একদিন আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা আজকাল এতো দেরি করেন কেনো?
মা বলে, তার কাজ বেড়ে গেছে।
আমি বলি, কেনো কাজ বেড়ে গেছে?
মা বলে, তুই বুঝবি না।
তখন আমাকে বড়োরা মাঝেমাঝেই বলতো, তুই বুঝবি না, শুনে আমার সুখ লাগতো না; অনেক দুরূহ উত্তর পাওয়া খুব জরুরি মনে হতো, আমি জানতে চাইতাম, তারা বলতো, তুই বুঝবি না; শুনে আমি চুপ করে যেতাম, কিন্তু মার কাছে চুপ করে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয় মা যা বুঝতে পারে আমিও তা পারবো। আমার তো মনে হতো মা-ই অনেক কিছু বুঝতে পারে না; তার বুঝতে সময় লাগে, কিন্তু আমি তার আগে বুঝে ফেলি।
আমি বলি, তুমি আমাকে বলল, দেখো আমি বুঝবো; আমি সব বুঝতে পারি।
মা একটু চুপ করে থেকে বলে, আসলে কাজ বাড়ে নি, কাজ আর কী বাড়বে; ঘরে ফিরতে তার ভালো লাগে না।
আমি বলি, কেনো ভালো লাগে না?
মা কোনো কথা বলে না। মাকে নিয়ে বেশ অসুবিধা হচ্ছে আজকাল; সহজে উত্তর দেয় না, চুপ করে থাকে।
আমি আবার জানতে চাই, কেনো ভালো লাগে না?
আমার ভয় হতে থাকে মা আবার বলবে, তুই বুঝবি না; মা তা বলে না; তবে এমন কথা বলে যে আমি ভয় পাই।
মা বলে, তোর বাবা তো তোর মতোই। আমি কুৎসিত হয়ে গেছি, আমাকে দেখতে যেমন তোর ভালো লাগে না, তোর বাবারও ভালো লাগে না। তাই দেরি করে ফিরে।
মার কথা শুনে আমি কেঁপে উঠি, একটা কষ্ট আমার মাথার ভেতর দিয়ে ঢুকে পা পর্যন্ত এসে গমগম করে ওঠে; আমার পায়ের নিচের মাটি আর মাথার ওপরের আকাশ ভেঙেচুরে যেতে থাকে। আমি মনে মনে বলতে থাকি-মা, তোমাকে আর কুৎসিত বলবো না, তোমাকে দেখতে আমার আর কুৎসিত লাগবে না, আমার সুন্দর লাগবে, সবচেয়ে সুন্দর; এবং আমি উঠে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসি, বই খুলে আমি কিছু পড়তে পারি না; আমার মনে, আমি শুনতে পাই, কে যেনো ব’লে চলছে-মা, তোমাকে আমি সুন্দর দেখতে চাই, তোমার সাথে আমি বেড়াতে যেতে চাই, তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হতে চাই। তখনই দেখি মা আমার জন্যে কোরানো নারকেল আর মুড়ি নিয়ে আসছে, মা হাঁটতে পাড়ছে না, তার পা দুটি দু-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, আর পেটটি মার থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছে; এবং তখনই আমার ঘেন্না লাগে। একবার মনে হয় দৌড়ে গিয়ে মার হাত থেকে বাটি দুটি আমি নিয়ে আসি, মার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার কষ্ট হয়, আমি মার মুখের দিকে তাকাই; মা আমার টেবিলের ওপর বাটি দুটি রাখে। মুখ ঘুরিয়ে মার মুখে আমি একটা ভয়ের ছায়া দেখতে পাই।
মা বলে, তোর জন্যে কুরিয়ে আনলাম।
আমি বলি, আমার তো খাওয়ার ইচ্ছে নেই।
মা বলে, আমার মনে হলো তোর খিধে পেয়েছে।
আমি বলি, না, আমার খিধে পায় নি।
মা বলে, তবু পড়তে পড়তে খা।
আমি বলি, আচ্ছা।
মা চলে যায়, আমার খেতে ইচ্ছে করে না; আমার মনে হয় অন্য যে কেউ এনে দিলে আমার খেতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে না। জানালা দিয়ে ওগুলো ফেলে দিতে ইচ্ছে করে, আর তখনই আমি কষ্ট পাই। ওগুলো আমি ফেলে দিই না, একপাশে সরিয়ে রাখি; অনেকক্ষণ পর মা আবার এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।
মা বলে, তুই এখনো খাস নি?
