, একদিন জামাঈ জিহাদে জয়েন করবো। আজকের দিনটাকে সাকসেকফুল করতেই হইব, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড, রাহমানির রাহিম আল্লা ইজ উইথ ইউ, দারোগাপুলিশ বাস্টার্ডগুলিরে আমি ম্যানেজ করব।’
আমি বলি, ‘দোয়া করবেন।‘
তিনি বলেন, ‘দোয়া তোমারে সব সময়ই করি, তোমার উপর আল্লার রহমত বর্ষিত হোক, তুমি পারবা, তুমি দ্যাশটারে ট্র্যান্সফর্ম কইর্যা দিবা। তোমার বড় নেতাগুলি গ্ৰেইট মুছলমান, তবে দে ল্যাক ব্রেইন।’
সেক্রেটারি কাদির জিনালি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, আই উইশ ইউ অল সাকসেস, উই মাস্ট রিইস্টাবলিশ পাক সার জমিন সাদ বাদ। তুমি দ্যাকতেই ত পাইতেছ কোনো গভর্নমেন্ট ফাংশনে ওই ব্লাডি সোনার বাংলাটা বাজতেছে না; ওইটা চালাইলেই দশ লাখ টাকার প্লেয়ার ব্ৰেক্স ডাউন, ইলেকট্ৰিছিটি বন্দী হইয়া যায়। গ্রেইট আব্দুল্লা দি গাফরুর রাহিম ডাস নট লাইক দ্যাট ব্লাডি সোনার বাঙলা আই ফাক ইউ রিটেন বাই এ মালাউন বাস্টার্ড; উই নিড পাক সার জমিন সাদ বাদ ইন অর্ডার টু গেট হিজ ব্লেসিং।’
সেক্রেটারি সাহেব এখন একটি নতুন পেয়ারে পড়েছেন, তিনি মনে করেন আল্লার রহমত ছাড়া যুবতী মেয়েটির সঙ্গে তিনি ছহবত করতে পারবেন না। আমাকে তাঁর একটু দরকার: প্রথম ছহাবতটার জন্যে তিনি পাগল হয়ে উঠেছেন। যুবতীটি আবার রেস্ট হাউজে যেতে চায় না, তার প্যালেসেই প্ৰথম ছহবত করতে চায়; এটা একটু ডিফিকাল্ট।
জামাঈ জিহাদের, আমাদের, বড়ো নেতা ফোন ক’রে বলেন, ‘কয়টারে কতল করব? কয়টা জ্বালাইবা? সব আগে থিকা আব্দুল্লার রহমতে ঠিক করছ ত?’
আমি বলি, ইনশাল্লা গোটা তিনেক, আর জ্বালাতে হবে গোটা দশেক, ভাঙতে হবে গোটা পাঁচেক৷’
তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা।‘
তিনটি মোবাইল আমাকে পাগল ক’রে তোলে।
কেউ বাদ নেই, সবাই ফোন করে মোবারক বাদ জানাচ্ছে। ৩টি ভিসি, ৭টি প্রোভিসি ফোন করেছে, তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে :
৮টি অ্যামবোসাডর, ১১ এনজিরও ডোনার ফোন করেছে;
২০টি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, ৩টি ইছলামি ব্যাংকের অনিছলামি এমডি,
২৫টি খাটি মুছলমান স্মাগলার, ৫টি পরহেজগার রাজস্বের
কালেক্টর, ৪টি ইছলামি অভিনেতা, ৫টি সেক্সি হিজাবপছন্দ নায়িকা,
আর আমেরিকা, কানাডা, উইকে, সুইডেন, জার্মানি, ইটালি,
সিডনি থেকেও ফোন আসছে; সৌদি, আমিরাত, সিরিয়া, পাকিস্তান, লিবিয়া।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া। কোরিয়া থেকে আসছে। ভেবেছিলাম মহাথির মহম্মদ, ওসামা বিন লাদেনও ফোন করবে, ব্যাটারা ফোন করে নি।
আমাদের নেটওয়ার্কটি বড়ো, অনেকেই টের পায় না, যারা ফোন করছে, তারাও জানে না কতো বড়ো নেট পাতা হয়েছে।
সটুপিড আমেরিকা জানে না আমরা কতোটা শক্তিশালী, ওদের আরো কতো দালানে আমাদের প্লেন পড়বে।
সকাল আটটার মধ্যেই মাদ্রাছা-হ-মদিনাতুন্নবির সামনের রাস্তা ভ’রে যায়।
সারা এলাকার মাদ্ৰাছার তালেবানরা এসেছে সালোয়ার, পাকিস্থানি পাঞ্জাবি, মাথায় সুন্দর মাদানি টুপি প’রে; আর আছে আমাদের মদিনাতুন্নবি এলাকার জিহাদিরা; সব মিলে হাজার পাঁচেক হবে। সবার হাতেই ফেস্টুনপ্ল্যাকার্ড: আরবিতে সুন্দর করে লেখা ‘আল্লাহু আকবর’, আর বাঙলায় আরবির মতো পেঁচিয়ে লেখা ভৈরব হচ্ছে কাফেরি নাম, তার নাম হইবে ওমরপুর’, ‘ইহুদিদের ধ্বংস কর’, ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউনদের বিদায় করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
‘পাকিস্থান জিন্দাবাদ’ প্ল্যাকার্ডও কতকগুলো তৈরি করেছিলো আহাম্মক মোঃ হাফিজুদিন; কিন্তু সেগুলো রাস্তায় দেখানোর সময় এখনো আসে নি। আমি ওগুলি নদীতে ফেলে দিতে বলি।
বড়ো বড়ো দশটি পেতলের ফলকে খোদাই ক’রে লেখা হয়েছে ‘ওমরপুর’।
একেকটি অক্ষর তিন ফুট উঁচু। আগের ভৈরব নামের ফলকগুলো ভেঙে ফেলে ওগুলো শহরের নানা জায়গায় শক্ত পেরেক মেরে লাগানো হবে; এতো শক্ত করে লাগানো হবে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। এখন থেকে লোকজন কাফেরি ভৈরভে ঢুকলেই দেখবে পবিত্র ‘ওমরপুর’, বেরোতেই দেখবে ‘ওমরপুর’; ভৈরব আর দেখবে না; ঢোকার সময় তাদের দিল জান্নাতের সুখে জ্যোতিতে ভ’রে উঠবে, বেরোবার সময় তারা দিল ভ’রে নিয়ে যাবে জান্নাতের সুখ আর জ্যোতি।
ফলকগুলোর ডিজাইন মনের মতো করে, জ্যোতি মিশিয়ে, আমিই ক’রে দিয়েছিলাম, কিন্তু বায়তুল মোকাররামের নিচের তলার লোকটি যে এতো সুন্দর এতো খুবসু্রত ক’রে ফলক তৈরি করবে, তা আমি ভাবি নি। ওই লোকটিও আমাদের জামাঈদ জিহাদে ইছলামের সদস্য কি না। আমি জানি না; তবে ফলকগুলো দেখেই বুঝতে পারি তার বুকেও জিহাদ জ্বলছে।
বুকে জিহাদ না থাকলে হাত এতো সুন্দর কাজ করে না; যেমন আমাদের বুকে জিহাদ আছে বলেই আমরা আজ সুন্দর কাজ করতে যাচ্ছি, আজ আমরা সুন্দরকে পয়দা করবো।
‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হবে ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস কর’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’ আওয়াজ তুলতে তুলতে আমরা সামনের দিকে এগোই; বলা যায় সামনের দিকটিই আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। চারদিকে, আশমানে জমিনে, তাকিয়ে দেখি সমস্ত শহর থেমে গেছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে, আনন্দে ঝলমল করছে, ভয়ে কাঁপছে, বেহেশতের বাদ্য শুনছে, ইচ্ছাফিলের শিঙ্গা শুনছে।
একবার থানার অসি এসে আমার সঙ্গে কথা বলে, কথা বলে ধন্য হয়, তারপর চলে যায়, এটাই আমাদের কথা ছিলো; আমরা শহরকে মহান আল্লার নামে মুখর ক’রে তুলি, আল্লার নামে নিস্তব্ধ করে তুলি। তিনিই সমস্ত মুখরতার মালিক, তিনিই সমস্ত স্তব্ধতার মালিক।
রাস্তায় একবার আমরা নীরব নিস্তব্ধ হয়ে দাড়াই; তারপর পাঁচ রোকাত সালাত আদায় করি। কোনো যে পাঁচ রাকাত বেছে নিলাম, তা আমি জানি না; হয়তো গফুরুর রাহিম রাহমানির রাহিমের এটাই ছিলো ইচ্ছে। সালাত সব সময় আদায় করা যায়; মহৎ সব কাজের আগেই সালাত আদায় ক’রে নিলে কাজ আরো মহৎ হয়ে ওঠে। সালাত আদায়ের সময় আমি মদিনাকে দেখতে পাই, উতরিব থেকে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ইহুদিরা, সেই দৃশ্য দেখতে পাই; আমার দিল খুশিতে ভ’রে ওঠে। দেখতে পাই পাথরের ঘরগুলো ছেড়ে ইহুদিরা পালাচ্ছে, অনেকে কতল হয়ে যাচ্ছে, ওদের বউ আর মেয়েগুলোকে শেকল দিয়ে বঁধেছি, বন্ধনের মধ্যেও ওদের সুন্দর দেখাচ্ছে, সৌন্দৰ্য সব সময়ই পীড়নে আরো সুন্দর হয়ে ওঠে; দেখতে পাই লম্বা গর্ত খুঁড়ছি, তাতে মাটি চাপা দিচ্ছি কয়েক হাজার ইহুদিকে। আমি জানি ভৈরবের মালাউন ইহুদিগুলো এখন ভয়ে নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে মাটির ভেতর ঢুকতে চাচ্ছে, তার তাদের দালাল ইবলিশগুলো কাঁপছে, একদিন ওই দালালগুলো আমাদের কাঁপাতো।
আমার দিল উতরিব থেকে মন্দিনায়–মদিনাতুন্নবিতে, মদিনা থেকে উতরিবে অবিরাম যাতায়াত করতে থাকে; ইহুদিদের আর্তনাদে আমার দিলে আঙুরের রসের ঝর্না বইতে থাকে; ইহুদি যুবতীগুলোকে দেখি, শেকল দিয়ে তাদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি, কয়েকটি ইহুদি যুবতী আমার দিলে ঢুকছে, ওদের দিলের গর্তে ঢুকোচ্ছি, আর পুরুষগুলোকে গর্ত খুঁড়ে জ্যান্ত মাটিচাপা দিচ্ছি, তারা শব্দও করতে পারছে না।
আমি ৬২২-এর পবিত্র মদিনাকে দেখতে পাই, আমার রক্ত জ্বলতে থাকে।
দেখি শয়তান অবিশ্বাসী ইহুদি গোত্রগুলো—বানু-আল নাদির, বানু কুরাইজা, এবং বানু কাইনুকাকে। আমার মনে হয় এখনো তারা আমাদের ঘিরে আছে, মদিনা থেকে তাদের আমরা বিতাড়িত করেছিলাম, তারা এখন জুড়ে বসেছে। এদেশে, তাই দেশকে পাক স্তান করতে হবে, যেমন করেছিলাম ১৪০০ বছর। আগে। মনে হয় যেনো আমি ঢুকছি। উতরিবে, নাপাক অঞ্চলে, আমার প্রথম কাজ হচ্ছে ইহুদিদের খতম করা, আজ আমি তা করবো।
আমি দেখতে পাই মালাউন ও তাদের দালালদের কয়েকটি ছিন্ন মাথা আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে, যা কয়েক কোটি টাকার থেকেও মূল্যবান। আমি দেখতে পাই আল নাদের দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, ওকবা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে, এবং আমি ছিন্নভিন্ন করছি তাদের।
আমার বুক থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে ‘আল্লাহু আকবর’।
সালাত শেষ ক’রে কাফেরি ভৈরবের নানা পথের প্রান্তে প্ৰান্তে স্থাপিত নাম ফলকগুলোর দিকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হবে ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস কর’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘মুরতাদদের ধ্বংস করো’ আওয়াজ তুলে এগোতে থাকি।
জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিনকে ভার দেয়া হয়েছে ভৈরবের নামফলকগুলো তুলে ফেলে সেখানে নতুন নামফলক ওমরপুর লাগানোর; এটা তার জন্যে একটি পুরস্কার, সে চিরদিন গৌরব করতে পারবে এগুলো তার নিজের হাতে লাগানো। যখন আমরা সব কিছু দখল করবো তখন হয়তো তাকে ভার দেয়া হবে এই নতুন পুরের, যার নামফলকের স্থপতি সে। মোঃ হাফিজুদিন পালোয়ান পুরুষ, মল্লযোদ্ধা, সে নিজের হাতেই ওগুলো টেনে খুলে ফেলতে চায়, বাহুতে জোশ তার উপচে পড়ছে, কিন্তু সে খুলতে পারছে না; সঙ্গে সে ভারি হাতুড়ি নিয়ে এসেছে, এগুলো আমাদের সব সময় দরকার হয়, তার সঙ্গে তালেবানরা একের পর এক ভাঙছে ভৈরব নামের ফলকগুলো, সেখানে লাগাচ্ছে ওমরপুরের ফলকগুলো, চারদিক জ্যোতিতে ভাস্বর হয়ে উঠছে; আর আওয়াজ উঠছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’।
আমি নিজেই থারথার করে কঁপিছি, অপূর্ব আবেগ ও জ্যোতিতে ভরে উঠছি, একটি উজ্জ্বল গুহার জ্যোতি দেখছি। লোকজন দূর থেকে আমাদের কাজ দেখছে, আমি তাদের চোখেও জ্যোতি দেখতে পাচ্ছি, তারাও জিহাদে পরিপূর্ণ, তারা নতুন যুগের সূচনা দেখছে। একে একে আমরা দশটি জায়গায় ‘ওমরপুর’ ফলক লাগাই; সারা শহর জ্যোতিতে ভ’রে ওঠে। এতো জ্যোতি আমি আগে কখনো দেখি নি; মাটির নিচের কূট অন্ধকারে যদি দশটি শামস জ্বলে ওঠে, তাহলে যে-জ্যোতি দেখা দিতে পারে, তা আমি দেখতে পাই।
এরপর শুরু হয় আমাদের প্রকৃত জিহাদ।
আমাদের জিহাদিরা উচ্চকণ্ঠে উঠছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘ইছলাম কায়েম করো’, ‘মুরতাদরা ধ্বংস হোক’ আওয়াজ তুলতে তুলতে বাজারের দিকে ছুটতে থাকে; জিহাদি মোঃ হাফিজুদিন আগে আগে এগোতে থাকে, সব সময়ই সে অগ্রপথিক, আমি আছি মাঝে, নেতাকে এখানেই থাকতে হয়। তারা দিকে দিকে বোমা ছুঁড়তে থাকে, মালাউনদের দশবারোটি দোকানে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়, মালাউনদের দালালদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়,–হরিপদর দোকান আর চাউল কল ঠিক থাকে–আমি আগেই নির্দেশ দিয়েছি। কয়েক জিহাদিকে ওগুলো পাহারা দিতে, আমি কথা দিলে কথা রাখি, যদি কথা দিই বুকের ভেতর থেকে; মোঃ হাফিজুদ্দিন গুলি করতে দক্ষ, দু-একটি গুলি না করলে, তাতে দু-চারটি খুন না হ’লে, সে সুখ পায় না। সে তার সুখকর কাজগুলো করতে থাকে।
আমি দেখতে পাই সে আগুনের মতো ঝড়ের মতো উটের মতো ছুটছে, গুলি করছে; দু-তিনটি মালাউন ও মালাউনদের একটি দালাল তার গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো: লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে আমার দিল ভরে উঠলো, লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যের মতো সুন্দর দৃশ্য আর নেই।
আমাদের জিহাদিরা ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘ভৈরব হলো ওমরপুর’, ‘ভৈরব নাম ধ্বংস হলো’, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘হজরত ওমর জিন্দাবাদ’, ‘ইছলাম কায়েম করো’ আওয়াজ তুলছে, বোমা ছুঁড়ছে, গুলি করছে, আগুন জ্বালাচ্ছে: দাউদাউ আগুন উঠতে থাকে, আগুনের সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হই, মহিমা বুঝতে পারি; বোমা ও গুলির শব্দে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠে, যেনো অনবরত বজ্র এসে পড়ছে। শহরের ওপর।
মহান পরিবর্তনের সময় এমন ঘটনা চিরকালই ঘটেছে, চিরকালই ঘটব; রোমে ঘটেছে, গ্রিসে ঘটেছে, ভারতে ঘটেছে, আরবে ঘটেছে, বঙ্গদেশেও ঘটেছে, সিন্ধুতে ঘটেছে; আজ ঘটেছে ভৈরবে, বদলে যাচ্ছে ভৈরব, যেমন বদলে গিয়েছিলো উতরিব। দু-তিনটি মালাউন ও মালাউনদের একটি দালাল লুটিয়ে পড়েছে–আমি ওদের চিনি, তাতে কিছু যায় আসে না, তবু তো ওদের আমরা মাটিতে জ্যান্ত চাপা দিই নি, যদিও চাপা দিলেই আমার মন শান্তি পেতো; ওগুলোর হিশেবে কেউ পাবে না; আমাদের জিহাদিরা তাদের ব্লাড প্রুফ বস্তায় ভরে ফেলেছে, অন্য কেউ তাদের দেখতে পায় নি।
তাদের আমরা চিরকালের জন্যে নামপরিচয়হীন ক’রে দেবো।
তারপরই ঘটে বৃহত্তম ঘটনাটি। মোঃ হাফিজুদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি এবার দৌড়ে তার কাছে যাই, দেখি তার হাত, মাথা উড়ে গেছে; জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন শহিদ হয়েছেন।
কে করতে পারে এই কাজ, কে আমাদের দিতে পারে একজন চিরঅমর শহিদ? আমি তা জানি, আর কেউ তা জানে না। যে-কজন জানে, তারাও কোনোদিন জানবে না; তারা চুপ থাকবে চিরকাল। অনেক মহান ঘটনা সামান্যরা কখনোই জানে না, তা জানা নিষিদ্ধ।
আমি জিহাদি মোঃ হাফিজুদিনের লাশের ওপর চিৎকার করে পড়ি, রক্তে ভিজে যাই; এবং বলি, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’।
আমার সঙ্গে সঙ্গে সব জিহাদি। আওয়াজ তোলে গর্জন করে বজের আওয়াজ তোলে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’। দিকে দিকে সাড়া পড়ে যায়; শহর আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায়, আকাশ ভেঙে পড়তে চায়, সূৰ্য গনগন করতে থাকে, সূৰ্য গ’লে পড়তে চায়। আমাদের জিহাদের এক অসাধারণ শাম্স্ দুপুরের আগেই ডুবে গেছে, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে; এতে মানুষ ও প্রকৃতি কেউ আর আগের মতো স্বাভাবিক থাকতে পারে না।
জোহরেই মাগরেব নেমেছে, কিছুই আগের মতো থাকবে না।
জিহাদিরা মসজিদ থেকে খাট এনে শাদা কাফন জড়িয়ে শহিদ হাফিজুদিনের ছিন্নভিন্ন লাশ খাটে রাখে, লাশ যতো ছিন্নভিন্ন হয় ততোই অমর হয়।
আমরা তার লাশ কাউকে দেখতে দিই না, তাতে রহস্য কমে যাবে; শহিদকে অমর করে রাখতে হলে তাকে রহস্যময় ক’রে রাখতে হয়। জিহাদিরা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবিয়’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’,
এই আওয়াজ ওমরপুরের আকাশকে কাঁপিয়ে তোলে, শহরটি বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে, পাশের নদীতে উচ্চ ঢেউ ওঠে, গাছপালার ভেতর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, সমস্ত বাড়িঘরের ভেতর দিয়ে আগুনের ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়।
শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটি বক্তৃতা দিই। আমি বলি, ‘বিছমিল্লাহির রাহমানের রাহিম, সমস্ত প্ৰশংসা আল্লার প্রাপ্য, জিহাদি ভাইয়েরা, আমাদের সামনে এখন শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের পাক লাশ, শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন মরেন নাই, তিনি শহিদ হয়েছেন, ইসলামের জন্য চিরকাল মোঃ হাফিজুদিনের শহিদ হয়েছেন, আমরাও তাঁর মতো শহিদ হবো। আমরা শরিয়া কায়েম ক’রে ছাড়বো। শহিদ হওয়ার মতো গৌরবের আর কিছু নেই। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গৌরবান্বিত শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন।’
জিহাদিরা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’, ‘মুরতাদদের খতম করো’।
আমি বলি, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন নিজের বুকের খুন দিয়ে এক নতুন নগর প্রতিষ্ঠা ক’রে গেছেন, যার নাম ‘ওমরপুর’। তাঁর রক্ত বৃথা যাবে না, শহিদের রক্ত বৃথা যায় না। তাঁর রক্ত থেকে সৃষ্টি হবে এক পাক পবিত্র স্তান, তার গান হবে পাক সার জমিন সাদ বাদ।’
আওয়াজ উঠতে থাকে ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
আমি বলি, ‘বলেন ভাইয়েরা কে খুন করেছে, কারা খুন করেছে আমাদের প্রিয় জিহাদি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে? বলেন জিহাদিরা, বলেন।’
জিহাদিরা আওয়াজ তোলে, ‘জিহাদি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে খুন করেছে মালাউনরা আর মালাউনদের দালালরা।‘
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘এখন জিহাদি ভাইয়েরা, আপনাদের কি কর্তব্য? আপনারা এখন কি করবেন? এই ইহুদিদের মালাউনদের মালাউনদের দালালদের হাতে আপনারা কি এখনও খুন হবেন? আপনারা কি শুধু খুন হ’তে চান?’
