কৃষ্ণকান্তর মতো থার্ডরেট পলিটিসিয়ান হওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।
শ্বশুরের পক্ষ নিয়ে রেমি কিছুক্ষণ তর্ক করার চেষ্টা করে, তারপর হাল ছেড়ে রণে ভঙ্গ দেয়। আজকাল সে ধ্রুবকে একেবারেই চটাতে চায় না।
কৃষ্ণকান্ত মাঝে মাঝে দিল্লি থেকে ট্রাংক কল করেন। কথা হয় রেমির সঙ্গেই। কী কথা হয় তা ধ্রুব জানে না।
তবু একদিন ধ্রুব রেমিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার শ্বশুরের মন্ত্রী হওয়ার আর কদূর? কাগজে তো কোনও উচ্চবাচ্য নেই দেখছি।
রেমি বিরস মুখ করে বলে, তোমার বুঝি সেজন্য ঘুম হচ্ছে না? শশুরমশাইকে ঠিকই মন্ত্রী করা হবে।
কোন দফতরের সর্বনাশ করবেন তা শুনেছ?
সেটা নিয়েই একটু মতের অমিল হচ্ছে। প্রাইম মিনিস্টার ওঁকে রাষ্ট্রমন্ত্রী করতে চাইছেন। উনি চাইছেন ক্যাবিনেট স্ট্যাটাস।
ও বাবাঃ, একেবারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী! সাংঘাতিক কথা।
ওঁকে তাই করাও হবে। কথা এগোচ্ছে।
ধ্রুব একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বিচিত্র নয়। এ দেশে সবই সম্ভব।
একদিন কৃষ্ণকান্তর ট্রাংক কল এল রাত এগারোটায়। রেমি গিয়ে ফোন ধরল। কিছুক্ষণ কথা, বলার পরই দৌড়ে এসে ধ্রুবকে ডাকল, ওগো, শ্বশুরমশাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। শিগগির যাও।
আমার সঙ্গে কী কথা?
যাও না, উনি কী বলবেন যেন তোমাকে।
ধন্য হলাম। যাচ্ছি। আর হাতে খিমচি দিয়ো না।
ধ্রুব গিয়ে বৈঠকখানার এক্সটেনশন ধরল।
কিছু বলবেন?
তেমন কিছু বলার নেই। কেমন আছো সব?
ভালই তো।
আজ প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে ফাইনাল কথা হয়ে গেল। আমাকে উনি ইনফর্মেশন অ্যান্ড ব্রডকাস্টিং দিচ্ছেন।
ধ্রুব একটুও উৎসাহ বোধ না করে বলল, তাই নাকি?
বুঝতেই পারছ, এখন স্থায়ীভাবে দিল্লিতেই থাকতে হবে। তোমাদের সঙ্গে হুট করে দেখা হবে। সংসারের দায়দায়িত্ব এখন সবই তোমার হাতে।
এদিকে সবই ঠিক আছে।
বউমার কাছে সব খবরই পাই। আজ হঠাৎ তোমার গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে করল। তাই ডাকলাম। ঘুমোচ্ছিলে নাকি?
না। বই পড়ছিলাম।
দিব্য কি জেগে আছে?
না, অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে।
জেগে থাকলে ওর সঙ্গে একটু কথা বলার চেষ্টা করতাম। আমাকে খুব চিনে গিয়েছিল। আফটার অল রক্তের টান তো, শিশুরাও বোঝে।
এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় ধ্রুব বিরক্ত হল। বলল, আর কিছু বলবেন?
না। বেশি কথা কিছুই বলার নেই। এই একটু আগে প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে বৈঠক শেষ হল। ফিরে এসেই ফোনটা করলাম। এখন একটু বেড়াতে বেরোব।
ও। বেশ তো।
যাও, তুমি গিয়ে ঘুমোও। আর-একটা কথা।
বলুন।
আলমারি সিন্দুক সব খুলে দেখেছ নাকি?
দেখেছি।
কাগজপত্র সব দেখেছ?
না, সব দেখা হয়নি।
দেখো। দলিল-দস্তাবেজ সব তুমি বুঝবে না। আমাদের উকিল ভট্টাচার্যের কাছে সব বুঝে নিয়ো। ওকে আমার বলা আছে।
আমার বুঝে কী হবে?
