আজকের কথা হয়নি। কথা ছিল, হপ্তায় একদিন বাদ দেব। সেটা আজ হতে পারে, কাল হতে পারে, পরশু হতে পারে।
আজকের কথাই হয়েছিল। আজ ড্রাই ডে না?
আজ! ওফ, মনেই ছিল না মাইরি! ইস, ছিঃ ছিঃ!
ওই ভূতের গাড়িটার দোষ নেই। ক্ষমা করে দে।
দেব? মাইরি?
দে। ক্ষমার মতো জিনিস নেই।
প্রশান্ত হাতের ইটটা ফেলে দেয়। গাঢ় স্বরে বলে, ক্ষমার মতো জিনিসই হয় না। আমি রোজ হাজার হাজার লোককে ক্ষমা করি। যেদিন কাউকে ক্ষমা করতে ভুলে যাই সেদিন ভাল করে খেতে পারি না, ঘুমোত পারি না, মাল খেলেই কান্না পায়। তোর?
আমারও ওসব হয়। সকলের হয়।
হবেই। ক্ষমা করতে আমি এত ভালবাসি যে, মাঝে মাঝে নিজেকেও ক্ষমা করে দিই।
বহুত মাতলামি করছিস প্রশান্ত! আজ ব্যাপারটা শুরু হল কী করে বল তো!
কোন ব্যাপারটা?
আমাদের মাল টানাটা! উই ব্লাক দা প্রমিস, কী করে শুরু হল?
নার্সিংহোম থেকে। তোর বাচ্চাটা অপয়া। দারুণ অপয়া।
আমার বাচ্চা!–বলে ধ্রুব ভ্রু কোচকায়, তারপর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে, আমার বাচ্চা! হাঃ হাঃ–
প্রশান্ত সন্দেহের গলায় বলে, তোরই তো! ঠিক বলিনি?
দূর শালা! তোকে একটা কথা বলে রাখি। তোকে বলেই বলছি। বাচ্চাটা আমার নয়।
তবে কার?
অত আমি জানি না। তবে লাস্ট টু ইয়ারস আমি বউয়ের সঙ্গে শুইনি।
মাইরি বলছিস?
মাইরি।
সামনের মোড়ে আর-একটা জিপগাড়ি বাঁক ফেরে এগিয়ে এসে ভ্যানটার পিছনে থামে। দু-একজন লোক নামে। কিন্তু ভ্যানটার হেডলাইট এখনও জ্বলছে বলে কাউকে দেখা যায় না।
একটু অপেক্ষা করে ধ্রুব আর প্রশান্ত।
ভ্যানের কাছ থেকে একজন চেঁচিয়ে বলে, ধ্রুববাবু।
প্রশান্ত আবার ফেলে-দেওয়া ইটটা তোলে। বলে, শালারা বহুত ভ্যানতারা করছে।
ধ্রুব হাত তুলে প্রশান্তকে থামায়। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য লোকটার উদ্দেশে বলে, কেন ঝুটমুট ঝামেলা করছেন? আমরা কিছু করিনি।
লোকটা হেঁড়ে গলায় বলে, বাড়ি যাবেন, না ধরে নিয়ে যাব?
ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখটা বিকৃত করে একটু। তারপর বলে, যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি।
হেডলাইটের আড়াল থেকে লোকটা আবার বলে, আপনার বাবা একটু আগেই থানায় টেলিফোন করেছিলেন। বলেছেন, এমনিতে না গেলে হাসপাতালে গিয়ে পাম্প করে পেট থেকে মাল বের করে তারপর ভ্যানে করে পৌঁছে দিতে।
ধ্রুব বলে, যাচ্ছি। কিছু করতে হবে না। আপনারা ডিউটিতে যান।
লোকটা নাছোড়বান্দা। বলে, যাচ্ছি বললে হবে না। আপনি ভ্যানে এসে উঠুন। আমরা পৌঁছে দেব।
ধ্রুব দুপা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে, ভ্যান লাগবে না। আমরা ট্যাকসি ধরে নেব।
তা হলে ধরুন। যতক্ষণ না ট্যাকসিতে উঠছেন ততক্ষণ আমরা ফলো করব। আমাদের ওপর স্ট্রিকট অর্ডার আছে।
প্রশান্ত বিড়বিড় করে বলে, তোর বাপটা বহুত খচ্চর। ভি আই পি আছে তো কী আছে? ছেলে বলে কি চাকর?