তারা আকাশ ফাটিয়ে মাটি কাপিয়ে আওয়াজ তোলে, ‘আমরা কতল করব।
আওয়াজ উঠতে থাকে মালাউনগো কতল করো’, ‘দালালগো কতল করো’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদিন জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘মালাউনদের খতম করো’, ‘মালাউনদের দালালদের খতম করো’।
জিহাদিরা দিকে দিকে ছুটতে থাকে।
যেমন ছুটেছে তারা উতরিবে, আলেকজান্দ্রিয়ায়, বাগদাদে, স্পেনে, বঙ্গদেশে, সিন্ধুদেশে; তারা মালাউন ও তাদের দালালদের ঘরবাড়ি দোকানে আগুন লাগাতে থাকে, কয়েকজনকে খুন করে বস্তায় ভ’রে ফেলে।
বিজয়ের নিয়ম হচ্ছে একটি সম্পূর্ণ দিন ধরে তাণ্ডব চালাতে হবে।
পুরোনোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস ক’রে নতুনকে সৃষ্টি করতে হবে, নাপাককে শেষ ক’রে পাককে শুরু করতে হবে; নাপাকের যেখানে শেষ পাকের সেখানে শুরু। আমরা যেতে থাকি স্কুল থেকে স্কুলে, কলেজ থেকে কলেজে; সেখানে যতো শহিদ মিনার ছিলো, সেগুলোকে একে একে ধ্বংস করি। শহিদ মিনার হচ্ছে মূর্তিপূজা, মূর্তিপূজা থেকে আমরা উদ্ধার করি আমাদের স্তানের প্রথম পুরকে। ভৈরব রূপান্তরিত হয় ওমরপুরে, আমাদের জিহাদ সাফল্য লাভ করে।
সারা শহর চুপ করে যায়; ভৈরব ভেদ করে ওমরপুর জেগে ওঠে।
মোবাইল এতোক্ষণ বন্ধ ছিলো; তিনটি মোবাইল আবার কলকল ক’রে ওঠে।
বড়ো নেতা ফোন করেছেন, ‘ফল কি হইল আলার রহমতে, আমরা জানার জইন্যে বেচইন হইয়া আছি, দিল কাপতেছে।‘
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, আমরা বিপ্লব কায়েম করছি, ভৈরবের নাম এখন থেকে ওমরপুর, চিরকাল থাকবে ওমরপুর।’
তিনি বলেন, ‘সোভানাল্লা, আমি জানতাম আল্লার রহমতে তোমাগো জিহাদ কায়েম হইব, তুমি যেইখানে আছ সেইখানে জয় না হইয়া পারে না, আমরা এই হারাম দ্যাশরে পাক স্তান কইর্যা তুলুম।‘
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা।’
তিনি বলেন, ‘আর কি কি করলা?’
আমি বলি, ‘মালাউন আর মালাউনদের দালালদের ঘরবাড়ি পুড়েছে, কতল হয়েছে, সব শহিদ মিনার চুরমার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সোভানাল্লা, এইডাই ত চাইছিলাম’।
আমি বলি, ‘তবে সবচেয়ে বড়ো একটি জিনিশ আমরা পেয়েছি।’
আমি বলি, ‘আমরা একজন মহান শহিদ পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘শহিদ? ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না। কে শহিদ হইল?’
আমি বলি, ‘আমিই শহিদ হতে পারতাম, অল্পের জন্যে হই নি, শহিদ হয়েছেন জিহাদি মোঃ হাফিজুদ্দিন, আমার দুই নম্বর।’
তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লা, আল্লায় আমাগো রহমত দিয়াছেন। আমাগো একজন মহান শহিদ দরকার আছিল। তিনি এখন ভেস্তে আছেন, সোভানাল্লা।’
আমি বলি, ‘আমি শহিদ হ’লেই ধন্য বোধ করতাম, পাক স্তানের জন্যে নিজের বুকের রক্ত দিয়ে ধন্য হতাম।’
তিনি বলেন, ‘না, না, তোমার এইখন শহিদ হইলে চলাব না, তোমার গাজি থাকতে হইব; তয় এইখন কি কর্মসূচি নিছ?’
আমি বলি, ‘একটা বড়ো কর্মসূচি হয়ে গেছে, শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের জানাজার পর আরো কর্মসূচি আছে।’
তিনি বলেন, ‘ঠিক কইর্যা কইরো, আল্লার রহমত আছে তোমার উপর।’
মোবাইলের পর মোবাইল।
মিনিস্টার আবদুল হান্নান মোল্লা বলেন, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স, তুমি সাকসেকফুল হইছ, এইটা আমারই সাকসেস; তবে অই অ্যাম শকড় অ্যান্ড সরি যে তোমাদের একজন শহিদ হয়েছে, মালাউন আর তাগো দালালদের দু-চারটি ফেলে দিতে পারলা না? উই আর উইথ ইউ অ্যান্ড ইছলাম।’
আমি বলি, আকাশে মাটিতে অনেক জিনিস আছে যার খবর আল্লা ছাড়া আর কেউ জানে না; দু-তিন দিনের মধ্যেই ঢাকা আসছি, তখন আপনাকে সব বলবো, আলহামদুলিল্লা।’
মিনিস্টার বলেন, ‘তুমি এখন বিজি, শহিদ মোঃ হাফিজুদিনরের শহরের শ্ৰেষ্ঠ জায়গায় কবর দিও, সে অমর, কয়েক দিন পর আমি জিয়ারত করতে আসব।’
আমি বলি, ‘আমি গিয়ে নিয়ে আসবো, আল্লা হাফেজ।’
সেক্রেটারি কাদির জিলানি অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে, আমি তার নামটা দেখতে পাচ্ছি মোবাইলে, কিন্তু ধরছি না; সে চেষ্টা করুক, কয়েকবার চেষ্টা করুক, তাহলে বুঝবে আমি কতো বড়ো মহৎ কাজে লিপ্ত রয়েছি।
সেক্রেটারি কাদির জিলানি বলেন, ‘মোবারকবাদ, কংগ্ৰেচুলেশন্স, তুমি তো সারা দেশরে কাপাই দিছ, ইউ আর নাও আওয়ার হিরো। দি নেম ভৈরব ওয়াজ শিয়ার আইডলেট্রি, নাউ উই হ্যাভ গট অ্যান ইছলামিক নেম–ওমরপুর। মেইন পার্টির নেতারাও টকিং অ্যাবাউট ইউ ফ্রম দি ভেরি ডন; বাট অই অ্যাম শকড় অ্যান্ড হ্যাপি দ্যাট নার ইউ হ্যাভ এ মার্টিয়ার, হো উইল গিভ উইটনেস টু আল্লা, দি রাহমানির রাহিম। ইছলাম ইজ নট ফার বিহাউন্ড।‘
আমি বলি, ‘শুকরিয়া।‘
তিনি বলেন, ‘ঢাকা এসেই প্লিজ ট্রাই টু মিট মি, ইট উইল বি মাই গ্রেটেস্ট প্লেজার টু সি ইউ ইন মাই অফিস অ্যান্ড ইন মাই প্যালেস ইন বারিধারা।’
আমি বলি, ‘ইনশাল্লা আসবো।’
আরো কতো মোবাইল, আরো কতো মোবাইল।
আমার ভয় হয় হয়তো শহিদ মোঃ হাফিজুদিনও মোবাইলে আমাকে বেহেশত থেকে কল করবে; তারও দুটি মোবাইল ছিলো।
মাইজদি থেকে, ‘মোবারকবাদ।’
নিউইয়র্ক থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
চট্টগ্রাম থেকে, ‘ইছলাম জিন্দাবাদ।‘
সিডনি থেকে, ‘মারহাবা।‘
হেলসিংকি থেকে, ‘মোবারকবাদ।‘
ঢাকা থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
লস এঞ্জেলেস থেকে, ‘নারায়ে তকবির।’
জাকার্তা থেকে, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
কাতার থেকে, কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
আবু ধাবি থেকে, ‘মোবারকবাদ’।
জেদ্দা থেকে ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স।’
আবু ধাবি থেকে, ‘মোবারক বাদ।’
কাবুল থেকে, কংগ্রেচুলেশন্স।’
এবং ঢাকা থেকে, এবং ঢাকা থেকে, এবং ঢাকা থেকে, এবং আরো, এবং আরো, এবং আরো। কোনো ফোনই আমাকে অবাক করে না।
একটি ফোন আমাকে চমকে দেয়, ওটি আমি আশা করি নি। নম্বরটি আমার অচেনা, কোনো নাম ভেসে ওঠে না।
তাহলে কি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন বেহেশতে থেকে কল করলো? ওখানকার নম্বর হয়তো ভিন্ন; ওখানে হয়তো গ্রামীণ ফোনের, সিটি সেলের, অ্যাকটেলের নেটওয়ার্ক নেই।
আমি বলি, ‘হ্যালো।’
সে বলে, ‘হুজুর, আমি আপনের বিবি। কণকলতা।’
আমি বলি, ‘তুমি!’
সে বলে, ‘হুজুর, আপনে ভাল আছেন তো?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ।‘
সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, হুজুর, আপনেরে মোকারকবাদ ও ধন্যবাদ। আমরা ভাল আছি, বাবার কলডা, দোকান, আমরা ভাল আছি।‘
আমি বলি, ‘ভালো থাকবে।’
সে বলে, ‘আমারে ভুইল্যেন না হুজুর, আমি আপনের বিবি; আপনের কতা আমি দিনরাইত ভাবি, আপনের কতা ভাইব্যা। আমার কষ্ট অয়।’
আমি বলি, ‘এটা তোমার ফোন?’
সে বলে, ‘জি হুজুর, আমার শত সহস্ৰ কদমবুশি আর চুমা।’
কতকগুলো চুমোর শব্দ পাই, মোবাইলটিকে আমার কণকলতার জিভ ব’লে মনে হয়, আরেকটুকু হ’লেই আমার হুজুর রাজপথেই তালগাছ হয়ে উঠতো, কিন্তু দেখি আমার বুকটিও কাঁপছে, হাহাকার করছে।
আমি ওর নম্বরটি সেভ ক’রে রাখি।
দুপুরে, জোহরের নামাজের পর, ঈদগা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
সেখানে আমরা শহিদ মোঃ হাফিজুদিনের জানাজা পড়ি।
ওমরপুর ভেঙে পড়েছে শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনের জানাজা পড়ার জন্যে।
আমার মনে হয়। পাক ফেরেশতারাও নেমে এসেছে; নইলে এতো লোক এলো কোথা থেকে? এখানে তো মালাউনরা আসে নি, তাদের দালালরা আসে নি; তাহলে যারা এসেছে, তারা সবাই কি জামাঈ জিহাদে ইছলামের? আমার তাই মনে হয়, সকলের বুকে এখন জিহাদ। সাধারণ মানুষ শুধু নয়, দারোগা পুলিশ অসি, ম্যাজিট্রেট, ইউএনও, ডিসি, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, উকিল, মুক্তার, চোর, ডাকাত, স্মাগলার কেউ বাকি নেই; সবাই এসেছে, তার জানাজার প্রাঙ্গণ গমগম করছে, আবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে; আমি মনে মনে মোঃ হাফিজুদ্দিনকে দেখতে পাই, তাকে বলি, ‘দ্যাখো, মোঃ হাফিজুদ্দিন শহিদ হয়ে তুমি কতো মহৎ হয়ে উঠছো, আমাদের জামাঈ জিহাদ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, তুমি আমাদের প্রেরণা, কিন্তু তোমাকে আমি কখনো বিশ্বাস করি নি, তাই তুমি আজ শহিদ, তুমি অমর, তবে তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ থেকো। তুমি জানো না কার বদৌলতে তুমি আজ অমর, তুমি আজ শহিদ, আজ আমাদের প্রেরণা। তুমি একটু বেশি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলে, তবে শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন তোমার ঘিলু ছিলো না, তুমি সাম্যবাদ, সর্বহারা থেকে আসে নি, ইছলামেরও কিছু তুমি বুঝতে না, কোরান হাদিছ তুমি বুঝে পড়ে নি, অর্থ বোঝ নি, খোমেনির কিছুই তুমি পড়ে নি; তুমি খুন বুঝতে, রক্ত বুঝতে, পিস্তল বুঝতে, তার জন্যে আমি তোমাকে শ্ৰদ্ধা করি। তোমার কবর হবে ওমরপুরের প্রধান কবর, প্ৰধান দরগা, তোমাকে আমরা আমার ক’রে রাখবো, মিনার তুলবো; তোমার রক্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পবিত্র নগর, প্রতিষ্ঠিত হবে একটি পবিত্ৰ স্তান। ধন্য তুমি শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিন, তোমাকে ছালাম।’
শহিদ মোঃ হাফিজুদ্দিনকে দাফন করার পর নিয়ম মতো শহরটিকে আমরাপুনরায় পরিশুদ্ধ, পাকপবিত্র, করি; জিহাদিরা যতোটা পবিত্র তাণ্ডব সৃষ্টি ক’রে তাদের সৃষ্টিকে উপভোগ করতে চায়, ততোটা আমি করতে দিই না; তবে ওমরপুর অপবিত্র থাকতে পারে না। আমরা দিকে দিকে ছুটি, ঘোড়ার যুগ থাকলে চেঙ্গিশ বা ইখতিয়ারের মতো ঘোড়া ছোটাতাম, কিন্তু আমাদের দুই পা চার পায়ের থেকে কম নয়, অন্য দুটি পা আমাদের হাতে পরিণত হয়েছে তলোয়ার পিস্তল ধরার জন্যে, আগুন লাগানোর জন্যে; জিহাদিরা মালাউন ও দালালদের ঘরে দোকানে আগুন লাগায়, ছেলেমেয়েদের নাচগানের কুফরি তিনটি স্কুলকে ছাইয়ে পরিণত করে—নাচগান জিনার সমান; কিন্তু কতল করার মতো যোগ্য মালাউন আর দালান পাওয়া যায় না।
ওরা পবিত্রপুর ছেড়ে আগেই পালিয়েছে, যারা পড়ে আছে তারা জিম্মি।
জিম্মিদের রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব, তাদের থেকে জিজিয়া আদায় করতে হবে, জিজিয়া ছাড়া আমাদের চলবে না, ধর্ম রক্ষার জন্য জন্যে জিজিয়া দরকার। ওমরপুর এখন পাক পবিত্র স্তান; তার বাতাসে ধুঁয়ো ও আগুনের গন্ধ, রক্তের গন্ধও আছে; কিন্তু তাতে কাফেরি নেই, মালাউন ও তাদের দালাল নেই। এই প্রথম আমি সম্পূর্ণ পাক নিশ্বাস নিই, আলহামদুলিল্লা। জিহাদিরা ক্লান্তিহীন পুরুষ, রক্ত ও আগুন তাদের প্রিয়, অনাহারে তারা দিনরাত জিহাদ করতে পারে, তাদের নিয়ে সারা দুনিয়াকে স্তানে পরিণত করা যাবে, তারা থামতে চায় না।
আমি বলি, ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ।‘
তারা সহস্র কণ্ঠে বজ্রের আওয়াজ তোলে, ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ’, আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘জামাঈ জিহাদ জিন্দাবাদ’।
আমি বলি, ‘তোমরা কি ক্লান্ত?’
বজ্ৰনিৰ্ঘোষে তারা বলে, ‘না।’
আমি বলি, ‘আমাদের ক্লান্ত হ’লে চলবে না, থামলে চলবে না; তবে আগামীকালও আমাদের মহৎ কর্মসূচি আছে, আগামীকাল আমরা শ্যামসিদ্ধির নাম বদলে দেবো, ওই কাফের গ্রামকে পাক ক’রে তুলবো, ওই মঠকে ধুলোয় গুড়িয়ে দেবো, তাই আমাদের আজ বিশ্রাম দরকার।’
তারা বলে, ‘আপনি আমাগো আদেশ করেন।‘
আমি বলি, ‘মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে তোমাদের জন্যে খাবার তৈরি রয়েছে, সেখানে গিয়ে তোমরা আহার করে। তারপর যার যার মাদ্ৰাছায় ফিরে যাও, কিন্তু কুয়ৎ ঠিক রেখো। আগামীকাল সকাল আটটায় আবার সকলে জমায়েত হয়ো মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবির সম্মুখে।’
তারা আওয়াজ তোলে ‘ওমরপুর জিন্দাবাদ’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘জামাঈ জিহাদ জিন্দাবাদ’।
জিহাদিদের প্রচুর আহারের ব্যবস্থা
জিহাদিদের প্রচুর আহারের ব্যবস্থা করেছে মাদ্রাছা-ই-মদিনাতুন্নবির মহান প্রতিষ্ঠাতা আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি; সে জানে জিহাদিরা খেতে পছন্দ করে, ওদের মগজ পেটে এবং অরো একটু নিচে, তাই সে তাদের জন্যে গোটা বিশেক গরু কোরবানি দিয়েছে।
খেতে আমিও পছন্দ করি, গরুর সুরুয়ার লাল টকটকে রঙ আর চর্বি আমার পছন্দ। মাদ্রাছা-ই-মদিনাতুন্নবির প্রাঙ্গণে উৎসব শুরু হয়ে গেছে, খাওয়ার উৎসব, জয়ের উৎসব; আমি আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারে, আর নতুন দুই নম্বর খেতে বসেছি আমার ‘গোলাপ-ই-সাহারা’য়। আমি যে-বিশাল ঘরটিতে থাকি, সেটির নাম দিয়েছি আমি ‘গোলাপ-ই-সাহারা’, ওই ফুলটির গন্ধ আমাকে কুয়ৎ দেয়। এখন আমার দুই নম্বর জিহাদি মোঃ আবু লাদেন।
লাদেন নামটি যে এই নাপাক দেশে আগেও ছিলো আমি জানতাম না; তার নামটি শুনেই আমার পছন্দ হয়, আরো পছন্দ হয় তার চরিত্র। আমি কয়েক দিনেই বুঝতে পারি সে সত্যিকার ছালাম দেয়, ওপরে উঠতে চায় না, আমি তাকে শুয়োরের গোস্ত খেতে বললেও সে বিছমিল্লা বলে খাবে। আমি একেই পছন্দ করেছি, তাই আজই তাকে দু-নম্বরের গৌরব দিই।
মোঃ আবু লাদেন আমার পায়ে ছালাম ক’রে বলে, ‘হুজুর, আমি খোয়াবেও ভাবি নাই আপনে আমারে আপনের দুই নম্বর করবেন। আপনের লগে আমি কোনো দিন বেঈমানি করুম না।’
আমি বলি, ‘আল্লার রহমত তোমার ওপর বর্ষিত হোক।’
সে আমার ঘরেই কয়েক রাকাত সালাত আদায় ক’রে আমার পায়ের নিচে বসে; একটু পরেই হয়তো সে আমার পা টিপতে শুরু করবে।
আমি বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তুমি ঈমানের সঙ্গে কাজ করবে; এখন উঠে চেয়ারে বসো, এসো এক সাথে খাই।’
সে আমার সঙ্গে চেয়ারে বসে খাবে কোনো দিন ভাবে নি; আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ার চেষ্টা করি কোনো দিন সে মোঃ হাফিজুদ্দিন জিহাদি হয়ে উঠবে কি না, এই দুনিয়ায় কাউকেই চিরকাল বিশ্বাস করা যায় না।
খেতে খেতে আমরা গল্প করি, শ্যামসিদ্ধির কথা বলি।
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, আপনেই আমাগো ফিউচার, আমরা দেশে ঈমান চাই, শরিয়া চাই, একদিন আপনে হইবেন আমাদের মোল্লা ওমর, দেশটারে আল্লার নামে চালাইবেন।’
আমি বলি, ‘আপনার বিবিজান লাইলাতুল কদর কেমন আছেন?’
