বউমাদেরও কি তাই মত?
জানি না। আপনি তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে আমি আজই শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়ে যাচ্ছি। সেখানেও এসব কেলেঙ্কারির কথা পৌঁছবে। কী করে যে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে মুখ দেখাব তা জানি না।
বিশাখার মুখের দিকে চেয়েও আজকের দিনটা থাকতে পারবে না?
কারও মুখের দিকে চাইতেই আর প্রবৃত্তি নেই। এ বাড়িতে পা দেওয়াই পাপ। বংশের মুখে এমন চুনকালি পড়বে তা জানতাম না।
“আজ আমি আর সেই হেমকান্ত নাই যে অল্প আঘাতেই আহত হইবে! নানা দাগা খাইয়া পরিণত বয়সে আজ আমি একটু শক্তপোক্ত হইয়াছি। কিন্তু আমার বুকের ব্যথাটা চাগাড় দিতেছে। রক্তচাপ বাড়িতেছে। চেয়ারের হাতলটা শক্ত করিয়া ধরিয়া কহিলাম, যদি যেতে হয় তবে যাবে। আমি আটকাব না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের অসহযোগিতাটা কেন? এখন জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছি।
“সবিতা বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গেল। আমি একাকী বসিয়া আকাশপাতাল ভাবিতে লাগিলাম। শরীরটা বড় দুর্বল লাগিতেছে। মাথাটা ঘুরাইতেছে। চোখে অন্ধকার দেখিতেছি। বারান্দায় কাহার পদশব্দ পাইলাম। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকিলাম, ওরে, কে আছিস? মনুকে একটু খবর দে।
“খবর দিতে হইল না। মনু নিজেই সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পরনে চওড়া লালপেড়ে গরদ। মুখোনি উপবাসে ক্ষীণ, তবু জ্যোতির্ময়ী। হাতখানা বাড়াইয়া দিয়া কহিলাম, আমার শরীর আবার খারাপ লাগছে।
“মনু আসিয়া আমাকে ধরিল। তারপর আর কিছু মনে নাই।
“মরিবার আর-একটি মাহেন্দ্রক্ষণ নিকটে আসিল। কিন্তু মরিলাম কই? মানুষ কখন মরিবে তাহার কোনও স্থিরতা নাই। কিন্তু আমার মনে হইতেছে ঠিক সময়ে মরিতে পারাটাও এক মস্ত বড় সাধনার বস্তু। আমরা মরিতে জানি না।
“যখন জ্ঞান ফিরিল তখন আমার চারিদিকে ভিড়। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বসিয়া আছে। বুক কাঁপাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া গেল।
“কে প্রশ্ন করিল, কেমন আছেন?
“কহিলাম, ভাল। বেশ ভাল। প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে।
“ডাক্তার কহিল, প্রায়শ্চিত্ত আপনার একার কেন? আমাদেরও। এবার বলুন তো কী হয়েছিল? কিছু না। বসে ছিলাম। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।
হলে ভাল। মনে রাখবেন, আপনার শরীরে দু-দুটো ফেটাল অসুখ। ব্লাডপ্রেশার আর হার্ট ট্রাবল। কোনওরকম রিস্ক নিলে কিন্তু বিপদে পড়বেন।
আমার তো এসব রোগ কোনওদিন ছিল না, ডাক্তার।
শরীরং ব্যাধিমন্দিরম্। শরীর থাকলে রোগ ভোগ আছেই। একটু সাবধানে থাকবেন।
“বিছানার চারদিকে জমায়েত লোকজনের মধ্যে হঠাৎ সবিতাকেও দেখিতে পাইলাম। সে এখনও যায় নাই। সর্পিল কঠিন এক চোখে আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমার মৃত্যু কামনা করিতেছে কি? আহা, তাহার বাসনা কেন যে ঈশ্বর পূরণ করিলেন না!
