সেই ঘরে মাঝে মাঝে কনক রঙ্গময়িকে পাঠাত। রঙ্গময়ির কাজ ছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করা, আপনার কি কিছু লাগবে?
এরকম নিরীহভাবে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। নলিনীর ঘরে মাঝে মাঝে খাওয়ার জল বা ঘোলের শরবত দিয়ে আসত রঙ্গময়ি। কাজটা তাকে দিয়ে কেন করানো হচ্ছে তা অবশ্য সে বুঝত না। নলিনীর প্রতি সে কোনও যুবতীসুলভ আকর্ষণও বোধ করত না।
নলিনীও ছিল হৃদয়চর্চা থেকে বহু দূরের মানুষ।
কিন্তু কনক ধৈর্য হারাচ্ছিল। মেয়েটা হাবা, ছেলেটা গবেট।
সুতরাং আর-একটু বাঁকা পথ নিতে হল কনককে। একদিন একটু বেশি রাত্রে সকলে ঘুমোনোর পর রঙ্গময়িকে ঠেলে তুলে দিল কনক, যা তো, নলিনীর বোধহয় খুব জ্বর এসেছে। দেখে আয় তো।
রঙ্গময়ি ঘুমচোখে একটু অবাক হলেও তড়িঘড়ি গিয়ে ঢুকেছিল নলিনীর ঘরে। নলিনী পড়তে পড়তে মুখ তুলে অবাক হয়ে চাইল। এত রাত্রে রঙ্গময়ি!
কিছু বুঝবার আগেই বাইরে থেকে দরজা টেনে শিকল তুলে দিল কনক।
নলিনী চমকে উঠল।
আর থরথর করে কেঁপে উঠল রঙ্গময়ি!
০০২. টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান
টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান খুব শ্লথ গতিতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে উত্তরমুখো এগিয়ে আসছে। হেডলাইটের সামনে ফুটপাথ ধরে দুজন মাতালকে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে। একজন লম্বা, ফিট চেহারা। অন্যজন কিছু থলথলে। দুজনেই দৌড়োচ্ছ ল্যাং ল্যাং করে, টলোমলো পায়ে। পড়ছে, আবার উঠছে। পিছু ফিরে দেখছে বারবার। ভ্যানটা তাদের ঠিক তাড়া করছে না, কিন্তু অনুসরণ করছে। লেগে আছে আঠার মতো পিছনে।
হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশান্ত বলে, রোজ ন্যাকড়াবাজি! শালা, রোজ ন্যাকড়াবাজি! আমাদের পেয়েছেটা কী? আই ধ্রুব, আয় কেলো করি সেদিনের মতো।
লম্বাজন ধ্রুব। হাইড্র্যান্টের উঠে-থাকা ঢাকায় একটা হোঁচট খেয়ে খানিক দূর ভারসাম্যহীনভাবে পড়ো-পড়া হয়ে গিয়েও দাঁড়ায়। কোমরটা চেপে ধরে বলে, মাইরি! মাইরি! রোজ পিছনে ভূতের গাড়ি! আর পারা যায় না।
অনেক রাত। ফাঁকা রাস্তায় হকারদের উঠে-যাওয়া অস্থায়ি দোকানপাটের ইট পড়ে আছে ফুটপাথে। প্রশান্ত একটা ইট তুলে নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, ঝাড়ব?
কেস খারাপ হয়ে যাবে। সেদিনের কথা মনে নেই?
আজ ফুটো করে দেব। দেব?
দাঁড়া, একটু ভাবি।
গাড়িটা কিছু দূরে হেডলাইট জ্বেলেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা দৌড়োলে আবার পিছু নেবে।
ধ্রুব সেদিকে চেয়ে বলল, এটা পুলিশের ভ্যান নয়।
তা হলে?
এটা মাইরি ভূতের গাড়ি।
তোর বাপের মাথা। দুটো ইট ঝাড়, ভাগবে।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, কালুর দোকানে হুটোপাটা করাটা আজ ঠিক হয়নি।
আলবাত ঠিক হয়েছে। শালা মাল বেচে খায়, তার আবার টাইম লিমিট কীসের? বারোটার পর সেল ক্লোজড, ইয়ার্কি পেয়েছে?
তা বলে ভাঙচুর করবি? সিভিলাইজেশন নেই?