কোরবান ব্যাপারি বলে, ‘তার প্যাড ত খালি থাকে না, এইখনও একটা প্যাডে। আমার অসুবিদা হইতেছে।’
আমি বলি, ‘খাঁটি মুছলমান আওরাতের পেট ভরা থাকাই নিয়ম, পেট খালি রাখলে তারা শয়তানের সঙ্গে জিনা করতে পারে।‘
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘শয়তানের লগে যাইতে জিনা করতে না পারে হেইরা লিগাই ত তার পেডটারে আমি গুদামের মতন ভাইরা থুই; তয় অখন আমার অসুবিদা হইতেছে, আমি তার উপরে ওটতে পারি না, আমার প্যাডটা ত দেকতে পাইতেছেনই, আর তারে উপরে ওটতে কইলে সে কয় এইডা ইছলামে হারাম, হে অনেক মছল্লা শিকছে।’
আমি বলি, ‘খাঁটি মুছলমানের নিয়মিত ছহবত দরকার।‘
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হ, হুজুর, সাচা কতা কইছেন।’
আমি বলি, ‘আপনার গার্মেন্টসে তো অনেক কচি মেয়ে আছে, গার্মেন্টসের পেট খসানোর জন্য তো অনেক এনজিও আছে?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হা, তাগো কয়টারে দিয়াই এইখন টেমপরারি কাম চালাইতে আছি, এইখন বোঝতে আছি ক্যান চাইরটা বিবি দরকার, আল্লা যা করেন ভালর লিগাই করেন।’
আমি বলি, ‘মাসে কটির পেট বানান?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হেই হিসাব রাখনের সময় আমার নাই, হুজুর, প্ৰডাকশন, এক্সপোর্ট, ইমপোট, কাস্টমস, সোনা আনন, ব্যাংক লোন, লোন শোদি না করনের ফাঁক বাইর করন, ট্যাকা পয়সার হিসাব রাখতে রাখতেই মাতা খারাপ অইয়া যায়।‘
আমি বলি, ‘প্রেগন্যান্ট হ’লে প্ৰব্লেম হয় না?’
সে বলে, ‘এইটা আইজাকাইল কোনো প্ৰব্লেমই না, হায়েজ না হইলেই পাঠাই দেই, আমাগো কন্টাক্ট করা ক্লিনিক আছে, তারা খসাই দেয়, তিন শ কইর্যা লয়, মাইয়াগুলিও ফুর্তিতে কাম করে, ফুর্তি ছাড়া কেউ কাম করতে চায় না।’
আমি বলি, ‘আপনার বিবিজান জানেন?’
সে বলে, ‘অহন জানলে আর না জানলে কিছু আহে যায় না। তয় হে ট্যাকা চিনে, আমার থিকা বাড়ি ল্যাখাই নিছে, দশ কোটি ট্যাকাও নিছে ল্যাকাপরা জানা বিবি ত, সব বোঝে, ট্যাকা বোঝে বেশি। তয় তার ছাৰ্ভিছটা ফাশ কেলাশ, গার্মেন্টসের মাইয়াগুলি অই রকম পারে না, ব্যাংককের ছেমরিরাও পারে না। আমি তাজ্জব অই বিবি এই ছাৰ্ভিছ শিগলো কোহ হানে?’
আমি বলি, ‘আপনার কি মনে হয় আপনার বেগম ছাহেবা আগেই সার্ভিস শিখে এসেছিলেন?’
সে বলে, ‘তোবা, আস্তাগাফেরুল্লা, অইডা বিবিজান করে নাই, পরথম যেই দিন ছোফার উপর ছহবত করি, লউয়ে ছোফা ভিজ্জা গেছিল; পরদিনই নতুন ছোফা কিনতে অইছিল।‘
আমি বলি, ‘অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গিয়েছিলো তাতে?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘ট্যাকা ত মুত। ছোফায় লউ দেইক্যা আমার দিল ভইর্যা গেছিল, মনে অইছিল আমি হুরি পাইছি।‘
আমি মোঃ আবু লাদেনকে জিজ্ঞেস করি, ‘মোঃ আবু লাদেন শাদি করেছো কয়টা?’
মোঃ লাদেন বলে, ‘না। হুজুর, ইছলামের জইন্যে জীবন কুরবানি কইর্যা দিছি, একটা বিবিও লই নাই, লমুও না।’
আমি বলি, ‘এটা ঠিক নয়, বিবি নেয়ার আদেশ আছে।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘অহন বিবি লওয়ার ট্যাকা অয় নাই, হুজুর।’
আমি বলি, ‘শিগগিরই হবে, একটি দুটি বিবি নিও।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘আপনে দয়া করলে লমু, হুজুর।’
আমি বলি, ‘এখন কষ্ট হয় না?’
সে একটু লজ্জিত হয়, তবু বলে, ‘হুজুর, আপনের কাছে মিছা বলুম না, আমার কয়ড়া গেলমান আছে, আর হুজুর শান্তির ঠাণ্ডা আগুনের সোম কয়ডা মালাউন মাইয়ার লগে ছহবত করছি।‘
আমি বলি, ‘কোনটি তোমার পছন্দ?‘
সে বলে, ‘হুজুর, মালাউন মাইয়াগুলি হুরির মতন, গেলমান দিয়া ঠ্যাকা কাম চালাই, হুজুর অনুমতি দিলে আইজ রাইতে একজন গেলমান আনুম।’
আমি বলি, ‘একটি মালাউন মাইয়া আনতে পারো নি?’
সে বলে, ‘না, হুজুর, অহন ত শান্তির ঠাণ্ডা আগুন নাই; আবর কবে শান্তির ঠাণ্ডা আগুন লাগাইবেন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘আগুন তো লেগেই আছে।’
আজ আমার কোনো হুর বা হুরি নেই বা উর্বশী নেই, দরকারও বোধ করছি না; কালকের শ্যামসিদ্ধিকে পাক করার পর দরকার হবে।
আজি আছে ব্ল্যাক লেবেল ও সিভাস রিগ্যাল, আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি পাজেরোতে ক’রে কয়েক বোতল নিয়ে এসেছে আমার জন্যে। আমারও একটি পাজেরো আছে, পুরানো, পাজেরো ছাড়া দেশকে পবিত্র স্তানে পরিণত করা যায় না; আর শারাব খুবই দরকার, গুলশানে আমার একটি ফ্ল্যাট আছে, আমার কিনতে হয় নি, এক ডোনার সেটি উপহার দিয়েছেন। আমিরাত থেকে তিনি আসেন মাঝেমাঝে, মুম্বাই থেকে একটি-দুটি হুর নিয়ে আসেন, বাঙালি হুরও তাঁর পছন্দ। মালাউন হুর তার বিশেষ বিশেষ পছন্দ–তার মতে ওদের সার্ভিস ফাইভ স্টার; তবে তাঁর শ্ৰেষ্ঠ পছন্দ চাকমা মারমা হুরী–দিঘিনালায় একবার চাকমা না মারমা হুর টেস্ট করার পর, আর কোনো হুরে তার রুচি নেই। আমিরাতিদের সবাই আমির; এলেই আমার হাজার পঞ্চাশেক ডলার থাকে, আর ওই ডলার জিনিসটা দেখলেই নফল নামাজ আদায় করতে ইচ্ছে হয়।
আমি একটি ব্ল্যাক লেভেল খুলি, মোঃ লাদেনকে জিজ্ঞেস করি, ‘চলবে?’
সে বলে, ‘হুজুর, এত দামি জিনিশ কোন দিন খাই নাই; ভাইগ্যে অয় নাই, কেরুই আমার ভাইগ্যে জোডে।‘
আমি বলি, ‘তাহলে তুমি তো এতোদিন কুকুরের মুত খেয়েছে।’
সে বলে, ‘আমরা ছোডো জিহাদি, অইডা খাইয়াই জিহাদ করি।’
আমি বলি, ‘আজ একটু ভালো জিনিশ খেয়ে দেখো।’
সে বলে, ‘হুজুর, আপনের লগেই খামু? আমার গুনাহ অইব না?’
আমি বলি, ‘না, গুনাহ্ হবে না, যদি বেঈমানি না করো, মনে রেখো আমি তোমার কে। ইছলামে আমরা সবাই সমান, তবে কেউ কেউ সমানের থেকে একটু বেশি, যেমন আমি তোমার থেকে সমানের চেয়ে একটু বেশি।’
সে বলে, ‘হুজুর, মইর্যা গেলেও বেঈমানি করুম না; চিরকাল আমি আপনের পায়ের নিচে পইর্যা থাকুম; আমি মোঃ হাফিজুদ্দিন না।’
একটু চমকে উঠি, তাহলে হাফিজুদ্দিনকে সেও খেয়াল করছে? আহাম্মক দেখালেও এর সম্পর্কেও সাবধান থাকতে হবে।
সন্ধ্যায় আমি মাদ্রাছা-ই-মদিনাতুন্নবির জিহাদিদের, আমার দুই নম্বরকে, আমার বডিগার্ডদের, দুই নম্বরের বডিগার্ডদের, ‘আলি দিবস’-এর মহান কর্মকাণ্ডের কর্মপদ্ধতি বুঝিয়ে দিই। ওই ঘিলুহীন জিহাদিগুলো সহজে কিছু বোঝে না–আল্লা ওদের এভাবেই সৃষ্টি করেছেন, তাঁর পরিকল্পনা কে বুঝতে পারে—, খুন আর ছহবত আর গেলমান ছাড়া, ওদের সব কিছু মুখস্থ করাতে হয়; কিন্তু একবার বুঝিয়ে দিলে, মুখস্থ হয়ে গেলে, ওরা বেশ মুখস্থ করতে পারে, ওরা হাইয়ানের মতো কাজ করে। আরব্য হাইয়ানের মতো; এটা আমার পছন্দ। হাইয়ান না হ’লে প্রকৃত ধাৰ্মিক পরহেজগার হওয়া যায় না, বিশ্বাসী হওয়া যায় না, অন্ধ হওয়া যায় না; যে প্রশ্ন করে, যার সন্দেহ আছে, তাকে দিয়ে কিছু করানো যায় না; যে প্রশ্ন করে না, যার সন্দেহ নেই, যে অন্ধ, তাকে দিয়ে সব করানো যায়; সে হচ্ছে প্রশ্নহীন অগ্নিকাণ্ড, খাপখোলা তলোয়ার।
সাম্যবাদ, সর্বহারার সময়ও আমি এটা দেখেছি, এখনো দেখছি, বেশি করে দেখছি; এবং এটা আমার ভালো লাগে বিশেষ একটি কারণে–আমি নেতা, একনায়ক, আমার আদেশ সবাই মান্য করে। তারা অবশেষে আমার কথা বোঝে, আগামীকাল তারা হরফে হরফে জের জবর পেশা নোক্তাসহ তা পালন করবে। জিনরা একবার বুঝলে জিনের মতোই কাজ করে।
বোঝাতে বোঝাতে রাতের আহারের সময় হয়ে যায়।
আমি আহার করি, একা, দুই নম্বরকে ডাকতে ইচ্ছে করে না, এবং সিভাস রিগ্যালের বোতলটি খুলে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি। এই সব জিনিশ–আঙুর, গম থেকে তৈরি সাকারগুলো–একটু অদ্ভুত, এগুলো মানুষকে একলা করে। বেশ একলা; অনেকের সঙ্গে খাওয়ার সময়ও আমি একলা বোধ করি, আর যখন একলা খাই তখন থাকি বিধাতার মতো নিঃসঙ্গ। অবশ্য এই চরম নিঃসঙ্গতা আমাকে কখনো কখনো চরম সুখ দেয়, নিঃসঙ্গতারও রয়েছে অবর্ণনীয় সুখ; মনে পড়ে এক সময় আমি কবিতা পড়তাম, কাপতাম, বিষন্ন হতাম; এখনো মনে পড়ে, ‘কমরেড, তুমি নবযুগ আনবে না?’, ‘অজস্র জন্ম ধ’রে আমি তোমার দিকে আসছি, কিছুতেই পৌঁছোতে পারছিনা’, ‘ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে’। এই সব আমি অনেক দিন করি না। আমি একলা বোধ করি, এবং কাকে যেনো মনে পড়ে। কাকে আমার মনে পড়ছে? কেনো মনে পড়ছে? মনে পড়া খুবই খারাপ, তাতে মানুষ অসুস্থ হয়; তাহলে আমি কি অসুস্থ হচ্ছি?
কাকে মনে পড়ছে? কী মনে পড়ছে?
কৃষ্ণকলি, পদ্মবতী, সীতা, রমলা, বকুলমালা, মেহেরুন্নেছা, লাকি, বিউটি, মঞ্জু, শেলিকে? মিনিস্টার, সেক্রেটারি, নেতা, সিডনি, লন্ডন, ঢাকা, কাবুল, কাতার, রিয়াদকে? না, তাদের কথা আমার মনে পড়ে না।
আমার মনে পড়ে কণকলতাকে, স্বৰ্ণলতাকে, সঞ্চারিণী পল্পবিনীকে।
আমি ফোন করি; এই প্ৰথম ফোন করতে আমার আঙুল কাঁপে।
তাহলে আমি কি সত্যিই অসুস্থ হচ্ছি? নইলে আঙুল কাঁপবে কেনো?
মোবাইলটি আমার হাত থেকে পড়ে যেতে চায়, ওটিকে আমার রক্তমাংসময় মনে হয়, কণকলতার চিবুকের মতো, বুকের মতো, টোলের মতো, স্বর্ণদ্বীপের মতো; মোবাইলটির যেনো একটি হৃৎপিণ্ড আছে, সেটি থারথার করছে।
আমার গলা শুনেই কণকলতা বৃষ্টির শব্দের মতো বেজে ওঠে।
‘হুজুর, আমি আপনের বিবি কণকলতা, আপনার কণকলতামণি। হুজুর, আমারে এই রাইতে আপনের মনে পড়ছে? আমি বুক ভাইর্যা আপনেরে ডাকতেছি, যেইভাবে আপনে আল্লারে ডাকেন। আপনে আমার ডাক শোনাতে পাইছেন, হুজুর?’
ওর ডাক আমি সব সময়ই শুনি, কিন্তু সেটা ওকে বলতে চাই না; আমি বলি, ‘তুমি ফোন করো নি কেনো?’
কণকলতা বলে, ‘আমার ডর করতে আছিল, হুজুর।’
আমি বলি, ‘কেনো?’
কণকলতা বলে, ‘মনে হইছিল আপনে জিহাদিগো লগে মিটিং করতেছেন, কাউলকার প্রোগ্রাম ঠিক করতেছেন; আপনের কত কাম, ফোন করার লিগা আমার বুক কাপছিলো।’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, ওই ঘিলুছাড়া বাঞ্চতদের অনেক কিছু বোঝাতে হয়েছে, অনেক সময় লেগেছে, এখন আমার একলা লাগছে।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনে তাইলে আল্লা রছুলরে ডাকেন, নইলে আমারে ডাকেন, কন কণাকলিতা, কণকলতা, কণকলতা।’
আমি বলি, তাতে আমার কাজ হবে না, তাদের তো আমি দমে দামে ডাকি, এখন আমার তোমাকে দরকার।‘
কণকলতা বলে, ‘খালি দরকার, হুজুর? আর কিছু না?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, দরকার।‘
কণকলতা বলে, ‘খালি দরকার? আমি আপনের রাইতের দরকারের মাল? আপনের খিদার পান্তাভাতে পিয়াইজ ভর্তা? আপনের মোতনের ডহি?’
আমি বলি, ‘তা আমার দিল জানে, কাউকে জানতে দেবো না।’
কণকলতা বলে, ‘আমারেও জানতে দিবেন না, হুজুর? একবার জানতে দিলে গলায় ফাঁসি দেওনের সোমও সুখ পামু।’
আমি বলি, ‘তোমার ফাঁসি দিতে হবে না।’
কণকলতা বলে, দড়ি ত বিছনার নিচেই রাইখ্যা দিছি, ওইটায় ঝোলনের আগে আপনের দিলের কতা আমারে একবার কন, হুইন্যা সুক পাই।’
আমি বলি, ‘না, কাউকে আমি দিলের কথা বলি না।’
কণকলতা বলে, ‘আমারেও কইবেন না?’
আমি বলি, ‘না।‘
কণকলতা বলে, ‘ক্যান, হুজুর?’
আমি বলি, ‘আমার দিল কথা বলতে ভয় পায়।’
কণকলতা বলে, ‘আপনের দিলডা এত ডরায় ক্যান? আপনে ত, হুজুর, ডরান না।’
আমি বলি, ‘আমার দিলটি হৃদয় হয়ে উঠছে।‘
কণকলতা বলে, ‘হৃদয়? এ কোন কতা হুনাইলেন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘তোমার বিশ্বাস হয় না?’
কণকলতা বলে, ‘আপনের সব কতাই আমার বিশ্বাস হয়, আপনে আমার কেছে আল্লার মতন, ভগবানের মতন।‘
আমি বলি, ‘এমন কথা বলা কবিরা গুনাহ।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আগামীকাইল তা জিহাদ আছে, আমাগো ঘরবাড়ি, বাবার কলডা, আর দোকানগুনি আমারে মনে কইর্যা একটু দেইখ্যেন।’
আমি বলি, ‘আমার একলা লাগছে, কণকলতা।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের তাল গাছ আমারে চায়, না আপনের হৃদয় আমারে চায়? কন, আপনের হৃদয় আমারে চায়?’
