“শচীন কহিল, খুব ভাবে। আপনার অসুস্থতার সংবাদ সে শুনেছে। তাই খুব দুশ্চিন্তা।
“যে কয়দিন বিশাখা ও শচীন আমাদের কাছে ছিল সেই কয়টা দিন বড় আনন্দে কাটিয়া গেল। ভাবিতে লজ্জা করে আমরা উভয়পক্ষই নববিবাহিত দম্পতি। আমি ও মনু বয়সে কিছু প্রবীণ, উহারা নবীন। প্রায় একই সময়ে আমাদের বিবাহ হয়। আমার ও মনুর মধ্যে প্রগৰ্ভতা নাই, উচ্ছ্বাস নাই, এক শান্ত তৃপ্তি আছে। উহাদের মধ্যে উচ্ছলতা, প্রগলভতা কিছু বেশি। আমি মনে মনে উভয় দম্পতির তুলনা না করিয়া পারিলাম না। শুধু একটা ব্যাপারে বিশাখা ও শচীনের তুলনায় আমরা পিছাইয়া আছি। আমার ও মনুর সন্তান হয় নাই।
“কয়েকদিন থাকিয়া বিশাখা ও শচীন ফিরিয়া গেল। বাড়িটা বড়ই শুন্য মনে হইতে লাগিল। কিন্তু শুন্যতা ভরিয়া দিতে মনুর জুড়ি নাই। গানে, গল্পে, সেবায় সে আমাকে সর্বদা ঘিরিয়া থাকে। আমার মনের কথাটি মুখে আসিবার আগেই সে কী করিয়া যেন টের পায়। তাই অভাব থাকিতে দেয় না। আমার কাছে তাহার যেন চাহিবার কিছুই নাই, শুধুই দেওয়ার আছে। মনু দিবসরজনী সেই দানযজ্ঞই করিয়া চলিয়াছে। উজাড় করিয়া নিজেকে সে যতই দিতেছে ততই যেন অফুরান হইয়া উঠিতেছে। স্ত্রীলোক আমি বেশি দেখি নাই সত্য, তবু মনে হয় এইরূপ স্ত্রীর পৃথিবীতে অল্পই আছে।
“শীঘ্রই মরিব এমন মনে হয় না। তবু একদিন তো ভবের খেলা সাঙ্গ করিতেই হইবে। তখন মনুর কী হইবে? আমা অপেক্ষা সে বয়সে প্রায় বিশ বৎসরের ছোট। তাহার দেহে মনে কোথাও বয়সের ভাটা পড়ে নাই। সে এখনও দীর্ঘদিন বাঁচিবে। সুতরাং তাহার প্রতি আমার কিছু কর্তব্য থাকিয়াই যায়। তাই কাশীর বাড়িটি আমি তাহার নামে রেজিস্টারি করিয়া দিলাম। ডাকঘরে তাহার নামে অ্যাকাউন্ট খুলিয়া কিছু টাকাও রাখিলাম। কিছু গহনা গড়াইয়া দিলাম যাহা ইহজন্মে তাহার অঙ্গস্পর্শে ধন্য হইবে কি না জানি না। সে গহনা পরে না।
“আমাকে এইসব আঁটঘাঁট বাঁধিতে দেখিয়া একদিন সে হাসিয়া কহিল, যদি মরার কথা ভেবে থাকো তাহলে এই বলে দিচ্ছি, যমের সাধ্যি নেই তোমাকে ছোয়। ঝটা মেরে তাকে তাড়াব।
“আমি কহিলাম, তোমার চেয়ে বয়সে আমি বড়। আমার আগে মরাই তো স্বাভাবিক। তোমাকে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারব না।
“একথায় মনু রাগিল, কাদিল এবং ঝগড়াও করিল। তাহাকে কী করিয়া বুঝাইব? বোধ হয় বুঝাইবার কিছুই নাই। ভালবাসার কাছে পরাজয় মানিয়া লওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি তাহাকে শান্ত করিয়া কাছে টানিয়া লইয়া কহিলাম, তোমার ওরকম স্বভাব কেন বলো তো? যত যাই হোক তুমি তো আমার নতুন বউ। একটা ভাল শাড়ি পরোনা, গয়না পরো না, সাজো না, কিছু আবদার করে চাও না। এরকম হওয়া কি ভাল? যৌবনে যোগিনী সাজার কী হল তোমার?
