প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম প্রেমের মতোই উজ্জ্বল অমর শাশ্বত ব্যৰ্থ।
সালেহ ফরিদউদ্দিন বলে, আসো আসো দোস্ত আমাগো কবিতার বই বাইর হইতে যাইতেছে, প্রুফ দ্যাখতাছি।
হাসানের ভেতরটা কেঁপে ওঠে; সে জিজ্ঞেস করে, কারা বের করছে? আহমেদ মোস্তফা হায়দার বলে, বাংলাবাজারের চৌধুরী ব্রাদার্স, তারা তরুণ কবিগো কাব্যগ্রন্থ বের করবে ব’লে ঠিক করছে, আমাগো দুইজন দিয়াই শুরু করছে, পরে অন্যগো কাব্যও বের করবো।
হাসানের ভেতরটা আবার কেঁপে ওঠে, একটা ঝিলিক ও একগুচ্ছ অন্ধকার তার ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।
সালেহ ফরিদউদ্দিন কবিতার জন্যে পাগল, হয়তো পাগলের থেকেও বেশি, হয়তো সে মরবেও কবিতার জন্যে; ইংরেজিতে অনার্স ভর্তি হয়েছিলো, কবিতার জন্যে পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগে; ও যে কীভাবে বেঁচে আছে হাসান জানে না। সালেহ হাসানের থেকে বছরখানেকের ছােটাে, কিন্তু এর মাঝে অনেক বেশি কবিতা লিখে ফেলেছে হাসানের থেকে। তার সাথে হাসানের প্রথম দেখা হয়েছিলো ব্রিটিশ কাউন্সিলে। হাসানের তখন বেশ কিছু কবিতা বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়, তরুণ কবি হিশেবে একটা পরিচিতি তার গ’ড়ে উঠছে, এবং সে তা উপভোগও করছে। সে একটি টেবিলে বসে পাউন্ডের ‘একগুচ্ছ নিষেধ’ প’ড়ে বেশ মজা পাচ্ছিলো, তখন একটি বিনম্র বিব্রত লাজুক তরুণ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে আগের দিনের দুই জেবের শার্ট, পাজামা পরা, চুল উস্কো খুস্কো, মুখে দু-এক দিনের না-কাটা দাড়ি, চোখ মান উজ্জ্বল, শরীরটা অসহায়।
তরুণটি জিজ্ঞেস করে, আপনি তো হাসান রশিদ?
হাসান একটু গোপন গৌরব বোধ করে, তাহলে তাকে এখন অনেকে চেনে।
হাসান হেসে বলে, হুঁ, আর আপনি?
তরুণটি বলে, আমার নাম মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন, এবার ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছি। আমিও কবিতা লিখি।
হাসান বলে, আপনার কোনো কবিতা আমি এখনো পড়ি নি। তরুণটি তখনই খাতা খুলে নিজের কবিতা সুর ক’রে পড়তে শুরু করে। হাসান বলে, ব্রিটিশ কাউন্সিলে এভাবে কবিতা পড়লে সবাই বিরক্ত হবে, চলুন বাইরে যাই।
বাইরে গিয়ে হাসানের মনে পড়ে আলাউদ্দিন রেহমানকে, যে তার নাম বদলে দিয়েছিলো; হাসানের মনে হয় মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নামেও চলবে না; একেও ভাঙতে হবে, নাম দিয়েই শুরু হবে তার ভাঙাভাঙি।
হাসান বলে, আপনার নামটি ঠিক আধুনিক কবির নামের মতো নয়, নামটি সম্ভবত বদলাতে হবে।
মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন বলে, আমি শুনেছি আপনিও নাম বদল করেছেন, আমিও আমার নাম বদলাবো।
কিছু দিন পর মোহাম্মদ সালেহউদ্দিন নিজেকে ভেঙে হয় সালেহ ফরিদউদ্দিন, এবং কবিতার জন্যে উৎসর্গ ক’রে দেয় নিজেকে, অনবরত ভাঙতে থাকে নিজেকে। প্রথম দিকে সে চলতি বাঙলা বলতো, বেশ চমৎকারভাবে বলতো, পরে অন্যদের মতো সেও মিশ্র বলতে থাকে। হাসান কখনো মিশ্রতে যেতে পারে নি, সম্ভবত সে বেশি আড্ডায় যায় না আর বেশি মেশে না ব’লে।