আমি বলি, দুটোই তোমাকে চায়; হৃদয়ে আর তালগাছে তফাৎ নেই।’
কণকলতা বলে, ‘এই রাইতে আসুম কেমুন কইর্যা, হুজুর? আপনে আমারে দিল দিয়া হৃদয় দিয়া আদর কইরেন; আর হুজুর, আমি আপনের হারটা গলায় পইর্যা আছি, মনে আয় হুজুররে বুকে লইয়া আছি, আমার বুক কাপতেছে।’
আমি বলি, ‘তুমি তবু হার পরেছে, আমার কিছু নেই, আমি একলা।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের লিগা আমি কষ্ট পাইতে আছি, হুজুর, আপনের লিগা আমার পরান কান্দে।’
অন্য মোবাইলগুলো আমাকে পাগল ক’রে তোলে।
কিছু না বলেই আমি কণকলতাকে কেটে দিই। শুধু শুনতে থাকি :
‘কাউলকা কয়েকটা মালাউনরে ফালাই দিও, অগো দালালগো ফালাই দিও, আল্লায় তোমারে রহমত করব। তোমার কামের উপরই আমরা ভরসা কইর্যা আছি, পাক স্তানের আর তেরি নাই, আল্লা হাফেজ।’
‘আমাগো তুমি পাক স্তানের দিকে আগাই দিছ, আবার আমরা পাক সার জমিন সাদ বাদ ফিইর্যা পাইব, আমাগো দিল খুশিতে ভাইর্যা আছে, আমাগো পাক স্তানের মুরুব্বিরা তাকাই রইছে, কাউলকা জাহান কাপাই দিবা, ডর নাই, মুরুব্বিরা আছে, আল্লা হাফেজ।’
‘মেইন পার্টির অনেকেই এইখন আমাগো লগে, মেইন পার্টিরে আমরা মাইনর পার্টি কইর্যা তুলুম, তারা আমাগো ট্রিক্স বুজতে পারে নাই; পরের ইলেকশনে আমরাই আসুম, তয় ইলেকশনে ফিলেকশনে আমরা বিশ্বাস করি না, আমাগো বিশ্বাস জিহাদে।‘
‘আমাগো স্বর্ণযুগে ইলেকশন আছিল না, এইখনও থাকব না, ইলেকশন হইল নাছারাগো, ইহুদিগো, খিরিস্টানগো, আস্তাগাফেরুল্লা, ইলেকশন হইল আইয়ামে জাহেলিয়াতের নিয়ম।’
‘দশজন জেনারেল তোমারে প্রশংসা করছে, মোবারকবাদ জানাইছে, তারা এইখন আমাগো লগে আছে, তারা তোমারে জেনারেলের জেনারেল মনে করে, তারা হেল্প করব, আল্লা হাফেজ।‘
‘আমি কাইল তোমার আরও সাকসেস উইশ করি করি, তুমি দ্যাশটারে পাক করবা, আবার আমরা স্তান ফিইর্যা পাব, উই মাস্ট গেট ইট ব্যাক। পিউর অ্যান্ড পারফ্যাক্ট ইছলাম ইজ স্টেজিইং এ কাম ব্যাক থ্রো ইউ. আল্লা হাফেজ।’
‘ইছলাম ইজ দি অনলি সলিশন, আন্ড উই উইল সল্ভ্ ইট। নো আদার সলিশন ইজ অ্যাকছেপ্টবল, দেয়ার ইজ নো আদার সলিশন। আল্লা দি গ্রেট দি রাহমানির রাহিম ইজ উইথ আস।‘
‘আই অ্যাম শিউর টুমরো উইল বি এ গ্রেট ডে ইন দি হিস্ট্রি অব ইসলাম, ইন দি হিস্ট্রি অব স্তান, জাস্ট বার্ন দ্যাট ব্লাডি মঠ, ফাক ইট, মেইক দি মালাউন্স ইউর জিম্মিজ। বি কেয়ারফুল অব দেয়ার দালালস, উই শ্যাল নেভার লেট দেম কাম ব্যাক টু পাওয়ার, দি দালালস আর কন্সপাইরিং টু কাম ব্যাক টু পাওয়ার, বাট দে মাস্ট বি ভেপারাইজড, আল্লা হাফেজ।’
‘এমডি অব দি দুবাই-মদিনা-কাতার ব্যাংক স্পিকিং, স্যার। উইশ ইউ অল সাকসেস। আমরা আপনের জইন্যে দুই কোটি ট্যাকা রাখছি সো দ্যাট ইউ ক্যান বিল্ড অ্যান আল আকসা অ্যাট দ্যাট প্লেস, আল্লা হাফেজ। ‘
‘ভিসি অব আইআইইউ স্পিকিং, কংগ্ৰেচুলেশন্স ফর টুমরো, ওয়ান ডে উই শ্যাল ট্রান্সফর্ম ইট ইনটু অ্যান আল আজহার, অনলি দি হোলি কুরআন, হাদিছ, ফিকাহ উইল বি টট, উই শ্যাল থ্রো এওয়ে দি ব্লাডি বাস্টার্ড ওয়েস্টার্ন সাইন্সেস, ইছলাম ইজ দি অনলি সাইন্স, ইট ইজ দি সাইন্স অব আল্লা দি রাহমানির রাহিম; অ্যান্ড উই নিড দ্যাট সং পাক সার জমিন সাদ বাদ। দি সং রিংগস ইন মাই হার্ট, আই লিসন টু ইট এভরি নাইট ইন পিটিভি।‘
‘আমি এই দ্যাশে, নাপাক দ্যাশে শাস লাইতে পারি না, প্লিজ ডু মেইক ইট এ পিউর অ্যান্ড পারফেক্ট পাকিস্তান। পাক সার জমিন সাদ বাদ।’
আর লন্ডন, হেলসিংকি,
নিউ ইয়র্ক, সিডনি, প্যারিস, তোকিও,
জাকার্তা, পুত্রজায়া, বার্লিন, আবু ধাবি, রিয়াদ, কাবুল,
তেহরান, আমস্টারডাম, দিল্লি, মস্কো, সোল, রোম, কাতার,
ইসলামাবাদ, সুনামগঞ্জ, মদনগঞ্জ, ভেদরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ,
ঠাকুরগাঁও, কামারগাঁও, সোনারগাঁও, ব্ৰাহ্মণগাঁও…
আমি একই সঙ্গে উত্তেজনা ও নিরুত্তেজনা বোধ করি; আমি শ্যামসিদ্ধি গ্রামটি ও তার আকাশছোঁয়া মঠটিকে দেখতে পাই।
আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে শ্যামসিদ্ধি, কিন্তু এক মাইল হেঁটে গেলেই দূর থেকে ওই মঠটি দেখতে পেতাম, ওটিকে দেখার জন্যে কতো দিন আমি বিকেলে এক মাইল দৌড়িয়েছি, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তার চুড়োটি দেখে আবার দৌড়ে বাড়ি ফিরেছি। কী সুখ পেতাম তাতে, আমি জানি না; কখন ওটি তৈরি হয়েছিলো তাও জানি না; কিন্তু গাছপালার ওপর দিয়ে উঠে যাওয়া আকাশচুম্বি ওই মঠ আমাকে আকাশ ছুঁতে বলতো। উচ্চতা আমার পছন্দ।
ওটি ধ্বংস করতে হবে আমাকে, ওটি জামাঈ জিহাদে ইছলামের শক্র, ওই মঠ ও জামাঈ জিহাদে ইছলাম একসঙ্গে থাকতে পারে না।
আমি বিশাল হ’তে চাই, বিশাল হতে হ’লে বিশালকে ধ্বংস ক’রেই হতে হয়; উচ্চ হতে চাই, উচ্চ হতে হ’লে উচ্চকে ধ্বংস করতেই হয়; ক্ষুদ্রকে ধ্বংস ক’রে কেউ আকাশ ছুঁতে পারে না।
একটু বেশি পান করেছি, বডিগার্ডদের বলে রেখেছি ফজরের আগেই আমাকে উঠিয়ে দিতে, তা তারা দেবে; কিন্তু আমার ঘুম আসছে না।
আমি কণকলতা ও শ্যামসিদ্ধর মঠটিকে দেখতে পাচ্ছি।
আজকের বিশাল কর্মকাণ্ড, নিঃসঙ্গতা, সিভাস রিগ্যালের জন্যে হয়তো আমি একটু স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছি, স্মৃতি সব সময়ই ক্ষতিকর; তা মানুষকে এগোতে দেয় না, মহৎ হ’তে দেয় না, স্মৃতিকে ধ্বংস ক’রেই গ্রেট হতে হয়। যাদের স্মৃতি নেই, তারাই গ্রেট।
আমি বোধ হয় গ্রেট হতে পারবো না, আমার স্মৃতি জেগে উঠছে–ওই মঠে কী হতো, এখন কী হয়, তা আমি জানি না; একবার একটুকু কাছে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম ঝাঁকেঝাঁকে পাখি এসে বসছে মঠের ফাঁকে ফাঁকে, আবার উড়ে যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছিলো ঝাঁকেঝাঁকে রঙ আর সুর এসে বসছে আর উড়ে যাচ্ছে, এখন অবশ্য আমি আবাবিল ছাড়া আর কোনো পাখি চিনি না।
আমি দেখি আশমান ভ’রে আবাবিল।
পাখির রঙ আর সুর আমাকে আর মুগ্ধ করে না, আমি মুগ্ধ হই পাথরের টুকরো মুখে করে আসা হিংস্র পাখির কথা ভেবে, যা বেহেশত থেকে ছুটে এসেছিলো রাহমানির রাহিম পরম করুণাময়ের নির্দেশে। হাতি নিয়ে এসেও কোনো কাজ হয় নি ওই পাক পবিত্র পাখির সামনে।
কয়েক বছর আগে একটি কাফেরের লেখা বই পড়ে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম, কাফেরটিকে না পেয়ে বইটিকে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।
কাফেরটি লিখেছে ওইগুলো পাখি ছিলো না, সে-বছর মক্কায় বসন্তু রোগ দেখা দিয়েছিলো, তাতে অনেকে মারা যায়, আর কাফের আক্রমণকারীরা বসন্তের ভয়ে পালিয়ে যায়। যারা বেঁচেছিলো, তাদের মুখ আর শরীর ভরে থাকে বসন্তের কুৎসিত দাগে; ওই দাগগুলোকেই মনে করা হয় আবাবিল পাখির ছোড়া পাথরের টুকরোর দাগ। আস্তাগফেরুল্লা।
কাফের নাছারারা কতো মিথ্যেই যে রটাতে পারে; তাই দুনিয়া থেকে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি ভুলতে পারছি না কণকলতাকে ও শ্যামসিদ্ধির মঠটিকে, আমি ঘুমোতে পারছি না।
রাত ভোর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ওই মঠটি হবে শূন্যতা।
নতুন মহাপূর্ণতা সৃষ্টির জন্যে শূন্যতা সৃষ্টি করতে হয়; আগামীকাল আমি শূন্যতা সৃষ্টি করবো মহাপূর্ণতা সৃষ্টির জন্যে।
কিন্তু আমি দেখতে পাই আমি বিকেলে বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছি পথের ধারে, দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি শ্যামল খয়েরি মঠটি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আকাশ মঠটির দিকে তাকিয়ে আছে; আমি একটি ঘাসফুলের মতো তাকিয়ে আছি মঠ ও আকাশের দিকে।
আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি, আগামীকাল, একদা ছোটো ঘাসফুল ধ্বংস করবে আকাশচুম্বি বিশালকে, ওই মঠ তা জানে না। মঠটি কি এখন আমার পায়ে এসে পড়তে পারে না? কাঁদতে পারে না হরিপদ বা দুর্গার মতো? আবেদন জানাতে পারে না, ‘হুজুর, আমাকে বাঁচান, আপনের পায়ে পড়ি।’
মঠ, তুমি আকাশচুম্বি হ’লেও, অতিশয় তুচ্ছ এই ঘাসফুলের কাছে; অবশ্য আমি আর ঘাসফুল নই, অগ্নিকুণ্ড, অনেক বছর আমি ঘাসফুল দেখি নি, দেখতেও চাই না। আমার সুদক্ষ বিস্ফোরকবিদরা সব পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছে, তারা জানে কয়েক মুহূর্তে কীভাবে বিশালকে ধ্বংস করতে হয়। বিস্ফোরকবিদেরা ট্রেনিং পেয়েছে দেশে ও বিদেশে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে আর পাক পাকিস্থানে, তারা জিহাদের বিজ্ঞানী।
আমি অবশ্য মাঝেমাঝে ভাবি ওই তুচ্ছ মঠটিকে ধ্বংস করতে কাফেরদের বিস্ফোরক ও নিয়মকানুন লাগবে কেনো?
একটি পাক কালাম কি আমরা খুঁজে বের করতে পারিনা যেটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক বজ্র ছুটে এসে ওটির মাথায় আঘাত হানবে, এবং টুকরো টুকরো হয়ে যাবে কাফেরদের মঠ? আল আজহার কী করে? খোমেনিরা কী করেন? তারা এখনো কেনো সেই কালামটি খুঁজে বের করতে পারে নি? আমি বিশ্বাস করি ওই কালাম আছে, শুধু আমরা বের করতে পারছি না; অথচ নাছাৱারা তার সাহায্যে এটম বোমা হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করেছে, তার ভয়ে মানুষ কঁপিছে। আমি জানি হাইড্রোজেন বোমার থেকেও শক্তিশালী কালাম আছে, আমরা এখনো সেটি খুঁজে বের করতে পারি নি।
আমার ঘুম আসছে না, আমি শান্তি পাচ্ছি না।
কণকলতাকে আমি ফোন করি; সে বলে, ‘হুজুর, অহন তিনডো বাজে, অহনও আপনে ঘোমান নাই, আপনের কী হইছে, হুজুর?’
আমি বলি, ‘তুমিও তো ঘুমেও নি।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুরের হারডা গলায় পইরা হুইয়া রইছি, ঘুমাইতে ইচ্ছা করতে আছে না, হুজুর থাকলে আর ঘুম কি; হারডারে মনে হইতেছে হুজুরের হুজুর হুজুরের জিবলা হুজুরের ঠোট।’
আমি বলি, ‘আমার ঘুম আসছে না; আমার গলায় তো কণকলতার হার নেই, আগুনের মালা বুকের মধ্যে।’
কণকলতা বলে, ‘আপনের কী হইছে, হুজুর? তালগাছ ঘুমাইতে দিতেছে না?’
আমি বলি, ‘না, তার থেকেও বড়ো।‘
কণকলতা বলে, ‘হেইডা কি, হুজুর?’
আমি বলি, ‘কাল শ্যামসিদ্ধির মঠটি ধ্বংস করা হবে, ওটি আর দেখবে না।’
কণকলতা হাহাকার করে উঠে বলে, ‘কন কি হুজুর? এইর থিকা আমারে খুন কইর্যা হালান, চুরমার কইর্যা হালান, বলি দিয়া হালান।’
আমি বলি, ‘সবই রাহমানির রাহিম আল্লার ইচ্ছা, পাক স্তান পাক সার জমিন সাদ বাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, কাল ওখানে শূন্যতা থাকবে, যেমন এখন আমার বুকে শূন্যতা।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের পায়ে পড়ি, তার বদলে আমারে বলি দেন, ভাগা দিয়া দ্যান, ওইডার দিকে আমি সকাল বিকাল চাইয়া থাকি।’
আমি বলি, ‘তার বদলে এখন নতুন কিছুর দিকে চেয়ে থাকবে।’
কণকলতা বলে, ‘নতুন জিনিশটা কি, হুজুর?’
আমি বলি, ওখানে একটি আল আকসা মসজিদ উঠবে, মসজিদের টাকাও পেয়ে গেছি, তার দিকে তাকালে তোমার চোখ ভরে যাবে।’
কণকলতা হাহাকার করে, ‘তার বদলে আমারে বলি দ্যান, হুজুর, আপনে কইলে আমি ভোরেই আসুম, ওই মডের নিচে আমারে বলি দিয়েন।’
আমি বলি, ‘তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
কণকলতা বলে, ‘অহন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘কাল সন্ধ্যার পর তোমাদের বাড়ি আমার পাজেরো যাবে, তুমি চলে এসো; আমরা পাক সার জমিন উদযাপন করবো।’
কণকলতা বলে, ‘আইচ্ছা, হুজুর।’
আমি বলি, ‘আল্লা হাফেজ।’
কণকলতা বলে, ‘আল্লা হাফেজ, হুজুর, আপনের লিগা আমার মন কান্দে।’
তারপরও সে ফোন রাখে না, চুমোর পর চুমো খেতে থাকে; তার জিভ আর ঠোঁটের চাপে আমার মোবাইল কাঁপতে থাকে।
আমি আবার মঠটিকে দেখতে থাকি, যেনো শেষবারের মতো দেখছি; কাল ওটি আমার পায়ের নিচে পড়ে থাকবে। পাখিগুলোকে দেখতে পাই, ডানার পর ডানা উড়ছে, সুখের পর সুখ ভাসছে, রঙ আর রঙ ছবি আঁকছে। কিন্তু এখন আর আমি ছবি আঁকা পছন্দ করি না, ছবি নাপাক, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি; কিন্তু আমি মঠটি ঘিরে রঙের ছবি দেখতে থাকি।
আমি একবার উঠে সালাত আদায় করি; আল্লার কাছে জামাঈ জিহাদে ইছলামের জন্যে রহমত চাই।
সিভাস রিগ্যালের একটি বোতল বের করি।
এক গেলাশ গিলতে গিলতে আমার কণকলতাকে মনে পড়ে।
তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, তার দুটি স্তন পাকা গন্ধমের মতো পেয়ারাগাছের ডালে বুলিতে দেখি, তার শরীরটিকে আমার একটি কোমল সোনালি মাংসের মঠ মনে হয়, একদিন কি ওই মাংসের মঠও আমার চুরমার করতে হবে? আমি মনে মনে পাক সার জমিন গানটা গাই। দেখতে পাই আমার দিল পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, পাখি ডাকতে শুরু করেছে, মোরগ অপূর্ব স্বরে আল্লার নাম নিচ্ছে, সোবে সাদেকের শাম্স্ উঠছে, মুয়াজ্জিন ডেকে বলছে, নিদ্রার থেকে সালাত উত্তম, ফেরেশতারা আল্লা আল্লা জিকির করছে, আমি সেই শব্দ শুনতে পাই। আমার অবশ্য ঘুম হয় নি, অনেক রাত হবে না; একরাত ঘুম না হ’লে আমার অনেক রাত ঘুম হয় না। আমি গিয়ে সবার সঙ্গে সালাত আদায় করি।
আলি আলি জুলফিক্কার
সকাল আটটার মধ্যেই,–ফজরের সালাতের পর জিহাদিরা বেশি দেরি করে নি, তারা জিহাদে কখনো দেরি করে না; মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবির প্রাঙ্গণ ও সামনের সড়ক কয়েক হাজার জিহাদির ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও তাদের দালালদের কতল করো’, ‘মুরতাদের খতম করো’ আওয়াজে কেঁপে কেঁপে হেলে দুলে উঠতে থাকে; প্রত্যেক জিহাদির কণ্ঠ বজ্র হয়ে উঠেছে—যে-বজ্রের আওয়াজ মানুষ কখনো শোনে নি, তাদের হাত হয়ে উঠেছে খোলা তলোয়ার, যা দিয়ে একদা তারা মিসর সিন্ধু স্পেন বসরা বাগদাদ সমরকন্দ ইরান তুরান বঙ্গ বিশ্ব জয় করেছিলো, এবং আবার জয় করবে।
মোঃ আবু লাদেন ও আমার বডিগার্ডরা আমাকে ঘিরে আছে, তার গার্ডরাও আমাকে ঘিরে আছে; আমি এটাই চাই, চোখ রাখছি। আবু লাদেনের চোখমুখের ওপর, তার ঈমান খতিয়ে দেখছি। না, সে মোঃ হাফিজুদ্দিন হয়ে উঠবে না; এটা আমাকে শান্তি দেয়। আজ ফেস্টুনপ্ল্যাকার্ড আরো বেশি, ষোলোটি নিশানে বড়ো বড়ো লাল অক্ষরে লেখা হয়েছে ‘আলিগঞ্জ’, নিশানগুলো জের জবর পেশসহ মঠ পেরিয়ে আকাশে উঠে যেতে চাচ্ছে, আকাশেও আমি শত শত নিশান উড়তে দেখছি—শুনছি পাক সার জমিন সাদ বাদ।
আমার চিত্ত পুলকে সুখে শান্তিতে তেজে ভ’রে উঠছে, স্পেন বিজয়ের সময় যেমন ভ’রে উঠেছিলো তারিকের চিত্ত, মনে হচ্ছে। আমি একটি সাগর পেরিয়ে উঠবো গিয়ে আরেকটি মহাদেশে, সেটিকে জয় করবো; যদিও এখানে কোনো পাহাড় নেই, যার নাম রাখতে পারি। আমার নামে; তবে আমি ঠিক তারিক হতে চাই না, আফ্রিকার মুর মুছলমান হতে চাই না, মুসা তাকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিলো, সেভাবে আমি লুপ্ত হতে চাই না। মুসাও আমি হ’তে চাই না, খালিদ বিন ওয়ালিদ যো-পুরস্কার দিয়েছিলো মুসাকে, তাও আমি চাই না।
আমি দূর থেকে দেখছি সবুজ শ্যামসিদ্ধি ও তার মঠটি থরথর করে কাঁপছে; কাঁপতেই হবে, ভূমিকম্পে মাটি ও পাথর না কেঁপে পারে না; আর যা ধ্বংস হবে, সে আগেই তা টের পায়; তার ভেতরে রোজকেয়ামতের খবর পৌঁছে যায়। মঠটি টের পেয়ে গেছে আজই তার শেষ দিন; তাই সেটি কাঁপছে, কাপতে কাপতে নিজেই পড়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি বাঁকে বাকে পাখি দেখি, উড়ন্ত রঙ দেখি, রঙে রঙে আঁকা ছবি দেখি, পাখিদের সুর শুনি; অনেক বছর আগে থেকে উড়ে আসছে ওই রঙ ওই ছবি ওই সুর। আস্তাগফেরুল্লা, ছবি আমি দেখতে পারি না, ছবি দেখা কাফেরদের কর্ম।
আমি জানি এখন তিনটি মোবাইল কলকল ক’রে বেজে উঠবে, থামতে চাইবে না। ওগুলো আমি বন্ধ রেখেছিলাম, মোবাইলে আবর্জনা শুনে শুনে আমার কান পাচে গেছে; কিন্তু বন্ধ রাখলে আমার নেতারা, মোবারকবাদীরা, শুভার্থীরা, কংগ্ৰেচুলেশন্সীরা হৃদরোগে ভুগবে।
অনেকে সালাত আদায়ের কথা ভুলে বারডেম ইছলামি হাসপাতালে ছুটবে।
তাদের একটু দয়া করা দরকার, তাদের জন্যে আমি ওগুলো অন করি।
আজ ‘আলি দিবস’, আজ বদলে যাবে পুরোনো ইতিহাস, তা শূন্যতায় পরিণত হবে, তার সমস্ত পৃষ্ঠা আগুনে ছাই হয়ে যাবে, মহাকালের ইতিহাসগ্রন্থে লিখিত হবে একটি নতুন, চিরভম্বর, স্বর্ণীক্ষরে লিখিত পৃষ্ঠা। ইতিহাস, আমি জানি, কখনোই শাশ্বত নয়, চিরসত্য নয়; যে জয় করে ইতিহাস তার, ইতিহাস লেখে জয়ীর পরিচারকেরা, খোজা ভৃত্যরা; আমার খোজা ভৃত্যরাও নতুন ইতিহাস লিখবো। আমি শিহরণ উত্তেজনা পুলক বোধ করি, যেমন প্ৰথম ঘোড়ায় চড়ে সিন্ধুর উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময় শিহরণ বোধ করেছিলেন মুহম্মদ বিন কাশিম। তবে আমি বিজয়ের পর বিন কাশিমের মতো লুপ্ত হতে চাই না, আমি চাই না কেউ আমাকে পুরস্কার দেয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে বেহেশতে পাঠিয়ে দিক, আপতত আমি বেহেশতের থেকে পৃথিবীর জাহান্নামই পছন্দ করি; আমি অজস্র রুঞ্জিন পাখির ওড়াওড়ি দেখি, আর একটি স্বৰ্ণলতা দেখি। কোনো কিছুই চিরকাল চিরউন্নত থাকতে পারে না, তার শীর্ষ যতোই উঁচু হোক, একদিন তাকে ভেঙে পড়তে হয়; আমি সুখ পাই এক সময়ের ঘাসফুল আমি, অত্যন্ত ছোট্ট, একটু লাল একটু হলদে, কিছুক্ষণ পর ধ্বংস করবো তাকে, যে আমার থেকে অনেক বৃহৎ ছিলো।
বৃহৎকে যে ধ্বংস করে সে হয় বৃহত্তর, মহৎকে যে ধ্বংস করে সে হয় মহত্তর। আমি বৃহত্তর হতে চাই, মহত্তর হতে চাই; আমার রক্ত বলছে, ‘তুমি বৃহত্তর হও, মহত্তর হও।’ ধ্বংস না করে আমি বৃহত্তর মহত্তর হতে পারি না। ধবংস আমাকে করতেই হবে।
সবাই প্রস্তুত; আমার জিহাদিরা, ক্ষৌরকারেরা, গোলন্দাজেরা, পদাতিকেরা, এবং বিস্ফোরকবিদেরা। আমিও প্ৰস্তুত। আমি আমার ‘গোলাপ-ই-সাহারা’য় গিয়ে একবার সালাত আদায় করতে চাই; কিন্তু মোবাইল, ও মোবাইল, ও মোবাইল। নাছারারা এটি আবিষ্কার করেছে আমাকে পাগল করার জন্যে।
আমি পাগল হতে থাকি, একটির পর একটি মোবাইল আমাকে পাগল করতে থাকে :
‘আইজ হইছে তোমার শ্ৰেষ্ঠ দিন, তুমি মালাউনগো মঠ ধ্বংস কর, যেমুন লাত মানৎ উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করা হইছিল, তোমার দিকে আমরা চাইয়া রাইছি, আমাগো সারা দুনিয়ার ভাইরা চাইয়া রইছে।’
‘তোমার উপর আল্লার রহমত রাইছে, তুমি কাইল আমাগো আগাই দিছ, আইজ আরও আগাই দিবা, তুমি এইখানে পাক স্তান কায়েম করবা, ইনশাল্লা, আমরা আবার পাক সার জমিন সাদ বাদ গামু।’
‘কাফেরগো, মালাউনগো ওই মন্ড পাক স্তানে থাকব না, মড হইল শির্ক, ওইখানে অটব মছজিদ। আল্লা হাফেজ।‘
‘অ্যাডভান্স কংগ্ৰেচুলেশন্স ফর ইউ অ্যান্ড ইউর জিহাদিস, ইউর হোলি ওয়ারিয়ারস, ডেস্ট্রয় দ্যাট ব্লাডি মঠ, দ্যাট টেম্পল অব দি বাস্টার্ডস, অ্যাজ আওয়ার ফোর ফাদারাস ডেস্ট্রয়ড আলেকজান্দ্ৰিয়া, অ্যান্ড দি টেম্পলস ইন স্পেইন, ইন মহেনজোদারো, ইন ইন্ডিয়া। ইউ আর আওয়ার তারিক, আওয়ার ইখতিয়ারউদ্দিন খিলজি, আইচ্ছা আইখানে ইজ দেয়ার এনি হিল, অই মিন এনি পাহাড় লাইক জাবালুক্তারিক?’
