রঙ্গময়ি এই অভিমানের কথায় মুচকি হেসে বলল, শরীর খারাপ তা বুঝব কী করে? দিব্যি তো ফুল-ফুল সেজে কুঞ্জবনে এসে বসে আছ।
হেমকান্ত ডাক-হাঁক বা প্রচণ্ড প্রতাপের মানুষ নন। তবে বন্ধ কপাটের মতো তার একটা নিরেট গাম্ভীর্য আছে। সেইজন্য সকলেই তাকে সমীহ করে। তার মুখের দিকে চেয়ে তরল কথাবার্তা কেউই বলে না। অবশ্য রঙ্গময়ি তার ব্যতিক্রম। হেমকান্তও রঙ্গময়ির কাছেই কিছু প্রগলভ হয়ে ওঠেন। রঙ্গময়ির একথাটায় তিনি হাসলেন না। বোধহয় পুরনো ক্ষতে ব্যথাতুর স্পর্শ পেলেন। বললেন, আজকের দিনটা আমার ভাল যাচ্ছে না, মনু। মনটা মুষড়ে আছে। এর ওপর যদি কোকাবাবুর মৃত্যুটা চোখে দেখতে হয় তবে সারা রাত আর ঘুম হবে না।
রঙ্গময়ি তার মায়াবী চোখ দিয়ে যতদূর সম্ভব খুঁটিয়ে লক্ষ করে হেমকান্তকে। তারপর বলে, মনের আর দোষ কী? পুরুষ মানুষরা হাঁটে, বেড়ায়, আড্ডা দেয়, তাস পাশা খেলে। তোমার তো সেসব কিছু নেই। কেবল বসে বসে আকাশ পাতাল কী যে ভাবো।
হেমকান্ত একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, আমি কি কেবল বসেই থাকি? কিছু করি না?
তা বলিনি। নিজের সব কাজ তুমি নিজেই করে নাও। কিন্তু সেটাও কি বাপু পুরুষ মানুষকে মানায়? নিজের ছাড়া কাপড় ধুচ্ছ, নিজের জল গড়িয়ে নিচ্ছ, নিজের মশারি টাঙাচ্ছ বা জুতো বুরুশ করছ, পুরুষ মানুষের এ কেমন ধারা? অত দাসদাসী তবে আছে কেন?
তা হলে কিছু করি বলছ?
করো, কিন্তু ওসব করে বলে আমি তোমার প্রশংসা করতে পারব না।
তোমার প্রশংসা! ওরে বাবা! সে তো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার শামিল।
আমার প্রশংসা তো বড় কথা নয়। তোমার বউও দুঃখ করে বলত, উনি যে কেন সকলের এত ছোয়াচ বাঁচিয়ে চলেন।
বলত নাকি?
বলবে নাই বা কেন? তাকে তো তুমি স্বামীসেবার সুযোগই দাওনি। জ্বর হলে মাথাটা পর্যন্ত টিপে দিতে ডাকতে না।
সেটা ভাল হয়নি বুঝি?
ভাল কি মন্দ সে জানি না। মেয়েমানুষের বুদ্ধি অল্প, তার ওপর আমি মুখ মানুষ। আমাদের চোখে ভাল লাগে না বলেই বলি।
রঙ্গময়ির স্বরে একটু অভিমানের সুর ছিল কি? হেমকান্ত মনে মনে একটু উদ্বিগ্ন হলেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তার নিজস্ব যে মতগুলি আছে তা তিনি কদাচিৎ লোকের কাছে ব্যক্ত করেন।
তর্ক করতে কেউ তাঁকে দেখেনি কখনও। হেমকান্ত মৃদু স্বরে বললেন, তোমার বুদ্ধি অল্প নয়। মূখও তোমাকে কেউ বলেনি। আমার সম্পর্কে তোমার সিদ্ধান্তও সঠিক। আমি নিজে আমার ত্রুটিগুলি খুব ভাল বুঝি। কিন্তু মনু, দোষ জেনেও কি সব সময়ে মানুষ সে দোষ ছাড়তে পারে?