ধ্রুব চাপা স্বরে বলে, সিভিলাইজেশন বলে একটা কথা আছে প্রশান্ত। আজ আমরা খুব গণ্ডগোল করেছি।
মাল খায় তো লোকে একটু গণ্ডগোল করবে বলেই গুরু।
ধ্রুব গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, আজ গণ্ডগোলের দিন ছিল না। কালুর দোকানে হুটোপাটা করা ঠিক হয়নি।
হুটোপাটা হত না মাইরি। একটা কালো মতো রোগা মতো লোক আজ কালুর দোকানে বসে ছিল। ভেজা বেড়াল শালা। খুব নজর করছিল আমাদের।
বটে! ঠিক দেখেছিস?
খুব ঠিকসে দেখেছি গুরু। গায়ে একটা ফান্টুস জ্যাকেট ছিল। খুনিয়া রঙের জ্যাকেট। শেষদিকে ওই লোকটা কালুকে চোখ মারায় কালু ঝাঁপ ফেলে দিল।
ভূতের বাচ্চাটা কে বল তো!
পুলিশের খোঁচড় হবে। ধ্রুব একটা হাই তোলে। বলে, ঠিক আছে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। চল। লিন্ডসে স্ট্রিটে মোড় নিয়েই দুজনে দাঁড় করানো ট্যাকসি দেখতে পায়। ট্যাকসির সামনে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
প্রশান্ত একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বলে, অ্যারেনজমেন্ট! মাইরি, তোর সঙ্গে ফুর্তি করে সুখ নেই।
মুখটা একটু বন্ধ রাখবি বাবা? কনস্টেবলটা ট্যাকসির পিছনের দরজা খুলে ধরে। বলে, উঠুন। ড্রাইভারকে বলা আছে।
ধ্রুব একটু লজ্জিত মুখ করে গাড়ির ভিতরে গড়িয়ে চলে যায়। প্রশান্ত উঠবার আগে কনস্টেবলটার দিকে কটমট করে একটু চেয়ে থাকে। কনস্টেবল দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ট্যাকসি চলতে থাকে।
প্রশান্ত বুক-পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এ পকেট ও পকেট হাতড়ে বলে, আমার দেশলাই?
ধ্রুব অলস গলায় বলে, আমারটাও কালুর দোকানে পড়ে আছে। এই যে ড্রাইভার, আপনার দেশলাইটা দেখি।
ড্রাইভার জবাব দেয় না, তবে একটা হাতে একটা দেশলাই এগিয়ে দেয়। সিগারেট ধরাতে যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্যই বোধহয় গাড়ির গতিও ধীর করে দেয়।
দুজনে সিগারেট ধরানোর পর প্রশান্ত বলে, ভি আই পি-দের হাত লম্বা হয় ঠিক শালা ভূতের হাতের মতো। সেই যে ঘর থেকে হাত বাড়িয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে এনেছিল, মনে নেই? ঠিক সেইরকম।
ধ্রুব ঝিমোতে ঝিমোতে বলে, মুখটা বন্ধ করবি বাপ! আমার মনটা ভাল নেই। আমি একটু চোখ বুজে ভাবছি।
কী ভাবছিস? যে বাচ্চাটা তোর বউ আজ পয়দা করল সেটা তোর নয়?
ওটা আমার নয় ঠিকই, কিন্তু ওটা নিয়ে ভাবছি না।
তবে কী নিয়ে ভাবছিস?
অনেক সিরিয়াস প্রবলেম আছে। তুই সব বুঝবি না। মুখ বুজে থাক। ভবানীপুর এলে নামিয়ে দেব।
প্রশান্ত একটু গম্ভীর হয়ে বিজ্ঞের মতো বলে, তোর প্রবলেম কোনটা জানিস?
আমার অনেক প্রবলেম।
তোর প্রবলেম আসলে একটাই। সেটা হল তোর বাপ।