বাড়ির সামনে একটু বাগান আছে। ফটক পেরিয়ে ঢুকলে ঘোরানো রাস্তা। তারপর গাড়িবারান্দা। সিঁড়ি, বৈঠকখানা। বাড়িটার চেহারা বেশ পয়মন্ত। নিজেদের বাড়ি হলেও ধ্রুব মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির চোখে বিচার করে দেখেছে। তার মনে হয়েছে, এ বাড়ির মালিকের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকার মতো এলেম আছে।
বৈঠকখানার দরজায় জগাদা দাঁড়িয়ে। মাথায় সেকেলে লেঠেলদের মতো ঝাকড়া চুল। জোয়ান চেহারা। গায়ে এই শীতকালেও একটা ফরসা গেঞ্জি আর ধুতি। বয়স ষাটের ওপরে হবে, কিন্তু বিপুল স্বাস্থ্যে চাপা পড়ে বয়স চি চি করছে।
আরে জগাদা!
জগা এক ধরনের নিষ্পলক চোখে তাকে দেখছিল। এখন জগাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ধ্রুবর। তবে সে যখন ছোট ছিল, এবং জগাদা যখন আরও কমবয়সি এবং আরও স্বাস্থ্যবান তখন চড়-চাপড়টা মাঝে মাঝে খেতে হত। আশ্চর্য এই, এ বাড়ির কাজের লোক হয়েও জগাদার সেই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করত না। এখন আর ভয় খায় না ধ্রুব, বরং পিছনে লাগে।
জগা বললে, এতক্ষণে এলে?
খুব রাত হয়ে গেছে নাকি? —ধ্রুব একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে।
জগা মাথা নেড়ে বলে, ফুর্তির পক্ষে রাত হয়নি মোটেই। কিন্তু আজকের দিনটা রাত না করলেও পারতে।
কেন, আজ কী?
আজ কী সে তো তোমারই জানার কথা।
ওঃ!–ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলে, সব ব্যাপারে তোমরা অত সিরিয়াস কেন বলল তো! দুনিয়াটা গোমড়ামুখোয় ভরে গেল মাইরি।
জগা একটু চাপা গলায় বলে, জোরে কথা বোলো না। বাড়িসন্ধু সবাই জেগে আছে।
কেন? জেগে আছে কেন? আমার বিচারসভা বসবে নাকি?
সে কে জানে। তুমি ঘরে যাও! বেশি শব্দসাড়া কোরো না।
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। চতুর্দিকে এত গার্জিয়ান থাকলে বড় মুশকিল। তোমাকে এখানে খাড়া থাকতে বলেছে কে?
কেউ বলেনি। তুমি ঘরে যাও।
জগাদা, তুমি কি এখনও এ বাড়ির চাকর?
জগা একটু হাসে, তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় তুমি চাকর হয়েই জন্মেছ। এ জন্মে আর স্বভাবটা ছাড়তে পারবে না।
না হয় নাই পারলাম।
কেন পারছ না? ম্যাকিনেল বেরীতে তুমি আটশো টাকা মাইনেব চাকরি করো। বাগনানে তোমার জমিজিরেত বউ-বাচ্চা আছে। এই সমাজব্যবস্থায় তুমি যথেষ্ট ভদ্রলোক, তবু চাকরের মতো হাবভাব কেন?
চেঁচিয়ো না, বলছি না, সবাই জেগে আছে।
ধ্রুব চট করে জিভ কেটে বলে, তাই তো। ভুলে যাচ্ছিলাম। আসলে তোমাকে দেখলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি এ বাড়ি তোমার রক্ত মজ্জা মেদ মাংস শুষে খেয়েছে। তোমার গায়ে, চরিত্রে, স্বভাবে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে চাকর বলে। আমার চোখের সামনে একবার তোমাকে সোনাজ্যাঠা চটিপেটা করেছিল। আজও তবে কেন তুমি এ বাড়ির গোলামি করো? তোমার ভিতরে আগুন নেই? বিদ্রোহ নেই?
