কী কথা?
কাজের কথাই। তা সে আর সময় হবে না। তবু তুমি আজ বাড়িতেই থেকে। যদি সম্ভব হয় তবে এয়ারপোর্টে আমার সঙ্গে যেয়ো। রাস্তায় বলা যাবে।
কিন্তু সেটাও সম্ভব হল না। বিকেল পর্যন্ত কৃষ্ণকান্ত ফিরতে পারলেন না। ফোন করে তার জিনিসপত্র এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিতে বললেন। তারপর ফোনেই ধ্রুবকে ডেকে বললেন, সব দিক সামলে চলো। সাবধানে থেকো। এখন তুমিই অভিভাবক।
ধ্রুব বলল, ঠিক আছে।
বউমাকে একটু যত্ন কোরো। লতুর বিয়ের কথা ভুলো না। সব তোমাকেই করতে হবে।
চেষ্টা করব।
চলি।
আচ্ছা।
ফোন রেখে দিল ধ্রুব। কিন্তু সে একটা অস্থিরতা বোধ করছিল ভিতরে-ভিতরে! এটার কোনও কারণ নেই। অন্তত কারণ কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
১০৫. কাশী আসিবার পর
“কাশী আসিবার পর চার বৎসরের বেশি অতিক্রান্ত হইল। ইতিমধ্যে কত কী ঘটিয়া গেল। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কত ঘটনার চমক। তবে তাহার ঢেউ আমাকে বড় একটা স্পর্শ করে না। রাজনীতিতে আমি কোনওদিনই জড়িত নহি। শুধু প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের জন্য যেটুকু খবর রাখা আবশ্যক তাহাই রাখি। একদিন কানে আসিল, কৃষ্ণকান্তকে দিল্লি লইয়া যাওয়া হইয়াছে। ভোলানাথ সরকার নামক পাবনার আশ্রমবাসী এক ভদ্রলোক আসিয়া একদিন খবর দিয়া গেলেন, পাবনায় অন্তরিন থাকিবার শর্তে কৃষ্ণকে মুক্তি দেওয়া হইবে। আমার নানা প্রশ্নের জবাবে তিনি যাহা জানাইলেন তাহা কিন্তু বিস্ময়কর। কৃষ্ণ ঢাকায় আত্মসমর্পণ করিলে তাহাকে গ্রেফতার করিয়া দিল্লিতে চালান দেওয়া হয়। তাহার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোেগ ছিল, যাহাতে ফাঁসি বা দ্বীপান্তর নিশ্চিত। পাঁচ বৎসরের মেয়াদ সেই তুলনায় কিছুই না। সেই মেয়াদ ফুরাইবার আগেই সে মুক্তি পাইল। আশ্রমবাসী কতিপয় ব্যক্তি গিয়া দিল্লিতে দরবার করায় সরকার খুবই আকস্মিক ও অদ্ভুত ভাবে তাহাদের আবেদন মানিয়া লন।
“ইহার কিছুদিন পর পাবনা আশ্রম হইতে কৃষ্ণর চিঠি আসিল। সে লিখিয়াছে, আপনি চিন্তা করিবেন না, আমি ভাল আছি। তারপর অন্যান্য সব কথা। আমার ও মনুর প্রসঙ্গ সে এড়াইয়া গিয়া শুধু লিখিয়াছে, নূতন মাকে প্রণাম দিবেন।
“চিঠি পড়িয়া মনু রাগিয়া বলিল, আমি আবার ওর নতুন মা হতে গেলাম কবে? আমিই তো আসল মা, শুধু ডাকের পিসি ছিলাম। এখন শুধু মা বলে ডাকবে, নয়তো পিসি, ওকে লিখে দাও।
“আমি হাসিয়া কহিলাম, তুমি ওর পিসি হলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয় ভাইবোন। সেটা কি ভাল দেখাবে?
