শ্যামলী বলে, বিয়ের বাইরে সন্তান অবৈধ।
হাসান বলে, ক্লান্তিকর অপ্রেমের বিয়ের সন্তান বৈধ, আর সুখকর সুন্দর প্রেমের সন্তান অবৈধ? এটা কী ক’রে হয়?
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, প্রেম সমাজে স্বীকৃত নয়, বিয়ে স্বীকৃত।
হাসান বলে, তাহলে চলো, আমরা বিয়ে করি; আজই করি।
শ্যামলী বলে, কী ক’রে করবো? আমি তো বিবাহিত, বিয়ে তো আমার একটা হয়েছে, আমার হাজব্যান্ড আছে।
হাসান বলে, তাহলে তাকে ছেড়ে দাও, তাকে তো তুমি ভালোবাসো না।
শ্যামলী বলে, হ্যাঁ, তাকে ভালোবাসি না; তবে তাকে ছেড়ে দিলে স্ক্যান্ডাল হবে, আমার ছেলেমেয়েদের জীবন কষ্টে ভরে যাবে, তারা আমাকে ঘেন্না করবে।
হাসান বলে, তাহলে সে তোমার স্বামী থাক, আর আমিও তোমাকে বিয়ে করি, আমিও স্বামী হই; তুমি দুজনের স্ত্রী হও।
হো হো ক’রে হেসে ওঠে শ্যামলী, তুমি কি পাগল হ’লে? মেয়েদের একসঙ্গে দুটি স্বামী থাকতে পারে না; মেয়েদের জরায়ু একজনের জন্যে।
হাসান বলে, আমরা শুরু করলেই থাকতে পারে। শ্যামলী বলে, তুমি তো পাগলা আউল-বাউল কবি ছিলে না, কিন্তু এখন তো তোমারও পাগলামো দেখা দিচ্ছে।
হাসান বলে, আমি তো তাকে বেশ ছাড়ই দিচ্ছি, তুমি কয়েক দিন তার সাথে থাকবে কয়েক দিন আমার সাথে থাকবে।
শ্যামলী বলে, আমার হাজব্যান্ড তাতে রাজি হবে কেনো? জেনেশুনে তার জমিতে সে অন্যকে চাষ করতে দেবে কেনো?
হাসান বলে, রাজি না হ’লে তাকে ছেড়ে দাও, তুমি তো তাকে ভালোবাসো না, তার সাথে শুতে তো তোমার ঘেন্না লাগে। জমি চিরকাল একজনের থাকে না।
শ্যামলী বলে, বিয়েতে ভালোবাসা লাগে না, গাড়িবাড়ি সন্তানেই চলে।
হাসান বলে, তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।
কেঁদে ওঠে শ্যামলী, না, তোমাকে ছাড়তে আমাকে বোলো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য হয়ে যাবো।
হাসান বলে, তাহলে আমিই শুধু শূন্য থাকবো?
শ্যামলী হাসানকে আদর করতে করতে বলে, মনে করো আমি তোমার বউ, তুমি আমাকে বউ ব’লেই ডেকো।
হাসান বলে, আর আমি তোমার?
শ্যামলী একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়, তারপর বলে, ঠিক আছে তোমাকে আমি আমার হাজব্যান্ডই মনে করবো, তুমি আমার হাজব্যান্ড।
হাসান বলে, বাইরে এ-পরিচয়টা তুমি দিতে পারবে?
শ্যামলী কেঁপে ওঠে, বাইরে এটা বলতে হবে কেনো? এ-পরিচয়টা শুধু তোমার আমার মধ্যে।
হাসান বলে, বিয়ে, স্বামী, স্ত্রী, সংসার এসব হাস্যকর আমার কাছে, কিন্তু আমি তোমাকে কাছেই চাই, সব সময় পেতে চাই।
শ্যামলী বলে, আমিও চাই, আমি যে কী করি।
হাসানের ওপর একটি চাপ এসেছে, কবিলেখকদের একটা জরুরি অবধারিত সভায় যেতে হবে, সেখানে একটা শক্তিমান ছোকরা লেখককবিদের জ্ঞান দেবে, বোঝাবে কেনো একদল করতে হলো, কেনো তাদের অবশ্যই ওই দলে যোগ দিতে হবে; হাসানকেও একদলে যোগ দিতে হবে। হাসান ওই পেশল মূর্খ ছোকরাকে চেনে, সে খুনটুন করতে দ্বিধা করে না, ছোকরা শিঘ্রি মন্ত্রীটন্ত্রী হবে, মহানায়কের একান্ত পেশি সে, এবং খুবই শক্তিমান, তার আদেশ মেনে চলতে হবে কবিলেখকদের।
হাসান ফোন করে কবি কামর আবদিনকে, আপনি কি শহিদালি সাহেবের সভায় যাচ্ছেন?