‘হোয়াট এ পিটি, উই উইল বিন্ড এ হিল দেয়ার, ইফ ন্যাছেছারি উই উইল ইমপোর্ট এ হিল ফ্রম পাকিস্থান অর আফগানিস্থান, অ্যান্ড নেইম ইট আফটার ইউ, প্লিজ ডু কাম টু মাই প্যালেস টুমরো।’
উই মাস্ট মেইক ইট এ পাক স্তান, ওই শালা মালাউনডার গানডা বন্দ করতে আইব, মাই গোল্ডেন বেঙ্গল অই ফাক ইউ, গোল্ডেন বেঙ্গল, হা হা হা, সেইখানে আমরা সিং করবো পাক সার জমিন সাদ বাদ। হোয়াট এ গ্রেট সং, রিটেন বাই এ পারফেক্ট মুছলমান। কি জানি তার নাম, ডু ইউ রিমেমবার?’
আমি বলি, ‘আব্দুল হাফিজ জলন্ধরি।‘
‘তার বাড়িডা জানি কই আছিল?’
আমি বলি, ‘কাশ্মিরের জলন্ধর।’
‘দ্যাট ইজ হোয়াই সে এই পাক সংড়া লিকতে পারছে, উই শ্যাল মেইক হিম আওয়ার ন্যাশনাল পয়েট।‘
‘বাই দি ওয়ে সে কবে জেন নবেল প্ৰাইজ পাইছিল?’
আমি বলি, ‘পায় নি।’
‘হোয়াট? নবেল প্ৰাইজ সে ডিড নট গেট? ইট মাস্ট বি এ কন্সপিরেছি। অব দি জিয়ানিস্টস; নাউ, তারে একটা নবেল প্ৰাইজ আইন্যা দিতে হবে, উই উইল অ্যাওয়ার্ড হিম এ নবেল পুরুস্কার, ইটস মানি মাস্ট বি ওয়ান বিলিয়ন।’
‘স্যার, এ নিউ আলি আকসা উইল বি দেয়ার, আওয়ার ব্যাংক হ্যাজ স্যাংশন্ড থ্রি ক্রোরস অব টাকাস ফর দিস পারপাস, ইফ নেছেছারি উই উইল স্যাংশন থ্রি ক্রোরস মোউর; আওয়ার গার্ডিয়ান্স ইন অ্যারাবিয়া ওয়ান্ট ইট, একটা আল আকসা বানাইতেই হইব, ইউ ইউরসেল্ফ উইল রিছিভ ওয়ান মিলিয়ন ডলারস।’
‘কতল অ্যাণ্ড কিল অ্যান্ড স্লটার দি মালাউন্স অ্যান্ড দেয়ার দালালস। উই নিড এ পাক জমিন, এপাক ওয়াতান, উই লাইক টু সিং এ পাক সং— পাক সার জমিন সাদ বাদ। ক্যান ইউ প্লিজ টেল মি হোয়াট ইজ দি নেক্সট লাইন? অই ওয়ান্ট টু গেট দি হোউল সং বাই হার্ট।’
‘আওয়ার মেইন পাটিও তোমার দিকে চাইয়া আছে, আমার ডর হইতেছে তারা না আবার তোমারে মিনিস্টার কইর্যা লইয়া যায়, তয় আল্লায় তোমারে আমাগো জামাঈ জিহাদে ইছলামের জইন্যে সৃষ্টি করছেন, তোমার ওপর আল্লার রহমত আছে, আমরা তোমার দিকে চাইয়া রইছি, মিনিস্টার হইতে তোমার দেরি নাই, আমিই তোমারে বড় মিনিস্টার বানামু।’
‘দুই চাইরডারে এমুন রকমে কতল করবা যাতে কেউর বোঝানের সাইদ্য না থাকে, যেমুন কালউকা করছ। ডর ঢুকাইয়া দিবা যাইতে মালাউনরা দ্যাশ ছাইরা যায়, হেরা থাকলে দ্যাশে ইছলাম থাকব না।’
‘জিহাদিগো ছহবত করতে দিও যখন তাহাদের খায়েশ হয়, জিহাদে বন্দী আওরতের লগে ছহবতে গুনাহ্ নাই। গনিমতের মাল ভোগ করনের নিয়ম আছে। মাজেমইদ্যে ছহবত না করলে কুয়ৎ থাকে না।’
‘আমার বয়স নাই, নাইলে গনিমতের মাল আমিও দুই একটা তোমার কেছে চাইতাম, কুলুপ নিতে গিয়া ক্যান যে অইডায় ইনফেকশন অইল।’
‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম ইয়া রহমাতুল্লা বরকত হু। ইউ মে নট নো মি, বাট অই নো ইউ অ্যাজ আওয়ার গ্রেট লিডার, অই এম এ মিনিস্টার, অই হেইট দিস ব্লাডি মেইন পার্টি লেড বাই এ মাইয়ালোক, আই শ্যাল জয়েন জামাঈ জিহাদে ইছলাম সুন। উইশ ইউ অল সাকসেস, আল্লা রাহমানির রাহিম ইজ উইথ ইউ, পাক সার জমিন সাদ বাদ।’
‘স্যার, অই এম দি ভিছি অব ছিছিইউ, আমি কনছিডার ইউ গ্রেটার দ্যান ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি অ্যান্ড মুহম্মদ বিন কাশিম, রাববুল আলামিন উইল লুক আফটার ইউ, অই প্রে ফর ইউ, আল্লা দি রাহমানির রাহিম হ্যাঁজ সেন্ট ইউ টু ডেলিভার আস ফ্রম দি হ্যাঁন্ডস অব দি মালাউনস অ্যান্ড দেয়ার মুরতাদ দালালস, উই ওয়ান্ট আওয়ার পাক স্তান ব্যাক৷’
‘হেই দোস্ত, কবি আল মুদাব্বির কইতে আছি, তরে লইয়া একটা কবিতা ল্যাকাছি, এককালে ল্যাকতাম শ্রেণীসংগ্রামের কবতে, এখন লেখি সত্যের কবতে, পরম সত্যের বয়াত, আরও লিখুম :
হিরার নুরের দিকে আমাদের যে নিয়ে যাচ্ছে দিন দিন,
তার নামে কোন পাহাড়ের নাম রাখবো আমরা?
হে মরদ, হে রুস্তম, আমার ছালাম লও,
তোমার পবিত্র পাক নামে রাখবো আমরা
হিমালয় কাঞ্চনজংঘার নাম।
দুনিয়ার সব পাহাড় পর্বত দরিয়া তোমার
নামে পরিচিত হবে, তুমি ঘুচাইতেছ আমাগো লানত,
আবাবিল পক্ষি ওড়ে তোমার সহিত
তাদের চঞ্চুতে আল্লার পাথর;
তুমি ঈমানদারদের দাও হিরার জোছনা, কামর ও সুরুজ।’
তারপর আবার পাগলি হয়ে উঠতে থাকে আমার তিনটি পাগল মোবাইল :
‘স্পিকিং ফ্রম কালিফরনিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম সুইডেন…’
‘স্পিকিং ফ্রম মালয়েশিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম ইন্দোনেশিয়া…’
‘রিয়াদ থিকা বলতেছি…’
‘করাচি থিকা বলতেছি…’
‘ইসলামাবাদ থিকা বলতেছি…’
‘লন্ডন থিকা বলতেছি…’
‘দিনাজপুর থিকা বলতেছি…’, ‘চাটগাও থিকা বলতেছি।…’, ‘ছিলেট থিকা‘বলতেছি…’, ‘লালমনিরহাট থিকা বলতেছি…’, ‘মাইজদি থিকা বলতেছি…’, ‘চরমনাই থিকা বলতেছি…’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ’স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘কংগ্রেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্রেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, ‘মারহাবা, মারহাবা’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকবাদ’, …
আমি পাগল হয়ে উঠতে থাকি, কিন্তু পাগল না হ’লে কে মহাপুরুষ হয়?
একটি ফোন কি আমাকে ভুলে গেছে?
না কি এই স্পিকিং আর বলতেছির নিচে কতল হয়ে গেছে?
আমিই ফোন করি, ধরেই সে বলে, ‘হুজুর, আমি বিবিজান বলছি, আপনের মোবাইগুলির কি সব দশ মাসের পেট হইয়া রইছে? টিপতে টিপতে আমার আঙ্গুল ব্যাদনা অইয়া গেছে, আপনে না টিপ্পা দিলে আমার আঙ্গুল ভাল আইব না, আমার হাত দুইডা আহনই টিপ্পা দ্যান হুজুর।’
আমি বলি, ‘ওইগুলোকে খালাস করতে পারছিলাম না।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমি মডটার দিকে চাইয়া আপনের লগে কতা কইতে আছি, আপনে কি সত্যই আইজ মডটা গুরাইয়া হালাইবেন?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, মঠটিও চায় আমি তাকে গুড়িয়ে ফেলি।’
কণকলতা বলে, ‘এর থিকা হুজুর আপনে আমারে গুরাই হালান।’
আমি বলি, ‘দরকার হ’লে তাও করবো।’
কণকলতা বলে, ‘পারবেন, হুজুর?’
আমি বলি, ‘সময় এলে দেখা যাবে।’
কণকলতা বলে, ‘আইজই গুরাইয়া হালাইয়া মডটারে বাচাই দ্যান, হুজুর।’
আমি বলি, ‘তোমাকে গুড়ো করবো ঠোঁট দিয়ে, সেগুলো হবে সোনার গুঁড়ো, কণকচুৰ্ণ, রাখবে আমার হৃদয়ে।’
কণকলতা চুমো খেতে থাকে, আর মোবাইল হুজুরের মতো দৃঢ় হয়ে ওঠে, কাঁপতে থাকে, আমি সহ্য করতে পারি না।
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আপনের হুজুররে চুমা খাইলাম, হুজুর কি গাইল্যা পরছে? না হুজুরের আরো লাগবো? তাইলে আর পাচখান চুমা দেই।’
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর গাড়ি পাঠাবো, চ’লে এসো। একটি তাঁতের শাড়ি পরে এসো, কণকলতার মতো তাঁতের শাড়ি।’
কণকলতা বলে, ‘আইচ্ছা, হুজুর।’
‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায় তকবির’, শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও তাদের দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’ আওয়াজ তুলে আমরা কয়েক হাজার জিহাদি শ্যামসিদ্ধির দিকে এগোতে থাকি। জিহাদিদের হাতে ‘আলিগঞ্জ’-এর নিশান উড়ছে, নিশানে চানতারা ঝলমল করছে, আরবিতে ‘আল্লাহু আকবর’-এর নিশান উড়ছে।
এই নিশান দেখলেই দিল পবিত্র হয়ে ওঠে; কোনো নিশানে সূৰ্য দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না, লাল সূর্য হচ্ছে কাফেরদের, বাঁকা চানতারা হচ্ছে ঈমানদারদের। সবাই আমরা জিহাদি, সবাই আমরা অস্ত্ৰসজ্জিত–বিচিত্র রকমের অস্ত্ৰ, যদিও তা দেখা যাচ্ছে না, দরকারের সময় দেখা দেবে ও কাজ শুরু করবে, কাজের কোনো শেষ থাকবে না।
দূর থেকে আমি মঠটি দেখতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে ভয়ে মঠটি এখনই জিহাদিদের পায়ে লুটিয়ে কাঁদবে, বা ‘লাই লাহ’ বলে উঠবে; এবং আমি একটি কাতর কান্নাও শুনতে পাই, ‘এর থিকা আমারে বলি দিয়া দ্যান, হুজুর’; ওটা কিছু না, বলি দেয়ার দরকার হলে দেবো, কিন্তু ওই কাফেরি মঠ ওখানে থাকতে পারবে না। অনেক বছর ছিলো, এখন তার ধ্বংসের সময় এসেছে; খুব বেশি উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, এখন তাকে খুব নিচু হ’তে হবে, তাকে পুরোপুরি শূন্যতা হতে হবে। ওখানে একটি আল আকসা উঠবে।
একটি সেক্রেটারি ওখানে একটি পাহাড় বিল্ড করার কথা বলেছে।
ওই শ্যালকদের মগজ অত্যন্ত উর্বর, খাঁটি গোবরের মতো, কী চমৎকার প্ৰকল্প তার মাথায় এসেছে, যা আমার মাথায় কখনো আসতো না। আমরা যখন দেশকে স্তান করে তুলবো, দিকে দেকে যখন সবাই গাইবে পাক সার জমিন, তখন ওই বাঞ্চস্তকে বহনফাকারকে মাদারফ্যাকারকে একটা বড়ো প্রমোশন দিতে হবে; বাঞ্চিতটাকে না হয় আমারই সেক্রেটারি করে নেবো। ও ভালো চাকর হবে, চুষতে বললে চুষবে।
আমি দূর থেকে মঠটিকে দেখছি।
আশ্চৰ্য, ওটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের ভয় পাচ্ছে না বেতমিজটি। তাতে আমার রাগ হয়; ইচ্ছে হয় ওর বুকে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিই, ওকে বলি দিই। তবে ছুরি বা তলোয়ারে কাজ হবে না, আমাদের বিস্ফোরকবিদদের লাগবে, তারা তাদের প্রতিভায় ধবংস করবে। কাফেরদের প্রতিভা।
পেটমোটা চাকরানিফাকার অসিটা একবার সালাম দিয়ে গেলো কয়েকটা দারোগা নিয়ে, রাস্কেল ইউএনওটাও ফোন করে মোবারক বাদ জানিয়েছে, ডগপুশার ডিসিটাও; তারপরও মঠটি দাঁড়িয়ে আছে!
শ্যামসিদ্ধি ঢুকতেই প্ৰথম দেখি এটি একটি শূন্য গ্রাম, আমাদের মেইন পার্টির কিছু খিলজি ছাড়া কেউ নেই, তারা মালাউন ও মালাউনদের দালালদের গরু বাছুর হাঁস ছাগল মুরগি নিজেদের গোয়ালে নিয়ে তুলছে; ঘরবাড়ি ভাঙা বা ওগুলোতে এখনো পেট্রোল ঢালতে শুরু করে নি। কারণ এই দিনটি আমাদের, এটা আমাদের মহত্ত্বের দিন; খিলজিরা এরা মেনে নিয়েছে, ওদের দিনে যেমন ওরা জয় করে, তেমনি আমাদের দিনে আমরা জয় করি; কেউ কারো জয়ের ওপর হাত দিই না।
তবে এখন খিলজিদের সময়, ওরাই বেশি জয় করছে, ওরাই বেশি ছহবত করছে; ওরাই ঘরবাড়ি বেশি ভরে তুলছে; একদিন ওদেরগুলোও হবে আমাদের। জিহাদিরা ঘুরে দেখে কেউ নেই, ছহবত করার মতো একটি বুড়িও নেই, একটা গেলমানও নেই; আগে বুঝতে পারলে কয়েক দিন আগে থেকেই গ্রামটিকে জিহাদিদের দিয়ে ঘিরে রাখতাম।
জয়ের পর, নতুন সৃষ্টির পর, ছহবত হচ্ছে বেহেশতের রহমত।
জিহাদিরা কয়েকটি ভাঙা ঘরে আগুন লাগায়; আগুন ভালো জ্বলে না।
আমি নিজে শান্তির ঠাণ্ডা আগুন পছন্দ করি।
আমি তাদের বলে দিয়েছি আগুন লাগিয়ে স্তানের সম্পদ নষ্ট করবে না, আর দূর থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা তার ছবিও তুলতে পারে, এক-আধটি পত্রিকা তা ছাপতেও পারে; আর বাঞ্চত ওয়েবসাইট ইন্টারনেটের যুগে–আস্তাগফেরুল্লা, এইগুলিও নাছারাদের চক্রান্ত–ওই সব ছবি আজই ইহুদিদের, মালাউনদের, দেশে পৌঁছে যেতে পারে।
যা করতে হবে, তা হচ্ছে তালা ভেঙে ঢুকতে হবে, ঘরবাড়িগুলো দখল করতে হবে, আলিগঞ্জে কোনো মালাউন ও দালাল থাকবে না। জিহাদিরা দখলের কাজ ভালোই করতে পারে, তাদের রক্তে রয়েছে দখলের প্রতিভা; নইলে আরব থেকে আফ্রিকা, হিন্দুস্থান থেকে ইন্দোনেশিয়া আমরা দখল করতে পারতাম না; একদিন এই প্রতিভার গুণেই আমরা ছোট্ট এই পৃথিবীটা দখল করবো, পারলে চানতারাও দখল করবো, পারবো ইনশাল্লা।
দখলি জিহাদির দখল করতে থাকে, আর জিহাদি বৈজ্ঞানিকেরা মঠের চারদিকে তার প্যাচাতে থাকে, বিস্ফোরকের ভূপ সাজাতে থাকে, ডাইনামাইট, গ্রেনেড পাততে থাকে, একশো জিহাদি মঠ বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে রিমোট কন্ট্রোল বোমা স্তরে স্তরে গাথকে থাকে। ওদের প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করে, আমি পিস্তল কাটা রাইফেল রিভলবার ছাড়া আর কিছু চালাতে জানি না, ক্ষুরও না; বোমা বানাতে শিখি নি, একবার শিখতে গিয়ে বিস্ফোরণে আমার প্রধান ও দুই তিন নম্বরের কয়েকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, আল্লা আমাকে বাঁচিয়েছিলেন, তাই তো আমি সর্বহারা ছেড়ে জামাঈ জেহাদে আসতে পেরেছি। জিহাদিদের কুয়ৎ ও চেহারা দুটিই আমাকে মুগ্ধ করে–কুয়তে তারা সবাই সমান, চেহারায় বিপরীত। একদল জিহাদির মুখমণ্ডল সুরমা আঁকা, মুখগুলো শান্তিতে ভরা ভরা, দাড়িগুলো কালো মসৃণ রেশম দিয়ে তৈরি, কথা বলে ফেরেশতার কণ্ঠস্বরে; আরেক দলের চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে, সেখানে সব সময় আগুন জ্বলে, তাদের গাল ভাঙা, দাড়িগুলো লোহার জালের মতো, কথা বলে ঘর্ঘর করে।
তবে কাজে, ক্ষৌরকর্মে, আগুন জ্বালানোতে, বোমা নিক্ষেপে, আর শরাবে ও ছহবতে দু-দলই সমান দক্ষ: এক বোতল শরাবের পরও ফজরের সালাতের কথা ভোলে না, সারারাত ছহবতের পরও টলে না। তারা মঠে মহৎ কাজ করছে, আওয়াজ তুলছে আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিকার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হবে আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের করল করো’, ‘মুর্তাদদের কতল করো’; আর আমি দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল নীল খয়েরি হলদে সবুজ পাখি মঠের কোটির থেকে উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসতে চাচ্ছে; অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে, বাচাগুলো উড়তে পারছে না, চিৎকার করছে, অনেকগুলো গড়িয়ে নিচে প’ড়ে গেলো, পাখির রঙ আর রোদনে চারদিক সুন্দর ও সঙ্গীতমুখর হয়ে উঠতে থাকে। কে যেনো বলেছিলো আমাদের সবচেয়ে দুঃখের ভাবনাগুলোই সবচেয়ে মধুর সঙ্গীত; পাখিগুলোর ওড়াউড়ি ও মধুর রোদন শুনে এটা আমি প্রথম বুঝতে পারি, এবং হঠাৎ শুনতে পাই, ‘হুজুর, এর থিকা আমারে ভাগ দিয়ে দ্যান।’
পাখিগুলো আর মঠটির জন্যে হঠাৎ আমার কষ্ট হয়, মঠটিকে আমিও আর দেখতে পাবো না; যদি আমি আবার বালক হয়ে যাই, ঘাসফুল হয়ে যাই, বিকেলে যদি মঠটিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে, এক মাইল দৌড়ে এসে যদি দেখি মঠটি নেই, তাহলে কি আমার বুক ফেটে কান্না আসবে না? আমি কি চোখে অন্ধকার দেখবো না? আমি কি শূন্যতায় হারিয়ে যাবো না? আমার কি বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হবে? একবার আমি ‘লা হাওলা’ পড়ি, হয়তো শয়তান আমার ওপর ভর করেছে, তাই আমি মঠ দেখছি, ভবিষ্যৎ আল আকসা দেখছি না। একবার আমার মহান নেতাকে মনে পড়ে, যিনি বায়তুল মোকাররমের দিকে তর্জানি নির্দেশ করে, অনেককক্ষণ স্তব্ধ থেকে, উচ্চারণ করেছিলেন মহাবাণী’চ্ছিল-না’, তিনিই সেটিকে ‘চ্ছিল’ করেছিলেন; আমিও কি তাঁকে, মহান নেতাকে, অনুসরণ করবো?
