“বিবাহসভায় ঘটা হইয়াছিল মন্দ নহে। আমার বিরূপ আত্মীয়স্বজনেরা কিছু নিষ্প্রভ ছিল। কিন্তু অভ্যাগতের সমাগম আমার কলঙ্ক সত্ত্বেও বড় কম হয় নাই। সামনের উঠানটিতে ভিড় উপচাইয়া পড়িতেছিল। বিবাহবাসরের একপার্শ্বে কয়েকখানা চেয়ারে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সমাসীন। গোলাপজল ও আতরের গন্ধে চারিদিক ম ম করিতেছে। কলকোলাহলে অনুষ্ঠান পরিপূর্ণ। ভিতরে ভিতরে কীটের দংশন হয়তো ছিল।
“রাজেনবাবু আমার পাশেই উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ নিম্নস্বরে কহিলেন, আপনার আত্মীয় কুটুম্বরা বোধহয় খুব খুশি নন?
না। খুশি হওয়ার কথাও নয়।
“রাজেনবাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, জানি। বুঝিও সব। আপনার এই অপমানের জন্য আমি নিজেও খানিকটা দায়ী।
ও কিছু নয়। সংসার বিচিত্র জায়গা।
তা বলে আমি নিজেকে অপরাধী ভাবছি না। রঙ্গময়ীর সঙ্গে আপনার বিয়ে হওয়াটার পিছনে একটা কারণ ছিল।
আপনি তো আমাকে তাও বলেছেন।
আপনার আত্মীয়দেরও কারণটা আমি বুঝিয়ে বলতে চাই।
তার দরকার কী? ওরা বুঝতে চাইবে না।
“রাজেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া কহিলেন, সে কথাও ঠিক। এ সংসারে যে যার নিজের সুবিধেমতো ঘটনাবলীর অর্থ বা ব্যাখ্যা করে নেয়। আমরা আমাদের মতো ব্যাখ্যা করেছি। ওরা ওদের মতো করবে। কিন্তু আমি ভাবছি, আপনার মানসিক চাপের কথা। আপনাকে অনেক সইতে হচ্ছে তো! শরীরটাও তাই বোধহয় খারাপ!
শরীর সেরে যাবে। এখন ভালই আছি। আমার কোনও অনুশোচনা নেই।
“রাজেনবাবু একটু কী ভাবিলেন। তারপর বলিলেন, শচীনকে আপনি কতটা চেনেন জানি না। তবে বলি ওর চিন্তা ভাবনাগুলো আমাদের মতো নয়। খুব আধুনিক ধ্যানধারণার ছেলে। দৃষ্টিটাও স্বচ্ছ। আপনার সঙ্গে যে রঙ্গময়ীর বিয়ে হওয়াটাও দরকার তা ওই আমাদের বুঝিয়ে দেয়।
আপনার ছেলেটি রত্নবিশেষ। আপনাদেরই আশীর্বাদ।
“সেদিন রাজেনবাবুর উক্তি বড় স্বাদু লাগিয়াছিল। রাজেনবাবু আমাদের ত্যাগ করেন নাই। তিনি সমর্থন জানাইয়াছেন, মন্দার বাজারে সেইটুকুরই তো অনেক দাম।
“অনেক রাতে শয্যাগ্রহণ করিলাম। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ ঠাসিয়াছে। মনু তখনও আসে নাই। একাই ঘুমাইয়া পড়িলাম। ঘুম ভাঙিল মাঝরাতে। আমার পাশে শুইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া মনু ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে। মনুকে ইদানীং কাঁদিতে দেখি নাই। তাহার কান্নার রকমটাই জানি না।
মনু, কাঁদছ কেন?
ওরা তোমাকে ওরকম করে কেন?
কারা কীরকম করে?
তোমার ছেলেমেয়েরা?
করুক। তুমিই তো বলেছ ওসব গ্রাহ্য না করতে।
বলেছি, কিন্তু তুমি তো আর সে কথা শুনছ না!
