কী হয়েছে? স্ট্রোক?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
কন্ডিশন কি খুব সিরিয়াস?
খুব। ডাক্তাররা কোনও ভরসা দিতে পারছেন না। ওঁর একটা চিঠি রয়েছে, আপনাকে অ্যাড্রেস করা। আর একটা পুলিশকে।
পুলিশকে?
হ্যাঁ। আপনি চলে আসুন। ফোনে সব বলা যাবে না।
ফোনটা রেখে ধ্রুব কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না, কী করবে বা কী করা উচিত। একধরনের পাথুরে অসাড়তা তার সর্বাঙ্গে। বোঝা ভার।
জগা কখন এসে নিঃশব্দে দাড়িয়ে ছিল পিছনে। হঠাৎ সে ধ্রুবর হাতটা ধরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী হয়েছে?
ধ্রুব তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল। কিছু বলল না।
কর্তার কিছু হয়েছে?
ধ্রুব খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে।
জগা কোনও আহা উহু করল না, বেশি জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেও গেল না। বরং সত্যিকারের কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে এক ঝটকায় টেলিফোন তুলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস-এ ডায়াল করে বিকেলের ফ্লাইটে দুটো সিট বুক করে ফেলল। তারপর ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল, বউমাকে কিছু জানিয়ো। চেঁচামেচি করবে। অফিসের জরুরি কাজে যাচ্ছ বলে বাক্স গুছিয়ে নাও। আমি তোমার সঙ্গে যাব।
ধ্রুব স্বস্তির শ্বাস ফেলল। জগাদা সঙ্গে থাকলে অনেকখানি ভরসা।
জগা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বলল? স্ট্রোক?
কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
জগা বিশেষ বিচলিত হল না। কাজের মানুষরা হয়ও না। তাদের কাছে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। ধ্রুবকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, যাও গুছিয়ে নাও। বেশি কিছু নিয়ো না। দুটো জামা, দুটো প্যান্ট, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার আর পাজামা। দিল্লিতে এখন খুব গরম, একটা টুপি নিয়ে। বউমাকে কিছু বোলা না। আমি টিকিট কাটতে এয়ারলাইনস অফিসে যাচ্ছি। কেটে না রাখলে পবে গড়বড হতে পারে।
ধ্রুব ঘরে এল।
রেমি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কার টেলিফোন গো?
অফিসের। আজ একটু বাইরে যেতে হবে।
কোথায়?
জয়পুর।
কদিনের জন্য?
ঠিক নেই। দেখি। তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।
তোমাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন?
ধ্রুব আনমনে একটা কম্পিত হাত নিজের মুখে বুলিয়ে নিল। রেমির কথাটার জবাব না দিয়ে জগার কথাটা মুখস্থ বলে গেল, দুটো প্যান্ট, দুটো জামা, গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, পাজামা আর একটা টুপি বড় অ্যাটাচি কেসটায় গুছিয়ে দাও।
কৃষ্ণকান্ত হাসপাতালে, এই সংবাদটা ধ্রুবকে তেমন চঞ্চল করেনি। যেটা রহস্যময় তা হল, কৃষ্ণকান্ত ধ্রুবকে একটি এবং পুলিশকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাঁর সেক্রেটারি বলেছে, টেলিফোনে সব কথা বলা যাবে না। এইসব ব্যাপারকে ধ্রুব মনে মনে নানাভাবে উলটেপালটে মিলিয়ে জুলিয়ে দেখছিল। ভাবতে ভাবতে বড্ড বেশি অস্থির আর চঞ্চল লাগছিল তার।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াল। অনেক সিগারেট খেল পরপর। দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরে সে খুব অনিচ্ছের সঙ্গে কয়েক গ্রাস ভাত মুখে তুলল মাত্র। রেমি খুব লক্ষ করছে তাকে। সেই দৃষ্টির সামনে আরও অস্বস্তি বোধ করছে ধ্রুব।
রেমি খুব সন্দেহের গলায় বলল, তোমার একটা কিছু হয়েছে।
কিছু না।
টেলিফোনটা পাওয়ার পর থেকেই তোমাকে অন্যরকম দেখছি।
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, অফিসের একটা প্রবলেম নিয়ে ভাবছি।
অফিস নিয়ে তুমি এত ভাবো নাকি?
মাঝে মাঝে ভাবতে হয় বই কী।
আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ না তো?
আরে না। এটা অন্য ব্যাপার।
খেয়ে উঠে ধ্রুব কিছুক্ষণ ঘুমের ভান করল। করতেই হল, নইলে রেমি আরও অনেক প্রশ্ন করবে।
বিকেল চারটের মধ্যেই জগা এসে গেল। মুখ থমথমে গম্ভীর। চোখ টকটকে লাল। প্লেন ছাড়তে অনেক দেরি, তবু জগা তাড়া দিয়ে বলল, চলো চলো, অনেক ঝামেলা আছে।
একটু হাঁফ ছাড়ল ধ্রুব। রেমির আওতা থেকে একটু দূরে গিয়ে তার ভালই লাগবে।
গাড়ি এয়ারপোর্টের পথে রওনা হতেই জগা বলল, শেষ খবরটা পেয়েছ?
না। কী খবর?
জগা একবার ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, নেই।
মানে?
তোমার বাবা বেঁচে নেই।
সামনের সিটটা একবার আঁকড়ে ধরল ধ্রুব। তারপর শ্লথ শরীরে বসে বলল, কখন?
দুপুরে মারা গেছেন।
কিছু বলল কী হয়েছিল?
জগা মাথা নাড়ল, না। ওখানে না গেলে কিছু বোঝা যাবে না।
ধ্রুব খুব ধীরে ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল। কৃষ্ণকান্তর মৃত্যুটা তার খুব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল না। কাল রাতে কৃষ্ণকান্ত নিজে যেচে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই কথাতেও কিছু অসংলগ্নতা ছিল। সব কিছু মিলে একটা দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। কিন্তু কেন? কেন? তাঁর তো কোনও ফ্রাস্ট্রেশন ছিল না।
দিল্লি পোঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। তবে গ্রীষ্মকাল বলে এবং দিলি কলকাতার পশ্চিমে বলে একটু দিনের আলোর আভা তখনও ছিল। সেই গোধূলিতে ধ্রুব দিল্লিতে নামল। দেখল চারদিকে মৃত্যুর বিবর্ণতা।
এয়ারপোর্টে কৃষ্ণকান্তর সেক্রেটারি উপস্থিত ছিলেন গাড়ি সহ। ধ্রুব গাড়িতে উঠতেই উনি মুখ-আটা একটা খাম ধ্রুবর হাতে দিয়ে বললেন, এটা আগে পড়ে নিন। মনে হচ্ছে চিঠিতে জরুরি কোনও কথা আছে।
কী করে বুঝলেন? চিঠিটা আপনি পড়েছেন?
সেক্রেটারি মাথা নেড়ে বললেন, না। তবে কাল রাতে উনি আমাকে হঠাৎ বললেন, আমার ছেলেকে লেখা একটা চিঠি তোমার হেফাজতে রইল। মানুষের কখন কী হয় বলা যায় না। যদি আমার হঠাৎ কিছু হয় তবে আমার ছেলেকে সবার আগে খবর দিয়ে। চিঠিটা পড়বার পর সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।
একথা উনি বললেন?
হ্যাঁ। প্রথমটায় আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম শুনে। উনি খুব সেন্টিমেন্টাল মানুষ ছিলেন না যে মৃত্যু নিয়ে বিলাসিতা করবেন।