আমি তো সেকথাই কালুকে বললুম, ঘর থেকে বার করে দিচ্ছিস, এটা কোন দেশি ভদ্রতা! বল, প্রথমে আমি রং দেখিয়েছি? ওই শালাই তো রং নিচ্ছিল।
ক্ষমাও তো করতে পারতি!
ক্ষমা?–প্রশান্ত একটু বেকুব বনে চেয়ে থাকে। তারপর জিভে চুক চুক দুটো শব্দ করে বলে, ইস শালা, তখন কথাটা মাথায় আসেনি মাইরি। অথচ দ্যাখ ধু-ধ্রুব, আমি শালা লোককে ক্ষমা করতে কত ভালবাসি। হাজার হাজার লোককে রোজ ক্ষমা করে দিচ্ছি শালা, আর কালুটাকে পারলুম না! এঃ!
ধ্রুব কিছু গম্ভীর হয়ে বলে, কোথায় আমাদের একটা গোলমাল হচ্ছে বল তো! রোজ গণ্ডগোল! একটা না একটা গণ্ডগোল। আর রোজ শালা পিছনে ভূতের গাড়ি।
এঃ। আমার দুগালে দুটো থাপ্পড় মারবি ধ্রুব? কেন শালা আমি রোজ ক্ষমা করতে ভুলে যাই বল তো! মারবি থাপ্পড়!
মারাই উচিত। তোর সঙ্গে মেশাও উচিত নয়।
প্রশান্ত একটু থতিয়ে যায়। ধরা ধরা গলায় বলে, তুইও ওর অনেকগুলো বোতল ভেঙেছিস। টেবিল চেয়ার উলটে ফেলেছিস।
সে তো তোরটা দেখে।
গাড়িটা সামান্য একটু এগিয়ে আসে।
প্রশান্ত বিস্ফারিত চোখে চায়। বলে, আসছে! ধু-ধ্রুব! দৌড়ো!
ইট মারবি না?
না, না। ক্ষমা! ক্ষমা! দৌড়ো!
পারবি না। গাড়ির সঙ্গে কোনও হিউম্যান বিয়িং দৌড়ে পেরেছে?
তা হলে?
ফেস কর। বিবেকানন্দ বলেননি, বর্বরদের মুখোমুখি হও!
কে?
গ্রেট ম্যান।
বিবেকানন্দ? কোথায় বলেছে বল তো!
কোথায় যেন।–বলতে বলতে ধ্রুব একটা ইট তোলে।
প্রশান্ত চাপা উত্তেজিত স্বরে বলে, মার! ফুটো করে দে! হুই-হুই-হু–ই-ই—
ধ্রুব ইটটা ছুড়তে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে উবু হয়ে পড়ে যায়। ইটটাও প্রায় তার সঙ্গেই পড়ে।
এঃ মিস।-বলে প্রশান্ত নিজের হাতের ইটটা খুব নিশানা করে ছুড়ে মারে। অদূরের হাইড্রান্টের জল ছিটকে ইটটা নিরাপদে অবতরণ করে।
গাড়িটা থেমে যায় ফের। সামনের দরজা খুলে একজন নামে। হেডলাইটের আলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে নোকটা অনুচ্চ স্বরে বলে, ধ্রুববাবু, হাল্লা মাচাচ্ছেন কেন? বাড়ি যান।
প্রশান্ত চোখ মিটমিট করে গাড়ির আলোর দিকে চেয়ে থেকে বলে, বাড়ি যাব কি না তাতে ওর বাবার কী?
ধ্রুব ওঠে। কাঁকালে হাত দিয়ে একটা ব্যথার শব্দ করে বলে, বাড়ি যেতে বলছে?
বলছে। বাট দ্যাট ইজ নট হিজ বিজনেস। মার ইট। রোজ পিছু নেওয়া! রোজ ন্যাকড়াবাজি! দে ফুটো করে।–বলতে বলতে আর-একটা ইট তোলে প্রশান্ত।
ধ্রুব কর্তৃত্বের একটা হাত তুলে বলে, দাঁড়া, কী হয়েছিল যেন কালুর দোকানে! হাল্লাবাজি?
ও মালের আড্ডায় একটু-আধটু হয়। কালু শালা মাল বেচে খায়, ওর অত ন্যাকড়া কীসের? ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আজ আমাদের মাল খাওয়ার কথা ছিল না। কাল আমরা প্রমিস করেছিলাম, আজ মাল খাব না।