“পরদিন সকালেই রুক্ষ শুষ্ক চেহারার এক যুবক উদভ্রান্তভাবে আমাদের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে চিনি না। তবু সে খুব উচ্চগ্রামে ডাকিল, বাবা!
“আমি বৈঠকখানায় বসিয়াই দুগ্ধপান করিতেছিলাম। শ্বেতপাথরের গেলাসটি হাত হইতে পড়িয়া ভাঙিয়া গেল। বুক কাপিয়া উঠিয়া শ্বাসকষ্ট হইতে লাগিল। যুবকটি আসিয়া আমার পায়ের উপর উপুড় হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, কেমন আছেন?
“কী বলিব? এই যুবককে কী বলিব? কে বিশ্বাস করিবে যে একদিন এ কীটাণুকীট হইয়া আমার শরীরের অভ্যন্তরে ছিল। মাতৃজঠর হইয়া পৃথিবীর আলো দেখিল এই তো সেদিন! ইহার মধ্যেই লম্বা চওড়া চেহারার বিশাল যুবক হইয়া উঠিল কীরূপে? রুক্ষতা ও শুষ্কতার ভিতর দিয়াও তাহার বিশাল কাঠামো ও অভ্যন্তরীণ তেজ প্রকাশ পাইতেছে। একটি অগ্নিশিখা।
“বুকটা ব্যথাইয়া উঠিল কি? শ্বাসকষ্ট হইতেছে। কোনওক্রমে দুটি হাত বাড়াইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিলাম, এলে! অবশেষে এলে!
“বেশ কয়েকদিন ডায়েরি লিখি নাই। শরীরের অবস্থা ভাল বুঝিতেছি না। বুকের মধ্যে এখনও অসহনীয় কষ্ট আছে। শ্বাসের গতিও অনিয়মিত। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছে, রক্তচাপও মারাত্মক। সবই ঠিক, তবু মরি তো নাই। দুই চক্ষু ভরিয়া পুত্রের মুখ দেখিয়াছি। আর এখন মরিলেই বা দুঃখ কী? মনু বিধবা হইবে। সে আর বেশি কথা কী? সে তো জানিয়াই আমার সহিত সংসার পাতিয়াছে।
“না, আজ আর অন্য কথা নহে। শুধু কৃষ্ণর কথা ভাবিব। পুত্রের ভিতর দিয়া পিতাই আবার জন্মগ্রহণ করে বলিয়া শাস্ত্রে একটা কথা আছে না! আজ মনে হইতেছে ওই তো আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আর কেন মিথ্যা এই দেহটি লইয়া থাকা?
“কৃষ্ণ আছে। থাকিবার কথা ছিল না। তিনদিনের কড়ারে আসিয়াছে। কিন্তু তাহাকে দেখিয়াই আমার রক্তচাপ বাড়িয়া যাওয়ার এবং দুর্বল হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ করায় সে যাইতে পারে নাই। মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি, সে যেন একেবারে আমার মুখাগ্নি করিয়া যায়।”
হেমকান্ত মারা গেলেন ভোররাতে। কেউ টেরও পেল না। শেষ সময়টায় শুধু তিনি নিজেই টের পেয়েছিলেন। বুকে অসংখ্য ছুরির আঘাতের মতো ব্যথার ফলা ঢুকে যাচ্ছে। টনটনে জ্ঞানে সবটাই তিনি অনুভব করতে পারলেন। শ্বাসকষ্ট প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছিল বুক। হেমকান্ত উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। রঙ্গময়ী পর পর সাতদিন একটানা রাত জেগে আর পারেনি। পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে অঘোর ঘুমে ঢলে পড়েছে। হেমকান্ত তাকে আর ডাকলেন না। তিনি গঙ্গার স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। অন্ধকারে নদী বয়ে চলেছে।
অস্ফুট একটা শব্দ করলেন হেমকান্ত। বুঝি বললেন, ওরা রইল। দেখো।
কাকে বললেন তা স্পষ্টভাবে তিনি নিজেও জানেন না। কিন্তু তার মনে হল, কেউ শুনল। মনে রাখল।
পরদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে হেমকান্ত পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনও চিহ্ন রইল না।
কৃষ্ণকান্ত বসে নিভন্ত চিতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, বাবা কেন শুধু তার আগমনটুকুর জন্যই প্রাণটা রেখেছিল কোনওক্রমে। কোনও গৃঢ় কারণে সে পিতৃঘাতী হল না তো!