রঙ্গময়ি ভ্রুকুটি করে বলে, তোমার দোষ দেখে বেড়ানোই বুঝি আমার কাজ? সেসব নয়। কিছু মনে কোরো না আমার কথায়। শরীর খারাপের কথা বলছিলে, কী হয়েছে তা তো বললে না।
এখনও তেমন কিছু হয়নি। হয়তো শরীর ততটা খারাপ নয়। মনটা খারাপ। আর মন খারাপ বলেই শরীরটাও ভাল লাগছে না।
চুপচাপ বসে থাকলে কি মন ভাল হবে? একটু বেড়িয়ে এসে গিয়ে। কোকাবাবুর বাড়িতে না যাও, অন্য কোথাও তো যেতে পারো।
হেমকান্ত হঠাৎ দাঁড়ান। বলেন, না, তার দরকার নেই। চলো, বরং দুজনেই কোকাবাবুর বাড়িতে যাই।
একথায় রঙ্গময়ি যেন একটু খুশি হয়। একটা দীপ্তি ক্ষণেক খেলা করে যায় মুখে। চোখের গভীর দৃষ্টি যেন বলে, এই তো চাই।
রঙ্গময়ির সঙ্গে হেমকান্তর বাইরের সম্পর্কটা খুবই পলকা। প্রায় কিছুই নয়। রঙ্গময়ি এ বাড়ির পুরুতের মেয়ে। পুরুত বিনোদচন্দ্র এখন খুবই বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তার ছেলে লক্ষ্মীকান্তই এখন পুজো-আর্চা করে। বিনোদচন্দ্রের অনেকগুলি ছেলেমেয়ে। তাদের অধিকাংশই লেখাপড়া শেখেনি। ভাল করে খাওয়াই জুটত না তাদের। রঙ্গময়ি বিনোদচন্দ্রের চতুর্থ কন্যা। তার আশা ছিল জমিদার শ্যামকান্তর মধ্যমপুত্র হেমকান্তর সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে হবে। শ্যামকান্তর স্ত্রী মেয়েটির সুলক্ষণ দেখে একবার এরকম অভিমত ব্যক্ত করেন। কষ্টেসৃষ্টে তিনি মেয়ের বিয়ে দিলেও চতুর্থ রঙ্গময়ির জন্য বিনোদচন্দ্র অন্যত্র বিয়ের চেষ্টা করেননি। বয়সে রঙ্গময়ির চেয়ে হেমকান্ত প্রায় পনেরো বছরের বড়। কিন্তু রঙ্গময়ির যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন হেমকান্তর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর বিনোদচন্দ্র নলিনীকান্তর আশায় বসে রইলেন। কিন্তু শ্যামকান্ত বা তার স্ত্রীর তরফ থেকে তেমন কোনও আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত পেলেন না। তার বড় তিনটি মেয়েই গরিবের ঘরে পড়েছে। তাদের একজন আবার অকাল-বৈধব্যের কবলে। ছেলেরা কেউই মানুষ হয়নি। বিনোদচন্দ্র তখন রঙ্গময়িকে জমিদারের ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া। পুরোহিত হলেও তাঁর নীতিজ্ঞান প্রখর ছিল না। গলগ্রহ এক বালবিধবা বোন তার সংসারে আছে। কনকপ্রভা। কনকের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, তবে বাঁকা। কনক একদিন বিনোদচন্দ্রকে বলল, সোনাভাই, যদি চৌধুরীবংশেই মনুকে দিতে চাও তো সোজা পথ ছাড়ো। বিনোদচন্দ্র সোজা পথ ছাড়তে রাজি, কিন্তু বাঁকা পথ পেলে তো!
কনক সেই বাঁকা পথের সন্ধান দিল না। তবে নিজেই দায়িত্ব নিল।
নলিনী বড় দালানে থাকত না। কাছারিঘরের পাশে খাজাঞ্চি মুহুরি বা ওই ধরনের কর্মচারীদের জন্য যে এক সারি ঘর ছিল তারই একটায় থাকত। বিলাসব্যসনের ধারে কাছেও ঘেঁষত না সে। ঘরে একটি তক্তপোশ, তাতে দীন বিছানা। কয়েকটা বইয়ের আলমারি আর লেখাপড়ার জন্য একটা টেবিল আর চেয়ার ছিল। অনেক রাত অবধি জেগে সে পড়াশুনো করত সেই ঘরে।