কামর আবদিন তোতলাতে থাকেন, তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন, বলেন, আআমি বুবুঝতে পারছি না, কিকিন্তু না গিয়ে উউপায় নেই, আমি বেঁচে থাথাকতে চাই, শুনেছি না গিয়ে উডউপায় নেই। আআমি বেঁচে থাকতে চাই ককাকবিতা লিখতে চাই।
হাসান জিজ্ঞেস করে, আপনি কি একদলে যোগ দিচ্ছেন?
কামর বলেন, দলটিল তো আমি বুঝি না, কিন্তু যোগ দিতে বললে যোগ তো দিতেই হবে; এটা প্রতিবাদ করার সময় নয়, বেঁচে থাকার সময়, কবিদের জীবনে একটা সময় আসে যখন বেঁচে থাকাই কবিতা।
হাসান বলে, একাত্তরেও তো আপনি বেঁচে ছিলেন।
কামর কাঁপতে কাঁপতে বলেন, আমি কবিতা লিখতে চাই, কবিতা লেখার জন্যে বেঁচে থাকা দরকার, আমি প্রেমের ভাষা জানি প্রতিবাদের ভাষা জানি না, আমি কবি, পলিটিশিয়ান নাই, বীর নই, বিপ্লবী নই।
খুব সুখে আছে মনে হচ্ছে রাকিব সুলতান; হাসানকে সে ফোন করেছে, দোস্ত, শ্ৰদ্ধেয় শ্যাক শহিদালি সাব যে কবিল্যাখকগো ডাকছেন, চিঠি দিছেন, তুমি তার চিঠি পাইছো নি? তোমারে বাদ দেয় নাই তো?
হাসানের বলতে ইচ্ছে করে সে কোনো চিঠি পায় নি, পাওয়ার সে যোগ্য নয়, কিন্তু ভুল বাঙলায় ধমকের পর ধমকের ভাষায় লেখা চিঠিটি তার সামনে পড়ে আছে, এবং তাকে ধমকাচ্ছে।
সে বলে, পেয়েছি।
রাকিব জিজ্ঞেস করে, তুমি নিশ্চয়ই যাইবা?
হাসান বলে, আমি জানি না।
রাকিব বলে, কও কি, দোস্ত, তুমি জানো না? আমাগো যাইতেই হইবো, সব কবিল্যাখ্যকরাই যাইবো, তোমারেও যাইতে হইবো। রাজাবাদশারা ডাকলে যাইতে হয়, কবিগো কাম ত তাগো বন্দনা করা।
হাসান বলে, হয়তো আমি যাবো না।
রাকিব বলে, কও কি দোস্ত? তোমারে যাইতেই হইবো, দ্যাশে, নতুন দিন আসছে, আমরা কবিরাও নতুন দিন রচনা করবো। কবিগো খালি কবিতা ল্যাখলে চলবো না, দ্যাশে নতুন সোসাইটিও ইস্টাবলিশ করতে হইবো। মহানায়কের প্রত্যেকটি কথা কবিগো মাইন্যা চলতে হইবো, তিনি ত সম্রাট।
হাসান বলে, তুমি যেয়ো।
আলাউদ্দিন রেহমান উদ্বিগ্ন হয়ে চ’লে এসেছে, বলছে, দোস্ত, তুমি নিশ্চয়ই শ্যাক শহিদালির চিঠি পাইছো?
হাসান বলে, হ্যাঁ পেয়েছি।