রঙ্গময়ি সেই রাগের আভাস দেখেই অপরাধবোধে কেঁদে ফেলল। ভাঙা বিকৃত গলায় বলল, আমি তো আসিনি। পিসি বলল, আপনার কিছু দরকার আছে কি না জিজ্ঞেস করতে। পিসি সঙ্গে এসেছিল।
হঠাৎ নলিনীর মুখ রুদ্ধ রোষে টকটকে লাল হয়ে গেল। বলল, তোমার পিসি?
হ্যাঁ, আমি কিছু জানি না।
নলিনী রাগলেও সেই রাগ রঙ্গময়ির ওপর প্রকাশ করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে সম্ভবত পরিস্থিতিটা একটুক্ষণ ভেবে নিল। তারপর হঠাৎ হাসল। তার হাসি বরাবর সুন্দর। অমলিন, সরল। দাঁতের ঝিকিমিকির ভিতর দিয়ে তার হৃদয় দেখা যেত।
মাথাটা একটু নেড়ে সে বলল, এভাবে কি হয়?
রঙ্গময়ি ভীত গলায় বলল, কী হয়?
নলিনী মাথাটা আগের মতোই নাড়তে নাড়তে বলল, এভাবে হয় না। তোমার পিসিকে সুযোগমতো বোলো, এভাবে হয় না। তুমি বড় ছোট, ঠিক বুঝবে না। তোমার পিসি ভুল করেছেন।
আপনি দরজাটা খুলে দিন।
ভয় পেয়ো না রঙ্গময়ি। চেয়ারটায় বোসো। দেখি আমি কী করতে পারি।
রঙ্গময়ি আর্ত গলায় বলল, পিসি দরজা বন্ধ করে দিল কেন?
সেটা তোমার পিসিকেই জিজ্ঞেস কোরো। তিনি যদি বলতে নাও চান তা হলেও ক্ষতি নেই, রঙ্গময়ি। বয়স হলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
রঙ্গময়ি হয়তো বুঝতে পারছিল, আবার পারছিলও না। কিশোরী বয়সের বয়ঃসন্ধি। আলো-আঁধারির সময়। পিসি একটা অঘটন ঘটাতে চাইছে, টের পাচ্ছিল সে। কিন্তু কেন, তা ভেবে তার মাথা কুল-কিনারা হারিয়ে ফেলছিল। এত রাতে একা পরপুরুষের ঘরে কী করে পিসি ঠেলে দিতে পারে তাকে?
তবে নলিনীকে রঙ্গময়ি জানত। এ পুরুষ বটে, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। না, কথাটা ঠিক হল না। নলিনী হয়তো বা বিপজ্জনকই ছিল। পরবর্তী কালে তার জীবনের একটা গোপন দিক প্রকাশ হওয়ার পর সেটা জানা গিয়েছিল। কিন্তু সেই বিপদ মেয়েদের জন্য নয়, ইংরাজদের জন্য। তাই রঙ্গময়ির সেই রাতে ভয় করেনি। লজ্জা ও আত্মগ্লানিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে গিয়ে নলিনীর টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারে বসল।
বুদ্ধিমান নলিনী দরজা খুলবার চেষ্টা করল না। শান্তভাবে ফিরে এসে সেও বসল নিজের চেয়ারে। রঙ্গময়ি দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। নলিনী ধীর স্বরে বলল, দরজার পাল্লাটা খুব ভারী। জোর করে খুলতে গেলে শব্দ হবে। কাউকে তো এ অবস্থায় ডাকাও যায় না।
রঙ্গময়ি ভীত স্বরে বলল, তা হলে?
তোমার পিসি খুব নিশ্চিন্তে বসে থাকবেন না নিশ্চয়ই। এক সময়ে এসে ঠিকই দরজা খুলে দেবেন। ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সে কতক্ষণ?–রঙ্গময়ি আকুল গলায় প্রশ্ন করে।
নলিনী তেমনি ঝকঝকে হাসি হেসে বলে, তোমার পিসির তো মাথায় গোলমাল। বিকারগ্রস্ত লোক। তিনি কখন এসে দরজা খুলবেন তা কে জানে! হয়তো একা আসবেন না, সঙ্গে লোক জুটিয়ে আনবেন।
লোক জোটাবেন কেন?