মঠটিকে না ভেঙে এটিকে মসজিদ বানিয়ে এর মাথার ওপরের ত্রিশুলটিকে ফেলে দিয়ে উড়িয়ে দেবো ‘আল্লাহু আকবর’ নিশানটি?
না, তা আমি পারি না; এটা উঁচু, কিন্তু এর ভূমিতে বেশি জায়গা নেই, দশজনও সালাত আদায় করতে পারবে না; এর নিয়তি হচ্ছে ধ্বংস হওয়া। রাহমানির রাহিম যাকে ধ্বংস করতে চান, তাকে আমি রক্ষা করতে পারি না। কিন্তু এর আগে এটিকে আমি এতো কাছে থেকে দেখি নি, দূর থেকে এটাকে স্বপ্ন মনে হতো, কাছে থেকে তা মনে হচ্ছে না; এর ধ্বংস অনিবাৰ্য।
মোবাইল বেজে ওঠে, ‘হুজুর, আমি মডটার দিকে চাইয়া আছি, আপনে কি আমাকে দ্যাকতে পাইতেছেন?’
আমি বলি, ‘না, অতো দূর দেখা যায় না।’
কণকলতা বলে, ‘দূরে থিকাও আমি আপনেরে দেখতে পাইতেছি, মড়টার থিকাও আপনেরে উচা লাগতেছে।’
আমি বলি, ‘তুমি ভুল দেখছো।‘
কণকলতা বলে, ‘ভুল দেখছি না, হুজুর, আপনে আমার বুকের ভিতর শ্যামসিদ্ধির মডের থিকাও উচা, তাই আপনেরে দেখতে পাইতেছি, আমি যুদি আপনের বুকে অই রকম উচা থাকতাম, তাইলে আপনেও আমারে দেখতে পাইতেন, আমি ত আপনের রাইভের জিনিশ।’
আমি বলি, ‘তুমি আমার সব সময়ের।’
কণকলতা বলে, ‘হাচা কইতেছেন, হুজুর? কন, হুজুর, হাচা কইতেছেন?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ।‘
কণকলতা বলে, ‘তাইলে আর অইডা খামু না।‘
আমি বলি, ‘কী খাবে না?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, পাচ পুরিন্দা বিষ আইন্যা রাকিছিলাম, মনে করছিলাম যহন মডটা ভাইঙ্গা পরব, তখন খামু; আমি যুদি আপনের সব সোমের অই, তাইলে আর খামু না।’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি আমার জীবনলতা, মনে রেখো।’
কণকলতা বলে, ‘তাইলে দুনিয়ার সব মড ধ্বংস আইলেও আমি বিষ খামু না, হুজুর, আমি আপনের কেছে আহুম।’
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর পাজেরো যাবে, তুমি তাঁতের শাড়ি পরে আসবে, এক কৌটো সিঁদুর নিয়ে এসো।’
কণকলতা বলে, ‘আইচ্ছা, হুজুর, আমি আপনের পায়ে পইর্যা রইলাম।’
জিহাদি বৈজ্ঞানিকদের কাজ শেষ
জিহাদি বৈজ্ঞানিকদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, তারা সবাই নেমে এসেছে মঠ থেকে, আমি মঠটিকে দেখি।
জিহাদিদের প্রধান বৈজ্ঞানিক এসে বলে, ‘হুজুর, কাম শ্যাষ অইয়া গ্যাছে, অহন খালি সুইচ টিপলেই অইব, সব চুরমার অইয়া যাইব।’
আমি বলি, ‘আলহামদুলিয়া, বিছমিল্লা বলে ঠিক মতো সব করেছে তো?’
প্রধান বৈজ্ঞানিক বলে, ‘আলহামদুলিয়া, সব কাম ঠিক কইর্যা করছি; এইডা অইল আমার সবচেয়ে বড় কাম, সব ঠিক মতন করছি, যা বাসাইছি তা দিয়া পাচ দশটা টুইন টাওয়ার হালাই দেওন যায়।’
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, তোমার জন্যে আছে জান্নাতুল ফেরদাউছ।’
সে বলে, ‘অহন সুইচ মারুম, হুজুর?’
আমি বলি, ‘আলহামদুলিল্লা, আমি বড়ো সড়কে গিয়ে দাঁড়াই, সেখান থেকে আমি দেখতে চাই কাফেরের পতন, মূর্তির ধ্বংস; আমি মোবাইল করলেই তুমি সুইচ টিপবে, দেরি করবে না, আলহামদুলিল্লা।’
প্ৰধান বৈজ্ঞানিক বলে, ‘বিছমিল্লা, আলহামদুলিয়া।’
আমার বডিগার্ডদের ও মোঃ আবু লাদেনকে নিয়ে আমি আধমাইল দূরে সড়কের ওপরে গিয়ে দাঁড়াই, বেশ দেখা যাচ্ছে, হয়তো ধ্বংসের সৌন্দৰ্য আমি দেখতে চাই, হয়তো সৌন্দর্যের ধ্বংস আমি দেখতে চাই; মঠটিকে আমি শেষবারের মতো দেখি, আর দেখবো না, আমার বুক কেঁপে ওঠে, সুখে না কষ্টে আমি বুঝতে পারি না। আবছা রঙের মতো, দালির রঙের দাগের মতো, পাখিরা উড়ছে মঠটিকে ঘিরে, আমার মনে হয়। আমিই উড়ছি, কখনো মনে হয় উড়ে উড়ে পাখিগুলো খুশিতে বলছে, ‘আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা’; সবুজের ভেতর থেকে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া হে মঠ, হে পৌত্তলিকতা, হে উজ্জা, হে লাৎ, হে মানৎ, তুমি আর থাকবে না, তুমি অবিনশ্বরী নও, তুমি তুচ্ছ।
আমি আর কখনো এক মাইল দৌড়ে এসে তোমার দিকে তাকিয়ে থেকে বিকেল ও সন্ধ্যা মাথায় ও বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো না; আমি আর ঘাসফুল নাই, আমি আজ তোমার থেকে বৃহত্তর, মহত্তর; তোমার পক্ষে চিরকাল বৃহৎ মহৎ থাকা সম্ভব নয়, নতুন বৃহৎ ও মহতেরা নিয়মিতই দেখা দেয়। ধ্বংস না করে বৃহৎ মহৎ হওয়া যায় না।
পাখিগুলো পাগলের মতো উড়ছে; ওই পাখিগুলো কি তায়রান আবাবিলা? না, তাহলে তাদের মুখে প্রস্তরখণ্ড থাকতো, ওগুলোর চঞ্চু থেকে বুলেটের থেকেও প্ৰচণ্ড প্রস্তরখণ্ড পড়তো; ওগুলো শুধুই রঙ, শুধুই সুর, শুধুই ব্যৰ্থতা, শুধুই ক্ৰন্দন; কবুতর, শালিক, টিয়ে, ময়না। ওগুলো ঘাসফুলের থেকেও তুচ্ছ। আমি একবার কষ্ট বোধ করি, একবার সুখ বোধ করি। একটি বালক আমার বুকের ভেতর দিয়ে বার বার দৌড়ে আসতে থাকে, মঠটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মুগ্ধ হয়ে আবার বাড়ি ফিরে যেতে থাকে।
তবে কোনো ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হলে আমার চলবে না; আমি আর বালক নই, আমি সাম্যবাদ থেকে সর্বহাৱা থেকে জামাঈ জিহাদে ইছলাম। আমি বুকে একবার শুনি ‘আল্লাহু আকবর’, আরেকবার শুনি ‘আলহামদুলিল্লা’। আমি দেখতে পাই একটির পর একটি ভেঙে পড়ছে ধ’সে পড়ছে জাহেলিয়ার মূর্তি।
আমি মোবাইলে বলি, ‘জিহাদি মোঃ আব্দুর রহমান।’
সে বলে, ‘জি, হুজুর?’
আমি বলি, ‘আল্লার রহমতে সব ঠিক আছে?’
সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, সব ঠিক আছে, হুজুর।’
আমি বলি, ‘তাহলে বিছমিল্লা বলে সুইচ টেপো।’
সে বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’
আমি শুধু শুনি হাজার হাজার পাখির আর্তনাদ ও দেখি বিপন্ন রঙের ওড়াউড়ি; আমি এতো রঙের ওড়াউড়ি দেখবো, এতো হাহাকার শুনবো, কখনো ভাবি নি; সুরে ও সঙ্গীতে আমার বুক ভ’রে ওঠে।
সৃষ্টি করতে সময় লাগে, ধ্বংস করতে সময় লাগে না; আমার চোখের সামনে ছাই হয়ে নিচের দিকে পড়তে থাকে মঠ, আমি একবার বলি, ‘সোভানায়া, আলহামদুলিল্লা’। মঠটি পুরোপুরি প’ড়ে যাওয়ার পর, ছাই হওয়ার পর, আমি মহাশূন্যতা দেখতে পাই, একটি বালক আর কখনো এটি দেখতে এক মাইল দৌড়ে আসবে না। ওই বালকের মৃত্যু হয়েছে। দূর থেকে শুধু শুনতে পাই ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।
কিন্তু তখনো আকাশে অনেক রঙ উড়ছে, আমি দেখতে পাই, পাখিদের আর্তনাদের মধুর সুর শুনতে পাই।
অনেকগুলো পাখির বাচ্চ উড়তে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে মঠটির মতোই। জিহাদিরা সেখানে নিশানের পর নিশান উড়োচ্ছে—‘আল্লাহু আকবর’-এর নিশান, ‘আলিগঞ্জ’-এর নিশান; নিশানগুলো খুবই উঁচু বাঁশের ওপর, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে-মহাশূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পাশে ওগুলো বামনের মতো। আমি বিশাল উচ্চ মহাশূন্যতা দেখতে পাই, মনে হয় মহাশূন্যতা দাঁড়িয়ে আছে। মঠের মতো, ওখানে এখন মহাশূন্যতার মঠ; আর তাকে ঘিরে উড়ছে নানান রঙ, নানান সুর; পাখিরা উড়ছে কেঁদে কেঁদে, ওগুলো বুঝতে পারছে না কোথায় বসবে; ওগুলোর বাচ্চাগুলো যে ছাই হয়ে গেছে, তা তারা বুঝতে পারছে, পাখিরাও বোঝে। আমার বুকে একটি নিঃসঙ্গ পাখি কাঁদতে শুরু করে, আমি বুকে তার ডানার করুণ স্পর্শ বোধ করি।
মোবাইলে একটি গভীর আর্তনাদ শুনতে পাই, যেনো একটি কবুতর হাহাকার করছে, ‘আমার হুজুর, হুজুর, হুজুর, এইটা আপনে কী করলেন? আমি বিষ খামু নি, হুজুর, আমি বিষ খামু?’
আমি বলি, ‘না, তুমি সন্ধ্যায়। তাঁতের শাড়ি প’রে আসবে।’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, এইটা আপনে পারলেন? অহন আমি সকালে দুইফরে বিয়ালে কি দেহুম?’
আমি বলি, ‘আল আকসা দেখবে, সেটা হবে। আরো সুন্দর।’
কণকলতা বলে, ‘এর থিকা হুজুর আমারে বলি দিতেন।’
আমি বলি, দরকার হলে তাও দেয়া যাবে।’
কণকলতা বলে, ‘তইতেও আমি এত কষ্ট পামু না অহন যেই কষ্ট পাইলাম, হুজুর, আমি ত বলি হইয়াই গেছি, আর কি বলি দিবেন আমারে?’
আমি বলি, ‘তাঁতের শাড়ির কথা মনে আছে?’
কণকলতা বলে, ‘আছে, হুজুর, সাত রকমের সাতটা কিনছি, হুজুর।’
আমি বলি, ‘এতোগুলো কেনো?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুরের বিবি একেক দিন একেকটা পরব।’
আমি বলি, ‘তুমি অপূর্ব, কণকলতা৷’
কণকলতা বলে, ‘আমি বিবি কণকলতা।’
আমি বলি, ‘তুমি এখন কী দেখতে পাচ্ছো?’
কণকলতা বলে, ‘কিছুই দ্যাকতে পাইতেছি না, হুজুর, আমার চোক অন্দ অইয়া গ্যাছে, কিছু দেহি না।‘
আমি বলি, ‘আমি দেখছি পাখিদের রঙ, তাদের কান্না, আর মহাশূন্যতার একটি মঠ, যা আমাকে ভেদ ক’রে উঠেছে।’
জিহাদিরা আশমান জমিন কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলছে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’; আমি দেখতে পাই শুনতে পাই ‘শূন্যতা, শূন্যতা’। আমি কেনো ‘শূন্যতা, শূন্যতা’ শুনছি, আমি কি সুস্থ নই?
আমাকে এখন কিছু বলতে হবে, কিন্তু বলতে আমার ইচ্ছে করছে না, আমার বলার কিছু নেই।
মোঃ আবু লাদেন এসে বলে, ‘হুজুর, আপনের বক্তৃতা সগলে হুনতে চায়।’
আমি বলি, ‘তুমি বরং বলো।’
সে বলে, ‘নাউজুবিল্লা, আমি কি বক্তৃতা দিতে পারি? আমার কতা কেও হুনব? সাগলে আপনের কতা হোনতে চায়।’
আশমান জমিন কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠতে থাকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, কিছু কন।’
আমি বলি, ‘তুমি বলো।’
মোঃ আবু লাদের বলে, ‘নাউজুবিল্লা; হুজুর আপনের পায়ে পড়ি, আপনে কিছুকন। আপনের কতা সগলে হোনতে চায়।’
আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না; কিন্তু আমাকে বলতে হবে।
আমি বলি, ‘বিছমিল্লাহির রহমানের রাহিম। আলহামদুলিল্লা, জামাঈ জিহাদের ভাইয়েরা, তোমরা ইছলামের গৌরব, তোমরা জাতির পথপ্রদর্শক, তোমরা উম্মার অগ্রপথিক, আল্লার বরকত তোমাদের ওপর বর্ষিত হচ্ছে।‘
‘তোমরা ভৈরবকে ওমরপুর, শ্যামসিদ্ধিকে আলিগঞ্জে পরিণত করছে। তোমরা দেশকে পাক করেছো। আমরা স্তান চাই, সার জমিন সাদ বাদ চাই; সেদিকে তোমরা দেশকে এগিয়ে দিয়েছো, আলহামদুলিল্লা।‘
‘তোমরা মুহম্মদ বিন কাশিম, তোমরা তারিক, তোমরা ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বকতিয়ার খিলজি। তোমাদের নাম জামাঈ জিহাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, আলহামদুলিল্লা। তোমরা নবযুগ নিয়ে এসেছো, আইয়ামে জাহেলিয়া এখনো দুনিয়া থেকে দূর হয় নি, জাহেলিয়ার অন্ধকারে তোমরা নতুন শাম্স্।’
আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।
আমি বলি, ‘কাফেরদের এই মঠ তোমরা যেভাবে ছাইয়ে পরিণত করছে, তা হবে বিশ্ব মুছলমানের আদর্শ, আলহামদুলিল্লা। এখানে উঠবে আল আকসা; দুনিয়ায় ইছলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম থাকবে না। ’
আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’, ‘আল আকসা স্থাপন করো’, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’।
আমি বলি, ‘এই গ্রাম আজ থেকে আলিগঞ্জ, আজ থেকে এই গ্রাম তোমাদের সকলের, আলহামদুলিল্লা, এখানে কোনো মালাউন ও দালাল থাকবে না, মুরতাদ থাকবে না; যেমন উতরিব থেকে দূর করা হয়েছিলো নাছারাদের, নতুন নাম হয়েছিলো মদিনাতুন্নবি, আজ থেকে শ্যামসিদ্ধির নাম আলিগঞ্জ।’
আমি বলি, ‘এই গ্রামের প্রতিকণা মাটি, প্ৰতিবিন্দু পানি তোমাদের, তোমরা দখল করে; প্রতিটি পাতা, প্রতিটি গাছ তোমাদের, তোমরা দখল করে; এর প্রতিটি ফল, প্রতিটি শস্যকণা তোমাদের দখল করে; এর প্রতিটি মাছ, প্রতিটি মাছের পোনা তোমাদের, তোমরা দখল করে; এই গ্রামের প্রতিটি গাভী ও বাছুর তোমাদের, দখল করে; প্রতিটি গৃহ তোমাদের, দখল করো, আলহামদুলিল্লা।’
আমি বলি, ‘দখল করা নিয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে কলহ করবে না, সবাই সব কিছু সমান ভাগে ভাগ করে নেবে; এই গ্রামের মাটি তোমাদের, আশমান তোমাদের, গৃহ তোমাদের, তোমরা ভোগ করো, আলহামদুলিল্লা।’
দখল তারা অবশ্য আগেই করেছে।
কিন্তু তাদের মুখে একটা গভীর কষ্টের দাগ দেখতে পাই; তারা কাউকে কতল করতে পারে নি, এবং তার থেকেও মারাত্মক হচ্ছে যে ছহবত করার মতো কোনো হুর গ্রামে নেই। তারা ভেবেছিলো হুর পাবে, নিঃশব্দে হুরদের সঙ্গে ছহবত করবে, যেমন করেছিলো শান্তির ঠাণ্ডা আগুনের কালে।
আমি বলি, ‘ছহবত করার মতো কোনো মালাউন স্থার আজ তোমরা পাবে না, আজ তোমরা ছহবত থেকে বিরত থাকবে। বেশি ছহবতে ধাতু ক্ষয় হয়। ধাতু অতিশয় মূল্যবান, দশ সের ঘি খেলে এক ফোঁটা ধাতু উৎপন্ন হয় তোমরা বীৰ্য ধারণ করো, ছহবতের সুযোগ তোমরা পাবে, শান্তির ঠাণ্ডা আগুন দেশ ভরে জুলছে, তোমরা বীৰ্যবান হও, তোমরা শিগগিরই গনিমতের মাল পাবে, শান্তির ঠাণ্ডা আগুন তোমরাও জ্বালাবে।’
আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জালেহিদের কতল করো’, ‘মুরতাদদের কতল করো’।
আমি বলি, ‘মাদ্রাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে তোমাদের জন্য সুআহারের ব্যবস্থা আছে, তোমরা দু-দলে ভাগ হও, প্ৰথম দু-দল দ্রুত আহার করে এসো, দু-দল পাহারায় থাকো, পরে দু-দল গিয়ে দ্রুত আহার করে এসো, এবং আলিগঞ্জে নিজেদের দখল কায়েম করবে, যাতে মালাউন ও মালাউনদের দালালরা ফিরে আসতে না পারে, ইনশাল্লা তারা ফিরতে পারবে না, আলহামদুলিল্লা।’
তারা আওয়াজ তুলতে থাকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিকার, ‘নারায়ে তকবির’, ‘শ্যামসিদ্ধি হলো আলিগঞ্জ’, ‘শ্যামসিদ্ধির মঠ ধ্বংস হলো, ধ্বংস হলো’, ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম জিন্দাবাদ’, ‘মুরতাদদের কতল করো’, মালাউন ও দালালদের কতল করো’, ‘জাহেলিদের কতল করো’।
আমি এক বিশাল উচ্চ শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি; আর একটি বালক এটি দেখার জন্যে দৌড়ে আসবে না; দেখি পাখিগুলোও আর নেই, রঙ নেই, সুর নেই, এমন কি তাদের ক্রন্দন নেই।
মোঃ আবু লাদেন ও বডিগার্ডদের নিয়ে অনেক দূরে গিয়ে আমি ওই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি; একটি দীর্ঘশ্বাস আমি বুকে চেপে রাখি।
মোঃ আবু লাদেন জিজ্ঞেস করে, ‘হুজুর, ওইহানে কি আল আকসা উঠব?’