একতলার একটা লম্বা প্যাসেজ পেরোচ্ছিল তারা। অনেকগুলো সারিবদ্ধ ঘর। বেশির ভাগই খালি এবং তালা দেওয়া। শেষ প্রান্তের ঘরটায় আলো জ্বলছে। এ ঘরটাই ধ্রুবর। ধ্রুবর একার। তার বউ এ ঘরে থাকে না। এখন অবশ্য সে নার্সিংহোমে।
জগা কথা বলছিল না। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল শুধু।
ধ্রুব নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জগার দিকে ফিরে বলল, ভাঙো জগাদা, ভাঙতে শুরু করো।
কী ভাঙব?
এ বাড়ির বনিয়াদ। হাতের কাছে যা পাও তাই দিয়েই ভাঙতে শুরু করে। বাড়ি ভাঙো, মানুষ ভাঙো, সিস্টেম ভেঙে উড়িয়ে দাও।
জগার কাছে এসব কথা নতুন নয়। বহুবার শুনেছে। পেটে জিনিস পড়লেই ধ্রুব একটু বিপ্লবী হয়ে যায়। জগা হাত ধরে ধ্রুবকে ঘরে টেনে ঢোকাল। তারপর দরজাটা আবজে দিয়ে বলল, আজকের দিনটা বাদ দিতে পারলে না? তোমার আজ প্রথম ছেলে হল!
কার ছেলে? আমার? মাইরি জগাদা, সব জেনেশুনে তুমিও একথা বললে!
চুপ!–আচমকাই জগা একটা বাঘা গর্জন করে ওঠে।
ধ্রুব দুপা পিছিয়ে যায়, কী যে চেঁচাও না! মাথা ধরে যাচ্ছে! চেঁচাচ্ছ কেন? এমন কী বলেছি?
যা বলেছ তা আর বোলো না।
কেন বলব না?
জগা একটা গভীর হতাশার চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, বউমার অবস্থা ভাল নয়।
তার মানে?
নার্সিংহোম থেকে একটু আগেই টেলিফোন এসেছে। ছোটবাবু খবর পেয়েই চলে গেছেন।
ধ্রুব চুপ হয়ে যায়। তার আর কিছু বলার থাকে না।
০০৩. কিশোরী রঙ্গময়ি
চোখের পলকে অবস্থাটা বুঝে নিয়েছিল কিশোরী রঙ্গময়ি। মেয়েদের বাস্তববুদ্ধি একটু বেশিই দেন বিধাতা। রঙ্গময়ি বুঝেছিল, ওই বন্ধ কপাট তার জীবনের সব সম্ভাবনার পথে খিল তুলে দিল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্ধ দরজার ওপর। চেঁচানোর উপায় নেই, করাঘাত করা বিপজ্জনক। দরজায় মৃদু কিল দিতে দিতে সে চাপা গলায় বলতে লাগল, দরজা খোললা, পিসি, দরজা খোলো! ও পিসি…
নলিনীকান্ত বজ্রাহতের মতো বসে অবাক চোখে দৃশ্যটা দেখছিল, কিছুক্ষণ সে বোধহয় মানুষ ছিল না, পাথর হয়ে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে বলো তো! কে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করল?
রঙ্গময়ি তখনও থরথর করে কাঁপছে। নলিনীকে তার ভয় ছিল না। সে জানত, নলিনী নারীমুখী নয়। মেয়েমানুষের প্রতি তার কোনও আগ্রহ নেই। রঙ্গময়ির ঢের বেশি ভয় সমাজকে, কলঙ্ককে। কাপতে কাপতে জ্বরগ্রস্ত রুগির গলায় সে বলল, পিসি, আমার পিসি। ওপাশে শেকল তুলে দিয়েছে।
কেন? বাইরে থেকে শেকল তুলে দেওয়ার মানে কী?
জানি না। আপনি দরজাটা খুলে দিন।
নলিনী অনুচ্চ স্বরেই কথা বলছিল। কিন্তু সেই মৃদু স্বরও রাগে থমথম করে উঠল, এত রাতে তুমিই বা আমার ঘরে এলে কেন?