তুমি বড় বোকা, রঙ্গময়ি। আমার যতদূর ধারণা, উনি তোমাকে আর আমাকে ফাদে ফেলতে চাইছেন।
সর্বনাশ!
নলিনী মাথা নেড়ে বলল, কিছু সর্বনাশ নয়। চিন্তা কোরো না। বসে বসে বই পড়ো বরং। কী পড়বে? বঙ্কিম?
রঙ্গময়ির বই পড়ার মতো মনের অবস্থা নয়। সে মাথা নেড়ে জানাল, বই পড়বে না।
তা হলে কী করবে?
বসে থাকব। ওই জানালাটার শিক ভাঙা যায় না?
যায়। তবে তার জন্য একটা ছোটখাটো হাতি লাগবে। দেখছ তো, কী মোটা শিক!
রঙ্গময়ি ভারী হতাশ হয়ে আবার মুখ ঢাকল। ফোঁপাতে লাগল।
নলিনী এবার আর তাকে বাধা দিল না। কাঁদতে দিল। নিজে যে বইখানা পড়ছিল সেটা ফের তুলে নিয়ে চঞ্চলভাবে পাতা ওলটাতে লাগল। কিন্তু পড়ার মতো মনের অবস্থা নয়। এক সময়ে বইটা টেবিলে রেখে শান্তভাবে রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে বলল, মানুষের মনের নোংরামি দেখলে আমার ভারী ঘৃণা হয়। পৃথিবীতে তোমার পিসির মতো মানুষের কোনও প্রযোজন নেই, তবু এরা জন্মায় কেন বলো তো?
রঙ্গময়ি কী জবাব দেবে? তার পিসি কনকপ্রভা খারাপ না ভাল তা সে কখনও বিচার করে দেখেনি। পিসি পিসিই। কোলেপিঠে করে তাদের মানুষ করেছে। আদরে সোহাগে শাসনে। শুদ্ধাচারী বিধবা। তার বিচার রঙ্গময়ি কি করতে পারে? তাই কথাটা তার কানে লাগল। কিন্তু পিসির পক্ষ হয়ে তো কিছু বলারও নেই। তাই চুপ করে নখ দিয়ে টেবিলক্লথের এমব্রয়ডারির একটা ফেঁড় খুঁটতে লাগল সে।
নলিনী উঠে চঞ্চল পায়ে পায়চারি করতে করতে বলল, তোমার পিসি এর আগে আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও এনেছেন। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বলেছি, বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কখনও নাবীচিন্তা করি না। সংসারধর্ম পালনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। তোমার পিসি সেটা শুনেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করেননি।
একথা শুনে রঙ্গময়ির মরে যেতে ইচ্ছে করছিল লজ্জায়। পিসি তার অজান্তে এত কাণ্ড করেছে, সে জানত না। টেবিলের দিকে আরও ঝুঁকে পড়ল সে।
নলিনী বলল, তিনি ভাবলেন আমি বোধহয় গরিবের মেয়ে বলেই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি নই। আশ্চর্য! গরিবিয়ানা তো একটা অবস্থার ভেদ মাত্র। নিত্য পরিবর্তনশীল সমাজে ধনী ও দরিদ্র কারও স্থায়ি পরিচয় তো নয়। তা ছাড়াও একটা কথা আছে রঙ্গময়ি।
রঙ্গময়ি এক পলক তাকাল নলিনীর দিকে। তারপর আবার মুখ নামিয়ে নিল।
নলিনী ধীর স্বরে বলল, তোমাকে বা আর-কোনও মেয়েকে আমার কোনওদিনই বিয়ে করার সম্ভাবনা নেই। আমি ভিন্নতর এক কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
রঙ্গময়ির বুক কাঁপছিল। ভয় সব সময়ই অজানাকে ঘিরে। সে তো জানে না নলিনী কী জিজ্ঞেস করবে। সে শক্ত হয়ে রইল।