“আমি আজকাল ফের মৃত্যুর কথা একটু বেশি ভাবিতেছি। গত বৎসর আমার হৃদযন্ত্র বেশ কয়েকবার বেয়াদপি করিয়াছে। রক্তচাপটাও যে বিদায় লয় নাই তাহা অভ্যন্তরে টের পাই। আর এইসব বৈকল্যই বোধ করি আমাকে মৃত্যুর কথা মনে করাইয়া দেয়। সেই যে কয়েক বৎসর আগে এক প্রত্যুষে কুয়ার দড়ি হাত হইতে পড়িয়া গেল সেদিন হইতেই আমার জীবনে মৃত্যুর ছায়া আসিয়া পড়িল। সেই ছায়া প্রলম্বিত হইয়া এত দূর আসিয়াছে। নদীর ধারে আসিয়া দাঁড়াইলে মাঝে মাঝে মনে হয়, এইখানেই বুঝি যাত্রাশেষ। আর কোথাও যাওয়া হইবে না। আর কোথাও যাওয়ার নাই।
“দশাশ্বমেধের বিশাল ঘাটে পুরোহিত, জ্যোতিষী, গণকার, হেটোমেঠো পণ্ডিতের অভাব নাই। তীর্থস্থানে সর্বত্রই ইহাদের দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের মধ্যে একজনের সহিত আমার কিছু সম্ভাব হইয়াছে। লোকটি বাঙালি। পূর্ববঙ্গেই নিবাস। লোকটি ভৃগুজ্যোতিষী। গ্রামে থাকিতে জ্যোতিষচর্চায় বিশেষ আয়পয় হইত না। কাশী পুণ্যার্থীদের জায়গা বলিয়া এখানে আসিয়া থানা গাড়িয়াছেন। মক্কেল যে বিশেষ জুটিয়াছে তাহা মনে হয় না। তবে নিত্যই বিকালের দিকে আসিয়া একটি শতরঞ্চি পাতিয়া চাতকের ন্যায় বসিয়া থাকেন। দু-একজন আসে, দুই চারি আনা দক্ষিণা পান। দুজনেই প্রায় নিষ্কর্মা বলিয়া আলাপ হইয়া গেল। আলাপ হওয়ার পর বুঝিলাম, মানুষটি লোক ঠকাইয়া খাওয়ার মানুষ নহেন। রীতিমত কষ্ট করিয়া অধ্যবসায় সহযোগে ভৃগু পরাশর আয়ত্ত করিয়াছেন। এই কাশীতেই তিনি যৌবনকালে এক পণ্ডিতের চেলাগিরি করিয়াছিলেন। তাহার নাম ধনঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়।
“জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস পাকা নহে। সব কিছুর মতো এই বিষয়টির প্রতিও আমার ঔদাসীন্য ছিল। ধনঞ্জয়ের সহিত আলাপ হইবার পর একটু কৌতূহল জন্মিল। আমার কোষ্ঠী একটা আছে বটে, কিন্তু কোথায় আছে জানি না। ধনঞ্জয়কে তাই কোষ্ঠী দেখানো হইল না। তবে উনি আমার কররেখা দেখিয়া কিছু আঁক কষিয়া কহিলেন, আপনার দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করার যোেগ দেখছি। আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী সুলক্ষণা।
“একটু বিস্মিত হইলাম! ধনঞ্জয় নিবিষ্টমনে আরও আঁক কষিয়া কহিলেন, আপনি ভূমি ও সম্পদের অধিপতি। সুপুত্রের পিতা। আপনার কোষ্ঠী বিচার করার আর কী আছে?
“আমি কহিলাম, মৃত্যুর কথা কি কিছু বলা সম্ভব?
“উনি বলিলেন, সম্ভব। তবে আরও ভাল করে বিচার করতে হবে। সময়-সাপেক্ষ।
“কয়েকদিনের মধ্যে আলাপ আরও গাঢ়তর হইল। ধনঞ্জয় আমার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলিলেন না। কিন্তু আমি একটি অন্য প্রসঙ্গ তুলিলাম। আমি তাহাকে ধরিয়া পড়িলাম, এ বিদ্যে আমাকে শিখিয়ে দিন।
“আশ্চর্য এই যে, ধনঞ্জয় ইহাতে আপত্তি প্রকাশ করিলেন না। সাগ্রহে বলিলেন, শিখবেন? বেশ তো কাছেই আমার বাসা। সকালের দিকে চলে আসবেন।
“পরদিনই ধনঞ্জয়ের বাসায় গেলাম। নিতান্তই হতদরিদ্র অবস্থা। ব্রাহ্মণী রোগাভোগা মানুষ, নিঃসন্তান। বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া ধনঞ্জয় আমাকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করিয়া শুনাইতে লাগিলেন। প্রথমটায় খটোমটো লাগিল। তারপর বেশ মজিয়া গেলাম।
“নূতন শেখা বিদ্যা পরখ করিতে মাঝে মাঝে মনুর কোষ্ঠী লইয়া পড়ি। কখনও নিজের হস্তরেখা বিচার করি। মনু হাসিয়া বলে, এ কোন নতুন বাই চাপল মাথায়! অত ভাগ্য বিচার করার আছেই বা কী?