সালেহর কবিতায় একটা এলোমেলো সুন্দর পাগলামো আছে, শব্দ নিয়ে পাগল কিশোরের মতো খেলা আছে, মাঝেমাঝে চমৎকার কাতর পংক্তি আছে, ছবি আছে, ভেতরে জীবনানন্দ আছে, এবং ওর মুখে একটা করুণ অসহায়তার আভা আছে। সালেহকে এজন্যে ভালো লাগে হাসানের।
সালেহর প্রিয় অভ্যাস নিজের কবিতা প’ড়ে শোনানো; শুধু প’ড়ে নয় নিজের কবিতা সে অনর্গল আবৃত্তি করতে ভালোবাসে।
ওর আরো একটি প্রিয় অভ্যাস অন্যের কোনো পংক্তি ভালো লাগলে সেটাকে নিজের কবিতার ভেতর সে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেয়। তাই ছাপানোর আগে সালেহকে কবিতা শোনাতে ভয় হয়, হয়তো কোনো পংক্তি সে হরণ ক’রে নেবে, ছাপিয়ে ফেলবে, তখন পুরো কবিতাটিই বাতিল হয়ে যাবে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকার সময় কোনো কোনো দিন হঠাৎ ছিন্নভিন্ন ওয়ার্ডস্ওয়ার্থি মেঘের মতো তার ঘরে আসতো সালেহ, বলতো দোস, তোমার হলে খাইতে আসলাম তোমার হলের চ্যাপ্টা রান আর টেবিলগুলি আমার খুব ভালো লাগে, তোমার লগে খাইলে প্যাট ভরে।
সে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকতো, এমন কি খাওয়ার সময়ও। হাসান সব সময়ই লজ্জা পায় নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে, অন্যকে পড়ে শোনাতে; কিন্তু সালেহর এটা বড়ো আনন্দ। খাওয়ার পর নিজের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে তার ক্যাপস্টেনের প্যাকেট থেকে একটার পর একটা সিগারেট ধরাতো, তারপর বলতো, দোস, পাঁচটা ট্যাকা দেও, সিনেমা দেখুম।
হাসান অবাক হতো, ও কী ক’রে ওই পচা দুৰ্গন্ধপূর্ণ আবর্জনা দেখে, আবার সিনেমার থেকে বহুদূরবর্তী কবিতা লেখে!
কবিতার জন্যে সে সব ছেড়েছে, এমন কি ছেড়েছে নিজের শরীরটিকেও, ওর শরীরটি নানাভাবে ভাঙছে বলে মনে হচ্ছে হাসানের।
হাসান জিজ্ঞেস করতো, শুধুই কি সিনেমা দেখবে, না কি অন্য কিছুও?
সালেহ লজ্জা পেয়ে বলতো, হল থিকা একবার ব্ৰোথোলেও যামু, দোস।
আহমেদ মোস্তফা হায়দার একটু অন্যমনস্ক ধরনের, আল্পতেই ভেঙে পড়তে চায়, কিন্তু ভেঙে পড়বে না ব’লেই মনে হয়; একটি দৈনিকে কাজ করে। পাশের বাড়ির একটি ইস্কুলে-পড়া মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, এবং কয়েক দিন পর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। পালানোর জন্যে তারা নদী সাঁতরে গিয়েছিলো, কিন্তু মেয়েটিকে সে ধ’রে রাখতে পারে নি। ওই মেয়েটির জন্যে শোক চিরকালের জন্যে লেগে আছে আহমেদের চোখে মুখে চুলে কণ্ঠস্বরে। আহমেদ কাতর সেন্টিমেন্টাল প্রেমের কবিতা লিখে চলছে, প্রতিটি বাক্যের শেষে অশ্রুর মতো একটি ক’রে বিস্ময়চিহ্ন বসাচ্ছে, হয়তো সারাজীবনই বসাবে। হয়তো এজন্যেই আহমেদ মোস্তফা হায়দারকে ভালো লাগে হাসানের।