“কৃষ্ণ যে আর ঘরের ছেলে হইয়া ঘরে ফিরিবে না তাহা মনে মনে বুঝিতে পারিতেছিলাম। তাই তাহার বিরহের অনুভূতিও ধীরে ধীরে তীব্রতা হারাইতেছিল। উপরন্তু আমি এই অগ্র বয়সে আজ কিছু গৃহসুখ উপভোগ করিতেছি। লজ্জার মাথা খাইয়া বলি, নারীপ্রেমও। ফলে প্রিয়জনদিগের সহিত বিচ্ছেদ সত্ত্বেও তেমন একটা অভাব কিছু বোধ করি না। সম্ভবত ইহাই মানবের ধন, ইহাই সত্য।
“আজকাল আলস্যে সময় কাটাইব সাধ্য কী? মনু নতুন সংসার পাতিয়াছে, সুতরাং সেই সংসারের জোগানদার, বাজার সরকার, বরকন্দাজ সব ভূমিকাই আমাকে পালন করিতে হয়। আমি কর্মচারী নিয়োগের কথা তুলিয়াছিলাম, মনু আমল দেয় নাই। তার বক্তব্য, এতটুকু সংসারে একজন বাজার সরকার বা হিসাবরক্ষকের দরকার নাই। জমিদারের ঠাটবাট কিছু ছাড়িতে হইবে। বুড়াবয়সে যাতে বাতে না ধরে তাহার ব্যবস্থাও করিতে হইবে। একজন ঝি ও একজন চাকর সম্বল করিয়া আমাদের চলিতেছে।
“এইসব কাজ করিতে আমার খারাপও লাগে না। তাছাড়া কাশীতে বাজার করিয়া সুখ আছে। আমাদের দেশ বেগুনের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে দেখিলাম তদপেক্ষা বৃহৎ ও সুস্বাদু বেগুন মিলে। অন্যান্য সবজির স্বাদও ভাল। মনুর রান্না তো চমৎকারই। রাবড়ি, প্যাড়া ইত্যাদিও এখানে সস্তা ও খাঁটি। গুরুভোজনে আমার কোনওকালেই আসক্তি নাই। কিন্তু সুস্বাদু খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ আছে। সুতরাং নতুন সংসারে এবং নতুনরকম জীবনধারায় প্রবেশ করিয়া অতীতের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিতে যে ক্লেশ বোধ করিতে পারিতাম তাহার অনেকটাই মনু নানাভাবে নিবারণ করিয়াছে। তাহার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
“কনক বা জীমূত এবং আমার জ্যেষ্ঠা দুই কন্যা বড় একটা খোঁজখবর করে না। ইহাতে দুঃখ অনুভব করি না। কারণ এইরূপই ঘটিবার কথা। তবে বিশাখা ও শচীন একদিন আকস্মিকভাবে আসিয়া কাশীতে হানা দিল। বিশাখার কোলে একটি ফুটফুটে শিশু। তাহাদের পাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইলাম।
“শচীন জনান্তিকে আমাকে জানাইল, পাবনা হইতে কৃষ্ণকান্ত আবার উধাও হইয়াছে। আমাকে দুশ্চিন্তা করিতে নিষেধ করিয়া শচীন বলিল, সে সম্ভবত আপনার কাছে আসবে।
“আমি অবাক হইয়া কহিলাম, কী করে জানলে?
“সে হাসিয়া কহিল, পাবনায় আমি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আর কারও জন্য নয়, আপনার জন্য সে সবসময়েই বেশ উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল।
“বুকটা ভরিয়া গেল। স্নেহ স্বভাবত নিম্নগামী। পিতা যেমন পুত্রকে স্নেহ করেন, পুত্র ততটা স্নেহ পিতাকে করিতে পারে না। আমার ক্ষেত্রে স্নেহের প্রকৃতি আরও বিচিত্র। কৃষ্ণ ছাড়া অন্যান্য পুত্রকন্যার সহিত আমার তেমন সম্পর্ক রচিত হয় নাই। কৃষ্ণ আমাকে কিছু স্নেহ করে জানিতাম। আজ আবার নতুন করিয়া তাহার ব্যাকুলতার কথা শুনিয়া আমার ক্ষুধার্ত পিতৃত্ব জাগিয়া উঠিল।
“কহিলাম, আমার জন্য সে কি খুব ভাবে?