“না কিছু নাই। জীবনের বারো আনা পার করিয়াছি। স্রোত এখন মোহনার মুখে। আমার আর ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু আমি তো ভবিষ্যৎ জানিবার জন্য শিখিতেছি না। শাস্ত্রটা কতটা খাঁটি তাহাই বিচার করিতেছি। এসব বুঝাইয়া বলায় মনু বলিল, তাহলে বলো তো আমি সধবা মরব কি না!
“আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। সধবা মরিবে কি না তাহা জানি না। অত পাকা জ্যোতিষী আমি হইয়া উঠি নাই। তবে মনুর কোষ্ঠী বেশ জটিল। ধনঞ্জয়বাবুও আজকাল মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসেন। আমাদের জমিদারি ঠাটবাট এই কাশীর বাড়িতেও কিছু আছে। ঝাড়লণ্ঠন হইতে বার্মা সেগুনের মহার্ঘ আসবাব, খিলান গম্বুজও কিছু কম নাই। উনি কিছু জড়োসড়ো বোধ করেন। একদিন আমি তাহাকে মনুর কোষ্ঠী দেখাইলাম। বহুক্ষণ দেখিয়া এবং আঁক কষিয়া কহিলেন, ইনি অনেকদিন বাঁচবেন।
“ইহা শুনিয়া মনু জনান্তিকে কহিল, মরণ!
“ভাগ্যক্রমে ধনঞ্জয় এবং আমি সমবয়স্ক। বহুকাল আমার তেমন কোনও বন্ধু জোটে নাই। ধনঞ্জয়ের মধ্যে আমি একজন বন্ধুকে পাইলাম। শাস্ত্র শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলি। দিন বেশ কাটিয়া যায়। মানুষের যে বন্ধুকে কত দরকার তাহা ধনঞ্জয়ের সহিত সখ্য হইবার পর বুঝিতে পারিলাম। সকালে বিকালে তাহার সঙ্গ পাইবার জন্য রোজ মন আনচান করে। মনু একদিন কপট রাগের গলায় কহিল এ যে আমার সতীন হয়ে দাঁড়াল দেখছি গো। তোমার যে আর টিকির নাগাল পাই না।
“নৌকায় করিয়া একদিন দুই পরিবার বেড়াইতে বাহির হইলাম। মণিকর্ণিকার ঘাট পার হইয়া অনেকদূর যাওয়া গেল। বেশ লাগিল এই জলভ্রমণটি। মনুর সহিত ধাঞ্জয়ের স্ত্রীরও বেশ আলাপ জমিয়া গেল। কথায় কথায় প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, আমি এস্রাজ বাজাইতে জানি। মনুই আগ বাড়াইয়া প্রচারটি করিল। ইহাতে ধনঞ্জয় আনন্দে উদ্বেল হইয়া কহিল, আমারও কিছু গানবাজনার চর্চা ছিল। তা ভায়া একদিন জলসা বসানো যাক।
“ধনঞ্জয় যে বাস্তবিকই গুণী লোক তাহাতে আর সন্দেহ কী। জলসার দিন সে একজন তবলায় ঠেকা দিবার লোক ও একজন সারেঙ্গিদারকে কোথা হইতে ধরিয়া আনিল। দুজনেরই পাকানো চেহারায় দুর্দশার ছাপ। আমার বৈঠকখানায় সেদিন বিরল-শ্রোতা জলসা খুবই জমিয়া গেল। ধনঞ্জয় পুরানো বাংলা গান চমৎকার সুরে লয়ে গাহিল। আমি এস্রাজ মন্দ বাজাইলাম না। মালকোষ ধরিয়াছিলাম। বাজাইতে বাজাইতে চক্ষু দুইটি বারবার অপূর্ণ হইয়া আসিতেছিল। বারবার কৃষ্ণর কথা মনে হইতেছিল। ইহজন্মে কি আর তাহাকে দেখিব? পিতৃহৃদয় এস্রাজ বাজাইয়া কেবল কাঁদিতেছিল।