আমি বলি, ‘ইনশাল্লা, উঠবে।‘
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘তরাতরি উড়াইলে ভাল আইব, হুজুর।’
আমি বলি, ‘কেনো?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, মালাউনগো দালালরা ঘুদি আবার পাওয়ারে আহে, তাইলে মশকিল অইব, এই ঘরবাড়িগুলি ছাইর্যা দিতে অইব।
আমি বলি, ‘ইনশাল্লা, তারা আর দুই শো বছরে পাওয়ারে আসবে না, আল্লা তাদের পাওয়ারে আসতে দেবে না, তারা অভিশপ্ত।’
আমার বডিগার্ডদের ও প্রথম দু-দল নিয়ে আমি মাদ্ৰাছা-ই-মদিনাতুন্নবিতে ফিরে আসি; ফেরার সময় আমি একবার পেছনের দিকে তাকাই; একটি অতি উচ্চ শূন্যতা দেখতে পাই। এর পর, আমার মনে হয়, ওখানে শুধু আমি শূন্যতাই দেখবো, কোনো পূর্ণতা দেখবো না; কোনো রঙের ও কাকলির ওড়াউড়ি দেখবো না; একটি বালক আর ব্যাকুল হয়ে এক মাইল দৌড়ে এসে উচ্চতা দেখার জন্যে দূরের সড়কে দাঁড়াবে না।
আমার মনে হয় একটি মহাউচ্চ শূন্যতা আমার পিছে পিছে আসছে, নিশ্বাস ফেলছে আমার পেছনে, আমাকে ঠাণ্ডা হাত বাড়িয়ে ধরছে।
দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, সিলেট, যশোর, লণ্ডন, হেলসিংকি, বার্লিন, লস এঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক, সিডনি, ইসলামাবাদ, দুবাই, রিয়াদ, জেদ্দা, কাতার, করাচি, টরেণ্টো, মাইজদি, টাঙ্গাইল, ময়মনসিং, রাজশাহী, তেঁতুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, খুলনা, পাঁচবিবি, ঘাটাইল পাগল হয়ে আছে, তারা শুনছে ‘ক্যানট বি রিচ্ড্ নাউ, প্লিজ কল লেটার’; কিন্তু আমি কি লেটার তাদের রিচ করতে দেবো?
গোলাপ-ই-সাহারায় ঢুকে বিছানার ওপর আমি মোবাইলগুলো ছুঁড়ে দিই, একটি ছুটে নিচে প’ড়ে যায়; একটিকেও আমার অন্য করতে ইচ্ছে করে না। সব মোবাইল যদি মঠটির মতো ধ্বংস হয়ে যেতো আমি শান্তি পেতাম। কিন্তু শান্তি কোথায়? আমার জন্যে কি আর শান্তি আছে?
আমার মোবাইল বন্ধ, দুনিয়া নিশ্চয়ই পাগল হয়ে আছে।
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি মোঃ আবু লাদেনকে নিয়ে পাগলের মতো আমার গোলাপ-ই-সাহারায় ঢোকে।
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, আপনেরে ফোন করতে করতে পাগল অইয়া গেছি, আসনের পথে পথে ফোন করছি, ফোনের পর ফোন করছি, ধরেন নাই দেইখ্যা ডরে কাপতে আছিলাম।‘
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ডর কেনো?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘কি জানি কি অয়, বলন তা যায় না। মালাউন আর মালাউনগো দালালরা যুদি কিছু কইরা থাকে?’
আমি বলি, ‘এখন তাদের সে-সাহস নেই।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আলহামদুলিল্লা, হুজুর মোবাইলগুলি অন করেন, নেতারা নিশ্চয়ই আপনেরে চাইতেছে, না পাইলে অনেকের হার্টের রোগ বাইর্যা যাইব, ডায়াবেটিস দেহা দিব, পেশাব বাইর্যা যাইব।‘
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর অহনও আহার করেন নাই।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘এই লাদেন ভাই, হুজুরের লিগা তরাতরি আহার লইয়া আসেন, একলগে আমরা আহার করি।’
আমার সামনে মেঝের ওপর কোরবান আলি ব্যাপারি একটি বেশ বড়ো বস্তা রেখেছে, আমি জানি ওর ভেতরে কী আছে। আমি ওদিকে আবার তাকাই।
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আইজ হুজুরের অনেক পেরাশানি গেছে, তাই মনে করলাম পাচ সাতটা ব্যালাক লেভেল আর ছিবাছ রেগাল লইয়া যাই। জিহাদের পর এই জিনিশ শরীলে কুয়াৎ আনে। আর হুজুরের লগে দিনটা ছেলিবেরেট করতে সুক পামু।‘
আমার বেশ ক্ষুধা লেগেছে, খেতে হবে; আমরা তিনজন খেতে বসি।
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, আইজ আসনের সোম যা দ্যাকলাম, সোভানাল্লা, তাতে আমার দিল জুরাই গ্যাল, ঠাণ্ডা অইয়া গ্যাল দিলে আমি এত শান্তি আগে পাই নাই।‘
আমি বলি, ‘কেনো?’
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, মক্কা মদিনায় আমি তিনবার গেছি হজ করতে, দিল ঠাণ্ডা হইছে, তয় আইজ ঠাণ্ডা অইছে সব খিকা বেশি। আগে আসনের সোম পরথমই চোকে পরত কাফেরগো উচা মডটা, দেইক্যা দিলে আগুন লাইগ্যা যাইত, আইজ দেহি হেইডা নাই, দিল জুরাই গ্যাল, হুজুর আমাগো পাক স্তান, সাদ বাদ, আর ইছলামের দিকে হাজার মেইল আগাই দিলেন, আলহামদুলিল্লা, সোভানাল্লা।‘
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর আমাগো পির আওলিয়াগো সমান, হুজুরের পায়ের নিচে আমি সারাজীবন পইর্যা থাকুম।‘
আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি ও মোঃ আবু লাদেন কয়েক কেজি গরুর গোস্ত আর ভাত শেষ করে ওঠে, আমি খেতে পারি না।
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর ত কিছুই খাইলেন না।’
আমি বলি, ‘বেশ তো খেলাম।‘
খাওয়ার পর কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুর, নতুন একটা বোতল ভাঙ্গি, একটু টেইস্ট কইর্যা দ্যাহেন।‘
মোঃ আবু লাদেনের চোখমুখও উজ্জ্বল দেখায়, সেও একটু টেস্ট করতে চায়; সে ভালো জিনিশের স্বাদ পেয়েছে।
আমি বলি, ‘কোরবান আলি ছাহেব, এখন টেস্ট করতে আমার ভালো লাগছে না, আমি একটু রেস্ট নোবো।’
তারা বলে, ‘আইচ্ছা হুজুর, আপনে রেস্ট নেন, আমরা অহন যাই; আমগো ডাকলেই আমরা আসুম।‘
আমার খুব রেস্ট নেয়া দরকার, যাতে আমি ওই শূন্য স্থানটিকে দেখতে না পাই; কিন্তু আমি দেখতে পাই শূন্য স্থানে আরেকটি মঠ উঠে দাঁড়িয়ে আছে, না কি আগের মঠটিই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে? ওটি কি আসলে ভাঙা হয় নি, চুরমার হয় নি? তাহলে আমি ওটি দেখতে পাচ্ছি কেনো?
লাল নীল হলদে সবুজ পাখিগুলোকে আমি উড়তে দেখছি, তাদের অবিরাম কলকাকলি শুনছি, একটি বালক এক মাইল দূর থেকে এসে সড়কে দাঁড়িয়ে মঠটি দেখছে–এসব আমি দেখছি কেনো, শুনছি। কেনো? একবার কি আমি গিয়ে দেখে আসবো মঠটি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কি না? ওটি কি চুরমার হওয়ার পর সেই পাখিটির মতো আবার জীবন লাভ করে মেঘ ভেদ করে আকাশের দিকে উঠছে, আর উঠছে?
মোবাইলগুলো অন করি নি, কিন্তু মনে হয় প্রত্যেকটি কাঁপছে।
এগুলো অন্ন করা দরকার, অন্তত একজনের জন্যে; তবে সে হয়তো ঢুকতে পারবে না, অন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ঢুকে পড়বে।
‘তোমারে ফোনের পর ফোন করতেছি, পাইতেছিলাম না, তয় বোজতে পারছিলাম আল্লার রহমতে তুমি বিজয় কইর্যা চলতেছ, আলহামদুলিল্লা, তুমি আমাগো নকিব, তোমার পথেই দ্যাশ আগাইব।‘
‘তোমারে না পাইয়া অন্য সোর্স থিকা খবর নিছি, অছি জানাইছে আমাগো মিশন সাকসেকফুল হইছে, আলহামদুলিল্লা, তুমি ছাড়া এইডা আর কেও পারত না, আলহামদুলিল্লা।’
‘পাক সার জমিন সাদ বাদটা দুই একবার বাজাইছ নি?’
‘কংগ্ৰেচুলেশন্স, আওয়ার গ্রেট হিরো, আওয়ার কায়দ-এ-আজম, আই হ্যাভ বিন তিন ঘণ্টা ধইর্যা ট্রাই করছিলাম টু রিচ ইউ, আই হ্যাভ গ্যাদার্ড দি গ্রেট নিউজ ফ্রম দি ডিছি, দ্যাট ব্লাডি মঠ ইজ নো মোর দেয়ার। আলহামদুলিল্লা, কংগ্ৰেচুলেশন্স, লুকিং ফরোয়ার্ড টু সিইং ইউ ইন মাই প্যালেস।’
‘আই হ্যাভ অলরেডি ডিছাইডেড টু জয়েন জামাঈ জিহাদে ইছলাম, বাট অই শ্যাল কিপ মাই পোস্ট, এ মিনিস্টার কেন হেল্প দি পার্টি ইন মেনি ওয়েজ।’
‘আই হ্যাভ অলরেডি ডিছাইডেড টু বিন্ড এ হিল দেয়ার।’
‘ফোর ক্রোরস ফর আল আকসা হ্যাভ বিন স্যাংশন্ড।’
‘পাকিস্তান আর বেশি ফার না, অই ফিল ইট ইন মাই ব্লাড।’
‘অছি বলতেছি ছার…’
‘ইউএনও বলতেছি ছার…’
‘ডিসি বলতেছি ছার…’
‘এক্সিকিটিভ ইনজিনিয়ার বলতেছি ছার…’
‘ছিভিল ছারজন বলতেছি ছার…’
‘স্পিকিং ফ্রম মালয়েশিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম ইন্দোনেশিয়া…’
‘স্পিকিং ফ্রম কালিফরনিয়া…’
‘ইসলামাবাদ থিকা বলতেছি…’
‘লন্ডন থিকা বলতেছি…’
স্পিকিং ফ্রম সুইডেন…’
‘রিয়াদ থিকা বলতেছি…’
‘করাচি থিকা বলতেছি…’
‘দিনাজপুর থিকা বলতেছি’ , ‘মাইজদি থিকা বলতেছি…’, ‘চরমনাই থিকা‘বলতেছি…’, ‘চাটগাও থিকা বলতেছি…’, ‘ছিলেট থিকা বলতেছি…’ ‘লালমনির হাট থিকা বলতেছি…’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘বলতেছি’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘স্পিকিং’, ‘মোবারকবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মোবারকাবাদ’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, ‘কংগ্ৰেচুলেশন্স’, …
ওই ফোনটি আর পাই না, ওটি নিশ্চয়ই ঢুকতে পারছে না। দুনিয়ায় এতো বড়ো বড়ো পাহাড় থাকলে কী করবে একটি ‘কণাকলতা’?
আমি ফোন করে বলি, ‘কণকলতা।’
আমি বলি, ‘না, ভালো নেই।‘
কণকলতা বলে, ‘কি অইছে, হুজুর, ভাল নাই কেন?’
আমি বলি, ‘আমি এক মহাশূন্যতা দেখতে পাচ্ছি, শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
কণকলতা বলে, ‘আমি আছি, হুজুর, আপনেরে ভাইর্যা দিমু। আপনেরো ভইর্যা দেওনের লিগা আমি বইস্যা আছি।’
আমি বলি, ‘আমি হয়তো বাঁচবো না।‘
কণকলতা হাহাকার করে ওঠে, ‘তাইলে আমিও বাচুম না, হুজুর। ‘
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর চ’লে এসো, তাঁতের শাড়ি প’রে।’
কণকলতা বলে, ‘হেই কতা কি আমি ভোলতে পারি, হুজুর? আপনার বিবি কণকলতা আসনের লিগা পাগল অইয়া রইছে।‘
আমি একটু পান করি, সাদ বাদ গানটা বাজিয়ে শুনি।
শোনার সময় আমি মহাশূন্যতা দেখতে পাই, হঠাৎ লাথি মেরে প্লেয়ারটাকে উল্টে ফেলে দিই, গানটা ছাছ্যাছা ক’রে বন্ধ হয়; একটি বালকের জন্যে, অজস্র পাখির রঙ ও সুরের জন্যে আমার কষ্ট হয়, আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি কাঁদতে পারি না, কী ক’রে কাঁদতে হয় আমি ভুলে গেছি।
ওই মঠটি কি এখনো ওখানে আছে, ওটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো?
আমি মোঃ আবু লাদেনকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, ‘মোঃ আবু লাদেন, মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো? না কি ওটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, অহন অইডার একটা ইডও নাই, সব কিছু ধুলা অইয়া গেছে।‘
আমি বলি, ‘তাহলে ওখানে কী আছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কিছু নাই, হুজুর, সব খালি, রাহমানির রাহিম আল্লার আশমান ছাড়া আর কিছু নাই।’
আমি বলি, ‘আশমান চুরমার হয়ে যায় নি তো?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আশমান চুরমার অইব ক্যান?’
আমি বলি, ‘হতে পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, অইহানে তা আমরা বোমা মারি নাই; আর আল্লার আশমান চুরমার অইতে পারে না।’
আমি বলি, ‘তাহলে কোথায় মেরেছো?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আপনে ত দ্যাকছেনই, মডে মারছি, কতগুলি বমা আর গ্রেনাইড মারল হেরা।‘
আমি বলি, ‘মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, গুরা অইয়া গ্যাছে।’
আমি বলি, ‘তুমি গিয়ে একটু দেখো তো মঠটি ওখানে আছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন তাজ্জব হয়, এতোটা তাজ্জব সে জীবনে কখনো হয় নি; সে তার দুটি ভোতা চোখ মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, ‘তুমি যাও, গিয়ে দেখো মঠটি আছে কি না? চুরমার হয়েছে কি না? ধবংস হয়ে কি না? গিয়ে আমাকে কল করো।’
মোঃ আবু লাদেন ছুটে যায়, কিছুক্ষণ পরই মোবাইলে শুনি, ‘হুজুর, এইহানে অহন কোনো মড নাই, জিহাদিরা একটা মছিদ তোলছে, আলহামদুলিল্লা।‘
আমি বলি, ‘খেয়াল রেখে ওখানে যেনো মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ মাথা তুলে না। ওঠে, দিনরাত পাহারা দিও।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, মাডির তল থিকা কি মড ওটতে পারে?’
আমি বলি, ‘পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, পারে না; খালি রাহমানির রাহিম চাইলে পারে। ‘
আমি বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তুমি ঠিক জানো যে মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ উঠতে পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আমরা পাহারা দিতে আছি, আপনে একটুও চিন্তা কইরেন না, আমরা খাড়া আছি, আমুন কোনো মন্ড ওটলে ওডনের সোমাই চুরমার কইর্যা হলাম, আলহামদুলিল্লা!’
আমি বলি, ‘দ্যাখো তো অন্য কোনো দিকে কোনো মঠ উঠছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, কোনো দিকই ওটছে না।’
আমি বলি, ‘দ্যাখো তো, অনেক দূরে একটি বালক মঠের দিকে তাকিয়ে আছে কি না? মঠ না দেখে সে কাঁদছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, দূরে কোনো পোলাপান নাই; যে-দুই চাইরজন আছে, তারা কাছেই আছে, হাসাহসি করতেছে।’
আমি বলি, ‘তুমি দূরের রাস্তায় গিয়ে দ্যাখো কোনো বালক একলা দাঁড়িয়ে আছে কি না? সেখান থেকে আমাকে কল করো।’
কিছুক্ষণ পর মোঃ আবু লাদেন কল করে, ‘হুজুর, রাস্তায় কোনো পোলা নাই, তয় দূরে মালাউন বাড়ির একটা মাইয়া এই দিকে চাইয়া রইছে। তারে ধইর্যা লইয়া আহুম নি, হুজুর?’
আমি বলি, ‘না; তুমি গিয়ে সালাত আদায় করো।’
একটু ঘুম এসেছিলো হয়তো, একটা মধুর স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম।
স্বপ্নের বদলে আমি বিভীষিকা দেখতে শুরু করি।–ধারাবাহিক, পথে পথে বিভীষিকা, দেখি আমি আগুন লাগিয়ে চলছি গ্রামের পর গ্রামে, সেই আগুন নরকের আগুনের থেকেও প্ৰচণ্ড, শহরের পর শহরে, সমস্ত ধানখেতে, পাটখেতে, সরষেখেতে, শিউলিগাছে আগুন জ্বলছে, গন্ধরাজে আগুন জ্বলিছে; ছুটে চলছে আমার জামাঈ জিহাদে ইছলামের জিহাদিরা; তারা দখলের পর দখল করছে, চুরমার করছে, কতল করছে, আওয়াজ তুলছে আকাশ দীর্ণজীৰ্ণ করে; টেনে এনে ছহবতের পর ছহবত করে চলছে ঘরে, আঙ্গিনায়, রাস্তায়, মাঠে, ইস্কুলের পথে; আমি আর জামাঈ জিহাদিরা আগুন লাগাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদ্যালয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, লাল সূর্যের পতাকায়, গেয়ে চলছি। পাক সার জমিন সাদ বাদ, আর গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, পুকুরে মাছ মরে ভেসে উঠছে, নারীরা মৃত সন্তান প্রসব করছে, আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে, পাখিরা লুটিয়ে পড়েছে; রক্তে ভিজে উঠছে মাটি, পুকুরে পানির বদলে রক্ত, নদীতে রক্তের ঢেউ, আকাশ থেকে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে, গাভীদের ওল্যান থেকে রক্ত ঝরছে; কবিতা থেকে রক্ত করছে, সব নর্তকী খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে, চিত্রকরের আঙুলে কুষ্টরোগ দেখা দিচ্ছে।
আমি দেখি আমার দেশ জেনায়–জেনায়–জেনায়–মূৰ্ছিতা হয়ে রাস্তার পাশে প’ড়ে আছে।
তার নাম পাক স্তান; তার গান পাক সার জমিন সাদ বাদ।
ভয়ে আমি চিৎকার ক’রে উঠি, আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বাইরে আমার বডিগার্ডরাও আমার চিৎকার শুনতে পায়।
একজন নক ক’রে বলে, ‘হুজুর, কি অইছে আপনের?’
আমি বলি, ‘আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারি ও মোঃ আবু লাদেনকে খবর দাও, তাদের আসতে বলো।’
আমি মুখহাত ধুয়ে নতুন পাজামাপাঞ্জাবি পরি, বিভীষিকা কাটিয়ে উঠি।
কোরবান আলি ব্যাপারি এসে বলে, ‘হুজুর, আপনের ডাকের লিগাই পাগলের মতন ওয়েট করছিলাম, আপনের লগে একটু ড্রিংক কইর্যা ধইন্য হইয়া তারপর ঢাকা যামু, আটটার মইদ্যে যাইতে অইব।‘
আমি মোঃ আবু লাদেনকে বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তিনটি গেলাশে হুইস্কি ঢালো, বেশি ক’রে ঢালো, খুব বেশি ক’রে।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘ঢালি, হুজুর।’
সে এখন বেশ ঢালিতে শিখেছে, ঠাণ্ডা পানিও ঠিক মতো মেশাতে শিখেছে।
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হুজুরের লগে ড্রিংক করনের সুকই আলাদা, অনেকের লগে করছি, সোনারগাঁও করছি, ব্যাংকক করছি, দুবাই করছি, সিঙ্গাপুর করছি, নিউ ইয়র্ক করছি, আটলান্টিক ছিটিতে তাজমহল কেছিনোয় করছি, এমুন কি সৈদি আরবের ফাইভ স্টারেও করছি, তায় হুজুরের লগে ড্রিংক করলে মনে অয় জান্নাতে বইস্যা খাইতে আছি; আর আইজ ত আমাগো ভিকটরি ডে, দিলডা সুকে ভইরা আছে, হেইডা ছেরিবেরেট করনের সুকই আলাদা।’
আমি বলি, ‘বেগম লায়লাতুন কদর কেমন আছেন?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে আবার কেমুনি থাকিব? প্যাড উচা কইর্যা চিৎ অইয়া হুইয়া রইছে, তার ত অই বিজিনেছ।’
আমি বলি, ‘আপনি তাঁকে বিজি রাখলে তিনি আর কী করবেন?’