“ডাক্তার বলিল, আপনার এখন ফুল রেস্ট দরকার। বিশাখার বিয়ে না হলে আমি ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যেতাম। তা অবশ্য করছি না। কিন্তু এখন ঘণ্টা কয়েক আপনি একদম নড়াচড়া করবেন না। বিয়ের সময়ে আপনাকে ধরাধরি করে আসরে নিয়ে যাওয়া হবে। খবরদার সিঁড়ি ভাঙবেন না কিন্তু। শরীর খারাপ বোধ করলেই শুয়ে পড়বেন এসে।
ঠিক আছে, তাই হবে।
“ডাক্তার চলিয়া যাইবার আগে সকলকে সাবধান করিয়া গেলেন, কোনও কারণেই যেন আমাকে বিরক্ত করা না হয়। এই সাবধানবাণী শুনিয়া ধীরে ধীরে সকলে বাহির হইয়া গেল। রহিল শুধু মনু। সে যথারীতি আমার মাথায় হাত বুলাইতেছিল।
“আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া মটকা মারিয়া পড়িয়া রহিলাম। বুকে ক্ষীণ হইলেও ব্যথাটা আছেই। রক্তের চাপও যে বেশি তাহাও অনুভব করিতেছি। চোখ বুজিয়াই ডাকিলাম, মনু।
বলো।
আমরা কবে কাশী যাব?
যেদিন তুমি যেতে চাও।
আমি তো আজই যেতে চাই।
আজ তো আর হয় না। বউভাত মিটে যাক, তার পরেই।
আজ যে হয় না তা জানি। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
এখন একটু চুপ করে শুয়ে থাকে। কথা পরে হবে।
না, জরুরি কথা।
বলো।
আমরা বিয়েটা না করলে কী হত?
কেন গো? কেউ কিছু বলেছে?
তোমাকেও তো বলে।
আমাকে বলে বলুক। তোমাকে বলেছে কি না বলো।
বলেছে।
কে? সবিতা নাকি?
তুমি কী করে জানলে?
কালীবাড়ি থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলাম সবিতা ঝড়ের বেগে নেমে যাচ্ছে। এসে দেখি তোমার এই অবস্থা।
“চুপ করিয়া থাকিয়া কিছুক্ষণ পরে বলিলাম, ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদের, মনু।
দোষ! দোষ হবে কেন? ওসব কথা ভেবো না। যত ভাববে ওর থই পাবে না। ঘুমোও। মাথাটাকে একটু ক্ষান্তি দাও।
আজকের দিনটায় ওরা যদি কেউ বিয়ের উৎসবে যোগ না দেয় তাহলে কেমন দেখাবে, মনু? লোকে ভাববেই বা কী?
আবার কথা বলছ! ডাক্তারবাবু কী বলে গেলেন মনে নেই?
ডাক্তার কি আর ঘরের কথা জানে? ওরা চোখ বুজে নিদান দেয়, বিশ্রাম করুন, ঘুমোন, ভাববেন।
কী বলব বলো? তোমাকে সান্ত্বনা দিতে পারি এমন কথা আমার জানা নেই। তবে আমার একবারও মনে হয়নি যে বিয়ে করে আমরা ভুল করেছি।
ভুল যে করিনি তা বুঝিয়ে দিতে পারো?
পারি। তবে কথা দিয়ে নয়। কথায় কি সব হয় গো? তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, যতদিন বাঁচব ততদিন ধরে তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করব যে, বিয়ে করে আমরা একটুও ভুল করিনি।
“আজ কাশীতে বসিয়া অনেক বিলম্বে সেদিনের কথা লিখিতেছি। লিখিতে লিখিতে মনটা স্নিগ্ধ হইতেছে। আজ আমারও মনে হয়, কিছুমাত্র ভুল করি নাই। মনুকে বিবাহ করিয়া আমি ঠিকই করিয়াছি। বঙ্কিমবাবুর সেই লাইনটি মনে পড়িতেছে, আমরা একই বৃন্তের দুটি ফুল। চন্দ্রশেখর একটু ফুল ছিড়িয়াছিলেন। আমার ক্ষেত্রে পুস্পটি বড় বিলম্বে ফুটিয়াছে।