কী গো, না বলে কয়ে চলে গেছ যে বড়! খেয়েও যাওনি!
যা অবস্থা দেখলাম ভাই, তাতে মনে হল আজ ধ্রুব চৌধুরীর মতো একজন নগণ্য লোককে অফিসের ভাত দেওয়ার কথা কারও খেয়াল হওয়ার নয়।
বাজে কথা বোলো না। সব রেডি ছিল। ঘরে এসে দেখি বাবু নেই।
বাবু যে নেই তা এতক্ষণে খেয়াল হল?
বাড়ি ভর্তি লোক, সকলের তদারক করতে হচ্ছে না! আমি তো ধরে নিয়েছি তুমি কোথাও আড্ডা মারতে গেছ।
বাঃ, চমৎকার।
ইয়ার্কি কোরো না। কিছু খেয়েছ?
খেয়েছি। ওটা কোনও প্রবলেম নয়।
রাগ করোনি তো!
আরে না।
দিব্য ভীষণ দুষ্টুমি করছে, ফোন ছাড়লাম।
আচ্ছা।
দ্বিতীয় ফোনটা কৃষ্ণকান্তর। কদাচিৎ তিনি ধ্রুবকে ফোন করেছেন। আদৌ কোনওদিন করেছেন কি না তাই আজ ধ্রুব মনে করতে পারল না।
ধ্রুব? আমি কৃষ্ণকান্ত বলছি।
কথাটা ধ্রুবর কানে খট করে লাগল। ধ্রুব যে কৃষ্ণকান্তকে বাবা বলে ডাকে না এটা হয়তো তারই পালটি।
ধ্রুব একটু চমকে উঠলেও স্বাভাবিক স্বরেই বলল, বলুন।
তুমি বোধহয় আজ বউমাকে না জানিয়েই অফিসে চলে গেছ। বউমা খুব চিন্তা করছিল।
একটু কাজ ছিল, তাই।
তা থাকতেই পারে। বউমা ভাবছিল বলেই আমি তোমার খবরটা নিলাম।
আচ্ছা।
আজ সকালে বাড়িতে অনেক লোক এসেছিল। মোস্ট ডিস্টার্কিং। তবে আমি লোককে ফিরিয়ে দিতেও পারি না। তোমাদের হয়তো একটু অসুবিধে হয়েছে।
না, অসুবিধে কীসের? আমি তো ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে ভিড় দেখছি।
তা অবশ্য বটে। এখন বড় হয়েছ, নিজস্ব মতামত হয়েছে। বলে কৃষ্ণকান্ত একটু থামলেন। তারপর বললেন, আমি আগামীকাল দিল্লি যাচ্ছি। বিকেলের প্লেনে। আমার ইচ্ছে কালকের দিনটা তুমি বাড়িতেই থাকো।
ধ্রুব একটু অবাক হয়ে বলল, আমি!
হ্যাঁ। যদি একটু অসুবিধে হয়ও তবু চেষ্টা করো।
আচ্ছা।
আমি হয়তো শিগগির ফিরব না। বউমা খুব কান্নাকাটি করছে। দিব্যর জন্য আমারও মনটা খারাপ হবে। তবু কী আর করা!
ধ্রুব কী বলবে! চুপ করে রইল।
কৃষ্ণকান্ত একটু গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর বললেন, কালকের দিনটার কথা ভুলে যেয়ো না।
না, ভুলব না।
কৃষ্ণকান্ত ফোন ছেড়ে দিলেন।
ধ্রুবর শরীরটা হঠাৎ খুব শিথিল এবং শীতল লাগতে লাগল। কৃষ্ণকান্তর হলটা কী?