বুঝে রাখা ভাল। কখন কীসের দরকার হয় কে জানে।
আমার তো বিষয়-সম্পত্তির কোনও প্রয়োজন নেই।
তোমার না থাক দিব্যর আছে। তা ছাড়া সম্পত্তি, বিষয়, টাকা এসব হাতে থাকলে তুমি পাঁচজনের উপকারও করতে পারবে, যদি চাও। এগুলো এমনিতে কিছু নয়, কিন্তু কাজে লাগাতে পারলে এগুলো মস্ত সহায়।
আপনার জিনিস আপনিই কাজে লাগাবেন।
কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বললেন, এইসব সম্পত্তির বেশির ভাগই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমি ওকালতি করে খুব একটা অর্জন করিনি। ওকালতি করলে অবশ্য পারতাম। তুমি যদি কাজে লাগাতে না চাও তবে অন্তত রক্ষণাবেক্ষণ কোরো।
দেখা যাবে।
ধৈর্য হারিয়ো না। সব দিকে চোখ রেখে চললে ভাল হবে। আর বউমাকে কষ্ট দিয়ো না। অমন মেয়ে দুটি হয় না। কী ধৈর্য, সহ্য আর অধ্যবসায়। সে যখন মরতে বসেছিল তখন আমি দুনিয়া হারিয়ে ফেলেছিলাম। বুঝলে?
বুঝেছি। এ সবই আপনি আমাকে আগে বলেছেন।
আবার বললাম। বারবার শুনলে কথাটা মনে গেঁথে যায়।
তাহলে ছাড়ছি।
হ্যাঁ।
ধ্রুব ফোন রেখে দিল। কোনও জরুরি কথা নয়, তবু লোকটা এত রাতে তাকে ডেকে এই খেজুরে আলাপ কেন করল তা বুঝতে পারল না সে।
রেমি এতক্ষণ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফোন রাখতেই বলল, একবার ওঁকে বাবা বলে ডাকলে না?
ধ্রুব অবাক হয়ে বলে, ডাকার কী হল?
ডাকতে হয়।
তার মানে?
ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মুখে একবার বাবা ডাকটা শোনেন।
তাই নাকি?
আমাকে কী বললেন জানো? বললেন, ধ্রুবর মুখে বহুকাল বাবা ডাক শুনিনি, ওকে একটু ডেকে দাও তো বউমা, কথা বলি।
ওসব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার ওঁর আছে নাকি?
না থাকলে বলবেন কেন?
ওঁকে বাপ ডাকার অনেক লোক আছে, রেমি। আমি না ডাকলেও ওঁর চলবে।
ছিঃ, ও কী কথা?
কিছু খারাপ নয়। ওঁকে বহু লোক দায়ে পড়ে বাপ ডাকে। আরও বহু লোক ডাকবে। আর আমরা ওঁর কে? ছেলেবেলায় লোকটাকে মনে হত বাড়ির পেয়িং গেস্ট। সম্পর্কটা তো হুট করে তৈরি হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে নিতে হয়। উনি তা গড়েননি।
রেমি ছলছল চোখে চেয়ে থেকে বলল, তুমি মানুষকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও, তাই না?
জানোই তো আমি স্যাডিস্ট।
মোটেই নয়। স্যাডিস্টরা অন্যরকম হয়। তুমি সেরকম নও।
এখন ঘুমোতে চলল।
তুমি ভীষণ নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুর হয়ে থাকলে সেটাও কৃষ্ণকান্তর কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।
রেমি আর তর্ক করল না।
পরদিন সকালে ফের দিল্লি থেকে ট্রাংক কল এল। কৃষ্ণকান্ত নন, তাঁর সেক্রেটারি ফোন করছে, ধ্রুব চৌধুরীকে চাই। আর্জেন্ট মেসেজ।
ধ্রুব গিয়ে ফোন ধরল, কী হয়েছে?
মিস্টার চৌধুরী ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে রিমুভ করা হয়েছে। আপনাদের এক্ষুনি আসা দরকার।