উনি যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। তার মধ্যে ষড়যন্ত্র থাকবে কেন?
নেই বলছ?
ওঁর বিষয়-সম্পত্তি তো কম নয়। আমি মেয়েমানুষ, সামলাতে পারব না বুঝেই তোমাকে ভার দিয়েছেন।
এমন নয় তো রেমি যে, তোমাকে উনি আর বিশ্বাস করেন না। কিংবা তেমন ভালও বাসেন না আর!
কক্ষনও নয়। ওঁর ভালবাসা উপচে পড়ে। মাপা জিনিস নয় সেটা। তুমি বুঝবে না।
তাহলে কেসটা কী?
আমি ওঁর কাছে যাই।
হিপনোটাইজড। কমপ্লিটলি হিপনোটাইজড।
বেশ। হিপনোটাইজড তো হিপনোটাইজড।
ধ্রুব হাত বাড়িয়ে রেমির একখানা হাত ধরল, শোনো রেমি। আমি ফের তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, বাস্তবিকই কৃষ্ণকান্ত লোকটি কী রকম? উনি কি জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার উপযুক্ত?
একশোবার উপযুক্ত। ওরকম মানুষ দেশে বেশি নেই।
তাহলে সেটা আমি ফিল করি না কেন?
সেটা তোমার দোষ।
হি কিলড হার।
কী বললে?
হি কিলড মাই মাদার।
কক্ষনও নয়। এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল ব্যাখ্যা করছ।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেমির হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, যাও, প্রণাম করে এসো।
তুমিও চলো না।
আমি ওঁকে প্রণাম করি না।
ছিঃ, কী যে হচ্ছ দিন দিন!
উনি জন্মদাতা মাত্র। তার বেশি কিছু নন। তুমি যাও।
রেমি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।
ধ্রুব আবার খবরের কাগজটা তুলে নেয়। অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকে খবরটার দিকে। পড়ে না। শুধু চেয়ে থাকে।
আজ সকাল থেকে অবিরাম টেলিফোন বেজে যাচ্ছে। অজস্র লোকের আগমনও ঘরে বসে টের পাচ্ছে ধ্রুব। এ এক অলিখিত উৎসব। খবরটা বেরোনোর পর লোকের মনে নানা আশা আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা উদ্বেল হয়ে উঠেছে তাই তারা থাকতে না পেরে আগাম সেলাম বাজাতে চলে এসেছে। মেরুদণ্ডহীন অয়েল মাস্টারস। এদের নিয়েই কৃষ্ণকান্তর কারবার। এদের ক্ষুধাতৃষ্ণা লোভ লালসা মিটিয়ে তারপর এদের কাঁধে ভর দিয়েই কৃষ্ণকান্তকে চলতে হবে। তার আর উপায় নেই।
করিডোরের মুখে দাঁড়ালে বাইরের ঘরের দৃশ্য খানিকটা দেখা যায়। ধ্রুব নিঃশব্দে উঠে এসে দাঁড়াল। প্রচুর লোক হা হা, হি হি করে উল্লাস জানিয়ে যাচ্ছে। মস্ত এক একক সোফায় কৃষ্ণকান্ত সমাসীন। উনি লোকের তোষামোদ এবং সাধুবাদ গ্রহণ করতে খুব ভালবাসেন। ভালবাসেন তুতি ও অন্যের মুখে নিজের গুণকীর্তন। ভালবাসেন লোককে ভয় দেখাতে এবং ভেঙে ফেলতে। নিজেকে ছাড়া উনি আর কিছুই বোঝেন না।
ধ্রুব বিষাক্ত এক দৃষ্টিতে দৃশ্যটা দেখছিল। ঘোমটা মাথায় রেমি শ্বশুরের সোফার পিছনে দাড়িয়ে। তার মুখে অহংকার জ্বলজ্বল করছে। সামনে স্তাবকের দল। তাদের মুখ বিগলিত, চোখ সশ্রদ্ধ, দেহ বিনয়ে নজ। জাদুকর তার সম্মোহন বিস্তার করে রেখেছেন চারধারে।
ধ্রুব মুখ ফিরিয়ে নিল। ঘরে এসে পোশাক পরে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাইরে।
