খবরটা ছাপা হওয়ার পর আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিত মহলে একটা উল্লাসের হাওয়া বয়ে গেল। সর্বভারতীয় এই পরিচিতি কৃষ্ণকান্তর তো পাওনাই ছিল। দেশের জন্য তিনি তো কিছু কম করেননি!
এ খবরে উল্লসিত হল না শুধু ধ্রুব। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটু চোখ বুলিয়ে খবরের কাগজটা ফের টেবিলে ফেলে রেখে রেমিকে বলল, তোমার শ্বশুর আবার মন্ত্রী হচ্ছেন, খবর রাখো?
না তো!
খবরের কাগজে আছে। সেন্ট্রাল মিনিস্টার। ল্যাজ বেশ মোটা হল।
ও কী রকম কথা! ছিঃ।
ল্যাজ মোটা নয়? ওয়েস্ট বেঙ্গলের মতো একটুখানি এক রাজ্যে গণ্ডুষজলের সফরী আর তো নয়। এবার ভারতবর্ষের মতো বিশাল চারণভূমি।
যোগ্য বলেই ওঁকে নিচ্ছে।
হ্যাঁ, যোগ্য বই কী, ভাল চেঁচাতে পারেন। পার্লামেন্টে ওঁর ভয়েস ভালই শোনা যাবে।
উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না।
ধ্রুব ফের খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে খবরটার দিকে চেয়ে রইল। সে খবরটা দেখছিল না। সে ভাবছিল। কৃষ্ণকান্ত কলকাতার পাট প্রায় চুকিয়ে দিলেন। তাকে চাবি দিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সার উত্তরাধিকার দিয়েছেন। আর দিচ্ছেন দুর্লভ স্বাধীনতা। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য তেমন কোনও বিলিব্যবস্থাও করেননি। সম্ভবত সেটাও ধ্রুবর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। এটাকে কৃষ্ণকান্তর মহৎ ত্যাগ বলে ধরে নিতে পারত ধ্রুব। বা এক ধরনের বানপ্রস্থ। কিন্তু তা তো নয়। কৃষ্ণকান্ত চললেন বৃহত্তর মৃগয়ায়। ধ্রুব জানে, কৃষ্ণকান্ত সাদামাটা ভাবে চোর নন, ঘুষ নেন না। কিন্তু তার দুর্নীতির রকমটাই আলাদা, যাকে দুর্নীতি বলে চেনাও যাবে না। অগাধ প্রশাসনিক ক্ষমতা ভোগ করতে করতে ভিতরের কঠিন নীতিবোধ গলে জল হয়ে যায়। আর সেই ক্ষমতার রন্ধ্রপথেই ঢোকে ক্ষমতার নানারকম অপব্যবহার। আসে দাম্ভিকতা, অত্যাচারী মনোভাব, আসে পরমত-অসহিষ্ণুতা। ভাল-মন্দের বিচারবোধ লুপ্ত হয়ে যায়। অতীতের ব্রহ্মচারী, ত্যাগব্রতী স্বদেশপ্রেমিক কৃষ্ণকান্ত খুব ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে নেমেছেন নীচে। তার পতন তিনি নিজেও টের পাননি কখনও। অতীতের কঠিন আদর্শপ্রাণতা কবে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আদর্শের কথা তিনি মুখস্থ বলে যান মাত্র, সেগুলোকে অপরিহার্য বলে বোধ করেন না, পালনযোগ্য বলে মনে করেন না।
ধ্রুব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রেমি তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে সাবধানে মশারিতে ঢাকা দিল। তারপর এসে ধ্রুবর হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে সাগ্রহে খবরটা পড়ল। তারপর বলল, এ মাঃ!
কী হল!
সেন্ট্রাল মিনিস্টার! তার মানে তো ওঁকে দিল্লিতে থাকতে হবে।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
উনি দিল্লি গেলে চলবে কী করে? চলবে না কেন?
বাঃ, এদিক সামলাবে কে?
কী সামলানোর আছে? একরত্তি একটু সংসার। এটা সামলানোর জন্য কৃষ্ণকান্তর মতো বৃহৎ মস্তিষ্কের দরকার কী? উনি ভারতবর্ষের জনগণের বৃহৎ সংসার সামলানোর পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে যাচ্ছেন, রেমি।
আর দিব্য! ওকে ছেড়ে উনি থাকতে পারবেন?
