কিন্তু চলো বললেই তো আর যাওয়া যায় না। কোথায় যাবেন বাইরের ধূসর অচেনায়? এই তো তিনি বেশ আছেন। সংসারে কোনও বন্ধন তার কখনও ছিল না, এখনও নেই। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকেই তার কোলেপিঠে মানুষ করতে হয়নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ঘোট দুটি ছেলেমেয়ের ভার নিয়েছিল পুরনো ও বিশ্বাসী দাসীরা। আর দশভুজার মতো রঙ্গময়ি। এমনকী নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও এক অপরিমেয় দূরত্ব ছিল তার। অন্দরমহল ও সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতে হত সুনয়নীকে। শেষ কয়েক বছর দুরারোগ্য ক্ষতে শয্যাশায়ি ছিলেন। সুতরাং হেমকান্তর বন্ধন বলতে কিছু নেই। কেউ তাকে ধরে রাখেনি। তবু হেমকান্তের কোথাও যাওয়ার নেই। এই পোড়ো জংলা ভূমিখণ্ডই তাকে অনন্তের আস্বাদন দেয়।
কুয়াশার ভিতরে অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তিকে দেখে অন্যমনস্ক হেমকান্ত একটু চমকে উঠলেন। উত্তরের পরিত্যক্ত দেউলের ভেঙে পড়া দেওয়ালের এক অংশ দিয়ে ছায়ামূর্তি ঢুকল। ওদিকে রাস্তা নেই। চারদিকে ইট ছড়িয়ে পড়ে আছে। লম্বা ঘাসের জঙ্গল। সাপের প্রিয় সে পথ ধরেই এগিয়ে আসছিল সে। চকিত পায়ে।
হেমকান্ত হাতের লাঠিটায় থুতনির ভর রেখে সকৌতুকে চেয়ে রইলেন। রঙ্গময়ি এখনও চকিত-চরণা, চকিত-নয়না, চকিত-রসনা।
রঙ্গময়ির বয়স ত্রিশের আশেপাশে। তাকে হঠাৎ সুন্দরী বলা যায় না। একপলক তাকিয়ে দেখলে তাম্রাভ গাত্রবর্ণের মেয়েটিকে তেমন নজরে পড়বে না। রঙ্গময়ির শরীর কৃশ এবং কিছু দীর্ঘ। চোখ দুটি বড় এবং মাদকতাময়। সবচেয়ে সুন্দর তার ব্যাকঝকে দাঁত। লম্বাটে মুখোনায় একটু আপাত-কঠোরতা আছে বটে, কিন্তু বিন্দুমাত্র পুরুষালি ভাব নেই। গম্ভীর থাকলে রঙ্গময়িকে ওরকম দেখায়। হাসলে মুখের আশ্চর্য রূপান্তর ঘটে। আশ্চর্য তার চোখ। একবার তাকালে আঠাকাঠির মতো চোখ লেগে থাকে। ফেরাতে ইচ্ছে করে না। কী গভীর মায়া, কত ছলছলে আর করুণ!
শীতের পোশাক বলতে রঙ্গময়ির অঙ্গে শুধু একটা মোটা সুতির চাদর জড়ানো। পায়ে চটি নেই। এই শীতে রঙ্গময়ির পায়ের চামড়া ফেটে একাকার কাণ্ড। ফিতে-পেড়ে সাদা খোলর একটা শাড়ি পরনে।
হেমকান্তর স্নিগ্ধ মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটল। বললেন, বড় ঠাণ্ডা পড়েছে, খালি পায়ে ঘোরা ঠিক নয়।
রঙ্গময়ি বলল, আয়দের কথা পরে হবে। ওসব তোমার মুখে মানায় না। শরৎ খবর দিয়ে গেল কোকাবাবুর শ্বাস উঠেছে। একবার যাও।
হেমকান্ত নড়ে উঠলেন, খুব খারাপ অবস্থা নাকি?
এখন আর খারাপ নয়, একেবারে শেষ অবস্থা। একবার যাও।
হেমকান্ত গম্ভীর হলেন। বললেন, আমি গিয়ে কী করব? বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। গোটা কয়েক সান্ত্বনার বুলি আউড়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কী?