আমি বলি, খাওয়ার কথা মনে ছিলো না।
মা বলে, এখন আমি মনে করিয়ে দিলাম, এখন খা।
মা আমার মুখে নারকেল আর মুড়ি তুলে দিতে থাকে, মার জন্যে আমার কষ্ট হয়, আমি খেতে শুরু করি।
মা বলে, খেতে কেমন লাগছে?
আমি বলি, ভালো।
মা বলে, তই অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিস।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুমি এমন হয়ে গেলে কেনো?
ডলিকে গর্ভবতী করতে আমার ইচ্ছে করে না। ওই মসৃণ বস্তু ছাড়া আজো আমি প্রবেশ করি নি, আমার ভয় করে, কোনোদিন পারবো না; ডলি আর আমার মধ্যে মসৃণ বস্তুর দূরত্ব রয়ে গেছে, ওই দূরত্বই আমাকে নির্ভয় রাখে, আমি আমাদের মধ্যে মসৃণ দুর্ভেদ্য দূরত্ব রাখতে চাই। মসৃণ বস্তু নেই, প্রবেশ করছি, ভাবতেই ভেতরে একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পাই। ডলির সর্বাঙ্গের স্পর্শ আমাকে উল্লসিত উত্তপ্ত কোমল কাতর সুখী করে, তবু মসৃণ বস্তু ছাড়া আমি প্রবেশ করছি, ভাবতেই মনে হয় আমি অন্ধকারতম। অন্ধকারে ঢুকছি, যেখানে কখনো আলোক ছিলো না, আলো জ্বলবে না, ওই অন্ধকার থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারবো না; ওই অন্ধকারে আমি লুপ্ত হয়ে যাবো। আমি গভীর কৃষ্ণ অন্ধকার দেখতে পাই, অন্ধকারকে আমি বাল্যকাল থেকেই ভয় করি। ডলি বারবার বলে সে-ই ব্যবস্থা নেবে, বটিকা খাবে; আমার সম্পূর্ণ সংস্পর্শ সে পেতে চায়, সে অনুভব করতে চায় মসৃণতাহীন আমার উপস্থিতি, সে বোধ করতে চায় বজ্রপাতের মতো প্রচণ্ড বর্ষণের স্বাদ। আমি তা পেতে চাই না; আমি তার মাংসের সাথে জড়িত হ’তে চাই না। আমার কি ঘেন্না লাগে? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ডলি বারবার জানায় যখন সে প্লাবিত পলিমাটির মতো বোধ করতে চায়; যখন সে পদ্মার স্রোতে জন্মজন্মান্তর ধরে ভিজতে চায়, হারিয়ে যেতে চায় প্লাবনের তলে, প্লাবন থেকে জেগে উঠতে তার ইচ্ছে করে না, তখন সে, ওই মসৃণ বস্তুর জন্যে, মরুভূমির মতো শুষ্ক বোধ করতে থাকে; সে মরুভূমি হয়ে ওঠে। মরুভূমি হতে তার ভালো লাগে না, সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি খুব যত্নের সাথে মসৃণ বস্তুটি পরখ করি, কোথাও ফেড়ে গেছে কি না, দেখি; তার ভেতর নিরাপদে ঘোলামলিন শাদা বস্তু রয়েছে দেখে আমি স্বস্তি পাই। ডলি যখন প্লাবিত হওয়ার কথা বলে, আমার মনে পড়ে নর্দমার কথা; কখনো উর্বর জমির কথা। উর্বর জমিতে বীজ ছড়ানোর কথা ভাবলে আমি ভয় পাই, আবাদ করতে আমার সাহস হয় না; নর্দমাও আমাকে অসুস্থ করে তোলে, মলভাণ্ডে নিজেকে বিগলিত করে দিতে আমি ঘেন্না বোধ করি।