পারার কী আছে? উনি একদিন ওঁর প্রিয় বাবা এবং সংসার ছেড়েছিলেন। দীর্ঘদিন জেলে কাটিয়েছেন। বিয়ের পরই ওঁকে একবার গ্রেফতার করা হয়। তখন সদ্য পরিণীতা স্ত্রীকে ছেড়েও থাকতে হয়েছে। বৈরাগ্য ওঁর রক্তে।
ঠাট্টা করছ?
বাপ রে, ওঁকে নিয়ে ঠাট্টা! ডন কুইকসোটকে নিয়ে ঠাট্টা চলে নাকি?
কে ডন কুইকসোট! শ্বশুরমশাই! তাহলে ওঁকে তুমি ছাই চেনো।
সেটা ঠিক। আমি ওঁকে চিনি না। কে বলো তো লোকটা? কেমন লোক?
ফের ইয়ার্কি? চুপ করো।
কেন চুপ করব, রেমি? আমি ভারতের জনগণের একজন। আমার জানার অধিকার আছে, আমাদের পরবর্তী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটি কেমন লোক।
ভাল লোক। এত ভাল লোক কোথাও পাবে না। তোমার ভারতবর্ষের অনেক ভাগ্যি যে ওর মতো লোক মন্ত্রী হচ্ছেন।
সাবাস, এ না হলে পুত্রবধূ!
শুধু পুত্রবধূ নই, আমি ওঁর মেয়েও।
তুমি পারো বটে, রেমি। এত জেনে এত বুঝেও অন্ধ। হিপনোটাইজড অ্যান্ড ব্রেন-ওয়াশড।
বেশ। আমরা কিছু লোক এই রকমই অন্ধ এবং হিপনোটাইজড হয়ে থাকতে থাকতে চাই। লেট আস বি হোয়াট উই আর।
ওটা যুক্তি হল না।
এটাই যুক্তি মশাই, কারণ এই হিপনোটিজম অনেক চেষ্টা করেও তুমি ভাঙতে পারেনি। আমাদের জ্ঞানচক্ষুও খুলতে পারোনি। পেরেছ, বলো?
তাই দেখছি।
তাহলে এবার স্বীকার করো, ওঁর মধ্যে একটা দারুণ পজিটিভ ফোর্সও আছে।
ছিল।
এখনও আছে। তুমি অপোজিশনের লোক বলে টের পাও না।
অপোজিশন?– বলে ধ্রুব খুব হোঃ হোঃ হাসল।
অপোজিশনই তো। তাছাড়া আর কী বলা যায় তোমাকে?
বেশ বলেছ! আসলে কী জানো? আমরা হচ্ছি সোরাব রুস্তম।
আমি একটু ওঁর কাছে যাই, প্রণাম করে আসি।
যাও।
কিন্তু উনি দিল্লি চলে গেলে যে কী করে এই ভূতের বাড়িতে থাকব। সংসারটাই বা কে সামলাবে কিছু বুঝতে পারছি না।
উনি পরশুদিন আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তার মানে?
মানে আমাকে কলকাতার সিংহাসনে অভিষিক্ত করেছেন।
কী বলতে চাইছ?
আরও বুঝিয়ে বলতে হবে?
জানোই তো আমি একটু বোকা।
উনি আমার হাতে সিন্দুক আলমারি ইত্যাদির চাবি তুলে দিয়েছেন।
তোমার হাতে! বলো কী?
আমিও বিস্মিত এবং তোমার মতোই বজ্রাহত, রেমি। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে।
তুমি চালাবে?
তা বলতে পারি না। তবে কৃষ্ণকান্ত দি গ্রেট-এর এটা একটা নতুন চালও হতে পারে। মে বি হি ইজ হ্যাচিং সামথিং, নইলে আমার হাতে চাবি কেন? মাইন্ড ইউ মাই ডিয়ার, তুমি ওঁর এত আপন, এত বিশ্বস্ত এবং প্রিয়পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও চাবির গোছা তোমার হাতে দেননি। অথচ সেটাই স্বাভাবিক হত।