যখন অফিসে এসে পৌঁছল তখন অফিস শুরু হতে অনেক দেরি। ফাঁকা ঘরে বসে ধ্রুব চুপচাপ চেয়ে রইল। সে এখনও জানে না, কৃষ্ণকান্তের ওপর তার এই বিরাগের প্রকৃত কারণ কী? সত্য বটে এক সময়ে নিজের পরিবারকে তিনি বড় হেলাফেলা করেছিলেন। তাঁর অমনোযোগ এবং নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যই তাঁর স্ত্রীকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ধ্রুবর মনে আছে মরার আগে তার মা যে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন তাতে স্পষ্ট ভাষায় তিনি তার স্বামীকে নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী। করে যান। এ গেল স্ত্রীর কথা। নিজের সন্তানদের সঙ্গেও কৃষ্ণকান্তর কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। নিজের পরিবারের চেয়ে ভোটদাতা বা দলীয় কর্মীদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া অনেক বেশি। বড় এবং ছোট দুই ছেলে তার অবহেলাতেই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। মেয়ে লতু বাড়িতে থেকেও নেই। বুড়ো বয়সে যখন আর আপনজন বলতে কেউ অবশিষ্ট নেই তার, তখন রেমিকে আঁকড়ে ধরেছেন কাঙাল ছেলের মতো। পরোক্ষে তোয়াজ করছেন ধ্রুবকেও। কিন্তু ধ্রুব মনে-প্রাণে লোকটিকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছে না। এই মানুষের সঙ্গে তার কোনও আত্মীয়তা গড়ে ওঠেনি যে!
ধ্রুবর কি কোনও দোষ নেই? আছে। কৃষ্ণকান্তর বিপুল প্রভাব ও প্রতিপত্তি সে দেখে আসছে জ্ঞান হওয়ার সময় থেকে। বিখ্যাত ও প্রভাবশালী পিতাদের পুত্ররা বড় হতভাগ্য। বাপের জ্যোতির পাশে তারা মিট মিট করে। ক্ষমতা, প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব থাকলেও তা সহজে স্বীকৃতি পেতে চায় না। লোকে তাদের আমল দেয় না। এই সত্য ধ্রুব খুব ছেলেবেলা থেকে টের পেয়ে আসছে। তার কোনও আলাদা সম্মান নেই, স্বীকৃতি নেই, তার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারেনি নিজের মতো করে। কৃষ্ণকান্তের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া ধ্রুবর সামনে আর কোন পথই বা খোলা ছিল? আর-একটা পথ ছিল। তা বিদ্রোহের এবং বিনাশের। বিখ্যাত বাপের কুপুত্ররা কিছু মনোযোগ পায়। ধ্রুব দ্বিতীয় পন্থা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও পৌছোতে পারেনি, কিছু লাভ হয়নি।
আজ কৃষ্ণকান্ত তাকে দয়া করছেন। দয়া ছাড়া আর কী? নিজেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিচ্ছেন, ধ্রুবকে দিয়ে যাচ্ছেন দায়দায়িত্ব। বিকশিত হওয়ার সুযোগ। ইটের নীচে চাপা ঘাস হলুদবর্ণ ধারণ করেছে, এখন ইট সরে গেলে হয়তো বা সবুজ হয়ে উঠবে। কিন্তু এই দায়টা নিতে হচ্ছে বলে ধ্রুবর ভিতরটা আজ তেতো, বিষাক্ত।
অফিসে আজ অনেকেই তাকে অভিনন্দন জানাতে এল। তার বাবা কেন্দ্রে মন্ত্রী হচ্ছেন, সোজা কথা তো নয়। অভিনন্দনটা ধ্রুবর পাওনা নয়। কিন্তু সে হাসিমুখেই কৃষ্ণকান্তর পাওনা গ্রহণ করল। টেলিফোনটা এল দুপুরে। প্রথম রেমির।