তিনি বলেন, ‘আল্লায় বীজ দিছেন, মাডিতে বীজ পরলে চারা ত অইবই; আর আমি ভিজা মাডিতে বীজ বোনতেই পছন্দ করি।‘
আমি বলি, ‘আর আপনার গার্মেন্টসের সুন্দরীরা?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘তাগো লিগাই তা টিকা আছি; হেরা শিলাই পছন্দ করে, কচি জিনিশ ত, মাজেমইদ্যে শিলাই করি। বিবিরে দিয়া ত অহন কাম আয় না। তয় আলহামদুলিল্লা, হের প্যাড থিকা খালি পোলা বাইর অয়, একটা মাইয়া বাইর হয় না, সোভানাল্লা।‘
আমি বলি, ‘আপনার বুড়ো ছেলে মুহাইমেন বিন কোরবান কেমন আছে?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘অই শালার পুত অখন আমার থিকাও ভাল আছে, মাসে গার্মেন্টসের ৩০টা মাইয়ার প্যাট বানায়, একবার ব্যাংকক না গেলে তার সুক অয় না, তয় আল্লারছুলরে ভোলে নাই, এজতেমায় যায়, হজে যায়, আর বিজিনেছ বোঝে ভাল, সোনা আইন্যাই মাসে কয়েক কোটি বানায়। অর বাড়িতে কাস্টমসের কর্তারা পইরা থাকে, অরো ‘ছার’ কয়।’
আমি বলি, ‘তাকে নিয়ে আপনি গর্ব করতে পারেন।‘
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হ, শালার পুতরে দেখাইয়াই একদিন আমার চলতে অইব, অখন অর ৩০টা মাইয়ার প্যাট ছাপের কাম আমার করতে অয়।’
আমি বলি, ‘আপনার দুই নম্বর ছেলে জিল্লুর বিন কোরবান?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে ত অল্প বয়সেই পাইক্কা গ্যাছে, প্যাট বানান হেও শিখছে, মাসে মাসেই বানায়।’
আমি বলি, ‘বেশ তো।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘ওই শালার পো আবর কয় ডিগ্রি ওপরে, গার্মেণ্টেসের দুইটা মাইয়ারে আমি টার্গেট কইর্যা রাকছিলাম, তার আগে হে নিয়া প্যাট বানাইছে। কাম করে না, মাসে মাসে দশ লাক নেয়। অখন একটা মডেলরে প্যাট বানাইছে, অর থিকা ১০ বছরের বড়, কয় তারে বিয়া করব।’
আমি বলি, ‘সে বেশ সৎ মনে হয়।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘বিয়া করনের কি দরকার? প্যাট ত আর কত বানাইবা, সব গুনিয়ে বিয়া করতে পারব?’
আমি বলি, ‘একবার করে দেখুক না।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মডেলডার আগের ঘরের আবার একটা মাইয়া আছে, হেরেও আনতে অইব।’
আমি বলি, ‘ধর্মকর্মে মতি আছে তো?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মাসাল্লা, সেইতে মন আছে, সালাত ভোলে না, এস্তেমা ভোলে না।’
আমি বলি, ‘আপনার বড়ো বিবি?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হে ত আর আমার বিবি না, তারে ত তালাক দিছি। হুনি হেও আহন মাসে মাসে ব্যাংকক সিঙ্গাপুর যায়, হে মডান অইয়া গেছে, বোরকা হিজাব ছাইর্যা দিছে, কাস্টমসের একটা কালেক্টর না কি তার পাটনার আর বয়ফ্রেণ্ড।‘
আমি বলি, ‘আপনার কেমন লাগে?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘মনে আইলে একটু খারাপ লাগে। আমার এক সোমের বিবি অন্যের লগে হুইছে ভাবলে আমি তিনডার লগে হুই।’
কোরবান আলি ব্যাপারি ঢকঢক ক’রে তিন গেলাশ কয়েক মিনিটে শেষ ক’রে দেয়, আরো দুই গেলাশ নিয়ে বসে।
মোঃ আবু লাদেনকে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্ল্যাক লেবেল কেমন লাগছে?’
সে বলে, ‘হুজুর, এইডার তুলনা নাই, নাছারারা যে কি জিনিশ বানায়, কি কিতাব পইর্যা যে নাছারারা এই জিনিশ বানায়!’
সেও কয়েক গেলাশ শেষ করেছে, একটু কাঁপছে।
আমি বলি, ‘ওই বস্তায় পাঁচটি বোতল আছে, তুমি নিয়ে যেও।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘আপনের রহমতের কতা কোন দিন ভুলুম না, হুজুর, আপনের পায়ে পইরা থাকুম।’
রাত আটটা বেজে এসেছে, পাজেরোও গেছে, আমি জানি এখনই কণকলতা আসবে, সে দেরি করবে না।
বোরখা পরে কণকলতা এসে ঢোকে, এসে পায়ে সালাম করে, তার মুখ ঢাকা। আমি জানি সে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো, চুমো খেতে চেয়েছিলো; কিন্তু এদের দেখে মুখ ঢেকেছে।
মোঃ আবু লাদেন ও আলহজ কোরবান আলি ব্যাপারির সঙ্গে কণকলতার পরিচয় করিয়ে দিই: বলি, ‘আমার বিবিজান।’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘আলহামদুলিল্লা।’
আমি বলি, ‘বিবিজান, তোমার মুখটি দেখতে দাও।’
কণকলতা মুখ থেকে ঢাকনা সরাতেই একটি পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দেয়।
কোরবান আলি ব্যাপারি দিল থেকে বলে ওঠে, ‘সোভানাল্লা, আলহামদুলিল্লা, মারহাবা, মাশাল্লা, আল্লায় হুজুররে বেহেশতের নারী দান করছেন, যে আল্লার কাম করে আল্লা তারে উপযুক্ত পুরুস্কার দেয়।’
আমি বলি, ‘আপনি ঢাকা যাবেন না?’
কোরবান আলি ব্যাপারি বলে, ‘হ, সময় অইয়া গেছে, চলেন আবু লাদেন ভাই, আমরা যাই, হুজুর বিবির লগে একটু মহব্বত করেন; জিহাদের পর হুজুরের একটু মহব্বত দরকার।’
সবুজের মাঝখানে একটি লাল টকটকে সূর্য উঠছে (শেষ)
তারা চলে গেলে কণকলতা আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে খেতে বলে, ‘হুজুর, আইজ আমার সুখের সীমা নাই, আপনে আমারে বিবিজান বলছেন।’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি আমার বউ, বউমণি।’
কণকলতা হঠাৎ আমার পায়ে পড়ে একই সঙ্গে সালাম ও নমস্কার করে।
আমি বলি, ‘তুমি এ কী করছো?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, আমি আপনার বউ, শুধু চুমো খেলে আমার মন ভারতো না, ওখানে পড়ে মন ভরে উঠলো, আপনার ঠোঁটে চুমো খেয়ে যে-সুখ পেয়েছি পায়ে চুমো খেয়ে তার থেকে বেশি সুখ পেলাম।’
আমি বলি, ‘কেনো?’
কণকলতা বলে, ‘এতো দিন ভাবতাম আমি হুজুরের রাতের জিনিশ, আজ দেখলাম আমি হুজুরের হৃদয়ের, আমার সুখের শেষ নেই। আমি আমার সুখ প্রকাশ করলাম।‘
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি এ কোন ভাষা বলছো?’
কণকলতা বলে, ‘হুজুর, এ-ভাষা বলতেই আমি ভালোবাসি, যেমন হুজুরকে ভালোবাসি, তবে গ্রামের ভাষাও আমার ভালো লাগে।‘
আমি বলি, ‘আমি আর হুজুর নই।’
কণকলতা বলে, ‘তাহলে কী?’
আমি বলি, ‘তোমার পতিমণি।‘
আমি কণকলতার দিকে, তাঁতের সুগন্ধি রঙিন শাড়ির দিকে, চিবুকের দিকে, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেনো এই প্রথম আমি তাকে দেখলাম, প্রথম বিস্ময় দেখলাম; যেনো আমি স্বপ্ন দেখছি, আমার দুঃস্বপ্ন কেটে গেছে, চারদিকের আগুন ও রক্তপাত বন্ধ হয়ে গেছে। পাখিগুলোর রঙ আমি দেখতে পাই কণকলতার শাড়িতে, কলকাকলি শুনতে পাই মুখমণ্ডলে।
আমি তাকিয়ে থাকি, তাকে জড়িয়ে ধরি না, চুমো খাই না।
কণকলতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কী হয়েছে, পতিমণি?’
আমি বলি, ‘কিছু তো হয় নি।’
কণকলতা বলে, ‘হয়েছে। তুমি শুধু আমাকে দেখছো; জড়িয়ে ধরছো না, চুমো খাচ্ছো না, আর…’
আমি বলি, ‘এখানে আমরা আর আমাদের জড়িয়ে ধরবো না, চুমো খাবো না, এখানে আমরা আর নগ্ন হবে না, সঙ্গম করবো না।’
কণকলতা বলে, ‘তাহলে কোথায়?’
আমি বলি, ‘তা আমি ঠিক জানি না; তবে এখানে নয়, এই নরকে নয়।’
কণকলতা বলে, ‘কেনো?’
আমি বলি, ‘এই নরক আমাকে ময়লা করে ফেলেছে, দূষিত ক’রে ফেলেছে, এই নরকে আমি বাঁচবো না; আমি হয়তো বাঁচবো না, তারা হয়তো আমাকে বাঁচতে দেবে না, তবে এই নরকে আর নয়।’
কণকলতা বলে, ‘তুমি বাঁচবে, আমিও বাঁচবো, তুমি না বাঁচলে আমিও বাঁচবো না, পতিমণি। আমাকে জড়িয়ে ধরো, ভালোবাসো।’
আমি জড়িয়ে ধ’রে তার কপালে চুমো খাই; কণকলতা আমার বাহুতে স্বৰ্ণলতার মতো জড়িয়ে থাকে, কোমলতার সুগন্ধে আমি ভ’রে উঠি।
আমি বলি, ‘এখান থেকে আমরা চলে যাবো।’
কণকলতা বলে, ‘কখন, পতিমণি?’
আমি বলি, ‘কিছুক্ষণ পরেই।’
আমার সম্পদ কম নয়, সম্পদে আমি ভ’রে উঠেছিলাম, আর শূন্য হয়ে উঠছিলাম; এগুলো কি আমি নেবো?
আলমারিতে বান্ডিলে তিরিশ লাখ টাকা আছে, এটা খুবই দরকার, জানি না কোথায় থাকবে; ড্রয়ারে বিশ বার সোনা আছে, এগুলোও আমার দরকার, জানি না কীভাবে বাঁচবো; তিনটি মোবাইল আছে–এগুলোও দরকার; আর আছে ১০ বোতল ব্ল্যাক লেবেল, ৮ বোতল সিভাস রিগ্যাল, ৩ কার্টন কিংফিশার, ৫ কার্টন টাইগার, ৫০০ ক্যাসেট পাক জমিন সাদ বাদ, হিতাচি সিডি প্লেয়ার, এলজি ফ্ল্যাট টিভি, আমার এগুলোর কোনো দরকার নেই; আর আছে এক সময়ের বান্ধবতম প্ৰিয়তমারা–৩টি পিস্তল, ৫টি রিভলবার, ৮টি কাটা রাইফেল, ২০টি এক্সএক্সএক্স, রাশিরাশি সালোয়ার পাজামাপাঞ্জাবি, আরো কতো কী।
এগুলো আমি নেবো?
আমি সিডি প্লেয়ারে সাদ বাদ ক্যাসেটটি একবার চালাই, একটু শোনার পরই লাথি মেরে প্লেয়ারটিকে চুরমার করে ফেলি; লাথি মেরে মেরে আরো কয়েকটি ক্যাসেট চুরমার করি। আমার মনে হয় আগুন নিভে যাচ্ছে, রক্তপাত থেমে যাচ্ছে। এসব আমি নেবো না; কিন্তু কিছু কি নেবো না? আমি সুটকেসে টাকাগুলো রাখি, সোনার বারগুলো রাখি, মোবাইলগুলো কণকলতার হাতে দিই। কয়েকটি ব্যাগে ভরি ব্ল্যাক লেবেল, প্ৰায় ৫০০ ক্যাসেট পাক জমিন সাদ বাদ, এক্সএক্সএক্স, পিস্তল, রিভলবার, কাটা রাইফেল।
কণকলতাকে বলি, ‘চলে যাই।’
কণকলতা বলে, ‘চলো।’
তখন মধ্যরাত; আমি বডিগার্ডদের ডাকি; বলি জিনিশপত্ৰ পাজেরোতে তুলে দিতে, তারা তুলে দেয়। আমি ঘরে তালা লাগাই। ড্রাইভার চলে গেছে, আমিই চালাবো।
আমি ড্রাইভারের সিটে বসি, কণকলতা বসে আমার বাঁ পাশে।
এক বডিগার্ড জিজ্ঞেস করে, ‘হুজুর, আমরা উডুম?’
আমি বলি, ‘না, তোমাদের লাগবে না।’
আমি গাড়ি স্টার্ট দিই; কণকলতাকে বলি তার বোরখা খুলে ফেলতে।
আমি চালাতে থাকি, কণকলতার তাঁতের শাড়ি ও শরীরের সুগন্ধ পাই, বহু দিন পর আমি অমল বাতাসে নিশ্বাস নিই। গাড়িটি ব্রিজে উঠতেই নদীতে ছুড়ে ফেলে দিই ব্ল্যাক লেবেলের সিভাস রিগ্যালের বোতলগুলো, পাক জমিন সাদ বাদের ক্যাসেটগুলো, এক্সএক্সএক্সগুলো, পিস্তল, রিভলবার, কাটা রাইফেলগুলো।
ওগুলোর আমার আর দরকার নেই; আমাকে যারা খুঁজবে, ওগুলো তাদের দরকার হবে।
কণকলতাকে বলি, ‘তোমার বোরখাটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।’
বোরখাটা অন্ধকারের থেকে কালো, ওটি অন্ধকারে মিশে যায়।
অন্ধকার, কিন্তু অন্ধকারে আমি আলো দেখতে পাই, গাড়ি চলতে থাকে।
কণকলতাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কণকলতা বলে, ‘ওই আমাদের বাড়ি।’
আমি বলি, ‘কণকলতা, তুমি তোমাদের বাড়িতে ফোন করো।’
কণকলতা ফোন ক’রেই বলে, ‘মা, আমি কণকলতা।’
ওর মা বলে, ‘কণকলতা, তুই কোন হানে?’
কণকলতা বলে, ;’মা, আমি আমাগো বাড়ির পাশ দিয়া তোমাগো জামাইয়ের লগে যাইতে আছি।‘
ওর মা বলে, ‘জামাইরা লাগে? জামাই কে?’
কণকলতা বলে, ‘মা, তুমি কতা কও জামাইর লগে।’
আমি ফোন নিয়ে বলি, ‘আদাব।’
ওর মা বলে, ‘অ, আপনে হুজুরে আমার কণকরে বিয়া করছেন?’
আমি বলি, ‘আমি আর হুজুর নই। কণকলতা আমার বউ। ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, চিন্তা করবেন না।’
ওর মা বলে, ‘কই লইয়া যাইতে আছেন?’
আমি বলি, ‘তা ঠিক জানি না।’
ওর মা বলে, ‘জামাই, কণকরে আমি ভগবানের নামে আল্লার নামে আপনের হাতে দিলাম, অরে আপনে দেইক্যা রাইক্যেন, ও আমার পুন্যিমার চান।‘
আমি বলি, ‘কণকলতাকে আমাকে কণকলতার নামেই দিন, আর কারো নাম লাগবে না, কণকলতা আমার কাছে পূর্ণিমার চাঁদের থেকেও বেশি।
কণকলতা আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, ‘মা, আমার লিগা চিন্তা কইরো না, আমি ভাল থাকুম, তোমার জামাই বাচলে আমি বাচুম।’
ওর মা বলে, ‘তোমরা বাইচ্যা থাকে।’
অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে, আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি, কিন্তু আমি যাচ্ছি, নরক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, এতেই আমি সুখ পাচ্ছি; আমার পাশে, আমার সঙ্গে, কণকলতা–আমার চারপাশে সবুজ বাঙলাদেশ। অন্ধকারে দু-পাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার ডানে সবুজ, আমার বাঁয়ে সবুজ, আর কণকলতা; একটি নদীর ওপর দিয়ে চলছি, তার নাম জানি না, নামটি আমার জানতে ইচ্ছে করে, হয়তো তার নাম স্বপ্নমতি, বা স্বপ্নেশ্বরী, ব্রিজটাকে আমার খুব আপন মনে হয়, এটি আমাকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, নদীটিকে মনে হয় আমার হৃদয়ের মতো, কণকলতার কোমল দেহখানির মতো; কণকলতাকে বলি, ‘তুমি ডান হাতটি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে রাখো’, কণকলতা আমাকে জড়িয়ে রাখে কোমল স্বৰ্ণলতা দিয়ে; আমাকে অনেক দূরে যেতে হবে, জানি না কোথায়, ওরা আমাকে খুঁজবে, আমাকে হয়তো বাঁচতে দেবে না, তবু আমি আর ওদের হিংস্রতার নই, পিস্তলের নই, কাটা রাইফেলের নই, ক্ষুরের নই; আমি আর জামাঈর নই; গাড়ি এঁকেবেঁকে চলছে, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি সবুজ খেত, রুপোলি নদী, আকাশে অষ্টাদশীর চাঁদ, আমি দেখতে পাচ্ছি বাঁশবন, হিজলগাছ, শিমুলগাছ, জলের দিঘি, হয়তো তাতে ফুটে আছে লালপদ্ম, শ্বেতপদ্ম, হয়তো শাপলা-পদ্ম, তোমরা ফুটে থাকো, শাপলা, তুমি ফুটে থাকো; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, এতো সুখ। কখনো পাবো, জীবনেও ভাবি নি, সুখে আমার ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে’; আমি বলি, ‘সুখে আমার বেঁচে উঠতে ইচ্ছে করছে, কণকলতা; আমি কণকলতার তাঁতের শাড়ির সুগন্ধ পাচ্ছি, অবর্ণনীয় একটি সুগন্ধ, মা যখন নতুন তাঁতের শাড়ি পরতো, তখন যে-গন্ধ পেতাম, সে-সুগন্ধ আমি পেতে থাকি, বহুদিন পর সে-সুগন্ধ দিচ্ছে আমাকে কণকলতা; আমি বলি, ‘বউমণি, তোমার শাড়িটির আঁচল আমার নাকের কাছে ধরো, এটির সুগন্ধ আমাকে বাঁচিয়ে তুলছে, কণকলতা আচলটি তার সুগন্ধি হাতে আমার নাকের কাছে ধরে, আমি সুগন্ধে ভ’রে উঠি; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, তুমি আমার হাতের আমার হাতের তালু আর আঙুল আজ দেখো নি, অন্ধকারে এখন দেখতে পাবে না, একবার আমার হাতের তালুর সুগন্ধ নিয়ে বলো দেখি কিসের গন্ধ; কণকলতা তার দু-হাতের তালু আমার নাকের ওপর রক্তপদ্মের মতো রাখে, অন্ধকারেও আমি তার হাতের রঙ দেখতে পাই, সুগন্ধে আমার বুক ভরে ওঠে; কণকলতা বলে, ‘পতিমণি, আমি জানতাম আজ আমি তোমার বউমণি হবো, তোমার বউমণি হওয়ার জন্যেই আমি জন্মেছি, তাই হাতে মেহেদি মেখেছি, কাল দেখবে হলুদের রঙে আমার শরীর কেমন সোনা হয়ে আছে, পতিমণিকে বরণ ক’রে নেয়ার জন্যে আমি সব করেছি, নিজেকে আমি কণকলতা ক’রে তুলেছি’; আমি বলি আমি বলি, ‘এক কোটো সিঁদুরও নিয়ে এলে ভালো হতো, বউমণি’; কণকলতা হেসে বলে, ‘তাও নিয়ে এসেছি, পতিমণি, তুমি বিছমিল্লা বলে আমাকে সিঁদুর পরিয়ে দেবে, কপাল থেকে সিঁথির ওপাশ পর্যন্ত’; আমি গাড়ি চালিয়ে চলেছি, নদী, মাঠ, খেত পেরিয়ে যাচ্ছি, দু-দিকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি আমার সোনার বাঙলাকে, আমার বা পাশে আমার কণকলতা, আমাদের চারদিকে আমার সোনার বাঙলা; কণকলতা বলে, ‘চারপাশ কী সবুজ; আমি বলি, ‘অন্ধকারেও তুমি সবুজ দেখতে পাচ্ছো’; কণকলতা বলে, ‘পাতিমণি, তুমিও সবুজ দেখতে পাচ্ছো’; তখন ভোর হয়ে এসেছে, এক অরণ্যের পাশে সমুদ্রতীরে আমি গাড়ি থামাই, কণকলতাকে বুকে ক’রে নামাই, সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেদের জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে খেতে দেখি সমুদ্রের ভেতর থেকে সবুজের মাঝখানে একটি লাল টকটকে সূর্য উঠছে।
(সমাপ্ত)