শুনছি তো। আর ভাবছি না।
তোমার শরীর ভাল নেই, জেনেও ওরা কেন যে–
তুমি কেঁদো না, মনু। তুমি কাঁদলে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।
সেই জন্যই তো লুকিয়ে কাঁদছিলাম।
লুকিয়েও কেঁদো না। স্বামী-স্ত্রীর দুজনের মধ্যে একজনকে অন্তত শক্ত হতেই হয়।
সব মানি। কিন্তু ওদের কথায় তোমারও সন্দেহ হচ্ছে আমাকে বিয়ে করে ভুল করেছ কি না!
সন্দেহ নয়, মনু। ভুল যে করিনি তার একটা অ্যাসুয়ারেন্স তোমার কাছ থেকে পেতে চাইছিলাম।
তোমার সন্দেহ হলে আমারও যে পায়ের তলায় মাটি থাকে না।
কাশী কবে যাচ্ছি আমরা?
কবে যেতে চাও?
দ্বিরাগমনের পর চলো।
তাই হবে।
শচীনকে সব বুঝিয়ে দিতে কদিন সময় লাগবে।
“আর দুজনের ঘুম হইল না। সারা রাত্রি আমরাও নানা কথা কহিয়া একরকম বাসর জাগিলাম।
“বউভাতের জন্য কেহ অপেক্ষা করিল না। বিবাহের পরদিনই আত্মীয়রা বিদায় লইল। কুটুষেরা কিছু রহিল। কিছু গেল। তবে বাড়ি অনেক ফাঁকা হইয়া গেল।
“দ্বিরাগমনের পর একদিন শচীনকে ডাকাইয়া উইল পাকা করিলাম। স্থাবর-অস্থাবর সমুদয় সম্পত্তিই পাইবে কৃষ্ণকান্ত। আপাতত শচীন কেয়ারটেকার থাকিবে। যদি কৃষ্ণকান্ত দখল না লয়
তবে জ্যেষ্ঠ দুই পুত্রের উপর সকল সম্পত্তি বৰ্তাইবে।
“আর এই জায়গা ভাল লাগিতেছিল না। সব বন্ধন যেন ছিন্ন হইয়াছে। একদিন শুভ লগ্ন দেখিয়া আমি ও মনু কাশী রওনা হইলাম।
“ইহাই বনগমন কি না জানি না। বন মানে তো বৃহৎ। পৌরাণিক আমলে বৃদ্ধবয়সে বৃহৎ সংসারের অর্থাৎ দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করা বিধি ছিল। জঙ্গলে যাওয়ার বিধান বলিয়া অনেকে ভুল করেন। যাহা হউক, আমার এই কাশী গমনটি জঙ্গল বা বৃহৎ কোনওটাতেই গমন নয়, ইহা কেবল পলায়ন।
“আজ কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গার ধারে আমাদের নাতিবৃহৎ বাড়ির দ্বিতলে জানালার পাশে বসিয়া এই ডায়েরি লিখিতে লিখিতে মনে হইতেছে, জীবনটা বড়ই করুণ-মধুর।
“পৃথিবীতে আমার কোনও কীর্তি নাই, বৃহৎ ত্যাগ নাই, যশ নাই। আমি একরূপ আত্মগোপনকারী পলায়নবাদী কাপুরুষ মানুষ। কিন্তু মানুষ তো এক প্রজন্মের নহে। সে যেমনই হোক তাহার উত্তরাধিকারী, বংশপরম্পরার ভিতর দিয়া তাহার রেশ চলিতে থাকে। পুত্রের ভিতর দিয়া পিতাই তো জন্ম লাভ করে। আজ মনে হইতেছে আমি যদি কৃষ্ণকান্তর ভিতরে একটুখানিও জন্ম লইয়া থাকি তবেই জীবন সার্থক হইবে।
“খবরের কাগজে আকস্মিকভাবে একদিন কৃষ্ণকান্তর নাম দেখিতে পাইলাম। স্বদেশি নেতা কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী বিচারে দোষী সাব্যস্ত হইলেও তাহার তরুণ বয়সের কথা বিবেচনা করিয়া মাত্র পাঁচ বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হইয়াছে।
১০৪. গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে
গুজবটা কী করে ছড়াল কে জানে। কিন্তু খবরের কাগজে একদিন বেশ ফলাও করে ছাপা হল, কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব পাচ্ছেন। হাই কম্যান্ডের সঙ্গে তার আঁতাত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তিনি শীঘ্র দিল্লি যাচ্ছেন।