রঙ্গময়ি খুব শান্ত স্বরে বলল, সেটুকুও তো করা দরকার।
আজ আমার শরীর ভাল নেই মনু। মনটাও খারাপ।
তা হলে যাবে না?
নাই গেলাম। এসব সামাজিকতা আমার ভাল লাগে না।
না কি চোখের সামনে কাউকে মরতে দেখতে চাও না!
হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, তাও বটে।
রঙ্গময়ি হেমকান্তর দুহাত দূরত্বে দাঁড়ানো। তার গা থেকে একটা আঁচ আসছে বলে মনে হল হেমকান্তর। রঙ্গময়ি বলল, তুমি আমি সবাই একদিন না একদিন তো মরবই। মরতে দেখা ভয়ের কী?
হেমকান্ত অন্য পন্থা ধরে বললেন, কোকাবাবু যদি মরেন তা হলে আমাকে তো আবার স্নান করিয়ে ঘরে ঢুকতে দেবে না।
স্নান করবে। তাতে কী? গরম জল করা থাকবে। আগুন আর লোহা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকবে। আমি সব তৈরি রাখব।
রাখবে জানি। কিন্তু আজ আমার অত হাঙ্গামা ভাল লাগছে না।
রঙ্গময়ি একটু হতাশার গলায় বলে, কোনওকালেই তো কোনও হাঙ্গামা পোয়ালে না। এমন জড়ভরত হয়ে দিন কাটাতে ভাল লাগে তোমার?
হেমকান্ত বিষণ্ণ গলায় বললেন, সংসার বাস্তবিকই বড় জটিল জায়গা, মনু। সুনয়নী গেছে, ভেবেছিলাম এরপর আর লোক-লৌকিকতা, ভদ্রতা-অভদ্রতার ধার ধারতে হবে না। আপনমনে থাকব। এখন দেখছি, নিজের মতো করে থাকবার উপায় নেই।
অত রেগে যাচ্ছ কেন? ব্যাপারটা খুব সামান্য। কোকাবাবু তোমাদেরই জ্ঞাতি। এক শহরে বাস। না গেলে কেমন দেখাবে? এ সময়ে শত্রুও তো যায়।
মনু, তুমি কোনওদিন আমার কোনও অসুবিধে বুঝলে না। কোনটা আমি ভালবাসি, কোনটা বাসি না, সেটা জেনেও তুমি সবসময়ে অপছন্দের কাজটাই আমাকে দিয়ে করাতে চাও। মরার সময় নাই বা গেলাম, কোকাবাবুর অসুখের সময় তো আমি প্রায়ই দেখতে গেছি।
রঙ্গময়ি হাসল না বটে, কিন্তু তার মুখে কিছু কোমলতা ফুটল। যেমন শিশুর অসহায়তা দেখে মায়ের মুখে ফোটে। রঙ্গময়ি খুব মৃদু স্বরে বলল, সঙ্গে আমি গেলে?
হেমকান্ত একথায় হঠাৎ মুখ তুলে রঙ্গময়ির দিকে তাকান। বিভ্রান্তের মতো বলেন, তুমি গেলে–তুমি গেলে–
সহিসকে গাড়ি জুততে বলো গে, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
হেমকান্ত হঠাৎ বললেন, খারাপ দেখাবে না, মনু?
রঙ্গময়ি যেতে যেতে মুখ ফেরাল। মুখে একটু হাসি। কী অপরূপ হয়ে গেল মুখটা! বিহুল হেমকান্ত চেয়ে রইলেন।
রঙ্গময়ি বলল, দেখাবে। তবু তোমার জন্যেই যেতে হবে।
বরং খবর পাঠিয়ে দাও, আমার শরীর খারাপ।
সেটা অজুহাত হল, অজুহাত কি ভাল?
মানুষের শরীর খারাপ হয় না?
হয়। তোমার হয়নি।
কে বললে হয়নি?
রঙ্গময়ি একটু ভ্রু কুঁচকে চিন্তান্বিত মুখে বলে, সত্যি বলছ নাকি? শরীর সত্যিই খারাপ?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, তোমরা তো কেউ আমার কোনও খবর রাখো না মনু। সে না হয় নাই রাখলে, কিন্তু মুখের কথাটুকু অন্তত বিশ্বাস কোরো।