“সে আমার চোখে বিহুল চোখ রাখিয়া কহিল, আমি সাজব কেন? কাকে ভোলাতে? তাছাড়া আমি বড় বড় ছেলেমেয়ের মা, আমার নাতিপুতি আছে।
“করুণভাবে হাসিয়া কহিলাম, তা বটে, তবে একতরফা। তোমাকে তারা এই জন্মে মা বলে স্বীকার করবে না।
“মনু মাথা নাড়িয়া কহিল, কৃষ্ণ স্বীকার করবে, বিশাখাও করবে। স্বীকার না করলেও দুঃখ নেই। আমি তো জানি, তাহলেই হবে।
“মনু প্রত্যহ বিশ্বনাথ মন্দিরে যায়। আমাকেও টানাটানি করে। মাঝে মাঝে যাইতে হয়। কিন্তু আমি মন্দিরের বিগ্রহে তেমন আকর্ষণ বোধ করি না। বিগ্রহ মূক, স্থবির। মানুষ ইচ্ছা করিলে বিগ্রহকে সামনে রাখিয়া নানা দুস্কার্য করিতে পারে। বিগ্রহ আমাদের শাসন করে না, উপদেশ দেয় না, বিগ্রহের কোনও জীবনদর্শন নাই। আমি বিশ্বাস করি, তিনি যেমন শ্রীকৃষ্ণ বা রামচন্দ্ররূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তেমনই এখনও অবতীর্ণ হন। মানুষ তাঁহাকেই খোঁজে। পরম প্রেমময় করুণাঘন, সর্বজ্ঞ, মানুষের প্রতি তাঁহার ভালবাসার শেষ নাই। ঈশ্বরকে আমি মানুষের মধ্যেই পাইতে চাই। কিন্তু মনু তত প্রাজ্ঞ নহে। সে ঠাকুরপূজা বোঝে। এই ব্যাপারে তাহার সহিত আমার কিছু মতভেদ আছে। কখনও কখনও তর্কও হয়। মনু শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়া কহে, বেশ তো, তোমার কথাই মেনে নিচ্ছি।
“আমি বলি, মানবে কেন? বুঝতে হবে।
“সে মাথা নাড়িয়া বলে, অত বুঝে কাজ নেই। আমি এই বেশ বুঝেছি আমার ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সব তুমি। আর ঠাকুরে আমার দরকার নেই। বিশ্বনাথ মন্দিরে যাই তোমার কথাই বলে আসতে। বলি, ও দেবতা, আমার দেবতাটিকে ঠিক রেখো।
“উচ্চৈস্বরে হাসিয়া ফেলি। আমাকে দেবতা বানাইয়াও তাহার ভয় কাটিতেছে না। আর একজন দেবতাকে রক্ষক হিসাবে ধার করিতেছে।
“মাঝে মাঝে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়া বসি। একা একা নিজের জীবনের কথা বসিয়া বসিয়া ভাবি। বছরের হিসাবে অনেক দিন পৃথিবীতে আছি বটে, কিন্তু এই জীবনের পরিসর কতটা? গভীরতাই বা কতখানি? আত্মগ্লানিতে মনটা বড় তিক্ত হইয়া ওঠে। আমি আত্মমুগ্ধ অন্ধ নহি। নিজের দোষ ত্রুটি দুর্বলতা কোনও কিছুকেই এড়াইয়া যাই না। জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করায় আমাকে খাটিয়া খাইতে হয় নাই। যদি উপার্জন করিতে হইত তবে আমি কী করিতাম? অর্জনপটু হইতে পারিতাম কি? না কি উঞ্ছবৃত্তি করিয়া নাজপৃষ্ঠ অকালবৃদ্ধ খিটখিটে এক কৃপণে পরিণত হইতাম?
“নিজেকে লইয়া আমার এই নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাও হয়তো একপ্রকার আত্মরতি। কিন্তু আমার সমস্যাও যে নিজেকে লইয়াই। উত্তরবাহিনী গঙ্গা ওই যে অবিরল বহিয়া চলিয়াছে উহার স্রোতোধারার মধ্যে যে অবিরল চরৈবেতি-চরৈবেতি মন্ত্র জপ হইয়া চলিয়াছে জীবনের মূলমন্ত্রও তাহাই। চলো, অগ্রসর হও, তীব্রতা ও ক্রমাগতিতেই জীবনের সৌন্দর্য ও সার্থকতা। নদীর বিশ্রাম নাই, ঘুম নাই, আছে শুধু চলা। উৎস হইতে মোহনা পর্যন্ত তাহার গতিতে কোথাও মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটে নাই। যতক্ষণ জীবন, যতক্ষণ গতি, ততক্ষণ মৃত্যু নাই।