চিতায় জল ঢেলে অস্থি নিয়ে কৃষ্ণকান্ত যখন স্নান সেরে ফিরে এল তখনও রঙ্গময়ী অচেতন। তাকে পাখার বাতাস দিচ্ছেন ধনঞ্জয়ের স্ত্রী।
বিছানাটার পাশে মেঝেয় বসে কৃষ্ণকান্ত খাটের পায়ায় একটু হাত বোলাল। শোক গভীর শোক গুরুভার। তবু অপেক্ষা করার সময় তো তার নেই। যেতে হবে।
খাটে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল কৃষ্ণকান্ত। শেষরাতে রঙ্গময়ী তাকে ডেকে তুলল।
ওরে ওঠ। আয়, দুজনে মিলে একটু কাঁদি।
১০৬. বাবা
কৃষ্ণকান্ত দিল্লি চলে যাওয়ার পর ধ্রুব কিছুদিন বুঝতে পারল না তার কী করার আছে বা কী করা উচিত। আলমারি এবং সিন্দুক খুলে সে বিস্তর দলিল-দস্তাবেজ, টাকা এবং শেয়ারের কাগজ ইত্যাদি পেল। কিছুই সরাল না। কৃষ্ণকান্ত তাকে একরারনামা দিয়ে গেলেও নিজের ভিতরে কোনও অধিকারের জোর বোধ করল না সে। সবই জায়গামতো আবার যেমন-কে-তেমন রেখে দিল। কৃষ্ণকান্ত হয়তো তাকে লোভ দেখাচ্ছেন। সংসারমুখী গৃহস্থে পরিণত করতে চাইছেন। কিন্তু ধ্রুব জানে, যতদিন কৃষ্ণকান্ত বেঁচে আছেন ততদিন কোনও উত্তরাধিকারই তাতে বর্তাবে। রাশ সবসময়ই অলক্ষে থাকবে কৃষ্ণকান্তর হাতে। সংসারের কর্তা হওয়ার অবশ্য কোনও সাধই নেই ধ্রুবর। কর্তা হওয়ার অনেক অসুবিধে, অনেক ভজঘট, অনেক মন রেখে চলা। একথাও ঠিক যে, কৃষ্ণকান্তও প্রকৃত অর্থে সংসারী ছিলেন না। তার জীবনের প্রায় সবটাই বহির্মুখী, বৃহৎ জীবন। ঘর-সংসারে তার একটা নাম-লেখানো ছিল মাত্র। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর খানিকটা হাল তাঁকে ধরতেই হয়েছিল এবং তখন দেখা গেল, সংসার চালানোটাও তার কাছে শক্ত কিছু নয়। সব ব্যাপারেই তার এক অনায়াস সিদ্ধি।
ধ্রুব এইসব ভাবে আর মাঝে মাঝে কৃষ্ণকান্তর চেয়ারে বসে অনেকক্ষণ ধরে কৃষ্ণকান্তর মন এবং চোখ নিয়ে সবকিছুকে বিচার করার চেষ্টা করে। লোকটাকে বুঝতে চায়।
রেমি এসে বলে, এখানে কেন ভূতের মতো বসে থাকো বলো তো?
সিংহাসনটা কেমন তা ফিল করার চেষ্টা করি।
সিংহাসন হবে কেন?
সিংহাসনই তো। হি ইজ এ কিং ইন হিজ ওন কিংডম। উনি আমাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে গেছেন। তাই নেট প্র্যাকটিস করছি।
তুমি কোনওদিন ওরকম হতে পারবে না। তোমার সেই মুরোদই নেই।