সন্ধেবেলাই আজ ধ্রুব বাড়ি ফিরে এল। কেন এল তা সে নিজেও জানে না। এসে ভাল ছেলের মতো মুখ-টুখ ধুয়ে একটা চেয়ারে বসে একখানা বই খুলল। রেমি ঘরে নেই। বোধ হয় ওপরে শ্বশুরের গোছগাছ করে দিচ্ছে। বইখানা খুলেও ধ্রুব কিছু পড়তে পারছিল না। মনটা চঞ্চল।
কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে থাকলে কতগুলো লক্ষণ দেখে তা বোঝা যায়। বাড়িটা নিস্তব্ধ থাকে, চাকর-বাকরেরা ফিস ফিস করে কথা বলে, বাসনের শব্দ হয় না, কেউ রেডিয়ো চালায় না বা হঠাৎ গান গেয়ে ওঠে না, পা টিপে টিপে হাটে। এমনকী বাড়ির আবহাওয়াটাও যেন একটু থমথমে থাকে। ধ্রুব সেই আবহাওয়াটা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল। তারপর বুঝল, কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে নেই। বই রেখে সে ওপরে উঠে এল।
কৃষ্ণকান্তর ঘরে বাস্তবিকই রেমি বিশাল এক ফাইবার গ্লাসের স্যুটকেস গোছাতে বসেছে। তাকে সাহায্য করছে দুজন ঝি।
কী করছ?
গোছাচ্ছি। বাবা কাল দিল্লি যাচ্ছেন।
জানি।
তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে!
এমনি। ছেলেটা কোথায়?
ঘুমোচ্ছে।
এত ঘুমোয় কেন ওটা?
বাচ্চারা ঘুমোয়, ওটাই নিয়ম। কেন? তোমার কি একটু ছেলেকে আদর করতে ইচ্ছে করছে?
না বাবা, আদর করতে হলে তো বোধ হয় ডেটল দিয়ে হাত-মুখ ধুতে হবে! অতটা পেরে উঠব না।
ডেটল না হলেও চলবে। সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুলে আর বাধা নেই। বাচ্চাদের চট করে ইনফেকশন হয় বলেই শ্বশুরমশাই সাবধান হয়েছেন। ওরকম বাঁকা ভাবে সব কথা ধরো কেন?
তোমার শ্বশুরমশাই কোথায়?
পার্টির কী একটা জরুরি মিটিং-এ গেছেন। জানো, আজ প্রাইম মিনিস্টারের ট্রাংকল এসেছিল?
বলো কী! তাহলে তো আমরা ধন্য। বাড়িতে আলোকসজ্জা করতে বলো।
ফের ইয়ার্কি?
তা প্রাইম মিনিস্টার কী বলল?
কী করে জানব?
ধ্রুব একটু হাসল। তারপর বলল, তোমার শ্বশুর একটা অদ্ভুত আবদার করেছেন।
কীসের আবদার?
কাল উনি দিল্লি যাবেন বলে আমাকে বাড়িতে থাকতে বলেছেন।
তাই নাকি? তুমি রাজি হলে?
হলাম। উনি নাকি দিল্লি থেকে আর সহজে আসছেন না।
তাই শুনছি। কী যে খারাপ লাগছে!
তুমিও দিল্লি গেলে পারো। যাবে?
সে কি আর বলতে বাকি রেখেছি ভাবো?
উনি কী বললেন?
বললেন, বউমা, তুমি গেলে আমার ছেলেটাকে কে দেখবে?
বটে! এত বড় কথা!
কেন বড় কথার কী হল?
বড় কথা নয়? আমি কি ছেলেমানুষ?
তুমি তার চেয়েও অধম।
কৃষ্ণকান্ত ফিরলেন অনেক রাতে। সঙ্গে এক দঙ্গল লোক। অনেক রাত অবধি বৈঠকখানায় মিটিং চলল। ধ্রুবর সঙ্গে চোখাচোখিও হল না। ঘুমও হল না তার। মনটা চঞ্চল। ভীষণ চঞ্চল। রাত তিনটের সময় উঠে সে দু পেগ-এর মতো হুইস্কি খেল জোর করে। দশ মিনিটের মধ্যে পেটে প্রবল ব্যথা উঠল। হুইস্কিটা গলায় আঙুল দিয়ে তুলে ফেলতে হল তাকে। তারপর সারারাত এক ধরনের মানসিক ছটফটানির মধ্যে ছেঁড়া-ছেড়া তন্দ্রা এল মাত্র।
পরদিন ধ্রুব অফিসে গেল না। কিন্তু তা বলে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে তার ভাল করে দেখাও হল না। কৃষ্ণকান্তকে সকাল থেকেই ফের হেঁকে ধরেছে লোক। বেলা দশটায় পার্টি অফিসে যাওয়ার আগে ধ্রুবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে ভাল করে দুটো কথাও বলতে পারছি না আজ। বড় ঝামেলা হয়েছে। অথচ কয়েকটা কথা বলার ছিল।